অনুবাদ গল্প:: উত্তরাধিকার - মন্টেগু রোডস জেমস :: অনুবাদঃ ঋজু গাঙ্গুলী


উত্তরাধিকার
ঋজু গাঙ্গুলী

[মূল কাহিনি: মিস্টার হামফ্রেজ অ্যান্ড হিজ ইনহেরিটেন্সলেখক: মন্টেগু রোডস জেমসপ্রথম প্রকাশ: ‘মোর গোস্ট স্টোরিজ অফ অ্যান অ্যান্টিকোয়্যারি (১৯১১বইয়ে]

মিস্টার হামফ্রেজ?”
ট্রেন থেকে নামার পর এদিক-ওদিকে তাকিয়ে চেনামুখ খুঁজছিলেন তরুণটি নিজের নাম শুনে তিনি ঘুরে তাকালেন স্টেশনমাস্টার সহাস্যে তাঁর দিকে এগিয়ে এসে বললেন, “উইলস্থর্পে আপনাকে স্বাগত জানাই মিস্টার কুপার বলেছিলেন, আপনি এই ট্রেনে আসছেন ওই যে, উনিও এসে গেছেন
কুপার হন্তদন্ত হয়ে এসে হামফ্রেজকে আপ্যায়ন করলেন তারপর বললেন, “হল থেকে একটা ঘোড়ার গাড়িও এসেছে ওতে আপনার মালপত্রগুলো পাঠিয়ে দিই লাঞ্চটা বরং আমার বাড়িতেই সেরে নিন তারপর আপনাকে হল-এ নিয়ে যাব

আপনি আগে এদিকে কখনও এসেছেন?” লাঞ্চের ফাঁকে মিসেস কুপার হামফ্রেজকে জিজ্ঞেস করলেন
আজ্ঞে না,হামফ্রেজ অকপটে স্বীকার করলেন, “তবে ট্রেনে আসতে-আসতে যা বুঝলাম, জায়গাটা ভারি সুন্দর
সুন্দর তো বটেই,মিসেস কুপার কিঞ্চিৎ দুঃখিতভাবে বললেন, “তবে কী জানেন, এখানে আসতে আপনার একটু দেরি হয়ে গেল গ্রীষ্মকালে এখানে বিভিন্ন বাড়ির বাগানে খুব সুন্দর পার্টি হয় সেগুলো আপনি দেখতে পেলেন না
আগে এলেও বোধহয় পার্টিগুলো উপভোগ করতে পারতাম না,হামফ্রেজ কাষ্ঠহাসি হাসলেন, “আমার কাকা, মানে যাঁর সৌজন্যে আমি এখানে এসেছি, তিনি তখন নিশ্চয় অসুস্থ ছিলেন সেই অবস্থায়…!”
ইশশ!” লজ্জায় লাল হয়ে গেলেন মিসেস কুপার, “আমি কিছু না ভেবেই কথাটা বলে ফেলেছিলাম মাফ চাইছি আসলে মিস্টার উইলসনের অসুস্থতার কথাটা মাথায় ছিল না
ওই নিয়ে ভাববেন না, মিসেস কুপার,হামফ্রেজ বললেন, “কাকা আমার জন্য এই বাড়ি আর সম্পত্তি রেখে গেছেন এটা ঠিক কিন্তু এও ঠিক যে আমি তাঁকে চিনতাম না চেনাজানা তো দূরের কথা, জীবনে একবারও তাঁকে দেখিনি আমি মিস্টার কুপার জানেন ব্যাপারটা কোর্টের বেইলিফ হিসেবে উনিই তো আমাকে একরকম খুঁজে বের করেছিলেন এই সম্পত্তি বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য সত্যি বলতে কী, মানুষ হিসেবে কাকা কেমন ছিলেন সেটা বরং আপনাদের কাছ থেকেই আমি জানতে চাইব
মিস্টার উইলসন, মানে আপনার কাকা একজন ভালো মানুষ ছিলেন,কুপার স্পষ্ট গলায় বললেন, “তাঁর এস্টেটে যারা থাকত, তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে তাঁর ব্যবহার ছিল ভদ্র এবং যুক্তিযুক্ত গোঁড়ামি বা আভিজাত্যের বশে ধরাকে সরা জ্ঞান করার বদভ্যাস তাঁর একেবারেই ছিল না
আচ্ছা,” হামফ্রেজ সামনে ঝুঁকে বললেন, “ওঁর ঠিক কী হয়েছিল? মানে কীসের থেকে উনি শেষ অবধি…?”
আলাদাভাবে ওঁর কোনও অসুখ-বিসুখই হয়নি উনি নিজের মতো থাকতেন একা, চুপচাপ ওষুধপত্র একটু বেশিই খেতেন দেখতাম বয়স হয়েছিল তারপর একদিনদীপ নিভে গেল আর কী
টুকিটাকি কথার মধ্য দিয়ে খাওয়া শেষ হল মিস কুপার মনে করিয়ে দিলেন, “তুমি সবকটা চাবি মনে করে নিও, বাবা বাগানের চাবিটাও নিও
আপনি বুঝি বাগান করেন?” হামফ্রেজ জানতে চাইলেন
তেমন কিছু না,ঠোঁট ওলটালেন মিস কুপার, “তবে মিস্টার উইলসনের বাগান নিয়ে আমাদের সবার কৌতূহল ছিল ওর মধ্যে একটা গোলকধাঁধা আছে তো আমাদের অনেকেরই খুব ইচ্ছে হত জায়গাটায় যাই, একটু হইহুল্লোড় করি লেডি ওয়ারড্রপ নিজে বাগান করেন বলে অনেকবার জায়গাটা দেখতে চেয়েছিলেন কিন্তু মিস্টার উইলসন বাগান আর ওই গোলকধাঁধা দুটোতেই ঢোকার গেট তালাবন্ধ করে রাখতেন কাউকে ওখানে যেতে দিতেন না উনি
তাই নাকি?” বাগানের কথা শুনে হামফ্রেজ একটু চনমনে হয়ে উঠলেন, “বাগান নিয়ে আমার একটু আগ্রহ আছে একবার সব বুঝে নিই তারপর ওখানে আপনাদের সাদর আমন্ত্রণ জানাব
বাগানের চাবিটা বোধহয় লাইব্রেরিতেই আছে,বিশাল একটা চাবির গোছা হাতড়ানোর ফাঁকে বললেন কুপার, “চলুন, মিস্টার হামফ্রেজ আপনার নতুন বাসস্থানটির সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দিই

কুপারদের বাড়ি থেকে উইলস্থর্প হল, অর্থাৎ উত্তরাধিকার হিসেবে হামফ্রেজের পাওয়া বিশাল বাড়িটা খুব বেশি দূরে নয় তবু সেটা পেরোতে অনেকটা সময় লেগে গেল বহু স্থানীয় মানুষ হামফ্রেজকে দেখার জন্য রাস্তার দুধারে ভিড় করেছিলেন যথোচিত গাম্ভীর্যের সঙ্গে তাঁদের সবাইকে অভিবাদন জানিয়ে এবং তাঁদের কথার টুকিটাকি উত্তর দিয়েই এগোলেন হামফ্রেজ
উইলস্থর্প হলের অধিকাংশ কর্মচারীর জন্য টাকাপয়সার ব্যবস্থা করেই গেছিলেন মিস্টার উইলসন, লাল ইট দিয়ে বানানো বিশাল বাড়িটার গেটের কাছাকাছি পৌঁছে বললেন কুপার, “তাই কাজ চলে গেলেও তাদের অসুবিধে হয়নি কয়েকজনকে অবশ্য কাজে বহাল রাখার স্পষ্ট নির্দেশ ছিল ওঁর উইলে ক্যাল্টন দম্পতির সঙ্গে আপনার আলাপ হবে ক্যাল্টন এই হলের বাটলার তার স্ত্রী রান্না, ঘরদোর সাফসুতরো রাখা এগুলো দেখেন দুজনেই ভদ্র, দক্ষ, পরিশ্রমী বাগানের পরিচর্যা করার জন্য ক্লাটারহ্যামও থাকবে সব মিলিয়ে জায়গাটা আপনার খারাপ লাগবে না
বিশাল বাড়িটার গড়ন একটু অদ্ভুত দুটো তলা থাকলেও বাড়িটা খুব উঁচু চওড়া বেসমেন্ট আর একগাদা সিঁড়ি পেরিয়ে তবে বাড়িতে ঢুকতে হয় পেছনের ফাঁকা আস্তাবল আর ধোপাখানা দেখার ইচ্ছে ছিল না হামফ্রেজের বাড়িতে ঢুকে মান্ধাতার আমলের আসবাব দেখে হামফ্রেজ একটু ঝিমিয়ে পড়ল দেয়ালে একটা ছবি থেকে মিস্টার উইলসন, অর্থাৎ হামফ্রেজের কাকা ক্লিষ্ট আর শুকনো মুখে ওর দিকে তাকিয়েছিলেন হামফ্রেজের মনে হল, ভদ্রলোকের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকলেও তাঁর সঙ্গে আগে আলাপ না হয়ে ভালোই হয়েছে তবে ক্যাল্টনদের সঙ্গে কথা বলে ওর বেশ ভালো লাগল লাইব্রেরির বইগুলো ভীষণ পুরোনো হলেও আলো-হাওয়ায় ভরা জায়গাটা দেখে হামফ্রেজের মন-মেজাজ ভালো হয়ে গেল তারপর কুপার ওকে বাগানে নিয়ে গেলেন
বাগানটা তো বিশাল!” বললেন হামফ্রেজ, “নতুন আইডিয়াগুলো কাজে লাগানো গেলে এই জায়গাটা সত্যিই দারুণ হয়ে যাবে আচ্ছা, ওই বাড়িটা কী?”
ওটা একটা মন্দির,কুপার বললেন, “মিস্টার উইলসন ইটালি থেকে মার্বেল আনিয়ে ওইবন্ধুত্বের মন্দির’-টিকে বানিয়েছিলেন চলুন, কাছ থেকেই দেখবেন

কাছ থেকে দেখে হামফ্রেজ বুঝতে পারলেন, তিভোলি-টেম্পল অফ সিবিল’-এর ছোটো সংস্করণ হিসেবে তৈরি করা হয়েছে এই মন্দিরটাকে গম্বুজের নিচে দেয়ালে প্রাচীন ভাস্কর্যের অনুকরণে কিছু দৃশ্য খোদাই করা ছিল কুপার চাবি বের করে কষ্টেসৃষ্টে দরজাটা খুললেন ভেতরে কোনও স্থাপত্য ছিল না তবে মেঝেতে বেশ কিছু চৌকো করে কাটা পাথর রাখা ছিল ঈষৎ উত্তল পাথরগুলোর গায়ে একটা করে অক্ষর গভীর করে খোদাই করা ছিল
এগুলো কী?” হামফ্রেজ জানতে চাইলেন
শুনেছি এগুলো নাকি আগে গোলকধাঁধার মধ্যে ছিল,কুপার বললেন, “ওখান থেকে এগুলো বের করে এখানে নিয়ে এসেছিলেন মিস্টার উইলসন
গোলকধাঁধা!” হামফ্রেজ সচকিত হলেন, “ওটা দেখা যাবে এখন?”
কেন যাবে না?” মন্দিরের দরজায় গিয়ে পশ্চিম দিকে হাতের লাঠিটা তুলে কুপার বললেন, “ওই বাঁকানো গেটটা দেখছেন? ওটার পেছনেই আছে গোলকধাঁধা আপনি ওই গেটের কাছে গিয়ে অপেক্ষা করুন আমি লাইব্রেরি থেকে চাবিটা নিয়ে আসি

ঘাসে ভরা পথটা ধরে গেটের কাছে গিয়ে হামফ্রেজ বেশ অবাক হয়ে গেলেন পুরো গোলকধাঁধাটাই একটা উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা তাতে একটা মজবুত গেটে ভারি তালা ঝুলছে বাগানের একটা অংশকে এইভাবে অগম্য করে রাখার কী কারণ থাকতে পারে সেটা হামফ্রেজ বুঝতে পারলেন না তবে বাঁকানো গেটের ওপরের লেখাটা তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করল:
Secretum meum mihi et filiis domus meae
আমার গোপন কথাটি রবে শুধু আমার ও আমার সন্ততিদের জন্যবিড়বিড় করে অনুবাদ করলেন হামফ্রেজ কথাটা কোত্থেকে নেওয়া হয়েছে? নানা ভাবনায় বেশ কিছুটা সময় কাটল অধৈর্য হয়ে হামফ্রেজ একবার ভাবলেন, পাঁচিল টপকে ভেতরে ঢুকবেন কিনা সদ্য বানানো স্যুটের কথা ভেবে সেই পরিকল্পনা স্থগিত রাখতে হল রেগেমেগে গেটের তালায় একটা লাথিই মেরে বসলেন হামফ্রেজ
গেট খুলে গেল!
ঝোপঝাড় আর কাঁটাগাছ ঠেলে সরিয়ে গোলকধাঁধায় ঢুকলেন হামফ্রেজ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে উনি বুঝতে পারলেন, এলাকাটা বৃত্তাকার কিন্তু বিভাজক হিসেবে বানানো ঝোপগুলো বহু-বহু বছর কাটছাঁট না হওয়ার ফলে জায়গাটা একটা জঙ্গলের চেহারা নিয়েছে মাঝের ফাঁকা অংশগুলোও ঝোপঝাড় আর কাঁটাগাছে একেবারে ভর্তি হয়ে গেছিল তাদের ঠেলে এগোতে গিয়ে হামফ্রিজের মনে হল, এটা গোলকধাঁধা না জঙ্গল! জংলি গন্ধ, পরাগরেণু আর বাষ্পে ভরা বাতাস ব্যাপারটাকে আরও অস্বস্তিকর করে তুলেছিল তবে হ্যাঁ, জায়গাটা মারাত্মক জটিল কিছু বোধহয় নয় কারণ ঝোপঝাড় ছাড়া তাঁর তেমন কোনও অসুবিধে হচ্ছিল না
কুপার এলেন নাকি? পেছনে একটা নড়াচড়ার শব্দ পেয়ে ঘুরেও কাউকে দেখতে পেলেন না হামফ্রেজ তার কিছুক্ষণের মধ্যেই গোলকধাঁধার কেন্দ্রে পৌঁছে গেলেন তিনি
কেন্দ্রে থাকা স্থাপত্যটা প্রথম দেখায় সূর্যঘড়ি বলে মনে হলেও হামফ্রেজ নিজের ভুল বুঝতে পারলেন ফিট চারেক উঁচু একটা স্তম্ভের ওপর দাঁড় করানো ছিল একটা তামার তৈরি গোলক আগাছা আর ময়লার পুরু আস্তরণ ঘষে-ঘষে যতটা সম্ভব সরিয়ে দিলেন তিনি কিন্তু পিলার আর গোলকের গায়ে লেখা-আঁকা জিনিসগুলোর মর্মোদ্ধার তখন করা গেল না তার ওপর গাছপালার ছায়ায় জায়গাটা এমনিতেই অন্ধকার হয়ে ছিল
আপনাকে শুধু-শুধু দেরি করালাম!” লাঠি আর পায়ের ক্ষিপ্ত প্রয়োগে ঝোপঝাড় ভেঙে এগিয়ে আসছিলেন কুপার কাছে এসে ঈষৎ হাঁফধরা গলায় ভদ্রলোক বললেন, “বিস্তর খুঁজেও গেটে লাগানো তালার চাবিটা পাইনি তবে আপনি তো দেখছি জায়গামতো পৌঁছেই গেছেন এখানে বোধহয় গত ত্রিশ কি চল্লিশ বছরে কেউ পা দেয়নি!”
আপাতত এখানে দাঁড়িয়ে ঠান্ডা লাগানোর মানে হয় না,হামফ্রেজ বললেন, “হলে ফিরে চা-টা খাওয়া যাক বরং
কুপার একমত হলেন আবার সেই কাঁটাগাছ আর ঝোপ ঠেলে বেরিয়ে গেটটা টেনে দিলেন হামফ্রেজ হলের দিকে যেতে-যেতে তিনি জানতে চাইলেন, “জায়গাটাকে এইরকম তালাবন্ধ করে কেন রাখা হয়েছিল, বলতে পারবেন?”
জানি না,গম্ভীরভাবে বললেন কুপার, “মিস্টার উইলসন খুব ভদ্র, কিন্তু কঠোর ভাষায় লিখে গেছিলেন, কাউকে যেন এখানে ঢুকতে না দেওয়া হয় লেডি ওয়ারড্রপ বেশ প্রভাবশালী মানুষ কিন্তু ওখানে ঢুকতে চেয়ে লেখা তাঁর চিঠির উত্তরেও মিস্টার উইলসন লিখে দিয়েছিলেন, গোলকধাঁধা আর ঢোকার মতো অবস্থায় নেই আমার মনে হয়…”
কী?”
আপনি জানেন এই গোলকধাঁধা কে বানিয়েছিল?” কুপারের প্রশ্নের উত্তরে হামফ্রেজ মাথা নেড়েনাবোঝালেন কুপার বললেন, “এটা বানিয়েছিলেন ওঁর ঠাকুরদা সেই ভদ্রলোক নানা দেশে ভ্রমণ করেছিলেন আমাদের চার্চে ওঁর দেওয়া একটা মার্বেল ট্যাবলেট তো স্থাপত্য হিসেবে রীতিমতো দ্রষ্টব্য আমার মনে হয়, তাঁর সম্বন্ধে মিস্টার উইলসনের ধারণা খুব একটা ভালো ছিল না সেজন্যই বোধহয় উনি এই গোলকধাঁধায় আসতেন না, কাউকে আসতেও দিতেন না
তাই নাকি?” হামফ্রেজ কৌতূহলী হলেন, “সেই ভদ্রলোক নিজের স্মৃতির উদ্দেশে কিছু বানিয়ে যাননি? মানে সেইসময়ের অভিজাত লোকজন তো ওইসব বানাতেন বলেই জানি
ভালো প্রশ্ন করেছেন,কুপার চিন্তিত মুখে বললেন, “কিন্তু আমি এমন কিছু দেখিনি ওঁর দেহ খুব সম্ভবত পারিবারিক ভল্টেই আছে, তবে সে-বিষয়েও আমি একেবারে নিশ্চিত নই

লাইব্রেরিতে বসে চা খেতে-খেতে নানা কথায় অনেকটা সময় কাটল তারপর কুপার লাফিয়ে উঠে বললেন, “এই রে! আমাকে আবার বউ আর মেয়েকে নিয়ে ব্রেসনেটদের ওখানে যেতে হবে চলি তাহলে?”
অবশ্যই,উঠে দাঁড়িয়ে হামফ্রেজ বললেন, “কাল আপনার স্ত্রী আর মেয়েকে ওই গোলকধাঁধা দেখাতে আনবেন নাকি? কিন্তু তার আগে জায়গাটাকে একটু ভদ্রস্থ করতে হবে কী করা যায়?”
ক্লাটারহ্যাম দেশে গেছে তবে আমি তার সাঙ্গোপাঙ্গদের কয়েকজনকে বলে দেব তারা দা, কোদাল, কাস্তে সব নিয়ে চলে আসবে কাল ভোরেই
সঙ্গে দড়ি আর লাঠিও রাখতে বলবেন গোলকধাঁধা বলে কথা! জিনিসটাকে সেভাবেই সাজাতে-গোছাতে হবে
ভালো বলেছেন কাল বিকেলে তাহলে আমরা সদলবলে আসছি গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খেতে শুভরাত্রি

রাত আটটার মধ্যে খাওয়া সেরে নিলেন হামফ্রেজ সঙ্গে আনা একটা রোমহর্ষক উপন্যাস পড়ার ইচ্ছে ছিল তাঁর কিন্তু ক্যাল্টন তাঁকে হল এবং গ্রামের ব্যাপারে নানা কথা বলছিল, বলেই চলছিল, বলেই চলছিল…! গত পঞ্চাশ বছরের এই তল্লাটের ইতিহাস শুনতে-শুনতে হামফ্রেজ একেবারে ঝিমিয়ে পড়লেন এদিকে ঘুমও আসছিল না বিরক্ত হয়ে হামফ্রেজ ঠিক করলেন, লাইব্রেরিতে ঠিক কী-কী বই আছে সেটা দেখা যাক কুপার বলেছিলেন যে প্রোবেটের জন্য নমো-নমো করে একটা তালিকা বানানো হলেও সেটা একেবারেই অসম্পূর্ণ মোমবাতি হাতে সেই রাতেই কাজে লেগে পড়লেন হামফ্রেজ
কিছুক্ষণ ওখানে কাটিয়েই হামফ্রেজ হাড়ে-হাড়ে বুঝে গেলেন, পড়ার মতো জিনিস চাইলে তাঁকে বাইরে থেকেই বইপত্র আনাতে হবে লাইব্রেরিতে গ্রিক, ল্যাটিন, হিব্রু নানা টেক্সট আর তার প্রাচীন অনুবাদের ছড়াছড়ি থাকলেও সে-সব জিনিস শুধু দুষ্পাঠ্য নয়, একেবারেই অপাঠ্য ওই বইগুলোর মধ্যেই একটা ছোটোখাটো সাইজের বাঁধানো বই পেলেন তিনি, যার প্রথম পৃষ্ঠাটাই ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে! ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত লাগল বলে হামফ্রেজ বইটা নিয়ে বসলেন
ভাষা থেকে বইটাকে সপ্তদশ শতকের বলেই মনে হয়েছিল তাঁর কালো মলাটের বইটার ভেতর একগাদা বিচিত্র উপদেশ আর উপাসনা-পদ্ধতি ছাড়া কিছু ছিল না আনমনে পাতা ওলটাতে-ওলটাতে হঠাৎ একটা পাতায় একধারে একটা হাতে-লেখা নোট দেখে পড়তে শুরু করলেন হামফ্রেজ
অসুখী সময়ের উপাখ্যাননামের নোটটায় একেবারে সেকেলে ভঙ্গিতে লেখা ছিল নিচের কথাগুলো ~

নিম্নবর্ণিত কাহিনিটি রূপকধর্মী না কঠোর সত্য ইহা নির্ণয়ের ভার আমি পাঠকেরপরেই সঁপিলাম তাঁহারা ইহার সঠিক অর্থ অনুধাবন করিবেন, এই আশাতেই উহা লিপিবদ্ধ করিতেছি
গ্রিসদেশের জটিল গোলকধাঁধা এবং উহার অভ্যন্তরে ভূপতিত নানা অমূল্য রত্নের কাহিনি বিষয়ে সকলেই অবগত আছেন যদি তেমন একটি গোলকধাঁধা আপনার বাসস্থানের সন্নিকটেই অবস্থিত হয়, তাহা হইলে আপনি কী করিবেন?
একদা এক যুবকের দুর্মতি হইল, সে উক্ত গোলকধাঁধায় প্রবেশ করিয়া তথা হইতে মণিরত্নাদি আহরণ করিবে আত্মীয় ও বন্ধুবর্গ তাহাকে বারংবার নিষেধ করিল, কারণ সকলেই জানিত যে ওই গোলকধাঁধার অভ্যন্তরে বিচিত্র নানা মুখ ও ছায়া লক্ষিত হয় তাহাদের সান্নিধ্য যে মঙ্গলময় এইরূপ ভাবনা কাহারও মস্তকে আসে নাই লোভ অতি বিষম রিপু তাহার প্রভাবে, সকলের নিষেধ অগ্রাহ্য করিয়া যুবক একাকী সেই স্থলে গমন করিল
দিবস গত হইল মসীকৃষ্ণ রাত্রি চরাচর আচ্ছাদিত করিল তথাপি সেই যুবক ফিরিয়া আসিল না রাত্রি গভীর হইলে গ্রামবাসী শুনিল, অসহায়ভাবে কে যেন আর্তনাদ করিতেছে কে এমন করিয়া ডাকে? কোথা হইতে আসিতেছে এই চিৎকার? কেহই তা বুঝিতে পারিল না অবশেষে নিশার অবসান হইলে গ্রামবাসী ভাবিল, যুবক আর জীবিত নাই তাহার অন্তিম সংস্কার সাধনের নিমিত্ত সকলে বিষণ্ণচিত্তে গির্জা-অভিমুখে গমন করিল
গোলকধাঁধা নিকটবর্তী হইলে সকলে সভয়ে ওই স্থান অতিক্রম করিতে সচেষ্ট হইল সহসা একজন কহিল, ‘পথে ও কে পড়িয়া আছে?’ সকলে নিকটে গিয়া দেখিল, সেই যুবক পথিমধ্যে পড়িয়া আছে জীবিত, তবে জ্ঞানহীন!
সহর্ষে গ্রামবাসী যুবককে তুলিয়া আনিল নানা জনের প্রচেষ্টায় যুবক চেতনা ফিরিয়া পাইল সকলে দেখিল, গোলকধাঁধার কেন্দ্রে সে সত্যই এক দুর্মূল্য রত্ন পাইয়াছে কিন্তু যুবক কহিল, ‘এমন রত্ন তো দূরস্থান, রাজকোষের সমুদয় অর্থ পাইবার সম্ভাবনা থাকিলেও আমি ওই স্থলে পুনঃপ্রবেশ করিব না
কেন সে এই কার্য দ্বিতীয়বার করিবে না এই প্রশ্নের উত্তর সে দিল না পরে, বহু আয়াসে, ক্রমে-ক্রমে সে ওই গোলকধাঁধায় নিজ অভিজ্ঞতার বিবরণ দিল
দিবাভাগে সূর্যকরোজ্জ্বল গোলকধাঁধা দেখিয়া কোনোরূপ দুশ্চিন্তা হয় নাই,যুবক কহিয়াছিল, ‘দিনমণি অস্তাচলে যাইবার পূর্বেই আমি কেন্দ্রস্থলে পৌঁছাই ও রত্নটি হস্তগত করি কিন্তু ফিরিয়া আসিবার সময় সমস্যা হয়
কী সমস্যা?’ শুধাইল সকলে সমস্বরে
বহু সাধ্যসাধনার পর যুবক কহিল, ‘কেহ আমাকে অনুসরণ করিতেছিল আমি তাহার পদশব্দ পাইতেছিলাম এও বুঝিতেছিলাম যে আমার পথের সমান্তরালেই সে চলিতেছে আমি থামিলে সে থামিতেছে এবং লতাগুল্মাদির মধ্য দিয়া সে আমাকে অবলোকন করিতেছে কিন্তু আমি তাহাকে দেখিতে পাইতেছিলাম না ক্রমে অন্ধকার হইল আমি ওই স্থান হইতে বহিরাগমনের পথ খুঁজিয়া পাইলাম না উপরন্তু আমার মনে হইলযেন আমার অনুসরণকারীর সংখ্যা বাড়িতেছে!
‘বুঝিতে পারিলাম, তাহারা শুধু আমার পশ্চাদ্ধাবনই করিতেছে না স্থলে-স্থলে তাহারা শলাপরামর্শ করিতেছে তাহাদের সেই কদাকার হাস্য ও ঘৃণার্হ মৃদুস্বর আমার শোণিতপ্রবাহ স্তব্ধ করিয়া দিতে লাগিল তথাপি আমি স্তব্ধ হই নাই ওই স্থানে প্রবেশ ও প্রস্থানের মূল দ্বারটি কোনও অলৌকিক উপায়ে অদৃশ্য হইলেও আমি তাহার সন্ধান হইতে বিরত হই নাই
আমরা কাহারও আর্তকণ্ঠ শুনিয়াছিলাম,একজন কহিল, ‘সে কি তোমার?’
হ্যাঁ,সভয়ে কহিল যুবক, ‘তখন মধ্যরাত্রি ক্লান্তি, অবসাদ ও ভীতির ত্র্যহস্পর্শে আমি দুর্বল হইয়া পড়িয়াছিলাম অকস্মাৎ শুনিতে পাইলাম, কেহ আমার নাম ধরিয়া উচ্চৈঃস্বরে আহ্বান করিতেছে প্রতীত হইল, আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা আমার সন্ধানে সেই স্থলে আসিয়া আমাকে আহ্বান করিতেছেন আমি যথাসাধ্য উচ্চকণ্ঠে সাড়া দিলাম কিন্তু তাহার কোনও উত্তর আসিল না নৈঃশব্দ্য ঘনাইয়া আসিল আমার চারিপার্শ্বে তাহার পর…!’
কী?’
কাহারও দেহের ভারে লতাগুল্মাদি পিষ্ট হইবার শব্দ কর্ণগোচর হইল সেই শব্দশব্দরা ক্রমেই নিকটবর্তী হইল আরওআরও নিকটে আসিল উহারা! আমি প্রাণভয়ে ছুটিতে লাগিলাম নিশার সমাপন হইয়া সূর্যের দীপ্তি দৃষ্টিগোচর না হওয়া অবধি আমি উন্মত্তের মতো ছুটিয়াছিলাম ওই গোলকধাঁধার মধ্যে আমি জানিতাম, ওইসকল অনুসরণকারী আমাকে ধরিতে পারিলে মৃত্যু, বা তাহা হইতেও অপকৃষ্ট পরিণতি হইবে তাই আমি ছুটিয়া চলিলাম শ্বাসবায়ু ফুরাইয়া আসিলে আমি পথিপার্শ্বে মৃতবৎ পড়িয়া থাকিতাম শুনিতাম, বৃহৎ সারমেয়ের ন্যায় আমার অনুসরণকারীরা স্তব্ধ হইয়া আমার গন্ধের অন্বেষণ করিতেছে এবং আপনাদিগের মধ্যে সেই ঘৃণ্য অস্পষ্ট শব্দের মাধ্যমে আলাপ করিতেছে পুনরায় ছুটিবার মতো অবস্থাপ্রাপ্ত হইলে আমি দৌড়াইতাম তবে আমার কাছে সবিশেষ ভীতির উদ্রেক করিয়াছিল আরও একটি বস্তু
সেটি কী?’ শুধাইল একজন
পথের মধ্যে ও পার্শ্বে স্থানে-স্থানে গহ্বর সৃষ্টি হইয়াছিল!’ কহিল যুবক, ‘শপথ করিয়া বলিতে পারি, আলোকিত গোলকধাঁধায় ওইরূপ কোনও গহ্বর বা খানাখন্দ ছিল না কিন্তু আমি দেখিতেছিলাম, অন্ধকার ওই তৃণাচ্ছাদিত পথ এবং বৃক্ষাদির নিচে ভূমি হইতে মুখবাদ্যান করিয়া আছে নানা কূপ বা গর্ত উহারা যে সাক্ষাৎ মরণফাঁদ ইহা বুঝিতে পারিয়াছিলাম সেইসকল গর্ত এড়াইয়া, অনুসরণকারীদের পিছনে ফেলিয়া সমস্ত রাত্রি আমি কীরূপে অতিবাহিত করিয়াছিলাম, তাহা তোমাদিগের বোধগম্য হইবে না শুধু কহিব, আমি কোনোমতেই ওই গোলকধাঁধার অভ্যন্তরে তো দূর, নিকটে অবধি যাইতে ইচ্ছুক নহি
এই কাহিনি হইতে আপনি কী অনুধাবন করিলেন? ইহা কি সত্যই এক গোলকধাঁধার মধ্য হইতে রত্ন অন্বেষণের আখ্যান? নাকি এই গোলকধাঁধা প্রকৃতপক্ষে সসাগরা পৃথিবী ভূয়োদর্শনের মাধ্যমে যাহার রত্নাদি আহরণ করিতে চায় মনুষ্য, অথচ পায় কেবল সর্বনাশের সন্ধান!”

লেখাটা পড়ে হামফ্রেজ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন নিজেকেই প্রশ্ন করলেন তিনি, “কাকা কি তাহলে ওই গোলকধাঁধায় আটকা পড়ে গেছিলেন কখনও? সেই অভিজ্ঞতা আর রাগ থেকেই কি তিনি জায়গাটাকে তালাবন্ধ করে রেখেছিলেন?”
উত্তর পাওয়া গেল না হাই তুলে, মোমবাতি নিভিয়ে শোয়ার ঘরের দিকে এগোলেন হামফ্রেজ

রাতে হামফ্রেজের ঘুমের ব্যাঘাত হয়নি তবে সকাল থেকেই তাঁর ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেল ভোর হতেই মালিরা চলে এসেছিল তাদের কাজটা বুঝিয়ে দিতে হল প্রবল উৎসাহে তারা কাজে লেগে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর কুপার নিজেই এলেন তাঁর কাছ থেকে এস্টেটের নানা বিষয় বুঝতে গিয়ে হাঁফিয়ে উঠলেন হামফ্রেজ
ওই ছবিটা দেখছেন?” খাওয়ার ঘরের বড়ো টেবিলটার ওপর নানা কাগজ বিছিয়ে কথা বলছিলেন কুপার হঠাৎ থেমে পেছনের দেয়ালে ঝোলানো একটা পোর্ট্রেইটের দিকে আঙুল তুলে কুপার বললেন, “উনিই হচ্ছেন সেই মিস্টার উইলসন, যিনি ওই মন্দির আর গোলকধাঁধা বানিয়েছিলেন
একটা চেয়ারে উঠে দাঁড়িয়ে ছবিটা খুঁটিয়ে দেখলেন হামফ্রেজ রোগাটে চেহারার এক তরুণ সেকেলে স্যুট পরে ছবি থেকে তাঁর দিকে তাকিয়েছিল মুখের অনুপাতে কিঞ্চিৎ বড়ো আকারের চোখ, উঁচু কপাল -সব নিতান্ত সাধারণ জিনিসের বাইরে দুটো জিনিস হামফ্রেজের নজর কাড়ল
প্রথমত, ছবিটার পটভূমিও রোম, কারণ ছবির তরুণের পেছনে কলিসিয়াম দেখা যাচ্ছিল
দ্বিতীয়ত, তরুণের হাতে পাকানো কাগজটা ওই মন্দির আর গোলকধাঁধার নকশা তার মানে এই দুটো জিনিসই ভদ্রলোক ইটালি থেকে আমদানি করেছিলেন! তবে নকশার আদলটা কাছ থেকে দেখে হামফ্রেজের মনে হল, আগেরবার ওই জায়গাটাকে যতটা সরল বলে মনে হয়েছিল, তা বোধহয় নয় আসুরিক পদ্ধতিতে ঝোপঝাড় ভেঙে না এগোলে ওই জায়গাটার কেন্দ্রে পৌঁছোনো বোধহয় সহজ হবে না

বিকেলবেলা কুপার পরিবারের সঙ্গে ওই গোলকধাঁধায় ঢুকে হামফ্রেজ বুঝতে পারলেন, তাঁর আশঙ্কা সত্যি বার বার চেষ্টা করেও বাকিদের নিয়ে জায়গাটার কেন্দ্রে পৌঁছোতে পারছিলেন না তিনি ইতিমধ্যে মালিরা জায়গাটা পরিষ্কার করে দেওয়ায় সবটা অনেক ছিমছাম দেখাচ্ছিল কিন্তু তা সত্ত্বেও অবস্থা এমনই দাঁড়াল যে হামফ্রেজ প্রধান মালিকে ডেকে পাঠাল
দেখুন মিস্টার উইলসন…” জিভ কাটল বুড়ো ক্লাটারহ্যাম, “মাফ করবেন স্যার উইলস্থর্প হলের এতদিনকার মালিকানা উইলসনদের কাছে ছিল বলে ওটাই বলে ফেলেছি দেখুন মিস্টার হামফ্রেজ, এই গোলকধাঁধা বানানোই হয়েছিল এমনভাবে যাতে প্রত্যেকটা রাস্তা একইরকম দেখায় তবে আমার সঙ্গে আসুন দেখি আপনাদের জায়গামতো নিয়ে যেতে পারি কি না
কাছের একটা ঝোপে নিজের টুপিটা ঝুলিয়ে ক্লাটারহ্যাম বলল, “এটাকে আমরা শুরু করার জায়গা বলে ধরে নিই, কেমন! এবার আসুন
পাঁচ মিনিট হাঁটার পর পুরো দলটা আবার ওই টুপির কাছেই এসে পৌঁছোল!
এ তো আজব ব্যাপার!” বিড়বিড় করল ক্লাটারহ্যাম, “আপনি তো দেখেছেন স্যার, আমি টুপিটা একটা গোলঞ্চ ঝোপের ওপর রেখেছিলাম এখন তো দেখছি এই রাস্তায় কোনও গোলঞ্চঝোপই নেই টুপিটা মাটিতে পড়ে আছে! এটা কী করে হয়? স্যার, আপনি যদি অনুমতি দিতেন তাহলে আমি একজনকে ডেকে এই জায়গায় একটা খুঁটি লাগাতে বলতাম, যাতে জায়গাটা দূর থেকেও চেনা যায়
হামফ্রেজ তৎক্ষণাৎ অনুমতি দিলেন
প্রচুর হাঁকডাকে ক্লাটারহ্যামের এক সহকারী সাড়া দিল লোকটির নাম উইলিয়াম ক্র্যাক বেচারি দলটার কাছে পৌঁছোতে একেবারে নাস্তানাবুদ হয়ে গেল একবার তার গলার আওয়াজ শুনে মনে হল সে আরও ভেতরের দিকে কোনও একটা গলিপথে রয়েছে প্রায় একইসঙ্গে তাকে দেখা গেল বাইরের দিকে, বেশ কিছুটা দূরে অবশেষে ক্র্যাক তাদের কাছে পৌঁছোলে ক্লাটারহ্যাম তাকে কাজটা বোঝাতে ব্যস্ত হল শেষ অবধি খুঁটি নয়, ক্র্যাক-কেই টুপির পাশে দাঁড় করানো হল তারপর নতুন উদ্যমে দলটা এগোতে শুরু করল কেন্দ্রে পৌঁছোনোর লক্ষ্যে
প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট বরবাদ করেও দলটা গোলকধাঁধার কেন্দ্রে পৌঁছোতে পারল না মিসেস কুপার যারপরনাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন দেখে হামফ্রেজই বললেন, “আপাতত ফেরা যাক পরে একটা বোধগম্য আর পরিষ্কার নকশা বানিয়ে আমরা আবার আসব এখানে
ফেরার সময় ক্লাটারহ্যাম বলল, “যথার্থ বলেছেন স্যার আমাদের একটা পরিষ্কার নকশা বানানো দরকার নইলে ভাবুন, কেউ ভেতরে থাকা অবস্থায় বৃষ্টি এলে কী হবে? সে বেচারি তো ভিজতেই থাকবে!”
কুপার-রা ফিরে গেলে হামফ্রেজ আবার গোলকধাঁধার কাছে এলেন বিকেলটা বরবাদ হল বলে তিনি খুব বিরক্ত হয়ে ছিলেন বিরক্তিটা বাড়ল, যখন একা-একা গোলকধাঁধায় ঢুকে একটিও ভুল পদক্ষেপ না নিয়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যে তিনি কেন্দ্রে পৌঁছে গেলেন! একবার তাঁর মনে হয়েছিল, তখনই কাগজ আর পেন্সিল নিয়ে জায়গাটার একটা নকশা বানানো যাক তারপর তাঁর খেয়াল হল, সরঞ্জাম জোগাড় করে এখানে আসতে-আসতে আলো এতটাই কমে যাবে যে কাজটা হবে না তখনকার মতো হলে ফিরতে বাধ্য হলেন হামফ্রেজ

পরদিন সকালে ড্রইং বোর্ড, পেনসিল, কম্পাস, পুরু কাগজ এইসব অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে গেলেন হামফ্রেজ যথারীতি, গেট খুলে গোলকধাঁধার কেন্দ্রে পৌঁছোতে তাঁর এবারও মিনিট পাঁচেকের বেশি লাগল না কিন্তু তারপর অন্য একটা ব্যাপার তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করল
মালিদের হাতে ঝোপঝাড় সাফ হওয়ার ফলে মাঝখানের স্তম্ভ আর তার ওপর বসানো গোলকটা স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছিল স্তম্ভ নেহাত সাদামাটা হলেও গোলকটা একেবারেই অন্যরকম ছিল সচরাচর এমন জিনিসে হয় পৃথিবীর মানচিত্রটাই ফুটিয়ে তোলা হয়, নয়তো আকাশের নানা নক্ষত্রমণ্ডলী আর গ্রহের বাস্তব বা কাল্পনিক অবস্থান দেখানো হয় এখানে নিরক্ষীয় অঞ্চলটা ড্রাকো মানে ড্রাগনের মতো একটা প্রকাণ্ড সরীসৃপের ডানায় চাপা পড়েছিল উত্তর গোলার্ধের বেশিটাই ঢাকা ছিল অন্য একটি প্রাণীর দুই ডানায় তার মাথাটা মেরুর কাছাকাছি থাকলেও একটা বলয় দিয়ে ঘেরা ছিল বলে স্পষ্ট হচ্ছিল না মুখের কাছে লেখা ছিলপ্রিন্সেপস টেনেনব্রাম
অন্ধকারের রাজপুত্র!” অর্থটা বুঝতে পারলেন হামফ্রেজ কৌতূহলী হয়ে তিনি নিচের গোলার্ধটা দেখতে ব্যস্ত হলেন সেই অংশটা কাটাকুটিতে একেবারে ঠাসা ছিল তাদের মধ্যেওআমব্রা মর্টিসকথাটা পড়া গেল
মৃত্যুর ছায়া?” চমকে গেলেন হামফ্রেজ আপনমনে নিজেকেই জিজ্ঞেস করলেন তিনি, “এটা কী ধরনের গোলক?”
কথাটা যেখানে লেখা ছিল, তার কাছেই আঁকা ছিল একঝাঁক পাহাড় তাদের মাঝের উপত্যকা থেকে অগ্নিশিখা বেরিয়ে আসছিল সেটার নিচে লেখা ছিলভ্যালিস ফিলিওরাম হিন্নোম ঢোঁক গিললেন হামফ্রেজ তাঁর মনে পড়ল, হিন্নোম উপত্যকা বলতে জেরুজালেমের বাইরের সেই জায়গাটা বোঝানো হত, যেখানে একদা শিশুদের বলি দেওয়া হত জায়গাটাকে আজও নরকের সঙ্গেই তুলনা করেন অনেকে!
ড্রাকোর ছবিটার ঠিক নিচেই যা আঁকা ছিল, একঝলকে তাদের দেখলে কিংবদন্তির নানা চরিত্র বলেই মনে হয় কিন্তু খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায়, গদা হাতে আরেকজনকে মারতে উদ্যত পুরুষটি হারকিউলিস নয়, বরং কেইন প্রথম হত্যাকারী! মাটির মধ্যে কিছুটা তলিয়ে যাওয়া আরেকজন মানুষকে দেখে এক লহমায় যোদ্ধা ওফিয়াকাস বলে মনে হলেও আসলে সে কোরাহ মোজেসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার অপরাধে যার পায়ের নিচে মাটি দুভাগ হয়ে গিয়ে তাকে গ্রাস করেছিল! একটা কুৎসিতদর্শন গাছের ডালে চুল দিয়ে বাঁধা অবস্থায় ঝুলে আছে ডেভিডের এক ছেলে আবসালন! তার কাছেই বৃত্তাকার একটা জায়গার মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল আলখাল্লা-পরা একটা লোক দেখে মনে হচ্ছিল, দুই লোমশ দানবের উদ্দেশে সে কিছু বলছে লোকটার পরিচয় হিসেবে লেখা ছিলহোস্টানেস মেগাস নামটা চিনতে না পারলেও সে যে কোনও জাদুকর এটা হামফ্রেজ বুঝতেই পারলেন
এ কেমন গোলক?
ইতালি, আর সেই সুবাদে দান্তের লেখায় নরক সম্বন্ধে হওয়া ধারণার প্রভাব এতে স্পষ্ট কিন্তু সেই জিনিস এমন অযত্নে আর অবহেলায় রাখা কেন?
তখনকার মতো গোলক ছেড়ে নকশা বানানোতেই মন দিলেন হামফ্রেজ
আধঘণ্টা চেষ্টা করে হামফ্রেজ বুঝলেন, কোনও একটা স্থির জিনিসের সঙ্গে গেটের দূরত্বটা স্থির করে নিতে না পারলে এ নকশা বানানোই যাবে না ক্লাটারহ্যামকে ডেকে একটা শক্ত আর মোটা সুতো জোগাড় করলেন তিনি স্তম্ভের ওপর রাখা গোলকের মাথায় একটা আংটা ছিল ওই আংটায় সুতোর একটা প্রান্ত আর গেটে অন্য প্রান্তটা বেঁধে একটা রেখা বানালে তার চারপাশে বৃত্ত আর উপবৃত্ত হিসেবে বানানো পথগুলোর নকশা বানানো যাবে কিন্তু এই গোলকটিকে যিনি তৈরি করিয়েছিলেন, তাঁর কি তাতে খারাপ লাগবে?
কাঁধ ঝাঁকালেন হামফ্রেজ তেমন কিছু হলে এই গোলকটাকে খোলা আকাশের নিচে এভাবে রেখে দিতেন না ভদ্রলোক গোলকটাকে টোকা দিয়ে তাঁর মনে হল, জিনিসটা ফাঁপা গায়ের আস্তরণটাও খুব একটা পুরু বলে মনে হল না তাঁর
আংটায় সুতোটা ভালোভাবেই বাঁধা গেল যেমন ভেবেছিলেন সেভাবে কাজ করে লাঞ্চের আগেই একটা খসড়া নকশা তৈরি করে ফেললেন হামফ্রেজ দুপুরের পর সেটাকে আরও পরিপাটি এবং নিখুঁত করে তুললেন তিনি বিকেল নাগাদ, কাজ যখন মোটামুটি শেষ হয়েই এসেছে, কুপার হাজির হলেন
আপনি তো কাজটা সেরেই ফেলেছেন দেখছি,সোৎসাহে বললেন কুপার, “এবার এই জিনিসটাউফ্‌!”
কী হল?” চমকে কাগজ থেকে মুখ তুললেন হামফ্রেজ
ছ্যাঁকা লেগে গেল!” হাতটা ঝাড়তে-ঝাড়তে কুপার বললেন, “এই গোলকটা এত গরম কেন? তামার জিনিস বলে?”
চড়া রোদ্দুরের জন্যও হতে পারেহামফ্রেজ গোলকে হাত দিয়ে অবাক হলেন, “কিন্তু আমার তো জিনিসটা একেবারেই গরম বলে মনে হচ্ছে না
বলেন কী?” কুপারকে রীতিমতো বিভ্রান্ত দেখাল, “আপনি কি শীতল রক্তের প্রাণী নাকি মশাই? আমার তো জিনিসটাকে একেবারে আগুন-গরম বলে মনে হল তা, এখন কি হলে ফিরবেন?”
হ্যাঁ,হামফ্রেজ উঠে দাঁড়িয়ে কাগজপত্র গোছানোর ফাঁকে বললেন, “আপনি বরং কাগজগুলো নিয়ে নিন আমি বাকি সব নিচ্ছি
ফেরার পথে সুতোটা খুলে নিলেন হামফ্রেজ

সেই রাতে বৃষ্টি হল সকালে আবিষ্কৃত হল, কুপারের ভুলে বা অন্য কোনও কারণে নকশাটা বাইরে থেকে গেছিল জলে ভিজে সেটা একেবারে নষ্ট হয়ে গেছিল দীর্ঘশ্বাস ফেলে নতুন করে কাজটা শুরু করলেন হামফ্রেজ গোলকের মাথার আংটায় সুতো বেঁধে তিনি সবে কাগজ-পেনসিল নিয়ে বসেছিলেন তখনই ক্যাল্টন একটা টেলিগ্রাম হাতে নিয়ে হাজির হল
টেলিগ্রাম এসেছিল লন্ডন থেকে হামফ্রেজ আগে যেখানে কাজ করতেন, সেই দফতরের প্রধান তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন একটা জরুরি বিষয়ে কথা বলার জন্য ব্যাপারটার সঙ্গে আইন-কানুন জড়িয়ে আছে বলে আদেশ উপেক্ষা করার প্রশ্নই ছিল না হামফ্রেজ বুঝলেন, তখনই রওনা হলে তিনি আধঘণ্টার মধ্যে লন্ডনের উদ্দেশে রওনা হওয়া ট্রেনটা ধরতে পারবেন কাজ ঠিকঠাক মিটে গেলে বিকেল পাঁচটার মধ্যেই ফিরেও আসতে পারবেন তিনি
ক্যাল্টনকে কাগজ-পেনসিল দিয়ে উঠে পড়লেন হামফ্রেজ আংটার মাথা থেকে সুতোটা খোলা হল না গেটও তাড়াহুড়োয় বন্ধ করা হল না
সবকিছু ঠিকঠাকই চলল সন্ধে নামার আগেই হামফ্রেজ হলে ফিরলেন লাইব্রেরিতে অনেকটা সময় কাটিয়ে তাঁর মনমেজাজ আরও ভালো হয়ে গেল রাতে শুতে গিয়ে হামফ্রেজ দেখলেন, শোয়ার ঘরের জানালাগুলো খোলা আছে, পর্দাও সব সরানো রয়েছে জ্যোৎস্না ভাসিয়ে দিচ্ছিল হলের সামনে লন আর তার পেছনের বাগানটাকে শিশিরভেজা ঘাস, ফুল, পাতা, দুধসাদা মন্দিরের গায়ের রেখাগুলো, এমনকি একটু দূরের গোলকধাঁধাকেও ভারি মায়াবী দেখাচ্ছিল সেই আলোয় একটা তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলে হামফ্রেজের মনে হল, সত্যিই বড়ো সুন্দর একটা জায়গা ও পেয়েছে উত্তরাধিকার হিসেবে শুধু
বাগানের ধারে একেবারে দৃষ্টিকটু প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে ছিল একটা রোগা, ঘোর কালো, ঝুপসি আইরিশ য়িউ গাছ
‘এটা এখানে একেবারেই মানাচ্ছে না পরে কখনও কাটিয়েই দেব গাছটাকে,আপনমনে বিড়বিড় করে শুয়ে পড়লেন হামফ্রেজ

পরদিন আইরিশ য়িউ নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় পেলেন না হামফ্রেজ বিস্তর চিঠি এসেছিল সেগুলো পড়ে, যথাসাধ্য উত্তর দিয়ে, আরও কিছু সামাজিক কাজকর্ম সারতেই তাঁর সকালটা কেটে গেল
লেডি ওয়ারড্রপের একটা চিঠিও এসেছিল পত্রলেখিকা জানিয়েছিলেন, তিনি বিভিন্ন বাড়িতে বাগানের অংশ হিসেবে বানানো গোলকধাঁধার বিবরণ দিয়ে একটা বই লিখছেন উইলস্থর্প হল-এর অংশ গোলকধাঁধার আলোচনা না থাকলে সেই বই একান্তই অসম্পূর্ণ থাকবে তাই তিনি বিশেষভাবে অনুরোধ করছেন, তাঁকে যেন জায়গাটি যথাশীঘ্র দেখার সুযোগ দেওয়া হয় কারণ তিনি অবিলম্বে দীর্ঘদিনের জন্য দেশান্তরী হতে চলেছেন
বেন্টলে-তে লেডি ওয়ারড্রপের বাড়িটা হল থেকে খুব বেশি দূরে নয় হামফ্রেজ এক সংবাদবাহককে দিয়ে তাঁকে জানিয়ে দিলেন, চাইলে তিনি পরদিন বা তার পরেরদিনই আসতে পারেন তিনিও সকৃতজ্ঞ উত্তর পাঠিয়ে জানালেন, পরদিনই তিনি আসছেন গোলকধাঁধা দেখতে
সেইদিন দুপুরের মধ্যেই হামফ্রেজ নকশা বানানোর কাজটা সম্পূর্ণ করলেন
রাতে শুতে যাওয়ার সময় নির্মেঘ আর আলো-ঝলমলে প্রকৃতি দেখতে ভারি ভালো লাগছিল হামফ্রেজের তখনই য়িউ ঝোপটার কথা খেয়াল হল তাঁর কিন্তু
ঝোপটা তো নেই! তাহলে কি ক্লান্তি আর ঘুম-ঘুম ভাবের জন্য গত রাতে ভুল দেখেছিলেন তিনি?
অনেক দেখেশুনেও এমন কিছু পেলেন না হামফ্রেজ, যেটা বাগানের সামগ্রিক চেহারায় বেমানান লাগে তবে নিচের একটা জানালার একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়ানো একটা কুচকুচে কালো ঝোপ তাঁর চোখে বিসদৃশ ঠেকল
‘ওই ঝোপটাকে কাটাতে হবে,’ এবারও শোওয়ার আগে নিজেকে মনে করালেন হামফ্রেজ, ‘চেহারা দেখেই মনে হচ্ছে রোগ বা পোকার গুদাম হবে ওটা এ জিনিস রাখা যাবে না

হামফ্রেজ উইলস্থর্পে এসেছিলেন এক সোমবার বৃহস্পতিবার গোলকধাঁধার নকশা তৈরি হল শুক্রবার লাঞ্চের পরেই লেডি ওয়ারড্রপের শুভাগমন হল বয়স্ক, হাসিখুশি মহিলাটিকে হামফ্রেজের বেশ ভালো লাগল গোলকধাঁধা দেখার অনুমতি পেয়েছিলেন বলে মহিলা হামফ্রেজকে বার বার ধন্যবাদ জানালেন কথায়-কথায় যখন বোঝা গেল যে বাগান করার ব্যাপারে হামফ্রেজের বাস্তব অভিজ্ঞতা আর পড়াশোনা আছে, তখন লেডি ওয়ারড্রপ দারুণ খুশি হলেন হলের চারপাশে কী-কী করা যায় সেই নিয়ে তাঁদের মধ্যে প্রচুর আলোচনা হল তারপর দুজনে মিলে বাগানটা দেখতে চললেন
বাগান, বিশেষত ছোট্ট মন্দিরটা দেখে মুগ্ধ হলেন লেডি ওয়ারড্রপএমন চমৎকার জায়গাটাতে খুব বেশি হাত লাগানো যাবে না,সোৎসাহে বললেন তিনি, “এর আদিম চেহারাটা নষ্ট হয়ে গেলে সেটা একেবারে বর্বরোচিত হবে আপনি জানেন, এইআধুনিকীকরণেরচক্করে কতগুলো প্রাচীন বাগান আর এমন গোলকধাঁধা বরবাদ হয়েছে আমাদের এই অঞ্চলেই!”
আমি একমত,হামফ্রেজ বললেন, “আচ্ছা, এই পাথরগুলো কি গোলকধাঁধাতেই ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত?”
হ্যাম্পশায়ারে একটা ভারি সুন্দর গোলকধাঁধা এখন নষ্ট হয়ে গেছে,তিক্তকণ্ঠে বললেন মহিলা, “তাতে এইরকম পাথর লাগানো ছিল এই যে হরফগুলো খোদাই করা আছে যদি আপনি ঠিক-ঠিক রাস্তা খুঁজে বেরিয়ে আসতে পারেন, তাহলে তাদের সঠিক বিন্যাসটা আপনি দেখতে পেতেন ক্রিটের রাজা মিনোস্‌-এর গোলকধাঁধার ভেতরে থাকা অর্ধবৃষ-অর্ধমানব মিনোটরের গল্পটা জানেন তো? মিনোসের মেয়ে অ্যারিয়াডনে একটি রত্নখচিত হার বা সুতোর সাহায্যে কাহিনির নায়ক থেসাস-কে মিনোটর-বধের পর ওই গোলকধাঁধা থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করেছিল সেই কাহিনি নিয়ে একটা প্রবাদ পড়া যায়, যদি পাথরগুলো ঠিকভাবে পড়া যায় তাই আমি বলব, পাথরগুলো যথাস্থানে অবশ্যই ফিরিয়ে দেওয়া উচিত
অবশ্যই সেটা করব তাহলে এখন…?”
গোলকধাঁধা!” কিশোরীর মতো ছটফটিয়ে উঠলেন ওয়ারড্রপ, “আমি এই বিষয়ে মোটামুটি পোড়খাওয়া মানুষ তবু, আপনি সঙ্গে থাকলে ভালো হয়

লেডি ওয়ারড্রপ সত্যিই রীতিমতো বিচক্ষণতার সঙ্গে গোলকধাঁধার মধ্য দিয়ে এগোলেন তবু কেন্দ্রে পৌঁছোতে দুজনের বেশ সময় লাগল জিনিসটা যে ১৭৮০ নাগাদ বানানো হয়েছিল, নানা জায়গার সঙ্গে তুলনা করে ওয়ারড্রপ এমনটাই বললেন প্রতিটি পথের মধ্যে মাটি পড়ে আর ঘাস গজিয়ে সমান হয়ে এলেও কিছুটা নিচু হয়ে থাকা জায়গাগুলো হামফ্রেজকে দেখিয়ে দিলেন ওয়ারড্রপ
এগুলোই হল পাথর বসানোর গর্ত,বললেন ওয়ারড্রপ, “বেশ বুঝে-শুনে বসাবেন কিন্তু
অবশেষে কেন্দ্রে পৌঁছোলেন দুজন গোলকটা দেখে একেবারে বাকশক্তিরহিত হয়ে গেলেন ওয়ারড্রপ অনেকক্ষণ জিনিসটা দেখে, এমনকি খুব আলতো করে ওটাকে ছুঁয়েও জিনিসটার কাছে এগোতে চাইছিলেন না মহিলা শেষে হামফ্রেজের দিকে ঘুরে সংশয়মাখা কণ্ঠে তিনি বললেন, “একটা সত্যি কথা বলবেন?”
কী কথা?” অবাক হলেন হামফ্রেজ
এখানে এসে অবধি আপনার কোনোরকম অস্বস্তি হচ্ছে না?” তীক্ষ্ণচোখে হামফ্রেজের দিকে তাকিয়ে ওয়ারড্রপ বললেন, “মনে হচ্ছে না, যেন কেউ আপনাকে দেখছে? যেন আমাদের তরফে কিছু একটা সীমা লঙ্ঘিত হলেইকেউ আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে? আমার হচ্ছে! আমরা কি হলে ফিরতে পারি?”
ফেরার পথে একটু লজ্জিতভাবেই বললেন ওয়ারড্রপ, “জায়গাটা বড়ো গুমোট হয়ে ছিল তাই ওইসব মনে হচ্ছিল পরে কখনও আবার যাব ওই গোলকধাঁধায় আচ্ছা, মিস্টার উইলসনের কাগজপত্রের মধ্যে এই জায়গাটার কোনও নকশা পেয়েছেন?”
পাইনি, তবে আমিই বানিয়ে নিয়েছি,গর্বিতভাবে বললেন হামফ্রেজ ততক্ষণে তাঁরা হলের কাছে ফিরে এসেছিলেন বড়ো ঘরটায় চা খাওয়ার সময় নকশাটা তিনি দেখালেন ওয়ারড্রপকে দারুণ খুশি হলেন মহিলা
এটার একটা ট্রেসিং করে আমাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পাঠিয়ে দিন,অনুনয়ের সুরে বললেন ওয়ারড্রপ, “ওটা বইয়ে দিতে হবে আমি লেখাটা সম্পূর্ণ করি আপনি ইতিমধ্যে ওই পাথরগুলো বসিয়ে দিন
সেখানেই তো হয়েছে মুশকিল,বিব্রতমুখে বললেন হামফ্রেজ, “আমি বা মিস্টার কুপার এই জায়গার মূল নকশা পাইনি পাথরগুলো কীভাবে সাজালে আপনার বলা সেই প্রবাদ বা ওইরকম কিছু পাওয়া যেতে পারে তা আমার মাথায় আসছে না
যাঁরা এই ধরনের ধাঁধা বা সংকেত নিয়ে কাজ করেন, এমন কাউকে ধরুন
তাই করতে হবে মনে হচ্ছে,হঠাৎ হামফ্রেজের গত রাতের কথা মনে পড়ল, “আচ্ছা, আপনি তো বাগান আর গাছপালার ব্যাপারটা আমার চেয়ে অনেক ভালো বোঝেন দেয়ালের কাছে, লাইব্রেরির জানালার নিচে ওই ঘন ঝোপটাকে কেটে দিলে কি খারাপ দেখাবে?”
কোন ঝোপ?” ওয়ারড্রপ জানালার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললেন, “ওই জানালার নিচে তো একটা ছোট্ট ফুলগাছ দেখছি
তাই তো!” হামফ্রেজ চোখ কচলালেন, “কাল রাতে ওপরে আমার ঘর থেকে দেখে জিনিসটাকে অনেক লম্বা আর বড়ো মনে হয়েছিল দেখার ভুল তাহলে
চা-পর্ব মিটলে লেডি ওয়ারড্রপ বেরিয়ে পড়লেন কিছুটা গিয়ে তিনি ড্রাইভারকে বললেন গাড়ি থামাতে ড্রাইভার হামফ্রেজকে ডেকে আনল কৌতূহলী হামফ্রেজ জানালার কাছে মুখ নামালেন ওয়ারড্রপ বললেন, “মন্দিরের মধ্যে রাখা পাথরগুলো উলটে দেখবেন তো যদি নম্বর লেখা থাকে, তাহলে বসাতে সুবিধে হবে

সেদিন সন্ধেবেলায় হামফ্রেজ ওই নকশার ট্রেসিং বানাতে ব্যস্ত হলেন রাত নটা বেজে গেছিল মূল নকশার সঙ্গে তুলনা করে, দূরত্ব আর দৈর্ঘ্য-প্রস্থের ব্যাপারে যথাসম্ভব নিখুঁত থাকতে চেষ্টা করছিলেন তিনি গুমোট গরম বলে জানালা খোলা ছিল মোমবাতির কম্পমান আলোয় কেন যেন বড্ড অস্বস্তি হচ্ছিল হামফ্রেজের তারই মধ্যে একটা বেশ বড়ো বাদুড় বেশ কয়েকবার লাইব্রেরিতে ঢুকে পড়েছিল সেটাকে তাড়াতে গিয়ে ব্যতিব্যস্ত হলেন তিনি
এ তো স্রেফ বাদুড়!” আপন মনে বিড়বিড় করলেন হামফ্রেজ, “এই খোলা জানালা দিয়ে কেউ যদি নিঃশব্দে ঢুকে মেঝের অন্ধকারে গা মিশিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসে, তাহলে কী অবস্থা হবে?”
অবশেষে কাজটা শেষ করা গেল তাও, কোনও গলিপথ ভুল জায়গা থেকে শুরু বা শেষ হয়েছে কি না সেটা দেখার দরকার ছিল বাধ্য হয়ে ট্রেসিং-এর সঙ্গে মূল নকশার তুলনা করতে গিয়ে আঙুল বুলিয়ে, একেবারে প্রথম থেকে গোলকধাঁধায় ঢুকতে শুরু করলেন হামফ্রেজ
বাইরের দিকের রাস্তার একটানা, দুটো ভুল ঠিক করলেন তিনি ঘাম মুছে আরও ভেতরদিকে এগোলেন হামফ্রেজ
কেন্দ্রের কাছে এত কাটাকুটি হল কেন?” আপনমনে বিড়বিড় করলেন তিনি, “ওহো! বাদুড়টা দ্বিতীয়বার লাইব্রেরিতে ঢুকেছিল ওই জায়গাটা নিয়ে কাজ করার সময় তবে মূল নকশা থেকে এখানে একটা জিনিস বাদ পড়েছে মনে হচ্ছে
হামফ্রেজ লক্ষ করলেন, মূল নকশায় একটা কালো বিন্দু ছিল, যেটা ট্রেস করা হয়নি
বিন্দুনা, এটা তো দাগ বলে মনে হচ্ছে! একটা টাকার মাপের কালো দাগ কালি পড়ে গেছিল নাকি ফেয়ার করার সময়? কালির দাগ এইরকম গভীর দেখায় নাকি?
হামফ্রেজের মনে হল, সারাদিনের ক্লান্তি আর গরমে তাঁর দুচোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে সেই অবস্থায় তিনি দেখলেন, গর্তটা চলে গেছে অনেক নিচে কাগজ, টেবিল, ঘরের মেঝে সব পেরিয়ে গর্তটা চলে গেছে কোন অনন্ত অন্ধকারের দিকে!
ওই দাগনা, গর্তের দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে হামফ্রেজের হঠাৎ ভয় করতে লাগল তাঁর মনে হল, গর্তটা থেকে যদি কিছু বেরিয়ে আসে? কী করবেন তিনি? কোথায় পালাবেন? ভাবতে-ভাবতেই হামফ্রেজ দেখলেন, গর্তের নিচে কী যেন একটা নড়ছে
কেউ উঠে আসছে গর্ত দিয়ে উপরে, আরও উপরে, একেবারে তাঁর কাছে!
চেষ্টা করেও অন্য কোনোদিকে চোখ সরাতে পারলেন না হামফ্রেজ তিনি দেখলেন, ক্রমে তার কাছে এগিয়ে এসেছে কালচে ধূসর রঙের একটা গোলাকার জিনিস সেটা একটা মুখের আকার নিল ফলের মধ্য থেকে যেভাবে পোকা বেরিয়ে আসে, সেইভাবে হাত-পা নেড়ে মুখটা ক্রমে হামফ্রেজের একেবারে কাছে এসে পড়ল! তার দুটো শীর্ণ, পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া হাত হামফ্রেজের মাথা লক্ষ করে লম্বা হল, যাতে তাঁকে নিজের দিকে টেনে আনা যায়
পেছনদিকে ছিটকে গেলেন হামফ্রেজ ছাদ থেকে ঝুলন্ত একটা নিভু-নিভু লণ্ঠনে তাঁর মাথাটা সপাটে লাগল
অন্ধকার!

মাথা ফাটেনি, তবে ব্যথা ছিল ভালোই স্নায়ুতে হওয়া চোট ছিল আরও জোরালো সব মিলিয়ে হামফ্রেজের শয্যাশায়ী অবস্থা চলল অনেকদিন ধরে জ্ঞান ফেরার পর হামফ্রেজ প্রথমেই ডাক্তারকে বললেন, “গোলকটা খোলার ব্যবস্থা করুন
ডাক্তারটি এই এলাকায় নতুন গোলকধাঁধা, তার মধ্যে গোলক, তার সঙ্গে রোগীর কী সম্পর্ক এইসব বুঝতে তাঁর বেশ সময় লাগল সব দেখে-শুনে এসে তিনি সখেদে বললেন, “জিনিসটা খুব একটা টেকসই ছিল না, বুঝলেন মাঝামাঝি জায়গায়, যেখানে ওই ড্রাগনের মতো ছবিটা ছিল, সেখানে এক ঘা দিতেই গোলকটা একদম ভেঙে গেল ধাতুর স্তরটা খুব একটা পুরু ছিল না তখন এই জিনিসগুলো বোধহয় অন্যভাবে বানানো হত
গোলকের ভেতরে কী ছিল?” অতিকষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে জানতে চাইলেন হামফ্রেজ
ভেতরে? অর্ধেকটা তো ছাই দিয়েই ভরাট ছিল দেখলাম তার মধ্যে হাড়-টার ছিল কি না সেটা খুঁটিয়ে দেখলে বলা যাবে তবে কাউকে পুড়িয়ে সেই ভস্ম ওটার মধ্যে ভরে রাখা হয়েছিল বলেই মনে হয়! আরে, আপনার আবার কী হল? নার্স!”

গোলকধাঁধা আর নেই তবে লেডি ওয়ারড্রপ সব শুনে হামফ্রেজকে ক্ষমা করে দিয়েছেন ঘটনাচক্রে তাঁর এক ভাইঝিই এখন মিসেস হামফ্রেজ হয়ে উইলস্থর্প হল সামলাচ্ছেন
পাথর নিয়ে ওয়ারড্রপের ধারণাটা ঠিক ছিল সেগুলোর পেছনে খোদাই করা নম্বর অনুযায়ী পাথরগুলো সাজানোর পর একটা প্রবাদ পাওয়া গেছিল তার সঙ্গে গ্রিক কিংবদন্তির সম্পর্ক ছিল না
লেখাটা ছিল ~ পেনেট্র্যান্স অ্যাড ইন্টিরিওরা মর্টিস এখানেই নরকের দ্বার!
উত্তরাধিকার হিসেবে সম্পত্তি রেখে যাওয়ার জন্য কাকার কাছে ঋণী হয়ে ছিলেন হামফ্রেজ তবে একটা কারণে মিস্টার উইলসনের ওপর তাঁর রাগ থেকেই গেছিল তিনি নিজের ঠাকুরদা জেমস উইলসনের যাবতীয় কাগজপত্র পুড়িয়ে না দিলে এই ব্যাপারটার আরও স্পষ্ট নিষ্পত্তি করা যেত
পারিবারিক ভল্টে জেমস উইলসনকে পাওয়া যায়নি তাঁর কী হয়েছিল, তাও নিশ্চিতভাবে বলতে পারেনি কেউ এক ইটালিয়ান কর্মচারীর জন্য বেশ ভালো অঙ্কের পেনশনের ব্যবস্থা করে গেছিলেন জেমস উইলসন এটুকুই জানা গেছিল শুধু
বাগানে কোনও আইরিশ য়িউ গাছ ছিল না লাইব্রেরির জানালার নিচেও কোনও বড়ো ঝোপ ছিল না
লাইব্রেরিতে সেই কালো মলাটের বইটাও আর খুঁজে পাননি হামফ্রেজ!
_____

2 comments:

  1. ফ্যান্টাস্টিক! একটানা পড়ে গেলুম।

    ReplyDelete
  2. যেমন অনবদ্য গল্প, তেমনই তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া অনুবাদ।

    ReplyDelete