ভুতু ভুতুম
মেঘনা নাথ
(১)
(২)
(৩)
(৪)
(৫)
_____
ছবিঃ সুকান্ত মণ্ডল
মেঘনা নাথ
এক ছিল দুই... না না, দুই ছিল এক... ধুত্তোর! অনেক অনেকদিন আগে এক রাজ্যে ছিল দুই যমজ বাচ্চা ভূত।
তাদের মাথা থেকে পা অবধি এক্কেবারে এক রকম দেখতে, মোটে আলাদা করা যায় না।
ভূতরাজ্যের নিয়ম অনুযায়ী তাদের পেতনি-মা যে একটু চুপসানো মতো, তার নাম দিল ভুতু, আর যে একটু ফুলো ফুলো, তার নাম দিল ভুতুম।
ভূতেরা আবার পুরোটাই হাওয়া দিয়ে তৈরি কিনা, তাই মোটা রোগার বালাই নেই, ফোলা আর চুপসানো দিয়ে দিব্যি
কাজ চলে যায়। ভূতরাজ্যের নিয়ম জানো না? যে যত উঁচু পদের কেউকেটা ভূত, সে আড়েবহরে তত ফোলা, আর তার তত বড়ো নাম।
আর নামে যুক্তাক্ষর থাকলে আরও জোরদার ব্যাপার।
ব্র-হ্ম-দৈ-ত্য, স্ক-ন্ধ-কা-টা এসব নাম শুনলেই মনে হয় যে বেশ এলেমদার, ওজনদার ভূত, কী বল? 'ব্রহ্মদৈত্য’, ‘স্কন্ধকাটা’ দুটোতেই সমান সংখ্যার অক্ষর, তাই ভূতের রাজার সিংহাসন নিয়ে
এই দুই দলের ভূতেদের মধ্যে মারামারিও কম নেই। নেহাৎ
স্কন্ধকাটাদের মাথা নেই তাই। শুধু
সেই জোরে ব্রহ্মদৈত্যদের দলের সর্দার ভূতেদের রাজামশাই হয়ে নামের আগে পিছে বেশ কটা
লম্বা লম্বা উপাধি নিয়ে সিংহাসনে বসে পড়েছেন। গুনে
গুনে একশো তেরোখানা অক্ষর, হ্যাঁ! রাজামশাই সিংহাসনে বসার পর থেকেই ঢেঁড়া পেটানো আছে, এর থেকে বড়ো নাম কারও রাখা
যাবে না।
রাজামশায়ের চেহারাখানাও তেমনই,
দেখলেই ভক্তি উপচে উঠতে বাধ্য। এই
মনে কর প্রকাণ্ড একটা ঘরের সমান একখানা ঘোলাটে কালো গ্যাসবেলুন, তার উপরে বিরিয়ানির হাঁড়ির
মতো বড়ো একটা মাথা, সেটাও
অমনই ঘোলাটে কালো। এইয়া বড়ো বড়ো দু’খানা চোখ, লরির হেডলাইটের মতো তাদের জ্যোতি, তেমনই বিশাল কুলোর মতো বড়ো
বড়ো দু’খানা কান, ইচ্ছেমতো
সেগুলো নাড়িয়ে ভূতের রাজা নিমেষের মধ্যে রাজ্যের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে যাতায়াত
করেন। অন্য ভূতেদেরও সে ক্ষমতা আছে
বটে, তবে
তাদের কানের আকারও অনেক ছোটো, তাই ক্ষমতাও অনেক কম। একটু
উড়তে না উড়তেই দম শেষ হয়ে যায়। তাই, দূরে কোথাও যেতে হলে তাদের
ঘুড়িই ভরসা। ওই একটু উঁচু দেখে গাছের মগডালে
উঠে হাওয়ার দিক বুঝে ঘুড়ি ভাসিয়ে দিয়ে ঝপ করে তার ওপর চড়ে বসলেই হল, ভেসে ভেসে যাও এবার যেদিকে
ইচ্ছা।
তা, যাকগে, যা বলছিলাম, এই সুবিশাল বপুখানা বছর বছর একইরকম রাখাটাও কিন্তু চাট্টিখানি
কথা নয়। এমনিতে, সাধারণ পাতি ভূতেদের তো সকালে
উঠে পছন্দমতো জায়গায় দাঁড়িয়ে হাঁ করে এক ঢোঁক হাওয়া গিলে নিলেই নিশ্চিন্তি, সারাদিনের মতো ভেসে বেড়ানোর
রসদ মজুত হয়ে যায়। বড়োলোক ভূতেরা শখ করে মাঝেসাঝে
নানারকম রান্নাবান্না করে বটে, তবে পাতি ভূতেদের ওসব ব্যাপার নেই। খেয়ে
সুখ নেই, খাওয়ার
সঙ্গে সঙ্গে তো সে খাবার হাওয়াশরীর বেয়ে পায়ের কাছে ধুপ করে এসে পড়ে, কী লাভ বাপু ঝক্কি বাড়িয়ে!
তবে রাজপরিবারের কায়দাকানুন আলাদা। অত্ত
বড়ো বড়ো শরীর নিয়ে সক্কাল সক্কাল রাজপরিবার আর মন্ত্রী-সেনাপতিদের বাড়ির সবাই যদি লাইন দিয়ে মাঠে দাঁড়িয়ে হাঁ করে হাওয়া
খায়, কেমন
বিশ্রী দেখায় বল দেখি! তাই
বিশেষ একরকমের ক্যাপসুলের মধ্যে তাদের জন্য হাওয়া ভরে রাখা হয়, দিনে একবার মনে করে টুপ করে
মুখে পুরে দিলেই হবে, ক্যাপসুল
আপনা আপনি ফেটে সারা শরীরে হাওয়া ছড়িয়ে দেবে। এখন
আবার নতুন ঢং উঠেছে, যে
সে হাওয়া হলে ঠিক মান পাওয়া যাচ্ছে না, বিশেষ বিশেষ জায়গার হাওয়া চাই। যত
অচেনা, অজানা
জায়গার হাওয়া, তার
দর,
কদর দুই-ই
বেশি। ভুতু-ভুতুমের বাবা ভূত এই হাওয়া
সংগ্রহ আপিসেরই কেরানি। মাস দুই হল আলাস্কার হাওয়া
সংগ্রহ করতে গেছেন।
সে যাই হোক, এই
ভুতু আর ভুতুমকে নিয়ে তাদের পেতনি-মা পড়েছে মহা মুশকিলে। দুটোই
একেবারে রাম বিচ্ছু। পড়াশোনায় তো মোটে মন নেই, আদ্ধেক
দিন পাঠশালা থেকে পালিয়ে আসে। দুটো
মিলে সারাদিন শুধু লাট্টু আর গুলতি নিয়ে টই টই করে বেড়াচ্ছে।
তার থেকেও বড়ো চিন্তার কথা হল ইদানীং ছানাগুলো কী মতলবে কে জানে, প্রায়ই ভূতেদের দুনিয়া আর
মানুষের দুনিয়ার মধ্যে যে অদৃশ্য পাঁচিল, তার চারপাশে ঘোরাঘুরি শুরু করেছে। ভাবখানা
এমন, যেন
হাওয়ার ধাক্কায় ঘুড়ি বেসামাল হয়ে ওদিকে চলে গেছে,
ওদের যাওয়ার কোন ইচ্ছাই ছিল না,
কিন্তু মায়ের চোখ কি আর অত সহজে ফাঁকি দেওয়া যায়! ঘরে থাকলেও সারাক্ষণ দুটো মিলে
গুজগুজ ফুসফুস করছে, আর
মাকে আসতে দেখলেই অমনি দু’জন দু’দিকে ফিরে ভালো ভূতের মতো বইয়ে মুখ গুঁজে দিচ্ছে।
ঘরসংসারের কাজ একা হাতে সামলে কাঁহাতক এদের চোখে চোখে রাখা যায়! একেই গরিব ভূত বলে গাঁয়ের এক্কেবারে
শেষ সীমানার দিকে কুঁড়ে, বলতে গেলে মানুষের একেবারে ঘাড়ের ওপরে তাদের বাস, বাচ্চা নিয়ে সারাক্ষণই ভয়ে
কাঁটা হয়ে থাকা, তার
ওপর যদি ওরা এরকম নিয়ম ভাঙার চেষ্টা করে, সর্বনাশের আর কী বাকি থাকে!
সর্বনাশ কেন? দাঁড়াও তবে বুঝিয়ে বলি। ভূতজন্ম
তো আর এমনি এমনি হয় না, মানুষের দুনিয়াতে কাজটি ফুরোলে পরে মানুষেরা ভূত হয়।
তাই মানুষের দুনিয়ার টান বড়ো বাজে টান। সে
টান একবার যাকে বাঁধে, সে
আর কোথাও থিতু হতে পারে না, কাজে মন লাগে না, সারা দিন-রাত তার মন আনচান, দেহ উচাটন হয়ে থাকে। কী
যেন নেই, কী
যেন সে হারিয়ে ফেলেছে… আনমনে এই ভেবে ভেবে দিনরাত কাবার করে দেয়।
কিন্তু এমন হতে থাকলে ভূতেদের দুনিয়াখানা চলবে কেমন করে? তাই ভূতেদের রাজ্যে কড়া নিয়ম, খুব প্রয়োজন ছাড়া, রাজদরবারের অনুমতি ছাড়া মানুষের
ধারেকাছে ঘেঁষা চলবে না, ব্যস! তাও, যাওয়ার আগে কোবরেজমশায়ের থেকে মানুষের গন্ধ তাড়ানোর ওষুধ খেয়ে
তবে যেতে হয়।
সাধারণত ভূতজন্ম হওয়ার পরে তেরো দিন একটা ঘোরের মধ্যে থাকে সকলে, কারণ ভূতেদের হেড আপিসে তখন
তার সম্পর্কে সমস্ত খোঁজ-খবর নেওয়া চলতে থাকে। ঠিক
করা হয়, তার
মানুষজন্মের কোনোকিছু ভূতেদের জন্য উপযোগী কিনা। দরকারি
কিছু থাকলে সেগুলো যেমন কে তেমন রেখে দিয়ে বাদবাকি তার নাম, তার বাপ-মায়ের নাম, ঠিকানা মগজধোলাই করে সাফ করে
দেওয়া হয়, নইলে
সে এখানে থাকতে চাইবে কেন! হয় তার এতদিনের আপনার জনদের কাছে ফিরে যেতে চাইবে, নয়তো শত্তুরদের ঘাড় মটকাতে
চাইবে! আর
মানুষজন্মের আপনজনদের কথা মনে থাকলে, ভূতরাজ্যে ঘর বাঁধতে তার মন সায় দেবে না যে! তাই এমন বন্দোবস্ত।
চোদ্দ দিনের দিন যে যেমন বয়সে মানুষ থেকে ভূতেদের দুনিয়াতে এসেছে, তেমন বয়সের ভূত হয়ে যায়।
তখন এই দুনিয়াই তার জগত,
এখানেই তার কাজ-কর্ম।
বাচ্চা ভূতেদের কথা অবশ্য আলাদা। বয়সে
বড়ো যে সব ভূত বাবা-মা
হতে চায়, তারা
রেজিস্ট্রি আপিসে গিয়ে নাম লিখিয়ে আসে। তারপর
ছানা ভূতেরা যখন যেমন আসে, বাপ-মায়ের নামের লিস্টি দেখে দেখে পরপর চিঠি পাঠিয়ে ডেকে এনে ছানা
ভূতেদের মা-বাবার
হাতে তুলে দেওয়া হয়। ভূত বাবা আর পেতনি-মায়ের কাছে
যেদিন চিঠি এসে পৌঁছল যে দু’জন বাচ্চা ভূত আসবে ওদের ঘরে,
চিঠি পড়েই পেতনি মায়ের বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল।
ইশ! কার নাড়ি ছেঁড়া ধন গো!
আহা!
এখনও যে মাঝে মাঝে মনে হয় না,
তেমন নয়। যখন
বিচ্ছুদুটো হাজার বকা খাওয়ার পরেও দিনের বেলা দু’পাশ থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোয়, যখন দুষ্টুমি করে ধরা পড়ে গিয়ে
আরও বেশি দুষ্টু দুষ্টু মুখ করে মুখ টিপে হাসতে থাকে,
ভূত বাবা ঘরে ফেরার পর ছুট্টে গিয়ে যখন দু’জন দুটো হাত ধরে ঝুলে
পড়ে ― বার বার মনে হয়, না জানি কার কোল ফাঁকা করে,
কাকে কাঁদিয়ে চলে এসেছে এরা!
নিজেকে কেমন যেন অপরাধী মনে হতে থাকে। তারপরেই
নিজের মনকে শাসন করে, কারও
কোল ফাঁকা না হলে তার কোলখানা ভরত কেমন করে?
সেদিন আবারও নিজেকে এসব বোঝাতে বোঝাতেই ঘরের কাজ সারছিল পেতনি-মা।
রান্নাবান্নার ঝামেলা না থাকলে কী হবে, বিচ্ছুদুটোর জ্বালায় ঘরের একটা
জিনিস ঠিক জায়গায় খুঁজে পাওয়ার উপায় আছে! খেলতে যাওয়ার নাম করে তো বেরোল দু’জনে, সারা বিছানা জুড়ে বইপত্র, শ্লেট পেন্সিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে
একাকার করে রেখে গেছে। শুধু ভোরের আলো ফোটার অপেক্ষা, অমনি দুদ্দাড় দৌড়! দেখেছ কাণ্ড, শ্লেটের ওপরে অঙ্কটা পুরোটা
কষেনি অবধি!
এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ। দরজা
খুলতেই পেতনি-মায়ের মুখটা খুশিতে ঝলমল করে উঠল। কতদিন
পরে ভূতবাবা বাড়ি ফিরল! ইশ! কী চুপসেই না গেছে! হাত থেকে ভারি ভারি ব্যাগগুলো নিয়ে ঘরের এককোণে রাখতে রাখতে বলল, “এতদিন দেরি হল যে? আমি তো চিন্তায় চিন্তায় একেবারে…!”
“পথ কি আর কম গিন্নি! এত দূরের দেশ যাওয়া, সেখানকার রাজামশায়ের দরবারে
আমাদের রাজামশায়ের চিঠি দেওয়া, তারপর এতগুলো শিশিতে হাওয়া ভরা...
কম কাজ? এত দূরের পথ তো আর বার বার যাওয়া যাবে না, তাই একেবারে অনেকটা নিয়ে আসতে
হল। তা ভুতু ভুতুম কই? খেলতে গেছে নিশ্চয়ই?”
“হ্যাঁ, তারা ভোরবেলা ঘরে থাকবার বাচ্চা
তো! ওই
দেখ, বিছানার
উপর সব ছড়িয়ে কেমন পালিয়েছে! তবে চলে আসবে এখনই, সূর্য তো মাথার ওপর চড়তে চলল। তুমি
বসো, আমি
হাওয়ার বাক্সটা নিয়ে আসি।”
কুলুঙ্গি থেকে সাবধানে হাওয়ার ক্যাপসুলের শিশি ভরা বাক্সটা নামাল
পেতনি-মা। ক্লান্ত লাগলে পাহাড়ের হাওয়া, দুর্বল লাগলে সমুদ্রতীরের হাওয়া, মাথা ঘুরলে ফুলের বাগানের হাওয়া
এসব শিশির গায়ে কাগজ সেঁটে সেঁটে লিখে রাখা। এত
চুপসে গেছে, পাহাড়, সমুদ্র দুটো শিশিরই ক্যাপসুল
লাগবে মনে হচ্ছে। ভুতু ভুতুমের কথাটা বলবে নাকি
এখনই? থাক।
দু’মাস পরে সবে ঘরে ফিরেছে,
একটু জিরিয়ে নিক।
দুটো শিশি থেকে গোটা তিন-চারেক ক্যাপসুল মুখে দেওয়ার পর আস্তে আস্তে ভূতবাবার চেহারাটা
মোটামুটি আগের অবস্থায় ফিরে এল। বাকিটা
বিশ্রাম নিলে ঠিক হয়ে যাবে। এমন
সময়, “বাবা!” বলে ভুতু ভুতুম ভেসে ভেসে এসে
ভূত বাবার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারপরে
বাবার গলা জড়িয়ে ধরে অনেক আদর খাওয়া হল, বাবার ব্যাগ থেকে একে একে সীলের চামড়ার তৈরি নকশা করা বল, কাঠের তৈরি ভেঁপু, খেলনা গাড়ি এসব পেয়ে নেড়েচেড়ে
দেখা হল। তারপরে বাবা যখন সব দরজা-জানালার পর্দা টাঙিয়ে ঘর অন্ধকার
করে আর একটা ব্যাগ খুলে খুব সাবধানে একটা কাচের শিশি বার করে বলল, “এই দ্যাখো!” ভুতু, ভুতুম আর পেতনি-মায়ের মুখে
কথা সরে না।
এ কী অদ্ভুত জিনিস! ভূতবাবা আগেও কত দেশ বিদেশ থেকে হাওয়া নিয়ে এসেছে, কিন্তু সে সব কখনোই দেখবার
মতো কিছু ছিল না। আগে আগে ভুতু ভুতুম বাবা ফিরলে
বাবার ব্যাগে উঁকি মারত ঠিকই, কিন্তু প্রতিবারই সেই একই জিনিস,
ব্যাগের মধ্যে তুলো দিয়ে মোড়া,
সারি সারি হাওয়ার শিশি,
যেগুলো থেকে বাবার আপিসে রাজপরিবারের সবার জন্য ক্যাপসুল তৈরি
হয়। তাদের না আছে কোনও রং, না আছে কোনও গন্ধ, বেশিরভাগ সময় বোঝাই যায় না
শিশিগুলো ভর্তি না খালি!
কিন্তু এবারের শিশিটা একেবারে আলাদা। শিশির
ভেতরে গাঢ় বেগুনি আর হলদে সবুজ রঙের কী আশ্চর্য সুন্দর এক আলো আপনা থেকেই নেচে নেচে
কত রকম নকশা তৈরি করছে। তার ভেতরে ঠিক যেন রাতের আকাশে
তারার মতো ছোট্ট ছোট্ট আলোর বিন্দু ঝিকমিক করছে। ওদের
চারজনকে ঘিরে শিশি থেকে মৃদু নরম আলো বেরিয়ে এসে যেন স্বপ্নের মতো ছড়িয়ে পড়েছে।
ওদের ঘোর কাটছে না দেখে ভূতবাবা বলল,
“এবার যে দেশে গেছিলাম,
সে দেশে রাত হলে আকাশ জুড়ে এরকম আলো দেখা যায়।
ওখানকার ভূতেরা এই আলোয় হাত ধরাধরি করে নাচে।
সে যে কী সুন্দর সুর কী বলব!”
“কিন্তু সেই আলোটা তুমি এখানে নিয়ে এলে কী করে বাবা?” ভুতু অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।
“আরে, সে জন্যই তো এত চুপি চুপি যাওয়া!
ওই দেশে এক মস্ত পণ্ডিত ভূত আছেন,
তিনি একটা যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন। শুধু
হাওয়া নয়, হাওয়ার
সঙ্গে সেই সময়ের আলোকেও বোতলে পুরে ফেলা যাবে। আর
এই হাওয়া থেকে তৈরি ক্যাপসুল মুখে দিলে সারা শরীরে অমন আলো ছড়িয়ে পড়বে।
রাজামশাইয়ের ছোটোবেলার বন্ধু ওই দেশে থাকেন।
তিনি রাজামশাইকে চিঠিতে এ কথা জানিয়েছিলেন।
রাজকন্যের সামনের মাসে জন্মদিন আসছে না? তিনি বাবার কাছে এসব শুনে বায়না
ধরেছেন তাঁর জন্মদিনের উৎসবে এই আলোশুদ্ধু হাওয়া চাইই চাই। আমাদের
আশেপাশের দেশে এসব খবর কেউ জানে না। তাই
তো আমি একেবারে একা গেছিলাম, অনেকজন মিলে গেলে সকলের সন্দেহ হতে পারে কিনা! রাতের পর রাত ধরে পণ্ডিতের
বলে দেওয়া সময়ে, পণ্ডিতের
আবিষ্কার করা যন্ত্র দিয়ে শিশিতে হাওয়া ভরেছি। আমাদের
আপিসেও খুব লুকিয়ে ক্যাপসুল তৈরির কাজ হবে,
বেশি ভূতে যেন টের না পায়। জন্মদিনের
দিন আলো ঝলমলে রাজকন্যেকে দেখে সকলে একেবারে চমকে যাবে!”
“আমাদের জন্যও ওই হাওয়া থেকে
ক্যাপসুল বানিয়ে দাও না বাবা? আমি আর ভুতুও ওরকম সাজব!”
ভুতুম বাবার হাত ধরে ঝুলে পড়ে প্রায়।
“চুপ চুপ চুপ!” ভূত বাবা আঁতকে ওঠে, “এ আবার কী সব্বোনেশে কথা! ভুলেও এসব চিন্তা মাথায় আনিস
না। এ জিনিস শুধু রাজকন্যের জন্য।
অন্য কেউ এ জিনিসে হাত দিলে রাজামশাই তার অবস্থা খারাপ করে ছাড়বেন।
আর যেন কক্ষনো এরকম বায়না করতে আমি না শুনি ভুতু ভুতুম।
যা শুয়ে পড়!”
ভুতু একটু বেশি সাহসী, তাই
বাবার চোখ রাঙানিতে ভয় না পেয়ে বলল, “দাও
না বাবা বানিয়ে? এত তো আছে! সব শুধু রাজকন্যেই পাবেন কেন? আমাদের ইচ্ছে করে না বুঝি?”
ভূত বাবা এবার গোল গোল চোখ করে এমন জোরে ধমক দিল যে ভুতু ভুতুম
দুজনেই ফোঁপাতে ফোঁপাতে ওদের খাটে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ল। বেশি
ফোঁপালে যদি হাওয়া বেরিয়ে গিয়ে চুপসে যায়,
সেই ভয়ে পেতনি-মা কিছুক্ষণ ওদের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার
চেষ্টা করল।
খানিক বাদে ওরা ঘুমিয়ে পড়লে ভূত বাবার কাছে এসে পেতনি-মা বলল, “কোনোভাবেই দেওয়া যাবে না, না? একটা অন্তত? তাহলে দুটিতে ভাগাভাগি করে
নিতে পারত।”
“তুমিও কি ওদের সঙ্গে বাচ্চা
হয়ে গেলে গিন্নি? এ
পুরো গোনাগুনতি জিনিস। একটাও কম হলে চাকরি নিয়ে টানাটানি
পড়ে যাবে!”
“এতগুলো শিশি লাগবে উৎসবে?”
“আরে, এর মধ্যে অন্য ব্যাপার আছে।
ওই পণ্ডিত হাওয়ার সঙ্গে আলোকেও শিশিতে পুরেছেন ঠিকই, কিন্তু একটু খুঁত রয়ে গেছে।
এ থেকে তৈরি ক্যাপসুল বেশিক্ষণ থাকে না। মোটামুটি
ধরো ঘণ্টা তিনেক বাদেই আলো নিভে আসে। একদিনেই
এক একজনের ধরো পাঁচ-ছ'টা তো লাগবেই।
সেজন্যই এখনও এ জিনিস বেশি প্রচার পায়নি।
নইলে এতদিনে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত না?
রাজারাজড়াদের অনুষ্ঠান,
কম করে হলেও সাত দিন ধরে তো চলবেই। এবার
হিসেব করে দেখ কতগুলো লাগবে। আর
এমনি এমনি তো এগুলো পাওয়া যায়নি। প্রচুর
সোনার মোহর দিয়ে কিনতে হয়েছে। সে
জিনিস আমাদের মতো এলেবেলে ভূতেদের হাতে রাজামশাই পেতে দেবেন কখনও! বাচ্চা দুটো চাইছে, আমারই কি ভালো লাগে বল না বলতে? ও ভেবে লাভ নেই, চলো ঘুমিয়ে পড়ি।
ক্লান্ত লাগছে।”
দু’দিন পর এক রাতে ভুতু ভুতুম পাঠশালা গেছে।
ভূত বাবা আপিসে গেছে হাওয়া জমা দিতে। পেতনি-মা
ঘরে বসে লণ্ঠনের আলোয় রেশমী রুমালে মখমলের সুতো দিয়ে নকশা বুনছে।
রাজকন্যের জন্মদিনের উপহার। ভারি
ভালো ভূত এই রাজকন্যে, যেমন
মিষ্টি দেখতে, তেমন
মিষ্টি ব্যবহার। সত্যি বলতে কী, রাজকন্যে আসার পর থেকে রাজামশাইয়ের
তিরিক্ষি, বিদঘুটে
মেজাজ অনেক নরম হয়ে গেছে। তাই রাজ্যশুদ্ধু সক্কলে রাজকন্যেকে
খুব ভালোবাসে। জন্মদিনের উৎসবে যার যতটুকু
সাধ্য, কিছু
না কিছু উপহার রাজকন্যেকে দেবেই।
এমন সময় ভূত বাবা শোঁ করে ঘুড়ি নিয়ে দরজার সামনে নেমে হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে
ঢুকে বলল, “ভুতু ভুতুম কই?”
“ওমা, তারা তো পাঠশালায়! কেন? কী হয়েছে?”
“সর্বনাশ হয়েছে গিন্নি।
দু’খানা হাওয়ার শিশি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!”
“অ্যাঁ?”
“বড়োবাবুর সামনে ব্যাগ খুলে
দেখি গুনতিতে দুটো কম। বড়োবাবু তো রেগে একেবারে...! বাচ্চাদের দেখাব
বলে বার করেছিলাম, হয়তো
ভুলে ঘরেই ফেলে এসেছি এসব বলে কোনোরকমে শান্ত করে এসেছি। এখনই
না নিয়ে গেলে বিপদ হয়ে যাবে গিন্নি। বড়োবাবু
এখনও রাজামশাইকে খবর দেননি, কিন্তু হিসাব না মেলাতে পারলে সব শেষ।”
"না না, ভুতু ভুতুম বায়না করেছিল ঠিকই, কিন্তু তোমার কাজের জিনিস ওরা নেবে না গো!"
"শিশিগুলো তো হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে না! চলো চলো খুঁজি!
ঘরেই কোথাও লুকিয়ে রেখেছে হয়তো!"
কুঁড়েঘরের সমস্ত কোণ তন্নতন্ন করে খুঁজেও পাওয়া গেল না শিশি দুটো।
ভূত বাবার কপালে হাত। পেতনি-মায়েরও
চিন্তায় মুখ শুকিয়ে এতটুকু। ঘণ্টা
খানেক বাদে ভুতু ভুতুম চুপিচুপি ঘরে ঢুকে মা বাবার মুখের অবস্থা দেখে সঙ্গে সঙ্গে পালাতে
যাচ্ছিল, ভূত
বাবা ঝপ করে দরজার হুড়কো তুলে দিয়ে এসে গম্ভীর মুখে জিজ্ঞাসা করল, "শিশি দুটো কোথায়
ভুতু ভুতুম?"
জিজ্ঞাসা করাই সার। তার
পরে হাজার ধমক, চোখ
রাঙানো, ভয়
দেখানো, এক
সপ্তাহ পাঠশালা থেকে ছুটি, নতুন খেলনার লোভ দেখানো...
কোনোভাবে ওদের মুখ থেকে একটি কথাও বার করা গেল না।
মুখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে কিছু একটা লুকোচ্ছে, অথচ সেই এক কথা, “জানি না।”
শেষে যখন বলা হল শিশি দুটো না পাওয়া গেলে রাজামশাই ভূত বাবাকে
ভয়ানক শাস্তি দেবেন, তখন
ভুতু ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে বলল, “ওগুলো আর আমাদের কাছে নেই।”
“নেই মানে?”
“একজনকে দিয়ে দিয়েছি,” এই বলে ভুতুমও হাউমাউ শুরু
করে দিল।
“দিয়ে দিয়েছিস!
কাকে?! কেন?”
"কোবরেজ দাদুর নাতি
তিড়িংদাদাকে।"
“ও বলেছিল ওকে যদি ওই হাওয়ার
শিশি দিই, তবে
ও আমাদের ওর দাদুর ঘর থেকে মানুষের গন্ধ তাড়ানোর ওষুধ এনে দেবে।”
“সে ওষুধ দিয়ে তোরা কী করবি?” ভূত বাবা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা
করে।
বেশ খানিকক্ষণ চুপ থেকে,
এদিক ওদিক তাকিয়ে, পালাবার পথ নেই দেখে শেষে ভুতু বলল,
“তিড়িংদাদা রোজ খেলতে এসে আমাদের মানুষের গল্প শোনায়।
বলে মানুষদের ওখানে খুব মজা। ওখানে
ভূতেদের সবার নাকি একটা করে বাড়ি আছে। সেখানে
আমাদের মানুষ মা-বাবা
থাকে। ওখানে গেলেই আমরা তাদের চিনতে
পারব, তারা
আমাদের খুব ভালোবাসবে, অনেক
মজার মজার খেলনা দেবে। তাই আমি আর ভুতুম ঠিক করেছিলাম, আমরা একবার পাঁচিল ডিঙিয়ে ওপারে
যাব, গিয়ে
দেখব মানুষ বাবা-মা
কেমন হয়। কিন্তু ও তো এমনি এমনি ওষুধ
দেবে না। কাল যখন খেলতে গিয়ে বাবার আনা
নতুন হাওয়ার কথা বললাম, তখন বলল ওই হাওয়া ওকে এনে দিলেই ও ওষুধ এনে দেবে আমাদের।
তাই তো আমরা চুপিচুপি তোমরা ঘুমিয়ে পড়ার পরে ব্যাগ খুলে শিশি
দুটো বের করে নিয়ে পাঠশালা যাওয়ার পথে ওকে দিয়ে দিয়েছি।"
ভূত বাবা আর পেতনি-মা এবার একেবারেই ভেঙে পড়ল।
রাজামশাই যদি এসব জানেন,
আর রক্ষা নেই।
“কেন চলে যেতে চাইছিলি ভুতু
ভুতুম? আমাদের
কাছে থাকতে আর ভালো লাগছে না?" পেতনি-মা ধরা গলায় জিজ্ঞাসা করে।
ভুতু ভুতুম মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। খানিকক্ষণ
কেউই কোনও কথা বলে না। তারপর হঠাৎ কাছেই ঢাক বাজার
আওয়াজ ভেসে আসে। রাজামশাই আসার সংকেত।
“বড়োবাবু নিশ্চয়ই আমার দেরি দেখে রাজামশাইকে খবর পাঠিয়েছেন,” ভূত বাবা আঁতকে উঠে বলল, “ভুতু ভুতুম এক্ষুনি জানলা দিয়ে
পালা। একদম এদিকে আসবি না।
গিন্নি তুমিও পালাও।”
“আর তোমার কী হবে গো?" পেতনি-মা ডুকরে
ওঠে।
“ও আমি কিছু একটা বানিয়ে বলে
দেব। বলব আমার হাত থেকে শিশি পড়ে
গিয়ে ভেঙে গেছে। এখন পালাও! পালাও তাড়াতাড়ি!"
কিন্তু পালানোর আগেই গাঁয়ের বাকি ভূতেরা ওদের কুঁড়েঘরের সামনে
জড়ো হয়ে হাঁকাহাঁকি করতে শুরু করল। বাধ্য
হয়েই ভূতবাবা দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে দেখল যে মাঠে ভুতু ভুতুমেরা খেলা করে, সেই মাঠে তাঁর বিশাল চেহারা
নিয়ে রাজামশাই ভাসছেন। সঙ্গে মন্ত্রীমশাই।
পাশে আপিসের বড়োবাবুও দাঁড়িয়ে।
ভয়ে ভয়ে রাজামশাইয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে রাজামশাই হুংকার দিয়ে বললেন, "কী ব্যাপার!
তোমার আজকে হাওয়া জমা দেওয়ার কথা ছিল কি না?"
"আ-আজ্ঞে
রাজামশাই!"
"তাহলে আজ মন্ত্রী তোমাদের আপিসে হাওয়া দেখতে গিয়ে
কেন শুনল যে দুটো শিশি কম পড়েছে?"
"আ-আজ্ঞে
আ-আমি, মানে…"
ততক্ষণে রাজামশাইয়ের খেয়াল হয়েছে চারপাশে জড়ো হওয়া গাঁয়ের
অন্য সব ভূতেরা নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করছে এমন কী হাওয়া যার জন্য স্বয়ং রাজামশাই এসে
হাজির! "এক
ঘণ্টার মধ্যে রাজপ্রাসাদে এসে আমার সঙ্গে দেখা করবে। শিশি
যদি উদ্ধার করতে পার ভালো, নইলে…" এই বলে রাজামশাই কান নাড়িয়ে ভোঁ করে উড়ে চলে গেলেন।
রাজামশাই চলে যেতেই ভুতু ভুতুম ছুটে এসে ভূতবাবার দু’পাশ থেকে
হাত ধরে ঝুলে পড়ল, কিছুতেই
তারা বাবাকে একা ছাড়বে না। পেতনি-মাও
আর একটা ঘুড়ি নিয়ে হাজির দেখে ভূতবাবা হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, "চলো তাহলে, সব একসঙ্গেই যাই।
যা হওয়ার হবে।"
মায়ের সঙ্গে ভুতুম আর বাবার সঙ্গে ভুতু এইভাবে ঘুড়ি চড়ে রাজপ্রাসাদে
পৌঁছনো গেল। বিশাল রাজসভা, তার চৌকাঠ থেকে ঘরের শেষ অবধি
দেখা যায় না। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড সিংহাসনে
রাজামশাই, মন্ত্রীমশাই, সেনাপতি, কোষাধ্যক্ষ সকলে সার দিয়ে বসে
রয়েছেন। রানিমা, রাজকন্যাও উপস্থিত।
ভুতু ভুতুমেরা সকলে গিয়ে নমস্কার করে দাঁড়াল।
ভূতবাবা মুখ খোলার আগেই ভুতু ভুতুম রাজামশাইয়ের পায়ের কাছে ঝাঁপিয়ে
পড়ে সব গড়গড় করে বলতে শুরু করল। রাজামশাই
সব শুনে বললেন, "বটে! তবে ডেকে পাঠাও কোবরেজের নাতিকে! আর কোবরেজকেও!"
খানিক বাদে পারিবারিক ঘুড়ি চড়ে দাদুর সঙ্গে শ্রীমান তিড়িং এসে
হাজির। কোবরেজমশাই রাজসভায় ঢুকেই “আজ্ঞে রাজামশাই, ছেলেমানুষ... কী বলতে কী বলে
ফেলেছে... আপনি-” ইত্যাদি শুরু করেছিলেন।
রাজামশাই “আঃ!” বলে গর্জন করতে চুপ করে গেলেন। তারপর
বেশ খানিকক্ষণ ধমক চলার পরে অবশেষে কাঁদো কাঁদো হয়ে তিড়িং বলল, "আমার কী দোষ! দাদুই তো বলেছিল ভুতু ভুতুমের
বাবার থেকে যেমন করে হোক একটা হাওয়ার শিশি জোগাড় করতেই হবে। আমি
তো তাই ওদের ওষুধ দেওয়ার লোভ দেখিয়েছিলাম।"
কোবরেজমশাই আবার মুখ খুলতে যাচ্ছিলেন,
রাজামশাই কটমট করতে চেপে গেলেন। "তাই নাকি? তা শিশি পাওয়ার পর কী করলে তুমি?"
"শিশি আমার কাছে
আছে নাকি! আমি
দাদুকে তক্ষুনি দিয়ে দিয়েছি যে! আর তারপরেই দাদু ঘুড়ি নিয়ে কার সঙ্গে দেখা করতে বেরিয়ে গেছিল
তো! এই
তো একটু আগে ফিরেছে।"
ব্যস! এবার সক্কলের গোল গোল চোখ করে কোবরেজমশাইয়ের দিকে তাকানোর পালা।
সকলের চোখ তার দিকে দেখে কোবরেজমশাই এক পা এক পা করে পিছন পানে
হেঁটে রাজসভার দরজার বাইরে রাখা ঘুড়িটা নিয়ে চুপি চুপি পালানোর ফন্দি করছিলেন, কিন্তু ভুতু ভুতুম ব্যাপারটা
বুঝে এক ছুটে গিয়ে হাতে থাকা লাট্টুর পিছন দিকটা দিয়ে ঘুড়িটা ফুটো করে দিতে কোবরেজমশাই
বাধ্য হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন।
“কী ব্যাপার কোবরেজ? পালাচ্ছ কেন? কার সঙ্গে দেখা করতে গেছিলে
তুমি?” গর্জন
করে উঠলেন রাজামশাই।
“আজ্ঞে...রাজামশাই, আ-আমি...মা-মানে...আমি রুগি দেখতে গেছিলাম রাজামশাই, হঠাৎ খবর এল কিনা...অনেক দূরে...মানে...”
“সত্যি বলবে,
না সেনাপতিকে ডেকে বলব তোমার হাওয়া বের করে দিতে?
রাজসভার কোবরেজের বদলে পাতি ভূত হয়ে দিন কাটাবে?”
“না না রাজামশাই! এমনটা করবেন না।
আমি বলছি সব... ওই স্কন্ধকাটাদের সর্দারের গত মাসে বাতের ব্যথা উঠেছিল কিনা, তাই তিনি আমায় ডেকে পাঠিয়েছিলেন।
শরীর সেরে যাওয়ার পরে খুব বড়ো করে ভোজ দিয়েছিলেন, ওখানেই আর কি, অত রকম খাবার, রঙিন শরবত... লোভ সামলাতে না
পেরে একটু বেশি গন্ধ শুঁকে ফেলে বেসামাল হয়ে পড়েছিলাম। তখন
কথায় কথায় আপনি মেয়ের জন্মদিনে যে চমকটা দেওয়ার কথা ভাবছেন, বলে ফেলেছি।
তাই শুনে ওই সর্দার বললেন ওঁকে যদি আগে থেকে দেখাতে পারি জিনিসটা, প্রচুর বকশিশ দেবেন... তা-তাই তিড়িংকে বলেছিলাম যদি বাচ্চা
দুটোর থেকে কিছু আদায় করতে পারে। আজ
ও শিশি দুটো এনে দিতে আমি ওই সর্দারকে দিয়ে এসেছি। আমার
সামনেই সর্দার আপনার হাওয়া আপিসে যে দু’জন স্কন্ধকাটা কাজ করে তাদের ডেকে সব হাওয়ার
শিশি দিনের বেলায় লুকিয়ে লুকিয়ে নষ্ট করার আদেশ দিল,
আপনাকে সবার সামনে হাসির পাত্র বানানোর জন্য।
আমার ভুল হয়ে গেছে রাজামশাই,
আর হবে না।" বলে
কোবরেজমশাই বড়োই হাউমাউ জুড়ে দিলেন।
“বটে! ব্যাটার মাথা নেই, তাও বদবুদ্ধি কম নেই দেখছি! এবার একটা কড়া ব্যবস্থা নিতে
হবে। আর মন্ত্রী, ওই দুই স্কন্ধকাটাকে এখনই বরখাস্ত
করো। কিন্তু তার আগে... এই কে আছিস, এক্ষুনি এর হাওয়া বের করার
ব্যবস্থা কর। আজ থেকে রাজবাড়ির চিকিৎসা
করার সম্মান তুমি হারালে কোবরেজ। রাজধানীতে
তোমায় যেন আর না দেখি। তোমার এই নাতিকে নিয়ে দূর
হও আমার চোখের সামনে থেকে।"
হাউ হাউ করা তিড়িং আর কোবরেজমশাইকে ভূত পেয়াদারা এসে টেনে রাজসভা থেকে নিয়ে
যাওয়ার পরে রাজামশাই ভুতু ভুতুমের দিকে ফিরে বললেন,
“এবার, মা-বাবাকে ছেড়ে মানুষদের কাছে যেতে চাওয়ার জন্য তোমাদের
কী শাস্তি হওয়া উচিত বলো দেখি!”
ভুতু ভুতুম তো ভয়ে চুপসে একেবারে একাকার। পেতনি-মা
আর ভূত বাবাও কাঁদো কাঁদো। এমন
সময় রাজকন্যে এসে রাজামশায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বললেন,
"ওদের ছেড়ে দাও না বাবা? ওদের জন্যই তো কোবরেজমশাই ধরা
পড়লেন। এবারের মতো ছেড়ে দাও!"
"এই দেখো মামণি,
তুমি কিছু বললে আমি না করতে পারি না যে! কথাটা অবশ্য তুমি মন্দ বলনি। স্কন্ধকাটাদের
দল যে তলে তলে এমন ফন্দি আঁটছে তা তো জানতেই পারতাম না এই পুঁচকেদুটো না থাকলে।
বেশ, ছেড়ে দিতে পারি, তবে একটা শর্তে। আমি
ভেবেছিলাম আমার মেয়ের জন্মদিনে সকলকে চমকে দেব। কিন্তু
স্কন্ধকাটারা যখন সব জেনেই গেছে, এ কথা বাকি সকলের জানতে আর বেশিক্ষণ লাগবে না।
হাওয়া আপিসে আমি পাহারা বাড়াচ্ছি,
আর ওদের বাবার আনা হাওয়া দিয়ে নতুন কী করলে হাওয়াগুলো নষ্টও হবে
না, আবার
সকলকে চমকেও দেওয়া যাবে, সেইটা যদি ওরা ভেবে বের করতে পারে,
তাহলে সব মাফ। দু’দিন
সময় দিলাম। এর মধ্যে উত্তর চাই, কেমন?”
ভুতু ভুতুম তখন পালাতে পারলে বাঁচে। এমন
সময় রাজামশাই আবার পিছু ডেকে বললেন,
"ও হ্যাঁ,
আর একটা কথা, শুনেছি বাচ্চা ভূতেরা লুকিয়ে লুকিয়ে মানুষের দুনিয়ায় গিয়ে
পড়লে মানুষেরা তাদের আটকে রেখে সারা দিনরাত ধরে অঙ্ক কষায়। গিয়ে
দেখবে নাকি একবার?"
আর ভুতু ভুতুম দাঁড়ায় ওখানে!
কোনোমতে দু’দিকে মাথা নেড়ে মা বাবার হাত ধরে একছুটে দে দৌড়।
রাজকন্যের জন্মদিনের উৎসব। সারা
দেশে হইচই পড়ে গেছে। ব্যস্ততার আর শেষ নেই।
জন্মদিনের সাত দিন আগে থেকে দেশশুদ্ধু ভূতের নেমন্তন্ন।
খেতে পারুক আর নাই পারুক,
জন্মদিনে জম্পেশ ভোজ না হলে হয়!
দেখে, শুঁকেও তো আনন্দ। ভোজ
হবে, গানবাজনা
হবে, নাচানাচি
হবে, রঙবেরঙের
বাজি ফাটানো হবে, সাতসতেরো
জিনিসের হট্টমেলা বসবে, বিশাল মাঠে যাত্রাপালার আসর বসবে,
রাজকন্যাকে উপহার দেওয়া হবে,
কতদিন বাদে অন্য গাঁয়ের ভূতেদের সঙ্গে দেখা হয়ে চারটে সুখ দুঃখের
কথা হবে... তবে
না বলবে সকলে, উৎসব
হচ্ছে! যেদিকে
তাকাও সেদিকেই যেন খুশির বান এসেছে।
সবই ঠিকঠাক, কিন্তু ভুতু ভুতুমের মা কিছুতেই যেন ঠিক নিশ্চিন্ত হতে পারে না।
সেই যে রাজামশাই ভুতু ভুতুমকে সেদিন অমন গুরুদায়িত্ব দিলেন, পরদিনই বাচ্চা দুটো বিকেল বিকেল
ঘুম থেকে উঠে ঘুড়ি নিয়ে সোজা রাজপ্রাসাদে চলে গেল। কী
উপায় ভেবে রাজামশাইকে বলেছে ওরা কে জানে,
রোজ রাতে পাঠশালা থেকে ফিরে ওদের খেলার দলের সঙ্গীসাথীদের নিয়ে
ওদের বাবার অফিসে চলে যায়, সেখানে নাকি খুব গুরত্বপূর্ণ গোপন কাজ হচ্ছে, কাউকে বলা বারণ নাকি! ওদের বাবাও হয়েছে তেমনই, কতবার করে জিজ্ঞাসা করেছে, কিন্তু একটি কথাও বার করতে
পারেনি।
একসপ্তাহ ধরে খুব হইহুল্লোড় হল। তারপর
উৎসবের শেষ রাত, জন্মদিনের
রাত। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে
রয়েছে রাজকন্যাকে দেখার জন্য। ঠিক
রাত বারোটায় রাজপ্রাসাদের সিংহদুয়ার খুলে গেল। নীল
ভেলভেটের উপরে সোনা রুপোর জরির কাজ করা গালিচার উপর দিয়ে রাজকন্যা তাঁর মা-বাবার হাত ধরে বেরিয়ে এলেন।
সঙ্গে সঙ্গে হুউউশ করে একটা মৃদু আওয়াজ। সবাই
চমকে উঠে দেখল ভুতু ভুতুম আর তাদের সঙ্গী বাচ্চা ভূতেরা রাজপ্রাসাদের ছাদে উঠে একের
পর এক স্বচ্ছ কাগজের ফানুস আকাশে ভাসিয়ে দিচ্ছে। ভাসিয়ে
দেওয়ার ঠিক আগে ছোট্ট ছোট্ট ক্যাপসুল ফানুসগুলোর মধ্যে ভরে দিচ্ছে আর অমনি ফানুসগুলোতে
অদ্ভুত এক আলো জ্বলে উঠছে। সমস্ত
ফানুস যখন আকাশে একসঙ্গে এক জায়গায় জড়ো হল,
সবাই অবাক হয়ে দেখল,
আকাশ জুড়ে কী সুন্দর মায়াবী বেগুনি-সবুজ-হলুদ আলো আপনা থেকেই নেচে নেচে কতরকম নকশা তৈরি করছে।
হাজারো তারার ঝিকিমিকি আর ফানুস থেকে আসা নরম আলো একসঙ্গে মিশে
সকলকে ঘিরে রেখেছে। এ কি স্বপ্ন না সত্যি? খানিকক্ষণ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে
থাকার পর ঘোর কাটলে সবাই হই হই করে হাততালি দিতে শুরু করল। হাততালি
থামলে রাজামশাই সকলকে বললেন কেমন করে ভুতু ভুতুমের বাবা আলাস্কার পণ্ডিতের থেকে আলো
মেশানো হাওয়া নিয়ে এসেছেন রাজকন্যার জন্য,
কেমন করেই বা স্কন্ধকাটাদের ষড়যন্ত্র ধরা পড়ে গেছে, কেমন করে ভুতু ভুতুম আর তাদের
বন্ধুরা মিলে এত্তগুলো ফানুস বানিয়েছে, উৎসবের জন্য। শেষে
বললেন, "আমি
স্বার্থপরের মতো শুধু আমার মেয়ের জন্য এই আলো আনার কথা ভেবেছিলাম বটে, কিন্তু এই বাচ্চা ভূত দুটো, ভুতু আর ভুতুমের বুদ্ধির জন্য
এই আলো আমি আজ সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারলাম। আজ
সারা রাত এই আলো আমাদের সব্বার!"
উৎসবের কয়েকদিন পরে, বিশাল এক বাক্স ভর্তি প্রচুর নতুন নতুন রঙিন খেলনা এল ভুতু ভুতুমের
বাড়ি। সঙ্গে একটা বাঁধানো ছবি, তাতে ভুতু ভুতুমের ফানুস ওড়ানোর
রঙিন ছবি আঁকা। ছবির তলায় লেখা, "আমার নতুন বন্ধুদের
জন্য নিজের হাতে এঁকে পাঠালাম, ইতি - রাজকন্যা।"
ছবিঃ সুকান্ত মণ্ডল
No comments:
Post a Comment