ছোট্ট
ভূতের গল্প
শঙ্কর চ্যাটার্জী
শঙ্কর চ্যাটার্জী
ছোটোবেলায়
আমরা কুলতলার মাঠে ক্রিকেট খেলতে যেতাম। ছোট্ট মাঠ, চারধারে
বুনো কুল গাছে ঘেরা বলে কুলতলার মাঠ বলা হত। রবিবার আর
স্কুল ছুটির দিনে দুপুর থেকে সন্ধে পর্যন্ত আমাদের খেলা চলত।
সেদিনও খেলা
চলছিল, এই
সময় আমার বলে গোবরা একটা ছক্কা হাঁকাল। বল উঁচু হয়ে
গিয়ে পড়ল,
একেবারে জঙ্গলের ভেতর। নতুন
ক্যাম্বিসের বল... আজকেই কেনা। সবাই বলল, গোবরা
মেরেছে আর তুই ফালতু বল করেছিস। তোরা দু’জনে
গিয়ে বল খুঁজে নিয়ে আয়। কাঁটা কুলগাছের ভেতর ঢুকে বল খোঁজা, এক বিরাট শাস্তি। গায়ে কাঁটার
আঁচড় লেগে যায়। কী আর করা যাবে?
দু’জনে
সাবধানে মাথা নিচু করে জঙ্গলের মধ্যে সেঁধোলাম। ছোটো ছোটো
বন কুল অসংখ্য ধরে রয়েছে, কিন্তু যা টোকো মুখে দেওয়া যায় না। আমি বল পড়ার
জায়গাটা দেখেছিলাম। আন্দাজমতো সেই জায়গায় হামাগুড়ি দিয়ে এলাম। জায়গাটা
স্যাঁতসেঁতে, ডালপালা আর পাতার জন্যে স্থানটা আলো আঁধার মাখামাখি।
বলটার জন্যে
এদিক ওদিক তাকাচ্ছি, হঠাৎ চোখে পড়ল... ওমা এ কী! সামনে একটা ছোটো ছেলে, খালি
গায়ে হাফ প্যান্ট পরে মাথা নিচু করে বসে আছে! ঝাঁকড়া চুলে কাঠ কুটি লেগে আছে। এ আবার কে
রে? গোবরাটা
অন্যদিকে খুঁজছে।
“তুই কে রে? এই
কাঁটার ঝোপে বসে কী করছিস?”
রোগা হাড়
গিলগিলে ছেলেটা আমার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইল।
“কী রে,
কালা নাকি?”
“বসে আছি,”
মিনমিনে গলা।
“এটা কি
বাড়ির রক?
এইরকম জায়গায় কেউ বসে থাকে?”
“কী করব
ভেবে পাচ্ছি না! মা না এলে যাব কী করে? এখানকার পথ ঘাট কিচ্ছু চিনি না যে...!”
সন্দেহ হল, ছিঁচকে
চোর-টোর নয়তো?
ভাবলাম বেরিয়ে গিয়ে বন্ধুদের ডেকে আনি। মাথায় এল, আমাদের বলটা আবার পকেটে পোরেনি তো?
“আমাদের
বলটা দেখেচিস?”
“সে আমি এক
মিনিটে খুঁজে দিতে পারি।”
বলে কী
শুঁটকো!
“বাহ্, তোর
তো খুব চোখের জ্যোতি!”
“রাতে আরও
বাড়ে।”
কথাটা কী
রকম মনে লাগল...। আমাদের চোখের জোর রাত্রে কমে যায়, আর
এ বলে কিনা...।
“তোর নাম কী?”
“বেঁচে
থাকতে নাম ছিল,
ভুলু।”
আবার খটকা
লাগল।
“বেঁচে
থাকতে মানে?
তুই কি মরে গেছিস নাকি?”
“গেছিই তো!
কয়েকদিন আগে পুকুরে ডুবে।”
এবার আমার
মুখ শুকনো হল। তবু এখনও সূর্যের আলো আছে, গোবরা
কাছাকাছি আছে,
বন্ধুরা মাঠেই রয়েছে।
“ইয়ার্কি
হচ্ছে? এখনই
একটা গাঁট্টা দোব মাথায়।”
ছেলেটা এবার
খিল খিল করে হাসল।
“পারবেই
না... এখন তো আর তোমার মতো আমার শরীর নেই...।”
সত্যি ভূতের
পাল্লায় পড়লাম নাকি? ও সত্যি বলছে কিনা আমায় পরখ করে দেখতে হবে!
“বেশ দেখি, তুই
সত্যি বলছিস কিনা একটা পরীক্ষা করি... আমাদের বলটা খুঁজে দিতে পারবি?”
“এ আবার
একটা পরীক্ষে হল? ঐ তো তোমার ডান পাশে, কুল গাছে
আটকে আছে!” আঙ্গুল তুলে দেখাল! হ্যাঁ তাই তো... লাল বলটা আটকে আছে! ম্যাজিক জানে
নাকি? সকালে
তো ভূত দেখা যায় না? নিশ্চয়ই ব্যাটার কোনও অভিসন্ধি আছে!
“যাক, এবার
আমার সঙ্গে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে চল... খুব মশা আছে।”
ও বসে থেকেই
কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, “না গো দাদা, এখান থেকে চলে গেলে মা এসে
খুঁজে পাবে না। আমি তো ছোটো, সবে ভূত হয়েছি! এখনও এদের সব ব্যাপার
স্যাপার সড়গড় হয়নি! দেখ না, অদৃশ্য হবার মন্ত্রটাই পুরো মনে নেই!
থাকলে, তুমি
আমাকে দেখতেই পেতে না!”
এবার ওর কথা
শুনে হাসি পেল! এই সময় গোবরার ডাক কানে এল। ও কাছাকাছি
এসে পড়েছে।
হঠাৎ বাচ্ছা
ছেলেটার মুখে হাসি দেখা দিল, “মনে পড়েছে, মনে পড়েছে...” মাথা দুলিয়ে বলল, তারপর বিড়বিড় করে একটা মন্ত্র পড়ল...।
অবাক
কান্ড... চোখের সামনে ওর রোগা দেহটা ধীরে ধীরে আবছা হতে হতে মুছে গেল! ইস... আর
একটু জোরে যদি মন্ত্রটা উচ্চারণ করত! ঠিক শুনে ফেলতুম।
_____
ছবিঃ অতনু দেব
No comments:
Post a Comment