ম্যাজিক ল্যাম্প:: ফেব্রুয়ারি ২০২১

ষষ্ঠ বর্ষ।। দ্বিতীয় সংখ্যা।। ফেব্রুয়ারি ২০২১
বিশেষ অনুবাদ সংখ্যা
---------------------

প্রচ্ছদঃ সপ্তর্ষি দে
--------

সম্পাদকীয়:: ফেব্রুয়ারি ২০২১


ম্যাজিক ল্যাম্পের প্রিয় বন্ধুরা,

কেমন আছ সবাই? আমি জানি ম্যাজিক ল্যাম্পের বন্ধুরা শুধু বাংলা বা ভারতে নয়, বিশ্বের দূর দূরান্তের দেশে ছড়িয়ে এই অতিমারিতে আমাদের সবার জীবন বদলে গেছে অনেকটাই আমরা বাধ্য হয়েছি ঘরে থাকতে, কম মেলামেশা করতে
তবে দেখো, এই আশঙ্কার মেঘ একদিন ঠিক কেটে যাবে ঝলমলিয়ে রোদ উঠবেই শুধু তোমরা এই সময় যে যেমন ভাবে পারো মানুষের পাশে থেকো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিও বন্ধুদের নিয়ে ছোট্ট ছোট্ট দল তৈরি করে তোমরা কিন্তু ঘরে বসেই অনেক কাজ করতে পারো আর এমন কোনো ভালো কাজ করলে ম্যাজিক ল্যাম্পকে জানাতে ভুলো না
ম্যাজিক ল্যাম্প এবারে নিয়ে এসেছে দেশ-বিদেশের এক ঝুড়ি নানা স্বাদের গল্পের ডালি কারণ এটা আমাদের বিশেষ অনুবাদ সংখ্যা আগাথা ক্রিস্টি, আন্তন চেকভ, এইচ জি ওয়েলস, হেক্টর হিউ মুনরো, আর এল স্টাইন, জেকবস, উইলবার মনরো লিফ, ফ্রেডরিক ব্রাউন, অ্যালিস পেরিন, প্যাট্রিক লাফকাদিও হার্ন, ফ্লোরিডোর পেরেজ, রেনে গসিনি, পান্নালাল নানালাল প্যাটেল, এ এল শেলটন, গ্রাসিয়েলা মোন্তেস, শেরিডান লে ফন্যু, টেরি ডেয়ারি প্রভৃতি বিখ্যাত সাহিত্যিকদের গল্প তো আছেই, তার সঙ্গে থাকছে দ্বাত্রিংশৎ পুত্তলিকা থেকে সংস্কৃত গল্পের ভাষান্তর এছাড়া থাকছে বিখ্যাত কবিদের ভাষান্তরিত কবিতা আশা করি এই সংখ্যাটি তোমাদের ভালোবাসা পাবে খুব ভালো থেকো ভালো থাকার চেষ্টা কোরো বন্ধুরা,
আর অন্যকে ভালো রেখো
ইতি,
জিনি
--------
ছবিঃ আন্তর্জাল

গল্পের ম্যাজিক:: ভারি মজা - রেনে গসিনি; অনুবাদঃ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী


ভারি মজা
রেনে গসিনি
অনুবাদঃ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী

সেদিন সকালে স্কুলে যাওয়ার সময়ে পথে অ্যালেকের সঙ্গে দেখা। আমায় দেখতে পেয়েই সে বলল, “এই নিকোলাস, ধর যদি আমরা আজ স্কুলে না যাই?” আমি বললাম, “ওরে বাবা! সে খুব দুষ্টুমির ব্যাপার হবে। স্কুলের স্যার তো রেগে যাবেনই, তাছাড়া বাবা আমাকে বলে, জীবনে বড়ো হতে গেলে, ভালো চাকরি-বাকরি পেতে হলে কঠোর পরিশ্রম করতেই হবে। মা’ও এসব শুনলে পরে খুব দুঃখ পাবে আর মিথ্যে কথা বলা যেহেতু পাপ, কাজেই সেটাও করা যাবে না।” অ্যালেক নাছোড়বান্দা। সে এত কিছু শোনার পরেও বলল, “আজ কিন্তু পাটিগণিতের ক্লাস আছে, মনে রাখিস।” অগত্যা আমায় তার প্রস্তাবে রাজি হতেই হল, স্কুলের পথে আর সেদিন গেলামই না দু’জনে।
বরং আমরা স্কুলের ঠিক উলটোমুখে টেনে ছুট দিলাম। অ্যালেক একটু পরেই হ্যা হ্যা করে হাঁপাতে হাঁপাতে স্টিম ইঞ্জিনের মতো ভসভসিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়তে লাগল। ছুটতে গিয়ে খালি পিছিয়ে পড়ছিল। ওহ, বলা হয়নি, অ্যালেক নামে আমার এই বন্ধুটা বেশ গোলগাল, নাদুসনুদুস। ব্যাটা সবসময় কিছু না কিছু খেয়েই চলেছে। ফলে, দৌড়োদৌড়িতে সে খুব একটা কম্মের নয়। এদিকে আমি আবার চল্লিশ গজ দৌড়ে রীতিমতো ওস্তাদ। চল্লিশ গজ মানে আমাদের স্কুলের মাঠ যতটা লম্বা আর কী!
আমি তাড়া লাগাই ওকে, “আরে জলদি ছোট, অ্যালেক!”
“আমি এর চেয়ে জোরে আর পারব না রে!” এই কথা বলে অ্যালেক আরও কিছুটা হাঁপিয়ে-টাপিয়ে একেবারে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমি ওকে যতই বলি এখানে এভাবে দাঁড়ানোটা ঠিক না। যে কোনও সময়ে আমাদের মা-বাবারা দেখে ফেললেই কেলেঙ্কারির একশেষতারপর আর আমাদের লোভনীয় পুডিংও খেতে দেবে না, ওদিকে সেই ভয়ানক স্কুল পরিদর্শক মশাই ধরতে পারলে আমাদের নির্ঘাত জেলে পুরবে। তারপর কেবল শুকনো রুটি আর জল খেয়েই দিন কাটাতে হবে। ঐসব খাওয়ার কথা শুনেই কিনা কে জানে, অ্যালেক ব্যাটা এমন জোরে দৌড়াতে লাগল, যে এবার আমিই ওর সঙ্গে তাল মেলাতে পারছিলাম না।
বেশ খানিকটা ছুটে মা যেই দোকান থেকে আমার প্রিয় স্ট্রবেরি জ্যামটা কেনে, ঠিক সেই মুদি দোকানটা পেরিয়ে গিয়ে আমরা থামলাম“এখানে আমরা নিরাপদ, কী বলিস!” অ্যালেক বলল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সে পকেট থেকে কিছু বিস্কুট বের করে খেতে আরম্ভ করল। কারণ, তার মতে নাকি, ভাত খাওয়ার পর ছুটোছুটি করলেই তার ভীষণ খিদে পেয়ে যায়।
“মতলবটা ভালোই ফেঁদেছিস অ্যালেক! যখনই ভাবছি বাকিরা সব এখন স্কুলে বসে কঠিন কঠিন পাটিগণিতের অঙ্ক কষছে, হাসতে হাসতে আমার পেটে প্রায় খিল ধরে যাচ্ছে।”
“আমারও রে”, অ্যালেক বলল। আমরা দু’জনে মিলে আরও একচোট হাসলাম। হাসি-টাসি থামলে অ্যালেককে জিজ্ঞেস করলাম, “এবার কী করা যায় বল তো?”
“কিচ্ছু মাথায় আসছে না,” একটু থেমেই ফের অ্যালেক বলল, “সিনেমা দেখতে যাবি?”
খাসা বুদ্ধি। তবে মুশকিল একটাই, সিনেমা দেখার পয়সা আমাদের কাছে ছিল না। দু’জনের পকেট ঝেড়েঝুড়ে সাকুল্যে কয়েকটা সুতো, মার্বেলের গুলি, দুটো গুলতির ফিতে আর ক’টা চিনেবাদাম বেরোল। চিনেবাদামগুলো বলাই বাহুল্য অ্যালেকের পকেটে ছিল আর সে পত্রপাঠ সেগুলো গলাধঃকরণ করল। আমি বললাম, “আচ্ছা বেশ, হতাশ হওয়ার কিছু নেই। সিনেমা নাই বা দেখা হল, তবু বাকি সবার চেয়ে আমরা আজ ঢের মজায় আছি।”
“সে আর বলতে! যাই হোক, এমনিতেও আমার ঐ পবনচাঁদের প্রতিশোধ দেখার খুব একটা শখ ছিল না।”
“যা বলেছিস, আমারও ইচ্ছে ছিল না। মানে, কী সব বস্তাপচা সিনেমা, ছোঃ!” আমিও অ্যালেকের কথায় সায় দিলাম।
তারপর আমরা গটগটিয়ে সিনেমা হলের সামনে দিয়ে হেঁটে বেরিয়ে গেলাম। দেয়ালের পোস্টারগুলোর মধ্যে একটা জনপ্রিয় কার্টুন সিনেমার বিজ্ঞাপনও ছিল বটে, তবে সেদিকে আমরা আর তাকালাম না।
“আচ্ছা, ঐ গোল বাগানটায় গেলে কেমন হয়? কাগজের বল বানিয়ে বেশ খেলা যাবে,” আমি প্রস্তাব দিলাম। অ্যালেক বলল, “মন্দ বলিসনি। তবে সেখানেও একটা সমস্যা আছে। বাগানের টহলদার লোকটা আমাদের দেখে ফেললে যদি জিজ্ঞেস করে আমরা স্কুলে না গিয়ে ওখানে কী করছি, তখন তো ধরা পড়ে যাব। তারপর আমাদের সেই কোন একটা ছোট্ট ঘরে তালাচাবি দিয়ে বন্দি করে রেখে দেবে, আর স্রেফ রুটি-জল খেতে দেবে।” ঐ পরিস্থিতির কথা ভেবেই অ্যালেক ক্ষুধার্ত হয়ে পড়ল। ব্যাগের ভিতর থেকে একটা চিজ স্যান্ডউইচ বের করে গপগপিয়ে খেতে খেতেই হাঁটতে শুরু করল। রাস্তা ধরে চুপচাপ অনেকটা চলে আসার পর অ্যালেকের স্যান্ডউইচ খতম হল, তখনই সে বলল, “আচ্ছা স্কুলে বাদবাকি ছেলেগুলো তো তেমন মজা করতে পারছে না, বল?”
“আরে না না। এমনিতেও এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে, এখন স্কুলে গেলে নির্ঘাত আমাদের শাস্তি দেবে,” আমি তাকে আশ্বস্ত করি।
সামনে বেশ ক’টা দোকান ছিল। তাদের কাচের জানলার দিকে আমরা একদৃষ্টে চেয়ে ছিলাম। অ্যালেক একটা রেস্তোরাঁর মেনুতে যা যা লেখা ছিল সব দেখে দেখে গড়গড় করে পড়ে শোনাতে থাকল আমায়। তারপর ঐ সুগন্ধী আতর আর প্রসাধনী জিনিসের দোকানের কাচে আমাদের ছায়া দেখে দু’জনেই কিম্ভূতকিমাকার সব মুখ করে নিজেদের ছায়াকেই ভেংচি কাটতে লাগলাম। তবে সেটাও বেশিক্ষণ করতে পারলাম না, কারণ দোকানের ভিতরের লোকগুলো আমাদের কীর্তি বেশ সন্ধিগ্ধ চোখে দেখছিল। তারা অবাকও হচ্ছিল নিশ্চয়ই। ওখান থেকে এগিয়ে গয়নার দোকানের ঘড়িটার দিকে নজর গেল আমাদের। এখনও কিছুই বেলা হয়নি বলতে গেলে
“দারুণ! বাড়ি যাওয়ার আগে এখনও আমাদের হাতে মজা করার অফুরন্ত সময় রয়েছে,” আমি বললাম। সত্যি বলতে, এই হাঁটাহাঁটি করতে গিয়ে আমরা বেশ কাহিল হয়ে পড়েছিলাম, তাই অ্যালেক বলল, “চল না ভাই, কোথাও বসে দু’দণ্ড জিরিয়ে নিই।”
কাছেই একটা পরিত্যক্ত ফাঁকা জমির মতো ছিল, আশেপাশে কাউকে দেখাও যাচ্ছিল নাওখানে বসাই যায়, ভাবলাম। জায়গাটা বেশ ভালোই। এখানে ওখানে নানা বাতিল জিনিস পড়ে আছে। আমরা পাথর, খোলামকুচি কুড়িয়ে ফাঁকা টিনের কৌটোতে টিপ করে ছুঁড়ে মারতে লাগলাম। তবে সে আর কতক্ষণ ভালো লাগে? বসে পড়লাম মাটিতেই। অ্যালেক আবার ব্যাগ থেকে একটা মাংসের পুর দেওয়া স্যান্ডউইচ বের করে খাওয়া শুরু করল। এই মনে হয় ওর শেষ স্যান্ডউইচ, আর নেই। “ওরা সব এখনও পিলে চমকানো অঙ্ক নিয়ে বসে আছে ক্লাসে, হ্যা হ্যা!” মুখভর্তি খাবার নিয়ে অ্যালেক যেই না এই কথা বলেছে, অমনি আমি চিড়বিড়িয়ে প্রতিবাদ করে উঠি, “মোটেও না! এতক্ষণে টিফিন হয়ে গেছে।”
“হুহ! টিফিন হলেই বা কী? টিফিনবেলায় তুই বুঝি খুব মজা করতিস?”
“তা তো বটেই,” বলেই কে জানে কী হল, আমি ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম।
মুখে যাই বলি, এবার তো মানতেই হবে, এই যে আমরা স্কুল পালিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, তাতে প্রথমে যতটা ভেবেছিলাম তার কিছুই মজা হচ্ছে না। একে করার মতো তেমন কিছু নেই, তার উপর ধরা পড়ার ভয়ে লোকজনের থেকে লুকিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। আর যদি না অ্যালেক হতভাগার সঙ্গে আজ সকালে দেখা হত, আমি তো সোজা স্কুলেই যেতাম, সে যতই পাটিগণিতের ক্লাস থাকুক না কেন। ওর সঙ্গে জুটি বেঁধে না পালালে এতক্ষণে টিফিনবেলায় বাকি বন্ধুদের সঙ্গে আমি হয় মার্বেল গুলি খেলতাম বা চোর পুলিশ খেলতাম।
“আরে অমন ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছিস কেন?” অ্যালেক বিরক্ত হয়ে বলল।
“সব তোর দোষ! তোর জন্য আমি আজ চোর পুলিশ খেলতে পারলাম না। ভ্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ...”
“মানে? আমার দোষ? আমি কি তোকে আমার সঙ্গে আসতে জোর করেছিলাম নাকি?” অ্যালেক খেপে গেল, “বরং তুই যদি না আসতিস তবে আমিও তো আর একা একা কামাই করতাম না আজ! আমিও স্কুল যেতে পারতাম। তাই দোষটা যদি কারও হয়ে থাকে সেটা তোর!”
“ওহ তাই বুঝি?” আমাদের প্রতিবেশী বিলিংস বাবু মাঝেমধ্যে বাবাকে বিরক্ত করলে বাবা যেমন ব্যঙ্গের সুরে ওঁর সঙ্গে কথা বলে, আমি অবিকল সেই সুরটা নকল করে অ্যালেককে বললাম।
“আজ্ঞে হ্যাঁ, তাই!” কী আশ্চর্য, অ্যালেকও অবিকল বিলিংস বাবুর মতো সুরেই জবাব দিল। তারপর আমাদের মধ্যে একটা বেদম হাতাহাতি হল, বাবা আর বিলিংসবাবুর মধ্যেও প্রায়ই যেমনটা হয়ে থাকে।
আমাদের মারপিট শেষ হতেই বৃষ্টি নামল। তখন আমরা পড়িমরি করে ঐ পরিত্যক্ত জমি ছেড়ে দৌড় দিলাম। কাছাকাছি কোনও একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই পেলেই হল। বৃষ্টি ভিজলে মা যা রাগ করে! আমি তো আবার মায়ের কথা একটুও অমান্য করি না, মানে প্রায় কখনওই করি না।
অ্যালেক আর আমি সেই গয়নার দোকানের বড়ো জানলাটার তলায় গিয়ে দাঁড়ালাম। সেখান থেকে দোকানের বড়ো ঘড়িটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি পড়ছিল। আমরা দু’জন একাই দাঁড়িয়েছিলাম সেখানে। নাহ, সত্যি, তেমন কিছু মজাই হল না আজ। কত কী ভেবেছিলাম, হায়। তবে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময়টা না আসা অবধি আমরা বাড়িমুখো হলাম না কিন্তু। অপেক্ষা করলাম সেখানেই।
বাড়ি ফিরতেই মা বলল, আমায় নাকি খুব ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। এতটাই, যে ইচ্ছে করলে আমি পরের দিন স্কুলে না গিয়ে বাড়িতে বিশ্রামও নিতে পারি। সেটা শুনে যখন আমি সজোরে ‘না’ বললাম, মা বেশ অবাকই হল। স্কুলে যাওয়ার এত ইচ্ছা!
ব্যাপারটা আসলে অন্য। পরদিন স্কুলে গিয়ে অ্যালেক আর আমি যখন বাকিদের বলব ‘গতকাল স্কুল কামাই করে আমরা কী মজাটাই না করেছি’ – আর সেই শুনে তারা সব হিংসায় জ্বলেপুড়ে লাল হয়ে যাবে, সেটা ভারি আমোদের ব্যাপার হবে। তোমরা কী বলো?

------
মূল গল্প – Having Fun; লেখক - রেনে গসিনি
------
সংক্ষিপ্ত লেখক পরিচিতিঃ ফরাসী লেখক রেনে গসিনি (১৯২৬ - ১৯৭৭) শিল্পী অ্যালবার্তো ইউদেরজোর সঙ্গে যৌথভাবে জগদ্বিখ্যাত কমিকস চরিত্র অ্যাসটেরিক্সের স্রষ্টা। তিনি একাধারে কমিকস লেখক তথা সম্পাদক হওয়ার পাশাপাশি ছোটোদের জন্য লিখেছেন বেশ কিছু গল্প। Having Fun গল্পটি তাঁর রচিত Nicholas and the gang at school নামে গল্পসংকলন থেকে গৃহীত।
------
ছবিঃ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী এবং আন্তর্জাল

গল্পের ম্যাজিক:: সেই মখমলি খরগোশটা - মার্জারি উইলিয়ামস; অনুবাদ : সুস্মিতা কুণ্ডু


সেই মখমলি খরগোশটা
মার্জারি উইলিয়ামস
অনুবাদ : সুস্মিতা কুণ্ডু

এক ছিল খরগোশ। উঁহু! যে সে খরগোশ নয়, মখমলের নরম মসৃণ তুলতুলে কাপড় দিয়ে তৈরি খরগোশ। যখন একদম নতুন ছিল খরগোশটা তখন যে কী ঝকঝকে ঝলমলে দেখতে লাগত তাকে! আসল খরগোশ যেমন হয় ঠিক তেমনটি, গাবলুগুবলু আর ফুলোফুলো। গায়ের কোটটি সাদা আর বাদামির ছাপে ভরা। সুতো দিয়ে বানানো ছিল তার গোঁফ। কানের ধার বরাবর গোলাপি সাটিনের সুতোর সেলাই দেওয়া।
এক ক্রিসমাসের সকালে একটা ছোট্ট ছেলের ক্রিসমাস স্টকিং-এর ভেতর থেকে উঁকি দিয়ে মখমলি খরগোশ প্রথম দেখল দুনিয়াটাতার দুটি নরম নরম থাবার মধ্যে ছিল বেরি গাছের সবুজরঙা পাতা। দেখলে পরে যে কারোর নজর কাড়তে বাধ্য।
মোজার মধ্যে আরও হরেকরকম মজাদার জিনিস ছিল। বাদাম, কমলালেবু, খেলনা গাড়ি, চকোলেট, আলমন্ড, দম দেওয়া খেলনা ইঁদুর। কিন্তু সবার সেরা ছিল মখমলি খরগোশটিই। খরগোশটা পাওয়ার পর বেশ অনেকটা সময় সেই ছোট্ট ছেলেটা ওটা নিয়েই মেতে রইল। তারপর একে একে সব আত্মীয়স্বজনরা এসে উপস্থিত হল ভোজসভার আয়োজনে। তারপর কতশত উপহারে ভরে উঠল ছোট্ট ছেলেটার হাত। রঙিন কাগজের মোড়ক খুলে সেগুলো দেখতে দেখতে ছেলেটা মখমলি খরগোশটার কথা ভুলেই গেল।
ক্রিসমাস কেটে গেল। তারপর না জানি কতদিন ধরে মখমলি খরগোশটা পড়েই রইল খেলনার তাকে, ছোট্ট ছেলেটার শোবার ঘরে। তার কথা আর কারোর বিশেষ মনেই রইল নাকো। মখমলি খরগোশের স্বভাবটাও ছিল ভারি লাজুক। শুধু কি তাই? নরমসরম মখমলে বানানো বলে অন্য দামি খেলনাগুলোও বড্ড ‘দূর দূর ছি ছি’ করত ওকে। বড়ো বড়ো যন্ত্র দিয়ে বানানো খেলনাগুলো তো নিজেদের না জানি কী মহানটাই ভাবত আর বাকি সব খেলনাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করত। ওরা সব নতুন কলকবজা দিয়ে এমন বুদ্ধি খাটিয়ে গড়া যে আসলের সঙ্গে নাকি কোনো তফাৎই নেই। এমনকি দু’দুটো বছরের পুরোনো রংচটা মোটরবোটটা অবধি দেমাক দেখিয়ে সবসময় খটমট সব যন্ত্রপাতির নাম বলত আর অন্যদের অপমান করত।
বেচারা মখমলি খরগোশ তো আর অমন যন্ত্রপাতি গিয়ে গড়া মডেলটি নয়, তাই কিছুই বলতে পারত না। তার ওপর বেচারা তো জানতই না যে এই দুনিয়ায় আসল খরগোশ বলেও একধরণের প্রাণী সত্যি সত্যিই আছেভাবত সব খরগোশই বুঝি ওর নিজের মতোই পেটে কাঠের গুঁড়ো ঠুসে তৈরি করা হয়েছে। আর এই সব কেরামতির যন্ত্রপাতির হাটে সামান্য কাঠের গুঁড়োর আর কী দামটাই বা আছে, তোমরাই বলো!
এমনকি টিমোথি নামে হাত-পা নাড়ানো কাঠের সিংহটা অবধি দিব্যি গর্ব করত নিজেকে নিয়ে। তাকে আসলে তৈরি করেছিল একজন বুড়ো যুদ্ধফেরত সৈন্য, তাই টিমোথি এমন ভাব করত যেন তার সঙ্গে বুঝি বড়ো বড়ো সরকারি অফিসারদের আলাপ রয়েছে। সব খেলনার মাঝে শুধুমাত্র মখমলি খরগোশই বেচারা নিজেকে বড্ড ক্ষুদ্র তুচ্ছ আর অতি সাধারণ খেলনা মনে করত। একমাত্র চামড়ার একটা ঘোড়া তাও একটুখানি মায়াদয়া করত ওকে, ভালোবাসত।
চামড়ার ঘোড়া এই খেলাঘরের সবচেয়ে পুরোনো বাসিন্দা। এতই তার বয়স হয়েছিল যে গায়ের বাদামি চামড়া জায়গায় জায়গায় চটে গিয়ে তলার সেলাই বেরিয়ে পড়েছিল। লেজের বেশিরভাগ চুলই টেনে ছিঁড়ে নিয়ে পুঁতির মালা গাঁথা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু চামড়ার ঘোড়া ছিল খুব জ্ঞানী। এত বছর ধরে কম যন্ত্রপাতির মডেল খেলনা তো আর দেখেনি সে। একে একে সব আসত, অনেক ফাঁকা আওয়াজ গর্ব করে শেষমেষ স্প্রিং ভেঙ্গে তাদের দফা শেষ হত। চামড়ার ঘোড়া জানত যতই হাঁতডাক করুক ওরা আসলে তো সেই খেলনাই। খেলনার থেকে বেশি আর কিছুই হতে পারবে না ওরা কোনোদিন।
কেন জানো?
কারণ এই খেলাঘরে আছে এক অদ্ভুত সুন্দর জাদু। কেউ জানে না সেটা কী! একমাত্র চামড়ার ঘোড়ার মতো বৃদ্ধ জ্ঞানী আর অভিজ্ঞ খেলনারাই বোঝে সেই রহস্য।

*                          *                          *


“আচ্ছা ‘আসল’ মানে কী গো?” একদিন মখমলি খরগোশ শুধোলো। সেদিন তখনও খেলাঘরের খেলনা গুছোনো হয়নি, তাই চামড়ার ঘোড়া আর মখমলি খরগোশ পাশাপাশিই পড়েছিল দু’জনায়। খরগোশ বলে চলে, “ভেতরে ওই যে যন্ত্রপাতিগুলো নড়াচড়া করে, লম্বা হাতল লাগানো থাকে, ওটাই কি আসল?”
চামড়ার ঘোড়া বলে, “উঁহু! তুমি কীভাবে তৈরি হয়েছ তাই দিয়ে আসল নকল সত্যি মিথ্যে বিচার হয় নাকো। আসল হতে গেলে তোমার ভেতরে একটা কিছুমিছু হওয়া চাই। যখন খেলাঘরের ছোট্ট শিশুটা তোমায় অনেক অনেকদিন ধরে ভালোবাসে, শুধু খেলা নয় কিন্তু, একদম সত্যিকারের ভালোবাসে তখনই তুমি ‘আসল’ হয়ে যাবে।”
খরগোশ ফের শুধোয়, “ওই যে বললে ভেতরে কিছুমিছু হলে পরে তবেই ‘আসল’ হওয়া যায়, তাতে কি ব্যথা লাগে গো?”
চামড়ার ঘোড়া তো আর মিছে কথা কইতে জানে না, তাই সে জবাব দেয়, “হুঁ তা লাগে বৈকি কখনও-সখনও। কিন্তু কী জানো, যখন তুমি ‘আসল’ হয়ে যাবে তখন এই ছোটোখাটো ব্যথাবেদনাতে তোমার কিছুই মনে হবে না।”
খরগোশের কৌতূহল মেটে না তবু। বলে, “আচ্ছা ব্যাপারটা কি অল্প অল্প করে হয় নাকি দুম করে একেবারেই ঘটে যায়?”
চামড়ার ঘোড়া বলে, “না রে বাবা! ওমনি করে হয় না। অনেক অনেক সময় লাগে। ওইজন্যই তো যে সে চাইলেই ‘আসল’ হতে পারে না। যদি অল্পেই ভেঙ্গে যাও বা অন্য খেলনাকে ভেঙে ফেল কিংবা ধরো আলতুসকির মতো তাকে তোলা হয়েই রইলে তাহলে তুমি ‘আসল’ হতে পারবে না। টিকে থাকতে পারলে যদ্দিনে তুমি আসল হবে তদ্দিনে দেখবে তোমার সব চুল ছিঁড়েখুঁড়ে গেছে আদরের চোটে। চোখ খুবলে গেছে, জোড়াতালি সব ঢিলেঢালা হয়ে গেছে, দেখবে একদম লজ্‌ঝড়ে হয়ে গেছ তুমি। কিন্তু যখন তুমি ‘আসল’ হয়ে যাবে তখন এসব কিছুতেই কিছু আসবে যাবে না। যারা তোমায় ভালোবাসে তাদের চোখে তুমি সবসময়ই সুন্দর থাকবে।”
খরগোশ চোখ বড়ো বড়ো করে জিজ্ঞাসা করে, “তার মানে তুমি নিশ্চয়ই আসল?”
বলেই মনে মনে জিভ কাটে। কী জানি চামড়ার ঘোড়া বুঝি কষ্ট পেল মনে। কিন্তু ঘোড়া হেসে জবাব দিল, “হুম। এই ছোট্ট ছেলেটা যার খেলাঘরে আমরা আছি, আমি ছিলুম তার কাকুর খেলনা। সেই আমাকে ‘আসল’ বানিয়েছে।  সে অনেক অনেক বছর আগের কথা। একবার তুমি ‘আসল’ হয়ে গেলে চিরকাল তাই থাকবে। আর কক্ষনো নকল হবে না।”
খরগোশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। না জানি কত মাস কত বছর লাগবে এই আসল জাদু হতে। খরগোশের মনের ভেতরটা ছটফট করছিল জানার জন্য এই ‘আসল’ ব্যাপারটা আসলে কী! হ্যাঁ মানছি ‘আসল’ হতে গেলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। চোখ খোওয়াতে হবে, গোঁফ খোওয়াতে হবে, কিন্তু তবুও খরগোশের বড়ো ইচ্ছে করছিল। আচ্ছা এইসব বিচ্ছিরি জিনিস না ঘটেই যদি ও ‘আসল’ হয়ে যেত তাহলে কী ভালোই না হত! তাই না!

*                          *                          *

বাড়ির ছোট্টছানার এই খেলাঘরটার দেখাশোনা যে করত তাকে সকলে ন্যানা বলে ডাকত। দেখতে গেলে ন্যানাই ছিল এই খেলাঘরের কর্ত্রী। কখনও কখনও ন্যানা খেলাঘর জুড়ে খেলনা ছড়িয়ে থাকলেও নজর করত না। আবার কখনও ঝড়ের গতিতে এসে সব খেলনা কুড়িয়ে ঠুসে ভরে দিত বাক্সের ভেতর। একে নাকি বলে ‘ঘর গুছোনো’! সমস্ত খেলনা এই ‘ঘর গুছোনো’ কাণ্ডটি বড়ো অপছন্দ করত, বিশেষ করে টিনের খেলনাগুলো। অবিশ্যি খরগোশের তাতে বিশেষ কিছু এসে যেত না। কারণ যেখানেই ছোঁড়ো না কেন তাতে নরমসরম খরগোশের মোটেই চোট লাগত না বাপু।
একদিন সন্ধেয় খেলাঘরে ঘটল এক কাণ্ড। ছোট্ট সেই ছেলেটি যখন ঘুমোতে যাচ্ছিল, কিছুতেই তার প্রিয় খেলনা চিনা কুকুরটা খুঁজে পেল না। প্রতি রাতে চিনা কুকুরটাকে জড়িয়ে ধরে না ঘুমোলে ছেলেটার ঘুমই আসে না। এদিকে ন্যানার তখন হাজার কাজের তাড়া। চিনে কুকুর খোঁজার তার সময় কই! তাই ন্যানা হেথা হোথা চেয়ে দেখে সামনের খেলনা বাক্সর খোলা দরজার আড়ালে উঁকি দিল।
“এই নাও, তোমার পুরোনো খেলনা খরগোশটা। আজ এইটে দিয়েই কাজ চালিয়ে নাও।”
এই বলে মখমলি খরগোশের কানটা ধরে টেনে বার করে এনে বসিয়ে দিল ছেলেটার কোলে।
সেই রাতে এবং তার পরে আরও অনেক অনেক রাতে মখমলি খরগোশ জায়গা পেল ছোট্ট ছেলেটার বিছানায়। প্রথম প্রথম খরগোশের বেশ অসোয়াস্তিই হত। ছেলেটা এমন চেপেচুপে জড়িয়ে ধরত ওকে! মাঝে মাঝে তো ঘাড়েই উঠে পড়ত ঘুমের ঘোরে। কখনও আবার বালিশের তলাতেও ঢুকিয়ে দিত খরগোশকে। আর বেচারা খরগোশের তো ওদিকে দমবন্ধ হয়ে আসার জোগাড়
খরগোশের মনটা বড্ড খারাপ করত। চাঁদের আলো বিছানো নিস্তব্ধ খেলাঘরে চামড়ার ঘোড়ার সঙ্গে গল্প করার দিনগুলো খুব মনে পড়ত।
কিন্তু খুব শিগগিরই নতুন এই জীবনটা খরগোশের ভালো লাগতে শুরু করল। ছোট্ট ছেলেটা অনেকক্ষণ ধরে কথা বলত ওর সঙ্গে। বিছানার ওপর চাদর দিয়ে সুড়ঙ্গ বানিয়ে বলত ওগুলো নাকি খরগোশের গর্ত যেখানে ‘আসল’ খরগোশেরা থাকে।
যখন ন্যানা রাতের খাবার খেতে চলে যেত আর ম্যান্টলপিসের ওপর বাতিদানে তিরতির করে জ্বলত মোমবাতি তখন ছোট্ট ছেলেটার সঙ্গে ফিসফিসিয়ে কত মজাদার খেলাই না খেলত খরগোশ। আস্তে আস্তে ছেলেটা ঢলে পড়ত ঘুমে। খরগোশ তখন তার গা ঘেঁষে সরে এসে চিবুকের নিচে মাথা গুঁজে গুটিশুটি দিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্নের রাজ্যে হারিয়ে যেত। ছেলেটাও সারা রাত তার দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে আগলে রাখত খরগোশকে।

*                          *                          *

এভাবেই সময় কেটে যাচ্ছিল। মখমলি খরগোশ বড়ো আনন্দে ছিল। এতই আনন্দে ছিল যে খেয়ালই করেনি কখন তার মখমলের গা খসখসে রুক্ষ নষ্ট হয়ে এসেছে। লেজের সেলাইটা খুলে গেছে। এমনকি নাকের ঠিক যেখানটায় ছেলেটা চুমু খায় সেখানের গোলাপি রঙটাও চটে গেছে।
অবশেষে বসন্ত এল। দিনগুলো লম্বা হতে শুরু করল। অনেকটা সময় ছেলেটার পিছু পিছু বাগানেই কেটে যায় খরগোশের। কখনও ঠ্যালাগাড়িতে চাপে, কখনও ঘাসের ওপর বসে পিকনিক করে। কখনও বা ফুলবাগানের সীমানায় র‍্যাস্পবেরি ঝোপের আড়ে বানানো ছোট্ট ছোট্ট পরিদের খেলনাবাড়িতে খেলা করে।
একদিন হল কী, হঠাৎ করেই বাড়ির ভেতর থেকে জলখাবার খাওয়ার ডাক আসতে ছেলেটা তাড়াহুড়োয় মখমলি খরগোশকে লনে ফেলে রেখেই উঠে চলে গেল। বিকেল গড়িয়ে আঁধার নামল। খরগোশ একা পড়ে রইল সেথায়। অবশেষে ন্যানা একটা বাতি নিয়ে খুঁজতে এল ওকে। ছোট্ট ছেলেটা আবার আদরের খরগোশটাকে ছাড়া ঘুমোতে পারে না কিনা।
ওদিকে বেচারা খরগোশ শিশিরে ভিজে জবজবে। ফুলবাগানে ছেলেটা তার জন্য খরগোশের গর্ত বানিয়েছিল,  সারা বিকেল তাইতে খেলে মাটি মেখে একশা। ন্যানা গজগজ করতে করতে নিজের অ্যাপ্রনের কোণটা দিয়ে খরগোশকে ঝেড়েঝুড়ে সাফ করতে শুরু করল।
“এই পুরোনো খরগোশটা না হলে চলে না বুঝি? একটা খেলনা নিয়ে এত আদিখ্যেতার কী আছে বুঝিনে বাপু!”
ছেলেটা বিছানায় উঠে বসে হাত বাড়িয়ে বললে, “দাও দেখি আমার খরগোশটাকে। আর একদম বলবে না এটা খেলনা। ও আমার সত্যি সত্যি ‘আসল’ খরগোশ।”
ছোট্ট খরগোশের কানে যখন কথাগুলো গেল সে ভারী খুশি হল। তার মানে চামড়ার ঘোড়া যা যা বলেছিল সব সত্যি। খেলাঘরের জাদু মখমলি খরগোশের ওপরেও হয়েছে। আর মোটেই ও খেলনা নেই। ও সত্যি সত্যি ‘আসল’ খরগোশ। ছোট্ট ছেলেটা নিজের মুখেই এই কথা বলেছে।
সেই রাতে আনন্দের চোটে খরগোশের চোখে ঘুমই আসে না। ওর কাঠের গুঁড়োর তৈরি ছোট্ট হৃৎপিণ্ডটা এত্ত এত্ত ভালোবাসায় ভরে উঠেছে যে মনে হচ্ছে যেন এক্ষুনি বুঝি ফেটেই যাবে। বোতাম দিয়ে তৈরি চোখজোড়া কবেই পালিশ চটে ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে গিয়েছিল। সেই চোখদুটোও যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, কত অনুভূতি উঁকি দিচ্ছে তাতে। এমনকি পরের দিন সকালে যখন ন্যানা খরগোশকে হাতে নিল সেও বলে উঠল, “পুরোনো খরগোশটার চোখজোড়া বাপু, যাই বলো না কেন বেশ জ্ঞানীগুণী দেখতে লাগছে।”

*                          *                          *


দেখতে দেখতে গ্রীষ্মকাল এসে গেল। যে বাড়িটায় ওরা সকলে থাকত তার কাছেই ছিল একটা জঙ্গল। জুন মাসের লম্বা দিনের শেষে যখন বিকেল নামত তখন ছোট্ট ছেলেটা চা জলখাবার সেরে খেলতে যেত সেখানে। মখমলি খরগোশকেও নিয়ে যেত সঙ্গে। ঝোপের আড়ালে একটা ছোট্ট বাসা বানিয়ে খরগোশকে সেখানে রেখে তবেই খেলতে যেত ছেলেটা। ছোট্ট ছেলেটার মনে যে বড়ো মায়া। নিজের প্রিয় খরগোশটাকে একটা বেশ আরাম-নরম জায়গায় থিতু করে তবেই যেত খেলতে। কত রকম খেলাই না খেলত সে। কখনও গাছের আড়ালে চোরপুলিশ খেলে, কখনও বা ফুল তোলে গাছের।
এমনই এক সন্ধেয় মখমলি খরগোশ মাটিতে একা একা শুয়ে পিঁপড়েদের আনাগোনা দেখছিল। ওর হাতের থাবার মধ্যে দিয়ে পিলপিলিয়ে এদিক সেদিক করছিল পিঁপড়ের দল। এমন সময় হঠাৎই চোখে পড়ল, দুটো অদ্ভুতদর্শন কী যেন চুপিচুপি বেরিয়ে এল পেছনের লম্বা ফার্নের ঝোপটা থেকে।
জীবদুটোকে দেখতে মখমলি খরগোশেরই মতো এক্কেবারে, কিন্তু তাদের গায়ে ঘন লোম, একদম চকচকে নতুনের মতোনিশ্চয়ই কেউ খুব যত্ন নিয়ে বানিয়েছে ওদের। সেলাইটুকুও দেখা যাচ্ছে না। যখন নড়াচড়া করছে তখন ওদের হাত পা গোটা শরীর কেমন যেন আকার বদলাচ্ছে। এই একবার লম্বা আর সরুপানা তো পরক্ষণেই মোটাসোটা গুবলুগাবলু। মখমলি খরগোশের মতো সবসময় একই রকম চেহারা তাদের নয়। মাটির ওপর তাদের নরম গদিওয়ালা পাগুলো ফেলে চুপিসারে মখমলি খরগোশের এক্কেবারে কাছে চলে আসছিল ওরা। পুচকে নাকগুলো কোঁচকাচ্ছিল মাঝে মাঝে। ওদিকে মখমলি খরগোশ ওদের দম দেওয়ার চাবিটা কোনখানে আছে সেটা খোঁজার প্রাণপণ চেষ্টা করছিল। কারণ এরকম লাফিয়ে লাফিয়ে যে খেলনা চলে তাদের দম দেওয়ার একটা না একটা ব্যবস্থা তো থাকতেই হবে। কিন্তু হাজার চেষ্টা করে কিছুই চোখে পড়ল না। এগুলো নির্ঘাৎ নতুন কোনও প্রজাতির খরগোশ।
ওদিকে নতুন খরগোশগুলোও হাঁ করে চেয়ে রইল মখমলি খরগোশের দিকে। মখমলি খরগোশও ঘুরে চায় ওদের পানে। নতুন খরগোশগুলো সারাক্ষণই তাদের পুচকে নাকটা কুঁচকোতে থাকে। হঠাৎ তাদের একজন শুধোলো, “এইয়ো! তুমি উঠে এসে আমাদের সঙ্গে খেলা করছ না কেন?”
মখমলি খরগোশ জবাব দিলে, “আমার এখন খেলতে ইচ্ছে করছে না।”
আসলে হয়েছে কী, লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে খেলতে গেলে তো দম দেওয়া চাবি স্প্রিং এসব থাকা চাই। মখমলি খরগোশের যে সে সব নেই সেটা নতুন খরগোশদের কাছে মোটেই স্বীকার করতে মন চাইছিল না।
“আরে! এ তো খুব সহজ খেলা খেলছি আমরা,” বলে উঠল লোমওয়ালা একটা খরগোশ। তারপর পাশের দিকে একটা লম্বা লাফ দিয়ে পেছনের পায়ে ভর রেখে খাড়া হয়ে দাঁড়াল। তারপর ফের বলল, “তুমি এইটাও করতে পারবে না?”
মখমলি খরগোশ বলল, “কেন পারব না? আমি ওর চেয়েও ঢের ঢের উঁচুতে লাফাতে পারি।”
আসলে ব্যাপারটা হল যখন ছোট্ট ছেলেটা ওকে লুফে লুফে খেলা করে তখন তো মখমলি খরগোশ অনেকটা উঁচুতেই লাফায়, তাই না? তবে সে রহস্যটা আর নতুন খরগোশদের কাছে ফাঁস করল না ও।
লোমওয়ালা খরগোশটা আবার জিজ্ঞাসা করে, “তুমি পেছন পায়ে ভর দিয়ে লাফাতে পারো?”
এবার বেচারা মখমলি খরগোশ পড়ল বেকায়দায়। ওর তো পেছনের পা বলে আলাদা করে কিছু নেই। একটা বালিশের মতোই গোটাটা একসঙ্গে জুড়ে বানানো। আর উপায় না দেখে মখমলি খরগোশ শেষমেশ চুপটি করেই বসে রইল ঝোপের নিচে। মনে মনে ভাবতে লাগল নতুন খরগোশরা যেন কিছুতেই না দেখে ফেলে ওর পেছনের এই অবস্থাটা। কোনোমতে বলল, “আমার ইচ্ছে করছে না লাফাতে।”
কিন্তু বুনো খরগোশগুলোও ছেড়ে দেওয়ার বান্দা নয়। ওদের নজর ভারী তীক্ষ্ণ কিনা। একজন গলা বাড়িয়ে দেখে চেঁচিয়ে উঠল, “আরে আরে! এই খরগোশটার তো পেছনের পা-ই নেই। ভাবো! খরগোশের কিনা পেছনের পা নেই! এমনধারা কাণ্ড জীবনে শুনিনি বাপু!”
তারপর হো হো করে হাসতে শুরু করল।
বেচারা মখমলি খরগোশ নিরুপায় হয়ে চিৎকার করল, “আছে আছে, একশোবার আছে! আমার পেছনের পা থাকবে না কেন! আমি তো পেছনের পা-দুটোর ওপরেই বসে আছি।”
বুনো খরগোশ বললে, “তাহলে পা-জোড়া লম্বা করে বার করে দেখাও দেখি আমায়। এই এমনি করে...”
এই বলে সে পাক খেয়ে খেয়ে নাচতে শুরু করল। তাই দেখে তো মখমলি খরগোশেরই মাথা ঘোরার জোগাড়। বলল, “আমার নাচ করতে ভালো লাগে না। আমি এই বসেই আছি দিব্যি আছি!”
কিন্তু মুখে বললে কী হবে, মখমলি খরগোশের ভেতরে ভেতরে নাচ করতে ভারী সাধ হচ্ছিল। মনের মধ্যে একটা যেন কী তিড়িংবিড়িং করছিল। দুনিয়ার সব কিছুর বিনিময়েও ও যদি এই খরগোশগুলোর মতো লাফালাফি নাচানাচি করতে পারত তাইতেই রাজি হয়ে যেত বুঝি ও।
বুনো খরগোশটা অবশেষে নাচ থামিয়ে মখমলি খরগোশের গা ঘেঁষে এল। এতটাই কাছাকাছি এল যে ওর লম্বা লম্বা গোঁফগুলো মখমলি খরগোশের কানে খোঁচা দিতে লাগল। তারপর হঠাৎই সেই বুনো খরগোশটা নাক কুঁচকে কান খাড়া করে পিছিয়ে গেল লাফ দিয়ে।
“উঁহু! এর গন্ধটা তো সুবিধের ঠেকছে না!” চেঁচিয়ে বলল, “এটা তো নকল। এটা মোটেই আসল খরগোশ নয়!”
 ছোট্ট মখমলি খরগোশ বলে উঠল, “আমি আসল! আমি আসল! আমায় ছোট্ট ছেলেটা বলেছে আমি আসল!”
কান্নায় গলা বুজে আসতে লাগল মখমলি খরগোশের।
ঠিক এমন সময়ই কার যেন পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। ছেলেটা ওদের খুব কাছ দিয়েই ছুটে গেল। সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে চোখের পলকে সেই বুনো খরগোশ দুটো অদৃশ্য হয়ে গেল ফার্নের ঝোপের আড়ে। তাদের সাদা লেজের ডগাটুকু এক ঝলকেই মিলিয়ে গেল।
“ফিরে এসো! আমার সঙ্গে খেলা করবে এসো! ফিরে এসো! আমি জানি আমি আসল খরগোশ!” চিৎকার করে উঠল ছোট্ট খরগোশ।
কিন্তু আর কেউ কোনো উত্তর দেয় না। শুধু পিঁপড়েগুলো আগের মতো হেথা হোথা চলে বেড়ায়। আর যে ফার্নের ঝোপের আড়ালে বুনো খরগোশ দুটো মিলিয়ে গিয়েছিল সেই ঝোপটা আলতো করে মাথা নাড়িয়ে দুলতে থাকে। মখমলি খরগোশ এক্কেবারে একা বসে থাকে। মনে মনে ভাবতে থাকে, “ইসস! ওরা কেন ওমনি করে ছুট্টে পালাল! কেন দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে কথা কইল না আমার সঙ্গে?”
অনেকক্ষণ ধরে মখমলি খরগোশ স্থির হয়ে পড়ে রইল। চেয়ে রইল ঝোপের দিকে। যদি বুনো খরগোশগুলো আবার ফিরে আসে এই আশায়। কিন্তু কেউ আর ফিরে এল না। আস্তে আস্তে সূয্যি ডুবতে লাগল। ক্ষুদে ক্ষুদে সাদা মথ পাখা নেড়ে উড়ে বেড়াতে লাগল। ছেলেটা ফিরে এসে মখমলি খরগোশকে তুলে নিয়ে হাঁটা দিল বাড়ির দিকে।

*                          *                          *

হপ্তার পর হপ্তা গড়িয়ে গেল। মখমলি খরগোশ খুউউব পুরোনো আর রঙচটা ঝরঝরে হয়ে এসেছে প্রায়। তবুও ছোট্ট ছেলেটা তাকে ঠিক আগের মতো ততটাই ভালোবাসে। সারাক্ষণ আদর করে করে খরগোশের প্রায় সব গোঁফই ঝরে গেছে। কানের গোলাপি সুতোর সেলাই একদম ধূসর হয়ে গেছে। গায়ের বাদামি বুটিগুলোও ফ্যাকাশে হয়ে এসেছে।
চটকে-মটকে খরগোশটার চেহারাও আর আগের মতো নেই। একমাত্র ছোট্ট ছেলেটা ছাড়া অন্য কেউ ওকে দেখলে চট করে বলতে পারবে না যে কোনোকালে ও একটা মখমলি খরগোশ ছিল। অবিশ্যি ছোট্ট ছেলেটার চোখে মখমলি খরগোশ সবসময়ই সুন্দর তা সে যত পুরোনোই হোক না কেন। আর কী-ই বা চাই মখমলি খরগোশের! এতেই সে খুশি। অন্য লোকে তাকে দেখে কী বলে কী ভাবে তাতে কিছুই মনে করে না সে। খেলনাঘরের জাদুতে সে যে ‘আসল’ হয়ে গেছে। আর একবার কেউ ‘আসল’ হয়ে গেলে আর কিছুতেই কিছু যায় আসে না।

*                          *                          *


একদিন হঠাৎ করে ছোট্ট ছেলেটা খুব অসুস্থ হয়ে পড়ল। চোখ মুখ লাল হয়ে যেতে শুরু করল, ঘুমের মধ্যেও ভুল বকতে লাগল। আর তার ছোট্ট শরীরটা এত গরম হয়ে যেত যে খরগোশকে জড়িয়ে ধরলে মনে হত যেন আগুনের ছ্যাঁকা লাগছে।
কারা যেন সব আসতে লাগল রোজ রোজ। ছোট্ট ছেলেটার ঘরে তারা যেত। সারা রাত একটা আলো জ্বলত তার ঘরে। মখমলি খরগোশ বিছানার একগাদা চাদরের মধ্যে লুকিয়ে পড়ে পড়ে সব দেখত। একটুও নড়ত না। মখমলি খরগোশ ভয় পেত নড়াচড়া করলে পাছে অন্যরা ওকে খুঁজে পেয়ে যায় আর দূরে কোথাও নিয়ে চলে যায়! ও যে এখন কিছুতেই ছোট্ট ছেলেটাকে ছেড়ে কোত্থাও যেতে পারবে না। ছেলেটার বড্ড প্রয়োজন এখন মখমলি খরগোশকে।
সময়টা মোটেই ভাল যাচ্ছিল না। দিনগুলো যেন বড্ড ক্লান্ত। ছেলেটার শরীর খুব খারাপ, তাই খেলতেও পারছিল না একদম। মখমলি খরগোশের দিন যেন কাটতেই চাইছিল না। সারাদিন কিছুই করার নেই। তবুও খরগোশ ধৈর্য ধরে গুটিশুটি দিয়ে পড়েছিল। শুধু মনে মনে আশা করত কবে সেই দিনটা আসবে যেদিন ছেলেটা আবার সুস্থ হবে। দু’জনায় একসঙ্গে বাগানে যাবে। র‍্যাস্পবেরি ঝোপের আনাচে-কানাচে ফুল প্রজাপতিদের সঙ্গে জমিয়ে খেলা করবে আবার আগের মতো
কত্তরকম মজাদার মজাদার জিনিস করবে বলে ভেঁজে রেখেছে খরগোশ। ছেলেটা যখন আধেক ঘুমে আধেক জেগে শুয়ে থাকে, খরগোশ তখন চুপিসারে বালিশের পাশে গিয়ে তার কানে কানে সব ফিসফিসিয়ে বলে।
আস্তে আস্তে ছেলেটার জ্বর কমে আসে, সুস্থ হয়ে ওঠে সে। এখন সে ধীরে ধীরে বিছানায় উঠে বসে ছবির বইয়ের পাতা উলটোতে পারে। মখমলি খরগোশও ওর গা ঘেঁষে এসে বসে থাকে। তারপর একদিন অবশেষে ছোট্ট ছেলেটা বিছানা ছেড়ে উঠে নতুন জামাকাপড় পরে। রোদ ঝলমলে একটা সকাল, জানালাগুলো সব হাট করে খোলা। ছেলেটাকে বাড়ির সকলে বারান্দায় এনে বসিয়েছে। গায়ে তার একটা গরম শাল মোড়া। ওদিকে খরগোশ বিছানার চাদরের মধ্যে জড়িয়ে-মড়িয়ে পড়ে ভাবতে থাকে।
ছোট্ট ছেলেটাকে পরের দিন সমুদ্রের ধারে নিয়ে যাওয়ার কথা হাওয়াবদলের জন্য। সবকিছুই ঠিক করা আছে, শুধুমাত্র ডাক্তারের নির্দেশের অপেক্ষা। সকলে সেই নিয়েই আলোচনা করছে। খরগোশ চাদরের তলায় পড়ে পড়ে সবকিছুই শুনতে পাচ্ছিল উঁকি দিয়ে।
সারা ঘর নাকি জীবানুমুক্ত করতে হবে। আর সমস্ত খেলনা আর বই যা কিছু নিয়ে ছেলেটা খেলত সব নাকি পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
মখমলি খরগোশ ভাবলে, “কী মজা! আমরা সমুদ্রের ধারে বেড়াতে যাব! হুররে!”
ছোট্ট ছেলেটা প্রায়ই সমুদ্রতীরের গল্প করত। সেই শুনে শুনে খরগোশের খুব মনে ইচ্ছে ছিল একদিন দেখবে কেমন করে বড়ো বড়ো ঢেউ আসে। দেখবে ছোট্ট কাঁকড়ার দল, বালির প্রাসাদ!
এসব যখন ভেবে চলেছে, ঠিক এমন সময়ই ন্যানার চোখে পড়ে গেল মখমলি খরগোশটা। ন্যানা জিজ্ঞেস করল, “এই পুরোনো খরগোশটার কী হবে?”
“এটা? এটা তো হাম-জ্বর বালাই-এর জীবাণুতে থিক থিক করছে নির্ঘাৎ। কী মুশকিল! শীগগির পোড়াও এটাকে আগে। একটা নতুন খেলনা কিনে দিও বরং, ভুল করেও এই খেলনা খরগোশটা দিও না যেন ওকে।”
অগত্যা ছোট্ট মখমলি খরগোশকে বাকি বইপত্তর আর ঢেয়ো-ঢাকনার সঙ্গে পুরে দেওয়া হল একটা বস্তার ভেতর। তারপর সেই বস্তাটাকে নিয়ে গিয়ে বাগানের একদম শেষ প্রান্তে মুরগির ঘরের পেছনে রেখে আসা হল। ওখানেই একটা আগুন জ্বালানোর জায়গা করা আছে। মালির হাত খালি হলেই বস্তাভরা জিনিসগুলোর গতি করবে। মালি তখন মাটি খুঁড়ে আলু বার করছিল আর মটরশুঁটি তুলে জড়ো করছিল। কিন্তু পরের দিন সকালেই তাড়াতাড়ি এসে বস্তাটাকে পোড়াবে জানাল মালি
সেই রাতে ছোট্ট ছেলেটা একটা অন্য ঘরে শুল। শুধু তাই নয়, নতুন একটা খেলনা খরগোশ তাকে দেওয়া হল সঙ্গে। নতুন খেলনা খরগোশটা গোটাটা তুলতুলে সাদা পশমে তৈরি। সত্যিকারের কাচ দিয়ে বানানো তার চোখজোড়া। এদিকে সমুদ্রের ধারে যাওয়ার খবরে ছেলেটা এতটাই আনন্দে ছিল যে এতসব কিছুই খেয়াল করল না সে।
ওদিকে যখন ছেলেটা সমুদ্রের তীরের স্বপ্ন দেখতে দেখতে গভীর ঘুমে ঢলে পড়েছে তখন এদিকে মখমলি খরগোশ বাগানে মুরগির খোপের এক কোণে ছবির বইয়ের মাঝে বস্তাবন্দি হয়ে একা পড়ে রইল। বস্তার মুখটা বাঁধন-খোলাই ছিল। একটুখানি ঠ্যালাঠেলি করেই বস্তার মুখ থেকে মাথাটা বার করে উঁকি দিতে পারল।
বেচারা মখমলি খরগোশ ঠাণ্ডায় কাঁপছিল। সবসময় বিছানাতে শুয়েই অভ্যস্ত। তাছাড়া এতদিন পুরোনো হয়ে যাওয়ার ফলে ওর গায়ের কোটটাও খুব পাতলা হয়ে এসেছে, সুতো বেরিয়ে এসেছে। ছেলেটা সবসময়ই ওকে জড়িয়ে থাকত কিনা। এই কোটে ওর মোটেই ঠাণ্ডা কাটছিল না। কাছেই র‍্যাস্পবেরির ঝোপটা চোখে পড়ল ওর। কত লম্বা আর ঝাড়ালো হয়ে গেছে জঙ্গলের মতোএর ছায়াতেই কতদিন সকালে খেলা করেছে মখমলি খরগোশ ছোট্ট ছেলেটার সঙ্গে।
পুরোনো সেই দিনগুলোর কথা বড্ড মনে পড়তে লাগল মখমলি খরগোশের। সূর্যের আলো মাখা লম্বা দিনগুলো কেমন আনন্দে বাগানে কাটত! দুঃখের ছায়া ঘনিয়ে আসে মন জুড়ে। চোখের সামনে ছবির মতো এক একটা মুহূর্ত সরে সরে যায়। প্রতিটি মুহূর্ত যেন আগেরটার চেয়ে আরও বেশি হাসিতে খুশিতে ভরা।  পরিদের ঘর, ফুলবাগান, জঙ্গলের নিঝুম সন্ধেগুলো, যখন মখমলি খরগোশ ঝোপের ধারে বসে থাকত আর পিঁপড়েরা আনাগোনা করত ওর থাবার ওপর দিয়ে। আর মনে পড়ে সেই সুন্দর দিনটার কথা যেদিন মখমলি খরগোশ প্রথম জানতে পেরেছিল যে ও ‘আসল’। মনে পড়ল চামড়ার ঘোড়াটার কথা। কত জ্ঞানী ছিল সে, কী নরম স্বভাব ছিল। কত কী শেখাত খরগোশকে।
মখমলি খরগোশ ভাবে কী লাভ ভালোবাসা পেয়ে, সমস্ত জৌলুস সৌন্দর্য খুইয়ে ‘আসল’ হয়ে এভাবেই যদি সব শেষ হয়?

*                          *                          *


তারপর... তারপর একটা ফোঁটা আসল চোখের জল গড়িয়ে এল ওর বিবর্ণ মখমলি নাক বেয়ে। টপ করে পড়ল মাটির ওপর।
ঠিক তখনই একটা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটল। মাটির ওপর যেখানটায় চোখের জলের ফোঁটাটা পড়ল সেখানেই একটা নাম না জানা ফুল ফুটে উঠল। ফুলটা বাগানের অন্যান্য ফুলগুলোর মতো একেবারেই নয়। ফুলের পাতাগুলো সরু, একেবারে পান্নার মতো ঘন সবুজ। আর পাতাগুলোর মধ্যেখানটায় একটা সোনালি ফুল ফুটে আছে। সেই ফুলটা এতটাই সুন্দর যে ছোট্ট খরগোশ কাঁদতেও ভুলে গেল। চেয়েই রইল ফুলটার দিকে। দেখতে দেখতে ফুলের পাপড়িগুলো খুলে গেল আর ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একটা পরি
পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর পরিটা মখমলি খরগোশের চোখের সামনে। মুক্তো আর শিশিরকণা দিয়ে তৈরি তার পোশাক। গলায় ফুলের মালা, চুলে ফুলের মালা। পরির মুখটা যেন ফুলেরই মতো সুন্দর। পরিটা এল ছোট্ট মখমলি খরগোশের কাছে। কোলে তুলে নিয়ে চুমো দিল তার চোখের জলে ভেজা মখমলি নাকের ওপর।
বলে উঠল, “ছোট্ট খরগোশ তুমি জানো না আমি কে?”
খরগোশ মুখ তুলে চাইল তার দিকে। মনে হল কোথায় যেন দেখেছে মুখটা! কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ল না কোথায়।
পরি সুরেলা গলায় ফের বলল, “আমি হলুম খেলাঘরের জাদু পরিবাচ্চারা যে সব খেলনা নিয়ে খেলা করে আমি তাদের সকলের খেয়াল রাখি। যখন খেলনাগুলো পুরোনো হয়, ছিঁড়েখুঁড়ে আসে, বাচ্চাদের আর খেলনাগুলোর প্রয়োজন পড়ে না তখন আমি এসে তাদের নিয়ে যাই আমার সঙ্গে। তারপর তাদের ‘আসল’ বানিয়ে দিই।”
“তার মানে আমি আগে ‘আসল’ ছিলুম না?” জিজ্ঞেস করে অবাক হয়ে মখমলি খরগোশ।
“আগে তুমি শুধু ছোট্ট ওই ছেলেটার জন্য ‘আসল’ ছিলে। এখন তুমি সক্কলের কাছেই ‘আসল’ হয়ে উঠবে,” মিষ্টি করে উত্তর দেয় পরি
তারপর পরি খরগোশকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে উড়ে গেল বনের ভেতর। চাঁদ উঠেছে, চারিদিক তাই আলোয় ভরা। জঙ্গলটা অপরূপ সুন্দর দেখতে লাগছে। ফার্ন গাছের পাতাগুলোর ওপর চাঁদের আলো পড়ে জমাট বাঁধা রুপোর মতো চকচক করছে। গাছের গুঁড়ির ফাঁকে ফাঁকে জমির ওপর বুনো খরগোশেরা নেচে নেচে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের ছায়াগুলোও মখমলের মতো সবুজ ঘাসের ওপর নাচছে। কিন্তু যেই না সকলে দেখল পরি আসছে ওমনি সকলে নাচ থামিয়ে গোল হয়ে ঘিরে দাঁড়াল তাকে।
“আমি তোমাদের জন্য একটা নতুন খেলার সঙ্গী এনেছি,” বলে চলে পরি, “তোমরা সকলে কিন্তু ওর খেয়াল রাখবে। খরগোশদের দুনিয়ার নিয়মকানুন ওকে শেখাবে। এবার থেকে চিরকালের জন্য ও তোমাদের সকলের সঙ্গেই থাকবে।”
এই বলে পরি মখমলি খরগোশকে আরেকটা চুমো দিয়ে নামিয়ে রাখল ঘাসের ওপর।
“যাও খেলা করো ছোট্ট খরগোশ,” বলল পরি
কিন্তু ছোট্ট খরগোশ তাও বসে রইল চুপটি করে বেশ কিছুক্ষণ। কারণ চারপাশের বুনো খরগোশদের দেখে ছোট্ট মখমলি খরগোশের মনে পড়ে গেল যে ওর তো পেছনের পা-ই নেই। আর এটা কিছুতেই অন্য খরগোশদের জানতে দিতে চায় না ও।
ছোট্ট খরগোশ তো বুঝতেই পারেনি, শেষবার পরি যখন ওকে চুমো খেল তখনই তো এক্কেবারে বদলে গেছে ও। অনেকক্ষণ তাই বসেই রইল। লজ্জায় নড়তেই পারছিল না বেচারা। এমন সময় হঠাৎই নাকে কী যেন কী সুড়সুড় করে উঠল। কিছু বোঝার ভাবার আগেই কখন যেন ছোট্ট খরগোশ নিজের পেছনের পা-টা তুলে নাকটা চুলকে ফেলল।
ও মা! তখনই ছোট্ট খরগোশ খেয়াল করল যে ওরও সত্যি সত্যি পেছনের পা আছে। শুধু তাই নয়? ময়লা পুরোনো মখমলের লোমের বদলে সত্যিকারের নরম আর চকচকে বাদামি লোমে ভরে গেছে ওর সারা গা। কান দু’খানা নিজে নিজেই দিব্যি নাড়াতে পারছে। আর ওর গোঁফগুলো এত্ত লম্বা হয়েছে যেন ঘাস ছুঁয়ে ফেলবে প্রায়।
ছোট্ট খরগোশ পেছন পায়ে ভর দিয়ে একটা লাফ মেরেই এমন মজা পেল যে সারা ঘাসময় তিড়িংবিড়িং করে লাফিয়েই চলল। কখনও ডাইনে লাফায়, কখনও বাঁয়ে, কখনও বা অন্যদের মতো ঘুরপাক খায়। এত আনন্দ আর উত্তেজনার চোটে খেয়ালই করল না ছোট্ট খরগোশ যে কখন পরিটা চলে গেছে।
অবশেষে ‘আসল’ খরগোশ হতে পেরেছে ও! বাকি সব খরগোশেদের সঙ্গে নিজের আস্তানা পেয়েছে ছোট্ট খরগোশ।

*                          *                          *

হেমন্ত কেটে গেল, কেটে গেল শীতও। এল বসন্তকাল। দিনগুলো আস্তে আস্তে সূর্যের উজ্জ্বল আলোয় উষ্ণ হয়ে উঠল। সেই ছোট্ট ছেলেটা একদিন খেলতে এল বাড়ির পেছনের জঙ্গলটায়। খেলতে খেলতে হঠাৎ দেখল ফার্নের ঝোপের আড়াল থেকে দুটো খরগোশ চুপি চুপি বেরিয়ে এসে উঁকি দিয়ে দেখছে ওকে। তাদের মধ্যে একজন পুরোপুরি বাদামি রঙের। অন্য জনের গায়ের বাদামি লোমের ওপর কেমন যেন আবছা দাগ। দেখলে মনে হবে অনেক কাল আগে বুঝি তার গায়ে বুটি বুটি রঙ ছিল, এখনও সেই দাগ থেকে গেছে। আর ওই ছোট্ট নরম-সরম নাকটা, গোল গোল কালো চোখ দুটো যেন বড্ড চেনা লাগছে।
ছেলেটা মনে মনে ভাবে, “তাই তো! এই খরগোশটাকে দেখতে এক্কেবারে আমার সেই খেলনা খরগোশটার মতোআমার যখন খুব জ্বর শরীর খারাপ করেছিল তখন হারিয়ে গিয়েছিল আমার খেলনা খরগোশটা।”
ছোট্ট ছেলেটা কোনোদিন জানতে পারল না যে ওই খরগোশটা সত্যি সত্যি তার সেই খেলনা খরগোশটাই ছিল। ছোট্ট মখমলি খরগোশ ফিরে এসেছিল ছেলেটাকে দেখতে যে সবার প্রথমে ওকে ‘আসল’ বলে ভালোবেসেছিল।
--------
মূল গল্পঃ ‘The Velveteen Rabbit’ - Margery Williams
--------
লেখক পরিচিতিঃ মার্জারি উইলিয়ামস-এর লেখা ‘দ্য ভেলভেটিন র‍্যাবিট’  শিশুদের অন্যতম জনপ্রিয় একটি বই। ১৯২২ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় এই বইটি। এছাড়াও ‘দ্য লিটল উডেন ডল’, ‘দ্য স্কিন হর্স’-সহ লেখিকার আরও কিছু ছোটোদের বই মন জয় করেছে শিশুদের।
--------
ছবিঃ আন্তর্জাল