গল্পের ম্যাজিক:: অদল বদল - পান্নালাল নানালাল প্যাটেল; অনুবাদঃ মঞ্জিলা চক্রবর্ত্তী


অদল বদল
পান্নালাল নানালাল প্যাটেল
অনুবাদঃ মঞ্জিলা চক্রবর্ত্তী

দোল উৎসবের গোধূলিবেলা, আকাশ যেন আবীর রঙে সেজেছে একদল গ্রাম্য বালক এক নিম বৃক্ষের তলায় আবীর ছোড়াছুড়ি খেলছিল
অমৃত ইসব দুই বন্ধু হাত ধরাধরি করে এসে তাদের সঙ্গে যোগ দিল দু’জনেই নতুন শার্ট পরেছে শার্ট দুটি হুবহু একইরকম শার্টের রঙ, সাইজ এমনকি কাপড় পর্যন্ত একেবারে এক তারা দু’জনে একই স্কুলের একই ক্লাসে পড়ত পথের এক কোনায় পরস্পরমুখী দুটি বাড়িতে তারা থাকত তাদের অভিভাবকরা কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করত দুঃসময়ে মহাজনের কাছে ধারদেনা করে সংসার চলত তাদের দু’জনের মধ্যে অধিকাংশ বিষয়েই মিল ছিল, ব্যতিক্রম কেবল অমৃত তার বাবা-মা তিন ভাইয়ের সঙ্গে থাকত, আর ইসব কেবল তার বাবার সঙ্গে থাকত
তারা দু’জন গাছতলার বাঁধানো চাতালে এসে বসল তাদের দু’জনের হুবহু একই পোশাক দেখে দলের একটি ছেলে জিজ্ঞেস করল, “কী রে অমৃত ইসব, তোরা তোদের পরিচয় বদল করলি নাকি?
একথা শোনামাত্র আরেকটি ছেলের মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল সে বলল, “তোরা দু’জন কুস্তি লড়ছিস না কেন? আমরা দেখি তাহলে তোরা সমান শক্তিশালী নাকি একে অপরের থেকে বেশি কেউ
প্রথম ছেলেটি একথা শুনে ভাবল বুদ্ধিটা নেহাত মন্দ নয় সে আরও একটু উৎসাহের সঙ্গে বলল, “হ্যাঁ, অমৃত ইসব, চল শুরু কর... দেখা যাক তোদের মধ্যে কে বেশি শক্তিশালী!
অন্য ছেলেটি তখন চিৎকার করে উঠল, “চল, শুরু কর..., এ তো শুধু মজার জন্য
ইসব অমৃতের দিকে তাকিয়ে ছিল অমৃত চিৎকার করে উঠল, “না, তাহলে মা আমায় পেটাবে...
তার চোখে মুখে আতঙ্ক ফুটে উঠল এমনিতেই সে যখন বাড়ি থেকে বের হচ্ছিল তখন তার মা তাকে সাবধান করেছিল, “অনেক লাফালাফি করে এই নতুন শার্টটা নিয়েছিস তুই, যদি ছিঁড়ে বা নোংরা করে এনেছিস তো তোর কপালে দুঃখ আছে!

একথা সত্যি যে অমৃত তার বাবা-মায়ের কাছ থেকে একপ্রকার জোর করেই শার্টটা আদায় করেছিল যখন সে শুনেছিল যে ইসবের জন্য নতুন শার্ট কেনা হবে তখন সেও একইরকম শার্ট চাইল, না হলে স্কুলে যাবে না বলে বায়না জুড়ে দিল তার মা তাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছিল, “ইসব খামারবাড়িতে কাজ করে তাছাড়া ওর জামাটা ছিঁড়ে গেছে তোরটা তো এখনও ভালো আছে!
অমৃত কাঁদতে কাঁদতে বলল, “কে বলেছে? - বলেই তার জামার ছোট্ট একটা ছিদ্রে আঙুল ঢুকিয়ে আরও বড়ো করে দিল
তার মা তখন আরেকটা ফন্দি এঁটে বললেন, “ইসবকে নতুন শার্ট কিনে দেওয়ার আগে ওর বাবা কিন্তু ওকে খুব পিটিয়েছে তুই কি ওরকম ঠেঙানি খেতে চাস?
অমৃতও হাল ছাড়ার পাত্র নয় সে বলল, “আচ্ছা, আমায় বেঁধে পেটাও, কিন্তু ইসবের মতো নতুন একটা শার্ট আমায় দিতেই হবে
অগত্যা অমৃতের মা বললেন, “বেশ, তাহলে তোর বাবাকে জিজ্ঞেস কর?
অমৃত জানে, মা না বলেছে মানে বাবাও রাজি হবে না সেও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয় সে বায়না জুড়ে দিল - স্কুলে যাবে না, খাবে না, এমনকি রাতে বাড়িও ফিরবে না এসব দেখে শেষমেশ তার মা নতুন পোশাক কিনে দেওয়ার জন্য তার বাবাকে রাজি করালেন তারপর ইসবদের গোয়ালঘরে লুকিয়ে থাকা অমৃতকে খুঁজে বাড়িতে ফিরিয়ে আনলেন

অমৃত ইসব সেই সুন্দর শার্ট দুটি পরে বাড়ি থেকে বের হল আর অমৃত মনে মনে ঠিক করল যে সে আজ এমন কোনো কাজই করবে না যাতে তার নতুন শার্টটা খারাপ হয়ে যায় সুতরাং ইসবের সঙ্গে কুস্তি লড়তে সে কোনো আগ্রহ প্রকাশ করল না
ঠিক তখনই ওই ছেলের দলের এক ঝগড়ুটে ছেলে অমৃতের ঘাড় ধরে টেনে ময়দানে নামিয়ে বলল, “চল, একপ্রস্থ কুস্তি লড়া যাক
অমৃত তখন ওর হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে নিয়ে বলল, “দেখ কালিয়া, আমি কুস্তি লড়তে চাই না ছেড়ে দে...
কালিয়া এ কথা শুনে ওকে ধাক্কা দিয়ে মাঠে ফেলে দিল ছেলের দল উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল, “হুররে... ... হুররে... ..., কালিয়া জিতেছে, জিতেছে অমৃত হেরো... হেরো...
ইসব মেজাজ ঠিক রাখতে পারল না আর কালিয়ার হাত টেনে ধরে বলল, “চল, আমি তোর সঙ্গে লড়ব
কালিয়া ভয়ে পিছিয়ে গেল কিন্তু ছেলের দল তাকে তাতাতে থাকল তখন তারা একে অপরকে সাঁড়াশির মতো পেঁচিয়ে ধরল ইসব কালিয়াকে ল্যাং মেরে ফেলে দিল তারপর টেনে মাঠে নিয়ে গেল কালিয়া চিৎকার করে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল
ছেলের দল ভাবল যেটা মজার ছলে শুরু হয়েছিল সেটা গম্ভীর ব্যাপার হয়ে গেল! কালিয়ার বাবা-মা বকাবকি করতে পারে ভেবে তারা যে যেদিকে পারল দৌড় লাগাল

অমৃত ইসবও মাঠ ছেড়ে হাঁটতে শুরু করল কিছুটা এগোনোর পর ইসবের শার্টের ওপর অমৃতের নজর পড়ল শার্টের পকেটটা ফালা হয়ে ছিঁড়ে ঝুলছে ভয়ে তারা আর এগোতে পারল না ভালো করে দেখতে থাকল জামাটার আর কোথাও ছিঁড়েছে কিনা! এমন সময় ইসবের বাড়ি থেকে তার বাবার চিৎকার কানে এল, “ইসব তুই কোথায়?
তাদের নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসছিল ইসবের বাবা তার ছেঁড়া শার্টটা দেখলেই তাকে মেরে ছাল চামড়া গুটিয়ে দেবেন তিনি মহাজনের কাছে ধার করে কাপড় কিনে বহু যত্নে তার শার্টটা বানিয়ে দিয়েছেন
ইসবের বাবা আবার চিৎকার করে উঠলেন, “ইসব... ইসব... তুই কোথায়?
হঠাৎ অমৃতের মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল সে ইসবকে টেনে নিয়ে দুটো বাড়ির মাঝে সরু গলিতে ঢুকে পড়ল সে অতি দ্রুত নিজের জামার বোতামগুলো খুলে ফেলল ইসবকে বলল, “পরে ফেল
ইসব জিজ্ঞেস করল, “তাহলে তুই কী পরবি?
“আরে আমি তোরটা পরব অযথা প্রশ্ন করিস না, তাড়াতাড়ি কর, কেউ দেখে ফেললে বিপদ!
ইসব শার্টটা খুলতে খুলতে বলল, “শার্ট বদল? কিন্তু এতে আমাদের সমস্যা মিটবে কি? তোর বাবা তোকে পেটাবে তো!
অমৃত বলল, “তা পেটাবে, কিন্তু আমাকে বাঁচানোর জন্য আমার মা আছে তো!
ইসব ইতস্তত করতে থাকল, ঠিক তখন খুব কাছেই কাউকে কাশতে শোনা গেল তারা দ্রুত শার্ট বদল করে গলি থেকে সতর্কভাবে বেরিয়ে বাড়ির দিকে পা চালাল
ভয়ে অমৃতের বুক ধড়ফড় করছিল কিন্তু ওর কপাল ভালো ছিল কারণ দোল উৎসবের সময় এমন ঘটনা ঘটা খুব স্বাভাবিক তাই তার ছেঁড়া শার্টটা দেখে তার মা রেগে একটু বকাবকি করলেও তাকে ক্ষমা করে দিলেন তারপর ছুঁচ সুতো এনে শার্টটা সেলাই করে দিলেন

এই ঘটনার পর তারা নির্ভয়ে হাত ধরাধরি করে গ্রামের বাইরে নেড়া পোড়া দেখতে গেল
একজন কিন্তু তাদের শার্ট বদলের দৃশ্য দেখে ফেলেছিল সে ওদের আনন্দটা মাটি করার জন্য বলতে থাকল, “কী রে... তোরা তোদের শার্ট বদল করেছিস তো
ছেলেটির ভয়ে ওরা ওখান থেকে কেটে পড়ল কিন্তু তারপর অন্য ছেলেরাও ক্রমে শার্ট বদলের ঘটনাটি জেনে ফেলল তারা একটা মজাদার ছড়া বানিয়ে ফেলল, “অদল-বদল, অদল-বদল
এই ঘটনা যাতে তাদের বাবার কানে না পৌঁছয় তাই তারা বাড়ির দিকে দৌড় লাগাল
উঠোনে খাটিয়ায় বসে ইসবের বাবা হুঁকো টানছিলেন তিনি তাদের বললেন, “তোরা তোদের বন্ধুদের থেকে দৌড়ে পালাচ্ছিস কেন? এখানে আয়, আমার পাশে বোস
তাঁর শান্ত ডাক তাদেরকে আরও উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল তারা ভাবল, ‘আমরা যেটা ভয় পেয়েছিলাম ঠিক সেটাই হল উনি সত্যিটা জেনে ফেলেছেন কেবল শান্ত থাকার নাটক করছেন
ইসবের বাবা একজন পাঠান দশবছুরে অমৃতের হাতটা শক্ত করে ধরে ডাক দিলেন, “ভবানী বৌদি..., আজ থেকে তোমার অমৃতও আমার ছেলে
ভবানী বৌদি ঘর থেকে বেরিয়ে হেসে বললেন, “হাসান ভাই, আপনি একটাকে সামলাতে পারেন না, তো দুটোকে কীভাবে সামলাবেন
আবেগরুদ্ধ কন্ঠে হাসান ভাই বললেন, “ভবানী বৌদি, আমি এমন একুশজনকে মানুষ করতে পারব তারা যদি অমৃতের মতো হয়!
অন্যান্য প্রতিবেশী মহিলারাও জড়ো হয়েছিলেন হাসান ভাইয়ের কথা শোনার জন্য
তিনি তাদের অপেক্ষা না করিয়ে তাদের ছেলেরা কীভাবে শার্ট বদল করেছিল সে গল্পটি শোনালেন “ইসব অমৃতকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তোর বাবা তোকে যদি পেটায় কী করবি? আর জানো আমাদের অমৃত কী বলেছিল? সে বলেছিল, ‘কিন্তু তাতে কী, আমার তো মা আছে’!
পাঠান অশ্রুসিক্ত নয়নে বললেন, “সত্যি তো! অমৃতের কথাগুলোই আমাকে বদলে দিল ওই আমাকে শেখাল কোনটা যথার্থ যোগ্য!

অদল-বদল-এর কাহিনিটা সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল গ্রামের প্রধানের কানেও উঠল তিনি ঘোষণা করলেন, “আজ থেকে আমরা অমৃতকে ‘অদল’ ইসবকে ‘বদল’ বলে ডাকব
তারা দুই বন্ধু খুব খুশি হল কেবল গ্রাম নয়, আকাশে বাতাসে প্রতিধ্বনিত হতে থাকল, ‘অমৃত-ইসব, অদল-বদল, অদল-বদল!
--------
Note : জ্ঞানপীঠ পুরষ্কারপ্রাপ্ত গুজরাটি লেখক পান্নালাল নানালাল প্যাটেলের লেখা ‘অদল বদল’ গল্পটি ইংরাজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে
--------
ছবিঃ অতনু দেব

1 comment:

  1. ভাল প্রচেষ্টা,আরো ভালোর আশায় রইলাম।

    ReplyDelete