ঈগলস
ক্রেস্ট রহস্য
অনন্যা দাশ
(১)
“এই
রিয়া, তোমার সঙ্গে একজন দেখা করতে এসেছে।”
“দেখা
করতে এসেছে? এখানে?” বিকারটা হাত থেকে নামিয়ে হাতের গ্লাভস খুলে রিয়া ল্যাবের
দরজার দিকে ফিরে তাকাল।
মার্সি
একজন কাকে নিয়ে এসেছে। মার্সি ওদের ডিপার্টমেন্টের একজন সেক্রেটারি। উচ্চতায় বোধহয়
সে পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি আর বেশ হৃষ্টপুষ্ট। তাই ওর পিছনে যে কে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেটা
বোঝাই যাচ্ছিল না। রিয়া তাই উঠে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। মার্সি মোটা হলে কী হবে
অসম্ভব হাসিখুশি আর সব কাজে দক্ষ।
“তোমরা
কথা বল,” বলে মার্সি চলে যেতে ওর সঙ্গে আসা মহিলাকে দেখতে পেল রিয়া। মহিলা বললে
হয়তো একটু ভুল হবে কারণ, যে এসেছে সে রিয়ারই বয়সী। তাকে অসমান্য রূপসী বললে কম বলা
হবে। ফর্সা রঙ, কাঁধ পর্যন্ত লম্বা কুচকুচে কালো ঘন চুল ল্যাবের কৃত্রিম আলোয় চকচক
করছে। স্বচ্ছ নীল চোখ, কিন্তু চোখের তলায় কে যেন তুলি দিয়ে এক পোঁচ কালি মেরে
দিয়েছে। রিয়ার দিকে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে মেয়েটা বলল, “আমার নাম সোনিয়া।”
ল্যাবের
অন্য লোকজনরা হাঁ করে তাকিয়ে ওদের দিকে দেখছে দেখে সোনিয়া বলল, “তুমি কফি খাবে?
তাহলে চলো, ক্যাফেটেরিয়াতে গিয়ে বসি।”
“আমার
আজকের কফির কোটা শেষ হয়ে গেছে। আর কফি খেলে রাতে ঘুম আসবে না। কিন্তু
অন্যকিছু টুকিটাকি খাওয়া যেতেই পারে।”
দু’জনে
ক্যাফেটেরিয়াতে গিয়ে বসল। সোনিয়া তার ব্ল্যাক কফিতে চুমুক দিয়ে একবার এদিক ওদিক
তাকিয়ে দেখে নিল। দুপুরবেলা লাঞ্চের সময় এখানে বেশ ভিড় হয়, কিন্তু এই বিকেল চারটের
সময় কে আসবে? তাই এখন প্রায় ফাঁকা।
“কারও
সামনে বলতে একটু দ্বিধা হচ্ছে, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আমাকে খুন করার চেষ্টা করা
হচ্ছে!”
ওর
কথা শুনে রিয়া তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। “তাহলে তো তোমার পুলিশের কাছে যাওয়া উচিত!
আমার কাছে এসেছ কেন?”
“পুলিশকে
বলেছিলাম। ওরা পাত্তা দিচ্ছে না! আসলে আমার কাছে কোনও প্রমাণ নেই তো, তাই। তোমাকে
কিছু করতে হবে না। শুধু একটু শুনে নাও, প্লীজ! তারপর তোমার যদি মনে হয় আমি
মিছিমিছি ভয় পাচ্ছি তাহলে আমি আর তোমাকে বিরক্ত করব না।”
রিয়া
ঘড়ি দেখে বলল, “ঠিক আছে। আমার হাতে মোটে আধঘন্টা সময় আছে। এক্সপেরিমেন্টটা শুরু
করে এসেছি।”
“না
না, আমি বেশি সময় নেব না। আমি আসলে এখানকার বাসিন্দা নই। নিউ চেরিভেল থেকে মিনিট
চল্লিশ ড্রাইভ করলে লাইনার্সভিল বলে একটা জায়গা আছে, সেখানে থাকি আমি। লুইসার মা
রোজি আমাকে তোমার কথা বলেছে।”
“রোজি?
মানে যে রোজি আমাদের ল্যাবে বাসন মাজে?”
“হ্যাঁ,
ওর মেয়ে লুইসা ঈগলস ক্রেস্টে কাজ করত। ওই ঈগলস
ক্রেস্টকে নিয়ে যত সমস্যার সূত্রপাত। ঈগলস ক্রেস্ট হল আমাদের বাড়িটার নাম। বেশ বড়োসড়ো
বাড়িই বলা চলে। ঈগলস ক্রেস্টের প্রাক্তন মালিক
আর্নেস্ট হলসন সম্পর্কে আমার দাদু হন। মানে, আমার বাবার বাবা। আমার বাবারা ছিলেন
দুই ভাই। ডোনাল্ড হলসন আমার জেঠু আর ড্যানিয়েল হলসন আমার বাবা। আঙ্কেল ডোনাল্ড,
তার স্ত্রী রুথ আর মেয়ে ফেলিসিটি সেই প্রথম থেকেই ঈগলস ক্রেস্টে থাকেন। আর থাকে
দাদুর ভাগনে জর্জ আর ভাইঝি সিবিল। আমার বাবা দাদুর সঙ্গে ঝগড়া করে বাড়ি থেকে
বেরিয়ে যান ওঁর যখন পঁচিশ বছর বয়স। তার ফলে দাদু আমাকে আর মাকে কোনওদিন দেখেননি।
বাবা-মা পথ দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার চার বছর বাদে দাদুর কাছ থেকে একটা চিঠি পাই। আমি
তখন ক্যালিফর্নিয়াতে থাকি। বাবা নাকি মাঝে মাঝে দাদুকে চিঠি লিখতেন। যাই হোক, দাদু
চিঠিতে লিখেছিলেন যে ওঁর নাকি কঠিন অসুখ, বেশিদিন হয়তো বাঁচবেন না, তাই আমাকে
দেখতে চান। চিঠির সঙ্গে এখানে আসার টিকিটটা পর্যন্ত পাঠিয়ে দেন! আমার তখন মাস তিনেক
হল চাকরি নেই। বাড়ি ভাড়া দেওয়াই মুশকিল হয়ে যাচ্ছে, তাই আমি মনে
মনে ভাবলাম, ‘ভালোই হল, একটা ঠাঁই পাওয়া গেল’। চলে এলাম। এসে দেখলাম, দাদুর শরীর
সত্যিই বেশ খারাপ। তখন মন দিয়ে ওঁর সেবাযত্ন করলাম বেশ কিছুদিন। তার মধ্যে দাদু যে
কী করে উইল বদল করে সবকিছু আমার নামে করে দিয়েছেন সেটা আমি ঘুণাক্ষরেও জানতাম না।
দাদু মারা যাওয়ার পর মিস্টার মস, মানে দাদুর উকিল, এসে ওঁর উইলটা পড়ে শোনাতে সবাই
শক পেল! দাদু ঈগলস ক্রেস্ট আমার নামেই লিখে দিয়ে গেছেন! অন্যরা কেবল তাদের জীবদ্দশায়
ওখানে থাকতে পারবে আর মাসে মাসে কিছু টাকা পাবে, এই যা। তাই আমি এখন ঈগলস
ক্রেস্টের মালিক।”
এতটা
বলে সোনিয়া থামল। রিয়া চট করে ঘড়িটার দিকে দেখে নিল। নাহ্, এখনও সময় আছে।
সোনিয়া
আবার বলতে শুরু করল, “দাদুর সঙ্গে আমার অনেক গল্প হত। দাদু আমাকে বলতেন, আমার চারপাশে
যারা ঘুরে বেড়াচ্ছে তারা কেউই আমাকে পছন্দ করে না। ওদের নজর কেবল আমার সম্পত্তির
দিকে! কে কত পাবে তাই নিয়ে হিসেব করে চলেছে সর্বক্ষণ।
“এদিকে
আমি উড়ে এসে জুড়ে বসেছি বলে ওরা আমার সঙ্গেও ভালো ব্যবহার করেনি প্রথম থেকেই। ওদের
ধারণা ছিল যে আমি দাদুর টাকার লোভে এসেছি। কিন্তু সেটা ঠিক নয়। দাদু মানুষটা যে
কেমন সেটা দেখার আমার খুব আগ্রহ ছিল ছোটোবেলা থেকেই। তারপর এখানে এসে দেখলাম, দাদু
কতটা নিঃসঙ্গ, কতটা একা! যাই হোক, দাদু মারা যাওয়ার পর থেকে সমস্যাটা শুরু হয়েছে।
“প্রথম
ঘটনাটা আমি ঠিক বুঝতেও পারিনি। রাতের
খাবারে কাঁকড়া রান্না হয়েছিল সেদিন। সঙ্গে অবশ্য চিকেনও ছিল। কাঁকড়াটা কেউ খেল না
আমি ছাড়া। কারও অ্যালার্জি, কারও ভালো লাগে না, কীসব বলল ভুলেও গেছি। রাতের বেলা
প্রচন্ড পেটের ব্যথায় ঘুম ভেঙে গেল। সে কী বমি আর পেট খারাপ! আমি ভাবলাম, ফুড
পয়সনিং মানে বিষক্রিয়া জাতীয় কিছু হয়েছে। খুব একটা বেশি খাইনি বলে সকাল নাগাদ ঠিক হয়ে
গেল। ডাক্তার আর ডাকতে হয়নি।
“এই
তো গেল প্রথম ঘটনাটা। দ্বিতীয় কান্ডটা বেশ ভয়ের। সেটা থেকেই আমি বুঝেছি কেউ আমাকে
খুন করার চেষ্টা করছে। ওহ্, একটা কথা বলা হয়নি। দাদু মারা যাওয়ার পর দাদুর কোনও
এক বন্ধুর নাতনি এসে বাড়িতে থাকতে শুরু করে। ওর নাম গ্রেটা। জেঠু
ওকে থাকতে দেন বলে আমি আর কিছু বলিনি। একদিন শপিং করে ফিরেছি। হাতে অনেকগুলো
ব্যাগ। আমার ঘরের দরজাটা দেখি অল্প খোলা। একটু আশ্চর্যই হলাম, কারণ আমি দরজা বন্ধ
করে গিয়েছিলাম। দরজাটা ঠেলতেই একটা ভারী পিতলের মূর্তি হুড়মুড় করে পড়ল উপর থেকে।
ভাগ্য ভালো, আমি তড়াং করে লাফিয়ে পিছিয়ে যাই। না
হলে আমার মাথা থেঁতলে যেত ওই মূর্তিটার ভারে!”
“দ্বিতীয়
ঘটনা শুনেও পুলিশ কিছু করেনি?”
“একজনকে
পাঠিয়েছিল। সে হাতের ছাপ-টাপ নিয়ে বলেছে যে মূর্তির গায়ে আমার হাতের ছাপ ছাড়া কারও
হাতের ছাপ নেই তাই কারও বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ নেই।”
“ও!”
“আমার
কিন্তু ভীষণ ভয় করছে! ওই এক তাল ইট-সিমেন্টের জন্যে আমার প্রাণটা দিতে চাই না আমি।”
রিয়া
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, “এবার আমাকে যেতে হবে। তোমার ফোন নম্বরটা দিয়ে দাও। আমি কাল
বা পরশু তোমার বাড়ি যাব। আমার সাথে কিম ডি মার্কোও যাবে হয়তো।”
“হ্যাঁ
হ্যাঁ, ও গেলে আপত্তি নেই। পুলিশ অফিসার ডি মার্কোর মেয়ে তো?”
“ঠিক।”
ল্যাবে
ফিরে গিয়ে কিম ডি মার্কোকে সবকথা বলল রিয়া। কিম
ডি মার্কো নিউ চেরিভেলের পুলিশ অফিসার-ইন-চার্জের আদুরে কন্যা। ঘটনাক্রমে কিম রিয়াদের
ল্যাবেই কাজ করে। রিয়ার মতন সেও পিএইচডি করার চেষ্টা করছে।
সব
শুনে ওর চোখ চকচক করে উঠল। বলল, “আজ রাতেই বাবাকে জিজ্ঞেস করব। সোনিয়া যখন সব বলেই
দিয়েছে তখন তো ব্যাপারটা গোপন হতে পারে না! বাবার সঙ্গে কথা বলে কালকেই যাব।”
রহস্যের
গন্ধ পেলেই কিম তার বাবাকে বিরক্ত করে ভিতরকার খবর জানার জন্যে।
(২)
পরদিন
রিয়া সকাল সকাল ল্যাবে গিয়ে কাজ শুরু করেছে সোনিয়ার বাড়ি যাবে বলে, এমন সময় কিম
হন্তদন্ত হয়ে এসে উপস্থিত। রিয়ার খুব কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, “খুব গন্ডগোল! গ্রেটা
বলে যে মেয়েটা ঈগলস ক্রেস্টে ছিল সে খুন হয়েছে কাল সন্ধ্যায়!”
“কী
সাঙ্ঘাতিক!”
“এবার
তো ব্যাপারটা পুরোপুরি বাবাদের ডিপার্টমেন্টের ঘাড়ে গিয়ে পড়েছে। আমি বাবার
নোটসগুলো প্রিন্ট করে এনেছি।”
“এ
বাবা! সেটা তো ইলিগাল না?”
“কেউ
জানলে তবে তো! কাউকে বলবই না। আগে কে কী বলেছে সেটা পড়ে ফেলে তারপর ওদের বাড়িতে
যাব। তবে একটা কথা বাবা বলেছেন। খুনির আসল
টার্গেট ছিল সোনিয়া। মেয়েটা সোনিয়ার একটা জামা পরে ছিল। সাদার ওপর বড়ো বড়ো গোলাপি
পোলকা ডট দেওয়া একটা জামা আছে ওর। মেয়েটা
বাগানে ছিল। পিছন থেকে দেখে কেউ ভেবেছে ওটা
সোনিয়া। সেটা ভাবাই স্বাভাবিক! বাড়ির সবাই বন্দুক চালাতে পারে। সবার টিপ ভালো।”
“খুনটা
হয়েছে কীভাবে?”
“পিছন
থেকে গুলি করে। বন্দুকটা নাকি সোনিয়ার দাদুর ছিল। ওঁর অফিস-ঘরের ড্রয়ারে চাবি দিয়ে
রাখা থাকত। সেটা সবাই জানে। চাবি কোথায় থাকে সেটাও সবাই জানে। ওই ঘরেরই একটা ছবির
পিছনে লুকানো। গুলিটা ওই ঘরের জানালা দিয়েই করা
হয়েছে, ফলে কাজটা যে কেউ করে থাকতে পারে।”
“বন্দুকটা
পাওয়া গেছে?”
“হ্যাঁ,
বন্দুকটা ওই ঘরেই টেবিলে রাখা ছিল, তবে হাতের ছাপ – জিরো।”
“হুঁ!
চলো, তাহলে তোমার বাবার নোটগুলো পড়ে দেখি।”
লাইব্রেরিতে
গিয়ে পড়তে শুরু করল দু’জনে। সব কিছু পড়ে-টড়ে কিম বাবার নোটস ছিঁড়ে ফেলে দিতে গেল আর
রিয়া বসে একটা টেবিল বানিয়ে ফেলল –
নাম
|
সোনিয়াকে
মারার মোটিভ আছে কি? /
গ্রেটাকে
মারবার মোটিভ?
|
অ্যালিবাই
|
ডোনাল্ড
হলসন
|
হ্যাঁ/না
|
বন্ধু
রবার্ট সেথের বাড়িতে ব্রিজ খেলছিলেন। অন্য তিনজন সাক্ষী আছে।
|
রুথ হলসন
|
হ্যাঁ/না
|
নিজের ঘরে
বই পড়ছিলেন। কী বই জিজ্ঞেস করতে একটু ভেবে বলেছেন ‘গন উইথ দা উইন্ড’।
|
ফেলিসিটি
হলসন
|
হ্যাঁ/না
|
পার্লারে
টিভি দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। কী প্রোগ্রাম জিজ্ঞেস করতে বলছে পুরনো বোরিং
কোনও এক সিনেমা। কী সিনেমা বলতে পারেনি।
|
সিবিল
হলসন
|
হ্যাঁ/না
|
রান্নাঘরে
মার্থাকে রাতের খাবার তৈরি করতে সাহায্য করছিলেন। মার্থা সায় দিয়েছে।
|
জর্জ
হ্যারিস
|
হ্যাঁ/না
|
বাইরে
বাগানের শেডে যন্ত্রপাতি সারাচ্ছিলেন। কেউ অবশ্য তাঁকে দেখেনি।
|
মার্থা
সিমস
|
না- ?/
না- ?
|
রান্নাঘরে
ছিলেন সিবিলের সঙ্গে।
|
সোনিয়া
হলসন
|
গ্রেটাকে
মারবার মোটিভ??
|
নিজের ঘরে
ছিল। বন্ধুকে ইমেল করছিল। সেন্ট মেলে একটা ইমেল আছে মোটামুটি ওই সময় পাঠানো।
|
(৩)
ঈগলস
ক্রেস্টে ওরা যখন গিয়ে পৌঁছল তখন সন্ধে প্রায় নেমে এসেছে। কিম গাড়ি চালাচ্ছিল। চারদিকে
ভুট্টার ক্ষেত, তার মধ্যে উড়ে বেড়াচ্ছে শয়ে শয়ে জোনাকি। সে এক অভিনব মায়াবী দৃশ্য।
রিয়া তো মোহিত হয়ে দেখছিল।
কিম
বলল, “এখন দৃশ্য দেখে কবিতা লিখতে বসে গেলে চলবে না। এমনিতেই দেরি করে ফেলেছি।
তাড়াতাড়ি সবার সঙ্গে যা কথা বলার বলে পালাতে হবে। বেশি রাত হলে মা খুব বকাবকি
করবেন।”
“হ্যাঁ
হ্যাঁ, তা তো নিশ্চয়ই। ওইদিকে তাকিয়ে দেখো,” বলে রিয়া আঙুল দিয়ে দেখাল।
সন্ধ্যার
আকাশের সঙ্গে গা মিশিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ঈগলস ক্রেস্ট। কিছুটা
পুরনো দিনের ইউরোপের কাসেলের ঢঙে তৈরি, তবে সূক্ষ্মতা বা সৌন্দর্য একদম নেই। কেমন
যেন একটা ভয়াবহ রুক্ষ কাঠ কাঠ ভাব। বাইরেটা হয় কালচে রঙ করা নয়তো অবহেলায় কালো হয়ে
গেছে।
কিম
দেখেই নাক সিঁটকে বলল, “ওমা, কী কুৎসিত দেখতে বাড়ি! এটাকে নিয়েই এত মারামারি?”
“হবে
না? কত বড়ো বাড়ি দেখছ না? কারও যদি নিজের থাকতে ভালো নাও লাগে বিক্রি করলেও তো
অনেক অর্থ পাবে!”
“হ্যাঁ,
তা ঠিক। অর্থের লোভই সব সর্বনাশের মূল।”
গাড়ি
পার্ক করে ঢাউশ কড়াটা নাড়তে এক সাদা চুল বয়স্ক মহিলা এসে দরজাটা খুললেন। পরনে সাদা
কালো ইউনিফর্ম। খুব সম্ভব মার্থা সিমস। ওদের দু’জনকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “কাকে
চাই?”
“সোনিয়া
আছে?”
সোনিয়ার
কথা শুনেই মহিলার কপালে ভাঁজ পড়ল। গম্ভীর মুখটা আরও গম্ভীর হয়ে গেল। “হ্যাঁ আছে।
কিন্তু তোমরা কে?”
“আমরা
ওর বন্ধু। নিউ চেরিভেল থেকে এসেছি।”
“এখন
বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলবে কিনা জানি না। বাড়িতে একটা ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। কারও
মনমেজাজ ভালো নেই,” বলে মহিলা ওদের তাড়াবার আপ্রাণ চেষ্টা করলেন।
“আপনি
একবার ওকে বলুন যে নিউ চেরিভেল থেকে রিয়া আর কিম এসেছে। তারপর যদি ও না দেখা করতে
চায় তাহলে আমরা চলে যাব।”
মার্থা
সিমস গজগজ করতে করতে ভিতরে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে অবশ্য ওদের ঘরে ঢুকে বসতে
বলেলেন। ওরা বাইরের ঘরে বসে আছে এমন সময় একটা লম্বা, টিংটিংয়ে রোগা ফ্যাকাসে গোছের
দেখতে মেয়ে টুক করে উঁকি দিয়ে চলে গেল। কিম বলল, “নির্ঘাত ফেলিসিটি। সবকিছুর
উপর নজর রাখে। ও হয়তো কিছু জানবে।”
একটু
পরেই সোনিয়া এসে হাজির হল। চুল
অবিন্যস্ত, চোখগুলো লাল লাল ফোলা ফোলা। মার্থা সিমস দরজার কাছে এক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে
থেকে চলে গেলেন।
“তোমরা
শুনেছ, কী ভয়ংকর ব্যাপার?”
“হ্যাঁ,
শুনেছি। সেইজন্যেই তো এলাম।”
“আমাকে
মারার চক্রান্তের শিকার হল বেচারি গ্রেটা! ওর তো কোনও দোষ ছিল না শুধু আমার জামাটা
পরা ছাড়া। ওর খুব পছন্দ হয়েছিল জামাটা, তাই ওকে দিয়ে দিয়েছিলাম। আমার কী যে ভয়
করছে, কী বলব! মনে হচ্ছে এখুনি চলে যাই এখান থেকে।
কিন্তু পুলিশ তো বলেছে কোথাও যাওয়া চলবে না যতক্ষণ না ওরা অনুমতি দিচ্ছে। কী যে
করি!”
“কাউকে
সন্দেহ করছে ওরা? কিছু বলেছে?”
“সবাইকে
সন্দেহ করছে! শুধু হয়তো মার্থা ছাড়া। তাও সে যা প্রভুভক্ত! জেঠুর পরিবারের জন্যে
যা খুশি করতে রাজি। আমার হঠাৎ এসে হাজির হওয়া তার একদম পছন্দ নয়।”
“তোমাকে
মেরে ওদের লাভ হবে সে ব্যাপারে তুমি নিশ্চিত?”
“হ্যাঁ,
দাদুর উইলেই সেটা বলা আছে। ঈগলস ক্রেস্ট সবসময় যেন ওঁর পরিবারের থাকে সেইজন্যে উনি
লিখে গেছেন যে আমি বিয়ে করলে আমার ছেলেমেয়েরা পাবে আর তার আগেই যদি আমার কিছু হয়ে
যায় তাহলে প্রথমে জেঠু, তারপর ফেলিসিটি, তারপর সিবিল আর তারপর জর্জ এইভাবে যাবে।”
“ও!”
“হ্যাঁ,
সেইজন্যে আমাকে মারলে ওদের লাভ তো বটেই!”
“তোমার
জেঠু-জেঠিমার সঙ্গে একবার কথা বলা যাবে? বা ফেলিসিটির সঙ্গে?”
“ফেলিসিটি
তো এই ঘরের বাইরেই আড়ি পাতছে। ওর সঙ্গে কথা বলো আগে। আমি না হয় জেঠুদের গিয়ে
জিজ্ঞেস করে আসছি। জর্জ বা সিবিলের সঙ্গে কথা বলা বৃথা। ওরা দু’জনেই ভয়াবহ মূর্তি
ধরেছে। জর্জ তো প্রায় পাগলামিতে নেমে পড়েছে। কখন যে কী করে বসে তার ঠিক নেই! ওরা
প্রথম থেকেই আমাকে দু’চক্ষে দেখতে পারে না। আরে বাবা, দাদু আমাকে ঈগলস ক্রেস্ট লিখে
দিয়েছেন তো আমি কী করব? ওরা প্রথমে ধুয়ো ধরেছিল যে উইল ভুয়ো। কিন্তু
সেই চাল ধোপে টেঁকেনি। পোস্টম্যান আর মালি সাক্ষী আছে ওই উইলে।”
ফেলিসিটি
সত্যি দরজার বাইরে আড়ি পাতছিল। ওকে হিড়হিড় করে টানতে টানতে ঘরের ভিতরে নিয়ে এল
সোনিয়া। মুখে কুলুপ এঁটে ফেলিসিটি সোফায় বসল। প্রথমে কিছুই বলতে চাইছিল না।
অনেক কষ্টে পুলিশকে কিছু বলা হবে না ইত্যাদি বলতে কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি
হল।
“তুমি
কী কর?”
“কিছু
না।”
“মানে,
পড়াশোনা, চাকরিবাকরি?”
“পড়াশোনা
আমার ভালো লাগে না। যতদূর পেরেছি করেছি। এখন আর করি না।”
“ও!
তাহলে এখন কী কর?”
“কিছু
না। খাই দাই, টিভি দেখি। ইচ্ছে হলে সেলাই করি বা ছবি আঁকি।”
“মানে,
বাড়ির বাইরে গিয়ে চাকরিবাকরি করার তোমার কোনও বাসনা নেই?”
“চাকরি!”
হি হি করে হেসে ফেলল ফেলিসিটি। “বাবাই কোনওদিন চাকরি করেননি তো আমি! তাছাড়া দাদু
মোটেই চাইতেন না যে আমি কষ্ট করি।”
“আচ্ছা,
যখন খুনটা হল তখন তুমি কোথায় ছিলে?”
“পুলিশকে
বলেছি তো যে আমি পার্লারে টিভি দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। গুলির শব্দ-টব্দ যদি
হয়েও থাকে টিভিতে সিনেমা চলছিল বলে আমি কিছুই শুনিনি।”
“কী
সিনেমা দেখছিলে মনে আছে?”
“কী
করে বলব? যখন টিভি খুললাম তখন ওটা শুরু হয়ে গিয়েছিল আর ভীষণ বোরিং এইটুকু বলতে
পারি। আমি বোধহয় পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।”
“ঈগলস
ক্রেস্ট ছাড়তে হলে তোমার ভালো লাগবে?”
ফেলিসিটির
মুখটা যেন কেমন হয়ে গেল। “ছাড়তে হবে কেন শুনি? দাদু তো আমাদের জন্যে ব্যবস্থা করে
দিয়েই গেছেন!”
“মানে?”
“মানে,
তোমাদের বন্ধু আর যাই করুক, আমরা বেঁচে থাকতে আমাদের এখান থেকে বার করতে পারবে না।
বাড়িটা হয়তো ওর, কিন্তু আমরা সবসময় লেজুড় হয়ে থাকব আর ও চাইলেও বাড়িটা অন্য কাউকে
বিক্রি করতে পারবে না।”
রিয়া
আর কিম মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। এই কথাটা সোনিয়া দিব্যি চেপে গিয়েছিল।
একটু
পরেই সোনিয়া মুখ হাঁড়ি করে ফিরে এল। “নাহ্,
কেউ কথা বলতে রাজি নয়। এড়িয়ে যাওয়ার ফন্দিফিকির খুঁজছে। মাথা ধরেছে, জ্বর জ্বর ভাব,
হ্যানত্যান। কালকে এলে কথা বলবে বলছে।”
কী আর করবে। কিম আর
রিয়া বাড়ি ফেরার জন্যে তৈরি হল।
সোনিয়া
বলল, “কাল-পরশু একদিন দিনেরবেলা এস, তখন সব ঘুরিয়ে দেখাব। পিছনের দিকে একটা বড়ো
চার্চ আর সার্ভেন্টস কোয়ার্টার আছে, সবকিছু।” তারপর গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“ওই দুটোকে বিক্রি করে দেব ভাবছি। আসল বাড়িটাকে তো ছোঁওয়া যাবে না দাদু এমন সব
গ্যাঁড়াকল করে রেখেছেন। কিন্তু উকিলের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি ওই দুটোকে বিক্রি করা
যাবে। শুধু ধুমসো বাড়ি দিয়ে তো আর সংসার চলে না! পকেট তো ঢং ঢং খালি! এদিকে জেঠু
বলছেন, আনাজপাতি ইত্যাদির খরচ আগে তো দাদু করতেন। এখন
সবাইকে নিজের ভাগটা দিতে হবে। কী জ্বালা! আমাকে ওই ধুমসো বাড়িটা না দিয়ে কিছু ডলার
দিলে কাজে দিত।”
“আচ্ছা,
ওই চার্চ আর সার্ভেন্টস কোয়ার্টার কী এখনও ব্যবহার হয়?”
“না,
চার্চ তো অনেকদিন ধরেই ব্যবহার হয় না, তাই পোড়ো বাড়ি হয়ে গেছে। মার্থার বর বেঁচে
থাকতে ওরা দু’জনে মিলে কোয়ার্টারে থাকত। বর মারা
যাওয়ার পর থেকে ও ঈগলস ক্রেস্টেরই একটা ঘরে থাকে। এখন তো টাকার এত টান যে আর সব
কাজের লোকেদের ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, শুধু মার্থা রয়ে গেছে।”
রিয়া
বলল, “ও, আচ্ছা। ঠিক আছে, দেখি কালকে যদি আসতে পারি।”
“রওনা
হওয়ার আগে একটা ফোন করে দিও, কেমন?”
গাড়ির
কাছে এসে কিম বলল, “ওই যাহ্! আমার যা ভুলো মন! গাড়ির জানালাটা বন্ধ করতে ভুলে
গিয়েছিলাম।”
“ভাগ্য
ভালো বৃষ্টি পড়েনি। নাহলে ভিতরটা সব ভিজে যেত।”
গাড়ির
দরজাটা খুলে ভিতরে ঢুকতে গিয়ে কিম বলল, “এ বাবা! হাওয়াতে কীসব বাক্স উড়ে এসেছে!”
রিয়া
বলল, “কী জানি বাপু, অত হাওয়া তো দিচ্ছে না।”
“তাহলে
কেউ বদমাইশি করে ফেলেছে আমরা সোনিয়ার দলে মনে করে।” বলে গাড়িতে স্টার্ট দিল কিম।
স্টার্ট না দিলে যে আলো জ্বলবে না! দুই বন্ধু মিলে বাক্সগুলোকে তুলে তুলে বাইরে
ফেলতে লাগল। তার মধ্যে কর্নফ্লেক্সের বাক্স, ডিমের কার্টন, হেয়ার ডাইয়ের বাক্স,
দাঁতের মাজনের টিউব, এমনকি কোকের ক্যান পর্যন্ত রয়েছে। আর সাথে রয়েছে একরাশ ময়লা।
কিমের
প্রায় কেঁদে ফেলার মতন অবস্থা। সে বেচারি নিজের গাড়ির খুব যত্ন নেয়। রিয়ারও গা
ঘিনঘিন করছে। সে ব্যাগ থেকে একটা হ্যান্ড স্যানিটাইজারের বোতল বার করল। সেটা দিয়ে
হাত মুছে, গাড়ি মুছে ওরা রওনা হল।
ফেরার
পথে কিম বলল, “ভাগ্যিস, তোমার ব্যাগে ওটা ছিল! তবে যে এটা করেছে সে পার পাবে না।
বাবাকে নিশ্চয়ই বলব। অবশ্য জানি না হাতের ছাপের জন্যে বাক্স নিলে হত কি না।”
“নাহ্,
ওটা তো ময়লা ফেলার ঝুড়ির যত ময়লা। ওর থেকে
কারও একজনের হাতের ছাপ পাওয়া যেত না। বাড়ির সবার
হাতের ছাপ আছে হয়তো ওতে।”
“তা
ঠিক। ওসব দরকার নেই, বাবা এমনিতেই বার করে ফেলবেন।”
রিয়া
একটু ভেবে বলল, “জর্জ, সিবিল বা মার্থার মধ্যে কোনও একজনের কাজ ওটা।
ফিলিসিটি আমাদের সঙ্গেই ছিল, আর সোনিয়া তো ওর জেঠু-জেঠিমার সঙ্গে কথা বলতে
গিয়েছিল। ওঁরা তো ঘরেই ছিলেন।”
“হুঁ,
জর্জ, সিবিল আর মার্থা, হয় ওদের কেউ বা তিনজন একসাথে।”
(৪)
পরদিন
ওরা ল্যাবের কাজ তাড়াতাড়ি সেরে বেরোতে যাবে এমন সময় সেক্রেটারি মার্সি এসে হাজির।
বলল, “ওই যে সোনিয়া বলে মেয়েটা সেদিন এসেছিল সে একটু আগে ফোন করেছিল। আমি ব্যস্ত
হয়ে পড়েছিলাম তাই তোমাদের জানাতে পারিনি। তোমাদের বলতে বলেছে যে ও আজ বিকেল
পর্যন্ত বাড়ির পিছনের ওই চার্চটাতেই থাকবে। বিক্রির জন্যে লোক দেখতে আসবে তাই কীসব
পরিষ্কার করছে বলল। ওখানে ওর সেল ফোনে সিগনাল নেই তাই আগে থেকে ফোন করে বলে দিল।
তোমরা বাড়িতে না ঢুকে সোজা ওখানেই চলে যেও। বাড়ির পিছনের দিকের অংশটা দিয়ে যেতে
হয়। আর বলল, চার্চ বুঝতে ভুল হবে না, বিশাল একটা চুড়ো আছে বাড়িটার।”
কিম
আজ ওর গাড়ির সিটগুলোকে কাপড় দিয়ে ঢেকেছে। নিজের গাড়ি নিয়ে ও ভয়ানক পিটপিটে, সবসময়
পরিষ্কার করে ওটাকে আর কালকের ঘটনায় কোকাকোলার ক্যান থেকে কোক বেরিয়ে নাকি এদিক
ওদিক ছোপ পড়ে গেছে। তাই কিমের মনমেজেজ ভালো নেই। ও ক্রমাগত বলেই
চলেছে, “ওই হাড় পাজিগুলোর জন্যে আমাকে উইক-এন্ডে গাড়ি পরিষ্কার করতে হবে!”
তাড়াতাড়ি
বেরিয়েছিল বলে বিকেল তিনটে নাগাদই ঈগলস ক্রেস্টে পৌঁছে গেল ওরা। এবার কিম চোদ্দবার
করে দরজা-জানালা সব বন্ধ আছে কি না চেক করে তবে রিয়ার পিছন পিছন চলল।
ঈগলস
ক্রেস্টকে দিনের বেলা আর অত ভয়াবহ দেখাচ্ছিল না। এমনি কালচে পাথরের তৈরি কুৎসিত
দেখতে একটা বড়ো বাড়ি যেটার দেখাশোনা ঠিক করে করা হয়নি, বাগান আগাছায় ভর্তি। বাড়িটার
পিছনদিকে যেতেই চার্চটাকে দেখতে পেল ওরা। খুব একটা বড়ো নয়, কিন্তু চুড়োর ওপর যখন
ক্রস দেওয়া তখন তো আর চার্চ না হয়ে যায় না।
সামনের
দরজাটা বেশ ভারী। ওরা দুমদুম করে কড়া নেড়ে ‘সোনিয়া, সোনিয়া’ বলে ডাকল, কিন্তু কোনও
সাড়া পেল না। তারপর কিম গায়ের সব শক্তি দিয়ে দরজাটাকে ঠেলতে চেষ্টা করতেই সেটা
খুলে গেল। বাইরের ঝকঝকে আলোর তুলনায় ভিতরটা অন্ধকার মতন দেখাচ্ছিল। কিম ইতস্তত করে
বলল, “ভিতরে ঢুকব? সোনিয়া তো সাড়া দিচ্ছে না!”
“কিন্তু
ও ফোন করে তো বলেছিল এখানেই থাকবে। হয়তো অন্য কোনওদিকে আছে, আমাদের ডাক শুনতে
পায়নি। চলো, ভিতরে গিয়ে দেখে আসি, ও না থাকলে না হয় বাড়িতে যাব।”
ঢুকেই
একটা ছোটো উঠোন মতন। তারপরই বেশ বড়োসড়ো প্রার্থনা সভা। সুন্দর রঙিন কাচ দিয়ে আলো
এসে পড়ছে। সারি সারি বেঞ্চ পাতা প্রার্থনার জন্যে, কিন্তু কেউ কোথাও নেই আর চারদিক
ধুলোয় ভরা আর কেমন একটা গন্ধ।
“সোনিয়া,
সোনিয়া,” বলে আবার হাঁক দিল রিয়া, কিন্তু কোনও উত্তর পেল না।
প্রার্থনা
কক্ষের শেষপ্রান্তে দু’দিকে যাওয়ার দুটো দরজা রয়েছে। তারই একটা দিয়ে ছোটো একটা ঘরে
গেল ওরা।
হঠাৎ
‘ওরে বাবা’ বলে চিৎকার করে উঠল কিম!
“কী
হল?”
“আমার
পায়ের ওপর দিয়ে লোমশ একটা কী হেঁটে গেল! আমি বাইরে চললাম। এমনিতেও এই সোঁদা গন্ধে
আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে!”
“একবার
চট করে সব ঘরগুলো দেখে নিই, তারপর চলে যাব। আমারও যে
জায়গাটাকে খুব একটা পছন্দ হচ্ছে তা নয়।”
ঠিক
তখনই ‘উঁ, উঁ’ শব্দটা শুনতে পেল ওরা। সেই শব্দ অনুসরণ করে পাশের ঘরটায় ঢুকে যে
দৃশ্যটা দেখল ওরা তাতে ওদের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল! সোনিয়া অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়ে
রয়েছে ধুলোভরা মেঝেতে! ওর মুখ টেপ দিয়ে বন্ধ করা, হাত আর পাও বাঁধা! অজ্ঞান
অবস্থাতেই ওর মুখ থেকে ‘উঁ উঁ’ আওয়াজটা বেরোচ্ছিল। দু’জনে
তাড়াতাড়ি ওর বাঁধন খুলে ধরাধরি করে ওকে চার্চের বাইরে নিয়ে এল। কিম সেল ফোনে
বাবাকে ফোন করল। সোনিয়ার জ্ঞান ফিরেছে, কিন্তু ভয়ে মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরোচ্ছিল
না। একটু পরে জল-টল খেয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে ও বলল, “চার্চের পিছনের দিকের একটা ঘর
পরিষ্কার করছিলাম। এমন সময় মাথায় সজোরে একটা বাড়ি পড়ল! চোখের সামনে
অন্ধকার দেখলাম। তারপর আর আমার কিছু মনে নেই।”
পুলিশ,
অ্যাম্বুলেন্স সব এল। সোনিয়া কিন্তু কিছুতেই হাসপাতালে যেতে রাজি হল না।
কিম
আশ্চর্য হয়ে ওকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি এই বাড়িতেই আবার থাকবে? যে বাড়ির লোকজন তোমাকে
মেরে ফেলতে চাইছে?”
“হ্যাঁ,
আমি ভয় পাই না। তাছাড়া আর উপায়ও নেই। হোটেলে থাকতে গেলে বিস্তর
খরচ। এদিকে কাল কয়েকজন ক্রেতার আসার কথা আছে। তারা চার্চ আর সার্ভেন্ট কোয়ার্টার
দেখবে, তাই আমাকে থাকতেই হবে।”
কিমের
বাবা ঈগলস ক্রেস্টের সবার সঙ্গে আবার কথা বললেন। কিম আর রিয়াও ওঁর সঙ্গে লেগে রইল।
মোটাসোটা টাক মাথা ডোনাল্ড হলসন, তার ফ্যাকাসে বউ রুথ আর ফেলিসিটি কিছুই বলল না
তেমন। মার্থা রাগ দেখাল। জর্জ আর সিবিল ধূর্ততার প্রতিমূর্তি
একেবারে! পেটে বোমা মারলেও একটা কথা যেন বেরোবে না!
পরে
কিমের বাবা বললেন, “যে কারও পক্ষেই কাজটা করা সম্ভব। কে যে সত্যি বলছে আর কে যে
মিথ্যে বলছে, বোঝা মুশকিল।”
পুলিশের
লোকজন যখন চলে যাওয়ার জন্যে পাততাড়ি গোটাবার চেষ্টা করছে, রিয়া আর কিম তখন অন্য
একদিকে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল সোনিয়ার কাছে বিদায় নিয়ে ফিরে যাবে বলে। কখন যে জর্জ
ওদের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে ওরা টেরই পায়নি। দাঁতে দাঁত চেপে
হিসহিস করে সে বলল, “তোমরা যদি প্রাণে বেঁচে থাকতে চাও তাহলে আর কখনও ভুলেও এখানে
এস না। তোমাদের ওই শয়তান বন্ধুকেও সাহায্য করার চেষ্টা কোরো
না। শয়তানিকে যে প্রশ্রয় দেয় বা চুপ করে মেনে নেয় সেও
শয়তানি ছড়াতে সাহায্য করে, আর যে শয়তানির বিরোধ করে না সে স্বয়ং শয়তানকে সাহায্য
করছে! কে বলেছে জানো?”
কিম
দুম করে বলল, “মার্টিন লুথার কিং জুনিয়ার!”
জর্জ
আর কিছু না বলে ওদের দিকে একটা জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সরে গেল।
(৫)
পরদিন
রিয়া গম্ভীর মুখ করে ল্যাবে বসে আছে দেখে কিম জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার?”
“কয়েকটা
জিনিসে একটু খটকা লাগছে, তবে ঈগলস ক্রেস্টে আর যেতে চাই না। ওই জর্জ লোকটা
মারাত্মক! তোমার বাবার সঙ্গে একবার বসা যাবে? ও, আরেকটা কথা, তোমার বাবাকে জিজ্ঞেস
কোরো ওঁর কাছে গ্রেটার কোনও ছবি আছে কি না।”
“হ্যাঁ,
নিশ্চয়ই। আমি বাবাকে বলব।”
সেদিন
বিকেলবেলা রিয়া আর কিম পুলিশ স্টেশনে গিয়ে হাজির হল। কিমের বাবা চীফ ডি মার্কো
ওদের জন্যে তৈরি ছিলেন। ওদের নিজের চেম্বারে নিয়ে গিয়ে বসালেন আর ওদের জন্যে কফি
নিয়ে এলেন। ফাইল থেকে একটা ছবি বার করে রিয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “এই হল
গ্রেটা। তুমি নাকি দেখতে চেয়েছিলে?”
রিয়া
আর কিম দু’জনেই ছবিটাকে দেখল। সুশ্রী দেখতে একটা মেয়ে। মাথায় সোনালি চুল। বয়স বেশি
নয়, কিন্তু চোখেমুখে কেমন যেন একটা ধূর্ত ধূর্ত ভাব, মানে ঠিক যে কীরকম চাহনি রিয়া
বুঝে উঠতে পারল না। ছবিটা ফিরিয়ে দিয়ে রিয়া বলল, “আচ্ছা,
সবার চুল যদি সোনালি হয় তাহলে চুল কালো করার ডাইটা কে মাখছে?”
“মানে?”
“সেদিন
যে বাক্সগুলো কিমের গাড়িতে ফেলা হয়েছিল তার মধ্যে একটা চুল কালো করার ডাইয়ের বাক্স
ছিল। ছেলেদের নয়, মেয়েদের। এখানে তো ছেলেদের আর মেয়েদের চুলের ডাইয়ের বাক্স আলাদা
হয় আর বাক্সে বড়ো বড়ো সুন্দর সুন্দর মুখের ছবি দেওয়া থাকে যাতে বুঝতে অসুবিধা না
হয়।”
থুতনিতে
হাত বোলালেন কিমের বাবা। “হুঁ, ডোনাল্ড আর জর্জের মাথায় তো
চুল প্রায় নেইই, ডাই করবে কী! দু’জনেই টেকো। জর্জ তাই সর্বক্ষণ মাথায় টুপি পরে
থাকে। মহিলাদের মধ্যে রুথ হলসনের চুল সাদাটে মতন আর ফেলিসিটি মার চুল পেয়েছে।
গ্রেটার চুল সোনালি, মার্থার সব চুল পাকা। একমাত্র কালো চুল...”
“হ্যাঁ,
একমাত্র কালো চুল সোনিয়ার। কিন্তু ওকে চুল কালো করতে হল কেন? মানে ডাইয়ের প্রয়োজন
হল কেন?” রিয়ার কপালে ভাঁজ পড়ল।
কিম
লাফিয়ে উঠল। “হয় ওর সব চুল পেকে গেছে, না হলে ওর নিজের চুল
কালো নয়। কিন্তু ড্যানিয়েল হলসনের মেয়ের চুল কালো ছিল!”
(৬)
কিমের
বাড়িতে রাতের খাবার সময় ডাইনিং টেবিলে বসে কথা হচ্ছিল। কিমের মা’র ডিনার টেবিলে ওইসব
কথাবার্তা নিয়ে ঘোর আপত্তি, কিন্তু অন্যরা কেউই শুনছিল না ওঁর কথা।
চীফ
ডি মার্কো বললেন, “সোনিয়া, মানে এলিজাবেথ রকওয়েল সব স্বীকার করেছে। ওকে ডাইয়ের
কথাটা বলতে আর ডিএনএ টেস্টের কথা বলতেই সে ভেঙে পড়ল। ইউরোপে ওর কলেজের বন্ধু ছিল
সোনিয়া হলসন। তার কাছে ঈগলস ক্রেস্টের গল্প শুনে শুনেই ওর মাথায় ওই কুবুদ্ধিটা আসে।
এখানে মানে আমেরিকায় তো সোনিয়া হলসনকে কেউ দেখেনি, তাই ইউরোপের সোনিয়া যদি ভ্যানিশ
হয়ে গিয়ে এখানে চলে আসে তাহলে তো কারও কিছু বোঝার কথা নয়। পাহাড়ে বেড়াতে নিয়ে গিয়ে
ঠেলে ফেলে দিয়ে সোনিয়াকে পথ থেকে সরায় এলিজাবেথ। এলিজাবেথ রকওয়েলের মৃত্যু হয়েছে রটিয়ে
দিয়ে সোনিয়া সেজে মার্কিনমুলুকে আসে। সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। যা আশা করেছিল তার থেকে
অনেক বেশি পেয়ে গিয়েছিল। এমন সময় সোনিয়ার আরেক বন্ধু গ্রেটা কিছু একটা সন্দেহ করে
এখানে এসে হাজির হয়। বা হয়তো সে সোনিয়ার সঙ্গেই দেখা করতে এসেছিল। গ্রেটা পুলিশে
না গিয়ে এলিজাবেথকে তেড়ে ব্ল্যাকমেল করতে শুরু করে। শত্রুর শেষ রাখতে নেই ভেবে
গ্রেটাকে পথ থেকে সরানোর ফন্দি করে এলিজাবেথ। নিজের জীবনের ওপর হামলার গল্পটা তৈরি
করে। তারপর গ্রেটাকে নিজের জামা পরতে দেয়। সেটা অবশ্য বেশ
কিছুদিন ধরেই দিচ্ছিল। হাওয়ায় চুল ওড়ে বলে মাথায় স্কার্ফ
দিয়েছিল গ্রেটা। তাই চুলের রঙও বোঝা যাবে না, এইসব দেখেশুনে
রেখেছিল এলিজাবেথ। তারপর ডেস্ক থেকে বন্দুক বার করে গ্রেটাকে মারাটা মোটেই কঠিন
ছিল না ওর পক্ষে। বাড়ির অন্য সবার মতনই সেও ছিল দক্ষ বন্দুকবাজ আর একটা খুন তো সে
আগেই করেছে! গ্রেটার খুনের ব্যাপারে নিজের ওপর থেকে সন্দেহ সরাবার জন্যেই ও আগে
থেকে আমাদের আর তোমাদের ফুড পয়জনিং আর মূর্তি ঘাড়ে পড়ার গল্প বলে রেখেছিল।
ভারি চালাক!”
“কিন্তু
আমরা যে ওকে চার্চে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পেয়েছিলাম!” কিম চোখ বড়ো বড়ো করে বলল।
“সেটাও
ওর একটা কারসাজি! ও নিজেই ওটা করেছিল। ওটা করা
সম্ভব। কিছু বিশেষ ধরনের গিঁট বাঁধতে জানতে হয়, ব্যস!
তোমরা তখন ওকে ঐ অবস্থায় দেখে তাড়াতাড়ি করে ওর বাঁধন খুলে দিয়েছিলে, তাই খেয়াল
করনি। ও সেটাই আশা করেছিল। ও যখন হাসপাতালে যেতে রাজি
হল না আমার তখনই বোঝা উচিত ছিল। ও
ফেঁসে গেল শুধু জর্জের পাগলামির জন্যে। হ্যাঁ,
কিমের গাড়িতে ওইসব ময়লা জর্জই ঢুকিয়েছিল। সে স্বীকার করেছে যে তোমাদের ওপর রাগে সে
ময়লা ফেলার ড্রামটা নিয়ে গিয়ে গাড়ির ভিতরে উলটে দিয়েছিল। এলিজাবেথ ভাবতেও পারেনি
যে ময়লা ফেলার ড্রামের তলায় লুকিয়ে দেওয়া হেয়ার ডাইয়ের প্যাকেট কেউ কোনওদিন দেখবে
বা খেয়াল করবে। অতি চালাক খুনিও ভুল করে বসে।
ভাগ্যিস, সেদিন রিয়া ওটা খেয়াল করেছিল, নাহলে আমরা আরও কিছুদিন অন্ধকারে হাতড়ে
বেড়াতাম আর এলিজাবেথ রকওয়েল চার্চ আর সার্ভেন্ট কোয়ার্টার বিক্রি করে সেই অর্থ
নিয়ে হাওয়া হয়ে যেত। ঈগলস
ক্রেস্টের লোকজন এখন খুশি। ওরা বুঝতে পারছিল, এলিজাবেথের অভিপ্রায় অসাধু, কিন্তু
আর্নেস্ট হলসনের মুখের ওপর কথা বলার সাহস ওদের কারও ছিল না। আর্নেস্ট হলসনেরও দোষ
ছিল না। এলিজাবেথ অভিনয় ভালোই করছিল, তাই ওর চাল ধরা সম্ভব
ছিল না। তাছাড়া উনি সেই কোন দশ বছর আগে নাতনির ছবি দেখেছিলেন। এলিজাবেথ
যে ওঁর নাতনি নয় সেটা উনি মোটেই বুঝতে পারেননি। ওঁর সঙ্গে সবসময় অতিরিক্ত মিষ্টি
ব্যবহার করত সে।”
রিয়া
বলল, “ও যদি অত হুড়োহুড়ি করে ঈগলস ক্রেস্টের চার্চ আর আউট-হাউসটা বিক্রি করার
চেষ্টা না করত তাহলে আমারও ওর ওপর সন্দেহ হত না। বলছিল
বটে যে ওকে মারার চক্রান্ত চলছে বলে ও তাড়াতাড়ি পালাতে চায়, কিন্তু বড্ড যেন তাড়া
দেখাচ্ছিল। দোকানে শ্যাম্পু কিনতে গিয়ে ডাইয়ের তাকটা দেখে হঠাৎ ধাঁ করে মাথায় খেলে
গেল ঐ ব্যাপারটা।”
(৭)
কিমের
বাবা ঈগলস ক্রেস্টের বাসিন্দাদের কী বলেছিলেন কে জানে, কিন্তু কয়েকদিন পর পোস্টে
ওখান থেকে একটা থ্যাঙ্ক ইউ কার্ড পেল রিয়া। কার্ড মানে একটা ছবি। পিছনে সবাই সই
করেছে। জলরঙে আঁকা ছবি। ঈগলস ক্রেস্টকে বেশ একটা মায়াবী আলোয় ধরেছে ফেলিসিটি।
কার্ডটা পেয়ে রিয়া খুশিই হল, আর ভাবল, যাক এবার ঈগলস ক্রেস্টের বাসিন্দারা নিজেদের
মতন করে কাটাতে পারবে তাদের বাকি জীবনটা।
_____
অলঙ্করণঃ পার্থ মুখার্জী