![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEg6rlWtbLQ4WTmBmq8Mu_5yK_j5iJfTdNRIchYd_knci80vAg2ogOCnJTJu2BFSnUydKww7sPSFE0UYQa90QQY4_TdBjmYyytc4l3lARe-sGlMz8AyiBvQdgdPn9aJzI3inaCFrxmvk9KfB/s640/Lomba+safar+Debjyoti+Jan18+1.jpg)
একটা
লম্বা সফরের কাহিনী
দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
।। পর্ব
তিন ।।
১২ই জুন, ১৮৩৪ তারিখ সকালে জাহাজ প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূল
বেয়ে এসে পৌঁছাল চিলির উপকূলে চিলো দ্বীপে। সেখান থেকে খাবারের জন্য কিছু শুয়োর আর
আলু তুলে নিয়ে, দ্বীপের পশ্চিম উপকূলের সমীক্ষা সেরে পরের দিন নোঙর তুলতে হাঁফ
ছেড়ে বাঁচলেন ডারউইন। জায়গাটায় কখনও বৃষ্টি থামে না। বেজায় স্যাঁতসেঁতে। সেখানে
কিছু ইণ্ডিয়ানের বাস। ভারী দুর্দশায় জীবন কাটে তাদের।
উপকূলবর্তী সমুদ্র দিয়ে চলতে চলতে অবশেষে ২৩ তারিখে ভালপারাইজোর দেখা
মিলল। এখানে আবহাওয়া বেশ গরম। সমুদ্রও শান্ত। ফলে ডারউইনের পেটটা বেশ সুখী হয়ে
উঠছিল এ তল্লাটে পৌঁছে। ভালপারাইজো শহরটা ভারী সুন্দর। হাওয়া শুকনো। নীল আকাশ।
চমৎকার সব পাহাড় চারধারে।
![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEh-o4d9OfjIl-EDxJAdhen9uVanB0qicIvC1mql4DVUMUXGxi5zt9tYukfJApQ5v7_Ht2TvzeAs6nb1CJC1W8k3AOWjdi3kasUQYtro8dXE0xjfE1dysU6tYklD68d554oeduUqS0me-4Qq/s400/Lomba+safar+Debjyoti+Jan18+2.jpg)
এখান থেকে শুরু হবে প্রশান্ত মহাসাগরের যাত্রা। অতএব ভালপারাইজোতে
দুই জাহাজই কয়েক সপ্তাহ ধরে লম্বা যাত্রার জন্য সারাই-সুরাই করবে। ডারউইন অতএব মনের
আনন্দে শহরে ঘুরে বেড়ান। বাসা নিয়েছেন শ্রসবেরির পুরোনো সহপাঠী রিচার্ড করফিল্ডের
বাড়িতে। আশপাশের গ্রামাঞ্চলগুলোয় ঘুরে ঘুরে নানান জাতের নমুনা জোগাড় করা তখন তাঁর
সারাদিনের কাজ।
কয়েকদিন সে-কাজ করতে করতে জাহাজদের সারাই শেষ। তারা কয়েকদিনের জন্য
রওনা দিল উপকূলবর্তী এলাকার সমীক্ষার কাজে। লম্বা সফরের আগে জাহাজগুলো কেমন সারাই
হল সেটাও বাজিয়ে দেখে নেওয়ার ইচ্ছে তাদের ওই করে।
মাসদেড়েক সময় নেবে দুই জাহাজ সে-কাজ শেষ করতে। ডারউইন সে-সময়টা
জাহাজে না ফিরে রওনা হলেন আন্দিজের দিকটা খানিক ঘুরে দেখে নিতে।
আগস্টের চোদ্দো তারিখ। উপকূল ধরে উত্তরমুখো এগোতে এগোতে হঠাৎ চোখে
পড়ল, বেশ অনেকটা উচ্চতায় চুনাপাথরের একটা স্তর। সাধারণ মানুষের কাছে তার বিশেষ কোন
তাৎপর্য না থাকলেও ডারউইনের বেশ আনন্দ হল তার উচ্চতা দেখে। কারণটা সহজ। ডারউইনের
দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূল আস্তে-আস্তে সমুদ্রস্তর থেকে উঁচু
হয়ে উঠছে। বেশ খানিক উচ্চতায় চুনাপাথরের এই স্তরটা তার অব্যর্থ প্রমাণ। অতটা মাথা
উঁচিয়েছে তাহলে এই উপকূল।
এরপর দীর্ঘ দেড় মাস ধরে কিলোটা উপত্যকা, বেল মাউন্টেন, সান ফিলিপের
কাছে জাজুয়েলের তাম্রখনি, সান্তিয়াগো, কাচাপুয়ালের উষ্ণ প্রস্রবণ, টাগুয়া-টাগুয়া
হ্রদ হয়ে যখন ফের উপকূলবর্তী শহর নাভিদাদ পৌঁছেছেন, তখন দীর্ঘদিন পাহাড়ে জঙ্গলে
ঘুরে ঘুরে নমুনা সংগ্রহ আর কঠিন ট্রেক-এর ফলে বেজায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সেখান থেকে
উপকূল ধরে সেপ্টেম্বরের সাতাশ তারিখে ভালপারাইজোতে এসে পৌঁছোতে বেশ কষ্টই হয়েছিল তাঁর।
তবে কষ্ট হলেও দীর্ঘ এই যাত্রায় অসংখ্য উল্লেখযোগ্য নমুনা তাঁর সংগ্রহে এসেছিল।
![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEhjaHDaRaA79aZ73baXulUyAgtJprWENC7IY5riIoA6lyh-LAEj2SWw7Ag0FYIFWuz0MR1V2l5nBIcoWWZGNawZjmtRj8WS9vTcCkd8k9cwbqFby4bX_ok4zcSJSS03W3Si9Jt-ZUb-XLQK/s400/Lomba+safar+Debjyoti+Jan18+3.jpg)
ভালপারাইজোতে ফিরে ফের জ্বর গায়ে করফিল্ডের বাড়ি। দিদিকে চিঠিতে
লিখলেন জ্বর হয়ে কী বেজায় কষ্ট পাচ্ছেন। তারপর জ্বর গায়েই সমস্ত নমুনা প্যাক করে
পাঠাবার বন্দোবস্ত সারলেন হেনসলোর কাছে। হাজারো জাতের লতাপাতা, পাখির ছাল,
পোকামাকড়, বীজ, জল আর গ্যাসের নমুনা — কী নেই তাতে!
ইতিমধ্যে খবর এল ক্যাপ্টেন ফিটজরয়ের নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়ে গেছে। সে
নিয়ে ভারী একচোট নাটক হয়ে গেল জাহাজে। একে তো মাসের পর মাস ধরে সমীক্ষার চাপ, তার
ওপর দেশের নৌ-বিভাগের কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও বেজায় ঝগড়া বেধেছিল তখন তাঁর। তাদের
অনুমতি না নিয়ে ডিসকভারি জাহাজটাকে কেন দুম করে কিনে বসলেন তিনি সে-নিয়ে তখন
ফিটজরয়ের ওপর বেজায় রেগেছেন তাঁরা।
এহেন অবস্থায় ফিটজরয় বেজায় রেগে গিয়ে করলেন কী, প্রথমে ডিসকভারিকে
বেচে দিলেন। তারপর লেফটেন্যান্ট উইকহ্যামকে জাহাজের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে সটান
ইস্তফা দেবার মতলব করলেন চাকরি থেকে। বলে দিলেন, পশ্চিম উপকূল এলাকার সমীক্ষা শেষ
করে কেপ হর্নকে পাক দিয়ে জাহাজ নিয়ে ফিরে যান ইংল্যাণ্ডে। আমার দ্বারা এ-কর্ম আর
হবে না।
উইকহ্যাম মানুষটার সঙ্গে ফিট্জ্রয়ের কোন তুলনাই চলে না। বেজায়
ঘাবড়ে গিয়ে তিনি তখন বারবার ফিটজরয়কে আটকাতে চাইছেন। শুধু বলেন একলা একলা কেপ হর্ন
দিয়ে? আবার? ওরে বাবা। আমি তা পারব না ক্যাপ্টেন।
অনেক কাকুতিমিনতির পর ফিটজরয় যখন বুঝলেন একে দিয়ে কাজ হবে না তখন
বাধ্য হয়েই নিজের ইস্তফা ফিরিয়ে নিয়ে ফের দায়িত্ব নিলেন জাহাজের।
ভাবছ এই সাধারণ একটা ঝগড়ার ঘটনাকে নিয়ে কেন এত লেখালিখি? কারণ আছে।
ধরো যদি উইকহ্যাম সেদিন ফিটজরয়ের কথা মেনে নিতেন, তাহলে? জাহাজ ফিরে যেত
গ্যালাপোগাসকে না ছুঁয়েই। ডারউইন সে দ্বীপ দেখতে পেতেন না। লেখা হত না অরিজিন অব
স্পিসিস নামের যুগান্তর আনা সেই বই। শুরু হত না অন্ধ ধর্মবিশ্বাসের বিরুদ্ধে
জীববিদ্যার জয়যাত্রা। মানুষের ইতিহাসটাই হয়তো অন্যভাবে গড়ে উঠত। হয়ত আজকের
পৃথিবীটার চেহারাও অন্যরকম হয়ে যেত সেদিন উইকহ্যাম ফিটজরয়ের কথা শুনলে। আসলে
এইভাবেই আজকের আপাত তুচ্ছ ছোট্ট কোনও ঘটনা আসলে ভবিষ্যতের অনেক বড়ো কোনও বিষয়ের
ভাগ্য তৈরি করে দেয়। (বিজ্ঞানের ভাষায় একে বাটারফ্লাই এফেক্ট বলে জানো তো? সে ভারী
মজার তত্ত্ব। ধরো সমুদ্রের গহনে কোনও দ্বীপে একটা প্রজাপতি তার ডানা নাড়াল। হবি তো
হ, তার ধাক্কাটা আবহাওয়ার কোনও একটা ভারসাম্যকে এমনভাবে একটুখানি নাড়িয়ে দিল যে
তার থেকে বাড়তে বাড়তে তৈরি হল বিরাট টর্নাডো ঝড়। ধেয়ে এসে অনেক মানুষের প্রাণ নিয়ে
নিল সে। গুগল সার্চ করে পড়ে নিও ব্যাপারটা। মজা পাবে।)
![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEjmIsfIXRBl8EBLe64zHDmI6m11elxygvK3x43Pmf4ar8dgfqcutLxSvDT3Gm9Gg15cyDD-00TxtHni4XFxWGnTu5qAZ6bB5bV4sKvF63C5vT-WtLvqIZ9p2LoRxM-jANz3OyY41nXGsSRa/s400/Lomba+safar+Debjyoti+Jan18+4.jpg)
ঝগড়া চলাকালীন বেকায়দা দেখে ডারউইন তখন অন্য পরিকল্পনা করে রেখেছেন।
দিদিকে চিঠিতে লিখলেন, ঝামেলা না মিটলে তিনি কর্ডিলেরা পাহাড় হয়ে ঘুরতে ঘুরতে লিমা
যাবেন। তারপর সেখান থেকে ফের এদিক ওদিক পথ চলে ভালপারাইজো এসেফের কর্ডিলেরা পেরিয়ে
বুয়েন্স্ এয়ার্স চলে যাবেন। তারপর সেখান থেকে জাহাজ ধরে ইংল্যান্ডের বাড়ি।
ভাগ্যিস তেমনটা হয়নি শেষপর্যন্ত!
নভেম্বরের শুরুতে ফিটজরয় তাঁর পাটাগোনিয়া, তিয়েরা দেলফুয়েগো আর
ফকল্যান্ডের সমীক্ষার কাগজপত্র ইংল্যাণ্ডে পাঠিয়ে দিয়ে সমুদ্রযাত্রার জন্য তৈরি
হয়ে গেলেন। নভেম্বরের দশ তারিখে ভালপারাইজো থেকে জাহাজে তুলে নেওয়া হল ডারউইনকে।
জাহাজ চলল দক্ষিণমুখো ক্রোনোস দ্বীপমালা হয়ে চিলো দ্বীপকে পাক দিয়ে ত্রেস মন্তেস
অন্তরীপের দিকে।
ডিসেম্বরের কুড়ি তারিখ নাগাদ ত্রেস মন্তেস এলাকার কাজ সেরে এস্তেভান
বলে একটা জায়গায় চাঁদের মত বাঁকা এক উপসাগরে সবে নোঙর ফেলেছেন তাঁরা এমন সময় একটা
উত্তেজক ঘটনা ঘটল। নাবিকরা দেখে পাড় থেকে একটা লোক পাগলের মত শার্ট ওড়াতে ওড়াতে
দৌড়ে আসছে। ব্যাপারখানা কী? তাকে পাকড়াও করে এনে শোনা গেল, তারা দলে ছ’জন।
আমেরিকান নাবিক। ফ্রান্সেস হেনরিয়েটা নামে একটা তিমি শিকারের জাহাজে কাজ করত।
জাহাজ থেকে পালিয়ে তারা দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলে পৌঁছোবার ফন্দি এঁটেছিল। ইচ্ছে ছিল
কাছাকাছি ভ্লাডিভিয়া বলে একটা জায়গায় গিয়ে নামবে। কিন্তু রাস্তায় নৌকোডুবি হয়ে
প্রায় সোয়া বছর ধরে সেই নির্জন জায়গায় বন্দি হয়ে আছে। তাড়াতাড়ি নৌকো পাঠিয়ে হতভাগা
মানুষগুলোকে জাহাজে তুলে আনা হল।
![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEjSz05xyyy_aw7Rh-NIo1mfFhDo4DL-NsdF5-wc5MP5sLLBe-bHIlO_CHCErpAe_JC1WFDkOm0zW5uQqyhbi53T2HHvefsWTt4CAlZx0mWXq2s8ycerwV1FBJDXJE_NtMNQCFFl0tRlIPVW/s400/Lomba+safar+Debjyoti+Jan18+5.jpg)
গোটা জানুয়ারি মাসটা জুড়ে সে-এলাকায় ঘোরাঘুরি শেষ করে ক্রোনোস
দ্বীপমালা থেকে প্রচুর মাছ, ঝিনুক, হাঁস জোগাড় করে তাই দিয়ে পেট চালিয়ে অবশেষে
ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে জাহাজ গিয়ে পৌঁছোল ভ্লাডিভিয়া উপকূলে।
এইখানে থাকাকালীন ১৮৩৫-এর ফেব্রুয়ারির কুড়ি তারিখ তিন মিনিটব্যাপী
একটা বেজায় ভূমিকম্প হয়েছিল। তাতে সে-এলাকার সব বাড়িঘর ধুলোয় মিশে যায়। কিন্তু
তাতে একজনের একটা লাভ হয়েছিল। তিনি ডারউইন। সেইটা এখানে বলা যাকঃ
ভ্লাডিভিয়ার কাজ সেরে মার্চের চার তারিখে জাহাজ এল কনসেপশান-এর কাছে টালকুহানো
বন্দরে। ভূমিকম্পে এই জায়গাটাও বেজায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।এইখানে কুইরিকিনা নামের
একটা ছোট্ট দ্বীপে কিছু একটা দেখে ডারউইন সেখানে নেমে পড়লেন জাহাজ থেকে। তাঁর চোখে
পড়েছে দ্বীপের পাশে সমুদ্র থেকে সদ্য উঁচু হয়ে ওঠা কিছু সামুদ্রিক চুনাপাথরের
স্তর। ভূমিকম্পের ফলে তাদের সাগরতলের নিচু বাসা ছেড়ে খানিকটা মাথা উঁচু করছে তারা।
![](https://blogger.googleusercontent.com/img/b/R29vZ2xl/AVvXsEiuBHMgzphfGOGCJEKWKH6thQyoIl9SL1AIhK51Iaaoq_FATbVIpiNaSykAiDbNI0_JyIaBLWKsEEMLm5mwioHDRPmb71XXxFZbgzl4h1JhMd2Sz3oh3x-mIvfT5INEGyuqMiPNt1VX9-3o/s400/Lomba+safar+Debjyoti+Jan18+6.jpg)
এইবার দ্বীপে ঘুরে ঘুরে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে শুরু করলেন ডারউইন। ফলও
ফলল হাতেনাতে। খুঁজে পেয়ে গেলেন একেক জায়গায় অনেক উচ্চতায় মাথা উঁচিয়ে থাকা, ঝিনুক
শামুকের দেহ থেকে তৈরি চুনাপাথরের স্তর। ভূমিকম্পে সদ্য মাথা জাগানো, আর অনেক
উঁচুতে উঠে যাওয়া পুরোনো চুনাপাথরের স্তরগুলো ফের একবার অব্যর্থ প্রমাণ দিচ্ছিল
তাঁর তত্ত্বের — দীর্ঘকাল ধরে পৃথিবীর মাথা নাড়ানো ভূকম্পের ফলে একটু একটু করে উঁচু
হয়ে উঠছে এই উপকূল। কাত হয়ে পড়ছে গোটা মহাদেশটা তার পুবের দিকে।
কিন্তু এর পাশাপাশি আরও একটা গুরুতর কথা তাঁর মাথায় আসছিল সেই দ্বীপে
দাঁড়িয়ে। ‘লিল’-এর তত্ত্ব বলেছিল মহাদেশীয় ভূমিদের সামান্য উত্থানপতন
ঘটতেও বহুকাল সময় লাগে (এপিসোড ১ দেখ, http://www.magiclamp.net.in/2017/04/blog-post_32.html)। পুন্টা অল্টার সেই বহু উঁচুতে ডারউইনের খুঁজে পাওয়া সামুদ্রিক জীবের
ফসিলের বয়স যে বহু লক্ষ বছর, সে কথা অনুমান করবার জন্য ‘লিল’-এর এই তত্ত্বর ওপর নির্ভর করেছিলেন ডারউইন। কিন্তু খোদ ‘লিল’-এর তত্ত্বটার সত্যতার চাক্ষুষ প্রমাণ এইবার তাঁর
সামনে এসেছে। একটা ধাক্কায় যতটুকু উঠেছে এই শিলাস্তর তা থেকে হিসেব করলে সত্যিই
আন্দাজ করা যায়, বহু উঁচুতে যেসব চুনাপাথরের স্তর রয়েছে, যা কিনা এককালের
সামুদ্রিক শামুক-ঝিনুকের দেহাবশেষ থেকেই তৈরি, সেগুলোর তত উঁচুতে পৌঁছোতে লক্ষ
লক্ষ বা কোটি কোটি বছরই লাগবার কথা। আর, তার মানে আমাদের এই পৃথিবী বাইবেলের কথামতো
মাত্র ছ’হাজার বছরের পুরোনো হতে পারে না! ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত একটা ছোট্টো
প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপে এইভাবেই খ্রিস্টান ধর্মের অন্ধবিশ্বাসের কফিনে আরও একটা
পেরেক পুঁতে দিয়েছিলেন সেই ছেলেটি।
মাঝে একবার ভালপারাইজোতে ফিরে গিয়ে কিছু নোঙর কিনে নিয়ে বিগ্ল্ তখন
ফের ফিরে এসেছে সে-এলাকায়, ভূমিকম্পের ফলাফল নিয়ে সমীক্ষা চালাতে। ডারউইনের
সে-কাজে ততটা উৎসাহ আর নেই তখন। তাঁর তখন ফের মন টেনেছে দুর্গম আন্দিজ। ঘুরে ঘুরে
সমীক্ষার কাজ চালায় বিগ্ল্। সেই করতে করতে সান্তিয়াগোয় পৌঁছে ফিটজরয়ের অনুমতি
নিয়ে কিছুদিনের জন্য জাহাজ ছাড়লেন তিনি। ক্যাল্ডক্লিউ নামে এক ভদ্রলোকের সহায়তায়
সূচনা হল আন্দিজে তাঁর দ্বিতীয় অভিযানের।
মার্চের আঠারো তারিখের একটা ঠাণ্ডা দিনের ভোর চারটেয় ডারউইনের যাত্রা
শুরু হল সান্তিয়াগো থেকে। সঙ্গে ছিল মারিয়ানো গঞ্জালেস নামে এক স্পেনিয় গাইড, মাল
বইবার জন্য দশটা খচ্চর আর তাঁর নিজের জন্য এক বুড়ি ঘোড়া। বছরের এ-সময়টা আন্দিজের
বেশির ভাগ গিরিসঙ্কটই বরফে ঢাকা থাকে। সে-সব পথ দিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এদেরই মধ্যে
একটু কম দুর্গম হল পোর্টিলো পাস আর উসপিল্লাটা পাস। অতএব নবীন অভিযাত্রী পোর্টিলো
পাস-এর পথে রওনা হলেন সান্তিয়েগোর সীমানা ছাড়িয়ে। পথ চলল আদিম মে-পো নদীর পাড় ঘেঁষে, তার বিস্তীর্ণ উপত্যকাকে
ছুঁয়ে ছুঁয়ে।
রওনা হবার তিনদিনের মাথায় শুরু হল পোর্টিলো পাস বেয়ে পেকুয়েনে
উপত্যকার দিকে ওঠবার পালা। বেশ অনেকটা উজিয়ে উঠতেই শুরু হয়ে গেল শ্বাসকষ্ট। কোনও
গাছপালা, জীবজন্তু এমনকি কীটপতঙ্গও নেই এলাকাটায়। তবে ওসব নিষ্প্রাণ জমি,
শ্বাসকষ্ট-টষ্টের কথা শিগগিরই বেমালুম ভুলে গেলেন তিনি। কারণ, সমুদ্রতল থেকে ১৯০০০
ফিট উচ্চতায়, পোর্টিলো পাস এর মাথার কাছাকাছি ঘন মেঘের রাজ্যেও তাঁর পায়ের কাছের
পাথরে তিনি তখন খুঁজে পেয়ে গেছেন কিছু সামুদ্রিক শামুকের খোলার প্রস্তরীভূত জীবাশ্ম!
দিনদুয়েক বাদে দুর্লভ সৌভাগ্যের চিহ্নের মতোই সেই নমুনা সঙ্গে করে
তাঁরা নেমে চললেন পাস-এর উলটো পাশে মেনডোজা শহরের দিকে। মেঘের মধ্যেই ক্যাম্প পড়ল
লস আরেনালস নামের একটা নির্জন জায়গায়। এদিকটার জীবজন্তু আর গাছপালাদের চেহারা
পাটাগোনিয়ার সঙ্গে অনেকটাই মেলে। অথচ পাস-এর উলটোদিকের চিলির সঙ্গে তার কোনও মিল
নেই।
এর দিনদুয়েক বাদে আবহাওয়া পরিষ্কার হলে কাছাকাছি অন্য একটা পাহাড়ের
মাথায় চেপে পুবদিকে প্রথম দেখা মিলল দক্ষিণ আমেরিকার বিখ্যাত তৃণভূমি
প্যাম্পাস-এর। ২৬ তারিখের বিকেলে লুক্সান নদী পেরিয়ে মেনডোজার কাছাকাছি একটা ছোট্টো
গ্রামে ক্যাম্প করা হল।
রাত্রিবেলা এক বিপত্তি হল। বেজায় যন্ত্রণায় ঘুম থেকে জেগে দেখেন এক
বিচ্ছিরি চেহারার পোকার দল আক্রমণ করেছে তাঁকে। গায়ে শুঁড় ডুবিয়ে রক্ত শুষে যাচ্ছে
প্রাণপণে। পোকাদের তাড়ানো হলে গাইড বলল ও হল বেনচুকা পোকা। ও কামড়ালে অনেক অসুখ
হয়। ডারউইন অবশ্য তাতে মোটেই ঘাবড়ালেন না। বরং করলেন কী, পেট ভরে রক্ত চুষে মোটকা হয়ে ওঠা একটা পোকাকে
ধরে তাকে পুষ্যি নিলেন। তারপর কয়েক মাস ধরে চলল তাকে রক্ত খাওয়ানো আর পরীক্ষা করে
দেখা, একবার রক্ত খেলে কদ্দিন তার খিদে পায় না। বিগল-এ পৌঁছোবার পর জাহাজের এক
অফিসারও তাকে খাওয়াবার জন্য রক্ত দিতেন।
মার্চের আঠাশ তারিখে মেনডোজা পৌঁছে, একটামাত্র দিন বিশ্রাম নিয়ে ২৯
তারিখেই ডারউইনের চিলির দিকে ফেরবার পালা শুরু হল। রওনা হলেন মেনডোজার উত্তরে
উসপাল্লাটা পাসের দিকে।
পথে ভিলা ভিসেনসিওতে কয়েকদিন থেকে গেলেন তিনি। কারণ সে-জায়গার
ভূতত্ত্ব। সে জায়গার সমস্ত পাহাড় সমুদ্রতলের লাভাস্রোত থেকে তৈরি! অথচ সমুদ্রতল
থেকে তার উচ্চতা ছ’হাজার ফিট আর সমুদ্রতট থেকে তা সাতশো মাইল ভেতরে! আশ্চর্যের
ওপরে আশ্চর্য, এগারোটা পাইনজাতীয় গাছের ফসিলও মিলে গেল তাঁর এখানে। সেইসঙ্গে আরো
ত্রিশ-চল্লিশটার শুধু খানিক চুনজাতীয় অবশেষ বাকি রয়েছে। আরেকটা জায়গায় দেখা গেল পাথরে
বদলে যাওয়া একটা গোটা জঙ্গল।
মাথায় অজস্র প্রশ্ন ঘুরছিল ডারউইনের। সমুদ্রের তলা থেকে এতটা উঁচুতে
উঠতে যে বহু লক্ষ বছর সময় লেগেছে এ জায়গার, সে তো তিনি আগেই প্রমাণ পেয়েছেন।
কিন্তু সেই সমুদ্রের নিচে যাবার আগে, এ জায়গা নিশ্চয় সমুদ্রতল থেকে বহু উঁচুতে
ছিল। নইলে পাইনজাতীয় গাছ এখানে আসবে কী করে? তার মানে তার প্রথমে সমুদ্রে ডুবতেও
নিশ্চয় লক্ষ লক্ষ বছর লেগেছে। তারপর ফের লক্ষ লক্ষ বছর লেগেছে তার জলের তলায় থেকে
গাছগুলোর পাথুরে ফসিলে বদলে যেতে, বা সামুদ্রিক নুনের প্রভাবে চুনজাতীয় অবশেষে
বদলে যেতে। তারপর ফের লক্ষ লক্ষ বছর লেগেছে তাদের সমুদ্রতল ছেড়ে এই উচ্চতায় ফের
উঠে আসতে। তাহলে, ঠিক কত পুরোনো আমাদের পৃথিবীটা? তাহলে তার জমি কি লক্ষ লক্ষ
বছরের একেকটা পর্বে বারবার সমুদ্রের তলায় তলিয়ে যায়, তারপর ফের মাথা জাগায়? অনাদিকাল
থেকে এ কোন নাগরদোলার খেলা চলছে ভূস্তরকে নিয়ে প্রকৃতির?
এর পরের কয়েকটা দিন হতভম্ব হয়ে যাওয়া ডারউইন কেবল ভাবতে চেষ্টা করে
চললেন, লিল থাকলে কীভাবে এর ব্যাখ্যা দিতেন? আর সেই করতে করতেই তাঁর মনে জন্ম নিতে
লাগল তাঁর একেবারে নিজস্ব ভূতত্ত্বের কিছু অনুমিতি।
আর বিশেষ বাকি ছিল না তাঁর সে যাত্রার আন্দিজ অভিযানের। এপ্রিলের
শুরুতে সান্তিয়াগোতে ফিরে কয়েকদিন ক্যাল্ডক্লিউ-এর বাড়িতে বিশ্রাম নিয়ে তিনি
ভালপারাইজোতে বন্ধু করফিল্ডের বাড়িতে ফিরে এসে নতুন একটা অভিযানের পরিকল্পনা
করলেন। আরও তথ্য চাই তাঁর। এবার তাঁর পথ চলবে উপকূল ধরে উত্তরের দিকে।
খুব ভালো লাগল।
ReplyDeleteরোমাঞ্চকর
ReplyDeleteযাঁরা পৃথিবীকে বদলে দিয়েছেন চিরাচরিত ধ্যানধারণা ও ধর্মীয় বিশ্বাসের মূলে আঘাত দিয়ে, কেউবা নিজের জীবন দিয়েও- চার্লস ডারউইন তাঁদেরই একজন। এত বিস্তারিতভাবে ডারউইনের যাত্রা-বিবরণী পড়তে তাই খুবই আনন্দ পাচ্ছি।
ReplyDelete