গো ফর গোয়েন্দা
সবর্না চ্যাটার্জ্জী
রহস্যের
প্রতি মানুষের কৌতূহল বোধহয় চিরকালীন। আমাদের
দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার সঙ্গে যা খাপ খায় না, আপাতদৃষ্টিতে যার কার্য-কারণ সম্পর্ক স্পষ্ট নয়,
সেই আলো-আঁধারি ধোঁয়াশা ভাব আমাদের মনকে সর্বদাই
বিস্মিত করে, রোমাঞ্চ জাগায়, অনেক সময় আতঙ্কেরও
কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এইসব কারণের
পিছনে লুকিয়ে থাকে কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষের চক্রান্ত। বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দা
চরিত্র বা ‘ডিটেকটিভ’ বলতে সেইসব কল্পচরিত্র বোঝায় যারা রহস্যোপন্যাসে কেন্দ্রীয়
চরিত্র হিসাবে রহস্য উন্মোচন করে। এরা
মূলত সৌখিন গোয়েন্দা, পুলিশ কর্মকর্তা বা স্পাই
অর্থাৎ গুপ্তচর। এই গোয়েন্দা-কাহিনিগুলো লেখা
হয় কোনও রহস্য বা অপরাধকে কেন্দ্র করে। গল্পের
গোয়েন্দা চরিত্রটি তার সঠিক বিশ্লেষণ ক্ষমতা, পরিমিত যুক্তিবোধ, তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, ক্ষুরধার বুদ্ধির বলে জটিল থেকে জটিলতর সমস্যার সমাধান করে পুনঃ পুনঃ উপস্থাপিত
হন পাঠক হৃদয়কে সমৃদ্ধ করতে। বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দা গল্প একটি অন্যতম
ক্ষেত্র। এই শ্রেণীর বর্ণনাত্মক গল্পে সাধারণত নরহত্যা বা চুরি জাতীয়
বিশেষ কোনও সমস্যার পরিমন্ডল সৃষ্টি করা হয়। চরিত্রগুলি
আবর্তিত হয় সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে।
পৃথিবীজুড়ে
বহু বিখ্যাত সাহিত্যের মাঝে তাই এটার নিজস্বতা রয়েছে। জনপ্রিয়তার
নিরিখে গোয়েন্দা-কাহিনি সবার উপর। এ
গল্পগুলো মানুষকে যেমন আনন্দ দেয় তেমনই বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশসাধন করে।
কিছু গবেষণায়
বলা হয়েছে, কোনও কোনও প্রাচীন এবং ধর্মীয় রচনার সঙ্গে আজকের
গোয়েন্দা-কাহিনির সাদৃশ্য আছে। গোয়েন্দা-কাহিনির সবচেয়ে পুরনো ও জানা
দৃষ্টান্ত হল, আরব্য রজনীতে
(আলিফ লায়লা) শেহেরজাদের বলা কাহিনিগুলোর একটি।
গল্পে এক জেলে দজলা নদীতে একটি তালাবন্ধ ভারী সিন্দুক খুঁজে পায়।
সে এটি বিক্রি করে দেয় আব্বাসী খলিফা হারুনুর রশিদের কাছে।
সিন্দুক ভেঙে পাওয়া যায় টুকরো টুকরো করে কাটা এক তরুণীর মরদেহ।
হারুন তার উজির জাফর ইবনে ইয়াহিয়াকে নির্দেশ দেন অপরাধের তদন্ত
করে তিনদিনের মধ্যে খুনিকে খুঁজে বের করতে, নাহলে জাফরের শিরশ্ছেদ করা হবে। গল্প
এগিয়ে যাবার সঙ্গে কাহিনি বিভিন্ন দিকে মোড় নেয়, রোমাঞ্চ সৃষ্টি হয়। গল্পটিকে
তাই গোয়েন্দা-কাহিনির একটি আদি রূপ বলা যেতে পারে। যদিও গোয়েন্দা চরিত্র হোমস
বা পোয়ারোর মতো জাফর স্বেচ্ছায় তদন্ত করেনি। এই গল্পটি শেষ হয় খুনীর দোষ
স্বীকারের মাধ্যমে।
বাংলায়
গোয়েন্দা-কাহিনি লেখা হয়েছে অনেক পরে। এর
মূল প্রেরণা এসেছে বিদেশি গল্পের হাত ধরে। প্রথমেই
উল্লেখ্য, এডগার অ্যালেন পো-র
(১৮০৯-১৮৪৯) কথা।
তার রচিত Murders in the rue
morgue ফিলাডেলফিয়া থেকে গ্রাহামস ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় ১৮৪১-এর এপ্রিল মাসে এবং এটাকে পৃথিবীর প্রথম গোয়েন্দা-কাহিনি বলে ধরা হয়।
ডিটেকটিভের নাম ছিল মঁসিয়ে দুপ্যাঁ
(Dupin)। মজার কথা,
এর একবছর পরেই ১৮৪২ সালে ইংল্যান্ডে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ বিখ্যাত
স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড খোলা হয়। চার্লস
ডিকেন্সের Bleak house-এর রেশ ধরে উইলকি কলিন্স রচনা করেন
The woman in white (১৮৫৯) ও The
moonstone (১৮৬৮)। এরপরে
এসেছেন আর্থার কোনান ডয়েল ডিটেকটিভ শার্লক হোমস ও সহকারী ডাঃ ওয়াটসনকে নিয়ে।
তার লেখা গল্পগুলি The
adventures of Sherlock Holmes (১৮৯২) ও
The memoirs of Sherlock Holmes ১৮৯৪ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল।
এ প্রসঙ্গে ইতি টানার আগে আগাথা ক্রিস্টির
(১৮৯০-১৯৭৬) নাম তো উল্লেখ
করতেই হয়। ইংল্যান্ডের মহিলা গোয়েন্দা-কাহিনির
এই লেখিকাকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাহিনিকার হিসাবে গণ্য করা হয়। আগাথা
মিলার বিয়ের পরে হয়েছিলেন আগাথা ক্রিস্টি। তার
সৃষ্ট ডিটেকটিভের নাম এরকুল পোয়ারো (Poirot)।
মোট ৬৭টি গোয়েন্দা-কাহিনি রচনা করেছেন তিনি।
প্রথমটির নাম ছিল The
mysterious affairs at styles (১৯২০)। কয়েকটি
উল্লেখযোগ্য রচনা – The murder on the links (১৯২৩), The mystery of the blue train (১৯২৮),
Murder on the orient express (১৯৩৪) প্রভৃতি।
সবশেষে উল্লেখ করা যায় অনেক আগে
(১৮৪৪) প্রকাশিত ডব্লিউ রেনল্ডস রচিত
Mysteries of the court of London বইটির কথা।
একসময় অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল বইটি।
এটি পরে ‘লন্ডন রহস্য’
নামে কয়েক খন্ডে বাংলায় অনূদিত হয়েছে।
বাংলা ভাষায়
লেখা গোয়েন্দা-কাহিনির কথা বলতে গিয়ে বিদেশের অনেক লেখার কথা আলোচনায় আসবেই।
কারণ, এসব লেখার দ্বারাই প্রাণিত হয়ে বাংলায় গোয়েন্দা গল্প লেখা শুরু হয়।
সকলেই যে হুবহু অনুকরণ করেছেন তা নয়,
তবে মূল প্রেরণা যদি বিদেশি গল্প থেকে না আসত তবে রবীন্দ্রনাথ হয়তো সত্যেন্দ্রনাথের
লাইব্রেরি থেকে এডগার অ্যালেন পো বা অন্যান্য কাহিনি পড়তেন না।
ফলে আমরা হয়তো সম্পত্তি সমর্পণ, ক্ষুধিত পাষাণ, কঙ্কাল, নিশীথে
প্রভৃতি রহস্য গল্পের স্বাদ পেতাম না।
এটা এখন
সকলেরই জানা যে বর্গীদের মতোই একসময়ে দেশে ঠগিদের অত্যাচার অসহনীয় রূপ নিয়েছিল।
ইংরেজ প্রশাসনকে নাস্তানাবুদ হতে হয়েছে এদের দমন করতে।
এই উদ্দেশ্যেই কমিশনার নিযুক্ত হয়েছিলেন উইলিয়াম হেনরি শ্লীম্যান
(Shleeman) (১৭৮৮-১৮৫৬)।
তাঁরই অধীনে দারোগা ছিলেন বরকতউল্লা নামে একজন বুদ্ধিমান বাঙালি
যুবক। পরে ধূর্ততার জন্য লোকমুখে
তাঁর নাম হয় বাঁকাউল্লা, যাঁর চাতুর্যের ও দক্ষতার
কিছু কাহিনি ইংরাজিতে রচিত হয়েছিল। লেখকের
নাম জানা না থাকলেও ‘বাঁকাউল্লার দপ্তর’
নাম দিয়ে ১২টি অধ্যায়ে বইটি বাংলায় প্রকাশিত হয়। ‘বাঁকাউল্লা দপ্তর’-এর হাত ধরেই নারীরা গোয়েন্দা-কাহিনিতে
স্থান পেতে শুরু করে। এরকমই
অপর একটি বই ছিল ‘সেকালের দারোগার কাহিনি’ – লেখক গিরীশচন্দ্র বসু। ডাকাতি
দমনের যে চেষ্টা ইংরেজ শাসকরা করেছিল সে আমলেরই এক দারোগা ছিলেন তিনি।
তাঁর বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা তিনি আত্মজীবনীর ভঙ্গিতে বর্ণনা করেছেন
১৮৮৮ সালে প্রকাশিত বইটিতে। এটি
সে অর্থে গোয়েন্দা-কাহিনি না হলেও সূচনা হিসাবে ধরা যেতে পারে নিশ্চয়ই।
গিরীশচন্দ্র দারোগার চাকরিতে নিযুক্ত ছিলেন ১৮৫৩ থেকে ১৮৬০ পর্যন্ত।
কাহিনিটি প্রথম ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়
‘নবজীবন’ নামক মাসিক পত্রে ১২৯৩-এর শ্রাবণ সংখ্যা থেকে।
আবার, প্রিয়নাথ
মুখোপাধ্যায় পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করেছিলেন তেত্রিশ বছর। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন তিনি।
‘আদরিণী’ (১৮৮৭), ‘ডিটেকটিভ
পুলিস’-১ম খন্ড (১৮৮৭), ‘বনমালী দাসের হত্যা’ (১৮৯১) প্রভৃতি
পুস্তক রচনা করলেও তিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন কিন্তু ‘দারোগার
দপ্তর’ লিখে। ‘দারোগার দপ্তর’-এর প্রথম সংখ্যা বেরিয়েছিল ১৮৯৩ সালে এবং এরপর ধারাবাহিকভাবে পুস্তকগুলি প্রকাশ
পেতে থাকে। প্রতিটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল
৪০ - ৪৮। পুস্তিকাগুলির
বিভিন্ন সংখ্যা ভিন্ন ভিন্ন নামে প্রকাশিত হত। কয়েকটি
সংখ্যার নাম - ২২নং সংখ্যা
‘বিষম সমস্যা’, ২৩নং সংখ্যা ‘বলিহারি বুদ্ধি’, ৭৪নং সংখ্যা ‘ঘর-পোড়া লোক’ (অর্থাৎ পুলিসের অসৎ
বুদ্ধির চরম দৃষ্টান্ত) ইত্যাদি। ‘দারোগার দপ্তর’ পাঠক মহলে যথেষ্ট সাড়া ফেলেছিল।
লক্ষ করা যেতে পারে, কোনান ডয়েলের প্রথম ডিটেকটিভ কাহিনি
‘এ স্টাডি ইন স্কারলেট’ প্রকাশিত হয় ১৮৮৭ সালে
এবং সে-বছরেই প্রিয়নাথের ‘ডিটেকটিভ পুলিশ’ অসাধারণ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। বইটি
সম্বন্ধে ১৮৮৮ সালের ২৫শে জানুয়ারির Indian
Mirror-এ একটি প্রশংসাসূচক প্রতিবেদন প্রকাশ পায়।
জর্জ ডবল্যু.এম.রেনল্ডসের Joseph Wilmot অবলম্বনে
ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ‘এই এক নূতন! আমার
গুপ্তকথা’ (১৮৭০-৭৩) রচনা করার পর ছয় বছর ধরে (১৮৭৩-৭৯) প্রকাশ করেন ‘আমার গুপ্তকথা-আশ্চর্য্য!’ ১৯০৪ সালে বেরিয়েছিল ‘আর এক নতুন! হরিদাসের গুপ্তকথা’।
হয়তো নামের জন্যই এই ‘গুপ্তকথা’ নামাঙ্কিত বইগুলি লিখেই ভুবনচন্দ্র বিখ্যাত
হয়েছিলেন। তাঁর এধরনের আরও কয়েকটি বই
‘বঙ্কিমবাবুর গুপ্তকথা’, ‘বিলাতী গুপ্তকথা’,
‘সংসার শর্বরী বা ভবকারাগারের গুপ্তকথা’ ইত্যাদি।
এরপর উল্লেখ্য
নাম প্রেসিডেন্সি কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক প্যারীমোহন সরকারের পুত্র শরচ্চন্দ্র দেব
(সরকার)। তাঁর
সাহিত্য রচনার অন্যতম প্রেরণাদাতা ছিলেন পণ্ডিত মহেন্দ্রনাথ বিদ্যানিধি। ‘দারোগার দপ্তর’-এর ধাঁচেই তিনি শুরু করলেন সংকলিত
‘গোয়েন্দা কাহিনি’। এগুলির
বিক্রির বহর দেখে বোঝা যায় ক্রাইম কাহিনি কীভাবে পাঠককুলকে সম্মোহিত করেছিল।
এর প্রতিটি খন্ড সপ্তাহে দু’দিন করে ফর্মা ধরে বিক্রি হত। একটি
বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে – ‘গোয়েন্দা কাহিনি এ
পর্য্যন্ত প্রায় পাঁচ লক্ষ ফর্ম্মা বিক্রীত হইয়াছে।’ সব সংখ্যাই বিক্রি হত
‘শ্রীশরচ্চন্দ্র সরকার সংকলিত’ নাম দিয়ে,
যদিও লেখক কিন্তু একা শরচ্চন্দ্র ছিলেন না; মণীন্দ্রনাথ
বসু, ধীরেন্দ্রনাথ পাল, পাঁচকড়ি দে প্রমুখ
হাত লাগিয়েছেন এসব লেখায়। এগুলি
ছাপা হত ৪৯নং ফিয়ার্স লেনের মোহন প্রেসে। এরকম
কয়েকটি বইয়ের নাম – ‘রঘু ডাকাত’
(দু’খন্ড), ‘খুন না হত্যা’
(তিন খন্ড), ‘ভীষণ নরহত্যা’, ‘ভীষণ নারীহত্যা’, ‘ডবল খুন’ ইত্যাদি।
এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছিল
‘রঘু ডাকাত’। সম্ভবত
এই সময় থেকেই বিদগ্ধজন ও ‘সাহিত্যের লোকেরা’
এই লেখাগুলি পড়ে উপভোগ করতেন। একেকটি সংখ্যা উৎসর্গ করা
হয়েছিল একেকজন গণ্যমান্য ব্যক্তির নামে। এদের
মধ্যে ছিলেন – মহেন্দ্রনাথ বিদ্যানিধি,
রাজানারায়ণ বসু, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, বিনয়কৃষ্ণ দেব বাহাদুর, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতি।
একটু খাপছাড়াভাবে
হলেও এখানে আরেকজনের কথা উল্লেখ করা দরকার। তিনি
হলেন নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত। মনে করা হয় যে তিনি হলেন প্রথম
‘ভদ্রস্থ’ লেখক যিনি রহস্য কাহিনি লিখেছেন। ‘ভারতী ও বালক’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর একটি লেখার নাম
‘চুরি না বাহাদুরী?’ অনেকেই লেখাটির প্রশংসা করেছেন।
একটা সময়ে সামান্য একটা ব্যবহার্য জিনিসও বিলেত থেকে আমদানি হত।
স্বদেশি দ্রব্য সবে তখন বাজারে আসতে শুরু হয়েছে।
হেমেন্দ্রমোহন বসু, এইচ. বোস. নামেই যিনি সমধিক খ্যাত,
এদেশে ‘কুন্তলীন’ মাথার তেল,
‘দেলখোস’ এসেন্স ও ‘তাম্বুলীন’
পানের মশলা আবিষ্কার করেন। ৬৩নং
বহুবাজার স্ট্রিটে তার কুন্তলীনের দোকান ও প্রেস ছিল। তিনি
‘কুন্তলীন’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন এবং
তাতে গল্প লেখার প্রতিযোগিতা আহ্বান করে শ্রেষ্ঠ গল্প লেখককে পুরস্কৃত করতেন।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, জগদীশচন্দ্র বসু প্রমুখ এই ‘কুন্তলীন পুরস্কার’
পেয়েছিলেন। গল্প
লেখকদের তাঁদের লেখার মধ্যে সুকৌশলে কুন্তলীন দেলখোস ইত্যাদি নাম ঢুকিয়ে দিতে হত।
ব্যবসায়িক স্বার্থসিদ্ধি করা ছাড়াও এই উদ্যোগ কিছু তরুণ প্রতিশ্রুতিপূর্ণ
লেখককে প্রেরণা জুগিয়ে তাঁদের সাহিত্যক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেছে।
গোয়েন্দা গল্প লিখে ১৩০৬ বঙ্গাব্দে পুরস্কার পেয়েছিলেন রজনীচন্দ্র
দত্ত (প্রথম পুরস্কার ত্রিশ টাকা), দীনেন্দ্রকুমার রায় (দ্বিতীয় পুরস্কার কুড়ি টাকা)
এবং অন্যান্যরা। দীনেন্দ্রকুমার
পরে ক্রাইম কাহিনি অনুবাদও করেছেন, তাঁর অন্যান্য লেখাও রয়েছে। রজনীচন্দ্র
দত্ত রচিত ‘অদ্ভুত হত্যা’ নামক গল্পটি
নগেন্দ্রনাথ গুপ্তর লেখার পর (তাঁর ‘চুরি
না বাহাদুরী?’ নামক গল্প) একটি মৌলিক ডিটেকটিভ
গল্প বলে সুকুমার সেন মন্তব্য করেছেন। তিনি
‘অদ্ভুত হত্যা’ শীর্ষক গল্পটি তাঁর বইতে পুরোটাই
উদ্ধৃত করেছেন।
এবার আসি
পাঁচকড়ি দে ও দীনেন্দ্রকুমার রায়ের কথায়। গোয়েন্দা
কাহিনি লিখে যিনি তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন তিনি হলেন কেদারনাথ দের পুত্র পাঁচকড়ি
দে (১৮৭৩-১৯৪৫)। ‘যমুনা’ পত্রিকার ফণীন্দ্রনাথ পাল, তাঁর দাদা যতীন্দ্রনাথ পাল এবং পাঁচকড়ি দে - এই তিনজন
মিলে বিরামহীনভাবে লিখে গিয়েছেন। পাঁচকড়ির
প্রথম রচনা ‘সতী শোভনা’।
মাত্র চল্লিশ পৃষ্ঠার বই, তবে মূল রচনাটা আকর্ষণীয়। তাঁর
অন্যান্য বই – ‘মায়াবী’, ‘মায়াবিনী’, ‘মনোরমা’, ‘হত্যাকারী
কে?’, ‘নীল বসনা সুন্দরী’ (‘অবসরে’
বেরিয়েছে), ‘জীবন্মৃত রহস্য’, ‘হত্যা রহস্য’, ‘ভীষণ প্রতিশোধ’, ‘ভীষণ প্রতিহিংসা’, ‘গোবিন্দরাম’, ‘মৃত্যু বিভীষিকা’, ‘হরতনের নওলা’ (কোনান ডয়েলের Sign of four-এর অনুবাদ), ‘কালসর্পী’, ‘পরিমল’, ‘প্রতিজ্ঞাপালন’,
‘লক্ষ টাকা’ প্রভৃতি।
বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যে সম্ভবত তিনিই প্রথম ডিটেকটিভ চরিত্র সৃষ্টি
করেছেন। তাঁর বিভিন্ন গোয়েন্দা কাহিনিতে
তিনি গোয়েন্দার ভিন্ন ভিন্ন নাম দিয়েছেন। সবচেয়ে
পরিচিত চরিত্র ডিটেকটিভ দেবেন্দ্রবিজয় ও তার গুরু অরিন্দমবাবু।
কোনও কোনও রচনায় গোয়েন্দার নাম গোবিন্দরাম,
কোথাও কীর্তিচন্দ্র আবার কোথাও রামপাল। সাড়া
জাগানো ‘হত্যাকারী কে?’ উপন্যাসে
গোয়েন্দা ছিলেন বৃদ্ধ অক্ষয়কুমার। অনেকে
মনে করেন পাঁচকড়িবাবুর অনেক বইয়ের লেখক আসলে ধীরেন্দ্রনাথ পাল।
পাঁচকড়ি
দের বই বিক্রি এক লক্ষ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তাঁর
বই ইংরাজি, হিন্দি, উর্দু, তামিল, তেলেগু, মারাঠি প্রভৃতি
বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বই
বিক্রির টাকায় তিনি কলকাতায় তিনটি প্রাসাদোপম বাড়ি তৈরি করেছিলেন।
১৯০৪ সালে প্রকাশিত ‘নীলবসনা সুন্দরী’ পাঠকমহলে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল।
লেখক হিসাবে
দীনেন্দ্রকুমার রায় ছিলেন (১৮৬৯ - ১৯৪৩) একটি পরিচিত নাম। গোয়েন্দা
ও রহস্যকাহিনি ছাড়া দীনেন্দ্রনাথ ‘পল্লীচিত্র’,
‘পল্লীবৈচিত্র’, ‘পল্লীকথা’, ‘সেকালের স্মৃতি’ প্রভৃতি বই লিখেও পাঠকসমাজের প্রশংসা
কুড়িয়েছেন। দীনেন্দ্রকুমারের প্রথম ডিটেকটিভ
গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ‘কুন্তলীন পুরস্কার’
পুস্তিকায় ১৩০৬ বঙ্গাব্দে। এই
সময়েই লিখেছেন ‘হামিদা’, ‘পট’, ‘অজয়সিংহের কুঠী’, ‘আমিনা
বাঈ’ প্রভৃতি গোয়েন্দা কাহিনি। পরে
প্রকাশিত হয়েছে – ‘রূপসী মরুবাসিনী’,
‘ভূতের জাহাজ’, ‘পিশাচ পুরোহিত’, ‘জাল মোহান্ত’, ‘চীনের ড্রাগন’ ইত্যাদি।
এর মধ্যে কিছু রয়েছে ইংরাজি রহস্যকাহিনির অনুবাদ।
উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ফাল্গুন ১৩০৭ বঙ্গাব্দে
‘নন্দন কানন’ নামে একটি ক্রাইম ও রহস্যকাহিনি সিরিজ
প্রকাশ করেন। দীনেন্দ্রকুমার ছিলেন এর সম্পাদক।
দ্বিতীয় বছরে ‘নন্দন কানন’ পত্রিকার নাম বদলে মাসিক ক্রাইম সিরিজ রাখা
হয়। এই সিরিজে লেখা প্রকাশ করে
দীনেন্দ্রকুমার যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেন। এতে
প্রকাশিত বহু গল্প বিলাতি Monthly magazine of fiction বই থেকে আহরিত। উপেন্দ্রনাথের
সঙ্গে দীনেন্দ্রনাথের সম্পর্ক ছিন্ন হবার পর দীনেন্দ্রকুমার নিজেই
‘রহস্য লহরী সিরিজ’ নামে ডিটেকটিভ কাহিনি বের করা
শুরু করেন। সব বইতেই গোয়েন্দার নাম ছিল
মিস্টার ব্লেক ও তার সহকারী স্মিথ। দু’শ সতেরোটি বই প্রকাশিত হয়েছিল এই সিরিজে। এর
সঙ্গে ‘নন্দন কানন’ সিরিজের বই
যোগ করলে বইয়ের সংখ্যা হয় প্রায় পাঁচশো। সাহিত্যিক
হিসাবে দীনেন্দ্রনাথের বৈশিষ্ট্য ছিল তার বিষয় বৈচিত্র্য। ‘বসুমতী’ পত্রিকার দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক সব সংস্করণের সঙ্গেই
তিনি যুক্ত ছিলেন। তাঁর কৃত শেষ অনুবাদ
‘কথাশিল্পীর হত্যারহস্য’ (উপন্যাস) নামে ‘মাসিক বসুমতী’র ১৩৫০-এর বৈশাখ সংখ্যা থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়ে মৃত্যুর পরেও চলতে থাকে।
হরিসাধন মুখোপাধ্যায় (‘কলিকাতার সেকাল ও একাল’ নামক বিখ্যাত গ্রন্থের রচয়িতা)
ও সুরেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্যও হাত লাগিয়েছিলেন গোয়েন্দা কাহিনি লেখায়।
তবে একজনের
কথা উল্লেখ করতেই হয়। তিনি হলেন মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য্য
(১৯০৩ - ১৯৩৯)। মনোরঞ্জনের
জন্ম ফরিদপুরে (এখন বাংলাদেশে)।
তার পিতা ছিলেন ছোটোদের প্রিয় ‘রামধনু’ মাসিক পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা।
পত্রিকার তৃতীয় বছরে সম্পাদকের পদ গ্রহণ করেন মনোরঞ্জন।
এই পত্রিকাতেই বেশ কয়েকটি রহস্য ও ডিটেকটিভ কাহিনি লিখেছিলেন তিনি।
তাঁর গল্পে ডিটেকটিভ একজন জাপানী,
নাম হুকাকাশি। কলকাতার
স্কটিশ চার্চ কলেজের পেছনে ডাফ স্ট্রিটে ছিল এই বিখ্যাত অপরাধতত্ত্ববিদ ও গোয়েন্দার
বাস। ছদ্মবেশ ধারণে সুনিপুণ হুকাকাশি
মারামারি ও আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের চেয়ে মগজ খাটিয়ে রহস্যভেদেই ছিলেন অধিক অভ্যস্ত।
তবে জাপানি যুযুৎসুর প্যাঁচও বেশ ভালোই জানা ছিল।
তার সাকরেদ ছিল রণজিৎ বা কখনও অভিজিৎ। জটিল
সমস্যা সমাধানে হেমেন্দ্রকুমারের জয়ন্তর মতো ঘন ঘন নস্যি নিতে দেখা যেত তাকে।
হুকাকাশি নিঃসন্দেহে বাঙালি পাঠকদের বিশেষ করে ছোটোদের মনে স্থান
করে নিয়েছিল। মাত্র ৩৬ বছর বয়সে পরলোক গমন
না করলে মনোরঞ্জন আরও রচনার মাধ্যমে নিশ্চিতভাবে গোয়েন্দা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে যেতে
পারতেন। প্রসঙ্গত,
মনোরঞ্জনের গোয়েন্দা কাহিনি ও ডিটেকটিভ হুকাকাশির রেশ ধরেই শিবরাম চক্রবর্তী
তার স্বভাবসিদ্ধ সরস ভঙ্গিতে গল্প লিখেছিলেন, তার গোয়েন্দার নাম
ছিল কল্কেকাশি।
‘রামধনু’তে প্রকাশিত মনোরঞ্জনের গোয়েন্দা কাহিনিগুলি
হল – ‘পদ্মরাগ’ (উপন্যাস, শ্রাবণ ১৩৩৫ থেকে ১৭ কিস্তিতে), ‘ঘোষ চৌধুরীর ঘড়ি’
(উপন্যাস, আশ্বিন ১৩৩৭ থেকে ১১ কিস্তিতে),
‘সোনার হরিণ’ (উপন্যাস, মাঘ
১৩৪১ থেকে ২৬ কিস্তিতে), ‘শান্তিধামের অশান্তি’ (ছোটোগল্প, অগ্রহায়ণ, ১৩৪৩),
‘তের নং বাড়ীর রহস্য’ (ছোটোগল্প, শ্রাবণ, ১৩৪৪), ‘হীরক-রহস্য’ (ছোটোগল্প, কার্ত্তিক,
১৩৪৪), ‘চণ্ডেশ্বরপুরের রহস্য’ (ছোটোগল্প, মাঘ, ১৩৪৪)। ‘সংসক্তপুরের রহস্য’ নামে একটি ছোটোগল্প প্রকাশিত হয়েছিল
সুনির্মল বসু সম্পাদিত ‘আরতি’ বার্ষিকীতে
(১৯৩৮)। মনোরঞ্জনের
লেখার ভক্ত ছিলেন হেমেন্দ্রকুমার, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
এবং সত্যজিৎ রায়ও। হেমেন্দ্রকুমার রায় তার
‘ড্রাগনের দুঃস্বপ্ন’ বইটি মনোরঞ্জনকে উৎসর্গ করেন।
তবে গোয়েন্দা কাহিনির বাইরেও মনোরঞ্জনের অনেক লেখা রয়েছে।
সম্ভবত
চল্লিশের দশকের শেষে ‘দেব সাহিত্য
কুটির’-এর জন্ম। এখান থেকে ছোটোদের অজস্র বই
বেরিয়েছে। এই প্রকাশনা সংস্থাটি বহু বছর
ধরে পূজার সময় একটি বার্ষিকী বের করত। একেক
বছর নাম হত একেকরকম যেমন, ‘দেবালয়’, ‘আগমনী’, ‘পরশমণি’, ‘অরুণাচল’,
‘উত্তরায়ণ’ ইত্যাদি।
রঙিন ছবিতে ভরা এই বইগুলি ছিল ছোটোদের খুবই প্রিয়।
হেমেন্দ্রকুমার
রায়ের (১৮৮৮-১৯৬৩) রহস্য, রোমাঞ্চ ও গোয়েন্দা কাহিনি নিয়ে দেব সাহিত্য
কুটির প্রধানত দুটি সিরিজ বের করেছিল – ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’
সিরিজ ও ‘প্রহেলিকা’ সিরিজ।
বহু লব্ধপ্রতিষ্ঠ লেখকেরা এই বইগুলি লিখেছেন।
এদের মধ্যে রয়েছেন হেমেন্দ্র কুমার রায়,
নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, প্রভাবতী দেবী সরস্বতী,
বুদ্ধদেব বসু, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়,
অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, শৈলবালা ঘোষজায়া,
দীনেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত
প্রভৃতি। কাঞ্চনজঙ্ঘা সিরিজের কয়েকটি
বই – ‘অন্ধকারের বন্ধু’, ‘রাত্রির
যাত্রী’, ‘কেউটের ছোবল’, ‘উদাসী বাবার আখরা’,
‘গুপ্ত ঘাতক’, ‘মিসমিদের কবচ’, ‘মুখ আর মুখোস’, ‘নিঝুম রাতের কান্না’ আর প্রহেলিকা সিরিজের – ‘ডাকাত কালীর জঙ্গলে’,
‘রাত যখন সাতটা’, ‘দেশের ডাক’, ‘ঝড়ের প্রদীপ’, ‘অপরাধের কারখানা’, ‘মৃত্যুদূত’, ‘নৈশ অভিযান’ প্রভৃতি। ‘সব্যসাচী’ ছদ্মনামে সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় বেশ কিছু
বই লিখেছেন।
এক সময়ে
হেমেন্দ্রকুমার ছিলেন ছোটোদের (এবং সেই সঙ্গে
বড়োদেরও) অত্যন্ত প্রিয় লেখক। বিদেশি
গল্পের ছায়া অবলম্বনে হেমেন্দ্রকুমারের রচনা – ‘অদৃশ্য মানুষ’, ‘আজব দেশে অমলা’, ‘মানুষের গড়া দৈত্য’, ‘কিং কং’ ইত্যাদি
ছিল ছোটোদের স্বর্ণযুগ। কাঞ্চনজঙ্ঘা
সিরিজের মোট চব্বিশটি বইয়ের মধ্যে গোয়েন্দা কাহিনি ছিল এগারোটিতে।
ছোটোদের জন্য তিনি লিখলেও বড়োরাও এগুলি উপভোগ করেছেন। খুব
সহজ ভাষায় তিনি যেভাবে রহস্য ঘনীভূত করে তুলে সেটা উন্মোচন করতেন,
পাঠককে সেটা আকর্ষণ করে শেষপর্যন্ত টেনে নিয়ে যেত।
তাঁর অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি বা গোয়েন্দা গল্পে তিনি তিনজোড়া গোয়েন্দা
(বা রহস্যভেদী) ও সহকারী সৃষ্টি করেছেন।
এরা হলেন – জয়ন্ত ও মানিক,
বিমল ও কুমার এবং হেমন্ত ও রবীন। জয়ন্ত-মানিক এবং বিমল-কুমারের সাহায্যকারী পুলিশ অফিসার হলেন
ইনস্পেক্টর সুন্দরবাবু এবং হেমন্ত-রবীনের ভূপতিবাবু ও সতীশবাবু।
কোনও কোনও কাহিনিতে পুরাতন ভৃত্য রামহরি ও প্রভুভক্ত সারমেয়
‘বাঘা’কেও ভুলবার নয়।
পাঁচকড়ি দের ডিটেকটিভ দেবেন্দ্রবিজয় বা অরিন্দমবাবুর মতো হেমেন্দ্রকুমার
রায়ের গোয়েন্দা জয়ন্ত কিন্তু বয়স্ক নয়। ছোটোদের
কাছে আকর্ষণীয় হবে না ভেবে হেমেন্দ্রকুমার তাঁর ডিটেকটিভের বয়স অনেক কম করেছেন।
জয়ন্তর বীরত্বব্যঞ্জক ও আকর্ষণীয় চেহারার বর্ণনা করা হয়েছে
‘জয়ন্তের কীর্তি’ বইটিতে। ১৯০৩
সালে পনেরো বছর বয়সে ‘বসুধা’ পত্রিকায় হেমেন্দ্রকুমারের প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়।
১৯২০ সালে ‘মৌচাক’
পত্রিকায় ‘যকের ধন’ প্রকাশিত
হলে রীতিমতো সাড়া পড়ে যায়। এরপর
ছোটোদের জন্য বিরামহীনভাবে লিখে গিয়েছেন হেমেন্দ্রকুমার।
তবে আধুনিক
বাংলা গোয়েন্দা কাহিনির জনক ধরা হয় শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়কে।
তাঁর গোয়েন্দা ব্যোমকেশ ও সহকারী অজিত বাংলার পাঠকমহলে গভীর ছাপ
ফেলেছিল। ব্যোমকেশ গোয়েন্দা কাহিনি
চলচ্চিত্রায়িতও হয়েছে একাধিকবার। এছাড়া
বাংলা সাহিত্যের প্রথিতযশা সাহিত্যিক দীনেন্দ্রকুমার রায়,
নীহাররঞ্জন গুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, নারায়ণ সান্যাল, সত্যজিৎ রায়, কৃশানু বন্দ্যোপাধ্যায়, অদ্রীশ বর্ধন, প্রভাবতী দেবী সরস্বতী, লীলা মজুমদার, সমরেশ বসু, সুনীল
গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, সুচিত্রা
ভট্টাচার্য গোয়েন্দাকাহিনি লিখেছেন।এদের মধ্যে সত্যজিৎ রায়ের
ফেলুদা কিশোরদের কাছে সবচাইতে জনপ্রিয়। যার
প্রধান চরিত্র প্রদোষচন্দ্র মিত্র। ডাকনাম
ফেলু। এছাড়া আছে ফেলুদা খুড়তুতো
ভাই তপেস রঞ্জন মিত্র। ডাকনাম তপসে।
গল্পের অন্য চরিত্র লালমোহন গাঙ্গুলি। যিনি
জটায়ু ছদ্মনামে রহস্য উপন্যাস লেখেন।
এবার তথাকথিত
লেখকদের সৃষ্ট সেই গোয়েন্দা চরিত্রগুলোর ওপর একবার চোখবুলিয়ে নেওয়া যাক।
একঃ হেমেন্দ্রকুমার
রায় সৃষ্ট জয়ন্ত
জয়ন্ত
ও তার সহকারী বন্ধু মানিক বাঙালি সাহিত্যিক হেমেন্দ্রকুমার রায়ের দুই কাল্পনিক গোয়েন্দা
চরিত্র। বাংলায় কিশোরপাঠ্য গোয়েন্দা
কাহিনির ভেতর জয়ন্ত-মানিক এবং সুন্দরবাবুর
কীর্তিকাহিনি অগ্রগণ্য।
জয়ন্তের
প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে ‘জয়ন্তের কীর্তি’ গল্পে। জয়ন্ত
ও মানিক দুই অভিন্নহৃদয় বন্ধু। তারা,
বিশেষত জয়ন্ত একজন সাহসী, ক্ষুরধার বুদ্ধিসম্পন্ন
তরুণ। রহস্যভেদের নেশায় দেশে ও বিদেশের
বিভিন্ন জায়গায় পাড়ি দিয়েছে এই জুটি। জয়ন্ত
শুধু বুদ্ধিমানই নয়, অত্যন্ত বলশালী পুরুষ। জয়ন্তের
একমাত্র নেশা নস্য নেওয়া। সে
অবসর সময়ে বাঁশি বাজাতে পছন্দ করে। গোয়েন্দা
পুলিশের বিপুলবপু দারোগা সুন্দরবাবু প্রায়ই তাদের সঙ্গী হন। তিনি
খাদ্যরসিক ও পেটুক বাঙালির প্রকৃষ্ট উদাহরণ। প্রাতরাশে
একসঙ্গে সাতটা ডিমের পোচ গলাধঃকরণ করেন। কথায়
কথায় ‘হুম’ বলা তার মুদ্রাদোষ। মানিকের
অভ্যাস তার সঙ্গে রসিকতা করা। এই
দারোগার সঙ্গে গোয়েন্দা জয়ন্তের সদ্ভাব ছিল, রহস্য সমাধানে জয়ন্ত-মানিকের দ্বারস্থ হতেন।
‘জয়ন্তের কীর্তি’ গল্পে প্রথম এই গোয়েন্দার সৃষ্টি করেন
হেমেন্দ্রকুমার। বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দা চরিত্রগুলির
ভেতর জয়ন্ত অনন্য। কিশোর-কিশোরীদের ভেতর অতি জনপ্রিয়
গোয়েন্দা জয়ন্তের অজস্র কাহিনি লিখেছেন তিনি। তার
অন্য সৃষ্টি অ্যাডভেঞ্চারিস্ট বিমল-কুমারের সঙ্গেও জয়ন্ত মিলিতভাবে রহস্য সন্ধানে যোগ দিয়েছে।
জয়ন্তের গোয়েন্দাগিরি নিয়ে অন্যান্য গল্প ও উপন্যাসগুলির অন্যতম
- মানুষ পিশাচ, নৃমুণ্ড শিকারি,
কাপালিকের কবলে, ভেনাস ছোরার রহস্য, শাজাহানের ময়ূর, কাঁচের কফ, হত্যা হাহাকারে ইত্যাদি।
দুইঃ নীহাররঞ্জন সৃষ্ট কিরীটি
কিরীটী
রায় ভারতীয় বাংলা ঔপন্যাসিক নীহাররঞ্জন গুপ্ত সৃষ্ট একটি বিখ্যাত গোয়েন্দা-চরিত্র। ‘কালো ভ্রমর’ উপন্যাসের মধ্য দিয়ে এ গোয়েন্দা চরিত্রের আবির্ভাব
ঘটে। তার সহকারী সুব্রত,
যিনি অধিকাংশ কাহিনিতে তার সঙ্গে থাকেন। কিরীটী
রহস্যভেদী হিসেবেই নিজের পরিচয় দিয়ে থাকেন। তার
সহকারী সুব্রত, স্ত্রী কৃষ্ণা।
টালিগঞ্জে তার বাড়ি রয়েছে, এছাড়াও রয়েছে নিজস্ব গাড়ি, ড্রাইভারের নাম হীরা সিং।
তার ভৃত্যের নাম জংলী। তার
উচ্চতা ছয় ফুট, গায়ের রং ফরসা।
চুল ব্যাকব্রাশ করা, কোঁকড়ানো। পুরু
লেন্সের কালো সেলুলয়েড চশমা পড়েন তিনি। দাড়িগোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো।
যুক্তরাজ্যে নীহাররঞ্জন গুপ্তের সঙ্গে বিখ্যাত গোয়েন্দাকাহিনি
লেখক আগাথা ক্রিস্টির পরিচয় ঘটে। এরপরেই
তিনি দেশে ফিরে এসে কিরীটী চরিত্র নির্মাণ করেন। তার
ছোটোবেলায় প্রত্যক্ষ করা একটি আত্মহত্যা এবং অন্তঃস্বত্ত্বা বিধবা বৌদিকে গুলি করে
খুন করেন যক্ষ্মারোগ-আক্রান্ত তাঁর রুগ্ন দেবর
— এ দুটি ঘটনাই পরবর্তীতে কিরীটীর মতো একটি গোয়েন্দা চরিত্র নির্মাণ
করতে প্ররোচিত করে তাকে।
তিনঃ প্রেমেন্দ্র মিত্র
সৃষ্ট পরাশর বর্মা
পরাশর বর্মা
প্রেমেন্দ্র মিত্রের সৃষ্ট গোয়েন্দা যে একাধারে কবি ও গোয়েন্দা।
তার বন্ধু সম্পাদক কৃত্তিবাস ভদ্র অর্থাৎ, গল্পের
কথকের মতে পরাশর বর্মার কবিতা অখাদ্যই নয়, জঘন্য। কিন্তু
পরাশর একটি অদ্ভুত ব্যক্তি যে হেঁয়ালি করতে ভালোবাসে,
নিজেকে গোয়েন্দা নয়, কবি হিসেবে পরিচয় দেয়।
রহস্য সমাধান করার দিকে যখন এগিয়ে যাচ্ছে এমন সময়েও পরাশর
নিঃস্পৃহ থাকে। আবার অতীব জটিল দুর্বোধ্য সমস্যার
সমাধান কবিতা পড়তে পড়তেও করে ফেলেছে এমন উদাহরণ আছে। লেখকের
নিজের ভাষায়, “কবি হলেও পরাশর বর্মাকে গোয়েন্দাগিরি করতে হয়, কিন্তু শার্লক হোমস,
পোয়ারো কি মাইগ্রে কারুর সঙ্গে কোনও আত্মীয়তা তার নেই।
আত্মীয়তা পাতাবার চেষ্টাও সে কখনও করে না।”
প্রেমেন্দ্র মিত্র পরাশর বর্মার বহু ছোটোগল্প ও গোয়েন্দা উপন্যাস রচনা করলেও তা তার
অন্যতম সৃষ্টি ঘনাদার মতো জনপ্রিয় হয়নি। মূলত
প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যেই পরাশর গোয়েন্দার গল্পগুলি লেখেন প্রেমেন্দ্র মিত্র।
দুটি কাহিনিতে ঘনাদার সঙ্গে পরাশরের মোলাকাত হয়,
সেগুলির নাম ‘ঘনাদা ফিরলেন’ ও ‘পরাশরে ঘনাদায়’।
পরাশর কাহিনির বইয়ের প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ করেছিলেন শিল্পী শৈল চক্রবর্তী।
পরাশর বর্মার কয়েকটি গল্প-উপন্যাসের মধ্যে রয়েছেঃ গোয়েন্দা
হলেন পরাশর বর্মা, ক্লাবের নাম কুমতি,
ভয়ংকর ভাড়াটে ও পরাশর বর্মা, রং নম্বর,
সুন্দ-উপসুন্দের আধুনিক উপাখ্যান, পরাশর বর্মা
ও ভাঙা রেডিও, পরাশর বর্মা ও কবিতার ঘন্ট, অঙ্কে কাঁচা পরাশর বর্মা, পরাশরের কমা-সেমিকোলন, বেইমান বাটখারা, প্রেমের
চোখে পরাশর বর্মা, গন্ধ পেলেন পরাশর বর্মা, নিলেম ডাকল পরাশর বর্মা, হার মানলেন পরাশর বর্মা,
হিপি-সঙ্গে পরাশর বর্মা ইত্যাদি।
চারঃ সমরেশ মজুমদার সৃষ্ট অর্জুন
অর্জুন
সমরেশ মজুমদার সৃষ্ট বাংলা সাহিত্যের একটি জনপ্রিয় গোয়েন্দা চরিত্র।
অর্জুন সিরিজের প্রথম বই ‘খুনখারাপি’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৪ সালে।
এই সিরিজের প্রধান পটভূমি উত্তরবঙ্গ। অর্জুনের
বাড়ি জলপাইগুড়ি শহরে। তবে উত্তরবঙ্গের বাইরে,
এমনকি বিদেশেও অর্জুনের কয়েকটি অভিযান রয়েছে।
অর্জুনের গুরু প্রাক্তন গোয়েন্দা অমল সোম।
এছাড়াও আছেন মজাদার চরিত্র মেজর এবং বিষ্টুসাহেব যারা প্রায়শই
অর্জুনের সঙ্গী হয়েছেন বিভিন্ন অভিযানে। অর্জুন
নিজের গোয়েন্দা পরিচয় পছন্দ করে না। সত্যসন্ধানী
বলে থাকে। ‘খুঁটিমারি রেঞ্জ’, ‘খুনখারাপি’, ‘সীতাহরণ রহস্য’ দুই পর্বে সমাপ্ত উপন্যাস
‘কালিম্পঙে সীতাহরণ’, ‘চণ্ডীগড়ে গণ্ডগোল’, ‘লাইটার’ দুই
পর্বে সমাপ্ত উপন্যাস, ‘দ্বিতীয় লাইটার’, ‘জুতোয় রক্তের দাগ’, ‘কালাপাহাড়’, ‘ড্রাকুলার সন্ধানে অর্জুন’ ইত্যাদি এই সিরিজের অন্যতম উপন্যাস।
পাঁচঃ ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায় সৃষ্ট পান্ডব গোয়েন্দা
পাণ্ডব
গোয়েন্দা হল ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায় রচিত কাল্পনিক চরিত্র। এই
গোয়েন্দাবাহিনি পাঁচজন কিশোর-কিশোরী নিয়ে
গঠিত। এই দলে এক কুকুর আছে।
দুঃসাহসী পাঁচটি ছেলেমেয়ে ও একটি কুকুর নিয়ে গঠিত পান্ডব গোয়েন্দারা
নানারকম রোমাঞ্চকর অভিযান করে। কখনও
নিজেরাই ঘটনায় জড়িয়ে যায়, আবার কখনও
কারও সাহায্যার্থে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে বিপদের মুখে। ভারতের
বিভিন্ন জায়গায় এই দল গোয়েন্দাগিরি চালিয়েছে। পান্ডব
গোয়েন্দা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭০ সালে মাসিক শুকতারা পত্রিকায়।
তারপর আনন্দমেলা পুজো সংখ্যাতেও পান্ডব গোয়েন্দার উপন্যাস বেরিয়েছে।
পান্ডব গোয়েন্দার একাধিক ছোটোগল্প ও উপন্যাস শিশুকিশোরদের কাছে
সবিশেষ জনপ্রিয়তা পায়। এই পাঁচজন গোয়েন্দাদের নিয়ে
কিছু জেনে নেওয়া যাক।
বাবলুঃ
সবচেয়ে বড়ো সদস্য। এই চরিত্র মূল নায়ক।
সে পিস্তল চালাতে পারে এবং লাইসেন্সকৃত পিস্তল থাকে তার কাছে।
বাবলু বুদ্ধিমান, সাহসী এবং প্রচুর সাধারণ জ্ঞানের অধিকারী।
বিলুঃ এটি
দ্বিতীয় মুখ্য চরিত্র। সাহসী,
বিচক্ষণ এবং বাবলুর অবর্তমানে বিলু দলকে একাধিকবার পরিচালনা করেছে, যদিও
তা সাময়িক।
ভোম্বলঃ
খাদ্যরসিক চরিত্র। কিঞ্চিৎ ভীতু, তবে দুর্দান্ত
সাঁতারু। সকল কাজের কাজী।
আরামপ্রিয়।
বাচ্চুঃ
প্রধান নারী চরিত্র, বিচ্ছুর দিদি।
বিচ্ছুঃ
দ্বিতীয় নারী চরিত্র, বাচ্চুর ছোটো বোন।
এই চরিত্র সবার চেয়ে বয়সে ছোটো, কিন্তু বুদ্ধিমান।
পান্ডব গোয়েন্দার প্রথম অভিযান মূলত বিচ্ছুর রাত্রিকালীন অভিযানকে
নিয়েই।
পঞ্চুঃ
এই কুকুর পাণ্ডব গোয়েন্দাদের সাথী। প্রয়োজনে
হিংস্র, বুদ্ধিমান দেশি কুকুর।
বহু ক্ষেত্রে পঞ্চুই জয় এনে দিয়েছে পান্ডব গোয়েন্দাদের অভিযানে।
পঞ্চুর এক চোখ কানা। তাকে
প্রথম গল্পে কানা পঞ্চু বলে পরিচয় দেওয়া ছিল।
ছয়ঃ সুচিত্রা ভট্টাচার্য সৃষ্ট মিতিনমাসি
মিতিনমাসি
হলেন বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যের একজন মহিলা গোয়েন্দা চরিত্র যার স্রষ্টা সাহিত্যিক
সুচিত্রা ভট্টাচার্য। কলকাতার ঢাকুরিয়ার বাসিন্দা
মিতিনের ভালো নাম প্রজ্ঞাপারমিতা মুখার্জী। তবে
সে তার বোনঝি টুপুরের কাছে মিতিনমাসি এবং বাঙালি রহস্যপ্রিয় পাঠকের কাছে গোয়েন্দা
মিতিনমাসি নামে পরিচিত। টুপুর মিতিনের সহকারী হিসেবে
কাজ করে। মিতিনের স্বামী পার্থ প্রেসে
কাজ করেন। তিনি খ্যাদ্যরসিক ও কল্পনাবিলাসী।
মিতিনের কাছে পুলিশের ডিআইজি অনিশ্চয় মজুমদার মাঝে মাঝে পরামর্শ
নিতে আসেন। অপরাধ বিজ্ঞান,
ফরেন্সিক সায়েন্স, অপরাধীদের মনস্তত্ত্ব, নানারকমের
অস্ত্রশস্ত্রের খুঁটিনাটি, অ্যানাটমি, ফিজিওলজি,
নানারকম আইন সবকিছু নিয়েই চর্চা করেন মিতিন।
তিনি ক্যারাটে জানেন, রিভলভার সঙ্গে রাখেন আবার রান্নাতেও পটু। মিতিন
মাসির প্রথম আত্মপ্রকাশ প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য। প্রথম
উপন্যাস ‘পালাবার পথ নেই’ আনন্দবাজার
পত্রিকার রবিবাসরীয়তে প্রকাশিত হয়। এছাড়াও
‘বিষ’, ‘মারণ বাতাস’, ‘তৃষ্ণা
মারা গেছে’ প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য লেখা উপন্যাস ও বড়োগল্প।
কিশোরদের জন্য মিতিন-কাহিনি প্রথম পুজোসংখ্যা আনন্দমেলা ২০০২ সালে
প্রকাশিত হয়। নাম ছিল
‘সারাণ্ডায় শয়তান’। এরপর
থেকে মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত নিয়মিতভাবে সুচিত্রা ভট্টাচার্য মিতিনমাসির গোয়েন্দা
অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি আনন্দমেলায় পূজাবার্ষিকীতে লিখে গেছেন। মিতিন
সিরিজের শেষ উপন্যাস ‘স্যান্ডার্স সাহেবের পুঁথি’ প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে।
সাতঃ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সৃষ্ট কাকাবাবু
কাকাবাবু
বিখ্যাত বাঙালি সাহিত্যিক ও কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি কাল্পনিক চরিত্র।
কাকাবাবুর আসল নাম রাজা রায়চৌধুরী। কাকাবাবু
মধ্যবয়েসি অবসরপ্রাপ্ত প্রতিবন্ধী এক মানুষ যিনি অসম্ভব সাহসী ও পন্ডিত ব্যক্তি।
তিনি ভারত সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের একজন প্রাক্তন কর্মকর্তা
যিনি একবার আফগানিস্তানে গাড়ি চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়েন ও পঙ্গু হন।
সব গল্পেই কাকাবাবুর সাথী ক্রাচ। এই
ক্রাচকে অনেক সময় অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে দেখা গেছে। কাকাবাবু
কিছুদিন সি.বি.আই বা সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশনের উপদেষ্টা ছিলেন।
এখানকার কর্তা নরেন্দ্র ভার্মা তাঁর বিশেষ বন্ধু।
তাঁর ভাইপো সন্তু ওরফে সুনন্দ রায়চৌধুরী আর সন্তুর বন্ধু জোজোকে
নিয়ে অনেক অ্যাডভেঞ্চারে জড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। বেশিরভাগ
অ্যাডভেঞ্চারই ভারতের বিভিন্ন জায়গায় বা বিদেশে বেড়াতে গিয়ে হয়।
তাই কাকাবাবুর প্রতিটি উপন্যাসেই নতুন নতুন জায়গার কথা থাকে।
কাকাবাবু শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হলেও তার অদম্য সাহস,
মনের জোর ও নানা বিষয়ে অভূতপূর্ব জ্ঞান থাকায় তিনি সব সমস্যার সমাধান
করেন। কাকাবাবু অবিবাহিত।
কাকাবাবুর উপন্যাস প্রথমবার প্রকাশিত হয় পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলা
পত্রিকায়। কাকাবাবুর কিছু অ্যাডভেঞ্চার
‘ভয়ংকর সুন্দর’, ‘সবুজ দ্বীপের রাজা, ‘পাহাড়চূড়ায় আতঙ্ক’, ‘ভূপাল রহস্য’, ‘জঙ্গলের মধ্যে এক হোটেল’, ‘জঙ্গলগড়ের চাবি’, ‘মিশর রহস্য’, ‘কলকাতার জঙ্গলে’, ‘নীলমূর্তি রহস্য’, ‘রাজবাড়ির রহস্য’, ‘বিজয়নগরের হীরে’, ‘কাকাবাবু ও
বজ্রলামা’, ‘উল্কা রহস্য’, ‘কাকাবাবু হেরে
গেলেন?’, ‘আগুনপাখির রহস্য’, ‘কাকাবাবু বনাম চোরাশিকারি’, ‘কাকাবাবু ও চন্দনদস্যু’,
‘কাকাবাবু ও এক ছদ্মবেশী’, ‘কাকাবাবু ও একটি সাদা ঘোড়া’, ‘এবার কাকাবাবুর প্রতিশোধ’, ‘কাকাবাবুর চোখে জল’, ‘কাকাবাবু ও জলদস্যু’ ইত্যাদি।
আটঃ সত্যজিত রায় সৃষ্ট প্রদোষচন্দ্র মিত্র
প্রদোষচন্দ্র
মিত্র ওরফে ফেলুদা সত্যজিৎ রায় সৃষ্ট বাংলা সাহিত্যের একটি জনপ্রিয় কাল্পনিক গোয়েন্দা
চরিত্র। ১৯৬৫ সালের ডিসেম্বর মাসের
সন্দেশ পত্রিকায় ফেলুদা সিরিজের প্রথম গল্প ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’ প্রকাশিত হয়।
১৯৬৫ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত এই সিরিজের মোট ৩৫টি সম্পূর্ণ ও চারটি
অসম্পূর্ণ গল্প ও উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। ফেলুদার
প্রধান সহকারী তাঁর খুড়তুতো ভাই তপেশরঞ্জন মিত্র ওরফে তোপসে ও লেখক লালমোহন গাঙ্গুলি
(ছদ্মনাম জটায়ু)। সত্যজিৎ
রায় ফেলুদার ‘সোনার কেল্লা’ ও ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ উপন্যাসদুটিকে চলচ্চিত্রায়িত করেন।
ফেলুদার রহস্য খুব জটিল। তপেশরঞ্জন
মিত্র ফেলুদার খুড়তুতো ভাই। ফেলুদার
দেওয়া তোপসে নামেই অধিক পরিচিত। এই
চরিত্রটি আর্থার কনান ডয়েলের জন ওয়াটসন চরিত্র দ্বারা অনুপ্রাণিত।
তোপসে ফেলুদার সর্বক্ষণের সঙ্গী। ফেলুদার
প্রায় সব অভিযানের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা সে লিপিবদ্ধ করে। তোপসের
বাবা সম্পর্কে ফেলুদার কাকা। ফেলুদা
তার কাকার পরিবারেরর সঙ্গেই ২১, রজনী সেন রোড, কলকাতা-৭০০০২৯-র বাড়িতে থাকে।
দক্ষিণ কলকাতায় রজনী সেন রোড থাকলেও ২১ নম্বর বাড়িটি অস্তিত্বহীন।
লালমোহন গাঙ্গুলি বা লালমোহনবাবু ফেলুদার বন্ধু।
ইনি জটায়ু ছদ্মনামে রহস্য-রোমাঞ্চ উপন্যাস লেখেন। লালমোহনবাবু
বাংলায় রহস্য-রোমাঞ্চ সিরিজের একজন
জনপ্রিয় লেখক এবং তার নিজের মতে সারা ভারতে তার অনুগামীরা ছড়িয়ে আছে।
তাঁর লেখা উপন্যাসগুলির প্রধান চরিত্র সাড়ে ছয় ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট
গোয়েন্দা প্রখর রুদ্র। তাঁর অবিশ্বাস্য গল্পগুলি বেস্ট-সেলার
হলেও বইগুলোতে মাঝে মাঝে খুবই সাধারণ ভুল থাকে, যেগুলো ফেলুদাকে শুধরে দিতে হয়। লালমোহনবাবুর
একটি ‘মাদ্রাজী সবুজ’ অ্যাম্বাসেডর গাড়ি আছে যা ফেলুদার অনেক অভিযানের নির্ভরযোগ্য
বাহন। ‘সোনার কেল্লা’ গল্পে ফেলুদা
ও তোপসের যোধপুর গমনকালে কানপুরে ট্রেনে প্রথম জটায়ু চরিত্রের আবির্ভাব ঘটে।
‘নয়ন রহস্য’ গল্পে লেখক জটায়ুকে বিদূষক হিসেবে উল্লেখ করেন।
সিধুজ্যাঠা
ফেলুদার বাবার বন্ধু। ফেলুদাকে প্রায়ই অসাধারণ স্মৃতিশক্তি
এবং সাধারণ জ্ঞানের অধিকারী সিধুজ্যাঠার কাছে বিভিন্ন জিজ্ঞাসা নিয়ে দ্বারস্থ হতে
হয়।
মগনলাল
মেঘরাজ ফেলুদার অন্যতম শত্রু। ফেলুদা
বেশ কয়েকটি কাহিনিতে তার মোকাবিলা করে। ‘জয়
বাবা ফেলুনাথ’ এবং ‘যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে’ এর মধ্যে প্রধান।
অধিকাংশ
ফেলুদা কাহিনি প্রথম পূজাবার্ষিকী দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
অল্প কিছু কাহিনি প্রকাশিত হয়েছিল সন্দেশ পত্রিকায়।
বইগুলির বাঁধাই কপি প্রকাশিত হয়েছে আনন্দ পাবলিশার্স থেকে।
এছাড়া ফেলুদার উপরে কমিক স্ট্রিপও প্রকাশিত হয়েছে।
অধিকাংশ ফেলুদা বইয়ের প্রচ্ছদ এবং অলঙ্করণ সত্যজিৎ রায়ের নিজের
আঁকা। ফেলুদা সিরিজের সমস্ত গল্প
ও উপন্যাস ইংরেজি ভাষাতে অনুদিত হয়েছে।
নয়ঃ শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় সৃষ্ট ব্যোমকেশ
বক্সী
ব্যোমকেশ
বক্সী শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় সৃষ্ট বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় গোয়েন্দা চরিত্র।
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৃষ্ট চরিত্র হিসেবে ব্যোমকেশ বক্সীর
আবির্ভাব হয় সত্যান্বেষী গল্পে। ১৩৩১
বঙ্গাব্দে কলকাতার চীনাবাজার অঞ্চলে পরপর কয়েকটি খুনের ঘটনার কিনারা করতে বে-সরকারী ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ বক্সী পুলিশ কমিশনারের অনুমতি নিয়ে অতুলচন্দ্র মিত্র
ছদ্মনামে এই অঞ্চলে এক মেসে বসবাস শুরু করেছিলেন। এই
মেসে তাঁর ঘরের অন্য ভাড়াটিয়া অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলমে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
ব্যোমকেশের অধিকাংশ গোয়েন্দা গল্পগুলি লিখিয়েছিলেন। সত্যান্বেষী
গল্পে ব্যোমকেশের বিবরণ দিতে গিয়ে অজিত বলেছেন, ‘...তাহার বয়স বোধকরি তেইশ-চব্বিশ
হইবে, দেখিলে শিক্ষিত ভদ্রলোক বলিয়া মনে হয়।
গায়ের রঙ ফরসা, বেশ সুশ্রী সুগঠিত চেহারা, মুখে চোখে বুদ্ধির একটা ছাপ আছে।’
এই গল্পের শেষে জানা যায়, হ্যারিসন রোডের একটি
বাড়ির তিনতলা ভাড়া নিয়ে ব্যোমকেশ বসবাস করেন। এই
বাড়িতে ব্যোমকেশ ছাড়া দ্বিতীয় ব্যক্তি তাঁর পরিচারক পুঁটিরাম।
ব্যোমকেশের অনুরোধে অজিত এই বাড়িতে বসবাস শুরু করেন।
বাড়ির দরজায় পেতলের ফলকে লেখা ছিল শ্রী ব্যোমকেশ বক্সী,
সত্যান্বেষী। সত্যান্বেষীর
অর্থ জিজ্ঞাসা করায় অজিতকে ব্যোমকেশ বলেন, “ওটা আমার পরিচয়। ডিটেকটিভ
কথা শুনতে ভালো নয়, গোয়েন্দা শব্দটা আরও
খারাপ, তাই নিজের খেতাব দিয়েছি সত্যান্বেষী।”
পরের গল্পগুলিতে ব্যোমকেশ নিজেকে সত্যান্বেষী বলেই পরিচয় দিয়েছেন।
‘অর্থমনর্থম্’ গল্পে ব্যোমকেশের সঙ্গে একটি খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত সুকুমারবাবুর বোন সত্যবতীর
পরিচয় হয়, যার সঙ্গে পরে তাঁর বিবাহ সম্পন্ন হয়।
‘আদিম রিপু’ গল্পে ব্যোমকেশের বাল্যকাল সম্বন্ধে কিছু তথ্য জানা
যায়। ব্যোমকেশের পিতা স্কুলে অঙ্কের
শিক্ষক ছিলেন ও বাড়িতে সাংখ্য-দর্শনের চর্চা করতেন এবং তাঁর মাতা বৈষ্ণব বংশের মেয়ে
ছিলেন। ব্যোমকেশের যখন সতেরো বছর বয়স,
তখন তাঁর পিতা ও পরে তাঁর মাতা যক্ষ্মারোগে মারা যান।
পরে ব্যোমকেশ জলপানির সাহায্যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ভারতের স্বাধীনতা লাভের পরেও অজিতও সপরিবারে
ব্যোমকেশ হ্যারিসন রোডের বাড়িতে বসবাস করেন। পরে
তাঁরা দক্ষিণ কলকাতার কেয়াতলায় জমি কিনে সেখানে বাড়ি বানিয়ে চলে যাবেন বলে মনস্থির
করেন। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যোমকেশ
বক্সী সিরিজের গল্পগুলিতে লেখক হিসেবে ব্যোমকেশের বন্ধু অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়কে উপস্থাপিত
করেছেন। ব্যোমকেশের প্রতিটি রহস্যভেদের
সঙ্গী অজিতের লেখনীতে ব্যোমকেশের অধিকাংশ গল্পগুলি তুলে ধরা হয়েছে।
কিন্তু ‘রুম নম্বর দুই’, ‘শজারুর কাঁটা’, ‘বেণীসংহার’, ‘লোহার
বিস্কুট’, ‘বিশুপাল বধ’ এই গল্পগুলিতে অজিতকে গল্পলেখক হিসেবে
উপস্থিত করা হয়নি। এই
প্রসঙ্গে শরদিন্দু বলেছেন, “অজিতকে দিয়ে ব্যোমকেশের
গল্প লেখানো আর চলছে না। একে
তো ভাষা সেকেলে হয়ে গেছে, এখনও চলতি ভাষা আয়ত্ত
করতে পারেনি, এই আধুনিক যুগেও ‘করিতেছি’, ‘খাইতেছি’ লেখে। উপরন্তু
তাঁর সময়ও নেই। পুস্তক প্রকাশের কাজে যে লেখকেরা
মাথা গলিয়েছেন তাঁরা জানেন, একবার মা-লক্ষ্মীর প্রসাদ পেলে মা-সরস্বতীর দিকে আর নজর থাকে না।
তাছাড়া সম্প্রতি অজিত আর ব্যোমকেশ মিলে দক্ষিণ কলকাতায় জমি কিনেছে,
নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছে; শীগগিরই তারা পুরনো বাসা
ছেড়ে কেয়াতলায় চলে যাবে। অজিত
একদিকে বইয়ের দোকান চালাচ্ছে; অন্যদিকে বাড়ি তদারক করছে, গল্প লেখার সময় কোথায়?......
দেখেশুনে অজিতকে নিষ্কৃতি দিলাম, এখন থেকে আমিই
যা পারি লিখব।”
রচনাকাল
অনুসারে ব্যোমকেশ সিরিজের প্রথম গল্প ‘পথের কাঁটা’ এবং দ্বিতীয় গল্প ‘সীমন্ত-হীরা’। এই দুইটি গল্প লেখার পর শরদিন্দু
বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যোমকেশ বক্সী চরিত্র নিয়ে সিরিজ লেখার কথা চিন্তা করে ১৩৩৯ বঙ্গাব্দের
২৪শে মাঘ সত্যান্বেষী গল্প রচনা শেষ করে ব্যোমকেশ চরিত্রকে পাঠকের সামনে উপস্থিত করেন।
সেই কারণে সত্যান্বেষী গল্পটিকে ব্যোমকেশ সিরিজের প্রথম গল্প হিসেবে
ধরা হয়ে থাকে। ১৩৩৯ থেকে ১৩৪৩ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত
দশটি গল্প লেখার পর পাঠকদের ভালো লাগবে না ভেবে পনেরো বছর ব্যোমকেশকে নিয়ে আর কোনও
গল্প লেখেননি। এরপর কলকাতার পরিমল গোস্বামীর
বাড়ির ছেলেমেয়েদের অনুরোধে ১৩৫৮ বঙ্গাব্দের ৮ই পৌষ ‘চিত্রচোর’ গল্পটি লেখেন।
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যোমকেশ চরিত্র নিয়ে তেত্রিশটি কাহিনি
রচনা করেছেন। এর মাঝে ‘বিশুপাল বধ’ গল্পটি
তিনি সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি। পরবর্তীতে
এই গল্প সম্পূর্ণ করেন সাহিত্যিক নারায়ণ সান্যাল।
শরদিন্দু
ছিলেন কোনান ডয়েল এবং আগাথা ক্রিস্টির ভক্ত। শার্লক
হোমস ও ওয়াটসনকে দেখে ব্যোমকেশ ও অজিতকে সৃষ্টি করা হয়েছে বলে অনেকে মনে করলেও বয়স
ও মানসিকতায় তাদের মধ্যে অনেক অমিল রয়েছে। শরদিন্দু
একের পর এক ব্যোমকেশ কাহিনি যখন লিখে গিয়েছেন, গল্পের মধ্যে তিনি সময়ের সঙ্গে ব্যোমকেশের সাংসারিক অবস্থা ও পরিবর্তনের দিকটাও
নজরে রেখেছেন। ব্যোমকেশের একটি ছেলেও আছে,
সেকথাও বলা হয়েছে। ‘অদ্বিতীয়’ গল্পটি শুরুই হয়েছে ব্যোমকেশ সত্যবতীর ঘরোয়া বিবাদ দিয়ে।
গল্পে এসবের উল্লেখ থাকলেও এগুলি কখনওই কাহিনিতে গুরুত্ব পায়নি,
মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠেনি।
অন্যান্য
বহু গোয়েন্দা কাহিনির মতো ব্যোমকেশ কাহিনিতে কোনও অ্যাকশন বা গোলাগুলি নেই।
প্রতিটি কাহিনিতে লেখক সামাজিক সমস্যাও তুলে ধরেছেন।
কাহিনির মধ্যে তিনি পরিচিত পরিবেশ সৃষ্টি করে মানুষের সহজ সাধারণ
জীবনে অতর্কিতে আগত সমস্যাগুলির সমাধান করিয়েছেন ব্যোমকেশের মাধ্যমে।
সাহিত্যক্ষেত্রে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যয়ের ছদ্মনাম ছিল
‘চন্দ্রহাস’।
দশঃ হুমায়ুন আহমেদ সৃষ্ট মিসির আলি
মিসির আলি
বাংলাদেশের প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ সৃষ্ট একটি জনপ্রিয় রহস্যময় চরিত্র।
মিসির আলি কাহিনিগুলো রহস্যমাত্রিক। মিসির
আলির কাহিনিগুলো ঠিক গোয়েন্দা কাহিনি নয়, কিংবা ‘ক্রাইম ফিকশন’ বা ‘থ্রিলার’-এর মতো খুনি-পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা-ধাওয়া নয়,
বরং মনস্তাত্ত্বিক, বিজ্ঞাননির্ভর এবং প্রচন্ড
যুক্তিনির্ভর কাহিনির বুনটে বাঁধা। বরং
অনেক ক্ষেত্রে একে রহস্যগল্প বলা চলে। বয়োজ্যেষ্ঠ
মিসির আলি অনুসরণ করেন বিশুদ্ধ যুক্তি (pure logic)।
এই যুক্তিই মিসির আলিকে রহস্যময় জগতের প্রকৃত স্বরূপ উদঘাটনে
সাহায্য করে। ঔপন্যাসিক
হুমায়ূন আহমেদ মিসির আলি চরিত্রটির ধারণা প্রথম পেয়ে যান যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটার
ফার্গো শহরে, স্ত্রীর সঙ্গে গাড়িতে
ভ্রমণের সময়। চরিত্রটির ধারণা মাথায় চলে
এলেও তিনি মিসির আলি চরিত্রের প্রথম উপন্যাস ‘দেবী’ লেখেন এই ঘটনার অনেকদিন পর।
উপন্যাসের কাহিনি অনুসারে মিসির আলি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মনোবিজ্ঞান’
(Psychology) বিভাগের একজন সহযোগী অধ্যাপক।
শুধুমাত্র একজন শিক্ষক হিসেবেই নন,
তাঁর অনুসারীদের কাছেও তিনি বেশ মর্যাদাবান একজন চরিত্র হিসেবে উল্লিখিত।
সেজন্য উপন্যাস বা বড়োগল্পে মিসির আলিকে বোঝাতে লেখক ‘তার’ লেখার
পরিবর্তে সম্মানসূচক ‘তাঁর’ শব্দটির ব্যবহার করে থাকেন। মিসির
আলির বয়স ৪০ থেকে ৫০-এর মধ্যে।
তাঁর মুখ লম্বাটে। সেই
লম্বাটে মুখে এলোমেলো দাড়ি, লম্বা
উসকোখুসকো কাঁচাপাকা চুল। প্রথম
দেখায় তাঁকে ভবঘুরে বলে মনে হতে পারে, কিছুটা আত্মভোলা। তাঁর
হাসি খুব সুন্দর, শিশুসুলভ।
মিসির আলির স্মৃতিশক্তি বেশ প্রখর। তিনি
মানুষের মন, আচরণ, স্বপ্ন এবং নানাবিধ রহস্যময় ঘটনা নিয়ে অসীম আগ্রহ রাখেন।
মিসির আলি একজন ধূমপায়ী। তিনি
‘ফিফটি ফাইভ’ ব্র্যান্ডের সিগারেট খান। তবে
তিনি প্রায়ই সিগারেট ছেড়ে দেবার চেষ্টা করেন। তাঁর
শরীর বেশ রোগাটে আর রোগাক্রান্ত। নানারকম
রোগে তাঁর শরীর জর্জরিত। লিভার বা যকৃৎ প্রায় পুরোটাই
অকেজো প্রায়, অগ্ন্যাশয়ের কার্যকারিতা
হ্রাস পেয়েছে, রক্তের উপাদানে গড়বড়, হৃৎপিণ্ড ড্রপ বিট দেয়। এজন্য
কঠিন এসব রোগের পাশাপাশি সাধারণ যেকোনও রোগই তাঁকে বেশ কাহিল করে ফেলে।
ফলে প্রায়ই অসম্ভব রোগাক্রান্ত হয়ে তাঁকে হাসপাতালে থাকতে হয়
এবং শেষপর্যন্ত তিনি সুস্থ হয়ে ফিরে আসেন। মিসির
আলি যুক্তিনির্ভর একজন মানুষ বলেই অসম সাহসিক। ভূতাশ্রিত
স্থানেও রাত কাটাতে তিনি পিছপা হন না, বরং এজন্য থাকেন যে, তাতে তিনি রহস্যময়তার ব্যাখ্যা
দাঁড় করাতে পারবেন। মিসির
আলির অনেকগুলো পারঙ্গমতার মধ্যে অন্যতম হল তিনি যে কাউকে,
বিশেষ করে ঠিকানাওয়ালা মানুষকে, খুব সহজে অজানা
স্থানেও খুঁজে বের করতে পারেন। এজন্য
তিনি টেলিফোন ডিরেক্টরি, গাড়ির রেজিস্ট্রেশন
নম্বর, টিভি-বেতার-এর লাইসেন্স নম্বর, পুলিশ কেস রিপোর্ট, হাসপাতালের মর্গের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট ইত্যাদির আশ্রয় নিয়ে থাকেন।
মিসির আলি প্রকৃতির বিস্ময়ে বিস্মিত হলেও প্রচন্ড যুক্তির বলে
বিশ্বাস করেন প্রকৃতিতে রহস্য বলে কিছু নেই। মিসির
আলি ধর্মীয় বিশ্বাসের দিক থেকে একজন নাস্তিক। মিসির
আলি সিরিজের প্রথম উপন্যাস ‘দেবী’-র ৬ষ্ঠ অধ্যায়ে তিনি নিজেকে নাস্তিক বলে অভিহিত
করেছেন। তবে কিছু জায়গায় তাকে ঈশ্বরের
অস্তিত্বে বিশ্বাসী অর্থাৎ একজন আস্তিক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।
মিসির আলি মূলত নিঃসঙ্গ একজন মানুষ,
মোটামুটি সব উপন্যাসে তাঁকে এভাবেই রূপায়িত করা হয়।
কিন্তু ‘অন্য ভুবন’ উপন্যাসে মিসির আলি বিয়ে করে ফেলেন বলে উল্লেখ
আছে। কিন্তু পরবর্তী উপন্যাসগুলিতে
আবার তাঁকে নিঃসঙ্গ একজন মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। ভালোবাসার
গভীর সমুদ্র হৃদয়ে লালন করলেও সেই ভালোবাসাকে ছড়িয়ে দেবার মতো কাউকেই কখনও কাছে পান
না। ভালোবাসার একাকীত্বে জর্জরিত
মিসির আলির নিঃসঙ্গতা ঘোচাতে বিভিন্ন সময় কিশোরবয়সী কাজের লোকের উল্লেখ পাওয়া যায়।
যেমন, ‘আমি এবং আমরা’ উপন্যাসে ‘বদু’ নামের একটি ১৫ - ১৬ বছরের কাজের ছেলের উল্লেখ রয়েছে। ‘দেবী’ ও ‘নিশীথিনী’ গল্পে
হানিফা নামে একটা কাজের মেয়ে ছিল। এরকম
কাজের লোককে মিসির আলি লেখাপড়া শেখানোর চেষ্টা করেন। আবার
‘অন্য ভুবন’ উপন্যাসে ‘রেবা’ নামের একটি কাজের মেয়ের উল্লেখ পাওয়া যায়।
মিসির আলি সংক্রান্ত উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থ প্রথম পর্যায়ে আলাদা
আলাদা বই আকারে বের হলেও পরবর্তীতে বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থা চরিত্রটির পাঠক সমাদর বিবেচনা
করে তা সংকলিত আকারেও প্রকাশ করে। মিসির
আলি-কেন্দ্রিক কয়েকটি গল্পের মধ্যে, দেবী, নিশীথিনী, বৃহন্নলা, অনীশ, মিসির আলির অমীমাংসিত রহস্য, আমি এবং আমরা, হিমুর দ্বিতীয় প্রহর, আমিই মিসির আলি, মিসির আলির চশমা, মিসির আলি, আপনি কোথায়, মিসির আলি আনসলভড, পুফি, যখন নামিবে আঁধার, ভয় ইত্যাদি
উল্লেখযোগ্য।
এগারোঃ আর্জে সৃষ্ট টিনটিন
দুঃসাহসী
টিনটিন (The Adventures of Tintin) বেলজীয় শিল্পী জর্জ রেমি (১৯০৭ – ১৯৮৩) রচিত একটি কমিক স্ট্রিপ সিরিজ।
রেমি এর্জে (বাংলায় হার্জ
নামে পরিচিত) ছদ্মনামে এই কমিক সিরিজটি রচনা করেন।
১৯২৯ সালের ১০ জানুয়ারি ল্য ভাঁতিয়েম সিয়েকল
(Le Vingtième Siècle) নামক একটি বেলজিয়ান
সংবাদপত্রের ল্য প্যতি ভাঁতিয়েম (Le Petit Vingtième) নামক শিশুদের ক্রোড়পত্রে
ফরাসি ভাষায় সর্বপ্রথম এই সিরিজের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ধারাবাহিকভাবে
মোট চব্বিশটি অ্যালবামে প্রকাশিত এই সিরিজটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
টিনটিনকে নিয়ে একটি সফল পত্রিকা প্রকাশিত হয়।
টিনটিনের গল্প অবলম্বনে চলচ্চিত্র ও নাটকও নির্মিত হয়।
সিরিজটি বিংশ শতাব্দীর সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় ইউরোপীয় কমিকসগুলির
অন্যতম। মোট ৫০টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত
এই সিরিজের বইয়ের কপি বিক্রির সংখ্যা ২০ কোটির ওপর। টিনটিন
সিরিজের পটভূমি প্রধানত বাস্তব বিংশ শতাব্দীর দুনিয়া। সিরিজের
নায়ক টিনটিন (ফরাসি সংস্করণেঃ
Tintin ত্যাঁত্যাঁ) একজন বেলজীয় সাংবাদিক।
প্রথম থেকেই বিভিন্ন অভিযানে তার সর্বক্ষণের সঙ্গী বিশ্বস্ত পোষা
ফক্স টেরিয়ার কুকুর কুট্টুস (ফরাসি:
Milou, মিলু; ইংরেজি: Snowy, স্নোয়ি)। পরবর্তীকালে তার অভিযানের সঙ্গী
হন উদ্ধত, উন্নাসিক ও খিটখিটে নাবিক ক্যাপ্টেন হ্যাডক;
প্রতিভাবান অথচ কানে খাটো প্রফেসর ক্যালকুলাস (ফরাসি সংস্করণে: Professeur Tournesol প্রোফেস্যর্
তুর্ন্যসল্) এবং অপদার্থ গোয়েন্দা জনসন ও রনসনের
(ফরাসি সংস্করণে: Dupond et Dupont দুপোঁ এ দুপোঁ;
ইংরেজি সংস্করণে: Thomson and Thompson টম্সন্ অ্যান্ড্ টম্সন্) মতো বেশ কিছু পার্শ্বচরিত্র।
কোনও কোনও কমিকসে এর্জে স্বয়ং উপস্থিত থেকেছেন অপ্রধান চরিত্র
হিসেবে; আবার কখনও কখনও তাঁর সহকর্মীদের সেই সকল চরিত্রে
অঙ্কন করেছেন। এর্জে এই কমিক স্ট্রিপ সিরিজটি
আঁকতে লিন ক্লেয়ার (ligne claire) নামের
শৈলী ব্যবহার করেন। পরিচ্ছন্ন
ও অভিব্যক্তিমূলক অঙ্কনের জন্য সিরিজটি বহুকাল ধরে প্রশংসিত হয়ে আসছে।
আকর্ষণীয় ও বহুচর্চিত এই সিরিজের প্লটকে একাধিক বর্গের অন্তর্ভুক্ত
করা যায়। যেমন, ফ্যান্টাসির উপাদানসহ
ডাকাবুকো অ্যাডভেঞ্চার গল্প, রহস্য,
রাজনৈতিক থ্রিলার, কল্পবিজ্ঞান ইত্যাদি।
আগাগোড়াই টিনটিন সিরিজের বৈশিষ্ট্য হল এর নির্মল হাস্যরস।
পরবর্তীকালে তার সঙ্গে যুক্ত হয় পরিশীলিত শ্লেষ এবং রাজনৈতিক
ও সাংস্কৃতিক ভাষ্য। টিনটিনের বাংলা বইয়ের কয়েকটি
হল, সোভিয়েত দেশে টিনটিন, কঙ্গোয়
টিনটিন, কৃষ্ণদ্বীপের রহস্য, ওটোকারের রাজদণ্ড,
কাঁকড়া রহস্য, আশ্চর্য উল্কা, চাঁদে টিনটিন, ক্যালকুলাসের কাণ্ড, লোহিত সাগরের হাঙর, তিব্বতে টিনটিন, আলফা কলা ও টিনটিন ইত্যাদি। টিনটিন
একজন সাংবাদিক। যে যুগের প্রেক্ষাপটে এর্জে
টিনটিনের এই পরিচয়টি তার একাধিক অভিযানের বর্ণনায় ব্যবহার করেছেন।
সেই যুগটি ছিল রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লব ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের
যুগ। এমনকি বাস্তবে চন্দ্রাভিযানের
বহু আগেই তিনি তাঁর কল্পনায় চাঁদে টিনটিনের অভিযানের গল্প শুনিয়েছেন।
এর্জে টিনটিনের একটি পৃথক জগৎ সৃষ্টি করেছিলেন।
এই জগৎ ছিল আমাদের বাস্তব জগতের একটি সরলীকৃত অথচ সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি।
আর এই প্রতিচ্ছবি অঙ্কনে এর্জেকে সাহায্য করেছিল তাঁর সুসংরক্ষিত
ছবির একটি সংগ্রহ। টিনটিনের গল্পগুলি রহস্যের
একেকটি ছকে বাঁধা উপস্থাপনা। এই
রহস্যের সমাধান করাও হয়েছে যুক্তিগ্রাহ্য পন্থায়। তবে
তার সঙ্গে এর্জে মিশিয়ে দিয়েছেন তাঁর নিজস্ব কৌতুকরসবোধ। তিনি
এমন সব পার্শ্বচরিত্র সৃষ্টি করেছেন যাদের হাবভাবের গতিপ্রকৃতি আগে থেকে আন্দাজ করা
গেলেও তাদের নিজস্ব চমৎকারিত্ব পাঠককে আকর্ষিত করে।
বারোঃ ডয়েল সৃষ্ট শার্লক হোমস
শার্লক
হোমস (ইংরেজি: Sherlock Holmes) ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগের একটি কাল্পনিক গোয়েন্দা
চরিত্র। ১৮৮৭ সালে প্রথম আবির্ভূত এই
চরিত্রের স্রষ্টা স্কটিশ লেখক ও চিকিৎসক স্যার আর্থার কোনান ডয়েল।
হোমস একজন উচ্চমেধাসম্পন্ন লন্ডন-ভিত্তিক ‘পরামর্শদাতা গোয়েন্দা’। নির্ভুল
যুক্তিসঙ্গত কার্যকারণ অনুধাবন, যেকোনও প্রকার
ছদ্মবেশ ধারণ এবং ফরেনসিক বিজ্ঞানে দক্ষতাবলে জটিল আইনি মামলার নিষ্পত্তি করে দেওয়ার
জন্য তাঁর খ্যাতি ভুবনজোড়া। কোনান
ডয়েল হোমসকে নিয়ে চারটি উপন্যাস ও ছাপ্পান্নটি ছোটোগল্প লিখেছেন।
প্রথম কাহিনি ‘আ স্টাডি ইন স্কারলেট’ ১৮৮৭ সালের বিটন’স ক্রিসমাস অ্যানাল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয়
কাহিনি ‘দ্য সাইন অব দি ফোর’ ১৮৯০ সালে লিপিনকোট’স মান্থলি ম্যাগাজিন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৮৯১
সালে ‘দ্য স্ট্র্যান্ড’ ম্যাগাজিন পত্রিকায় প্রথম ছোটোগল্পের সিরিজটি প্রকাশিত হওয়ার
পরই শার্লক হোমস চরিত্রটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৯২৭
সাল পর্যন্ত হোমসকে নিয়ে একগুচ্ছ ছোটোগল্পের সিরিজ ও আরও দুটি ধারাবাহিক উপন্যাস প্রকাশিত
হয়। হোমস কাহিনির পটভূমির সময়কাল
১৮৮০ থেকে ১৯০৭ সাল। শেষ ঘটনাটির সময়কাল অবশ্য
১৯১৪। চারটি বাদে সবক’টি কাহিনিই
হোমসের বন্ধু তথা জীবনীকার ডাঃ জন ওয়াটসনের জবানিতে লেখা। দুটি
গল্প (‘দ্য ব্লাঞ্চেড সোলজার্স’ ও ‘দ্য লায়ন’স মেন’ হোমসের নিজের জবানিতে এবং অন্য দুটি গল্প ‘দ্য ম্যাজারিন স্টোন’ ও ‘হিজ
লাস্ট বো’) তৃতীয় পুরুষে লেখা। দুটি
গল্প আবার (‘দ্য মাসগ্রেভ রিচুয়াল’ ও ‘দ্য গ্লোরিয়া স্কট’)
হোমস ওয়াটসনকে নিজের স্মৃতি থেকে শুনিয়েছেন এবং ওয়াটসন সেখানে কাহিনির
কাঠামোটিই মাত্র বর্ণনা করেছেন। প্রথম
উপন্যাস ‘আ স্টাডি ইন স্কারলেট’-এর মধ্যবর্তী
অংশে হোমস ও ওয়াটসনের অজ্ঞাত ঘটনার দীর্ঘ বর্ণনা করা হয়েছে এক সর্বজ্ঞ বর্ণনাকারীর
জবানিতে। কোনান ডয়েল বলেছিলেন যে হোমসের
চরিত্রটির অনুপ্রেরণা হলেন ডাঃ জোসেফ বেল, যাঁর অধীনে এডিনবরা রয়্যাল ইনফার্মারিতে করণিক হিসেবে ডয়েল কাজ করতেন।
হোমসের মতো বেলও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পর্যবেক্ষণ থেকে বিরাট বিরাট
সিদ্ধান্ত বের করতেন। আর্থার কোনান ডয়েল ডাক্তারি
পাশ করে প্লাইমাউথের সাউথ সী’র ১ নম্বর বুশ ভিলাতে বাড়ি ভাড়া নিয়ে ডাক্তারি করার
পাশাপাশি শার্লক হোমস লেখায় হাত দেন। ১৮৮৭
খ্রিস্টাব্দে ‘আ ট্যাঙ্গলড স্কিন’ (ইংরেজি: A Tangled Skin) উপন্যাসের মাধ্যমে শার্লকের
জন্ম দেন তিনি যাতে শার্লকের বয়স লেখা হয় ৩৩ বছর। তখন
অবশ্য নামকরণ করেছিলেন শেরিনফোর্ড হোমস। পরে
সেটা পছন্দ না হওয়ায় রাখলেন শার্লক হোমস। একই
সঙ্গে উপন্যাসের নামও বদলে দিয়ে করলেন ‘আ স্টাডি ইন স্কারলেট’
(ইংরেজি: A Study in Scarlet)। একসময়
ডাক্তারি ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি মনোনিবেশ করলেন লেখালেখিতে। ডয়েলের
শিক্ষক ডাক্তার জোসেফ বেল ছিলেন সত্যিকারের অপরাধবিজ্ঞানী, যাঁর কাজ ডয়েলের অনুপ্রেরণা
হিসেবে কাজ করেছিল। ডাক্তার ওয়াটসনের জবানিতে
কাহিনিগুলো বর্ণিত। শার্লক হোমসের প্রথম আবির্ভাব
১৮৮৭ সালে, পুরো নাম উইলিয়াম শার্লক স্কট হোমস। শার্লক
হোমসের জন্ম ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ৬ জানুয়ারি শুক্রবার বিকেলবেলায়।
বাবা সাইগার হোমস আর মা ভায়োলেট শেরিন ফোর্ড।
বাবার যদিও ইচ্ছে ছিল শার্লক বড়ো হয়ে হবেন ইঞ্জিনিয়ার,
কিন্তু শার্লক হয়ে গেলেন বিশ্বের একমাত্র কনসাল্টিং গোয়েন্দা।
তাঁর সঙ্গী, যোগ্য সহকারি
বন্ধুবর লেখক ডাক্তার ওয়াটসন রহস্যোদঘাটনের চেষ্টা করেছেন কেন তিনি এই পেশায় এলেন।
কিন্তু বারবার ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। পরে
অবশ্য একদিন শার্লক নিজের মুখেই বলেছেন সেকথা। ছেলেবেলা
থেকেই শার্লক শিখে গিয়েছিলেন কী করে দুই চোখের ক্ষমতা দিয়ে চোখে দেখা জিনিসের খুঁটিনাটি
বের করে ফেলা যায়। ১৮ বছর বয়সে যখন তিনি অক্সফোর্ড
কলেজে আন্ডার গ্র্যাজুয়েটের ছাত্র, তখন তিনি বন্ধুবান্ধবহীন। চেহারা
তেমন সুন্দর না হলেও তাঁর দিকে চোখ না ফিরিয়ে থাকা যায় না, একটা অসাধারণ আকর্ষণীয়
ক্ষমতা ছিল তাঁর। তবে দ্বিতীয় বছরে ভিক্টর ট্রেভর
নামে এক বন্ধু জুটে গেল তাঁর। ভিক্টরও
শার্লকের মতো নিঃসঙ্গ। ১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জুলাই
বন্ধু ভিক্টর তাঁর বাবার সঙ্গে শার্লককে পরিচয় করিয়ে দিয়ে শার্লকের বিশ্লেষণী ক্ষমতার
কথা বললেন। এতে বৃদ্ধ ভিক্টর শার্লককে
পরীক্ষা করতে চেয়ে তাঁর সম্বন্ধে বলতে বললে, শার্লক যা বললেন, তাতে বৃদ্ধের হাসি হাসি চেহারা মলিন
হয়ে গেল। সেই থেকেই শখের কাজটি শার্লক
পেশা হিসেবেই নিয়ে নিলেন। শার্লক
হোমস অবিবাহিত। লন্ডনের যে ভাড়া বাড়িটিতে
তিনি থাকেন তার ঠিকানাঃ ২২১/বি বেকার স্ট্রিট,
লন্ডন। বাড়ির
গৃহকর্ত্রী মিসেস হাডসন। হোমস কদাচিৎ যোগাযোগ করেন বড়োভাই
মাইক্রফট হোমসের সঙ্গে।
তেরোঃ আগাথা ক্রিস্টি সৃষ্ট পয়োরো
আগাথা ক্রিস্টির
অনন্য গোয়েন্দা-চরিত্র হারকিউল পোয়ারো।
এই গোয়েন্দার প্রথম আত্মপ্রকাশ ১৯২০ সালে,
‘দ্য মিস্টিরিয়াস অ্যাফেয়ারর্স অব স্টাইল’ উপন্যাসে।
ক্রিস্টি পোয়ারোকে এনেছেন ৩৩টি উপন্যাস,
১টি নাটক ও অন্তত ৫০টি ছোটোগল্পে। বেলজিয়ামের
বাসিন্দা হারকিউল পোয়ারোর স্বভাব এমন — অত্যন্ত সময়নিষ্ঠ, পকেটে শালগমাকৃতির একটি ঘড়ি সে বহন
করেছে পেশাগত জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। বরাবরই
একটি নির্দিষ্ট ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স রক্ষা করে টাকাপয়সা খরচ করেছে পোয়ারো।
সেই নির্দিষ্ট ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স হচ্ছে ৪৪৪ পাউন্ড ৪ শিলং ৪ পেন্স।
পায়োরোর উচ্চতা ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি। মাথাটি
খানিক ডিম্বাকৃতি ও উত্তেজনার মুহূর্তে তার সবুজ চোখের চাহুনিতে এক আলাদা ঝিলিক উপস্থিত
হয়। তার গোঁফটি মিলিটারি আদলে বিশেষ
বৈশিষ্ট্যময়। আগাথা ক্রিস্টি ডয়েলের শার্লক
পড়ে বড়ো হয়েছিলেন। তাই তার সৃষ্টিতে হোমসের প্রভাব
থাকাটা খুব স্বাভাবিক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আগাথা
ক্রিস্টি টার্কির রেড ক্রস হসপিটালে নার্স হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন।
এই সময়েই তিনি গল্প লেখা শুরু করেন। বিংশ
শতকের শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা হারকিউল পোয়ারো। ১৯২০
থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত এই প্রিয় চরিত্রটিকে নিয়ে লিখে গেছেন আগাথা ক্রিস্টি।
ফাইভ লিটল পিগস কাহিনিতে পোয়ারোর ভাষ্য ছিল,
নিশ্চিত থাকুন, আমিই সর্বশ্রেষ্ঠ।
ছোটো থেকেই
গোয়েন্দাকাহিনির প্রতি একটা বিশেষ টান ছিলই। সবচেয়ে
প্রিয় ফেলুদার হাত ধরেই মগজাস্ত্রের সাহায্যে বাড়ির ও বাড়ির আশোপাশের ছোটো ছোটো প্রবলেম
সলভ করার চেষ্টাও করতাম। এইসব গল্প আমাদের মনকে এক অদ্ভুত
আর্বতে চিন্তা করতে শেখায়। কৌতূহল, আগ্রহ, চিন্তাশক্তি, পর্যবেক্ষণ
ক্ষমতা, বিশ্লেষণ ক্ষমতা সবকিছুকে আরও উন্নত করতে সাহায্য করে।
সাহিত্য জগতের এই সকল কাল্পনিক হিরোরা সেই কারণেই হয়তো আমাদের
জীবনে এতটা কাছের মানুষ। এই স্বল্প আলোচনায় অনেক সাহিত্যিকের
সৃষ্টি হয়তো অধরাই থেকে গেল। চরিত্রগুলি
প্রতিটিই তার নিজ বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল লেখকদের অনবদ্য লিখনশৈলীর গুণে।
সেই কারণেই কখনও পুরনো না হওয়া গোয়েন্দাগল্পের ঔজ্জ্বল্য মানবজীবনে
সর্বদা চিরন্তন।
______________________
Wikipedia
ছবিঃ আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment