কেশরগড়ের মৃত্যুরহস্য
শুভ্রা ভট্টাচার্য
।। এক।।
জঙ্গলের দিক থেকে ঘণ্টার ঠুং-ঠাং শব্দ শোনা
যাচ্ছে। এই কাকভোরে জঙ্গলের মন্দিরে পুজো
হচ্ছে? কিরণ হাঁ করে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে ভাবল কিছুক্ষণ। শব্দটা থেমে গেল হঠাৎ। হাতের
দড়িবাঁধা
ছাগলটা ঘাস খেতে যাবে বলে ছটফট করছে। এখন শীতকাল। হালকা
সূর্যের মুখ
দেখা গেলেও ঘন কুয়াশায় রাস্তাঘাট পরিষ্কার দেখা যায় না। কিরণ ভাবল একবার
জঙ্গলে ঢুকবে কি না...
রজতের ভাগ্যটাই খারাপ। আজকাল যেখানেই যান, দুর্ভাগ্য
বয়ে নিয়ে চলেন। বিয়ে থা করেননি। তাই সময়
পেলে একা একাই বেরিয়ে পড়েন ঘুরতে। এবারে আর কাজ নয়, পুরুলিয়ায়
নিতান্তই হাওয়াবদল করতে এসেছিলেন। পরশুই
চণ্ডীগড় ফিরে যাওয়ার কথা। পুরুলিয়ার
জঙ্গলের সাইডটা সেভাবে ঘুরে দেখার সময় হয়নি। আর মার্ডারটা সেখানেই
হয়েছে। বছর উনিশের ছেলেটার রক্তাক্ত দেহটা
আবিষ্কার করেন মন্দিরের পুরোহিতমশাই। তিনি সকালে মন্দিরে পুজো দিতে ঢুকেই
দেখতে পান মৃতদেহটা। তারপর গ্রামের লোকজন খবর দেয় পুলিশে।
ঘটনাটা বিচ্ছিরি হলেও ভারি অদ্ভুত লাগে রজতের। আঠারো-উনিশ বছরের একটা গরীব
কৃষক ছেলের কার সাথে এত বড়ো শত্রুতা থাকতে পারে যাতে তার প্রাণটাই চলে গেল?
“আমি একবার স্পটে গিয়ে ব্যাপারটা
দেখতে চাই,” পুরুলিয়া থানার ও সি মিঃ সামন্তকে আর্জি জানালেন
আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার সুপারিন্টেন্ডেন্ট রজত বোস।
“কী দরকার স্যার, আপনি আবার এসব
ঝামেলায় যাবেন?”
মিঃ সামন্তও অহেতুক ঝামেলা পোয়াতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু
রজত যখন একবার
কোনও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেখান থেকে তাকে টলাবার সাধ্য কার? অগত্যা সামন্তরও আর
কিছু বলার রইল না।
রজতের গেস্ট বাংলোর অদূরেই কেশরগড়ের অগভীর জঙ্গল।
সামন্তর পুলিশ-জীপ জঙ্গলের বাইরে রেখেই তারা দু’জন জঙ্গলে প্রবেশ
করলেন। ঢুকতে ঢুকতেই সামন্ত বললেন, “বুঝতেই পারছেন, গ্রামের ব্যাপার।
এদিকে খুনখারাপি হয় না বললেই চলে। হলে পরে
গ্রামকে গ্রাম সেই খবর হু হু করে ছড়িয়ে পড়ে আর সেই তালে তাল মিলিয়ে বাড়তে
থাকে ভিড়।”
সত্যিই তাই। গোটা কেশরগড়ের প্রায় সব মানুষই
যেন এসে জড়ো হয়েছেন এখানে। তারই মাঝে
রয়েছে কিরণের
পরিবারের লোকেরাও। একটা চাপা কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে কেবল।
মন্দিরের বাইরের কনস্টেবলটি দারোগাবাবু আর রজতকে
আসতে দেখে তড়িঘড়ি ভিড় সরিয়ে জায়গা বানিয়ে দিল। রজতের দৃষ্টি তখন জীর্ণ
মন্দিরটার উপর। চেহারা দেখে অনুমান করা যায় যে মন্দিরটা অন্তত দুশো-আড়াইশো বছরের প্রাচীন। মন্দিরের গায়ে একসময়
অনেক কারুকার্য ছিল, যেগুলোর বেশিরভাগই নষ্ট হয়ে গেছে। ইটের দেওয়াল ভেঙে
বেড়ে ওঠা অশ্বত্থের চেহারাই জানান দিচ্ছে যে এত বছরে একবারও সংস্কার হয়নি
মন্দিরটার। মন্দিরের ভেতর থেকে একজন পাউচে করে ব্লাড
স্যাম্পল আর আনুষঙ্গিক তথ্যপ্রমাণ কিছু তুলে নিয়ে এল। এগুলো ল্যাবে টেস্ট করাতে
হবে।
সিঁড়ির ধাপেই লেগে রয়েছে চাপ চাপ রক্তের দাগ। সেইদিকে
আঙুল
নির্দেশ করে সামন্ত বললেন, “ভিক্টিমের মাথায় ভারী কিছু দিয়ে
আঘাত করে খুন করা হয়েছে।”
মন্দিরের ভেতরে রয়েছে একটা বেশ বড়োসড়ো শিবলিঙ্গ। তাতে
বাসি ফুলের
মালা চড়ানো। মন্দিরে প্রবেশের মুখেই সিলিং থেকে
ঝুলছে একটা বড়ো পেতলের ঘণ্টা। সকাল ন’টার রোদের আলো ঘণ্টার
উপর প্রতিফলিত হচ্ছে। রজত ঘাড়
তুলে ঘণ্টাটা দেখতে দেখতে চোখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, “ভারী সেই জিনিসটা কি
পাওয়া গেছে?”
পাশে দাঁড়ানো কনস্টেবলটি জানাল যে তদন্তে সেরকম
কিছু পাওয়া যায়নি। একটা বড়ো মাটির ঘট ভেঙে মন্দিরের ভেতরটা জলে
থৈ থৈ করছে।
।। দুই।।
“শিকারি অসম্ভব ধূর্ত। জল
ঢেলে সব প্রমাণ লোপাট করেছে,” সামন্তর গলায় আক্ষেপের সুর।
“তাহলে কি কিছুই মেলেনি?” রজত জিজ্ঞেস করলেন।
“ঐ নামমাত্র। ব্লাড
স্যাম্পলটা
মিলিয়ে দেখা হয়েছে। ঐ রক্ত মৃত ছেলেটারই।”
“আর কিছু?”
“আর কিছুই পরিষ্কার প্রমাণ নয়। যেটা দিয়ে খুনটা করা
হল সেটাই তো গায়েব। জানেন, ছেলেটা খুব ব্রাইট ছিল। সমাজসেবা-টেবাও করত। খুনের মোটিভটা যদি
জানা যেত...”
“মন্দিরের পুরোহিতকে জেরা করা
হয়েছে?”
“হয়েছে তো। তিনিই তো প্রথম দেখেন
ছেলেটা মরে পড়ে আছে। প্রথমে দূর থেকে ভেবেছেন বোধহয় অসুস্থ হয়ে শুয়ে আছে। কাছে
এসে রক্ত
দেখেই চিল্লাচিল্লি আরম্ভ করেন।”
“পুরোহিত কি এখনও আপনাদের
কাস্টডিতেই, নাকি ছেড়ে দিয়েছেন?”
“ছেড়ে দিলাম তো। এখানে আর রেখেই বা
কী
করব? অবশ্য জানিয়ে রেখেছি যে আমরা না বলা অবধি যেন এই গ্রাম
ছেড়ে কোথাও না যান।”
“লোকটার বাড়িটা ঠিক কোথায়?”
“কার? ঠাকুরমশাইয়ের?”
“হ্যাঁ।”
“কাছেই তো।”
“আর কিরণের বাড়িটা?”
ফোনের রিসিভারটা রেখে এক চুমুকে ঠাণ্ডা হয়ে
যাওয়া চা-টা শেষ করে উঠে পড়লেন রজত। মোবাইল ফোন আর ঘরের চাবিটা
পকেটে নিলেন। পাজামা-পাঞ্জাবীর ওপর শুধু একটা হালকা চাদর জড়িয়ে নিলেন। রুম
থেকে বেরোতেই বাংলোর
কেয়ারটেকারটা ছুটতে ছুটতে এসে স্যালুট করে বলল, “গাড়ি বের করতে বলব, স্যার?”
পকেট থেকে ঘরের চাবিটা হাতে দিয়ে রজত বললেন, “না থাক। আমি একটু
হাঁটতে বেরোলাম।”
“কিন্তু স্যার,
বড়োবাবুর
হুকুম আপনাকে যেন একা একা কোথাও না যেতে দিই। আজকেই সকালে এমন একটা
খুন হয়ে গেল...”
রজত হেসে বললেন, “বড়োবাবুর সঙ্গে আমার কথা হয়ে গেছে। দুটো দিন আছিই যখন
বাংলোয় শুয়ে শুয়ে করবটা কী? আর তাছাড়া আমি তো বেশিদূর যাব না। এই ধারে-কাছেই হাঁটব একটু।”
বিকেল পাঁচটা মানেই এখন অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। বাংলো থেকে বেরিয়ে রজত
হাঁটতে শুরু করলেন। কিছুদূর গিয়ে একটা সাইকেল-রিকশায় চড়ে বসলেন। মিনিট
পনেরো লাগল কিরণদের
বাড়ি পৌঁছোতে। রিকশাওয়ালাটিও আক্ষেপ করে বলেছিল, “ছেলেটা বড়ো ভালো ছিল, বাবু। নিয়তি যে কখন
কাকে কী সাজা দেয়, কে বলতে পারে!”
কিরণের পরিবার তো কান্নায় ভেঙে পড়েছে। রজত তাদের আশ্বস্ত করে
বললেন, তদন্তের স্বার্থে তারা যদি কিছু কিছু বিষয় জানান তাহলে অপরাধীকে ধরতে
সুবিধা হবে পুলিশের। এভাবে রজত গল্পের ছলে কিরণের মা-বাবার কাছ থেকে কিছু
কিছু জিনিস জানার চেষ্টা করলেন। আদতে নিজের কিছু প্রশ্নের উত্তর
খোঁজার চেষ্টা করলেন।
ছেলেটা কলেজে পড়াশুনো করছিল। বাবাকে জমিতে
চাষাবাদে
সাহায্য করত। বাড়িতে ছাগল আছে। সেই ছাগলের
দুধও
বাজারে বিক্রি করতে নিয়ে যেত। এত কিছু করেও ছেলেটা নিজের
পড়াশুনো ঠিক চালিয়ে যাচ্ছিল। এভাবে
যে তাকে চলে যেতে হবে কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি। পাড়া-প্রতিবেশীরাও কিরণের
এই মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না। সেই সকালে
কিরণকে অনেকেই দেখেছিল ছাগল নিয়ে মাঠের দিকে যেতে। তারপর তাকে আর কেউ দেখেনি।
।। তিন।।
ঠাকুরমশাইয়ের বাড়ি খুঁজতে বেশি বেগ পেতে হল না। একজন
পথচারীকে জিজ্ঞেস করতেই বাড়িটা দেখিয়ে দিল। বোঝা গেল যে
এলাকার সবাই বেশ
খাতির-টাতির করেন তাঁকে। সত্তরোর্ধ্ব বয়স্ক মানুষ। প্রতি-নমস্কার জানিয়ে রজতকে
ঘরে বসতে বললেন। ছোট্ট দুটো ঘরে কর্তাগিন্নির সংসার। একমাত্র
মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন কলকাতায়। রজত বিনয়ের
সঙ্গে বললেন, “দেখুন, আমি পুলিশ নই। কাজেই জেরা করতে এসেছি সে
ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। এমনিই আপনার সঙ্গে আলাপ করতে এলাম।”
বৃদ্ধ স্মিত হেসে বললেন, “আপনার কথা বড়োবাবুর কাছে শুনেছি। এই
দুর্ঘটনার জন্য আপনার কাজকর্মের অসুবিধা হল।”
রজত অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, “আপনাকে বুঝি বলা হয়েছে
আমি এখানে কোনও কাজে এসেছি? আমি কিন্তু বেড়াতেই এসেছিলাম।” একটু চুপ থেকে জিজ্ঞেস
করলেন, “যে ছেলেটি মারা গেছে তাকে চিনতেন?”
বৃদ্ধ ঘাড় নাড়লেন। “কিরণ শুধু ভালো ছাত্রই
ছিল না, একজন ভালো মনের মানুষও ছিল। সবাইকে সবসময় সাহায্য করত। এমন
একটি দিনও যায়নি যেদিন সে স্কুলে বা কলেজে যাওয়ার আগে মন্দির দর্শন করেনি।
শুধু আমি নই, এ-গ্রামের তথা পুরুলিয়ার বহু মানুষ তাকে এক নামে চেনে।”
রজত লক্ষ করলেন যে কথাগুলো বলার সময় পুরোহিতমশাইয়ের
চোখদুটো জলে ছলছল করছে। খুব স্নেহ করতেন কিরণকে।
আর কয়েকটা টুকটাক জিজ্ঞাসা সেরে রজত আবার বাংলোর পথ
ধরলেন।
রাতের খাওয়াদাওয়ার পর একটা ডায়েরি নিয়ে লিখতে
বসলেন। ছোটোবেলা থেকেই গোয়েন্দা-গল্পের পোকা রজত
পড়াশুনার ‘চরিত্র দোষে’ আজ আর্কিওলজিস্ট। কিন্তু সময়
পেলেই রহস্য
সমাধানের ভূত ঘাড়ে চেপে বসে। সারাদিনে যা
যা শুনলেন,
জানলেন সেগুলো ডায়েরিতে লিখে রাখাই গোয়েন্দাদের নিয়ম। তিনিও সেই নিয়ম মেনে
প্রশ্ন-উত্তরের তালিকা প্রস্তুত করলেন। তারপর
একটা নতুন পাতার
মাথায় বড়ো বড়ো করে লিখলেন –
কয়েকটা খটকা
১। একটা সাধারণ প্রশ্ন সবাইকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল
যে, মন্দির থেকে চোখে পড়ার মতো কিছু চুরি গেছে কিনা। উত্তর
মেলেনি। তাহলে ধরে নেওয়া গেল যে কিছু চুরি যায়নি। যদিও ঐ পোড়ো মন্দিরে
চুরি করার মতো তেমন কিছু নেইও।
২। কিরণকে কে বা কারা খুন করতে পারে? বা কোনও
সন্দেহভাজন ব্যক্তি আছে যার সঙ্গে কিরণের শত্রুতা থাকতে পারে? এর
উত্তরেও কোনও জবাব মেলেনি। সবাই এককথায় জানিয়েছে যে
কিরণের কারও সঙ্গেই কোনও শত্রুতা ছিল না।
৩। তাহলে জঙ্গলের মন্দিরে কাকভোরে ছেলেটা কী করতে গেছিল?
এই অবধি লিখে পেনের মাথাটা দাঁত দিয়ে কামড়াতে
থাকলেন। কিছুক্ষণ আগেই সামন্তকে ফোন করে জেনেছেন যে বডি
পোস্টমর্টেম হয়ে ফিরতে ফিরতে তিনদিন সময় মিনিমাম লাগবে। রজত জিজ্ঞেস করেছিলেন পোস্টমর্টেমের রিপোর্টটা কোনওভাবে কালকের মধ্যে
পাওয়া যাবে কিনা। তিনি উৎসুক রিপোর্টটা জানতে। তবে কাল রাতের দিকে হয়তো জানতে পারবেন। মাথার মধ্যে চিন্তারা
এসে ভিড় জমাচ্ছে। ডেডবডিটা রজত নিজে চোখে দেখেননি, তবে শুনেছেন মাথায় এত
জোরে আঘাত করেছে যে চোখদুটো অবধি ঠেলে বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়েছিল। সেই
বীভৎস
বডি রজত সহ্য করতে পারতেন না। তবে একটা
বিষয়ে ভাববার আর সেটা হল, যে ভারী জিনিসটা দিয়ে আঘাত করে খুন করা হয়েছে আততায়ী হয়
সেটা নিজেই বহন করছিল অথবা মন্দিরেই মজুত ছিল।
কিরণের ফটো আজ বিকেলেই দেখেছেন তাদের বাড়িতে। খুব
শান্ত, স্থির চোখের দৃষ্টি। মুখখানা দেখলেই
মায়া হয়। মনটা খারাপ হয়ে গেল হঠাৎ। তিনি বাংলোর ফোনের ডায়াল
ঘোরালেন। ইন্সপেক্টর সামন্তকে জানালেন তাঁর প্রশ্ন
আর খটকাগুলো। ‘পারলে আজ রাত থেকে ঐ মন্দিরের
উপর সাদা পোশাকের পুলিশ গোপনে নজর রাখুক।’ এই প্রস্তাবে সামন্ত
খুব অবাক হন। “আপনি কি ভাবছেন আজও ওখানে কোনও ক্রাইম হতে পারে?”
“হতে পারে না, আমার স্থির বিশ্বাস
হবেই। আজ অথবা কাল।” রজত দৃঢ়ভাবে বললেন।
।। চার।।
এখন রাত দেড়টা প্রায়। এসময় রজতের অফিসে বসে
কাজ করার সময়। তাই অভ্যেসমতো চেয়ারে বসে ভাবতে ভাবতেই কফির
কাপে চুমুক দিলেন। কিছুক্ষণ আগেই কফিটা দিয়ে গেছে এই বাংলোর একমাত্র কেয়ারটেকার
রামা, রামা মাহাতো। এখানে এসে থেকে রজত ভালোই যত্ন-আত্তি পাচ্ছেন রামার দৌলতে। নয়তো
এই অগ্রহায়ণ
মাসের কুয়াশা-ঘেরা নিশ্ছিদ্র অন্ধকার রাত দেড়টার সময়েও ধূমায়িত কফি মাগ
হাজির হয়ে যাওয়া কি চাট্টিখানি কথা?
পুরুলিয়ার অঞ্চলগুলো ভারি সুন্দর। শহর তো
সুন্দর বটেই, গ্রামাঞ্চলগুলো আরও আরও ভালো। আর তেমনি ভালো মানুষগুলো। কাল
রাতে
এইসময় কনফারেন্সে ছিলেন রজত। কী অপূর্ব পুরুলিয়ার ছৌ-নাচ দেখলেন সেখানে।
রাবণবধ
পালা। অদ্ভুত সব মুখোশ পরে ঝালর ঝালর পোশাক গায়ে ছেলেমেয়েগুলো নাচছিল। এতদিন
টিভিতে দেখেছেন সেই নাচ। চোখের সামনে এত কাছ থেকে দেখলেন এই প্রথম। নাচের
পোজের থেকেও মুখোশগুলো যেন বেশি আকর্ষণ করছিল। সিংহ
সেজেছিল যে,
তার লাফঝাঁপ তো দেখার মতো। মাঝে মাঝে
দু’পায়ে
দাঁড়িয়ে উঠেও লাফ দিচ্ছিল। তাঁর গলায় আবার একটা
ঘণ্টা ঝুলছিল। ঘণ্টাটা বেজেই চলেছিল ঠুং-ঠাং শব্দে। সেই বাজনা
যেন এখনও কানে বাজছে। তবে যেন একটু বেশিই জোরে জোরে বাজছে। একসময় রজতের মনে হল
ঠুং-ঠুং নয়, শব্দটা বোধহয় ঠকঠক ছিল। পরক্ষণেই মনে হল ঘণ্টা তো
ঠকঠক করে বাজে না, ওটা তো ঠুং-ঠুং হওয়ারই কথা। কিন্তু
তিনি যেন খুব জোরে জোরে ঠকঠক শব্দ শুনতে পাচ্ছেন। আওয়াজটা
আচমকা খুব জোরে জোরে হওয়াতে রজত ধড়মড় করে চেয়ারে সোজা হয়ে বসলেন। খুব জোর আলোয় ঘরটা যেন
ঝলমল করছে। চোখ কচলে দেখলেন, এ তো সকাল হয়ে গেছে। তবে কি তিনি
সারারাত চেয়ারে বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন? কী যেন কী একটা কিছুতেই মনে
করতে পারছেন না। মাথাটা খুব ঝিমঝিম করছে। তক্ষুনি আবার জোরে জোরে
শব্দ, দরজায়। এবারে দুমদাম। মাথাটা জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে চেয়ার
থেকে উঠলেন রজত।
দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলেন সামন্ত, তার
পেছন পেছন বিস্ফারিত গোলগোল চোখ নিয়ে রামা।
“কী আশ্চর্য, মশাই ঘুমুচ্ছিলেন
নাকি? এ তো পুরো কুম্ভকর্ণের ঘুম। আমি তো বেজায় ভয় পেয়ে গেছিলাম।”
“স্যার, আপনার জন্য আরেকটু হলেই তো আমাদের
হার্ট-ফেল হয়ে যাচ্ছিল প্রায়,” রামার গলা রীতিমতো কাঁপছে তখন।
“যাই হোক, আপনার প্রেডিকশন কিন্তু
মিলল না, রজতবাবু। গতকাল
সারারাত মন্দিরটার উপর আমাদের লোক লুকিয়ে নজর রেখেছিল। কিন্তু
না কেউ
এসেছিল, না কোনও ঘটনা ঘটেছে।” তারপর হাসতে হাসতে
সামন্ত বললেন, “আর দেখুন রজতবাবু, ঐদিকে আমাদের টেনশন দিয়ে সারারাত জাগিয়ে
রেখে আপনি দিব্যি নিশ্চিন্তে নাকে তেল দিয়ে ঘুমুচ্ছেন।”
ব্যাপারটা ঠিক কী হয়েছে এখনও পরিষ্কার
মনে পড়ছে না রজতের। রাতে তো তিনি ডায়েরি
লিখছিলেন। তারপর, তারপর... সামন্তকে ফোনও করলেন। ও হ্যাঁ, তারপর বোধহয় কফি খাচ্ছিলেন। কফি
কাপটা কোথায় গেল যেন...
“কিছু খুঁজছেন, স্যার? আমার কথা শুনতে
পাচ্ছেন?” সামন্তর কপালে বিরক্তির ভাঁজ।
“কফি-মাগটা এখানেই
রেখেছিলাম ঠিক,” বলে চেয়ারের এদিক সেদিক খুঁজতে থাকেন রজত।
দেখাদেখি সামন্তও খুঁজতে থাকেন। “মাগটা খুব দরকারি
বুঝি?”
তার জবাব না দিয়ে রজত মুখ তুলে জিজ্ঞেস করেন, “রামা কোথায় গেল?
এসেছিল না ঘরে একটু আগেই?”
সামন্ত একটু বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি ঠিক কাকে খুঁজছেন
বলুন তো, রজতবাবু? কাপটা, নাকি রামাকে?”
এর উত্তরে সামন্তকে অবাক করে রজত বললেন, “ইন্সপেক্টর সামন্ত, আপনি
খবরদার
মন্দির থেকে পুলিশ-পাহারা তুলবেন না যেন। আজ একটা হেস্তনেস্ত হবেই। চলুন তো একবার আমাকে
থানায় নিয়ে।” বলতে বলতেই রজত চোখের নিমেষে পার্স, ডায়েরি,
মোবাইল, চাদর সব তুলে নিয়ে হনহন করে দরজা দিয়ে হাঁটা লাগালেন।
।। পাঁচ।।
লাঞ্চটা জমিয়ে ইন্সপেক্টর সামন্তর বাড়িতেই সারা হল। বিকেলে
বাংলোতে ফিরতেই গেটের দারোয়ান চাবি নিয়ে এগিয়ে এল। বলল, “স্যার, রামা আমাকে চাবি দিয়ে
গেছে। বলল, বাড়ি থেকে ফোন এসেছে। বৌ নাকি
খুব অসুস্থ,
তাই তাড়াতাড়ি চলে গেছে।”
রজত মনে মনে হাসলেন। ঘরে
ঢুকেই মোবাইল থেকে ফোন করলেন সামন্তকে। জানালেন
রামার বাড়ি চলে যাওয়ার গল্প। “আপনি একটু ব্যাটাকে
চোখে চোখে রাখবেন, সামন্তবাবু। চিন্তা নেই, এখনই পালাবে না।
ওর কাজ এখনও বাকি যে। আর হ্যাঁ, ল্যান্ড ফোনটা কিন্তু ট্যাপ
করা হয়েছে আগাগোড়া। তাই মোবাইল থেকে আপনাকে ফোন করছি।”
সন্ধ্যার দিকে একবার বাংলোর ল্যান্ড ফোন
থেকে নম্বর ডায়াল করলেন রজত। সামন্তকে ফোনে ধরে বললেন, “মন্দির থেকে পাহারাটা
তুলেই দিন, সামন্ত। আর তো কিছুই হওয়ার নেই। আর
হ্যাঁ,
পোস্টমর্টেমের রিপোর্টটা এলে খবর দেবেন। আমি কাল সকালেই ফিরে
যাচ্ছি চণ্ডীগড়। দেখুন, আপনারা এদিকে কিছু করতে পারেন-টারেন কি না।”
এরপর নিজেই রান্নাঘরে গিয়ে জল গরম করে আনলেন। টি-ব্যাগ ডুবিয়ে চা বানিয়ে খেলেন। বারান্দায়
দাঁড়িয়ে
একটা সিগারেট ধরালেন। মাথাটা বেশ হালকা লাগছে এখন। চিন্তাগুলো
ফুরফুর করছে। হাতের ঘড়ি দেখলেন, সবে আটটা বেজেছে।
একটু হাঁটা যাক। গেট কিপারকে ডেকে বললেন, “রামা আমার রাতের খাবার
রেখে গেছে। আমি বরং একটু হেঁটে আসি। তাহলে খিদেটাও পাবে ভালোভাবে।”
“জী হুজুর!” বলে দারোয়ান দরজায়
তালা লাগিয়ে দিল।
বাংলো থেকে মন্দিরে যাওয়ার দুটো রাস্তা। একটা
সোজা
চওড়া পথ, আরেকটি বন্ধুর ঘুরপথ। রজত ঘুরপথটি বাছলেন। কাঁচা
রাস্তা,
আঁকাবাঁকা। মন্দিরের পেছনের দিকে এসে একটা টিলার
উপর উঠলেন। টিলার খাঁজে শরীরটা এমনভাবে এলিয়ে
দিলেন যে এখান থেকে মন্দিরের দরজাটা মোটামুটি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু
কুয়াশার
জন্য তাকে কেউ দেখতে পাবে না।
সময় কাটতে চায় না।
প্রায় ঘণ্টাদুয়েক একভাবে বসে থাকতে
থাকতে হঠাৎ মনে হল যেন কারও পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। ঘড়ির
রেডিয়াম
ডায়াল বলছে রাত প্রায় সাড়ে দশটা। দুটো ছায়ামূর্তি এগোচ্ছে মন্দিরের দরজার দিকে। দু’জনেই ঢুকে গেল মন্দিরের
ভেতরে। রজত দমবন্ধ করে বসে রইলেন কান খাড়া করে। একটা
বিশেষ
শব্দের প্রতীক্ষা করছেন যেন। এমন সময় খুব মৃদু ঘণ্টার ঠুং-ঠুং শব্দ
শোনা গেল।
তৎক্ষণাৎ টিলা থেকে নেমে এলেন রজত। দু’পকেট থেকে
দুটো জোরালো টর্চ বের করে দু’জনের মুখ লক্ষ করে জ্বেলে ধরলেন। আচমকা এই ঘটনায়
হকচকিয়ে গেল দুই মুখোশধারী। প্রাথমিক হতভম্ব অবস্থাটা কাটিয়ে উঠেই
দু’জন দু’পাশে ছিটকে সরে গেল। একজনের পকেট
থেকে বেরিয়ে এল ঝকঝকে আগ্নেয়াস্ত্র। মুখের উপর
টর্চ পড়ায় লক্ষ
স্থির করতে অসুবিধা হচ্ছিল। রজত চোখের আন্দাজে
মাপলেন আততায়ীকে। বড়োজোর হাত ছয়েক দূরে দাঁড়িয়ে। চকিতে ডান হাতের টর্চটা ছুড়ে
মারলেন রিভলবার ধরে থাকা হাতটা লক্ষ্য করে। লোকটা সরে যাওয়ায় একটু লক্ষ্যভ্রষ্ট
হল। টর্চটা সজোরে গিয়ে লাগল কাঁধে। শব্দ হল গুড়ুম। আততায়ী মাটিতে
পড়ে গেল। ছুটে এলেন সামন্ত আর চারজন পুলিশ। দু’জনেরই হাতে হাতকড়া
পরানো হল। সামন্তর হাতের অব্যর্থ টিপটা লেগেছে আততায়ীর
রিভলবার ধরা হাতটার উপর। বেচারা নিজের গুলিটা ছোড়ার সুযোগই পায়নি।
সামন্ত হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এলেন রজতের দিকে। “স্যার, আপনার লাগেনি তো
কোথাও? গুলি-ফুলি লাগেনি তো?”
রজত বললেন, “আহা সামন্ত, গুলি তো আপনি
চালালেন। অবশ্য ঐ গুড়ুমটা শুনে আমারও আক্কেলগুড়ুম হয়ে যাচ্ছিল আরেকটু হলে।”
“তবে? আপনি তো মশাই আচ্ছা লোক! কত করে বললাম, গোলাগুলির মাঝখানে
আসবেন না। যদি আপনার লেগে-টেগে যেত তখন উপর-মহলে আমি কী জবাবদিহি করতাম বলুন
তো?” সামন্ত তো রেগে কাঁই।
দু’জনের মুখোশ খোলা হল। মুখোশের আড়াল
থেকে বেরোলো বাংলোর কেয়ারটেকার রামা মাহাতো আর তার এক শাগরেদ। রজত বললেন, “সামন্ত, মন্দিরের ঘণ্টাটা
খোলার ব্যবস্থা করুন। দেখুন, ওদের পকেট থেকেই যন্ত্রপাতি সব
পেয়ে যাবেন। জলদি করুন।”
থানায় এসে দেখলেন, ঠাকুরমশাইকে ধরে আনা
হয়েছে। তাঁর মুখে অদ্ভুত এক উদাসীন ভাব। রজত
আর সামন্ত তাঁর সামনে এসে দাঁড়ালেও উনি মুখ তুললেন না, কোনও শব্দ উচ্চারণ করলেন না। মন্দিরের ঘণ্টাটা বয়ে আনা
হল সেখানে। জল দিয়ে ডলে ডলে ধুতেই ওপরের মেকি কালচে হলদে রঙ উঠে
বেরিয়ে এল চকচকে সোনার পালিশ। সামন্ত মাথায় হাত দিয়ে
বললেন, “ওহ মাই গড! এ তো
প্রায় ত্রিশ কিলো সোনা হবে।”
“মন্দিরে প্রথমদিনই এটা দেখে আমার
সন্দেহ হয়েছিল। রোদের আলো পড়ে একটু বেশিই ম্যাড়ম্যাড় করছিল যেন। এটা বাজানোর
নামে একবার গায়ে হাত বোলাতেই সন্দেহ হল গা’টা বেশ খসখসে। পেতলের ঘণ্টা হলে গা
মসৃণ হবার কথা। সেইদিনই মন্দিরের আসল ঘণ্টাটা সরিয়ে এই স্মাগলড ঘণ্টাটা
নকলি রঙ চড়িয়ে ওখানে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সবাই ঘণ্টা
বাজাবে,
কেউ তো আর ঘণ্টার গায়ে হাত বোলাবে না, তাই সন্দেহও হবে না। আর
তাছাড়াও ওরা এটা কালই রাতের অন্ধকারে আবার বদল করে ফেলত। কিন্তু
গোল
বাধলো কিরণ এসে যাওয়ায়। কিরণ চিনে ফেলে লোকাল ছেলে রামাকে। ওরা
সেই ঘণ্টাটা দিয়েই ওকে আঘাত করে আর লুকিয়ে ফেলে অন্যত্র।”
রজত চেয়ার টেনে ঠাকুরমশাইয়ের সামনে বসলেন। কয়েক মুহূর্ত ওঁর নতমুখের
দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করলেন, “কিরণ আপনাকেও দেখে ফেলেছিল, তাই না?”
পুরোহিত মুখ তুললেন। তাঁর দু’গাল বেয়ে গড়িয়ে এসেছে
জল। কান্নাধরা গলায় বললেন, “আমি বুঝতে পারিনি ওরা ছেলেটাকে
এভাবে শেষ করে দেবে। আমি বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ওরা
শোনেনি আমার কথা। ছেলেটাকে আমার চোখের সামনে দু-দু’বার মাথায় আঘাত করল ঐ
ঘণ্টা দিয়ে।”
একটা ঘৃণামিশ্রিত কষ্ট দলা পাকিয়ে উঠছিল রজতের গলা
ঠেলে। ঝটিতি চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লেন। ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন বাইরেটায়। কিরণের
সরল মুখটা চোখের সামনে ভাসছে। ছোট্ট নিষ্পাপ ছেলেটা হয়তো স্বপ্নেও ভাবতে
পারেনি যে ঠাকুরমশাইকে সে দেবজ্ঞান করত, যে হাত থেকে সে আশীর্বাদী ফুল নিত, সেই
হাতেই একদিন এত বড়ো পাপ হবে।
গাঢ় কুয়াশা ঘিরে ধরছে চারপাশটা।
বিষণ্ণতার
মেঘ জড়িয়ে রইল কেশরগড়ের মন্দিরটার আষ্টেপৃষ্ঠে।
_____
অলঙ্করণঃ পুষ্পেন মণ্ডল
দারুণ গল্প শুভ্রা! খুব ভালো লাগল।
ReplyDelete