পূর্ব জন্ম
সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়
আঃ! ধাক্কা দিস না বলছি। আবার দেখো, বারণ শোনে না, গুঁতোয়।
ব্যথা লাগবে। তোর বয়স কম। হাড় শক্ত হয়নি এখনও।
কে কার কথা শোনে। ঠেলতে ঠেলতে সমুদ্র-জাত নব্যযুবক
ইন্দো-অস্ট্রেলিয়ান প্লেট গোঁয়ারের মত ঘাড় গুঁজে নেমে যায় সাতশ কিলোমিটার নিচে।
পৃথিবীর গহন গভীরে। তপ্ত লাভায় লীন হয়ে যায় তার শরীর। প্রাচীনা ইউরেশিয়ান প্লেটকে
ঠেলে তোলে।
পৃথিবীর কঠিন লিথোস্ফেরিক খোল মোটামুটি ডজন খানেক মেজর প্লেটে
ভাঙ্গা। ২৫০০ লক্ষ বছর আগে পারমিয়ান যুগে পৃথিবীর সংযুক্ত ভূখণ্ড প্যানজিয়া ভেঙ্গে
টুকরো হতে শুরু করে। শুরু করে দেয় নিজেদের মধ্যে ঠেলাঠেলি। আমাদের আঙ্গুলের নখ যে
গতিতে বাড়ে সেই গতিতে প্লেটগুলি নিজের নিজের জায়গা থেকে সরে যেতে থাকে। সরতে সরতে
ট্রিয়াসিক, জুরাসিক যুগ পেরিয়ে একশ লক্ষ বছর আগে ইন্দো-অস্ট্রেলিয়ান প্লেট এসে
ধাক্কা লাগায় ইউরেশিয়ান প্লেটকে। কঠিন ভূখণ্ড মেশে নবীন মৃত্তিকায়।
মাটি-পাথর-অস্থি-মেদ-মজ্জা সমেত ভেঙ্গে চুরে সরে আসে আকাশের কাছাকাছি। আকাশের নীল
চোখ করুণায় ঘন হয়। হিম পড়ে। তৈরি হয় হিমালয়। তার রহস্যের ঘেরাটোপ মানুষকে চিরন্তন
হাতছানি দেয়। অমোঘ ডাকে।
ইয়কসাম বেসক্যাম্পে বসে জিভ-পোড়া কফি খেতে খেতে আড্ডা হচ্ছিল।
সিকিমের পুরোন রাজার রাজধানী। পিছনে খাড়াই উঠে গেছে পাহাড়। সমুদ্র থেকে উঠে এসেছে
বলে তার বুকে এত উদভ্রান্ত ঢেউ। এত রহস্য। এখনও খনন করলে পাওয়া যায় স্মৃতির মত
শঙ্খ, প্রবাল। খুঁড়তে খুঁড়তে ফসিল। পাথরে কোরাল-ছাপ, সামুদ্রিক
মাছের অবয়ব। এইখানে একদিন আমিও ছিলাম। হয় তো কোনো প্রাণী নয়, জলজ উদ্ভিদ হয়ে।
ঠিক কবে মানুষ হয়ে উঠলাম? স্মৃতি হাতড়ে দেখি
চল্লিশ লক্ষ বছর আগে আফ্রিকার গহিন অরণ্যে এক পূর্বজ সোজা হয়ে দাঁড়াল। এখন সে তার
হাত দুটি চলা ফেরা, গাছে চড়া ছাড়াও অন্য কাজে লাগাতে পারে।
অবশ্য তার শরীর আর বুদ্ধির যৎসামান্য বিকাশ হতে হতেই কেটে গেল আরও পনেরো লক্ষ বছর।
পঁচিশ লক্ষ বছর আগের সেই প্রোটো-মানুষের নাম অস্ট্রালোপিথেকাস আফ্রিকানাস। তার
পরিবেশ, তার বেঁচে থাকার আকাঙ্খা তাকে ক্রমাগত বদলে দেয়, হোমো
হাবিলিস থেকে হোমো ইরেকটাস। সে এখন সোজা হয়ে হাঁটতে শিখেছে। অনায়াসে হেঁটে পার হয়ে
যায় মাইলের পর মাইল। পাহাড়, সমতল, অরণ্য, সমগ্র
পৃথিবী তার চারণভূমি। দশ লক্ষ বছর আগে হাঁটতে হাঁটতে সে চলে এল সাউথ ইস্ট এশিয়ার
দ্বীপপুঞ্জে। তার প্রস্তরীভূত দেহাবশেষ দেখে সেই মানুষকে আমরা নাম দিয়েছি জাভা
ম্যান।
বেঁচে থাকা বড় দায়। হিংস্র শ্বাপদদের আক্রমণ থেকে রেহাই নেই। তারা
মানুষের থেকে আকারে বড়ো, শক্তিশালী, দ্রুতগামী।
তাদের দাঁত নখ তীক্ষ্ণ। তারা রাত্রির অন্ধকারে মানুষের থেকে ভালো দেখতে পায়।
পৃথিবীতে বেঁচে থাকে সেই যে সবথেকে উপযুক্ত। হয় তো আমিই সেই বালক, পাথর নিয়ে
খেলতে খেলতে দেখলাম আগুনের স্ফূলিঙ্গ উড়ে শুকনো পাতা জ্বলে উঠল। প্রথমে ভয় পেয়ে
লাফ দিয়ে সরে গেলাম। তারপর সেই আগুনকে নিয়ন্ত্রণ করে রাত নির্বিঘ্ন হল। পাঁচ লক্ষ
বছর আগে যে মানুষ পাথর ঘষে আগুন জ্বালল, সে হোমো সাপিয়েন্স
সাপিয়েন্স। বন্য জানোয়াররা আগুনকে ভয় পায়। মানুষকে ভয় পায়। কাছে আসে না। মানুষ পাথরে শান দিয়ে পশু শিকারের জন্য
অস্ত্র বানাল। দূর থেকে পাথর ছুঁড়ে শিকার করতে পারলে ক’দিন মহাভোজ।
অস্ট্রেলিয়া আমেরিকা তখনও জনমনুষ্যহীন। অস্ট্রেলিয়ায় যেতে হলে ইস্ট
এশিয়া থেকে নৌকায় চেপে সাগর পাড়ি দিতে হবে। আলাস্কা যেতে হলে সাইবেরিয়া থেকে
পেরোতে হবে বেরিং স্ট্রেট। নৌকো বানানোর কারিগরি তখনও মানুষের আয়ত্ত্ব হয়নি।
তাছাড়া সাইবেরিয়ার ঠান্ডা সহ্য করে সেখানে বসতি পাতাও দূরস্থ।
মোটামুটি সেই সময়েই আর এক দল মানুষ পাড়ি জমাল ইউরোপ, পশ্চিম
ইউরেশিয়ায়। তারা রূপ বদলাতে বদলাতে হাজার পঞ্চাশ বছর আগে হয়ে গেল গুহাবাসী নিয়ান্ডারথাল
মানুষ। তারা দল বেঁধে থাকত, অসুস্থ পরিজনদের সেবা করত, মৃত
আত্মীয়দের গোর দিত। কিন্তু তাদের পাথরের অস্ত্র তখনও তেমন আধুনিক হয়ে ওঠেনি। বরং
সমসাময়িক আফ্রিকান মানুষেরা চেহারার বিচারে তাড়াতাড়ি আধুনিক হয়ে উঠছিল। এমনকি জাভা মানুষেরাও।
ঠিক এই সময় এল মানুষের ইতিহাসে এক বিরাট পরিবর্তন – গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড।
পূর্ব আফ্রিকা, দক্ষিণ ইউরোপের মানুষরা থাকার জন্য ঘর বানাল। শীত তাড়াতে পোষাক
সেলাই করল। তাদের ভোকাল কর্ডের গঠন বদলাল। তারা পরস্পরের সঙ্গে কথা বলা, ভাবের
আদান-প্রদান শুরু করল। অস্ট্রিচের ডিমের খোসার মালা পরে সাজগোজ নাচাগানা শুরু করল।
গুহার গায়ে খোদাই করে পালিত পশুদের ছবি আঁকল। গুহার ভিতর আগুন জ্বালিয়ে ধারালো
পাথরের ছুরি হাতে যে মানুষটি স্বকৃত শিল্পর দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিল তার
সঙ্গে আমার ডি এন এ’র কোথায় যেন দারুণ মিল।
এই ক্রো-ম্যাগনন মানুষের খুলির আকার প্রায় আধুনিক মানুষের মতন। সেই
মানুষেরা পাথরের অস্ত্রকে নির্দিষ্ট আকার দিল। পাথরের সঙ্গে সঙ্গে পশুর হাড় দিয়েও
অস্ত্র বানাল। শিকার করার জন্য তির-ধনুক তৈরি করল। তাই দিয়ে তারা বন্য হাতি, গণ্ডারের
মতো বিরাট চেহারার জানোয়ারও শিকার করত। ক্রো-ম্যাগননরা বেচারা নিয়ান্ডারথালদের
মেরে-ধরে শেষ করে দিল।
তুষার যুগ চলে যায়, ফিরে আসে। তুষার যুগে হিমবাহে এত জল
জমে যে সমুদ্রের জলের স্তর নেমে যায়। অগভীর বেরিং স্ট্রেট জল সরে ভূখণ্ড। হেঁটে
পার হওয়া যায়। কিন্তু এশিয়ার মূল ভূখণ্ড থেকে নিউ গিনি, অস্ট্রেলিয়া
তখনও গভীর সমুদ্র-জলে বিচ্ছিন্ন। তিরিশ থেকে চল্লিশ হাজার বছর আগে মানুষ নৌকা
বানিয়ে সেই জলপথ পাড়ি দিল। মোটামুটি সব কটি মহাদেশের বুকেই পড়ল তার পদচ্ছাপ। শেষ
তুষার যুগ চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ভ্রাম্যমানতাও কমে এল। সে এখন পৃথিবীর
একছত্র অধিপতি। সে থিতু হয়ে বসল। গ্রাম পত্তন করে চাষ-বাস, পশু-পালন
শুরু করল। দেখতে দেখতে সেও হয়ে গেল বার তের হাজার বছর।
কথা বলতে বলতে সন্ধে নামে। কাঠ কুটো জড়ো করে ক্যাম্পে আগুন জ্বেলে
তার চারদিকে আমরা গোল হয়ে বসি। কাল এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা ট্রেকিং শুরু। নাড়ির টান
বড়ো টান। বারবার ফিরে আসি। পূর্বজন্ম ডাকে। হয়
তো কোথাও, পাহাড়ের
কোনও গোপন গুহা-কন্দরে, হিমবাহের অন্তরালে, শীতলতায়
অবিকৃত পড়ে আছে আমার বিগত জন্মের শরীর। যদি খুঁজে পাই, ঠিক চিনে
নেব। দু-চোখ ভরে দেখব তার মোহন রূপ।
_____
ছবিঃ আন্তর্জাল
খুব সুন্দর লাগল।
ReplyDelete