ম্যাজিক ল্যাম্প:: অক্টোবর ২০২২

অষ্টম বর্ষ।। প্রথম সংখ্যা।। অক্টোবর ২০২২
শারদ সংখ্যা ১৪২৯
------------------

প্রচ্ছদ: মৃণাল শীল
--------

সম্পাদকীয়:: অক্টোবর ২০২২


ম্যাজিক ল্যাম্পের প্রিয় বন্ধুরা,

কেমন কাটল তোমাদের এবারের পুজো? নীল আকাশের পেঁজা তুলো মেঘের ছুটোছুটি দেখতে দেখতে? নাকি বৃষ্টিতে ভিজে, ভিড় ঠেলে? বাড়িতে বইমুখো হয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে নাকি পুজোমণ্ডপে অনেক কাজেকর্মে পাহাড়ে, সমুদ্রে নাকি মরুভূমিতে
তবে যেখানেই যাও -  দেশে, বিদেশে - ম্যাজিক ল্যাম্প শারদ সংখ্যা তোমাদের হাতের মুঠোয় মোবাইল খুলেই পড়ে নিতে পারবে তাই দেরি না করে চটপট পড়ে ফেলো থাকছে ছড়া, কবিতা, কমিকস, গল্প, প্রবন্ধ - আরও অনেক কিছু কলম ধরেছেন প্রখ্যাত সাহিত্যিকরা
সুন্দর, সুন্দর ছবি দিয়ে ম্যাজিক ল্যাম্পকে সাজিয়েছেন এই সময়ের সেরা শিল্পীরা প্রচ্ছদ এঁকেছেন প্রখ্যাত শিল্পী শ্রী মৃণাল শীল
শারদ সংখ্যাটিকে সাজিয়েগুছিয়ে তোমাদের সামনে নিয়ে এসেছেন শ্রী তাপস মৌলিক
আমাদের জানাও তোমাদের কেমন লাগল এই সংখ্যা খুব ভালো থেকো বন্ধুরা
ইতি,
জিনি

----------
ছবি - আন্তর্জাল

গল্প:: ডানা গজানোর গান - সৈকত মুখোপাধ্যায়


ডানা গজানোর গান
সৈকত মুখোপাধ্যায়

হলুদ রং-এর স্কুলবাসটার নাম ছিল সাবমেরিন কেন যে বাসের মালিক বাসটার ওরকম নাম দিয়েছিলেন কে জানে সাবমেরিন তো চলে সমুদ্রে কখনও জলের ওপর দিয়ে, কখনও জলের নিচ দিয়ে কিন্তু এই বাসটার তো জলের সঙ্গে কোনো সম্পর্কই ছিল না সে লিটল এঞ্জেল স্কুলের প্রাইমারি-সেকশনের বাচ্চাদের বাড়ি থেকে স্কুলে নিয়ে আসত, আবার স্কুল থেকে বাড়িতে পৌঁছিয়ে দিত বর্ষাকালে বেলেঘাটার রাস্তায় হাঁটু-সমান জল জমলে কখনও কখনও স্কুলবাসটাকে একটু চাকা ভেজাতে হত ঠিকই, কিন্তু শুধু সেইজন্যেই কি ওকে সাবমেরিন বলা যায়?
তবু বাসের মালিক সবুজ রং দিয়ে বেশ বড়ো বড়ো করে বাসের হলুদ বডিতে লিখে দিয়েছিলেন সাবমেরিন
তাতে বাসটার কোনো দুঃখ ছিল না সে ভাবত, নামে কী আসে যায়? এই যে বাচ্চাদের স্কুলের নাম লিটল এঞ্জেল, তা কোনো বাচ্চাটাকেই দেখে তো তারএঞ্জেলমানে দেবদূত বলে মনে হয় না বরং যাতায়াতের পথে একেকটা বাচ্চা যে পরিমাণে গুণ্ডামি করে, তাতে ওদের প্রত্যেককে পকেট-সাইজ শয়তান বলেই মনে হয় তার
কীরকম সব শয়তানি শুনবে? এই হয়তো মনপ্রীত পেছনের সিট থেকে হাত বাড়িয়ে আনুষ্কার মাথায় ওয়াটার বটলের জল ঢেলে দিল আর আনুষ্কা সঙ্গে সঙ্গে আকাশ-পাতাল হাঁ করে কাঁদতে বসল পরক্ষণেই উদিতি রাহুলকে সিটের ওপরে ফেলে দমাদ্দম পেটাল আর রাহুলও সেই রাগে বাসের সিট-কভার থেকে এক মুঠো স্পঞ্জ ছিঁড়ে জানলা দিয়ে উড়িয়ে দিল সারাক্ষণ ওরা এইসব করে যাচ্ছে
ওদের সামলানোর জন্যে লক্ষ্মণ বলে একটা রোগামতন ছেলে বাসের মধ্যে থাকত ঠিকই, কিন্তু তাকে বাচ্চাগুলো ল্যাঙ্কিদাদা বলে ডাকত আর সুযোগ পেলেই বাসের সিট থেকে পা বাড়িয়ে ওকে লেঙ্গি মেরে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করত সেই ছেলে আবার ওদের সামলাবে কী?
ওরা বরং ভয় পেত ড্রাইভার জনকরামকে জনকরাম ড্রাইভারের সিট থেকে মুখ ঘুরিয়ে হুংকার দিলে ওরা একটু শান্ত হয়ে বসত কিন্তু সেও বেশিক্ষণের জন্যে নয় রাসমণি বাজার পেরোবার আগেই শব্দ উঠত ভ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ কী ব্যাপার? না, ল্যাঙ্কিদাদা যে ডাস্টারটা দিয়ে জানলার কাচ মোছে, মহুয়া সেইটা দিয়ে সমর্পিতার মুখ মুছিয়ে দিয়েছে
বাচ্চাদের এইসব বদমাইশি সাবমেরিন খুবই উপভোগ করত
তার দুটো চোখ ছিল সামনে, যাকে সবাই হেডলাইট বলে আর বাকি চোখগুলো ছিল বাসের ভেতরে বাসের ভেতরে যতগুলো আলোর বাল্ব, ততগুলোই চোখ ছিল সাবমেরিন নামে সেই বাসটার সেই বাল্বের চোখ দিয়ে সে স্কুলের বাচ্চাদের বদমাইশি দেখত আর মনে-মনে হাসত
মাঝে মাঝে সাবমেরিন নিজেও ওদের গুণ্ডামিতে একটু অংশ নিত যেমন হয়তো কোমরটাকে হঠাৎই একটু বাঁ দিকে বেঁকিয়ে দিল তার ফলে পুরো বাসটাই বাঁদিকে একবার টাল খেল আর সিটের ওপরের বাঙ্ক থেকে অর্পিতার স্কুলব্যাগটা দমাস করে পড়ল ঠিক নিচের সিটে বসে থাকা অরিত্রর মাথায়
এত ছেলেমেয়ে থাকতে সাবমেরিন কেন বেছে বেছে ঠিক অরিত্রর মাথাতেই ব্যাগ ফেলল? তার কারণ, জানত, স্টুডেন্টদের মধ্যে সবচেয়ে মোটাসোটা ছেলেটার নামই অরিত্র দাস আর সেই অরিত্র দাস কারণে অকারণে তার ভালোমানুষ বন্ধুদের কিলঘুসি লাগিয়ে দেয় তাই এইভাবে ওকে অল্প একটু শাস্তি দিয়ে দিল সাবমেরিন
আসলে সাবমেরিনের বয়সও তো বেশি নয় মাত্র চার বছর আগেই গাড়ির কারখানায় ওর জন্ম হয়েছিল তার মানে স্টুডেন্টদের বয়স আর সাবমেরিনের বয়স ছিল প্রায় এক সেইজন্যেই সাবমেরিন ওদের সঙ্গে একটু খেলতে চাইত

*                   *                   *

সাবমেরিনের দিনগুলো এইভাবে বেশ ভালোই কাটছিল মুশকিল হল দেশে কোভিড আসার পরে একমাস গেল, দু’মাস গেল সাবমেরিনকে আর জনকরাম গ্যারেজ থেকে বারই করে না কেনই বা করবে? আর সব স্কুলের মতন লিটল এঞ্জেল স্কুলেও তো ছাত্র-ছাত্রীদের আসা বারণ হয়ে গিয়েছিল তখন আর ছাত্র-ছাত্রীরাই যদি যাতায়াত না করে তাহলে রাস্তায় বাস বের করে হবেটা কী?
বেলেঘাটার খালপাড়ে যে গ্যারেজটায় সাবমেরিন থাকত, সেই জায়গাটা ছিল একটু নির্জন মতন রাস্তাটার একপাশ দিয়ে বয়ে গেছে বেলেঘাটা খাল আর অন্যপাশে রয়েছে কয়েকটা বন্ধ কারখানা বসতবাড়ি বলতে কিছুই ছিল না সেখানে, আর তাই সন্ধের পর থেকে জায়গাটা অন্ধকারে ডুবে যেত গ্যারেজটাও তেমন পাকাপোক্ত গোছের কিছু ছিল না দরমার দেয়াল আর টালির চাল দিয়ে তৈরি একটা ল্যাঙপেঙে ঘর
কোভিড আসার আগে ওই গ্যারেজেরই একপাশে লক্ষ্মণ থাকত বাসের ভেতরে, বাসের মেঝেতেই বিছানা পেতে ঘুমোত ছেলেটা তাই তখন সাবমেরিনের অত ভয়-টয় করত না কিন্তু এখন তো লক্ষ্মণ নেই; সে বিহারে তার গ্রামে পালিয়ে গেছে এখন সারারাত সাবমেরিনকে ওই অন্ধকার খালপাড়ে ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে একাই থাকতে হয় একা-একা ওখানে রাত কাটাতে ভীষণ ভয় করে সাবমেরিনের
একবছরের রোদে-জলে দরমার দেয়ালটা জায়গায় জায়গায় ভেঙে পড়েছে সেই ফাঁক দিয়ে সাবমেরিন আড়চোখে তাকিয়ে দেখে খালের পাড়ে একটা ফাঁকা জমিতে অনেকগুলো পুরোনো গাড়ির কঙ্কাল পড়ে আছে ওই জমিটা আসলে একজন পুরোনো লোহার ব্যবসায়ীর গোডাউন সে অ্যাক্সিডেন্টে বাতিল হয়ে যাওয়া গাড়িগুলোকে লোহার দামে বিক্রি করবে বলে ওখানে রেখে দিয়েছিল কোভিড শুরু হয়ে যাওয়ার ফলে সেগুলোকে আর বেচতে পারেনি
সাবমেরিন দরমার দেয়ালের ফাঁক দিয়ে একবার করে বাতিল গাড়ির ভাঙা জানলাগুলোর দিকে তাকায়, অ্যাক্সিডেন্টে তুবড়ে যাওয়া মোটরগুলোর বনেটের দিকে তাকায়, আর ভয়ে শিউরে-শিউরে ওঠে ওগুলো যে একটা করে গাড়িভূত সে ব্যাপারে তার সন্দেহ থাকে না তবে তার ইঞ্জিন হিম হয়ে যায় বাতিল ক্রেনটার দিকে তাকালে ওটার সামনে যে বিশাল লম্বা লোহার হাতের মতন জিনিসটা লাগানো আছে, এখন সেটা মাটির ওপরে কেতরে পড়ে আছে ঠিকই, কিন্তু সাবমেরিন ঘুমোলেই তো ওই লোহার হাতটা সাবমেরিনের ঘাড়ে সুড়সুড়ি দিয়ে দিতে পারে পারে না?
এইসব দুঃস্বপ্ন দেখতে-দেখতে বেচারা সাবমেরিন রোগা হয়ে গেল তার চারটে চাকা থেকেই সব হাওয়া বেরিয়ে গেল কারবুরেটরের জল শুকিয়ে গেল মোবিল-ট্যাঙ্ক ফুটো হয়ে সব মোবিল মাটিতে পড়ে গেল সাবমেরিন বুঝতে পারত, যে কোনো দিন ভূতগুলো তাকে ওই ভাঙা গাড়ির কবরখানায় টেনে নিয়ে যাবে
এসব কথা ভেবে বেচারা সাবমেরিনের বুকটা গুড়গুড় করে তার কিচ্ছু ভালো লাগে না কতদিন হয়ে গেল সে তার ছোট্ট বন্ধুদের মুখ দেখতে পায় না কতদিন সে রাস্তায় বেরোয় না, পুলিশকাকুর বকা খায় না কবে যে এই হতচ্ছাড়া লকডাউন শেষ হবে সেই কথাই সে ভাবে বসে-বসে
তারপর একদিন সাবমেরিনের জীবনে একটা ভারী আশ্চর্য ঘটনা ঘটে গেল
গ্যারেজে পড়ে থাকতে-থাকতে কখন যে সাবমেরিনের দরজার লকটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল তা সে নিজেও খেয়াল করেনি একদিন গভীর রাতে সেই বাসের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ল এক রাজকন্যা আর একটা নেড়িকুকুর
 
*                   *                   *

বুঝতেই পারছি, কথাটা তোমাদের একটুও বিশ্বাস হচ্ছে না তোমরা নাক-টাক কুঁচকে বলছ, ‘ধ্যাত, বেলেঘাটায় আবার রাজকন্যা আসে কোথা থেকে? তাও এই টু-থাউজ্যান্ড টোয়েন্টি-টুতে আঙ্কলটা কেবলই মিথ্যে কথা বলে
না গো, সোনা মিথ্যে কথা নয় একেবারেই আগে আমার কথাটা মন দিয়ে শোনো, তাহলেই বুঝবে কোথা থেকে এল সেই রাজকন্যা আর নেড়িকুকুর
আসলে আজ থেকে অনেক অনেক বছর আগে সেই রাজকন্যার বাস ছিল হিমালয়ের কোলে এক রাজ্যে রাজ্যের নাম কাঞ্চনপুর রাজার নাম বসন্তরঞ্জন আর রাজকুমারীর ভালোনাম গুঞ্জামালা, ডাকনাম গুনগুন
কাঞ্চনপুর রাজ্যটা ছিল ভারী অদ্ভুত সেখানে চারিদিকেই পাথুরে মাটি, তাই চাষবাস বিশেষ হত না মাটির নিচে যে সোনাদানা পাওয়া যেত, তাও না তবু সেই রাজ্যের লোকের কোনো দুঃখ ছিল না দেশের রাজামশাই তাদের জন্যে রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজ, ডাক্তারখানা, খেলার মাঠ সব বানিয়ে দিতেন
রাজামশাই- বা অত পয়সা পেতেন কোথা থেকে? তার কি পয়সা বানাবার মেশিন ছিল?
উঁহু বলছি শোনো
সেই অনেক বছর আগের যে সময়টার গল্প বলছি, তখন সারা পৃথিবীতে একমাত্র কাঞ্চনপুরের বনেই পাওয়া যেত পক্ষীরাজ ঘোড়া দুনিয়ার যত রাজারানি, যত রাজকন্যা আর রাজপুত্র, তাদের সবাইকে কাঞ্চনপুর থেকেই পক্ষীরাজ ঘোড়া কিনতে হত পক্ষীরাজ ঘোড়া বিক্রির টাকাতেই কাঞ্চনপুর হয়ে উঠেছিল সত্যিকারেই কাঞ্চনপুর, মানে সোনার শহর
পক্ষীরাজ ঘোড়া তো আর যে-সে প্রাণী নয় তারা যেমন সুন্দর আর শক্তিশালী, তেমনই তারা বুদ্ধিমান মানুষের চেয়ে বুদ্ধি তাদের একটুও কম নয় তাই তাদের ফাঁদ পেতে ধরা যেত না তাহলে কাঞ্চনপুরের মানুষেরা তাদের বিক্রি করত কেমন করে?
তারা নিজেরাই মানুষের কাছে এসে ধরা দিত কেন বলো তো? শুনলে তোমরা বিশ্বাসই করবে না
পক্ষীরাজদের পিঠের ওই যে দুটো ডানা থাকে না, সেই ডানা-দুটো একজন মানুষের ছোঁয়া ছাড়া খুলতই না মানুষটি হলেন কাঞ্চনপুরের রাজা যখন যিনি ওই দেশের রাজা হতেন তিনিই পক্ষীরাজদের ডানা ফোটানোর কাজটি করতেন বহুযুগ ধরে এরকমই চলে আসছে কাঞ্চনপুরের রাজারা মৃত্যুর আগে খুব গোপনে নিজের ছেলে বা মেয়েকে ডানা ফোটানোর গোপন মন্ত্রটি শিখিয়ে দিয়ে যেতেন
এদিকে আবার পক্ষীরাজরা খুব দেশ বেড়াতে ভালোবাসে তো! পিঠে ডানা না থাকলে তারা বেড়িয়ে বেড়াবে কেমন করে? তাই দু’বছর বয়স হলে তারা নিজেরাই গুটিগুটি পায়ে বনের ভেতরে এক ঝরনার ধারে চলে আসত
প্রতিদিন ভোরবেলায় সেই ঝরনার তীরে এক পাথরের ওপরে এসে বসে থাকেন দেশের রাজামশাই; আর কারুর সেখানে যাওয়ার অনুমতি নেই তলোয়ার হাতে নিয়ে প্রহরীর দল সেই বনকে দিবারাত্র পাহারা তো দিতই, কিন্তু তার থেকেও কড়া পাহারা দিতেন পক্ষীরাজদের পূর্বপুরুষ তাঁর কথা পরে বলছি আগে শোনো, ঘোড়ার ছানার ডানা ফুটত কেমন করে
ছোট্ট ঘোড়ার ছানাটি রাজামশাইয়ের সামনে এসে শান্তভাবে মাথা নিচু করে দাঁড়ালে তিনি খুব আদর করে ঘোড়াটার কাঁধের কাছে হাত বোলাতে বোলাতে একটা মন্ত্র পড়তেন সেটা যতটা না মন্ত্র তার চেয়েও বেশি গান খুব সুন্দর-সুরের একটা গান রাজামশাই যতই গান করতেন, ততই পক্ষীরাজের কাঁধের কাছ থেকে সাদা ফুলের পাপড়ির মতন দুটো ডানা একটু-একটু করে বেরিয়ে আসত তারপর গানটা শেষ হওয়া মাত্রই পক্ষীরাজের ছানা ডানা ঝাপটিয়ে আকাশে একপাক উড়ে আবার মাটিতে নেমে আসত মানুষের গলায় রাজামশাইকে বলত, এবার আমার বিদেশ যাওয়ার ব্যবস্থা করুন
রাজামশাই তখন সেই নতুন পক্ষীরাজের পিঠে চেপে সোজা রাজবাড়ির ছাদে এসে নামতেন সেখানে আগে থাকতেই সোনার মোহরের থলি নিয়ে অপেক্ষা করত সেদিন যার পালা, সেই ক্রেতা রাজামশাই তার হাতে পক্ষীরাজের লাগামটি তুলে দিয়ে, সোনার মোহরের থলিটি নিয়ে নিতেন সেই অর্থ দিয়েই যে তিনি রাজ্যের নানান উন্নতি ঘটাতেন সেকথা তো আগেও বলেছি
বছরের পর বছর, যুগ যুগ ধরে এরকমই চলে আসছিল গণ্ডগোল বাঁধাল ছোট্ট রাজকুমারী গুঞ্জামালা কিংবা গুনগুন ছোট্ট মানে তার বয়স তখন মাত্র দশ-বছর একদিন খুব ভোরবেলায় তার ঘুম ভেঙে গেল সে দেখল, তার মা, মানে রানিমা তখনও ঘুমোচ্ছেন অন্যপাশে বাবার শোবার জায়গাটা ফাঁকা
সে জানত, বাবা রোজ ভোরবেলায় কী যেন একটা জরুরি কাজে বেরিয়ে যায় কিন্তু অত ভোরে তার ঘুম ভাঙে না বলে সে কোনোদিন বাবাকে বেরোতে দেখেনি সেদিন ঘুমটা ভেঙে গেল বলেই গুনগুন জানলার পাশে গিয়ে দাঁড়াল আর সেখানে দাঁড়াতেই দেখতে পেল, তার বাবা মহারাজ বসন্তরঞ্জন তানপুরাটি ঘাড়ে নিয়ে রাজবাড়ির নিচের রাস্তাটি ধরে কোথায় যেন যাচ্ছেন
গুনগুন ভারী অবাক হল বাবা যদি কাজেই যাবে তাহলে ঘাড়ে তানপুরা কেন? তার কৌতূহল আর বাধা মানল না সে পা টিপে-টিপে নিচে নেমে, বাবা যেদিকে গিয়েছিল সেদিকেই দৌড় লাগাল
অত ভোরে রাজবাড়ির প্রহরী কিংবা দাসদাসীরা কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি তাই তারা জানতেও পারল না যে, রাজকুমারী রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে গেল
রাস্তায় বেরিয়ে গুনগুন কিন্তু বাবাকে দেখতে পেল না সে যখন বাবাকে খোঁজার জন্যে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে, তখনই, ঠিক তার পেছন থেকে আওয়াজ এলঘেউ
পেছনদিকে একবার তাকিয়েই গুনগুনের মুখে হাসি ফুটে উঠল সে দেখল কালু তার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রবল আনন্দে পাঁইপাঁই করে লেজ নাড়ছে আর মাঝে মাঝেই সামনের থাবাদুটো ওপরে তুলে লাফিয়ে উঠছে নেড়িকুকুরের ওই ছোট্ট ছানাটাকে গুনগুন খুব ভালোবাসে ওকে দু’বেলা নিজের হাতে ভাত খাওয়ায় কালু নামটা গুনগুনেরই দেওয়া
গুনগুন কালুকে কোলে তুলে নিয়ে বলল, “কী মুশকিল দেখ তো কালু বাবাকে এইদিকেই যেতে দেখলাম, কিন্তু এখন আর খুঁজে পাচ্ছি না
কালু বুঝদারের মতন গুনগুনের মুখের দিকে তাকিয়ে ওর কথাগুলো শুনল তারপর আবারঘেউবলেই ওর কোল থেকে লাফিয়ে রাস্তায় নেমে দৌড় দিল আসলে কালু তো কুকুর, তাই রাজামশাইয়ের গায়ের গন্ধ পাচ্ছিল আর গুনগুনকে মনে মনে বলছিল, আমার সঙ্গে চলো তোমার বাবাকে খুঁজে দিচ্ছি
গুনগুন কালুর মনের কথা বুঝতে পেরে ওর পেছন পেছন দৌড় দিল দৌড়োতে দৌড়োতে ওরা দু’জনে একটু বাদেই পৌঁছে গেল সেই ঝরনাটার ধারে
একটা খুব বড়ো গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে গুনগুন অবাক হয়ে দেখতে লাগল ওর বাবার কাণ্ড দেখল, একটা খুব সুন্দর সাদা ঘোড়ার বাচ্চা বাবার সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে আর বাবা সুর করে একটা গান গাইতে গাইতে বাচ্চা ঘোড়াটার কেশরে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে দেখতে দেখতে ঘোড়াটার পিঠে দুটো ডানা গজাল আর সে পাখির মতন উড়ে গেল আকাশে
এবার আর থাকতে না পেরে গুনগুন গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে ডাকল, “বাবা!
গুনগুনকে দেখেই মহারাজ বসন্তরঞ্জনের চোখ দুটো বড়ো-বড়ো হয়ে উঠল তিনি বললেন, “এ কী সর্বনাশ করলি মা? তুই জানিস না, এই মায়াবনে রাজা ছাড়া আর কারুর ঢোকা নিষেধ এবার যে তোকে শাস্তি পেতে হবে
গুনগুন তাই শুনে ভয় পেয়ে গেল ফ্যাকাশে মুখে বাবাকে জিজ্ঞেস করল, “কে দেবে শাস্তি? কেমন শাস্তি?
মহারাজ কিছু বলার আগেই একটা পাথরের মতন ফসিলের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন পক্ষীরাজদের পূর্বপুরুষ তাকে দেখতে অনেকটা ঘোড়ার মতোই, কিন্তু আকারে একটা কুকুরের চেয়ে বড়ো নন তিনি ঘোড়াদের সেই পূর্বপুরুষের নাম ইয়োহিপ্পাস ইয়োহিপ্পাস রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে, মাটিতে খুর ঠুকতে ঠুকতে বললেন, “রে রে বিচ্ছু বালিকা! তোর এত বড়ো সাহস যে, তুই আমাদের মায়াবনে প্রবেশ করিস যা, তুই দু’হাজার কুড়ি সালের কলকাতায় গিয়ে ঘুরে বেড়া
মহারাজা বসন্তরঞ্জন ইয়োহিপ্পাসের সামনে হাত জোড় করে বললেন, “ও তো বাচ্চা মেয়ে প্রভু না জেনে অপরাধ করে ফেলেছে তার জন্যে এত বড়ো একটা অভিশাপ দিয়ে দিলেন!
ইয়োহিপ্পাস মাথাটা আকাশের দিকে তুলে বড়ো বড়ো দাঁতের পাটি বের করে বললেন, “চিঁহিইই বাচ্চাই হোক, কিংবা বুড়ো, আমাদের নিয়মের নড়চড় হবে না, হি হি
রাজা বললেন, “তাহলে ওর শাপমোচন হবে কেমন করে সেটা বলে দিন?
ইয়োহিপ্পাস একটু ভেবে বললেন, “যদি টানা তিনদিন কোনো মানুষ ওকে গান গাইতে না শোনে, তাহলেই ওর শাপমোচন হবে তাহলেই গুনগুন আবার কাঞ্চনপুরে ফিরে আসতে পারবে
তাই শুনে গুনগুন এবং রাজামশাই দু’জনেই একসঙ্গে বলে উঠলেন, “অসম্ভব
এমনকি কালু অবধি দুঃখিত মুখে দু’দিকে ঘাড় নাড়িয়ে বলল, ‘ভুক ভুক
সবাই জানে, যতক্ষণ জেগে থাকে ততক্ষণই গুনগুন আপনমনে গান গেয়ে যায় সেইজন্যেই তো ওর ঠাকুমা ওর নাম দিয়েছে গুনগুন
যাই হোক, গুনগুন রাজামশাইকে বলল, “তুমি ভেব না বাবা আমি খুব চেষ্টা করব তিনদিন গান না গেয়ে থাকবার আর একবার কলকাতায় গিয়ে পড়লে আমার গান এমনিতেই বন্ধ হয়ে যেতে পারে আয় কালু!
ইয়োহিপ্পাস বললেন, “আয় কালু মানে? আবার কোথায় যাবে?
গুনগুন বলল, “কেন? আমার সঙ্গে কলকাতায় - তো এই মায়াবনে ট্রেসপাস করেছে তাহলে ওই বা শাস্তি পাবে না কেন?
ইয়োহিপ্পাস একটু ভেবে বললেন, “তা ঠিক আচ্ছা, তাহলে কুকুরছানা, তুমিও এখন কলকাতায় গিয়ে উপস্থিত হও
বলামাত্রই একটা রুপোলি রঙের হাওয়া এসে গুনগুন আর কালুকে তুলে নিয়ে সোজা বেলেঘাটা খালপাড়ে সাবমেরিনের সেই ভাঙা গ্যারেজের দরজায় নামিয়ে দিয়ে চলে গেল

*                   *                   *

কাঞ্চনপুর থেকে যখন হাওয়াটা গুনগুন আর কালুকে তুলে নিয়েছিল, তখন ওখানে ছিল সকালবেলা অথচ ওরা দু’জন যখন কলকাতায় নামল, তখন সেখানে গভীর রাত
চারিদিকে তাকিয়ে গুনগুনের তো চক্ষু চড়কগাছ কী রকম জায়গা রে বাবা! বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি গুদামখানার মতন বাড়ি পাশে একটা নোংরা জলের খাল কোথাও একটা মানুষের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না এখানে সে থাকবেই বা কোথায় আর খাবেই বা কী! মনের দুঃখে গুনগুন রাস্তার ধারে একটা ভাঙা পাইপের ওপরে বসে পড়ল তারপর কালুর মাথাটা দুই হাঁটুর মধ্যে চেপে ধরে, ওর পিঠে হাত বুলোতে বুলোতে নিজের মনে গান গাইতে শুরু করল
কালু বলল, ‘ভুক ভুক আসলে সে বলতে চাইছিল চুপ চুপ বোকা মেয়ে! তোমার কি শাপমোচনের শর্তের কথা মনে নেই? ইয়োহিপ্পাস তোমাকে তিনদিন গান গাইতে বারণ করেছে না?
গুনগুন কালুর কথা বুঝতে পারল না গানটা গাইতেই লাগল আসলে তার একইসঙ্গে খুব মনখারাপ লাগছিল আর ভয়ও করছিল সে তো মাত্র দশ বছরের একটা পুঁচকি মেয়ে, তার ওপরে রাজবাড়ির আদরে মানুষ এই প্রথম মায়ের কাছ থেকে এত দূরে চলে এসে সে যে কী করবে কিছুই বুঝতে পারছিল না তাই গান গাইছিল
একটু আগেই তো বললাম, গুনগুন ভীষণ গান ভালোবাসে গান তার সবচেয়ে বড়ো বন্ধু এই অচেনা দেশে সেই বন্ধুকে সে ছাড়বে কেমন করে?
তারপর কী হল শোনো একটু বাদেই গুনগুনের হাতের নিচে নরম-নরম, সিল্কি-সিল্কি কীসের যেন ছোঁয়া লাগল রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোয় গুনগুন দেখল, কালুর পিঠে দুটো ডানা গজিয়ে উঠেছে তখন গুনগুনের মনে পড়ল, সে যে-গানটা এখুনি গাইছিল, সেটা আসলে আজ সকালেই সে শুনে শুনে শিখে ফেলেছে গানটা গাইছিল তার বাবা বসন্তরঞ্জন এটা সেই ডানা গজানোর গান
গুনগুন ভারী খুশি হল বলল, “দ্যাখ রে কালু তোর ডানা গজিয়েছে. কালু পরিষ্কার মানুষের ভাষায় বলল, “তাতে আমার কী লাভ হল? জানোই তো, আমরা নেড়ি কুকুরেরা নিজেদের পাড়া ছেড়ে কোথাও যাই না ডানা নিয়ে তাহলে করবটা কী?
গুনগুন চোখ গোল গোল করে বলল, “এ কী রে কালু তুই কথাও বলতে পারছিস!
কালু পেছনের বাঁ-পা দিয়ে সামনের ডান কান চুলকোতে চুলকোতে বলল, “তাই তো দেখছি তাছাড়া বুদ্ধিটাও মনে হচ্ছে হঠাৎই বেজায় বেড়ে গেছে সবই ওই পক্ষীরাজ-এফেক্ট
তারপর চারদিকে তাকিয়ে, একটু গন্ধ-টন্ধ শুঁকে বলল, “চলো, গুনগুন ওই খালি গ্যারেজটার মধ্যে রাতের মতন আশ্রয় নিই
কালুর পেছন পেছন গুনগুন গিয়ে গ্যারেজে ঢুকল
কালু বলল, “বাইরে বড্ড মশা বাসটার ভেতরে নরম গদিও আছে নিশ্চয় চলো, ভেতরেই ঢুকে পড়ি
গুনগুন দরজা খুলে বাসের ভেতরে পা দিল পেছন পেছন কালু
ওদের পায়ের আওয়াজে সাবমেরিনের ঘুম ভেঙে গেল সে হাঁউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠল, “ওরে বাবা রে, ভূত রে খেয়ে ফেলল রে
কালু কুকুরের ভাষায় তাকে এক ধমক দিল, গ্রুফ মানে চুপ তারপরেই কালুর মনে পড়ে গেল, সে তো এখন দিব্যি বাংলা বলতে পারে তাই বলল, “একদম চুপ থাকো, বোকা কোথাকার আমরা ভূত নই ইনি কাঞ্চনপুরের রাজকন্যা, গুঞ্জামালা আর আমি তার ইয়েযাকে বলে দেহরক্ষী কালু সিং রাজকন্যা এখন ঘুমোবেন তুমি একদম শব্দ করবে না
সারাদিনে প্রচুর উত্তেজনা আর ধকল গিয়েছিল গুনগুন তাই সত্যিকারেই একটা সিটের ওপরে শুয়ে তখুনি ঘুমিয়ে পড়ল কালু আর সাবমেরিন অনেক রাত অবধি জেগে জেগে গল্প করল নেড়িকুকুরের ছা কালু বাতিল বাস সাবমেরিনকে তাদের দুঃখের কথা বলল বলল, কেমন করে ইয়োহিপ্পাসের অভিশাপে তাদের ভবিষ্যতের একটা সময়ে এসে পড়তে হয়েছে আর সাবমেরিন কালুকে বলল তার দুঃখের কথা বলল, লকডাউনের বাজারে কীভাবে সে দিনের পর দিন মানুষের মুখ না দেখে একা একা এখানে পড়ে আছে আর ভূতের ভয়ে আধমরা হচ্ছে
পরদিন সকালে কালু একটু আশপাশটা দেখে আসবার জন্যে বেরোল কাছাকাছি একটা বাড়ির রান্নাঘরের পেছন দিয়ে যাবার সময় তার নাকে এল চমৎকার লুচি ভাজার গন্ধ সে উঠোনটা পাক খেয়ে রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল তাকে দেখেই সেই বাড়ির রাঁধুনি ইষ্টপদ একটা খুন্তি তুলে নিয়ে বলল, “হ্যাট হ্যাট কোত্থেকে একটা নেড়িকুকুরের ছানা এসে জুটল রে বাবা!”
কালু পরিষ্কার বাংলায় বলল, “বাজে বকিস না আমি এক ছদ্মবেশী যোগীপুরুষ দে, ওই প্লাস্টিকের প্যাকেটটার মধ্যে কুড়িটা লুচি, দু-বাটি সাদা তরকারি আর চারটে মালপোয়া তুলে দে ঠাকুর তোর মঙ্গল করবেন
কুকুরকে বাংলায় কথা বলতে শুনে ইষ্টপদ কাঁপতে-কাঁপতে প্যাকেটে করে সব খাবার সাজিয়ে কালুর গলায় ঝুলিয়ে দিল কালু যাবার সময় তাকে বলে গেল, “আবার দুপুরের দিকে আসব বিরিয়ানি-ভোগ সাজিয়ে রাখবি আর আমার কথা যদি ঘুণাক্ষরেও কাউকে বলেছিস, তাহলে তোর মাথায় বজ্রাঘাত হবে
গ্যারেজে ফিরবে বলে ঘুরে দাঁড়াতেই কালু দেখতে পেল -পাড়ার চারটে গুণ্ডা কুকুর হিংস্র চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে উঠোন পেরোলেই তাকে চেপে ধরে সব খাবার কেড়ে নেবে কালু মুচকি হেসে ডানা ঝাপটে আকাশে উড়ে গেল ইষ্টপদ এতক্ষণ কোনোরকমে অজ্ঞান না হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল এবার কুকুরছানাকে উড়ে যেতে দেখে সে ঠাঁই করে মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়ে গেল

*                   *                   *

হুম-হাম করে খান পাঁচেক লুচি আর দুটো মালপোয়া খেয়ে রাজকুমারী গুঞ্জামালার পেটটা একটু ঠান্ডা হল সে চটপট ফ্রকের কোনায় হাত মুছে নিল তারপর যথাসাধ্য গম্ভীর গলায় বলল, “বৎস সাবমেরিন তুমি কী চাও বলো তো
সাবমেরিন বলল, “রানিমা, আমি স্কুলে যেতে চাই
রানিমা ডাক শুনে গুনগুন এত খুশি হল যে, তার গাম্ভীর্য কোথায় উড়ে গেল সে তড়াক করে একটা সিটের হেলান দেওয়ার জায়গাটায় উঠে বসে, পা নাচাতে-নাচাতে বলল, “তা গেলেই পারো কে তোমাকে আটকাচ্ছে? রাস্তায় তো একটিও লোক নেই পুলিশরা নাকি গরিব মানুষদের খাওয়াবে বলে লঙ্গরখানায় খিচুড়ি রাঁধতে ব্যস্ত তাহলে তুমি স্কুলে যাচ্ছ না কেন?
সাবমেরিন বলল, “কেমন করে যাব রানিমা? আমার চাকায় হাওয়া নেই, মোবিল নেই, জল নেই সবচেয়ে বড়ো কথা, আমাকে যে চালিয়ে নিয়ে যায়, সেই জনকরামও নেই তাহলে রাস্তায় বেরোব কেমন করে?
গুঞ্জামালা চোখ পাকিয়ে কালুর দিকে তাকাল কালু তখনও অবশিষ্ট লুচিগুলোকে কোঁৎকোঁৎ করে গিলছিল গুনগুন বলল, “এই বেয়াদপ যা, গাড়ির মেকানিক ডেকে নিয়ে আয় বলবি খালপাড়ের মহারানি ডেকেছেন
কালু শেষ লুচিটা গিলে নিয়ে বলল, “ইঃ ভারী আমার মহারানি এলেন রে বলি তোমার জন্যে এই প্যানডেমিকের মধ্যে বেরিয়ে কি মোটর-মেকানিক তার প্রাণটা খোয়াবে? কেউ আসবে না এখন
তাই শুনে গুনগুনের মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল সে বলল, “এই কালু! তাহলে বেচারা সাবমেরিনের কী হবে? যে আমাদের ওপরেই ভরসা করে আছে
কালু বলল, “চিন্তা করছ কেন? তোমার ডানা গজানোর গানটা মনে আছে তো? বাসের গায়ে হাত বুলিয়ে ওটাই একটু গাও না সাবমেরিনের ডানা গজালে উড়ে উড়েই যেখানে ইচ্ছে চলে যেতে পারবে
গুনগুনের চোখ দুটো ঝকমক করে উঠল বলল, “সত্যি রে কালু পক্ষীরাজ থুড়ি নেড়িরাজ হওয়ার পর থেকে তোর বুদ্ধিটা এত খোলতাই হয়েছে, বলবার কথা নয়
কিন্তু পরক্ষণেই গুঞ্জামালার মুখটা আবার মলিন হয়ে গেল সে বলল, “আমি যে ভেবেছিলাম এখন তিনদিন একদম গান গাইব না তাহলে তিনদিন পরেই মায়ের কাছে ফিরে যেতে পারব
কালু বলল, “দেখো, তুমি যা ভালো বোঝো করো
গুনগুন একটু চিন্তা করে বলল, “নাঃ আমার বাড়ি ফেরার চেয়ে সাবমেরিনের স্কুলে যাওয়াটা অনেক বেশি জরুরি কারণ, একে তো বয়সে আমার চেয়ে অনেক ছোটো তার ওপরে অনেকদিন ধরে এই একা থাকার শাস্তি ভোগ করছে
এই বলে গুনগুন বাসের ভেতরে বসেই সেই ডানা গজানোর গানটা গাইতে শুরু করল
ঘন্টাদুয়েক বাদে সাবমেরিনের দু’দিকের দেয়ালের গা ফুঁড়ে দিব্যি দুটো অ্যালুমিনিয়ামের ডানার কুঁড়ি বেরিয়ে এল কালু উল্লাসে লাফিয়ে উঠে বলল, “হচ্ছে, হচ্ছে তোমার গানে কাজ হচ্ছে গেয়ে যাও, গেয়ে যাও থেমো না
থামল না গুনগুন মাঝে মাঝে একটু দম নিয়ে সে গেয়েই যেতে লাগল
কিন্তু বাসের ডানা তো আর কুকুরের কিংবা পক্ষীরাজের মতন এতটুকু ডানা নয় প্রায় ছোটোখাটো এরোপ্লেনের ডানার মতন মস্ত সেই ডানা বাড়ছে তো বাড়ছেই বাড়তে বাড়তে অত বড়ো গ্যারেজের মেঝে প্রায় পুরোটা ঢেকে গেল
ইতিমধ্যে কালু মাঝে মাঝে ইষ্টপদর রান্নাঘরে যায় সেখান থেকে পানীয় জল, ভালোমন্দ খাবার এইসব নিয়ে আসে বুদ্ধি করে সাবান, মাথার তেল, আরএকটা নতুন তোয়ালেও নিয়ে এসেছিল গুনগুন কি এতদিন চান না করে থাকবে নাকি?
তিনদিনের দিন সকালবেলায় হঠাৎ বেলেঘাটা মেন রোডের দিক থেকে অনেক গাড়িঘোড়ার আওয়াজ পাওয়া গেল সামনের রাস্তা থেকে লোকজনের গলার আওয়াজও ভেসে আসছিল সাবমেরিন, কালু আর গুনগুন তিনজনেই যখন ভারী অবাক হয়ে ভাবছে ব্যাপারটা কী, তখনই সাবমেরিনের ড্যাশ-বোর্ডে লাগানো রেডিওটা বেজে উঠল কী ব্যাপার? না, আজ থেকে করোনা-বিধি শিথিল করা হয়েছে তাই লোকজনও রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে
রেডিওর আওয়াজ একটু পরে থেমে গেল মনে হয় ব্যাটারির যেটুকু চার্জ অবশিষ্ট ছিল, সেটুকুও ফুরিয়ে গিয়ে থাকবে ওরা তিনজনেই চুপ করে বসেছিল একটু বাদে সাবমেরিন তিতিবিরক্ত স্বরে বলল, “বেরুক গে রাস্তায় লোক আমি আজই গভীর রাতে একবার অন্তত আকাশে উড়ে নেব এত সুন্দর ডানার ব্যবস্থা করে দিলেন মহারানি, আর সেটা একবারও ব্যবহার করব না?
কালু বা গুনগুন ওর কথার কোনো উত্তর দিল না ওদেরও মনখারাপ লাগছিল তাছাড়া আরেকটা চিন্তাও ওদের মাথায় ঘুরছিল এই তিনদিন ফাঁকায় ফাঁকায় তো বেশ ভালোই কাটিয়ে দেওয়া গিয়েছিল কিন্তু এবার লক্ষ লক্ষ লোক কলকাতার রাস্তায় বেরিয়ে পড়বে একটা ফুটফুটে সুন্দর বাচ্চা মেয়েকে ডানাওয়ালা কুকুর নিয়ে কলকাতার রাস্তায় ঘুরতে দেখলে কী গণ্ডগোলটা যে বাধবে সে ওরা ভেবেই কূল পাচ্ছিল না
হঠাৎ সাবমেরিন চেঁচিয়ে উঠল, “এই রে!
“কী হল? গুঞ্জামালা আর কালু দু’জনেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠল
সাবমেরিন বলল, “জনকরাম আর লক্ষ্মণ এদিকেই আসছে দেখছি ওই দেখো, ওরা গ্যারেজের গেটের বাইরে এসে দাঁড়াল এবার ভেতরে ঢুকবে
গুনগুন বলল, “কালু আমরা কোথায় লুকোব রে? কিছু একটা বুদ্ধি বার কর শিগগিরই
কিন্তু ওদের আর বুদ্ধি-টুদ্ধি কিছু বার করতে হল না ঠিক যখন দরমার গেটটা খুলে জনকরাম ভেতরে পা দিল, তখনই একটা রুপোলি হাওয়া কোথা থেকে এসে গুনগুন আর কালুকে উড়িয়ে নিয়ে চলে গেল সেই সঙ্গেই উড়ে গেল সাবমেরিনের সেই বিশাল ডানা
জনকরাম ভেতরে ঢুকে বলল, “গ্যারেজের ভেতরে এমন সব সুখাদ্যের গন্ধ ছাড়ছে কেন রে লক্ষ্মণ? তুই এখানে বসে লুকিয়ে লুকিয়ে লুচি-টুচি খেতিস নাকি?

*                   *                   *

কাঞ্চনপুরের আকাশে তখন সবে সন্ধে নেমেছে রাজকন্যা গুঞ্জামালা আর তার পোষা কুকুরছানা কালু রাজবাড়ির ছাদে এসে নামল
গুঞ্জামালা বলল, “ব্যাপারটা কী হল বল তো কালু! তিনদিন তো দূরের কথা, আমি তো তিনঘণ্টাও গান বন্ধ করিনি তাহলে শাপমোচন ঘটল কীভাবে?
কালু বলল, “ইয়োহিপ্পাসের অভিশাপটা তুমি ঠিকঠাক মনে করতে পারছ না উনি বলেননি যে, তোমাকে তিনদিন গান বন্ধ রাখতে হবে বলেছিলেন, তিনদিন অন্য কোনো মানুষ গান না শুনলেই তুমি আবার কাঞ্চনপুরে ফিরে আসতে পারবে
গুঞ্জামালা চোখ গোল গোল করে বলল, “তাই তো! গত তিনদিন ধরে আমার গান তো শুনেছিস কেবল তুই আর সাবমেরিন তোরা তো কেউ মানুষ নোস
কালু বলল, ‘ভেউ
গুঞ্জামালা অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাল ব্যাটা বাংলা না বলে আবার কুকুরের ভাষা বলছে কেন? কালুর দিকে তাকিয়ে আরওই অবাক হয়ে গেল গুঞ্জামালা কালু যে শুধু মানুষের ভাষায় কথা বলার ক্ষমতাই হারিয়ে ফেলেছে তাই নয়, ওর পিঠ থেকে ডানাদুটোও অদৃশ্য হয়ে গেছে
গুঞ্জামালা আরেকবার ওর পিঠে হাত রেখে সেই ডানা গজানোর গানটা গাইবার চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না দেখল, সেই গানটাও ওর মাথার মধ্যে কেমন করে যেন হারিয়ে গেছে
----------
ছবি - অতনু দেব