হরিরামের বন্ধু
সঙ্গীতা দাশগুপ্ত রায়
হরিরাম কুমোর বড্ড সরল সাধাসিধে। এতটাই সরল যে লোকে তাকে বোকা বলে। শুধু লখাইয়ের মা বলে, “আমাদের হরি মোটেই বোকা নয়। ভালোমানুষ সে। খামোখা ওকে বোকা বলিস কেন?” কিন্তু শেষে একদিন সেও স্বীকার করল হরিরাম বড্ডই বোকা।
হয়েছে কী, হরির জ্ঞাতিভাই রাজারাম পাশের গাঁ থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে এসে বলল, “দাদা গো, বউ বাচ্চা নিয়ে সে গাঁয়ে আর থাকা গেল না। গেলবার বন্যাতে ঘর ভাসিয়ে দিয়েছিল। তাই ভাবলাম এবার বর্ষার আগে নিজের গাঁয়েই ফিরে যাই। তো এসে দেখি গাঁয়ের শেষে বাপের সেই ভিটে পোড়ো হয়ে গিয়েছে। কোনোরকমে একখানা ঘর দাঁড়িয়ে। সদরে দরজা নেই, তিনদিকে জংলা ঝোপ। ওসব কেটে গুছিয়ে সারিয়ে তুলতে সময় লাগবে। তদ্দিন তোমার ঘরে যদি ঠাঁই দাও তো বাঁচি।”
সম্পর্কে ভাই রাজারাম। সে থাকবে এ তো আনন্দের কথা। হরিরাম ভারী খুশি হয়ে আপ্যায়ন করেই রাখল তাদের। তার নিজের বলতে কেউ নেই। একলা মানুষ সকাল থেকে মাটি ছানে, পুতুল গড়ে, চাকে বসে কলসি, হাঁড়ি, সরা, ভাঁড় বানায়। মাটির জিনিসের খরিদ্দার মন্দ না। তার ওপর এ হল কৃষ্ণভক্তদের গাঁ। রাস, ঝুলন, দোলের মেলা লেগেই আছে। মেলাতে মাটির পুতুল বেশ বিকোয়। মানুষটিও সে আলাপী। কাজ করতে করতে পথ দিয়ে আসা যাওয়া লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে। ঘরের লাগোয়া উঁচু ধাপিতে বাঁশের মাচা করে রেখেছে। বয়স্ক লোকজন এসে বসে গল্পগাছা করে। কৃষ্ণনাম গায় কেউ কেউ। দিব্যি দিন কেটে যায়। তবে এখন যখন ভাই এসে জায়গা চাইছে, তাকে না করল না হরিরাম। বরং বড়ো ঘরখানা সে তাদের জন্যেই ছেড়ে দিল। তিনটি ছোটো বাচ্চা, বউ, এদের একটু জায়গা তো লাগবেই। ছোটো পাশের ঘরটিতে গিয়ে মাটিতে বিছানা পাতল সে।
ছোটো ঘরটা আসলে তার পুতুলের কারখানা। পুতুল গড়া থেকে শুরু করে সেগুলো শুকিয়ে তোলা, রং তুলি দিয়ে সাজিয়ে নেওয়া সব ওই ঘরে। বাকি যা হাঁড়ি, সরা, মালসা তৈরি করে সেও পুড়িয়ে ব্যবহারের যুগ্যি হলে ওই ঘরেই সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে। জিনিসে ঠাসা ঘরটা। তাও তার মধ্যেই নিজের জন্য একটু জায়গা করে নিল হরিরাম।
কিন্তু দেখা গেল ভাইয়ের বাচ্চাগুলো বড়ো দুরন্ত। খেলতে খেলতে রোদে দেওয়া হাঁড়ি সরার ওপর পড়ে সব ভাঙে কিংবা দুষ্টুমি করে পোড়ানো পুতুলগুলোর গায়ে মুখে কালো রং করে ভূত বানিয়ে দেয়। হরিরাম দেখে, হাসে, ভাবে আহা নিজের ছেলেপুলে হলেও তো এমনই দুষ্টুমি করত। কিন্তু বার বার হাতে গড়া জিনিস নষ্ট হলে কাঁহাতক আর সহ্য করা যায়! একদিন হরি একটু বকেই উঠেছে। সেদিন খেতে বসে দেখা গেল শুধুই ভাত রান্না হয়েছে। আর কিচ্ছু না। ছেলেপুলেকে বকার দুঃখে তাদের মা ঘরে গিয়ে খিল দিয়েছে। হরিরাম গাছ থেকে দুটো লঙ্কা পেড়ে নিল, তারপর নুন লঙ্কা মেখে ভাতটুকু খেয়ে উঠে আবার ভাঙা পুতুলগুলোকে এক্কেবারে ভেঙে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে নতুন পুতুল গড়তে বসল। মাটির জিনিস একবার ভাঙলে আর মেরামত হয় না। ও এক্কেবারে ভেঙে নতুন করে গড়তে হয়।
কিন্তু এত চুপ থেকেও শেষরক্ষা হল না। বর্ষা এল। কুমোরের বাড়িতে বর্ষা এলেই ঢাকাঢুকি তোড়জোড় শুরু হয়। ছোটো ঘরখানা, যেটায় হরিরাম শুচ্ছিল, সেখানেই সব মাটি তুলে রাখতে হবে এবার। আর তো ওই ঘরে থাকা যায় না। হরিরাম ভাইকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, গাঁয়ের শেষে তার সেই ভাঙা ঘর সারানো হয়েছে কিনা।
কিন্তু কথাটা পাড়তেই রাজারাম মাথা চুলকে বলল, “হাতে তেমন টাকা পয়সা তো নেই দাদা যে ঘরদোর সারাব। পুরোনো ভাঙা বাড়ি। তাতে চতুর্দিকে গাছপালা ঘিরে জঙ্গল বেঁধে ফেলেছে। সেখানে বউ বাচ্চা নিয়ে গিয়ে ফেলা কি ঠিক হবে? দুপুর থাকতেই সন্ধে নামে ওখানে। ছেলেপুলেগুলো অন্ধকারে ভয়েই মরবে। ওই বাঁশবন আর বাদা পেরিয়েই শ্মশান। শেয়ালেরও উৎপাত ভারী। কোনদিন হয়তো দাওয়ায় শোয়ানো কোলের খোকাটাকেই মুখে করে তুলে নিয়ে গেল! কী সর্বনাশ হতে পারে ভাবো তো। তার চেয়ে তুমি একা মানুষ। ওখানে থাকলেও ঝক্কি নেই কোনো। দাও দাদা, তোমার ঘরখানা আমাকে দাও আর আমার বনের ধারের ঘরখানা তুমি নিয়ে আরাম করে থাকো।”
হরিরাম নেহাত ভালোমানুষ, তাই কিছু বলেনি, নইলে এত হট্টগোল তারও অভ্যেস নেই সে তো সত্যিই। এভাবে থাকা তার পক্ষেও অসম্ভব। আবার ভাইয়ের কথাও ঠিক। অমন জায়গায় হয়তো বিপদই হবে ছোটো ছেলেপুলে নিয়ে।
নিরুপায় হরিরাম রাজি হয়ে গেল! লোককে বলল, “আহা ভাইটার তো বড়ো সংসার। বউ বাচ্চা নিয়ে ওই জংলা জায়গায় থাকতে পারে? আমি ঝাড়া হাত পা মানুষ, মাটি ঘেঁটে দিন কেটে যায়। রাতে একটু শোয়ার মতো ছোটো ঘর হলেই চলে, সে গাঁয়ের ভেতরেই কী আর বাইরেই কী।”
শুনে হরিরামের প্রাণের বন্ধু লখাই তো এই মারে কী সেই মারে। বলল, “তোর বুদ্ধি বলিহারি! এই ঘর তোর গাঁয়ের এক্কেবারে মাঝমধ্যিখানে। লোকে যেতে আসতে দাঁড়িয়ে বাচ্চাদের পুতুল কেনে, বাড়ির বউ-ঝিরা এসে মাটির সরা হাঁড়ি কিনে নিয়ে যায়। এখন তুই গাঁয়ের শেষের শ্যাওড়া গাছের নিচে ঘর বসালে কে যাবে জিনিস কিনতে?”
হরিরাম মাথা নাড়ে, “না না, আমার বাঁধা খদ্দের। আসবে ঠিক। তা ছাড়া জিনিস নিয়ে তো বাজারেও বসতে পারি।”
কিন্তু কাজের সময় দেখা গেল লখাই-ই ঠিক। দিন যায়, সপ্তাহ গিয়ে মাস ঘুরতে চলল, কিন্তু ওই পোড়ো বাড়ির জঙ্গুলে আস্তানায় কেউ যায় না।
আগে যাতায়াতের পথে পড়ে বলে বাড়ির সামনে লোকে ছেলেপুলে নিয়ে দাঁড়াত, পুতুল নিত। কেউ আবার কুটুম বাড়ি যাচ্ছে, দুটো পুতুল কিনে বলত ভালো করে মুড়ে দাও হরিদাদা, ট্রেনে চড়ে যাবে অনেকদূর। তেমন লোক এখানে কোথায়! এ পথ দিয়ে যাতায়াত কেবল শ্মশান ফিরতি মানুষের। তারা কেউ কেউ দাঁড়িয়ে মালসা, হাঁড়ি এসব কিনে নিয়ে যায়। অশৌচে লাগে ওসব। ওইটুকুই বিক্কিরি।
তবু আশা ছাড়ে না হরিরাম। বড়ো আদর করে সে মাটির বউ, কেষ্ট ঠাকুর, ছোট্ট গোপাল, নাচনেওয়ালি ঘাঘরা পরা মেয়ে বানায়। পেটমোটা গোপালভাঁড় বানায়। তার হাতে আবার ছোট্ট রসগোল্লার হাঁড়িও ঝুলিয়ে দেয়। ছোটো প্লেটের ওপর সাজানো মনোহারি মিষ্টি, পুঁচকি পুঁচকি কলা আপেল সন্দেশ সাজায়। বানায় হোঁতকা মোটা গলায় গামছা জড়ানো বাবু হয়ে বসে থাকা লোক। এসব জিনিস আগে বানালেই বিক্কিরি হয়ে যেত। ছোটো খুকুরা ওই মোটা লোক কিনত খুব! আর মিষ্টি, ফলের ডালাও। দেখলেই কিনবে। ঝুলনে ফলওয়ালা, মিষ্টির ব্যাপারী সাজাবে। হরিরাম কত সময় এক দুটো পুতুল বিনে পয়সাতেও দিয়েছে। হাসিমুখ দেখার আনন্দ ছিল কত তখন। সে আনন্দ বুঝি জীবন থেকে হারিয়েই গেল। মনমরা হয়ে বসে থাকে হরিরাম।
দিন যায় এইভাবেই। যে ক’টা টাকা ছিল সেও শেষ। ভাবে বাজারে যাবে পুতুল নিয়ে। কিন্তু বাজার বহুদূরের পথ। যদি বৃষ্টি আসে! তাছাড়া তার বয়সও হয়েছে। ঝাঁকা মাথায় নিয়ে হাঁটার ক্ষমতাও নেই অতখানি। একা দাওয়ায় বসে হরিরাম চোখ মোছে। কাজটা সে বড়ো ভুলই করেছে বুঝতে পারে এখন!
ক’দিন হল কোত্থেকে একটা কুকুর জুটেছে। পায়ে পায়ে ঘোরে। হরিরাম তাকে নানকা বলে ডাকে। কুকুরটার সঙ্গেই বকবক করে। বলে, “বুঝলি নানকা, বিশ্বাস করে ঠকা ভালো বলে লোকে। কিন্তু ঠকে যাওয়া ভালো না রে। একদম ভালো না।”
নানকা কী বোঝে কে জানে। ভুক ভুক করে কাছে আসে, ওর ফাটা পা জিভ দিয়ে চেটে আরাম দেওয়ার চেষ্টা করে। হরিরাম উঠে কাঠকুটো জড়ো করে আগুন ধরায়। আলু পুড়িয়ে নিজে খায়। নানকাকেও দেয়।
লখাই মাঝে মাঝে আসে। অনেকটা রাস্তা পেরিয়ে আসতে হয়। তাও আসে। হাতে করে একটা পাউরুটি, দুটো নাড়ু নিয়ে আসে। বলে, “আয় দু’জনে মিলে খাই।” কখনও বলে, “চল তুই আমার সঙ্গে। গাঁয়ের পাঁচজনে গিয়ে হাঁকার দিলে দেখি কেমন তোর ঘর না ছাড়ে!”
হরিরাম মাথা নাড়ে। “না না। ভাইয়ের সঙ্গে লড়তে পারব না।”
“তাহলে গাধার মতো মর এখানে।” লখাই দুমদাম পা ফেলে চলে যায়।
হরিরাম নানকাকে বলে, “পিছনের ভেরেন্ডার ঝোপটা সাফ করব, বুঝলি? তারপর মাটিটা ভালো করে কুপিয়ে খানিক কচু আলু বসিয়ে দিলে খাবার আর কী চিন্তা!” বলতে বলতে সে পুতুলগুলোর গায়ে হাত বোলায়। ওদের সঙ্গেও বকবক করে। বলে তোদের জন্য নতুন ঘর দিতে পারলাম না। এই ভাঙা অন্ধকার ঘর আর নোংরা দালানে থাকাই তোদের কপালে ছিল। গোপালভাঁড়কে হাতে নিয়ে নিজেই হাসে। বলে তোমার রসগোল্লার হাঁড়ি থেকে যদি দুটো দাও তো খাই গোপাল দাদা। বকবক করতে করতে ঢুলুনি এসে যায়। বর্ষাকালে জঙ্গলে কখন যে রাত নেমে আসে বোঝা যায় না।
লখাই আজ বড্ড রেগে চলে গেল। একমাত্র ওই-ই তো তাকে মনে রেখেছে। ও যেদিন আসে সেদিন যত রাগারাগিই করুক, হরিরাম তবু হাসিমুখে কিছুক্ষণ কাটায়। রাজারামের বদলে লখাই যদি তার ভাই হত তো বেশ হত। সাতপাঁচ এইসবই ভাবছিল হরিরাম। হঠাৎ মনে হল বাইরে যেন পায়ের আওয়াজ হচ্ছে। শেয়াল ঘুরছে হয়তো। বাইরে ঝুড়িতে রাখা আছে তার পুতুলগুলো। ভাঙলে লোকসান। এক হাতে কুপি আর এক হাতে লাঠি নিয়ে হরিরাম বাইরে গিয়ে দাঁড়ায়। বটগাছের পাতার ফাঁক দিয়ে একটু চাঁদের আলো এসে পড়ছে। কোথাও শেয়াল-টেয়াল কিছুই নেই। হরিরাম এদিক ওদিক দেখে আবার ঘরে ঢুকতে যাচ্ছিল, হঠাৎ একটু খুকখুকে কাশির আওয়াজ কানে আসে। কাণ্ড দেখো। এই অন্ধকারে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে লখাই আবার ফিরে এসেছে। অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না তেমন, তাও হরিরাম আন্দাজেই ডাকে, “আয় লখাই, শুদুমুদু রাগ করে চলে যাচ্ছিলি!”
ওদিকে নানকা নেভা উনুনটার গা ঘেঁষে শুয়েছিল। সে হঠাৎ লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে চেঁচাতে লাগল।
হরিরাম একটা দাবড়ানি দিল কুকুরটাকে। “মানুষ চিনতে কদ্দিন লাগে রে? আমার বন্ধু লখাই। ওকে চিনিস না নাকি?”
“আমি লখাই নই বাপু,” বলতে বলতে একটা বুড়ো মতো লোক এগিয়ে আসে আর একটু।
হরিরাম হাঁক দিল, “কে ওখানে?”
“আমি হে। কুকুরটাকে থামানো যায় না?”
উত্তর দিতে গিয়ে হরিরামের একটু ভয়ই লাগে। লোকটার গায়ে মোটা চাদর, মাথাও ঢাকা। মুখখানা ভালো দেখতে পাচ্ছে না এত দূর থেকে। নাহ্, বাইরেও একটা আলোর ব্যবস্থা করতে হবে মনে হচ্ছে।
নানকা ওর পাশেই দাঁড়িয়ে তারস্বরে চিৎকার করছে। হরিরাম ওর মাথায় হাত দিয়ে বলে, “থাম্ নানকা। চুপ কর্।”
লোকটা দু-পা এগিয়ে আসে আরও, “ব্যস্ত নাকি ভায়া?”
এবার হরিরাম ভালো করে নজর করে। আহা রে, কেমন মরা মরা চোখ। কালি মারা মুখ। যেন কতদিন ঘুমোয়নি। ভাবে কোনো খদ্দের হবে হয়তো। তাড়াতাড়ি একমাত্র ভাঙা টুলটাই এগিয়ে দেয়। মুখে বলে, “না না, ব্যস্ত কীসের। আসুন আসুন। কিছু নেবেন? হাঁড়ি পাতিল সরা খুরি সব আছে। পুতুলও আছে অনেক রকম। বাড়ির খুকু খোকাদের জন্য নেবেন? দেখাব?”
লোকটা ভাঙা টুলখানায় বসে। দিব্যি কায়দা করে বসেছে। লখাই যতবার বসে একদিকে হেলে যায়।
লোকটা আবার একটু গলা খাঁকরে নিল। তারপর বলল, “না হে কিছুই লাগবে না। একা একা পড়ে থাকি। কিছুদিন ধরেই দেখছি তুমিও একা মানুষ। তাই আলাপ করতে এলাম।”
হরিরাম নিশ্চিন্ত হয়। প্রতিবেশী তার মানে। বলে, “তা ভালো করেছেন। কাছেই থাকা হয় নাকি?”
“হ্যাঁ ওই তো, ভ্যারেন্ডা ঝোপের ওদিকটায়,” বলেই ঘং ঘং করে কাশতে শুরু করে।
তাড়াতাড়ি একটু জল এগিয়ে দেয় হরিরাম।
লোকটা হাত নাড়ে। লাগবে না। তারপর আবার কথা শুরু করে, “ঘরে লোকজন তো দেখছি না!”
“আজ্ঞে না। ঘরে কেউ নেই। একা মানুষ। আগে গাঁয়ের মধ্যেই থাকতাম। এ আমার জ্ঞাতির ঘর। তার ছেলে এসে বলল দাদা আমাকে তোমার ঘরটা দাও আর তুমি আমার ঘরটা নাও। এদিকটায় লোকজন নেই তেমন। বউ বাচ্চারা থাকতে ভয় পাবে। তাই নিজের ঘরটা তাদের দিয়ে আমি এখানে এসেছি। তবে এসে বুঝেছি বাচ্চাদের দোষ নেই। ভয় একটু লাগেই,” হাসল হরিরাম।
“ভয় কীসের? ভূতের না চোরের?”
“আজ্ঞে ভূতের। গরিবের সংসারে চুরির আছেই বা কী?”
“মানুষ নিজের আস্ত হাত পা মাথা থাকতেও হাওয়ায় ভাসা ভূতকে কেন এত ভয় পায় কে জানে,” লোকটা খিক খিক করে হাসল।
হরিরাম মাথা চুলকোয়। কথা খুঁজে পায় না। শেষে বলে, “ঘরে একটু চা অবধি নেই। থাকলে এই বর্ষায় গুড় দিয়ে খেতে দিব্যি লাগত। কী বলেন?”
লোকটা মাথা নাড়ে। “চা? আহা সে ভারী ভালো জিনিস। খুব খেতাম আগে।”
হরিরাম ভাবে এও হয়তো তার মতোই গরিব। সত্যি গুড় দিয়ে বানানো চা দিব্যি লাগে। হরিরামের নাকে ফোটানো গুড়-চায়ের গন্ধ ভেসে এল হঠাৎ।
লোকটাও তেমন কথক নয়। চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে। হরিরামই আবার কথা শুরু করে। গ্রামে থাকতে সে সবার ভালোমন্দ খোঁজ নিত। এখনও সে স্বভাব আছে। জিজ্ঞেস করল, “বাড়িতে কে আছে আপনার?”
লোকটা বলল, “বাড়িতে আছে হয়তো সবাই। কে জানে। সেই কবে এসেছি। আর যাওয়া হল কই।”
“এই যে বললেন এইখানে বাড়ি?” হরিরাম অবাক হয়।
লোকটা বলে, “এখানে থাকি বললাম তো।”
হঠাৎ ভারী ঠান্ডা হাওয়া দেয়। চাঁদটাও গিয়েছে মেঘে ঢেকে। এ লোকটার নাম কী কে জানে। হাতে টর্চও নেই একখানা। এই অন্ধকারে বাড়ি ফিরবে কী করে? সাপখোপ বেরোয় এ সময়।
লোকটা আচমকা নিজে থেকেই বলে, “আমার নাম চরণদাস। তবে আমাকে সাপখোপে কামড়ায় না। ভয় নেই ওসবের। রাত হল। উঠি। এখানে একা একা থাকি। কথা বলার লোক নেই। মন টেঁকে না। তাই একটু এলাম।”
আরে! লোকটা কি মনের কথা পড়তে পারে নাকি! কেমন বুঝে ফেলল!
আহা চেনা নেই জানা নেই তো কী হয়েছে? তারই মতো একলা মানুষ। বসুক না হয়।
হরিরাম কথা বলতে চায় একটু। বলে, “চরণদাস? বাহ্ বেশ নাম। অনেকদিন আছেন বলছেন এখানে। তা পরিবার নিয়ে আসেননি কেন? নাকি তারাও আমার ভাইয়ের মতোই আসতে চায় না?”
লোকটা হাসে। বলে, “আমার কথা থাক। তুমি যে এখানে এসেছ তোমার কেমন লাগছে তাই বলো।”
হরিরাম মাথা চুলকোয়। বলে, “আজ্ঞে ভালো লাগার তো উপায় থাকেনি। বিক্রিবাটা করার মতো মানুষই নেই কোত্থাও। এদিকে ঘরে আমার পুতুল থই থই করছে। মাটির কাজ করি বাবু। দু’দিন বিক্কিরি না হলে তিনদিনে হাঁড়ি চড়ে না।”
লোকটা বলে, “গাঁয়ে গিয়ে ফেরি করতে পারো তো?”
হরিরাম করুণ হাসে। বলে, “বুড়ো হয়ে গেছে বাবু পা দুটো। মাথায় করে পুতুল নিয়ে ঘোরা আর পারি কই? ঘরে শক্ত সমর্থ ছেলেপুলে থাকলে তাদের বলতাম বাজারে দোকান দিতে। আমার তো বাড়ির মধ্যেই দোকান ঘর ছিল বাবু। সব খোয়ালাম বুদ্ধির দোষে। লোকে ঠিকই বলে। আমি বড্ড বোকা।”
লোকটা একটু চুপ করে তাকিয়ে থাকে। কী যেন ভাবে। তারপর বলে, “কই তোমার পুতুল কেমন দেখি।”
খুব উৎসাহ ভরে হরিরাম কয়েকটা পুতুল দেখায়। বলে, “এই যে বাবু আমার হাতের কেষ্ট ঠাকুর, গৌরাঙ্গ, জগন্নাথেরা তিন ভাই বোন। এই দেখুন সবজিওয়ালি মা আর মেয়ে, তক্তপোশে বসা ব্যাপারী মুদি। এই ইস্কুলে যাওয়া খোকা খুকু। এই দেখুন কাঠুরে মাথায় বোঝা নিয়ে চলেছে। সব রকম পুতুল বানাতাম। বিক্কিরিও খুব ছিল বাবু। রাস ঝুলনে দোকান খালি হয়ে যেত আমার। ওই বাড়ি আমার পয় ছিল বাবু। সব খোয়ালাম বিশ্বাস করে।”
হরিরাম নিজের মনে বকে চলে। লোকটা ওসব কথা শোনে কিনা বোঝা যায় না। ঝুড়ি কাঁখে সবজিওয়ালি দেখে হাসে, বলে, “বাহ্, একদম সত্যিকারের আনাজের মতো বানিয়েছ তো!” মুদিকে হাতে নিয়ে বলে, “একদম নিতাই মু্দির চেহারা।” কাঠুরেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলে, “কাজ তোমার সত্যি ভালো হে। এমন পুতুল লোকে শো-কেসে সাজিয়ে রাখার জন্য কেনে।” বই হাতে ছেলেমেয়ে পুতুল জোড়া তুলে অনেকক্ষণ চুপচাপ দেখে লোকটা।
হরিরাম বলে, “ইস্কুলের খোকাখুকুরা বাড়ির সামনে দিয়েই রোজ যেত। ওদের দেখেই বানিয়েছিলাম বাবু।”
লোকটা মাথা নাড়ে। বলে, “হ্যাঁ, দেখে আমার ইস্কুলের ছেলেমেয়েগুলোর কথা মনে পড়ল।”
“আপনার ইস্কুল আছে বুঝি?” হরিরাম অবাক হয়।
লোকটা হাতের পুতুলগুলো রেখে দেয়। বলে, “আমার ইস্কুল না। যেখানে আমি পড়াতে এসেছিলাম সেই ইস্কুলে।”
হরিরাম বোঝে লোকটা এখানকার ইস্কুলের মাস্টার।
“বেশ পুতুল তোমার। ওই সবজিওয়ালি মা আর খুকু তো খুব সুন্দর,” বলে উঠে দাঁড়ায় লোকটা। টুক টুক করে দাওয়া থেকে নামে। তারপর বলে, “যাই। আবার আসব ’খন তোমার যদি অসুবিধা না হয়।”
লোকটা চলে যেতে পুতুলগুলো ঝুড়িতে তুলে চাপা দিয়ে ঘরে এসে শোয় হরিরাম। এই তো একজন কথা বলার সঙ্গী পাওয়া গেল। মাস্টার মানুষ। অনেক জ্ঞানের কথাও জানে নিশ্চয়ই। ঠাকুর দেবতার কথাও। এসব কথা শুনতে ভারী ভালোবাসে হরিরাম। ভাবে লখাই এলে চরণদাসের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে হবে। জ্ঞানীগুণী সঙ্গ করলে রাগটা একটু কমবে ওরও। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে হরিরাম।
জঙ্গলে আলো কম, মানুষ নেই, কিন্তু পাখি খুব আছে। ভোর না হতেই তাদের আওয়াজে ঘুম ভাঙে রোজ। হরিরাম দরজা খুলে বাইরে আসে। বাড়ির হাতায় বিরাট বট গাছ একখানা। পাখিগুলো লাফালাফি করে বটফল খায়। পাখির কিচিরমিচিরের সঙ্গে নানকাও ঘেউ ঘেউ করে সুর মেলায়। হরিরাম নিমডাল হাতে নিয়ে চিবোয় খানিক। কুয়োর জল অনেকটা ওপরে উঠে এসেছে বৃষ্টিতে। পুরোনো কুয়ো অনেক। যখন এসেছিল তখন গা-ময় শ্যাওলা। বড়ো বড়ো বুক সমান ঘাসে ঢেকে গেছিল ভাঙা পাড়টাও। সে সব এখন একদম পরিষ্কার করে ফেলেছে হরিরাম। এখন বর্ষায় দুটো সোনা ব্যাঙ লাফিয়ে ঘোরে। নানকা ওদের দিকে ফিরেও তাকায় না। হরিরাম ভাবে হয়েছে বেশ। কুকুর ব্যাঙ পাখি নিয়েই জীবন কাটিয়ে দেবে বরং। অভ্যেসও হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। দাঁতন সেরে মুখ ধোয়। তারপর দা-খানা হাতে নিয়ে বাড়ির পিছনের ভেরেন্ডা আর কাঁটাঝোপের দিকে এগোয়। বাড়িখানা রহনসই করার কথা কাল থেকে মনে হচ্ছে বার বার। কিছুক্ষণ এলোমেলো ঝোপঝাড় কাটে। তারপর জমাট আগাছা কিছুটা হালকা হতেই হরিরাম অবাক হয়ে দেখে বিশ ত্রিশ হাত দূরেই আর একটা বাড়ি। এত ঠাসা আগাছার বন যে চোখেই পড়েনি ওটা আগে। বাড়িটার জানলা দরজা কিছু নেই। দেয়াল ভেঙে পড়েছে এদিক ওদিক। ভেতরে কেউ আছে বলে মনে হয় না। অদ্ভুত ব্যাপার! শুনশান একটা পোড়ো বাড়ি এই ঠাসবুনোট ঝোপের পিছনে ছিল সে বুঝতে পারেনি এদ্দিন! চোখের নজর বেশ কিছুদিন হল তেমন জোরালো নেই আর। ভালো করে দেখবে বলে আর একটু এগোয় হরিরাম। কাছাকাছি গিয়ে বুঝতে পারে বাড়িটা আপাদমস্তক পোড়ো। সামনের যেটুকু এখনও খাড়া আছে তার গায়ে লেখা ‘অবৈতনিক বিদ্যালয়’। অবৈতনিক কথাটার আগেও কিছু লেখা ছিল হয়তো। সেদিকটা ভেঙে গেছে একদম। হরিরামের হঠাৎ মনে পড়ে চরণদাসও তো মাস্টার। সে এলে জিজ্ঞাসা করবে এই ইস্কুলের কথা।
পায়ে পায়ে বাড়ি ফিরে আসে হরিরাম। কিন্তু বাড়ির হাতায় ঢুকেই থমকে যায় তখনই।
একটা বউ ঢুকে পড়েছে কখন। সঙ্গে আবার একটা মেয়েও। বউটার মাথায় ঘোমটা। কাঁখে সবজির ঝুড়ি। দু’জনের কেউই যেন ওকে দেখতে পায় না। বউটা দাওয়ায় ঝুড়ি নামিয়ে রাখে। মেয়েটা সবজিগুলো গুছিয়ে রাখে নেভা উনুনটার পাশেই।
হরিরাম চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করতে যায়, কে তোমরা? গলা দিয়ে একটু আওয়াজ বেরোয় না।
কারা এরা? মুখগুলো চেনা চেনা লাগছে। গাঁয়ের কেউ কি? লখাই পাঠিয়েছে? গলাটাই বা এমন আটকে আছে কেন? আর ওরাও এমন ভাব করে জিনিস গুছিয়ে চলে যাচ্ছে যেন হরিরাম অদৃশ্য।
ওরা চলে যাওয়ার পরেও অনেকক্ষণ হরিরাম চুপ করে বসেই থাকে। নানকাও কোথায় ছিল কে জানে এতক্ষণ। লেজ নাড়তে নাড়তে ঢোকে একসময়। হরিরাম ওকেই বকা দেয়। “কোথায় ছিলিস?”
ওমা! এই তো দিব্যি গলা খুলে গেছে।
হরিরাম ধীরে ধীরে ওঠে, উনুনে আগুন জ্বালায়। মাটির হাঁড়িতে সবজি সেদ্ধ করে। তারপর নুন দিয়ে মেখে খেতে খেতে ভাবে হয়তো লখাই নয়, ওই চরণদাসবাবু লোকটাই পাঠিয়েছে এদের। কাল হরিরাম ঝোঁকের মাথায় অনেক কিছুই বলেছে। ঘরে যে একটা দানাও নেই তাও বলেছে হয়তো কথার তোড়ে। সেই-ই হয়তো পাঠিয়ে দিয়েছে এদের।
ভাবতে ভাবতে পেট ভরে খায় হরিরাম। নানকাকে বলে, “খাবি?”
নানকা উত্তর দেয় ভুক ভুক।
হরিরাম মাথা নাড়ে। “ঠিক বলেছিস। বড়ো ভুখ, বড়ো ভুখ। আয়, খা আমার থেকে।”
সন্ধের মুখে চরণদাস আসে। সেই খুক খুক কাশি। হরিরাম বলে, “আসুন আসুন চরণদাদা। কাশি তো বেশ হয়েছে দেখছি। ওষুধ-বিষুধ খাচ্ছেন?”
লোকটা মাথা নাড়ে। বলে, “এ কি ওষুধে সারার রে বাপু? গলায় ধোঁয়া ঢুকে থেকে এই কাশিই শুধু।”
হরিরাম বলে, “বসুন। একটু গরম জল খাবেন? কমবে হয়তো খুকখুকুনি।”
লোকটা একটু হাসে। বলে, “থাক বাপু। এ কাশি যাবার নয়।”
হরিরাম আসল কথাটা পাড়ে। বলে, “আপনি যে সবজি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, সেই সবজিতেই আজ পেট ভরেছে আমার কত্তা। কিন্তু আপনি খামোখা ওসব পাঠাতে গেলেন কেন?”
লোকটা হাসে। বলে, “বোকা মানুষের এত কথায় কাজ কী হে? যাক, কাল তোমার সব পুতুল সেভাবে দেখা হয়নি। দেখাও দেখি আজ আর একবার।” লোকটা আগ্রহ দেখায়।
পুতুলের কথা কেউ তুললে হরিরাম বিগলিত হয়ে পড়ে খুশিতে। সঙ্গে সঙ্গে ঝুড়ির ঢাকা খুলে মেলে ধরে। গোপালভাঁড়কে হাতে নিয়ে লোকটা দেখে মন দিয়ে। ছোট্ট হাঁড়িখানায় হাত বোলায়। বলে, বাহ্ রে! তারপর ঝাঁকা মাথায় মাছওয়ালাকে তুলে ছোট্ট ছোট্ট রুপোলি নিখুঁত মাছগুলোর গায়ে হাত বোলায়। বলে, “ভারী নিখুঁত কাজ তোমার হরিরাম। ছোটোদের খেলনা এত নিখুঁত করতে লাগে? কত সময় লাগিয়েছ এসবের পেছনে?”
হরিরাম লজ্জা পায়। বলে, “বহুদিনের অভ্যেস বাবু। জন্ম থেকে এই-ই তো করছি। চোখ বন্ধ করেও এমনিই কাজ করতে পারি।”
চরণদাস বন্দুক হাতে হাঁটু গেড়ে বসা সৈন্য, হলদে চোখের শালিক পাখি, ঝোলা কাঁধে কাগজকুড়ানি, এগুলোও দেখে তবে মন দেয় না। জিজ্ঞাসা করে, “আর কিছু নেই?”
হরিরাম বলে, “আছে, কেষ্ট ঠাকুর, রাধারানি, শীতলা মন্দিরে পুজো দেওয়ার মাটির ঘোড়া, এইসব।”
লোকটা বলে, “এত পুতুল এখানে কেউ কিনবে? বাজারে গিয়ে বসলে তাও বিক্কিরি হয়।”
হরিরাম একটু চুপ করে থাকে। তারপর বলে, “বাজার তো অনেক দূর বাবু। বুড়ো হয়েছি। পায়ের জোর কই আর?”
লোকটা কী যেন ভাবে। শুধু বলে, “হুম।” তারপর যেন হঠাৎ মনে পড়ল এমনি সুরে বলে, “একটা সুন্দর পুতুল বানাও দেখি। আমি যেমন বলছি তেমনি, পারবে? তোমার ওই কাঠুরের মতো সাজোয়ান একটা মানুষ বানাও। মাথায় ঝাঁকাও রেখো।”
হরিরাম বলে, “বেশ তো বাবু। বানাব। কার জন্য নেবেন? কবে লাগবে?”
লোকটা বলে, “বানাও তো। নিজের জন্যই বানাও না হয়। ও হ্যাঁ। আর ওই পিছনের ঝোপ-টোপ কেটে ফেলছ দেখলাম, কেন হে?”
হরিরাম বলে, “কিছুই করার তেমন শক্তি তো নেই বাবু। তাও খানিক সাফাই করলাম। জমি রয়েছে পড়ে। একটু যদি কচু কি কুমড়ো ফলাতে পারি তাতেও পেট ভরে।”
লোকটা হাসে। বলে, “সে তো বটেই।”
“আপনি পিছনবাগের ঝোপ কোথা থেকে দেখলেন বাবু?” হরিরাম জিজ্ঞাসা না করে পারে না।
লোকটা খুক খুক করে কাশে একটু। তারপর বলে, “ওই যে, ইস্কুলের দালান থেকে দেখলাম। যাই এবার।”
দু’পা এগিয়ে আবার পিছন ফিরে বলে, “বর্ষায় উঠোনখানায় বড্ড কাদা জমেছে।”
হরিরাম ঘরে ঢুকে আলো জ্বালে। নানকাও ঢুকে আসে সঙ্গে সঙ্গে। এই পোড়ো বাদাড়ে এই এক নানকাই তার একমাত্র সঙ্গী। হরিরাম বসে বসে খানিক কৃষ্ণনাম করে। মনে পড়ে তার সেই ঘর দুটির বাইরে বাঁশের নিচু মাচায় বসে ভক্তদের কৃষ্ণগানের কথা। মনে পড়ে তাঁদের মুখগুলো। ভাবে একদিন যাবে বৃষ্টিবাদলা একটু কমলে। বসবে মাচাটায় খানিকক্ষণ। চরণদাসকেও নিয়ে যাবে সঙ্গে করে। বলবে সকাল সকাল আসতে। নতুন মানুষ নিয়ে গিয়ে লখাইদের তাক লাগিয়ে দেবে। কিন্তু যাবে কি সে? অদ্ভুত মানুষ চরণদাস! এত পুতুল দেখল, সে সব কিনল না একটাও। অথচ নতুন পুতুলের বরাত দিয়ে গেল। কে জানে কী মনে আছে। যাক, চেয়েছে যখন কাল সকালে উঠেই তার পছন্দমতো পুতুল বানাতে বসবে।
ভোরের দিকে হরিরামের মনে হল সে যেন তার পুরোনো ঘরে শুয়ে আছে। সেখানে শুয়ে শুয়ে বাইরে পথচলা লোকেদের গলা পাওয়া যেত। হঠাৎ কেউ দরজার সামনে দিয়ে দৌড়ে গেলেও টের পেত। এখনও যেন তেমনই মনে হচ্ছে, বাইরে কারা যেন হাঁটাচলা করছে।
প্রথমে ভাবে স্বপ্ন দেখছে নিশ্চয়ই, কিন্তু তারপর পাখির কিচিরমিচির শুনে বোঝে জেগেই শুনছে। তাড়াতাড়ি উঠে দরজা খোলে হরিরাম। বাইরে তাকিয়েই অবাক হয়ে যায়। আলো ফুটছে সবে। আজও সেই বউ মানুষটা একটা ছোটো ঝাঁকায় সবজি নিয়ে এসে দাওয়ায় রেখে চলে যাচ্ছে। বাচ্চা মেয়েটাও চলেছে লাফিয়ে লাফিয়ে। হরিরাম ভাবে, কে পাঠাচ্ছে এসব। যেই-ই পাঠাক, কিন্তু এভাবে ভিক্ষা নেবে কেন সে? চেঁচিয়ে ডাক দিতে চায়। কিন্তু তখনই একটা পেট মোটা ফতুয়া আর ধুতি পরা লোক একটা হাঁড়ি হাতে করে গটগটিয়ে ভেতরে ঢোকে। কোনো দিকে তাকায় না অবধি। চুপচাপ সবজির ঝুড়ির পাশে হাঁড়িটা নামিয়ে দিয়ে চলে যায়। সবজি, হাঁড়ি, কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখে ভাবতে ভাবতে উঠোন ফাঁকা। কেউ কোত্থাও নেই।
কী যেন একটা চিন্তা হরিরামের মাথায় খেলে যায়। নিচু হয়ে হাঁড়িটায় উঁকি দেয়। যা ভেবেছে তাই-ই। হাঁড়ির মধ্যে টুপটুপে রসগোল্লা রসে ভাসছে।
হরিরামের মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে। সবাই খুব চেনা। কেন চেনা সেটাও একটু একটু বুঝতে পারে যেন। তাড়াতাড়ি বারান্দার কোণের পুতুলের ঝুড়ির ঢাকা সরায়। গোপাল ভাঁড়, সবজির ঝুড়ি হাতে বউ আর ছোট্ট মেয়ে, তিনটে পুতুলই ঝুড়ির একদম ওপরেই আছে। আর শুধু ওই তিনটে পুতুলের পায়েই ভিজে কাদা লেগে রয়েছে। বাকি সব পুতুল একদম খটখটে শুকনো।
হরিরাম ভাবে, চরণদাস মাস্টার কি জাদু করেছে কোনো? যে পুতুলগুলো মন দিয়ে দেখছিল সেগুলোই এমন জ্যান্ত হয়ে উঠল কী করে? আজ এলেই ওকে জিজ্ঞাসা করতে হবে। আজ আসবে কি?
ভাবতে ভাবতে হরিরাম মিষ্টির হাঁড়িখানা ঘরে তোলে। ইচ্ছে করে খেতে। কিন্তু চরণদাস তার বন্ধুমানুষ। সে ভালোবেসে পাঠিয়েছে। তার সঙ্গে ভাগ করেই খাবে ’খন। ভেবে মিটি মিটি হাসে। তারপর দাওয়ায় গিয়ে মাটি ছানে, মাটি মাখে, ছোটো ছোটো ভাগে ভাগ করে নেয় মাখা মাটি। সারাদিন ধরে সে একটা ছেলে পুতুল তৈরি করে। দিব্যি জোয়ান ছেলে, যেমন এককালে হরিরাম ছিল। শক্তসমর্থ, কিন্তু মুখখানা নরম ধরনের। গোঁফটি আঁকল ঠিক বাবার মতো। বাবার অল্পবয়সি চেহারা হরিরামের মনেই নেই। তাও যেন মনে হচ্ছিল বুঝি বাবার মতোই প্রায় এই মুখটা।
বেলা পড়ে আসে। হরিরাম সরু কাঠি বাঁকিয়ে বুনে ঝাঁকা বানায়। তাতে মাটি গুলে লেপে দেয়। নিজের কাজ সে নিজেই মুগ্ধ হয়ে দেখে। তারপর পুতুলটার মাথায় মাটির ঝাঁকাটি বসিয়ে দিয়ে বলে, “বা রে বা। কে হে তুমি? আমি না আমার বাবা?”
উনুনে নরম আঁচ তোলে সে। পুতুলটাকে ধারে বসায় শুকোনোর জন্য। চার-পাঁচদিন লাগবে শুকোতে এখনও। তার মধ্যে হরিরাম রং গুলে তৈরি করবে। হলুদ আর সবুজ গুলবে ডোরা কাটা জামার জন্য। অমনি হলদে সবুজ একখানা জামা হরির খুব পছন্দ হয়েছিল একসময়। তখন তার বয়স কত? বিশ-পঁচিশ হবে। হাটের দোকানে ঝোলানো জামাটা যেন ওকে ডাকছিল। কিন্তু রংচঙে জামাখানা লজ্জায় কিনে উঠতে পারেনি। চিরকাল সবাই তাকে দেখেছে খালি গায়ে সারাদিন। বড়োজোর একটা সাদা বেনিয়ান। শীতের দিনে তার ওপরেই হাত কাটা সোয়েটার। ওতেই চলে যায়। মাটি ঘাঁটলে শীত করেও না।
সেই হলুদ সবুজ ডোরা জামার কথাও ভুলেই গেছিল হরিরাম। আজ এতকাল পরে মনেই যখন পড়ল, ওই রঙেরই জামা এঁকে দেবে পুতুলের গায়ে। ভাবতে ভাবতে বার বার রাস্তার দিকে তাকাচ্ছিল সে। চরণদাস মাস্টার এখনও আসেনি। সারাদিন না খেয়ে কাজ করেছে হরিরাম। চরণদাস সন্ধের পরেই আসে। মাস্টার মানুষ। ছেলেপুলেদের পড়ায় হয়তো সারাদিন। সে এলে দুইজনে মিলে খুব রসগোল্লা খাবে। সন্ধে প্রায় হয়েই এসেছে। বটের উঁচু মাথার পিছনের আকাশটা সিঁদুরে হয়ে উঠেছে।
ভাবতে ভাবতেই লখাই এসে ঢোকে। দৌড়ে এসেছে বোধহয়। ভয়ংকর হাঁপাচ্ছে সে। বলে, “তুই এখনও বেঁচে আছিস হরি? কী ভাগ্যি আমার! চল চল আর এখানে একদণ্ড নয়। যে খবর আজ শুনেছি তারপর আর ভাবিনি তোকে এসে জ্যান্ত দেখব।”
হরিরাম অবাক হয়। বলে, “কী শুনে এলি রে?”লখাই এদিক ওদিক তাকায়। এখনও বিকেলের আলো আছে অল্প। সেই আলোয় তার মুখের ঘাম চকচক করে। গলা নিচু করে লখাই বলে, “জানিস, চরণদাস নামে একজন আছে। সে এখানেই থাকে।”
হরিরাম বলতেই যাচ্ছিল যে চরণদাস বন্ধু মানুষই। একটু বসলে লখাইয়ের সঙ্গে হয়তো দেখাও হয়ে যাবে তার। কিন্তু লখাই তখন তোড়ে কথা বলে চলেছে। বলল, “সেই চরণদাস ছিল মাস্টার। এ বাড়ির পিছনে নাকি একটা ইস্কুল তৈরি করতে চেয়েছিল সে। কোথা থেকে টাকাপয়সা জোগাড় করে খানিকটা খাড়াও করেছিল। কিন্তু কারা নাকি শত্রুতা করে একদিন রাতের অন্ধকারে আগুন ধরিয়ে দেয় ইস্কুলে। ভেতরেই থাকত চরণদাস। ওই আগুনে সেও জ্যান্ত পুড়ে মরে। কিন্তু মরেও সে এ জায়গা ছেড়ে যায়নি। রাত বিরেতে লোকের বাড়ির দরজায় ধাক্কা দেয়। অনেকেই দেখেছে তাকে। ছেলেপুলেদের দেখতে পেলে হঠাৎ সামনে দাঁড়িয়ে বলে, ইস্কুল যাসনি যে কাল! চরণদাসের ভয়েই এইদিকে এখন আর কেউ থাকে না। যে যেমন পেরেছে গাঁয়ে ভিড়ের দিকে চলে গেছে। সবাই জানে এখানে চরণদাসের ভূত আছে। তুই ছাড়া এ তল্লাটে কোনো মানুষ দেখেছিস কখনও? চল চল। শিগগির চল তুই এখান থেকে।” লখাই তাড়া দেয়।
হরিরাম চুপ করে শোনে সব। তারপর মাথা নেড়ে বলে, “তুই খামোখা ভয় পাচ্ছিস লখাই। ওসব গল্প কথায় বিশ্বাস করিস কেন? এই তো আমি দিব্যি আছি। দেখ, ঘরে রসগোল্লা আছে। খাবি?”
লখাই অবাক হয়ে দেখে ওকে। বলে, “রসগোল্লা? কোথায় পেলি?”
হরিরাম একগাল হেসে বলে, “কোথায় আবার পাব? ভূতে জোগাল ধরে নে। খাবি কিনা বল।”
লখাই সন্দেহের চোখে তাকায়, তারপর ঘাড় নেড়ে বলে, “না, খাব না। অন্ধকার হয়ে আসছে। বাড়ি যাই।”
লখাই চলে গেলে হরিরাম উঠোনটা ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করে। কুয়ো থেকে জল তোলে। ভাবতে থাকে একটু আগে শোনা কথাগুলো। তারপর দাওয়ায় উঠে নানকার দিকে তাকিয়ে বলে, “যে ক্ষতি করে না সেই-ই আসলে বন্ধু। তা সে মানুষই হোক বা অন্য কিছু। এ কথা আমার মা বলত। আর মা কক্ষনো ভুল বলে না। বুঝলি নানকা?”
----------
ছবি - শ্রীময়ী
খুব ভালো
ReplyDelete