কানাই পালের পোষ্য
শিশির বিশ্বাস
সন্ধেয় রাসবিহারী মোড়ে রাস্তা পার হবার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল মোহিত। হঠাৎ কাছে বিড়বিড় করে অস্ফুট গলায় কাউকে কথা বলতে শুনে কৌতূহলে ঘাড় ফেরাল।
এত নিচু গলায় কেউ সাধারণত কথা বলে না। তারপরেই ভিতরের তাগিদটা নাড়া দিয়ে উঠল। মানুষটা অন্ধ! রাস্তা পার হবার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। চোখে গাঢ় চশমা। হাতে ব্লাইন্ড ওয়াকিং স্টিক।
আজকাল অনেক উন্নত মানের ব্লাইন্ড স্টিক বের হয়েছে। সঙ্গে ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি লাগানো থাকে। তা দিয়ে শহরের ভিড় পথেও দিব্যি চলা যায়। সামনে চলার পথে কোনো বাধা আছে কিনা যন্ত্র শব্দের হেরফেরে জানিয়ে দেয়। কিন্তু এই মানুষটির ব্লাইন্ড স্টিক একেবারেই সেকালের।
শুধু সাদা রং ছাড়া বোঝার উপায় নেই যে, এটা ব্লাইন্ড স্টিক।
কলকাতার পথে এই
অবস্থায় অন্ধ কাউকে দেখলে সাহায্যের জন্য এগিয়ে যাওয়া মোহিতের অভ্যাস। আজও ব্যতিক্রম হল না। যদি দরকার হয়, মানুষটিকে রাস্তা পার করে দেবে।
কিন্তু বলতে গিয়েও হঠাৎ কেমন থতোমতো খেয়ে গেল।
বিড়বিড় করে ভদ্রলোক সেই থেকে কারও সঙ্গে একইভাবে কথা বলে চলেছেন।
এত অস্ফুট যে, বোঝা মুশকিল।
তবে কথা যে বলছেন, তাতে সন্দেহ নেই। ঠোঁট নড়ছে। হঠাৎ দেখলে মনে হয়, বুঝি মোবাইলে কথা বলছেন। কিন্তু তেমন কিছু নেই।
এমনকি কানে ইয়ার-ফোনও নয়। সামান্য ইতস্তত করে সাহায্য লাগবে কিনা জিজ্ঞাসা করতে যাবে, ভদ্রলোক হঠাৎ ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন।
“কিছু বলবে ভাই?”
অন্ধ মানুষ এভাবে কারও দিকে তাকিয়ে বড়ো একটা কথা বলে না। থতোমতো খেয়ে মোহিত বলল, “ন–না, মানে আপনার হাতে ব্লাইন্ড স্টিক…।”
কথা শেষ না
করে মোহিত থেমে গেলেও উনি বললেন, “আরে আমি তো অন্ধই। রাস্তা
পার হবার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি।
যা গাড়ির ভিড়!”
“যদি দরকার হয়, সাহায্য করতে পারি।”
“সে তো
খুবই ভালো কথা ভাই,” খুশি হয়ে ভদ্রলোক তৎক্ষণাৎ হাত বাড়িয়ে দিলেন।
ভদ্রলোককে নিয়ে রাস্তা পার হবার সময় সামান্য ইতস্তত করে মোহিত বলেই ফেলল, “স্যার একটা কথা বলব? তখন কি মোবাইলে কথা বলছিলেন আপনি?”
“মোবাইল! মোবাইল কোথায়?
আমি তো
মোবাইল ব্যবহার করি না,” মাথা ঝাঁকিয়ে
উনি বললেন।
“তাহলে স্যার, বিড়বিড়
করে কার সঙ্গে কথা বলছিলেন?”
“তাই বুঝি?” কিছুটা যেন অপ্রস্তুত হলেন উনি। “আরে সে তো
আমার ভুতোর সঙ্গে কথা বলছিলাম।”
“ভুতো! বেজায় অবাক হল মোহিত।
“কে?”
“আরে ঘাবড়ে যেও না ভাই,” অল্প হাসলেন উনি, “ভুতো আমার পোষ্য লক্ষ্মীপ্যাঁচা।”
“পোষ্য লক্ষ্মীপ্যাঁচা! কোথায়?”
যতটা অবাক হবার ততটাই অবাক হল মোহিত।
“ছিল তো,” তড়িৎ উত্তর ভদ্রলোকের, “তোমাকে
দেখে কিছু ঘাবড়ে গিয়ে উড়ে গেছে। চলে আসবে আবার। আসলে ব্যাপার কী জানো? ওই ভুতোকে নিয়েই আমি পথ
চলি কিনা।
সামনে কোথায় কী আছে, কোনদিকে
যেতে হবে, কাঁধে বসে ভুতোই আমাকে গাইড করে। কী, অবাক হয়ে গেলে নাকি?”
অবাক হবার মতোই ব্যাপার, কিন্তু চট
করে মোহিতের মুখে কথা জোগাল না। ভদ্রলোক অবশ্য থামলেন না। “আসলে কী জানো, ভুতো প্যাঁচা হলেও ওর কথা আমি বুঝতে পারি।
অবশ্য সে
কথা মানুষের মতো নয় যদিও।
রকমারি কিছু আওয়াজ। ভুতোও বুঝতে পারে আমার কথা। কি বিশ্বাস
হল?”
খানিক চুপ হয়ে থেকে মোহিত আনমনেই অল্প মাথা নেড়েছে কী নাড়েনি ভদ্রলোক
বললেন, “বাহ্, তাহলে বুঝেছ দেখছি। আসলে সব পশুপাখিরই নিজস্ব ভাষা, মানে কিছু শব্দ রয়েছে। বুঝে নেওয়া চাই।”
“আপনি, আপনি কী করে বুঝলেন যে আমি বুঝতে পেরেছি?” একটু অবাক হল মোহিত।
“ওই যে
মাথা নাড়লে?”
“আমি মাথা নেড়েছি, কী করে বুঝলেন?” মোহিত আরও অবাক।
“কেন ভুতো বলল তো।”
“ভুতো!” অবাক হয়ে মোহিত ঘাড় ফিরিয়ে পাশে ভদ্রলোকের দিকে তাকাল। সত্যিই ভদ্রলোকের বাঁ দিকের কাঁধে বসে রয়েছে ছোটো এক লক্ষ্মীপ্যাঁচা। একটু আগেও ছিল না। এর
মধ্যে ফের যে উড়ে এসেছে, একেবারেই
বুঝতে পারেনি।
কিন্তু পাখিটার দিকে তাকিয়ে প্রায় আঁতকে উঠল মোহিত।
সাধারণ পাখি হলেও প্যাঁচা খুব একটা দেখা যায় না। মোহিতও দেখেনি। শুধু ছবিতেই। কিন্তু লক্ষ্মীপ্যাঁচা কি এমন কালো কুচকুচে হয়? তারপর পাখিটার
ওই ভয়ংকর মুখ! হঠাৎ তাকিয়ে অজান্তেই এক পা
পিছিয়ে গিয়েছিল।
প্যাঁচার মুখ কিছু বিদঘুটে হয়
ঠিকই। বাবার কাছেই শুনেছে, ছেলেবেলায় একবার গ্রামের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে পুকুরে ছিপ ফেলে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন। নির্জন পুকুরের
চারদিকে ঘন
গাছপালার বাগান।
বড়ো এক
কদম গাছের তলায় বসে ছিপ ফেলেছেন। হঠাৎ পিছনে সেই কদমগাছের ঝাঁকড়া এক ডালের দিকে চোখ পড়তেই আক্কেল গুড়ুম! পাতার ফাঁকে বড়ো বড়ো চোখ পাকিয়ে কেউ ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
আঁতকে উঠে মুহূর্তে ছিপ ফেলে বাড়ির দিকে দৌড় দিয়েছিলেন তারপর।
সব শুনে ঠাকুরমা
হেসে বলেছিলেন, “আরে ওটা তো হুতুম প্যাঁচা। ওরা দিনের বেলা চুপচাপ গাছে বসে কাটিয়ে দেয়। রাতে শিকার খুঁজে বেড়ায়।
দিন কয়েক হল প্যাঁচাটা ওই
কদমগাছেই আস্তানা নিয়েছে।”
নাতির হাত ধরে পুকুরঘাটে নিয়ে ফের দেখিয়েও এনেছিলেন। সত্যি, বড়ো এক হুতুম প্যাঁচাই বটে। প্রায় পাথরের মতো স্থির হয়ে বসে আছে।
বাবা অবশ্য এরপর একা আর
কখনও পুকুরঘাটে মাছ ধরতে যাননি।
সেই তুলনায় লক্ষ্মীপ্যাঁচা আকারে অনেক ছোটো।
কিন্তু এমন কালো আর কদাকার মুখ হয় জানা ছিল না। ছোটো পাখিটা গম্ভীর মুখে দুই চোখ মেলে বাবার দেখা সেই হুতুম প্যাঁচার মতোই ড্যাবড্যাবে চোখে তাকিয়ে রয়েছে।
লাল চোখ দুটো যেভাবে জ্বলজ্বল করছে, মতলব তেমন ভালো বলে মনে হল না। রাসবিহারী
মোড়ের এই
মানুষের ভিড়েও হঠাৎ ঘামতে লাগল মোহিত।
ক্রসিং পার হয়ে ইতিমধ্যে ফুটপাতে উঠে এসেছে ওরা। চট
করে ভদ্রলোকের হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, “ক্রসিং পার হয়ে এসেছি। এবার তাহলে আসি স্যার।”
“হ্যাঁ ভাই নিশ্চয়,” ভদ্রলোক হেসে উত্তর দিলেন, “তোমার সঙ্গে কথা বলে বেশ ভালো লাগল।
কী নাম তোমার?”
“মোহিত। মোহিত বৈদ্য।”
“বাহ্! বেশ নাম। যদিও জিজ্ঞেস করোনি, তবু আমার নামটাও বলে রাখি, ছেলেবেলা থেকে অন্ধ তো, সবাই তাই কানাই বলে ডাকত।
সেই নামটাই বহাল হয়ে গেছে।
কানাই পাল।
বাস কলকাতার পুতুলকুঠি।”
“পুতুলকুঠি!” অবাক হয়ে মোহিত বলে ফেলল।
“হ্যাঁ, পুতুলকুঠি। নাম শোনোনি?” কিছু যেন অবাক হলেন উনি।
কলকাতায় অনেক বাড়িরই কিছু একটা নাম আছে। কিন্তু সেই নামে কে
আর চেনে? সঙ্গের ঠিকানাটাই আসল।
ও নীরবে মাথা নাড়ল। নেতিবাচক।
ভদ্রলোক তৎক্ষণাৎ বললেন, “তাহলে শোনোনি দেখছি।
পুতুলকুঠি নর্থ কলকাতায়। গঙ্গার ধারে। কাউকে জিজ্ঞাসা করলেই দেখিয়ে দেবে।
এই সন্ধের পর বাড়িতেই থাকি। ওদিকে গেলে চলে এস একদিন।
দু’তলার ঘর
থেকে চমৎকার গঙ্গা দেখা যায়।
খানিক গল্প করতে ভালোই লাগবে।”
আরও কিছুক্ষণ ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা চালানোই যেত। উনি খুশিই হতেন হয়তো।
কিন্তু মানুষটির কাঁধে ড্যাবডেবে চোখে তাকিয়ে থাকা লক্ষ্মীপ্যাঁচাটাকে কিছুতেই
যেন সহ্য করতে পারছিল না
মোহিত, যদিও তারপর একবারও তাকায়নি ভদ্রলোকের কাঁধের দিকে।
প্যাঁচাটা সেখানে একইরকম বসে আছে কিনা দেখেওনি আর। তবে নিশ্চয় রয়েছে। নইলে অল্প আগে ভদ্রলোকের কথার উত্তরে ওর
নীরবে মাথা নাড়া বুঝলেন কী
করে! মোহিত তাই আর কথা বাড়ায়নি। বিদায় নিয়ে চলে এসেছিল।
ঘটনাটা মাস কয়েক আগের। মোহিত এর মধ্যে নর্থ কলকাতায় গেলেও পুতুলকুঠি যাওয়ার কথা মনে হয়নি। পথে এমন কত মানুষের সঙ্গেই তো পরিচয় হয়। সেই সূত্র আর টিকিয়ে রাখে ক’জন? মোহিতও রাখেনি। প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ মানুষটির সঙ্গে ফের এভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবেনি।
সেদিন শিবপুরে এক বন্ধুর বাড়ি যাবে। গোড়ায় বাসে যাবে বলেই বের হয়েছিল। কিন্তু পথেই হঠাৎ খবর পেল কী এক
গোলমালে দ্বিতীয় সেতুর একটা লেন বন্ধ রয়েছে আজ। অনেক বাসই তাই হাওড়া ব্রিজ হয়ে যাচ্ছে। খবরটা শুনেই ও মত
বদলে ফেলেছে।
চাঁদপাল ঘাটে ফেরি ধরলে অনেক আগে শিবপুর পৌঁছে যেতে পারবে।
বাস পার্ক স্ট্রিট ছাড়াতে সিট ছেড়ে উঠবে কিনা ভাবছে, হঠাৎ পিছনে কেউ অস্ফুট স্বরে বিড়বিড় করে উঠল। বাসে–ট্রেনে এভাবেই অনেকে মোবাইলে কথা বলেন।
পাশের ব্যক্তিও বুঝতে পারেন না। কিন্তু গলার স্বর শুনে বেজায় চমকে উঠল ও। সেদিনের সেই ভদ্রলোক! সেই আগের দিনের মতো বিড়বিড় করে কথা বলছেন।
মুহূর্তে ঘাড় ফেরাল ও।
হ্যাঁ, সেই ভদ্রলোকই।
পিছনের সিটে ঘাড় গুঁজে সমানে বিড়বিড় করে বকে যাচ্ছেন। কাঁধে ভুতো নেই অবশ্য।
হয়তো কোলের উপর রয়েছে। ও
দেখতে পাচ্ছে না। কিছু অবাক হয়েই বলল, “স্যার, আপনি!”
“আরে!” কিছুটা যেন সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন উনি। “তুমি সেই মোহিত না?”
“একদম স্যার।”
“গরিবের আস্তানায় আর তো গেলে না। তা
ফের যখন দেখাই হল, আজ আর ছাড়ছি না।”
সামনেই এসপ্ল্যানেড। নামার জন্য এগোতে হবে।
মোহিত তাড়াতাড়ি বলল, “আমি স্যার চাঁদপাল ঘাটে যাব।
সামনেই নামতে হবে।”
“চাঁদপাল ঘাট!” হঠাৎ যেন কিছু সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন উনি। “কোথায় যাবে?”
“ওপারে শিবপুর।
বিশেষ দরকার।”
“তাই?” সামান্য থামলেন
উনি। তারপর বললেন, “তাহলে চলো, আমারও ওদিকে ফোরশোর রোডে একটু কাজ আছে।
খানিক গল্প ছাড়া কিছু কাজও হবে।” কথা শেষ করেই উনি হাতটা বাড়িয়ে দিলেন।
এরপর আর কথা চলে না। খুবই তাড়া ছিল। এক
বন্ধুর বাড়িতে যাবে দরকারি একটা বই আনতে। টাইম দেওয়া আছে।
ইতিমধ্যেই দেরি হয়ে গেছে। তবু বলল, “আজ, আজ ভুতো নেই?”
“ছিল তো। তুমি তাকাতেই উড়ে গেল। আমার পোষ্যরা বেজায় খেয়ালি আবার। শুধু চলেই গেল না, আজ যে আর
ফিরবে না, জানিয়ে
গেল সেটাও।
তুমি থাকলে কিছু সুবিধেও হয়
তাই।”
শুনে কিছু অবাকই হল মোহিত। যত ছোটোই হোক, জলজ্যান্ত
একটা প্যাঁচা ওর সামনে উড়ে গেল, অথচ সে
দেখতেই পেল না! কিন্তু সে
কথা আর
জিজ্ঞাসা করা গেল না। শোভনও নয়। এদিকে স্টপেজ এগিয়ে আসছে, ভদ্রলোকের বাড়িয়ে দেওয়া হাত ধরে উঠে পড়ল।
এসপ্ল্যানেড থেকে চাঁদপাল ঘাট। দূরত্ব একেবারে
কম নয়। তায় গোটা কয়েক ক্রসিং। মানুষের ভিড়। দ্রুত পা চালাবার দরকার ছিল। কিন্তু ভদ্রলোকের
গল্প থামতেই চায় না। এদিকে হাতে সময় নেই।
এই দুপুরের দিকে ঘাটে ফেরি লঞ্চের সংখ্যাও তেমন বেশি নয়। হুঁ–হাঁ করে তাল দিয়ে মোহিত যখন জেটিঘাটে পৌঁছোল, ভোঁ দিয়ে একটা ফেরি লঞ্চ ছাড়ার মুখে। অনেকেই জেটি দিয়ে ছুটতে শুরু করেছে। লঞ্চের দড়ি খুলে দিলেও ছুটে গিয়ে অনেকেই লাফিয়ে উঠছে তখনও।
এমন দৃশ্য নতুন নয়। মোহিত নিজেও অনেকদিন উঠেছে।
কিন্তু আজ
উপায় নেই।
অন্ধ মানুষটিকে নিয়ে এভাবে ওঠা সম্ভব নয়। তবু হাতের ঘড়ির দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, “খুব তাড়া ছিল আমার। কিন্তু এই অবস্থায় আপনাকে
নিয়ে লঞ্চে ওঠা যাবে না।”
মোহিত ভেবেছিল, কথার অন্তর্নিহিত অর্থ হয়তো বুঝবেন উনি। কিন্তু কোনো উত্তরই এল
না। চোখের সামনেই ফেরি লঞ্চ জেটি ছেড়ে চলে গেল। শেষ মুহূর্তেও
দুজন যাত্রী বেশ ঝুঁকি নিয়েই মস্ত লাফে দিব্যি লঞ্চের ডেকে লাফিয়ে পড়ল। মোহিত দাঁতে দাঁত চেপে তাকিয়ে দেখছিল। উনি বললেন, “এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে আর লাভ কী?
চলো উপরে বসি কোথাও।”
অগত্যা ঘাটের উপর ফাঁকা এক বেঞ্চে বসল দু’জন। ফেরি লঞ্চ ফেল করে মোহিতের মেজাজ একেবারেই ভালো ছিল না। উনি অবশ্য বিপুল উৎসাহে নানা কথা বলে যাচ্ছিলেন।
গোড়ায় হুঁ–হাঁ করলেও মোহিত পরের দিকে তেমন সাড়া দিচ্ছিল না। বন্ধুকে সময় দেওয়া আছে। দেরি হবার কারণে যদি সে বের হয়ে পড়ে, কোনো কাজই হবে না। মোবাইলে ধরার চেষ্টা করেও হল
না। টাওয়ার বেজায় কম। বিড়ম্বনা আর কাকে বলে!
ভদ্রলোক অবশ্য বকে চলেছেন তখনও। মোহিত বন্ধুকে ধরার জন্য সমানে চেষ্টা করে যাচ্ছে। অন্য দিকে নজর দেবার সময় নেই। হঠাৎ চারপাশে হইহই চিৎকারে চমকে উঠল। তাকিয়ে দেখে কী এক
কারণে সবাই জেটির দিকে দৌড়তে শুরু করেছে। কী
ব্যাপার? কয়েক পা এগোতেই সারা শরীর প্রায় হিম হয়ে গেল ওর।
একটু আগে যে
লঞ্চটা ঘাট থেকে ছেড়েছিল, মাঝগঙ্গায় উলটে গেছে। কাছেই একটা বড়ো বামবোট।
পাশে একজন জানাল, বামবোটটা দক্ষিণ দিক থেকে আসছিল।
জোরালো বানের তোড়ে দুটোর কোনোটাই দিক ঠিক রাখতে পারেনি। মুখোমুখি ধাক্কায় উলটে গেছে।
ভয়ানক জোরালো বান।
তারপর প্রায় মাঝনদী। ফুলে ওঠা গঙ্গার জলে হাবুডুবু খাচ্ছে অনেকগুলো মানুষ। কেউ দুই হাত তুলে আর্ত চিৎকার করছে।
আশপাশ থেকে কিছু জেলে নৌকো ছুটে এসে দু-একজনকে জল থেকে তোলার চেষ্টা শুরু করেছে বটে, কিন্তু সে
আর কয়জন।
জলের তীব্র টানে ততক্ষণে অনেকেই ভেসে গেছে। যারা সাঁতার জানে তারাও যে বেশিক্ষণ ভেসে থাকতে পারবে, সেই সম্ভাবনা কম। ভাবতে গিয়ে বুকের ভিতরটা হঠাৎ হিম হয়ে এল মোহিতের। অন্ধ কানাই পালের সঙ্গে ওইভাবে দেখা না
হলে, প্রায় জোর করে সঙ্গে না
থাকলে তারও ওই দশা হতে পারত! সাঁতারটাও জানা নেই।
এক মুহূর্ত দেরি না করে মোহিত এরপর ছুটল ঘাটের অদূরে সেই বেঞ্চের দিকে। নাহ্, ভদ্রলোক নেই সেখানে।
চলে গেছেন।
ভিড়, মানুষের ছুটোছুটির মধ্যে ভদ্রলোকের সন্ধান আর পায়নি মোহিত। শিবপুর যাওয়া বাতিল করে বাড়ি ফিরে এসেছিল তারপর।
রাতে টিভির খবরেই বিস্তারিত জানা গেল। চাঁদপাল ঘাটের কাছে গঙ্গায় ফেরি লঞ্চ উলটে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। বাড়িতে তাই নিয়ে আলোচনা।
সেই আলোচনায় যোগ দিলেও মোহিত ঘুণাক্ষরেও আসল ব্যাপার ভাঙেনি। বরং প্রসঙ্গ
পালটে পাশে ছোটোকাকুর কাছে হঠাৎই পুতুলকুঠির কথা পেড়েছিল।
ছোটোকাকু অনেক খোঁজখবর রাখে। বইপত্রও পড়ে প্রচুর। অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, “সে কী
রে, পুতুলকুঠির নাম শুনিসনি! কলকাতায় পয়লা নম্বর ভূতের বাড়ি ওটা।”
পুতুলকুঠির বিস্তারিত বিবরণ তারপর ছোটোকাকুর
কাছেই জানতে পেরেছিল মোহিত। অন্য সময় হলে সে
সব ভয়ানক কথার পর ভিতরের ইচ্ছেটা হয়তো নামিয়ে ফেলত মাথা থেকে, কিন্তু দুপুরে যে
ঘটনা ঘটে গেল, ভদ্রলোকের সঙ্গে একবার দেখা না
করলেই নয়। অগত্যা পরের দিনই বাস ধরে হাজির হল শোভাবাজারে। বাড়িটা
এদিকেই।
ঠিকানা জানা নেই।
ভেবেছিল, খুঁজে পেতে সমস্যা হবে হয়তো।
কিন্তু তেমন কিছু হল না। বাস থেকে নেমে প্রথম যাকে জিজ্ঞাসা করল, বাতলে দিলেন তৎক্ষণাৎ। সরু এক গলি। দু’পাশে প্রায় গায়ে গায়ে পুরোনো দিনের একের পর এক
জরাজীর্ণ বাড়ি।
সেদিকে তাকিয়ে ভিতরে কিছু অস্বস্তি হওয়াই স্বাভাবিক। তার উপর জায়গাটা ঘিঞ্জি নর্থ কলকাতা হলেও গলির ভিতর জনমানুষ খুবই কম। কাউকে জিজ্ঞাসা করবে কিনা ভাবছে। হঠাৎই নজরে পড়ল বাড়িটা।
কিছুটা থতোমতোও খেয়ে গেল। ছোটোকাকুর কথার সঙ্গে কিছুমাত্রও মেলাতে
পারল না। পথের উপর পুরোনো দিনের জীর্ণ দু’তলা বাড়ি।
জীর্ণ দরজা।
পাশে বড়ো এক বোর্ডে লেখা:
প্রবেশ নিষেধ। প্রবেশ নিষেধ।
এটা ভূতের বাড়ি নয়। গুজবে একেবারেই কান দেবেন না। বাড়ির কাউকে অযথা বিরক্তও করবেন না।
— বাসিন্দাবৃন্দ
আধভাঙা দরজা দিয়ে ভিতরের অনেকটাই দেখা যাচ্ছে। মাঝখানে মস্ত খোলা চাতাল, হরেক মালপত্র ডাঁই করা, কিন্তু দু’তলাটা একেবারেই ফাঁকা।
কেউ বাস করে বলে মনে হল না। পরপর অনেকগুলো দরজা – বন্ধ ঘর। সামনে বারান্দায় রাজ্যের ঝুলকালি।
তবে নিচের তলায় লোকজন রয়েছে।
কয়েকজনকে দেখতেও পেল। আধভাঙা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ও ভিতরে ঢুকবে কিনা ভাবছে।
কোত্থেকে কুচকুচে একটা কালো রঙের বিড়াল ছুটে এসে ওর পায়ের কাছে ঘুরঘুর করতে লাগল। বার দুই শুঁকেও গেল পায়ের পাতা। ভরসন্ধেয় ওই ব্যাপার দেখলে অনেকেই হয়তো ঘাবড়ে যেত, কিন্তু কালো বিড়াল নিয়ে মোহিতের একেবারেই দুর্বলতা নেই। দুর্গাপুরে ওর
এক মামা থাকেন। বছরভর তিনি বাড়িতে কালো বিড়াল পোষেন। কিন্তু এই বিড়ালটা যেভাবে
পায়ের উপর ঝুঁকে গন্ধ শুঁকছে, কামড়ে দিতেও পারে।
সেই আশঙ্কায় ও পা ছুঁড়ে তাড়াবার চেষ্টা করল। কিন্তু বিড়ালটা
গ্রাহ্যই করল না। আরও কাছে ঘেঁষে এল।
আর দেরি করা যায় না। ও কাউকে ডাকবে কিনা ভাবছে।
তার আগেই ময়লা ধুতি পরা খালি গায়ে একটা রোগা চিমড়ে মাঝবয়সি মানুষ তড়িৎ গতিতে ছুটে এলেন। প্রায় নিঃশব্দে। মোহিত কিছু বলবার আগেই তিনি খনখনে গলায় বললেন, “কীঁ কাঁণ্ড! ভুঁতো আঁপনাকে চেনে নাকি?”
“ভুতো, ভুতো কে?” ফের থতোমতো খেল মোহিত।
“ওঁই বেঁড়ালটা,” বলতে বলতে জোরে একবার নাক টানলেন উনি। সামান্য গলা ঝেড়ে নিয়ে বললেন, “কানাইদা, মানে আমাদের কানাই পালের।”
“আমি, আমি তো
ওনার সঙ্গেই দেখা করতে এসেছি।
পথে একদিন আলাপ হতে আসতে বলেছিলেন। আছেন উনি?”
“না, নেই এখন।
দুপুরে বেরিয়েছেন।
তবে চলে আসবেন কিছুক্ষণের মধ্যেই।
আপনি দু’তলায় ওনার ঘরে গিয়ে বসুন বরং।
তবে সিঁড়িটা একটু নড়বড়ে। সাবধানে উঠবেন। ওরে ভুতো, স্যারকে
ঘরে নিয়ে যা।”
লোকটার মুখের কথা শেষ হতে পেল না। কালো বিড়ালটা মোহিতের প্যান্ট কামড়ে প্রায় টানতে শুরু করল।
সভয়ে পিছিয়ে গিয়ে মোহিত বলল, “ওনার, ওনার ভুতো নামে একটা কালো প্যাঁচাও তো
আছে!”
“কালো প্যাঁচা!” লোকটা কিছু থতোমতো খেলেন যেন। তারপর সামলে নিয়ে বললেন, “থাকতেও পারে। ব্যাপার হল, ভুতো তো আর
একটা নয়
ওনার। ওদের সঙ্গে নিয়েই তো
থাকেন। দিনভর কলকাতার পথে ঘোরাঘুরি করেন। এদিকে জন্মান্ধ
মানুষ। সে
যাক, আপনি ভুতোর সঙ্গে উপরে ওনার ঘরে চলে যান বরং। পাশেই গঙ্গা। জানলা দিয়ে তাকিয়েও দিব্যি সময় কেটে যাবে।”
লোকটার কথা শেষ হতেই কালো বিড়ালটা ফের মোহিতের প্যান্ট কামড়ে ধরে টানতে শুরু করেছিল, কিন্তু কোনোক্রমে
ছাড়িয়ে নিয়ে সে ততক্ষণে মুখ ঘুরিয়ে ফেরার পথ ধরেছে। চলতে চলতেই বলল, “উনি নেই যখন, আজ থাক বরং। পরে অন্য একদিন আসব।”
----------
ছবি - অতনু দেব
No comments:
Post a Comment