মুখোশটা
শরণ্যা মুখোপাধ্যায়
গল্পেরও আগের গল্প।।
গ্রামদেশের মেলার স্বাদই আলাদা। কত যে অদ্ভুত জিনিস কিনতে পাওয়া যায় তার লিস্ট করলে অবাক হতে হয়। হয়তো কোনো ঠাকুরের পুজো বা শীতকালের দুপুর বা নতুন ফলক লাগানো হচ্ছে। কিছু একটা পেলেই হল। ব্যস মেলা শুরু করে দেবে লোকে। তবে তেমন হলে খুশিই হয় আলোক। সে দারুণ পুতুল বানাতে পারে। তার গুরু কুমোরপাড়ার শ্রেষ্ঠ শিল্পী ভোলাপাগলা। সে যে কী কাজ জানে, লোকে তা বোঝে না। আলোক বোঝে। তাই ছুটে ছুটে যায় ভোলা ঠাকুরের কাছে। গিয়ে গিয়েই এই বিদ্যে সে আয়ত্ত করেছে। দরমার ঘরের চৌকো জানালার ফাঁক দিয়ে সূর্যের অল্প আঁচ গড়িয়ে আসে তার চোখে। মুখ নিচু করে ক্লাস সিক্সের আলোক বণিক ব্যস্ত হাতে তুলি চালায়। শূন্য মাটিতে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করে।
।। ১।।
মুখোশটা দারুণ। দেখেই পছন্দ হয়ে গেল। অফিস থেকে বেরিয়েই নবীনবাবু ফুটপাথের মুখোশওয়ালাটাকে দেখে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। এমনিতে তিনি যে খুব খরচে, তা নয়, তবে মনের মতো জিনিস পেলে ছাড়েন না। তাঁর জীবনে দুটি নেশা। এক, টাকা রোজগার আর দুই, বিভিন্ন পুরোনো আর্টিফ্যাক্ট কেনা। অর্থাৎ মানুষের হাতের কাজের নানারকম সুন্দর, নতুন বা পু্রোনো জিনিস কেনা এবং সেই জিনিস দিয়ে ঘর সাজানো।
নবীন সরকার বড়োবাজারে একটি অফিসে কাজ করছেন আজ প্রায় পঁচিশ বছর। এখন আর আগের মতো মনোযোগ দিয়ে কাজ করার দরকার পড়ে না তাঁর। শুধু নির্দেশ দিয়েই ক্ষান্ত থাকলে চলে যায়। যারা ওঁর তাঁবের লোক, তাদের সুবিধা পাইয়ে দেওয়া, আর যারা ওঁর মতে চলে না তাদের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলাতে ওঁর জুড়ি নেই। বিয়ের ধার ধারেননি উটকো ঝামেলার ভয়ে। ডান আর বাঁ এই দুই হাতের রোজগারে নিজের বয়স পঞ্চাশ হবার আগেই শহরের মাঝখানে প্রাসাদোপম বাড়ি করেছেন। অনেকগুলো গাড়ি। এছাড়াও সোনা, জমিজমা কিছুরই অভাব নেই তাঁর। বাবা-মা অনেক আগেই পরলোকগত হয়েছেন। থাকার মধ্যে ছিলেন এক দাদা, নিজের বাবাকে অসুস্থ অবস্থায় ভুল বুঝিয়ে সেই ভালোমানুষ দাদাকেও সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করেছেন নবীনবাবু। তা তিনিও ভাইয়ের ব্যবহার দেখে আর সম্পর্ক রাখেননি। বাড়ি থেকে বার হয়ে যাবার পর খুবই কষ্টে কাটিয়েছেন, কিন্তু কখনও সাহায্যের হাত পেতে এগিয়ে আসেননি। নবীনবাবু দূর থেকে শুনেছিলেন দাদার অবস্থা ভালো নয়। স্ত্রী আর এক ছেলেকে নিয়ে টানাটানির সংসার। যদিও আগে দাদা একটা ব্যাবসা করত, মোটামুটি ভালোই চলত সেটা। কিন্তু ভালোমানুষ তো। ব্যাবসা চালানোর জন্য যে কূটবুদ্ধি সময়ে সময়ে প্রয়োজন হয়, সেটা ছিল না। দেনা করে ফেলেছিলেন। লস-টস করে, শেষে অনেক ঋণ রেখে মারা যান। পাওনাদাররা বাড়িতে অনেকবার হামলাও করেছে।
তা নবীনবাবু গিয়েছিলেন খবর পেয়ে। নিজের দোহারা চেহারার দাদাকে ওরকম হাড়সর্বস্ব দেখে যে একটুও খারাপ লাগেনি, তা নয়। তবে, ওই যে, বাজে খরচ তাঁর ধাতে নেই। হাজার দশেক টাকা বিধবা বৌদির হাতে ধরিয়েই কেটে পড়েছিলেন তিনি। ভাইপোর তখন দশ বা বারো বছর বয়স। সেও আজ প্রায় বছর পনেরো আগের ঘটনা।
নিজের শখ নিয়ে ব্যস্ত থাকাই তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র। আর হ্যাঁ, মাঝে মাঝে তাঁর বাড়িতে আসা নানা কৃপাপ্রার্থীকে তাঁর জিনিসগুলি দেখিয়ে তার দাম সম্পর্কে তাদের অবহিত করেন তিনি। তাদের শুকনো মুখ আর লোভাতুর চোখ দেখে এক বিজাতীয় আনন্দ পাওয়াটাও তাঁর আরেক নেশা। যে জিনিসগুলোর নাগাল তারা কোনোদিন পাবে না, সেগুলো তাদের দেখিয়ে তিনি বোঝান, তিনি নিজে কত বড়ো মাপের লোক।
মুখোশটা যে এভাবে পাওয়া যাবে তা তিনি ভাবেননি। লোকটা হাঁকছে দেখেই তাকিয়েছিলেন তিনি। অনেক রকম জিনিসের মধ্যে এই বিশালাকার মুখোশটা মনে ধরে তাঁর। লোকটা বেশ অদ্ভুত। ওই মুখোশটা পছন্দ বলাতে কেমন যেন খরচোখে তাকাল নবীনবাবুর দিকে। তাঁর নেয়াপাতি ভুঁড়ি থেকে গোলগাল ফরসা মুখের ওপর থাকা কালো তিলটা অবধি খুঁটিয়ে দেখে বলল, “আপনার চোখ আছে বাবু। এ মুখোশ সকলের চোখে পড়ে না। যার চোখে পড়ে, এই মুখোশ তাকেই পায়।” কথাটা শুনে বেশ অবাক লেগেছিল নবীনবাবুর। কী বলছে লোকটা?
“চোখে পড়ে না মানে? বিক্রির জন্যই তো সাজিয়ে রেখেছ, যাতে লোকে দেখে কেনে?” জিজ্ঞেস করাতে লোকটা খিকখিক করে হাসল, বলল “এ জাদু-মুখোশ বাবু, এ জ্যান্ত। এর খিদে-তেষ্টা সব আছে। এই একখানিই আছে এ জগতে, আমি দেখতে পেয়েছিলাম, তাই আমার কাছে এতদিন ছিল, এখন আপনি দেখতে পেলেন, তাই এখন আপনার।” যতসব বাজে কথা। নবীনবাবু বুঝলেন লোকটা দর বাড়াতে চাইছে এ সব বলে। এদের চেনেন তিনি। অনেক দিন ধরে জিনিস কিনছেন কিনা। মুখোশটা নিয়ে একটা রহস্য করে, এটাই একমাত্র, বলে দাম বাড়াবার চেষ্টা। তাঁর মতো ঝানু লোকের বুঝতে বাকি নেই এ সব। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল লোকটাকে যখন তিনি দাম দিতে গেলেন, সে কোনো দরই বলল না। শেষে জোর করে একটা একশো টাকার নোট লোকটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে মুখোশটা নিয়ে হনহন করে হাঁটা দিলেন তিনি। কাজটা ভালো। হাতের গুণ আছে, যেই বানিয়ে থাক না কেন।
খুশিতে ডগমগ নবীনবাবু যদি একবারের জন্যও পিছন ফিরতেন, তাহলে দেখতে পেতেন মুখে বাঁকা হাসি নিয়ে একশো টাকার নোটটা কুচিয়ে ছিঁড়ে ফেলল মুখোশওয়ালা।
।। ২।।
মুখোশটা বেশ ভারী। চাকরকে চা করতে বলেই জিনিসটা নিয়ে বসেছেন নবীনবাবু। লম্বায় প্রায় এক ফুট, চওড়ায় ইঞ্চি দশেক। কালচে ধরনের শ্যাওলাপড়া রং। গড়ন ডিম্বাকৃতি। মোটা নাক, টুবো গাল, চওড়া ঠোঁট। কিন্তু সবচেয়ে আকর্ষণীয় হল চোখটা। মুখের আকৃতির সঙ্গে একেবারে বেমানানভাবে বসানো দুটো বিরাট গোল গর্ত, চোখের জায়গায়। কোনো মণি নেই, কিচ্ছু নেই। প্রায় চার ইঞ্চি ব্যাসের এক একটা চোখের মধ্যে রীতিমতো হাত ঢুকে যায়। মুখোশটা কীসের বানানো, বলা মুশকিল, মাটির মতোই মনে হয়, খুব শক্ত পোড়ামাটির হবে হয়তো, নাকি কাঠের? কে জানে। কিন্তু মুখটা অদ্ভুত হলেও একটা টান আছে। কী যেন আছে মুখটায় যেটা নবীনবাবু চিনি চিনি করেও চিনতে পারছেন না।
* * *
কয়েকদিন কেটে গেছে। আজ নবীনবাবুর মেজাজটা বেশ খারাপ। রতনলাল, ওঁর নতুন বস, বেজায় কড়া। তিনি আবার নতুনদের নিয়ে কাজে বেশি বিশ্বাসী। নবীনবাবুর মতো বাস্তুঘুঘুদের কড়া হাতেই নিয়ন্ত্রণ করছেন আজ মাসছয়েক হল। আজ নবীনবাবুকে দেরিতে আসার জন্য লেটমার্ক দিয়েছেন। সকলের সামনে কথা শুনিয়েছেন ভালোই। মানে লেগেছে তাই। সেই থেকেই মেজাজটা খিঁচড়ে গেছে। মুখ বুজে অপমান সহ্য করার বান্দা তিনি নন। বাড়িতে এসে ঘর অন্ধকার করে বসে এ সবই ভাবছেন। ওলাউঠোর এমন একটা কিছু হোক যাতে ওর অফিস আসাই বন্ধ হয়ে যায়। অনেকক্ষণ ধরে এই সব শাপশাপান্ত করতে করতেই হঠাৎ শিউরে উঠলেন নবীনবাবু। হাতে যেন একটা ঠান্ডা ছুরি কেউ চালিয়ে দিল। আঙুলগুলো খসে পড়ছে যেন। ঠিক এই সময়েই ঘণ্টা বেজে উঠল ঘড়িতে। কী জ্বালা, সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন নিজের হাতটা ওই মুখোশের চোখের গর্তের মধ্যে চালান করে দিয়েছেন, নিজেই জানেন না। আঙুলসমেত কবজি অবধি হাত প্রায় সবটাই ঢুকে গেছে ওই চোখের গহ্বরে। সভয়ে হাতটা এক ঝটকায় বার করে নিলেন নবীনবাবু। কিন্তু কই, কিচ্ছু হয়নি হাতে! শুধু আঙুলগুলো খুব গরম লাগছে। কী হল ভাবতে ভাবতেই রাতটা কেটে গেল নবীনবাবুর।
।। ৩।।
অফিসে সেদিন একটু তাড়াতাড়িই এসেছেন নবীনবাবু, আগের দিনের কথা মনে রেখে। আসতেই, গুঞ্জনটা কানে এল। তাঁর এক নম্বর তাঁবেদার সেনবাবু দৌড়ে এলেন, “স্যার, শুনেছেন? রতন স্যারের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। গড়িতে, কাল রাতে, হেড-অন কলিশন। অবস্থা খুব খারাপ, কোমায় আছেন।” নবীনবাবুর হৃৎপিণ্ডটা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে আবার চলতে আরম্ভ করল। ব্যাপারটা ভালো করে বোঝার জন্য খুঁটিয়ে সবটা জানলেন সবার কাছ থেকে। ঘটনাটা ঘটেছে কাল রাত দশটা নাগাদ।
সারাটা দিন আনমনা হয়ে অফিসে কোনোরকমে কাটিয়ে ছুটি হতেই বাড়ির পথ ধরলেন নবীনবাবু। মনটা খুব চঞ্চল হয়ে আছে। বাড়ি ঢুকেই সোজা চলে গেলেন শোবার ঘরে, মুখোশটা ওখানেই একটা শোকেসের ওপর সাজানো আছে। যা মনে করছেন তিনি, সেটা কি সত্যি? মুখোশটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন নবীনবাবু। কাল রাতে রতনলালের কথাটা যখন ভাবছিলেন, তখন মুখোশ তাঁর হাতে ছিল। বাড়িতে এলে এখন ওটা নিয়েই মেতে থাকেন তিনি। ঘড়িতে বেজেছিল রাত ঠিক আটটা। সময়টা মনে থাকার কারণ, তাঁর বাবার আমলের গ্র্যান্ডফাদার ক্লক। সেটায় তখন ঘণ্টা বাজছিল। নবীনবাবু কি তবে একটা ইচ্ছাপূরণ মুখোশ পেয়েছেন? এরকমও হয়? রতনলালের বদলে আবার এসেছেন রতিকান্তবাবু। নবীনবাবুর পছন্দের লোক। সুবিধাটা যেন বড্ড হঠাৎ হয়ে গেল। জানার একটাই উপায়, নবীনবাবু খাটে বসে কাঁপা হাতে মুখোশটার ডানচোখের গর্তে হাত ঢোকালেন, আর মনে মনে বললেন, শেয়ারের যে ইনভেস্টমেন্টটা লসে রান করছে ওটা যেন দশগুণ হয়ে ফিরে আসে। ইচ্ছেটা বলার সঙ্গেই আবার প্রচণ্ড যন্ত্রণা। আঙুলগুলো যেন কেউ খুবলে নিচ্ছে। হাতটা কোনোরকমে বার করেই মুখোশটাকে জায়গায় রেখে দিলেন নবীনবাবু।
।। ৪।।
হ্যাঁ, আলাদিনের এক আশ্চর্য প্রদীপই পেয়েছেন নবীনবাবু। সেটা বুঝতে পরেরদিন বেলা বারোটার বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি তাঁকে। দশলাখ টাকার হঠাৎ বেড়ে ওঠা ব্যাংক-ব্যালেন্স নিয়ে নতুন কী করবেন, সেটা ভাবতে ভাবতেই পরের দিন রাতে মুখোশটা নিয়ে বসলেন। এবারের ইচ্ছা তাঁর দীর্ঘদিনের শত্রু, অফিসের কলিগ তিমিরবাবুর সর্বনাশ। দিন যত এগোতে লাগল নবীনবাবু ততই ফুলে ফেঁপে উঠতে লাগলেন। কেটে গেল দুটো মাস।
শরীরটা হঠাৎই খারাপ হতে আরম্ভ করেছে। বংশগতভাবে দোহারা চেহারা তাঁদের সকলেরই। কিন্তু যেভাবে গত একমাসে নবীনবাবুর ওজন কমেছে, তাতে অফিসের বিশ্বাসবাবু, কুমুদবাবু সকলেই একবার করে শরীরের খবর জানতে চেয়েছেন। কিন্তু নবীনবাবুর ওসব দিকে ভাবার সময় নেই। শীর্ণ শিরাবহুল কাঁপতে থাকা হাতটা ডানচোখের গর্তে ঢুকিয়ে নতুন করা ফ্ল্যাটটার জন্য চাইতে হবে অনেকগুলো ফার্নিচার। চকচক করে ওঠে নবীনবাবুর কোটরগত চোখদুটো। এখন আর বরফকামড়টা হাতে তেমন লাগে না। অভ্যেস হয়ে গেছে। শুধু একটা ব্যাপার আশ্চর্য লাগে মাঝে মাঝে, তাঁর গালের জন্মদাগ, তিলটা আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে! কিন্তু এ সবে মাথা ঘামাবার মতো বোকা তিনি নন। তাঁর এখনও অনেক কিছু পাওয়া বাকি। মাত্র দু’মাস হয়েছে, তাঁর শত্রু বলতে আর কেউ তেমন আর নেই। আর সম্পত্তি? এই দু’মাসে যা করেছেন তিনি, গত বিশবছরে তার সিকিও করতে পারেননি।
রাত ঠিক আটটা বাজছে। নবীনবাবু হাতটা সবে ঢুকিয়েছেন মুখোশের চোখের গর্তে, এমন সময় নিচ থেকে কলিংবেলের আওয়াজ এল। কে এল আবার? হাতটা বার করে নিতে গিয়েও পারলেন না নবীনবাবু। টানাটানি করতে লাগলেন। দুর্বল শরীর। হাতটা যেন জ্বলে যাচ্ছে, একেকটা সেকেন্ড অনন্তকাল মনে হচ্ছে। সিঁড়ি দিয়ে কেউ উঠে আসছে ওপরে তাঁর ঘরেই। নবীনবাবুর গলা দিয়ে আওয়াজ বার হচ্ছে না। লোকটা যখন দরজার সামনে এসে দাঁড়াল, একবার বিস্ফারিত চোখে তার দিকে তাকালেন নবীনবাবু। সেই মুখোশওয়ালা না? এখানে? কী করে এল?
“চিনতে পারছ কাকা? আমি আলোক”…
মানুষের যখন শেষ সময় ঘনিয়ে আসে, তখন তার সামনে অনেক কুয়াশাঘেরা সত্যি স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে। ঠিক এই ভয়ানক সময়েই অত্যন্ত অপ্রাসঙ্গিকভাবে নবীনবাবু বুঝতে পারলেন যে মুখোশটা তাঁর কেন চেনা চেনা লাগত। ওটা একেবারে তাঁরই মুখের আদলে তৈরি। ছেলেরা যে ক্যারিকেচার বা কার্টুন বানায় বড়ো বড়ো লোকেদের, অনেকটা সেরকম। তাই একঝলকে হঠাৎ ধরা যায় না। তবে শুরুতে যা ছিল, তার চেয়ে এ ক’দিনে মুখোশটা যেন আরও বেশি করে তাঁর মুখের মতো হয়ে উঠেছে।
কী একটা হিসেব যেন মেলাবার শেষ চেষ্টা করলেন নবীনবাবু, কিন্তু পারলেন না। তাঁর অন্তিম চিৎকারটা গলার কাছেই আটকে রইল।
* * *
ধীর পায়ে এগিয়ে এসে নবীনবাবুর হাড়সর্বস্ব হাত থেকে মুখোশটা তুলল আলোক। তার বাবা, নবীনবাবুর ভাই, খুবই ভালোমানুষ ছিলেন। বোকা ছিলেন। ভাইয়ের কাছ থেকে অত বড়ো ধাক্কাটা খেয়েও কিচ্ছু করতে পারেননি। সে তখন অনেক ছোটো। কিন্তু সে সব বুঝত। মায়ের চোখের জল, বাবার দীর্ঘশ্বাস। বন্ধুবান্ধব বিশেষ ছিল না। ওই একটেরে ভাড়াবাড়ির ঘুপচি ঘরে যখন শ্বাস বন্ধ হয়ে আসত তার, তখন সে ছুটে চলে যেত তার একমাত্র সঙ্গী, বন্ধু, শিক্ষক ভোলাঠাকুরের কাছে। ভোলাঠাকুর শুধু কুমোর ছিলেন না। তিনি নানারকম বিদ্যেও জানতেন। তিনি নিজে হাতে ধরে আলোককে শিখিয়েছিলেন মানুষের নানা রিপুকে কীভাবে মাটির ছাঁচে বন্দি করা যায়। তিনি বলতেন যে লোকের যা চাহিদা, তা যদি প্রয়োজনের থেকে অনেক বেশি হয়, তাহলে সেই অতিরিক্ত রিপুকে এক বিশেষ খাঁচা টেনে নিতে পারে নিজের ভেতরে। বন্দি করে রাখতে পারে তাকে। সে খাঁচা লোভ দেখায়, টোপ ফেলে ধীরে ধীরে বন্দি করে তার শিকারকে। সে খাঁচা গড়ার নিয়ম তিনি শিখিয়েছিলেন ছোট্ট আলোককে। নিজের কাকার মুখের আদলে একটু একটু করে আলোক সেই খাঁচা-মুখোশ গড়ে তুলেছিল। সে চেয়েছিল, কাকার অতিরিক্ত লোভ যেন বন্দি হয়ে যায় ওই মাটির কারাগারে। তাহলে কাকা আর কোনো মানুষের ক্ষতি করতে পারবেন না তাদের মতো। আজ এত বছর পর, বহু চেষ্টায় কাকার সন্ধান পেয়েছিল সে। তাঁর বিষয়ে খোঁজ নিয়েছিল। তাঁর শখের ব্যাপারে জেনেছিল। তারপর তাঁর অফিসের সামনে মুখোশওয়ালা সেজে দাঁড়াতে আরম্ভ করেছিল। তিনদিনের মাথাতেই কাজ হয় তার। কাকা মুখোশটা কেনেন।
আজ সে সফল। তার চোখের সামনে কাকার অচেতন দেহ আর শো-কেসের ওপর রাখা শূন্যচোখের মুখোশটা। কিন্তু সেটা আর প্রাণহীন নয়। আলোক শুনতে পাচ্ছে, তার ভিতর থেকে উঠে আসছে কাকার তীব্র স্বর। “দাও দাও দাও! আলো দাও, বাতাস দাও, স্বস্তি দাও…”
মুখোশটার ডান গালে সদ্য গজিয়ে উঠেছে এতদিন কাকার গালে থাকা কালো তিলটা।
----------
ছবি - সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
No comments:
Post a Comment