সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
রবিবার, ছুটির দিন। অন্তু সবে জলখাবার খেয়ে অংকের হোমটাস্ক নিয়ে বসেছিল। একটা ল.সা.গু করতে গিয়ে সে হিমশিম খাচ্ছে, ঠিক তখনই তার কানে একটা অদ্ভুত শব্দ এল। শব্দটা ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসছিল। জানলার ধারে বসে থাকায় আপনা থেকেই তার চোখ চলে গেল বাইরে। এক মুহূর্তের ঝলকেই যা দেখল, তাতে অন্তুর চক্ষু চড়কগাছ। খটখটিয়ে চার পা ফেলে দৌড়ে গেল একটা ঘোড়া। না, ঠিক ঘোড়া নয়, মানে চারটে পা, লেজ সব ঘোড়ার মতো হলেও সামনের দিকটা তো একটা মানুষের মতো! দুটো হাত, পেট, বুক, মাথা – এ কী! সেন্টর! গ্রিক পুরাণের বইতে এর ছবি তো দেখেছে অন্তু। চোখ কচলে আবার তাকাল। ততক্ষণে সেই জন্তুটা সামনের মোড় ঘুরে দৃষ্টির অন্তরালে চলে গেছে।
এই শহরের এক প্রান্তে নদীর ধারে শ্মশান। বৃদ্ধ সনাতন মণ্ডল মারা গেছেন আজ ভোররাতে। তাঁকে দাহ করতে নিয়ে এসেছে আত্মীয়-পরিজন সহ পাড়ার জনা দশেক লোক। বডি ইলেকট্রিক চুল্লিতে ঢোকানোর আগে সরকারি নিয়মকানুন মেনে দরকারি কাগজপত্রে সই-সাবুদ চলছে। ডাক্তারের দেওয়া ডেথ সার্টিফিকেটও রয়েছে। খাটিয়ায় শোয়ানো আছে সাদা চাদরে মোড়া শবদেহ। খাটিয়ার পাশে বসে অপেক্ষা করছে কয়েকজন। হঠাৎ তাদের হাউমাউ চিৎকারে সবাই চমকে উঠে দেখল চাদরটা নড়ছে এবং এক পলকের মধ্যেই চন্দ্রবিন্দুপ্রাপ্ত সনাতন মণ্ডল দিব্যি উঠে বসলেন সেই খাটিয়াতে এবং ফ্যালফ্যাল করে চারদিকে তাকাতে লাগলেন। সকালের খটখটে আলোতেও এমন দৃশ্য দেখে সবার আতঙ্কে চিৎকার করাটা স্বাভাবিক।
* * *
ল্যান্ডিংটা খুব একটা জুতসই হল না ধী-এর। হাতঘড়িতে ফিট করা দিকনির্দেশক যন্ত্রে একটা গোয়ালঘরের সন্ধান পেয়ে তার পাশে ডাঁই করে রাখা খড়ের গাদায় নামবে ভেবেছিল সে, যান্ত্রিক লোকেশনের সামান্য গোলমালে সেটা হয়ে গেল গোয়ালের খড়ের চাল। সবসুদ্ধ ভেঙে হুড়মুড়িয়ে সে যেখানে পড়ল, সেখানে অনেকটা গোবর জড়ো করা ছিল। হাতে-পায়ে সে সব মাখামাখি হয়ে এক বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড! ওদিকে জাবর কাটতে কাটতে সাদা গোরুটা তাকে দেখে মনে হয় বিষম-টিষম খেয়ে গেল। তার বিকট গলার আওয়াজ শুনে লাঠি হাতে ভুবন ঘোষ ছুটতে ছুটতে এসে ধীকে দেখে পুরো ভ্যাবাচ্যাকা। ধী ততক্ষণে নিজের পোশাকে লাগানো ছোট্ট জেট স্প্রেয়ার মেশিন দিয়ে সারা গায়ে লেগে থাকা গোবর ধুয়ে ফেলে আবার ইনবিল্ট হিটার দিয়ে জলটা শুকিয়ে নিচ্ছিল। ভুবন ঘোষকে অমনভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে ছোট্ট করে ‘সরি, কিছু মনে করবেন না। একটু ব্যস্ত আছি। পরে একদিন আলাপ করব আপনার সঙ্গে, কেমন?’ বলে সেখান থেকে মুহূর্তে ধাঁ হয়ে গেল। ভুবনবাবু আর তার গোরু দুজনেই প্রায় একই ভঙ্গিতে তখনও দাঁড়িয়ে।
আসলে বড়োসড়ো একটা গোলমাল হয়ে গেছে। ধী সহ আরও অনেক ‘ব্রহ্মাণ্ড শৃঙ্খলা সমিতি’-র সদস্যের মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। একটা বাক্স হারিয়ে গেছে। সামান্য একটা বাক্স? না, না, সামান্য কে বলেছে? ওর মধ্যে আছে অজস্র টুকরো জুড়ে বানানো এই বিশ্বের রকমারি জীব, এমনকি আদিকাল থেকে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলা কিছু ব্যবস্থার সাংকেতিক আর যান্ত্রিক প্রতিরূপ। দেখতে যতই সাধারণ খেলনার বাক্সের মতো হোক, ওর এক একটা টুকরো ওলট পালট হয়ে যাওয়া মানেই মহাবিশ্বের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাওয়া! তা এ হেন বাক্স হারাল কীভাবে?
আসলে এই ব্রহ্মাণ্ডে দুষ্টু শিশুর তো অভাব নেই! সে এই মর্ত্যলোকেই হোক বা ‘ব্রহ্মাণ্ড শৃঙ্খলা সমিতি’-র মুখ্য দপ্তর, যাকে অনেকে ‘স্বর্গ’ বলে ডাকে, সেখানেও তারা বহাল তবিয়তে আছে। তেমনই একজনের কীর্তির ফলে সেই বাক্সটা কঠিন পাহারায় থাকা প্রহরীদের চোখ এড়িয়ে সেই দস্যির হাতে এসে গেছিল। তারপর ধরা পড়ার ভয়ে স্থান-কালের এক গুপ্ত ছিদ্রপথের মধ্যে দিয়ে সে টুপ করে ওটা ফেলে দিয়েছে। ব্যস! অমনি সেই ছিদ্রপথও বন্ধ হয়ে গেছে আর প্রহরীদের মাথায় পড়েছে বাজ! এখন কোথায় সে বাক্স গেছে, কার কাছে, এসব খুঁজতে যা সময় লাগবে তার মধ্যে যদি কেউ ওটার সাহায্যে কোনো সর্বনাশ করে ফেলে?
তড়িঘড়ি দক্ষ প্রহরীদের একটা দল অন্তরীক্ষে সেটা খুঁজতে বেরিয়ে পড়ল। পৃথিবীসহ যে সব গ্রহে মানুষ বা উন্নত প্রাণীদের বসতি আছে তাদের সবক’টাতেই তারা ছড়িয়ে পড়ল। তারপর নিজেদের সঙ্গে থাকা অত্যাধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে বাক্সটার যথাসম্ভব স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট স্থানাঙ্ক অনুসন্ধান করতে শুরু করল তারা। ধী হল তাদেরই একজন, পৃথিবীর আকাশে এসেই সে যন্ত্রের সিগন্যাল থেকে টের পেল, বাক্স এখানেই আছে! উত্তেজনায় তার হৃদস্পন্দনের গতি বেড়ে গেল কয়েকগুণ।
তবে বাক্সটার একেবারে সুনির্দিষ্ট লোকেশন পাওয়া একটু ঝামেলার। একে তো এত ছোটো একটা জিনিস, তার মধ্যে এত মানুষের মধ্যে কে সেটাকে পেয়েছে কে জানে? আর পেয়ে তো এক জায়গায় বসেও থাকবে না সে। প্রতি মুহূর্তেই অবস্থান পালটে যাওয়ার আশঙ্কা। তবে একটাই উপায় আছে সেটাকে চিহ্নিত করার। যদিও সে উপায়টা বেশ বিপজ্জনক। কেউ যদি ওই বাক্সের ভিতরের জিনিসগুলোকে নিয়ে তাদের গঠন এলোমেলো করে দিতে থাকে, তাহলে জগতে যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে, তার থেকে পাওয়া যাবে এক একটা সংকেত। সেই সংকেতের সূত্র ধরেই বিশৃঙ্খলার উৎস অর্থাৎ বাক্সের বর্তমান মালিকের কাছে পৌঁছানো যাবে।
ধী বারবার সেই সংকেতগুলো পাচ্ছিল আর একটু একটু করে অভীষ্টের কাছে আসছিল। তার মনের মধ্যে একটা অজানা ভয়ও খেলে যাচ্ছিল। যে বাক্সটা পেয়েছে সে ওটা নিয়ে আর যাই করুক, দুটো বিশেষ জিনিসে যেন হাত না দেয়! এক একটা করে গোলমালের আভাস পেয়ে সংকেত অনুসরণ করে সে অকুস্থলে পৌঁছে তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণের সাহায্যে দেখছিল ঠিক কোন কোন টুকরো নিয়ে এবারের গণ্ডগোলটা পেকেছে! শ্মশানের দিক থেকে আসা শোরগোলটার খবর পেয়েই সে দ্রুত সেখানে পৌঁছোল। আশঙ্কাটা মনে হচ্ছে সত্যি। একজন মৃত ব্যক্তি বেঁচে উঠেছেন! এটা তখনই সম্ভব, যখন… যখন সময়-সূচক যন্ত্রের কাঁটা উলটোদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হবে! তার মানে সেই দুটো জিনিসের একটা ইতিমধ্যেই সেই ব্যক্তির হস্তগত। আর শুধু হাতেই আসেনি, সে রীতিমতো সেটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। সময় উলটোদিকে বইতে শুরু করলে ভয়ংকর সব কাণ্ড ঘটবে। মৃতরা আবার জীবিত হয়ে উঠবে, সদ্যোজাতরা অস্তিত্বহীন হয়ে যাবে!
টিক, টিক, টিক… সময় বয়ে যাচ্ছে। সামনে নয়, পিছনে! সবার অজান্তেই। শুধু ধী এই সময় কাঠামোর খামখেয়ালির বাইরে। স্বতন্ত্র অবস্থানে থেকেও তার মন শঙ্কিত। যে করে হোক একে ঠেকাতেই হবে। আবার সব আগের মতো অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। তার জন্য সবার আগে চাই ওই বাক্সটা। কোথায় কার কাছে রয়েছে সেটা?
তার সতর্ক চোখ-কান উদ্ভ্রান্তের মতো খুঁজতে থাকে তাকে। একটা বড়ো রাস্তার মোড়ে আসতেই তার কবজিতে লাগানো যন্ত্রে হঠাৎ করেই সিগন্যালের তীব্রতা বাড়ে। তার মানে খুব কাছেই রয়েছে ওটা! কোথায়? কোথায়? প্রচুর গাড়িঘোড়া এখানে। চকিতে তার চোখ স্থির হয় বামদিকের ফুটপাথের উপর একটা বিশেষ জায়গায়। পলিথিন শিট পেতে ছোটো একটা সংসার। একপাশে মা ইটের উনুনে কাঠকুটো জ্বেলে হাঁড়িতে ভাত রাঁধছেন আর তাঁর ছোটো ছেলেটি, বছর ছয়েক বয়স হবে, তার হাতে রংচঙে কয়েকটা টুকরো। আর তার পাশে… তার পাশে খোলা পড়ে আছে সেই বহু আকাঙ্ক্ষিত বাক্স! হ্যাঁ, ঠিক তাই। ওটাই তো সেই বাক্স! ভালো করে তাকিয়ে ধী দেখল ছেলেটার পাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা জিনিসগুলোর মধ্যে একটা ঘোড়ার পুতুলের অর্ধেকটার সঙ্গে জুড়ে রয়েছে একটা মানুষের অর্ধেক, একটা বিশেষ ঘড়ির কাঁটা উলটোদিকে ঘুরে চলেছে আর এখন ছেলেটা যে ঘনকের আকারের রঙিন বস্তুটা হাতে তুলে নিচ্ছে সেটা ওই অতি বিপজ্জনক দ্বিতীয় জিনিসটা! কী সর্বনাশ!
ধী চিৎকার করে তাকে সাবধান করতে গেল, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই ছেলেটা ঘনকের দুটো দিক ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক করে ফেলল, অনেকটা রুবিক কিউবের মতো। তার ফলে যা হওয়ার তাই হল। আকাশের একটা অংশ এক ঝটকায় মাটিতে নেমে এল, রাস্তার একটা দিক ছিটকে উঠে গেল উপরে। ডান দিকের বাড়িগুলো চলে এল বামদিকে আর বামের লোকজন, গাড়িঘোড়া সব হুড়মুড়িয়ে ডাইনে চলে এল। চারদিকে হুলুস্থুলু কাণ্ড। কী হচ্ছে কেউ কিছু বুঝতে পারছে না। বুঝছে শুধু ধী। ছেলেটার কিন্তু কোনো হুঁশ নেই। সে আপনমনে ঘনকটা নিয়ে নাড়াচাড়া করে যাচ্ছে। ওটা যে আসলে মহাজাগতিক স্থানের অক্ষ আর দিক নির্ণায়ক ঘনক সেটা ও বেচারা জানবেই বা কী করে?
ধী বামদিকে ছুটে তাকে ধরতে যাচ্ছিল, কিন্তু এতক্ষণে সে চলে গেছে ডানদিকে। আবার সেদিকে দৌড়োতেই ছেলেটার হাতের আরেক মোচড়ে ধী যেখানে ছিল, সেই জায়গাটা লাফ দিয়ে উঠে গেল শূন্যে! নাহ্, এভাবে ওকে পাকড়াও করা তো প্রায় অসম্ভব। স্থানের এই ভয়াবহ জ্যামিতির মধ্যে পড়ে সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছে। সবার আগে দরকার এই পরিবর্তনটা থামানোর। ধী মাথা ঠান্ডা রেখে নিজের হাতে আটকানো যন্ত্রের একটা বিশেষ বোতামে চাপ দিল। সঙ্গে সঙ্গে যেন ম্যাজিক ঘটল। আশেপাশের সমস্ত কর্মকাণ্ড, মানুষজন এক লহমায় থমকে গেল। গতিময়তা বজায় রাখতে পারল শুধু দু’জন। ধী আর সেই ছেলেটা। বাকি বিশ্বের সময়কে কিছুক্ষণের জন্য থমকে দাঁড় করিয়েছে ধী।
এবার সে ছেলেটার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াল। “ওগুলো আমাকে দাও, খোকা।”
তার নরম কণ্ঠে অনুনয়ের সুরে বলা কথাগুলোর সপাট জবাব এল ছেলেটার মুখ থেকে, “না। কেন দেব? এগুলো আমার। আমি খেলব।”
সত্যিই তো। যে ছেলে কখনও কোনো ভালো খেলনা দেখেনি সে এমন মজার জিনিস হাতছাড়া করবে কোন দুঃখে? অন্য উপায় ভাবতে হবে। এত ছোটো একটা বাচ্চার সঙ্গে চালাকির আশ্রয় নিতে হচ্ছে ভেবে ধীর একটু খারাপ লাগল, তবে আর তো উপায়ও নেই। সে ছেলেটার মগজের ভিতরে জমে থাকা সাম্প্রতিক স্মৃতির খানিকটা অংশ দিয়ে খুব দ্রুত ওই বাক্স আর তার ভিতরের পুতুল বা খেলনাগুলোর একটা করে ত্রিমাত্রিক প্রতিরূপ বানিয়ে ফেলল। যেটা দেখতে পাবে শুধু সে আর ধী নিজে। তারপর একটা সামান্য হাতসাফাই। চোখের পলকে আসল বাক্স আর তার সামগ্রীগুলো চলে এল ধীর নাগালে আর ছেলেটা তারই স্মৃতি দিয়ে বানানো খেলনা বাক্সের নকল প্রতিরূপ নিয়ে মগ্ন হয়ে থাকল, যেটা নিয়ে হাজার নাড়াচাড়া করলেও আর কোনো বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে না কখনও।
ধী একটা স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার সময় আর স্থানের যন্ত্রগুলোকে যার যার নিজের সঠিক অবস্থানে ফেরত পাঠিয়ে দিল, যাতে সব আবার আগের মতো হয়ে যায়। এই বিগত কিছু সময়ের গণ্ডগোলের কোনো চিহ্ন আর কোথাও থাকবে না, মানুষজনের স্মৃতিতেও থাকবে না এই অবিশ্বাস্য ঘটনাক্রম। তারপর হুশ করে পৃথিবী ছেড়ে ‘ব্রহ্মাণ্ড শৃঙ্খলা সমিতি’-র সদর দপ্তরের দিকে রওনা দিল ধী। আরেকটা কাজ বাকি আছে। বাক্সটা ঠিক জায়গায় রেখে তো আসতে হবেই, কিন্তু কোন বিচ্ছু এটা সরিয়েছিল তাকে খুঁজে বের করতেই হবে। যাতে ভবিষ্যতে আর এমন অনিষ্ট না করতে পারে, তার জন্য উচিত শিক্ষা দিতে হবে তাকে। নাহ্, শুধু শাস্তি নয়, তার উপযুক্ত একটা কিছু খেলনাও দিতে হবে বটে! মনে মনে হেসে ফেলল ধী। বাচ্চারা সব জায়গাতেই একরকম।
----------
ছবি - লেখক
No comments:
Post a Comment