দুই বোন, দুই শ্বেতকালী
সমুদ্র বসু
জগৎ জননী মা কালী, পরম
শক্তির আধার, তাই তো তাঁকে নানারূপে নানাভাবে মাতৃরূপে উপাসনা করা হয়। বাংলার
বিভিন্ন প্রান্তে, শহর থেকে গ্রাম নানা অঞ্চলে শক্তি আরাধনা তথা মা কালীর পূজা হয়ে
আসছে প্রাচীনকাল থেকেই। অঞ্চলভেদে একেক রূপে তাঁর আরাধনা করা হয়ে থাকে। ভক্তের
সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছেন তিনি, তাই তো দৈবিক সত্ত্বার বাইরেও, তিনি হয়ে উঠেছেন ঘরের
মেয়ে। আবার তিনিই 'মা'। আজ আমরা জানব তেমনই দুই কালীর কথা যাদের রং সাদা আবার যারা
দুই বোন কালী নামেও পরিচিত।
------ রাজবল্লভী, রাজবলহাট, হুগলী |
রাজবল্লভী,
রাজবলহাট, হুগলী
রাজবলহাটের
সবুজ ঘেরা শান্ত পরিবেশে বিরাজ করছেন মা রাজবল্লভী। মন্দির অঙ্গনে ঢোকার আগেই একটা
গোড়া বাঁধানো বটগাছ। মন্দির প্রাঙ্গণে অনেকটা জায়গা জুড়ে নাটমন্দির আর উঁচু
ভিতের উপরে প্রতিষ্ঠিত অনাড়ম্বর মন্দির। অনন্য সুন্দর দেবীর গাত্রবর্ণ সাদা, তাই
রাজবল্লভী মাতা শ্বেতকালী নামেই অধিক পরিচিত। দেবীর মাথায় কারুমণ্ডিত মুকুট। দেবী
ত্রিনয়না। হাত দুটি। ডান হাতে ছুরি, সামনের দিকে প্রসারিত বাম হাতে রুধির অর্থাৎ
রক্তের পাত্র। স্মিত হাসি ও প্রসন্নতায় ভরা মুখমণ্ডল, ডাগর ডাগর চোখ। পদপ্রান্তে
শায়িত কালভৈরবের বুকে দেবীর ডান পা। আর দেবীর বাঁ পা স্পর্শ করে আছে সুদর্শন
বিরূপাক্ষের মাথা। দেবীর কণ্ঠ নরমুণ্ডমালা ও কোমরে মনুষ্য হস্তের কোমরবন্ধনী আছে।
তবে, তা দৃশ্যমান নয়। কারণ, দেবী ১৪ হাত শাড়ি পরিহিতা।
১১৯২ সালে দিল্লি অধিকার করেন পাঠান সুলতান মহম্মদ ঘোরী। ঠিক সেইসময়
ভুরসুট পরগণার রাজা ছিলেন শনিভাঙ্গর। তাঁর মৃত্যুর পর রাজা হলেন চতুরানন। টানা চল্লিশ
বছর রাজত্ব করার পর তিনি ভুরসুট সিংহাসনে অভিসিক্ত করলেন তাঁর জামাতাকে। অনুমান,
বছর দশেক রাজত্ব করার পর জামাতা রাজা সদানন্দের মনে বৈরাগ্য জন্মাল। একদিন রাজা
সদানন্দ তাঁর নিজেরই শিকার করা পশুদের সামনে বিষণ্ণ মনে দাঁড়িয়ে ভাবছেন যে, তিনি
এমন-ই নরাধম! ব্রাহ্মণকুলে জন্মগ্রহণ করেও শুধুই রাজরক্ষায় নিজেকে আবদ্ধ রেখেছেন।
অস্তগামী সূর্যের আলোয় রাজা হঠাৎই লক্ষ করলেন, রুদ্রাক্ষমালা পরে এক ব্রাহ্মণ
ধ্যানমগ্ন অবস্থায় বসে আছেন পদ্মাসনে। রাজা কাছে গিয়ে প্রণাম করলেন। তারপর রাজা
স্ব-ইচ্ছায় ব্রাহ্মণকে তাঁর নিজের মনের দ্বন্দ্বের কথা জানালেন। ব্রাহ্মণ এরপর
রাজাকে শক্তিমন্ত্রে দীক্ষত করেন। ব্রাহ্মণের উপদেশেই রাজা সদানন্দ শিবসাধনায়
সিদ্ধিলাভ করেন। ওই সাধনাকালেই দ্বিভুজা মহামায়া, ষোড়শী রমণীমূর্তি রূপে দেখা দেন
রাজাকে। মা রাজাকে আদেশ করেন, এই জায়গাতেই যেন তাঁর (মা রাজবল্লভী) মূর্তি
প্রতিষ্ঠা ও পুজোর ব্যবস্থা করা হয়। এরপরই সাধক রাজা সদানন্দ বরাভয়দায়িনী, নৃ-মুণ্ডমালিনী,
শ্বেতকালিকা দেবী রাজবল্লভী মায়ের প্রতিষ্ঠা করেন রোন নদী ও দামোদর নদের মাঝামাঝি
ভূখণ্ডে। জন্ম হল এক নতুন গ্রামের। নাম হল রাজবল্লভহাট। চতুরাননের ৪০ বছর আর
সদানন্দের ১০, এই মোট ৫০ বছর ধরলে আনুমানিক (১১৯২+৫০) ১২৪২ সালে রাজবল্লভীর
প্রতিষ্ঠা বছর ধরা যেতে পারে। এখন থেকে কমবেশি ৭৭০ বছর আগে শ্বেতকালী তথা মা
রাজবল্লভীর প্রথম মন্দির ও বিগ্রহ প্রতিষ্ঠাকাল। পূর্বে নাম ছিল রাজপুর। রাজা
সদানন্দ রায় দেবী প্রতিষ্ঠার পর নামকরণ করেন রাজবল্লভীহাট। দেবীর নামানুসারে হল
গ্রামের নাম। কালক্রমে সে নাম রূপান্তরিত হয়ে দাঁড়াল রাজবল্লভহাট। এখন পরিচিত
হয়েছে রাজবলহাট। এটি দামোদর নদের পূর্ব তীরে। পশ্চিম তীরে ডিহি ভুরসুট গ্রাম।
প্রতি ১২ থেকে ১৪ বছর অন্তর মায়ের নবকলেবর (নতুন মূর্তি) তৈরি হয়
গঙ্গাজল আর গঙ্গামাটি দিয়ে। সেই দেবীমূর্তিকে বৈশাখ মাসে শুভ অক্ষয় তৃতীয়ার দিন
প্রতিষ্ঠা করা হয়। যে কারণে অক্ষয় তৃতীয়ার দিন ভোরবেলা মায়ের বিশেষ পুজো
অনুষ্ঠিত হয়। এখানে দুর্গাপুজো মহাসমারোহে পালন করা হয়। নবমীর দিন হয় ছাগবলি
এবং পুরোনো রীতি মেনে মহিষ বলিও হয়। ওইদিন মায়ের অন্নভোগ হয় না। মাকে ওই দিন
ছাতুভোগ নিবেদন করা হয়। এছাড়া চৈত্র সংক্রান্তির দিনও অন্নভোগের পরিবর্তে মাকে
নিবেদন করা হয় চিঁড়েভোগ। বছরে এই দু'দিন ছাড়া
সারা বছর মাকে অন্নভোগ নিবেদন করা হয় এবং সেই প্রসাদ ভক্তরাও পেয়ে থাকেন। তার জন্য
সকাল সাড়ে দশটার মধ্যে ২৫ টাকার বিনিময়ে কুপন সংগ্রহ করতে হয়। তবে এখানে অনধিক
৭০০ জনের বসে প্রসাদ গ্রহণের ব্যবস্থা আছে। বর্তমান দেবীমন্দিরে গর্ভগৃহের একটি
খপ্পর আছে। ছাগ ও মেষবলির পর খণ্ডিতদেহ ফেলা হয় ওই খপ্পরে। কথিত আছে, ওই খপ্পর
নির্মিত স্থানটিতে রাজা সদানন্দ রায়ের পঞ্চমুণ্ডির আসন ছিল। রাজা মন্দির
নির্মাণের সঙ্গে নাটমন্দির, নহবতখানা, শিবমন্দির ও প্রতিদিন ভোগের জন্য নির্মাণ
করলেন রন্ধনশালা। কালের নিয়মে সদানন্দ নির্মিত কোনো কিছুই একসময় আর রইল না।
পরবর্তীকালে এগুলি সব নতুন করে নির্মাণ ও সংস্কারের কাজ সম্পন্ন করেছেন বিভিন্ন
ভক্ত ও স্থানীয় সম্পন্ন গ্রামবাসীরা। তবে যাত্রীদের স্নানের জন্য রাজার খনন করানো
বড়ো পুকুরটি আজও আছে মন্দিরের সামনে।
রাজবল্লভী মায়ের মন্দির পরিচালনার জন্য যদিও একটি স্বতন্ত্র কমিটি
আছে, কিন্তু মা তাঁর সারা বছরের পুজোর খরচ চালানোর ব্যবস্থা নিজেই করে রেখেছেন।
মায়ের নামে একটি বড়ো দিঘি এবং বেশ কয়েকটি পুকুর আছে। আছে বেশ কয়েক বিঘা জমিও।
আর মায়ের নামাঙ্কিত জমিতে বেশ কিছু দোকানঘর ভাড়া দেওয়া আছে। এইসব মিলিয়ে বছরে
যা আয় হয় তা দিয়েই মায়ের সেবা হয়। এছাড়াও মায়ের অগণিত ভক্তের সক্রিয়
সহযোগিতা তো আছেই। বিশেষ করে ওই গ্রামসাসীদের। কারণ এখানে একটা প্রচলিত রীতি আছে
যে, যাঁর বাড়িতে বা জমিতে প্রথম যে ফলটা হয় তা রাজবল্লভী মাকে উৎসর্গ করেন। এমনকি
নিজের পুকুরের মাছও। বছরের পুজোর ভার পালা করে চলে। যাঁর যখন পালা হয় তখন তিনিই
সব ব্যবস্থা করে থাকেন। কিন্তু ওই যে ভোগের জন্য মাথাপিছু ২৫ টাকা করে নেওয়া হয়
তার থেকে জনপ্রতি ১ টাকা করে যায় মা রাজবল্লভীর এস্টেটে। প্রতি শনি, রবিবার এবং
ছুটির দিনগুলিতে প্রচুর জনসমাগম হয়। মন্দিরের দরজা খোলা হয় সকাল সাতটায়। পুজো
শুরু হয় সকাল এগারোটায়। রাজবল্লভী মায়ের সঙ্গে নিত্যপুজো হয় গণেশ, বাসুদেব,
লক্ষ্মী, সরস্বতী, ভগবতী ও মা ষষ্ঠীর। নারায়ণসহ অন্যান্য দেবদেবীদের প্রতিদিন
নিরামিষ অন্নভোগ হয়। দুপুর দেড়টায় হয় দেবীর ভোগ নিবেদন। ভাত, ডাল, সব রকমের
সবজি দিয়ে তরকারি, তেঁতুল দিয়ে মাছের অম্বল এবং পায়েস। এরপর সন্ধ্যারতি হয়
সাতটায়। আরতি শেষে মাকে নিবেদন করা হয় লুচি, সন্দেশ ও ছানা। বছরে দু-দিন দুর্গানবমী
ও চৈত্র সংক্রান্তিতে অন্নভোগ হয় না। রাজবল্লভী মাকে প্রায় সারাদিনই পুজো দেওয়া
যায়। সব শেষে মাকে তামাক সেজে দিয়ে দরজা বন্ধ করা হয়। মায়ের মন্দির খোলা থাকে
সকাল ৭টা থেকে টানা রাত ১০টা পর্যন্ত (শীতে রাত ৮টা)।
----- সিদ্ধেশ্বরী, আঁটপুর, হুগলী |
সিদ্ধেশ্বরী,
আঁটপুর, হুগলী
স্বামী বিবেকানন্দ
ও তাঁর গুরুভাইদের স্মৃতিবিজড়িত গ্রাম আঁটপুর হুগলী জেলার হরিপালের কাছে অবস্থিত৷
১৭০৮ সালে তৈরি মিত্রদের রাধাগোবিন্দের আটচালা শৈলীর মন্দিরটির টেরাকোটার কাজ
অতুলনীয়৷ বাংলার প্রাচীন কাঠ খোদাইয়ের অন্যতম নিদর্শন মেলে কাছের চন্ডীমন্ডপে৷
স্বামীজীর গুরুভাই স্বামী প্রেমানন্দের জন্মস্থান আঁটপুর৷ আঁটপুর মন্দিরময়৷ বহতা
নদীর ধারে অবস্থিত আঁটপুর গ্রামটি আটটি গ্রামের সমন্বয়ে গঠিত৷ আটটি গ্রাম তড়া,
বোমনগর, কোমরবাজার, ধরমপুর, আনারবাটি, রানিরবাজার, বিলাড়া, লোহাগাছি৷ বর্ধমান রাজা
তিলোকচন্দ্র বাহাদুরের দেওয়ান কৃষ্ণরাম মিত্র বৈদ্যবাটির নিমাইতীর্থের ঘাট থেকে
গঙ্গাজল, গঙ্গামাটি এনে সেই মাটি পুড়িয়ে তাতে ইট তৈরি করে রাধাগোবিন্দের মন্দির
নির্মাণ করেন৷ টেরাকোটার কাজের জন্য তিনি বিষ্ণুপুর থেকে মৃৎশিল্পী আনান৷ মন্দিরটি
প্রায় ১০০ ফুট উঁচু৷ মন্দিরের সম্মুখভাগে ও দুই পাশের দেয়ালে অজস্র টেরাকোটার
প্যানেল আছে৷ সামাজিক দৃশ্য থেকে পৌরাণিক দৃশ্য সবই দেখা যায় টেরাকোটার ক্ষুদ্র
প্যানেলে৷
এই আঁটপুরেই রয়েছে আরেক প্রাচীন মন্দির - সিদ্ধেশ্বরী শ্বেত কালী
মন্দির। আঞ্চলিক জনশ্রুতি অনুযায়ী আঁটপুরের সিদ্ধেশ্বরী শ্বেত কালী ও পার্শ্ববর্তী
গ্রাম রাজবলহাটের রাজবল্লভী দুই বোন। গড় ভবানীপুরের রাজা সদানন্দ প্রতিষ্ঠা করেন
রাজবলহাটের রাজবল্লভী। সেখানকার রানি তারাদেবীকে এই সিদ্ধেশ্বরী শ্বেত কালী
স্বপ্নাদেশ দেন আঁটপুরে তাঁকে প্রতিষ্ঠা করতে। স্বপ্নের মাধ্যমেই তিনি জানিয়েছিলেন
তাঁর রূপের কথা। পূর্ণিমার পূর্ণ চন্দ্রের মতন যেন তাঁর রূপ হয়, এ
কথাই তিনি জানান রানিকে। রানি তখন
মাতৃ মন্দির প্রতিষ্ঠা ছাড়াও মন্দিরসংলগ্ন ৩৬৫ বিঘা জমিও দান করেন। আগে মায়ের
মূর্তি ছিল অষ্টধাতু নির্মিত। বাংলার ১৪০০ সালে প্রাচীন মন্দিরটি সম্পূর্ণ
ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে মাতৃভক্ত গ্রামবাসীগণ মন্দিরটি পুনঃনির্মাণ করেন। তারা দেবী মাতৃ
মন্দিরের দু’পাশে দুটি শিব মন্দির নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। বর্তমানে
সেই দুটির পুনর্নির্মাণের কাজ চলছে। ১৪২০ সালের ৮ জ্যৈষ্ঠ মায়ের নতুন মূর্তি
স্থাপন করা হয়। চতুর্ভুজা শ্বেত কালী। ডান হাতে অভয় ও বর মুদ্রা আর বাম হাতে খড়্গ
ও কাটা মুন্ডু। রাজবল্লভী মায়ের মতনই আমিষ ঘ্যাঁট তরকারি মায়ের প্রধান ভোগ।
এই
দুই কালী দুই বোন হোক আর না হোক, এই সব জনশ্রুতি আর ইতিহাস আজ যেন মিলেমিশে সবকিছুকেই বিশ্বাসে
পরিণত করেছে।
----------
ফোটো - লেখক
No comments:
Post a Comment