ডাইনি ও জলপরি
সুমন্ত্র ঘোষ
(১)
ইংল্যান্ডে লন্ডন থেকে পূর্ব দিকে অনেক অনেকটা গেলে দেখা যাবে
সমুদ্রের গা থেকে সাদা একটা পাহাড় খাড়া উঠে গেছে। সেই
পাহাড়ের মাথায় ছোট্ট একটা গ্রামে মানুষ একটু নিরিবিলিতে থাকে।
বাইরের লোকজন খুব একটা সেই গ্রামে যায় না,
কারণ পাহাড়ে ওঠার রাস্তাটা এতটাই খাড়া যে গাড়িতে দু-খানা ঘোড়া জুতিয়েও
কোনো রকমে আস্তে আস্তে উঠতে হয়। তিনটে
ঘোড়া হলে ভালো ওঠা যায় বটে, কিন্তু একটা
গাড়ির পেছনে তিনটে ঘোড়ার খরচা ক’টা মানুষ করতে পারে!
তাছাড়া একফালি পাহাড়ি রাস্তায় পাশাপাশি তিনটে ঘোড়া ছোটানোও বেশ বিপদের।
কাজেই বাইরের লোক তেমন আসত না বলে গ্রামটা নিয়ে বেশি কথা জানা
ছিল না তেমন কারও।
গ্রামের লোকজনের কাজ বলতে সাদা পাথরের তৈরি নানারকমের রান্নার
জিনিসপত্র বা মূর্তি বানিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে চাপিয়ে পাহাড় থেকে একটু দূরের এক শহরে
বিক্রি করা। তারপর সেই পয়সায় গ্রামের
দরকারি খাবারদাবার আর মশলাপাতি কিনে ফিরে আসা। তাছাড়া
গ্রামে কিছু শাকসবজির বাগান আছে। পাহাড়ের
যে দিকটা ভাঙা পাথরের ধাপে ধাপে সমুদ্রে গিয়ে মিশেছে সেদিক দিয়ে নেমে মাছ ধরতে যায়
কয়েক ঘর মানুষ। সমুদ্র ভীষণ উত্তাল সেখানে;
জলের মাঝে এবড়ো খেবড়ো পাহাড় ডুবে থাকে বলে সেগুলো কাটিয়ে মাছ ধরা
ভীষণ বিপদের। নৌকা ডুবে কত লোক যে ভেসে চলে
গেছে তার কোনো ঠিক নেই। মাছ ধরা হলে নৌকাগুলো পাথরের
খাঁজে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। তবে
ঝড়-ঝঞ্ঝা এলে নৌকাগুলো পাথরের গায়ে ধাক্কা খেয়ে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।
আর সমুদ্রের এই দিকটায় ঝড়ঝাপটা প্রায়ই আসত।
এইভাবেই কষ্টেসৃষ্টে ভয়ের সঙ্গে লড়াই করে জীবন কাটত তাদের।
একদিন বিকেলে বাইরের শহর থেকে ঘোড়ার গাড়িতে করে পাহাড় বেয়ে
উঠছিল হেনরি। গাড়ি ভরতি করে পাথরের তৈরি
মাদার মেরি আর জিশু খ্রিস্টের মূর্তি পৌঁছে দিয়ে চাল,
গমের বস্তা নিয়ে ফিরছে সে। মূর্তিগুলো
গ্রামের অনেক আলাদা আলাদা কারিগর তৈরি করেছে। হেনরির
কাজ শুধু তার ঘোড়ার গাড়িতে করে নিয়ে গিয়ে শহরের দোকানে দিয়ে আসা।
আর গ্রামের মুরুব্বিদের কথামতো কিছু খাবারদাবার কিনে গাড়িতে চাপিয়ে
ফেরা। এই কাজের জন্য অল্প কিছু টাকা
পায় ও। কিন্তু হেনরির লোভ তেমন নেই।
যা পায় তাই নিয়েই খুশি থাকে।
সন্তর্পণে ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে আস্তে আস্তে সরু রাস্তা দিয়ে
উঠছিল হেনরি। তার পথের বামদিকে খাড়া পাহাড়
উঠে গেছে ওপরে। আর ডানদিকে নেমে গেছে খাদ।
এই পাহাড় কেটে রাস্তা কারা বানিয়েছিল তা জানে না হেনরি।
শুনেছে প্রথম যখন ওদের গ্রামে গির্জা তৈরি হবে বলে ঠিক হয়েছিল
কয়েকশো বছর আগে, তার পরেই এই রাস্তা কাটা
হয়। তার আগে পায়ে হেঁটে উঠতে হত
পাহাড়ে। ওদের গ্রামে খাবার তখন কীভাবে
আসত, তা নিয়ে কোনো ধারণা নেই হেনরির।
যদিও যাতায়াতের পথে এসব নিয়ে ভাবতে ওর দিব্যি লাগে।
কিছুদূর এগোনোর পর হেনরি দেখতে পেল বামদিকের এক গুহা দিয়ে ঘন
সাদা ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে গলগলিয়ে। খাড়া
পাথরের গায়ে পর পর গুহা আছে অনেকগুলো। কিছু
কিছু গুহার মুখ এত সরু যে সেগুলোকে ফোকর বলা যায়। তেমনি
কোনো এক গুহা দিয়ে বেরিয়ে আসছে ধোঁয়া। সাধারণত
বৃষ্টি হলে এই গুহাতে পাহাড়ি ছাগল আর অন্যান্য জন্তু জানোয়ার আশ্রয় নেয়, কিন্তু তেমন বৃষ্টি তো
হয়নি শেষ ক’দিন। তাছাড়া
আগুন কি পশুপাখি জ্বালতে পারে? ঘোড়াদুটো
গুহার কাছে এসে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। চিন্তান্বিত
মুখে চাবুকের খোঁচা মারল হেনরি ঘোড়া দুটোর গায়ে। তারা
একটু নড়ল বটে, কিন্তু এগিয়ে যাওয়ার
কোনো লক্ষণ নেই। এদিকে ঢালু রাস্তায় প্রতিমুহূর্তে
গাড়ি নিচে গড়িয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। হেনরি
তাই প্রচণ্ড জোরে চাবুক কষাল ঘোড়া দুটোকে। কিন্তু
বৃথা চেষ্টা। ঘোড়াগুলোর পা যেন মাটিতে গেঁথে
দিয়েছে কেউ। গাড়ি থেকে নেমে গায়ের জোরেই
ঘোড়াদুটোর লাগাম সামনের দিকে টেনে ধরল হেনরি, তাও একচুল নাড়াতে পারল না তাদের।
এদিকে হেনরি খেয়াল করল না কখন সেই ধোঁয়া বেরোনো পাহাড়ি গুহা
থেকে বেরিয়ে তার পেছনে দাঁড়িয়েছে ছোটোখাটো চেহারার এক বুড়ি।
তার মাথায় কালো লম্বা বাঁকানো টুপি,
গায়ে ধূসর রঙের এক গাউন আর হাতে সাদা রঙের সরু মুগুরের মতো লম্বা একটা
লাঠি। টুপির নিচ থেকে সাদা শনের মতো
চুলগুলো ছড়িয়ে পড়েছে পিঠে। সরু
কাঠির মতো আঙুল তার আর লম্বা বাঁকানো নাক। চোখের
মণি দুটো লালচে আগুনের মতো। হেনরি
ঘোড়াগুলোকে টেনে নড়াতে না পেরে বিরক্ত হয়ে পেছন ফিরেই বুড়িকে দেখতে পেয়ে ভয়ে
দু-পা পিছোতে গিয়ে ধড়মড়িয়ে উলটে পড়ল রাস্তার উপরে। এই
ফাঁকা জায়গায় এমন একটা দৃশ্য দেখে প্রথমেই সে দৌড়ে পালাতে চাইল সেখান থেকে।
কিন্তু কোনোরকমে উঠে দাঁড়াতে পারলেও,
দৌড়োতে গিয়ে একটা পাও নড়তে পারল না হেনরি।
ঐ ঘোড়াগুলোর মতো ওরও কেমন যেন পা আটকে গেছে রাস্তার উপরে।
হতোদ্যম হয়ে বুকে ধড়ফড়ানি নিয়ে আবার ওই বুড়ির দিকে তাকিয়ে
চমকে উঠল হেনরি। বুড়ি কোথায়!
তার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে মাঝববয়সি এক মেয়ে।
তার গায়ে চমৎকার সবুজ পোশাক, মাথায় ফুল লাগানো এক গোল টুপি। হাতে
লাঠির বদলে একটা ঝুড়ি ধরা। মেয়েটা
কি জাদু জানে? হেনরি অবাক হয়ে তার
দিকে তাকিয়ে থাকল। মেয়েটা
হাতের ঝুড়ি হেনরির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “ভয় পেয়ো না। তুমি
যা খাবার নিয়ে যাচ্ছ তার থেকে আমাকে এক ঝুড়ি দাও। যখনই
গাড়ি নিয়ে ফিরবে আমাকে এক ঝুড়ি খাবার দিয়ে যাবে। তাহলে
তোমার গ্রামের আর কোনো বিপদ হবে না।”
হেনরি একটা ঘোরের মধ্যে সেই ঝুড়ি ভরতি করে খাবার দিল।
এছাড়া তার আর কী-ই বা করার ছিল? খাবার নিয়ে মেয়েটা গুহায় ফিরে যেতেই
আবার ছটফটিয়ে উঠল ঘোড়াগুলো। হেনরি
গাড়িতে চেপে কোনোরকমে ছুটে চলল গ্রামের দিকে। সন্ধের
গায়ে গায়ে যখন পৌঁছোল সে, তখন গির্জায় সন্ধের
প্রার্থনা শুরু হয়েছে। গ্রামের
বেশিরভাগ লোক জড়ো হয়েছে সেখানে। হেনরি
গির্জার কাছে ঘোড়ার গাড়ি থামিয়ে এক লাফে গাড়ি থেকে নেমে গির্জার ভারী দরজা হুড়মুড়িয়ে
খুলে ঢুকে পড়ল সেখানে।
সন্ধের প্রার্থনা সেদিন আর জমল না। গ্রামের
মুরুব্বিদের আলোচনা শুরু হয়ে গেল ঘটনাটা নিয়ে। আর্থার
নামের একজন মুরুব্বি বললেন, “কিছুদিন অপেক্ষা করে
দেখাই যাক না। ডাইনি যখন বলেছে অল্প কিছু
খাবার দিলে গ্রামের কোনো ক্ষতি করবে না, তখন শুধু শুধু ঝামেলা করে কী লাভ?” এ কথা শুনে গির্জার
ফাদার দাঁত খিঁচিয়ে বললেন, “আমি থাকতে গ্রামে ডাইনির উৎপাত হবে
এটা আমি মানতে পারব না। কেন
দেব আমাদের কষ্ট করে জোগাড় করা খাবার ওকে? ওকে উৎখাত করা দরকার। আমি
তো আছি সঙ্গে। ভয় কীসের?”
বাকি মুরুব্বিরা ফাদারের পক্ষে মত দিলেন।
একটু পরে মশাল জ্বেলে গ্রামের লোকেরা হাতে বল্লম নিয়ে যে যার
ঘোড়ায় চড়ে বসল। ঠিক হল শুরুর ঘোড়াতে ফাদার
থাকবেন। কিন্তু হঠাৎ ঘোড়াগুলোর কী
হল কে জানে, তারা সবাই একসঙ্গে চিৎকার
করে সামনের দুটো পা ওপরের দিকে তুলে গা ঝাড়া দিয়ে উঠল।
ঘোড়ার উপর থেকে বেশ কিছু লোক পড়ে গিয়ে চিৎকার চেঁচামেচিতে ভরে
উঠল চারদিক। কারোর কারোর মশালের আগুন ছিটকে
ছড়িয়ে পড়ে জ্বলে উঠল আশেপাশের শুকনো ঘাস আর ঝোপঝাড়। কেউ
খেয়াল করল না এর মধ্যেই আকাশে ঘনিয়ে উঠেছে ঘন কালো মেঘ আর হঠাৎ করে এক দমকা বাতাসে
চারপাশে যেন ধুলোর ঝড় উঠল। প্রায়
সমস্ত গাছ থেকে সব ক’টা পাখি একসঙ্গে ডেকে
উঠল রাতের অন্ধকার ভেদ করে। বাতাসের
দমকে গির্জার কিছু জানলার কাচ ঝনঝনিয়ে ভেঙে পড়ল চারদিকে আর একসঙ্গে সমস্ত গির্জার
ঘন্টাগুলো দুলে উঠে যা গম্ভীর শব্দ শুরু হল তাতে ভয়ে বুক শুকিয়ে গেল সবার।
ফাদার তাড়াতাড়ি গির্জায় ফিরবেন বলে ঘোড়ার দিকে হাত বাড়াতেই
ঘোড়া সামনের দু-পা তুলে নাক দিয়ে এমন
আওয়াজ করল যেন খুরের চাঁট মারবে এখুনি। আর্থার
বলে উঠল, “আমি বলেছিলাম একটু অপেক্ষা করে দেখা যাক।
কী দরকার ছিল এসব করার? আমাদের নিজে থেকে কোনো ক্ষতি তো করতে আসছিল না।”
শেষ অবধি আর্থারের কথাটাই মানা হল। ফাদার
চাইলেও তাঁর কথায় আর রাজি হল না গ্রামের কেউ। সবাই
কিছুদিন অপেক্ষা করতে রাজি। তিনদিন
পরে রাত্রিবেলা প্রচণ্ড ঝড় উঠল সমুদ্রে। সারারাত
দমকা হাওয়ার সঙ্গে ভারী বৃষ্টি হল গ্রামে। জেলেরা
মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। পাথরের
গায়ে ধাক্কা লেগে কতগুলো নৌকা যে ভাঙবে তার নেই ঠিক। রাত
জুড়ে চিন্তা করার পর ভোরবেলা ঝড় থামলে জেলেরা পাহাড়ের গা বেয়ে সমুদ্রের ধারে গিয়ে
দেখল যে সব ক’টা নৌকা অটুট আছে।
সেই থেকে গ্রামে নিয়ম হয়ে গেল খাবার নিয়ে ফেরার পথে প্রতিবার
গাড়ি থেকে এক ঝুড়ি খাবার দিয়ে আসতে হবে ডাইনিকে।
(২)
দুপুরে খাবারের পর ম্যাটি সমুদ্রের দিকের ভাঙা পাথরগুলোর উপর এসে
একটু বসে। এই সময় এই দিকটা একদম নিরিবিলি
থাকে। জেলেরা ভোরে মাছ ধরতে বেরিয়ে
সেই বিকেলের দিকে ফেরে। গ্রামের বাকিরা খাওয়াদাওয়া
করে নিজের ঘরে একটু শুয়ে বসে আরাম করে নেয়। ম্যাটির
নিজের বাড়ি বলতে তো কিছু নেই। আর্থারের
বাড়ির এক কোণের একটা ছোট্ট ঘরে থাকে ও। আর
আর্থারের সঙ্গে পাথর কেটে মূর্তি তৈরি করে। এত
ছোটোবেলায় বাবা-মাকে হারিয়েছে ও যে তাদের
কোনো স্মৃতিই ওর নেই। পৈতৃক
বাড়িটাও রক্ষণাবেক্ষণ হয় না বলে একেবারে ভেঙেচুরে গেছে। ম্যাটির
ইচ্ছে আছে একদিন অনেক টাকা করতে পারলে ওই বাড়ি সারিয়ে থাকতে শুরু করবে ও।
কিন্তু আর্থারের সঙ্গে কাজ করে যা অল্প রোজগার হয়,
সেই টাকা জমাতে সারাজীবন না লেগে যায় ওর!
এই যে এখন একা ও বসে আছে আর সবাই কী সুন্দর তার বাবা মা ভাই বোনেদের
সঙ্গে আরাম করছে ঘরে - এতে একটু হলেও মন খারাপ
হয় ম্যাটির। আগে আরও হত।
কিন্তু এই সতেরো বছর বয়েসে অনেকটা অভ্যেস হয়ে গেছে মন খারাপ।
ওর যে নিজের কেউ নেই শুধু তাই নয়,
গ্রামের কারোর সঙ্গে ঝগড়া হলেও ওর হয়ে কেউ কথা বলে না।
অথচ অন্য সবার হয়ে বলার কেউ না কেউ আছে। ও
যে দুর্বল এটা বুঝতে পেরে ওর বয়সি কিছু ছেলে ওকে একা পেলেই উলটোপালটা বলে।
ও চুপচাপ সরে যায় সেখান থেকে। এসব
মেনে নেওয়া অভ্যেস হয়ে গেছে তার। মাঝে
মাঝে মনে হয় এই গ্রাম ছেড়ে অনেক দূরে চলে যেতে পারলে বড়ো ভালো হত,
যেখানে ও সব কিছু নতুনভাবে শুরু করতে পারত।
হয়তো কোনো একদিন বেরিয়ে পড়বে ও। এই
গ্রামের প্রতি তার বিন্দুমাত্র টান নেই।
দুপুরে এখানে কোনো এক পাথরের ছায়ায় একা বসে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে
থাকতে থাকতে মন ঠান্ডা হয়ে যায় ওর। এই
জায়গাটা বড়ো সুন্দর। দূর দূর অবধি সাদা মেঘ ছাওয়া
আকাশ আর ঘন নীল ঢেউ খেলানো জল ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না। কোনো
মানুষের চিহ্নমাত্র নেই। এই বেশ ভালো।
যত পাহাড়ের দিকে এসেছে জল, তত যেন সবুজ হয়ে উঠেছে তার রং। সেই
স্বচ্ছ জলের নিচে পাথরে লেগে থাকা শ্যাওলা, তাদের ফাঁকে ফাঁকে হলুদ বালি আর রংচঙে ঝিনুক কাঁপা-কাঁপা দেখা যায়।
অনেক দূরে দিগন্তের কাছে জেলে নৌকা বিন্দু বিন্দু দেখা যায় আকাশের
গভীরে ডানা মেলা পাখিদের মতো। সেই
নৌকাগুলো যখন ফিরতে থাকবে ম্যাটিকেও আবার ফিরতে হবে আর্থারের কাছে বিকেলের কাজে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে নৌকাগুলোর থেকে চোখ সরিয়ে সমুদ্রের ধারের পাথরগুলোর
দিকে তাকাতেই চমকে উঠল ম্যাটি।
সমুদ্র থেকে উঠে থাকা একটা বড়ো পাথরের আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে ওর
দিকেই তাকিয়ে আছে একটা মেয়ে। ভিজে
চুল ছড়িয়ে আছে তার শরীরে, যেন এইমাত্র সমুদ্রে
ডুব দিয়ে এসেছে সে। বড়ো
বড়ো দু’চোখে গভীর আগ্রহ তার, কিন্তু
যেন বড়ো ভয় পেয়ে লুকিয়ে আছে পাথরের খাঁজে। কে
এই মেয়ে! ম্যাটি তো একে কখনও দেখেনি গ্রামে।
কত বয়স হবে মেয়েটার? ওর মতোই কি? ম্যাটি মেয়েটার দিকে হাত নাড়তেই মেয়েটা
ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গিয়ে তড়িঘড়ি ঝাঁপ দিল জলে। ম্যাটি
দেখল তার পায়ের জায়গাটা যেন একটা মাছের লেজের মতো। জলে
সেই রুপোলি লেজ একবার ঝাপটা খেল, তারপর কোথায়
যেন হারিয়ে গেল মেয়েটা।
ব্যাপারটা বুঝতে কয়েক মুহূর্ত লাগল ম্যাটির।
ততক্ষণে উত্তেজনায় গলা শুকিয়ে গেছে তার।
যাকে দেখল সে কি মৎস্যকন্যা? যে মৎস্যকন্যাদের গল্প ও অনেক শুনেছে গ্রামের জেলেদের কাছে? এরা দেখতে নাকি খুব সুন্দর হয় আর চমৎকার গান গাইতে পারে।
গানের সুরে যেন জাদু আছে তাদের। কেউ
বুঝত না আগে যে, সুর যতই মোহময়ী হোক,
আসলে এই মৎসকন্যারা রাক্ষুসি। মানুষকে
মেরে তাদের বড়ো আনন্দ। তাদের সুরেলা গলা শুনে মন্ত্রমুগ্ধ
হয়ে জেলেরা জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে মৎস্যকন্যাদের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করত আগে,
আর তাদের জলে ডুবিয়ে মারত এই রাক্ষুসিরা।
যদিও ম্যাটি যাদের থেকে গল্প শুনেছে সেই জেলেরা কেউ নিজে দেখেনি
মৎস্যকন্যা, তবে আগের যুগের জেলেরা
দেখেছে। তাদের গল্পগুলো রয়ে গেছে সাবধানবাণী
হিসেবে যে এই মৎস্যকন্যাদের দেখলেই পালিয়ে যেতে হবে যতটা দূরে সম্ভব।
তবে কি ম্যাটি সেই রাক্ষুসিদের একজনকেই দেখে ফেলল?
লাফিয়ে উঠে ম্যাটি দৌড়োল গ্রামের দিকে। এই
খবরটা সবাইকে না দেওয়া অবধি তার শান্তি নেই।
(৩)
পাথরের গায়ে ছেনি হাতুড়ির শেষ ঘাগুলো মারতে মারতে স্বস্তির শ্বাস
ফেলল ম্যাটি। দুপুরের খাবার সময় হয়ে আসছে।
এখুনি কয়েকঘণ্টার জন্য ছুটি পাওয়া যাবে।
আর ও গিয়ে বসবে সমুদ্রের ধারের সেই বড়ো পাথরগুলোর কাছে।
গ্রামে এখন মূর্তি তৈরির নতুন একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে
- সেটা হচ্ছে মৎস্যকন্যার মূর্তি। শহরে
নাকি ভালোই বিক্রি হচ্ছে সেগুলো। এই
ভাবনাটা আর্থারের মাথাতেই প্রথম আসে। ও
ম্যাটিকে একদিন বলে, “পাথর কুঁদে একটা মৎস্যকন্যার
মূর্তি বানা তো দেখি। তোর
কত কল্পনাশক্তি আছে দেখব।”
ম্যাটি বারো দিন পরে যখন মূর্তি তৈরি শেষ করেছিল তখন গোটা গ্রামের লোক
অবাক হয়ে দেখতে এসেছিল। মৎস্যকন্যার
এমন ছোট্ট মায়াবী মুখ আর তাতে টানা টানা মায়াবী চোখ দেখে খুশি হয়েছিল সবাই।
তারপর থেকে অন্যান্য মূর্তি তৈরির কারখানায় ম্যাটির দেখাদেখি
অনেকে ওরকম মৎস্যকন্যা গড়ার চেষ্টা করে, কিন্তু কোনোটাই ম্যাটির মতো এত সুন্দর হয় না। যারা
নিজের চোখে ওই মায়াময় দৃশ্য দেখেনি তারা শুধু কল্পনা করে কি আর খুব ভালো মূর্তি বানাতে
পারে?
তবে ম্যাটির দুঃখ হয় এই ভেবে যে তিনমাস আগের সেই ঘটনা কেউ বিশ্বাস
করল না। সেদিন দৌড়ে ও যখন গ্রামের
দিকে আসছিল তখন একটু দূরে একটা ঝাঁকড়া গাছের নিচে দাঁড়িয়ে গল্প করছিল গ্রামের কয়েকজন
ছেলে - ওরই বয়সি। ও
সেখানে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে সমুদ্রের দিকে হাত তুলে কোনোরকমে বলল,
“মৎস্যকন্যা! মৎস্যকন্যা! পাথরের আড়ালে ছিল!” ওর কথা ভালো করে শেষ হতে না হতেই
বেশ একটা শোরগোল পড়ে গেল। বেশ
কয়েকজন দল বেঁধে ছুটে গেল পাথরগুলোর দিকে। বাকিরা
চিৎকার করে গ্রামের বাকিদের ডাকতে লাগল। সবাই
মিলে দৌড়ে এ-পাথর ও-পাথরের খাঁজে আঁতিপাঁতি
করে অনেক খুঁজেও কোনো চিহ্ন দেখতে পেল না মৎস্যকন্যার। ম্যাটি
বুঝিয়ে বলল যে সে তো আর এখানে নেই। জলে
ঝাঁপ দিয়ে চলে গেছে অন্য কোথাও। লোকের
তাও আগ্রহের শেষ নেই। শেষে হুগো বলে একটা ছেলে বলল,
“ম্যাটি সত্যি মৎস্যকন্যা দেখেছে তো? আমার তো বিশ্বাস
হয় না। আমার বাবা এতদিন ধরে মাছ ধরতে
যায়, আজ অবধি কখনও দেখতে পেল না কিছু।
আর ম্যাটি নাকি গ্রামে বসে দেখে ফেলল।”
অন্য একজন পেছন থেকে বলল, “সেই তো। মৎস্যকন্যা ওকে দেখলে গান গেয়ে
টেনে নিয়ে যেত। ছেড়ে দিত নাকি?”
তারপর ম্যাটি যেন কিছু আর বলতে সুযোগই পেল না।
সবাই মিলে ওকে খোঁচা মেরে কথা বলতে লাগল। আর্থার
তো বলেই বসল, “আরে দূর, মৎস্যকন্যা না ঘোড়ার ডিম। ওই
ডাইনিকে যেদিন থেকে আমরা খাবার দিতে শুরু করেছি, তবে থেকে আমাদের গ্রাম সুখে শান্তিতে আছে। কোথাও
কোনো বিপদ নেই। হঠাৎ এক রাক্ষু্সি আসবে কোথা
থেকে। এই ম্যাটি মিথ্যে কথা বলে হইচই
লাগিয়ে দিল। এদিকে কাজের সময় পেরিয়ে গেল
ওর। দিব্যি একবেলা কাজের হাত থেকে
বেঁচে গেল।”
এটা শুনে সবচেয়ে কষ্ট পেয়েছিল ম্যাটি। যতদিন
ও কাজ করছে আর্থারের কারখানায় ও এক মুহূর্তের জন্যেও ফাঁকি দেয়নি।
তাও আর্থার সবসময় ওকে দূরছাই করে। সবার
সামনে ছোটো করে। সেদিন ওর আধবেলার মাইনে কেটে
নিয়েছিল আর্থার। তার পরেও যে ম্যাটি মৎস্যকন্যার
এতগুলো সুন্দর মূর্তি বানিয়েছে, তাতে গ্রামের
কত মানুষ প্রশংসা করেছে, কিন্তু আর্থার একবারের জন্যেও ওর পিঠ
চাপড়ে দেয়নি।
গ্রামের সবার মনোভাব দেখে ম্যাটি ভয়ে কাউকে বলতে পারেনি যে এই
তিনমাসে ও ওই মৎস্যকন্যাকে আরও কয়েকবার দেখেছে। ওই
পাথরগুলোর ফাঁক থেকে মায়াবী চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থেকেছে ও। শুরুর
দিকে ম্যাটির চোখ মৎস্যকন্যার দিকে পড়লেই ভয়ে জলের মধ্যে লুকিয়ে পড়ত মৎস্যকন্যা।
এখন আর তেমন হয় না। এখন
দিব্যি জল থেকে ভেসে উঠে একটা চ্যাটালো পাথরের উপরে দু-হাতে ভর দিয়ে ম্যাটিকে আগ্রহ
নিয়ে দেখতে থাকে মেয়েটা। তার
ভিজে চুল আর গাল বেয়ে জল ঝরে পড়ে মুক্তোর দানার মতো। শেষ
দু-দিন ম্যাটি একটু একটু করে এগিয়ে গেছে মেয়েটার
দিকে। সচকিত হয়ে মৎস্যকন্যা বড়ো
বড়ো চোখে তাকিয়ে থেকেছে তার দিকে, কিন্তু সরে যায়নি। ম্যাটিও
একেবারে কাছে যাওয়ার সাহস পায়নি তা বলে। এতদিন
ধরে এই মৎস্যকন্যাদের নিয়ে এত গল্প শুনেছে - সেই ভয় কি আর অত সহজে যায়!
তবে এটা নিয়ে অনেক ভেবেছে ম্যাটি কাল সারারাত।
মেয়েটাকে দেখে ওর কিছুতেই রাক্ষসী বলে মনে হয় না।
মানুষ অনেক কিছুই বানিয়ে বলে অন্যের নামে।
আর্থার ওর নামে তো সবসময় খারাপ কথা বলে। সেগুলো
কি সত্যি? তাছাড়া ও তো জন্ম থেকে শুনে আসছে ডাইনি বুড়ির
উপদ্রব হলে পুরো গ্রাম ছারখার হয়ে যায়। কাজেই
ডাইনি দেখতে পেলেই দল বেঁধে তাকে ধরে আগুনে পুড়িয়ে মারতে হবে।
কিন্তু বাস্তবে হল তো তার উলটো। সামান্য
খাবারের বিনিময়ে এই ডাইনি তাদের পুরো গ্রামকে রক্ষা করছে। সব
ডাইনি হয়তো খারাপ হয় না। কেউ কেউ হয়।
যেমন মানুষের মধ্যেও আর্থারের মতো কিছু বাজে লোক থাকে।
তাহলে এই মেয়েটিকেই বা আগেভাগে রাক্ষসী বলা হবে কোন যুক্তিতে?
মেয়েটা তো কারোর কোনো ক্ষতি করেনি। কখনও
গান গেয়েও জলের দিকে টেনে আনার চেষ্টাও করেনি ম্যাটিকে। ম্যাটি
আজ ঠিক করেছে মেয়েটার একদম কাছে যাবে। চেষ্টা
করবে কথা বলার।
দুপুরে ছুটি পেয়ে তাড়াতাড়ি খাওয়াদাওয়া সেরেই ম্যাটি দৌড়ে
গেল সেই পাথরগুলোর কাছে। আজ মেয়েটা আগে থেকেই দাঁড়িয়ে
ছিল একটা পাথরের আড়ালে। যেন ম্যাটির জন্যই অপেক্ষা
করছিল ও। ম্যাটি দৌড়ে ওর কাছে গিয়ে
মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল ওর জলে ভেজা মুখটার দিকে। মেয়েটা
একটু একটু করে পিছিয়ে যেতে থাকল জলের দিকে। তার
চোখে ভয় নেই, বরং কোথাও যেন চুম্বকের
মতো সম্মোহন আছে। সেই জাদু ডাক উপেক্ষা করার
ক্ষমতা ম্যাটির নেই। মন্ত্রমুগ্ধের মতো দুরু দুরু
বুকে জলের দিকে এগিয়ে যেতে থাকল ম্যাটি।
(৪)
কয়েকমাস পরে তার ডিঙি নৌকা নিয়ে দ্রুত গ্রামের দিকে ফিরছিল ন্যাথাম।
আজ মাছ ধরতে একটু দূরেই চলে গিয়েছিল ও। তাই
অন্যরা একটু আগে ফিরে এলেও দেরি হয়ে গেছে ওর। সূর্য
তখন ডুবে গিয়ে দিগন্তের ওপার থেকে লালচে হলুদ রঙের ক’টা রশ্মি আকাশের বুকে ছুড়ে দিয়েছে শেষ আলোটুকু পৃথিবীকে দেওয়ার জন্য।
সেই আলোয় তেজ তেমন নেই। বরং
ছাড়া ছাড়া সাদা মেঘের সঙ্গে মিশে কমলা রঙের আভার মতো ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে।
ওই বড়ো বড়ো পাথরগুলোতে তখন ছায়া ছায়া কালচে অন্ধকার জমতে শুরু
করেছে। ন্যাথামের একটু ভয় যে করছে
না, তাই নয়। কিছুদিন
আগে ম্যাটি গ্রাম থেকে উধাও হয়ে যাওয়ার পর থেকে ন্যাথামের বেশ গা ছমছম করে সন্ধের
পর। ন্যাথামের মনে হয়েছিল এই পাথরগুলোর
ধারে খুঁজে দেখা উচিত সেই রাক্ষুসি মৎস্যকন্যাকে যার কথা ম্যাটি বলেছিল।
কিন্তু খুব একটা কেউ পাত্তা দেয়নি। বিশেষত
আর্থার।
আর্থার বলেছিল, “বাঁদর ছেলের সবসময় পালিয়ে যাওয়ার শখ ছিল। ভালো
হয়েছে পালিয়ে গেছে। এমনিতেও কাজকর্ম তেমন কিছু
করত না। বরং আমার ঘরে থাকাখাওয়া করে
আমার খরচা বাড়াচ্ছিল।”
আর্থার ছিল ম্যাটির বাবার বন্ধু। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর আর্থারের কাছেই বড়ো হয়েছে ম্যাটি।
সেই আর্থারের কোনো গা নেই ম্যাটিকে খোঁজার।
তাই অন্যরাও আর পাত্তা দেয়নি। ন্যাথাম
বলেছিল, “যে পালাবে সে তো পোঁটলা বেঁধে নিজের জামাকাপড়
নিয়ে যাবে। নিজের জিনিস ফেলে কেউ পালায়?”
আর্থার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেছিল, “ওর কথা ভেবে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। ডাইনি
বুড়ি আসার পর থেকে আমাদের গ্রামের কোনো ক্ষতি হয়নি। কাজেই
ম্যাটি পালিয়ে গেলে সুস্থ শরীরেই গেছে।”
ওই ডাইনির উপর একদম শুরু থেকেই অগাধ আস্থা আর্থারের।
কাজেই ন্যাথাম আর কথা বাড়ায়নি। গ্রামের
কিছু লোক তাও সমুদ্রের ধারে একটু উঁকিঝুঁকি মেরেছিল, কিন্তু তেমন কিছু খুঁজে পায়নি।
আজ ন্যাথাম প্রায় যখন গ্রামের কাছে পৌঁছে গেছে তখন একটা কালো
চ্যাটালো পাথরের উপরে আবছা একটা মেয়ের অবয়ব দেখে চমকে উঠল রীতিমতো।
কেমন যেন মনে হল একটা যুবতী মেয়ে পাথর থেকে ধীরে ধীরে নেমে পড়ল
জলের মধ্যে আর তারপর ডুব দিয়ে কোথায় যে হারিয়ে গেল আর দেখা গেল না।
শুধু মনে হল যেন একটু বড়ো মাছের রুপোলি লেজের মতো কিছু একবার ঝাপটে
উঠল জলের মাঝে। ভয়ে হাড় হিম হয়ে গেল ন্যাথামের।
পাথরগুলোর কাছে পৌঁছে নৌকা, জাল, মাছ সব রইল পড়ে, ও কাঁপতে
কাঁপতে দৌড়ে গেল গ্রামের দিকে।
ন্যাথামের কথা ফেলে দেওয়ার মতো ক্ষমতা গ্রামের লোকেদের ছিল না।
নাথাম অভিজ্ঞ জেলে। চোখের
ভুল হওয়ার কথা নয় ওর। গ্রামের সবার ধারণা হল যে ভোলাভালা
ম্যাটিকে দিয়ে খাওয়া শুরু করেছিল রাক্ষুসি। এখনো
খিদে মেটেনি। এরপর আবার কাকে টেনে নিয়ে
যাবে কে জানে! তাই সবাই মিলে সন্ধের
অন্ধকারে মশাল জ্বেলে ছুটল ডাইনি বুড়ির গুহার দিকে। ডাইনি
তো বলেছিল ওদের গ্রামে কোনো বিপদ আসতে দেবে না। বুড়ির
জাদুক্ষমতা নিয়েও কারোর কোনো সন্দেহ নেই। কাজেই
প্রতিকারের জন্য ওর কাছেই যাওয়া ভালো।
গ্রামের লোকেদের ডাকে মশাল হাতে গুহা থেকে বেরিয়ে এল ছোটো একটা
মেয়ে। বয়স তার চোদ্দো পনেরো হবে।
ডান হাতের মুঠোয় ধরা কী একটা গুঁড়ো অন্য হাতের মশালের আগুনে
ছিটিয়ে দিতেই সবুজ একটা শিখা দপ করে উঠল একবার আর মুহূর্তের মধ্যে ধোঁয়ায় ভরে উঠল
চারপাশ। সেই ধোঁয়ার দমকে নাক চোখ জ্বালা
করে উঠল সবার। মুখ ঢেকে কাশতে কাশতে হাঁপ
ধরে গেল প্রায়। চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এল।
তারপর বেশ কিছুক্ষণ পরে কাশি থামলে সবাই সামনের দিকে তাকিয়ে দেখে
সেই ডাইনি বুড়ি দাঁড়িয়ে আছে। বুড়ি
যে কখন শরীর পালটে ফেলে কেউ ধরতে পারে না।
ওদের দিকে তীব্র চোখে তাকিয়ে বুড়ি বলল,
“লজ্জা করে না তোদের এখন নিজেদের দরকার পড়তে আমার কাছে দৌড়ে এসেছিস?
আর ম্যাটি যখন হারিয়ে গেল তখন একজনও এসেছিলি খোঁজ নিতে? বাপ-মা মরা ছেলেটাকে নিয়ে কোনো মায়া মমতা নেই তোদের?
তোরা কি মানুষ? ইচ্ছে করছে তোদের সবক’টাকে দমবন্ধ করে মেরে দি।”
গ্রামবাসীরা কী বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে রইল।
ন্যাথাম এগিয়ে এসে বলল, “আমি কিন্তু ভেবেছিলাম ম্যাটির কথা। কিন্তু
ওর এমনিতেই গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল, তাই আমরা ভেবেছিলাম ও শহরের দিকে কোথাও চলে গেছে।”
ন্যাথামকে দেখে বুড়ি একটু নরম হল। ন্যাথামের
মনটা যে নোংরা না তা ও জানে। বুড়ি
বলল, “ঐ মৎস্যকন্যা কিছুদিন আগে তার পরিবারের সঙ্গে
সাঁতরে বেড়াচ্ছিল সমুদ্রে। এক
বিরাট ঝড়ে হঠাৎ করে দলছুট হয়ে এদিকে চলে এসেছে। তার
পর থেকে বাবা-মাকে খুঁজে পায়নি ও।
এই পাথরগুলোর ফাঁক দিয়ে একটা সুড়ঙ্গ মতো আছে।
ভেতরের দিকটা বেশ বড়ো একটা ঘরের মতো। সেখানে
থাকে ও। ম্যাটির সঙ্গে ভালোই বন্ধুত্ব
হয়েছে মেয়েটার। এখন ওর সঙ্গেই দিব্যি নিশ্চিন্তে
থাকে ম্যাটি।”
অন্য একজন জিজ্ঞেস করল, “মৎস্যকন্যা মেরে ফেলেনি
ওকে? ও রাক্ষুসি না?”
বুড়ি জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে বলল,
“সবার মধ্যেই ভালো খারাপ থাকে। সব
মৎস্যমানব বা মানবী খারাপ হয় না। মানুষও
খারাপ ভালো মিশিয়ে হয়। তোদের মধ্যে খারাপ নেই?
এই যে আর্থার সবসময় চাপ দিত ম্যাটিকে তার বাবার পু্রোনো বাড়িটা আর্থারের
নামে লিখে দেওয়ার জন্য। ম্যাটি
রাজি হয়নি। তাই তো ওর এত রাগ ম্যাটির উপরে।”
সবাই চুপ হয়ে গেল। এরপর
আর কারোর কিছু বলার থাকে না। বুড়ি
আবার বলল, “তোরা নিশ্চিন্তে থাক।
ওই মেয়ে তোদের কিছু করবে না। আর
আমি যদি কখনও বুঝতে পারি তোদের কেউ ম্যাটি বা মেয়েটির কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করছে,
আমি কিন্তু পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দেব। জ্যান্ত
পুড়িয়ে মারব তোদের। যা দূর হ এখন সব আমার সামনে
থেকে।”
(৫)
পরের দিন বিকেলে সুড়ঙ্গের ধারে একটা পাথরের গায়ে হেলান দিয়ে
বসে ছিল ম্যাটি নিশ্চিন্তে। তার
ঘাড়ে মাথা রেখে পাশে বসে ছিল সেই মৎস্যকন্যা। হলুদ
রং মাখা বিকেলে এই সূর্য ডোবার দৃশ্যটা তার বড়ো পছন্দের। এখানে
আর্থারের গালাগালি নেই, বাড়ি হারানোর ভয় নেই,
গ্রামের ছেলেদের পেছনে লাগা নেই - দিব্যি আরামের
জীবন। পাথর কেটে টেবিল চেয়ার বানাচ্ছে
এখন ম্যাটি এই পাথরের ঘরটা সাজাবে বলে। ম্যাটি
কখনও ভাবেনি তার জীবন এত সুন্দর হয়ে উঠবে। ঠিক
মানুষকে সঙ্গে পেলে নিজেকে সত্যি রাজপুত্র মনে হয় আর এই পাথরের সুড়ঙ্গকেও রাজপ্রাসাদ।
মন ভরা শান্তি নিয়ে রঙিন বিকেলের নরম আলোয় ম্যাটি দিগন্তের দিকে
তাকিয়ে রইল ঝলমলে চোখে তার রাজকুমারীর সঙ্গে।
-------------------
(Dan
Keding ও Amy Douglas-এর ‘English
Folktales’ গ্রন্থের ‘Lightening the Load’ ও ‘A
Story of Zennor’ গল্পদুটি থেকে অনুলিখিত।)
----------
ছবি - আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment