প্রবন্ধ:: ইন্দ্রজাল কমিক্‌স ও তার জাদু: ফিরে দেখা - সম্রাট লস্কর

ইন্দ্রজাল কমিক্ তার জাদু: ফিরে দেখা
সম্রাট লস্কর

ছোট্ট বন্ধুরা, আজকের এই গ্যাজেটময় জীবনে যেখানে আমাদের সবসময় ঘিরে রয়েছে স্মার্টফোন, ট্যাব, ল্যাপটপের মতো ডিজিটাল ডিভাইসগুলো, অন্তর্জাল আমাদের সবাইকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে চারিদিকেসেই সময়ে গল্প বই পড়ার সময় তোমরা বোধহয় খুব বেশি পাও না সেটাই হয়তো স্বাভাবিক তবে অন্যান্য গল্প বই না পড়লেও তোমাদের মধ্যে প্রায় সবাই যে কমিক্ পড়তে ভালোবাস সেটা নিশ্চিত বলা যায় বাংলাতে বাঁটুল দি গ্রেট, হাঁদা-ভোঁদা, নন্টে-ফন্টে বা অনুবাদে টিনটিন তো সবার প্রিয়; অনেকেই আবার সুযোগ পেলে ডুবে যাও ভারতের ডায়মন্ড কমিক্ বা আমেরিকার মার্ভেল আর ডিসি কমিক্সের পাতায় ছোটোবেলায় আমরাও তাই করতাম, তবে মার্ভেল বা ডিসি কমিক্ সেই সময়ে সহজে পাওয়া যেত না আমাদের অবশ্য ছিল ইন্দ্রজাল কমিক্ আন্দাজ করতে পারি ইন্দ্রজাল কমিক্ নিয়ে তোমাদের ধারণাটা তুলনামূলক ভাবে কম সেটা হওয়াই স্বাভাবিক, কারণ এখন আর ওই কমিক্সগুলো প্রকাশিত হয় না, পুরানো সংখ্যাগুলোও সহজে পাওয়া যায় না প্রায় হারিয়ে যাওয়া সেই ইন্দ্রজাল কমিক্ নিয়ে তোমাদের কিছু কথা বলার জন্যই এবারের এই লেখা
জনপ্রিয় সংবাদপত্রদ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া’- নাম তোমরা নিশ্চয় শুনেছ এই সংবাদপত্রের মালিকানা আছে বেনেট, কোলম্যান কোম্পানির কাছে সেই কোম্পানিই ১৯৬০-এর দশকের প্রথমদিকে সিদ্ধান্ত নেয় আমেরিকার সংবাদপত্রে প্রকাশিত জনপ্রিয় কমিক স্ট্রিপ্সগুলোকে কাহিনি অনুযায়ী নাম দিয়ে আলাদা আলাদাভাবে প্রকাশ করার শিশু সাহিত্য কমিক্ নিয়ে আগ্রহী অনন্ত পাই এই পরিকল্পনায় অগ্রণী ভূমিকা নেন এই অনন্ত পাই- কিছুদিনের মধ্যেদ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া’- চাকরি ছেড়েঅমর চিত্র কথাকমিক্ সিরিজ শুরু করবেন তবে সে কথা এখানে নয় ইন্দ্রজাল কমিক্সের জন্য প্রথমেই বেছে নেওয়া হয় লি ফকের বিখ্যাতফ্যানটমসিরিজের কাহিনি মার্চ, ১৯৬৪ প্রকাশিত হল ইন্দ্রজাল কমিক্সের প্রথম সংখ্যা – ‘দ্য ফ্যানটম্ বেল্ট মূল্য ছিল ৬০ পয়সা প্রথমদিকে ইন্দ্রজাল কমিক্ প্রতি মাসে প্রকাশিত হত ইংরেজি, হিন্দি মারাঠি ভাষায় ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ল অন্য ভারতীয় ভাষাতেওবাংলা, গুজরাটি, কন্নড়, তামিল মালায়ালাম সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চাহিদা অনুযায়ী সংখ্যাগুলো কখনও পাক্ষিক আবার কখনও বা সাপ্তাহিক হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে আশির দশকের প্রথম দিকে ইন্দ্রজাল কমিক্সের চাহিদা সব থেকে বেড়ে যায় যদিও দুর্ভাগ্যজনকভাবে বছর দশেকের মধ্যেই এই কমিক্ চিরকালের মতো বন্ধ হয়ে যায় তবে শেষের কথা একটু পরে
প্রথম কয়েকটি সংখ্যা রঙিন না হলেও, অষ্টম সংখ্যা থেকেই ইন্দ্রজাল সম্পূর্ণ রঙিন হয়ে ওঠেইন্দ্রজাল কমিক্সের প্রথম ৩২টি সংখ্যাই ছিল ফ্যানটমের অভিযান নিয়ে প্রথম দশটি সংখ্যায় ছিল ২৮টি করে পৃষ্ঠা, তার মধ্যে ফ্যানটমের জন্য ১৬টি পৃষ্ঠা নির্ধারিত, বাকি ১২টি সাধারণ জ্ঞানের জন্য তারপরের কিছু সংখ্যায় পৃষ্ঠা সংখ্যা কমলেও ২৯ নম্বর সংখ্যা থেকে পৃষ্ঠা সংখ্যা দাঁড়ায় ৩২টিতে সেটাকেই এই সিরিজের স্ট্যানডার্ড পৃষ্ঠা সংখ্যা বলে গণ্য করা যায় ফ্যানটম কমিক্সের জনপ্রিয়তা দেখে অন্যান্য চরিত্রদেরও নিয়ে আসার সিন্ধান্ত হয় একে একে আসে জাদুকর ম্যানড্রেক, মহাকাশ-অভিযাত্রী ফ্ল্যাশ গর্ডন, গোয়েন্দা রিপ কার্বি, সুপারহিরো গার্থ, নৌসেনা অভিযাত্রী বাজ সয়্যার অন্যান্যরা অবশেষে আসে এক বিশুদ্ধ ভারতীয় হিরো, বাহাদুর বাহাদুর একেবারেই ইন্দ্রজাল কমিক্সের নিজস্ব আবিষ্কার তবে ইন্দ্রজাল কমিক্ নায়ক-প্রধান, কোনো মহিলা প্রধান চরিত্র আছে রকম একটাও কমিক্ কিন্তু নেই তোমরা যারা সুপারগার্ল, ব্যাটগার্ল, ওয়ান্ডার উমান বা মিস মার্ভেল-এর কমিক্ পড়েছ বা সিনেমা দেখেছ, তোমাদের কাছে ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত লাগবে তো বটেই
ইন্দ্রজাল কমিক্সের ভিতরের আঁকাগুলো বিদেশি শিল্পীদের হলেও প্রচ্ছদটা কিন্তু আঁকতেন ভারতীয় শিল্পীরাই প্রথম পঞ্চাশটি সংখ্যার প্রচ্ছদশিল্পী ছিলেন বি. গোবিন্দ্ গোবিন্দের আঁকার মান নিয়ে কিছু প্রশ্ন অবশ্যই আছে পরের দিকের সংখ্যাগুলোর প্রচ্ছদ করার দায়িত্ব পান শেহাব বা শেখরের মতন দক্ষ শিল্পীরা শেহাবের আঁকা ফ্যানটমের প্রচ্ছদগুলো তো রীতিমতো আকর্ষণীয় সাধারণত গল্পের কোনো টান টান উত্তেজনার দৃশ্য যেখানে নায়ক কোনো বিপদে পড়েছে বা অ্যাকশনে জড়িয়ে পড়েছে সেগুলোই প্রচ্ছদে বেশি জায়গা পেত আর ছিল ইন্দ্রজাল কমিক্সের নিজস্ব লোগোএকটি জাদু প্রদীপ বা ম্যাজিক ল্যাম্প প্রথম কয়েকটি সংখ্যায় প্রচ্ছদের উপর দিকের বাম ধারে লোগো হিসেবে থাকত একটি শিশু ম্যাজিক ল্যাম্প কিছুদিনের মধ্যেই অবশ্য শিশুটি কোনো অজানা কারণে উধাও হয়ে যায়, লোগো হিসেবে থেকে যায় শুধু ম্যাজিক ল্যাম্পটি অনেকেই ওই লোগোটিকে ইন্দ্রজাল ল্যাম্প বলেই চিনতেন

-----
ইন্দ্রজাল কমিক্সের প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ, শিল্পী - বি. গোবিন্দ্

-----
শেহাবের আঁকা একটি প্রচ্ছদ

অস্বীকার করার কোনো জায়গাই নেই যে ইন্দ্রজাল কমিক্সের বিভিন্ন নায়কদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল ফ্যানটমই ১৯৩৬ সালে লি ফকের সৃষ্টি করা এই চরিত্রের জনপ্রিয়তা ষাটের দশকে ছিল আকাশছোঁয়া সেই জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করেই ইন্দ্রজাল কমিক্সের যাত্রা শুরু হয় ফ্যানটমের জনপ্রিয়তা বোঝানোর জন্য একটি তথ্য দেওয়াই বোধহয় যথেষ্ট হবে যে ইন্দ্রজাল কমিক্সের মোট ৮০৩টি প্রকাশিত সংখ্যার মধ্যে ৪১৪টি ফ্যানটমকে নিয়ে, মানে অর্ধেকেরও বেশি সংখ্যার নায়ক ফ্যানটম মূলত একবিংশতিতম ফ্যানটমের অভিযান নিয়েই কমিক্সগুলো লেখা হত বাঙ্গালার খুলি গুহার বাসিন্দা এই একুশ নম্বর ফ্যানটমের সঙ্গে আমরা দেখতে পেতাম তাঁর স্ত্রী ডায়ানা, সন্তান কিট হেলোয়েজ, পালিত-পুত্র রেক্স, পিগমিদের নেতা গুরান, জ্ঞানবৃদ্ধ মজ, ডেভিল নামের এক নেকড়ে, হিরো নামের ঘোড়া এবং অন্যান্যদের আমেরিকায় সেই সময়ে ফ্যানটম কমিক্সের সেরা অলংকরণ শিল্পী ছিলেন রে মুর কিন্তু কোনো অজ্ঞাত কারণে মুরের আঁকা ভারতে তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি ইন্দ্রজাল কমিক্সে বরং বেশি করে উইলসন ম্যাকয় বা সাই ব্যারির আঁকা কমিক স্ট্রিপগুলোই ব্যবহার করা হয়েছে তবে ফ্যানটমকে ভারতীয় পাঠক-পাঠিকাদের আরও কাছে নিয়ে আসার জন্য কিছু বিশেষ সিদ্ধান্তও নেওয়া হয় ভারতীয় আঞ্চলিক ভাষাগুলিতে ফ্যানটমের নাম হয়ে যায় বেতাল; অরণ্যদেব নামটি কিন্তু ইন্দ্রজাল কমিক্সে ব্যবহৃত হয়নি কখনও লি ফকের ফ্যানটমের দেশ ছিল বাঙ্গালা, সেই নাম তো আর ভারতীয় কমিক্সে রাখা যায় না, তাই বাঙ্গালা হয়ে যায় ডাঙ্গালা বা ডেঙ্কালি একই কারণে দুর্ধর্ষ সিং ব্রাদারহুড পরিচিত হয়সিঙ্গা জলদস্যুদল হিসেবে আর বিংশতিতম বেতালের হত্যাকারীর নাম রাম থেকে পরিবর্তন করে রাখা হয় রামালু বেশ কিছু দৃশ্য আবার বাদ দেওয়া হয় সেগুলো ভারতের ছোটোদের পড়ার উপযুক্ত নয় বলে
লি ফকের আরেক সৃষ্টি জাদুকর ম্যানড্রেকও বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল নিজের জাদুশক্তি, বিশেষত সম্মোহনবিদ্যা এবং বন্ধু লোথার আর স্ত্রী নার্দাকে নিয়ে ম্যানড্রেক শক্তিশালী প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে যেভাবে লড়ে যেত তা পড়তে দিব্যি ভালো লাগত ম্যানড্রেকের বাসার নামটিও বেশ আকর্ষণীয়জানাডু কুবলাই খানের রাজধানী জানাডুর কথা মনে করিয়ে দেয় অ্যালেক্স রেমন্ডের মহাকাশ অভিযাত্রী ফ্ল্যাশ গর্ডন আবার আমার মতো অনেকেরই খুব প্রিয় ছিল সায়েন্স-ফ্যান্টাসির ওই দুরন্ত অ্যাডভেঞ্চার কাহিনিগুলোতে ফ্ল্যাশ ছাড়াও থাকত তার বান্ধবী ডেল, ডক্টর জারকভ, যুবরাজ বারিন এবং অবশ্যই মঙ্গো গ্রহের দুষ্টু রাজা মিং ফ্ল্যাশ তার বন্ধুদের নিয়ে কীভাবে মিং-কে মঙ্গোর সিংহাসন থেকে সরিয়ে দিতে সক্ষম হয় সেই গল্পগুলিই মূলত ইন্দ্রজাল কমিক্সে আমরা পড়তাম
তবে ইন্দ্রজাল কমিক্সের নায়কদের মধ্যে বাহাদুরের কথা আলাদা করে বলা উচিত একেবারেই ভারতীয় এই হিরোর সৃষ্টি করেছিলেন আবিদ সুর্তি ডিসেম্বর, ১৯৭৬ বাহাদুরের প্রথম কমিক্দ্য রেড ব্রিক হাউসপ্রকাশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হিট চম্বলের পটভূমিকায় লেখা বাহাদুরের কাহিনিতে ডাকাতদের সঙ্গে পুলিশবাহিনীর সংঘাত প্রায়শই দেখা যেত বাহাদুর নিজেও এক মৃত ডাকাতের সন্তান যে বড়োই হয়ে উঠেছিল বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য, কিন্তু অবশেষে নিজের ভুল বুঝতে পেরে সে ডাকাতদের বিরুদ্ধে লড়াই করার সিদ্ধান্ত নেয় আবিদ সুর্তি বেনেট কোলম্যান কোম্পানি ছেড়ে দেওয়ার পর জগজিৎ উপ্পল বাহাদুরের কাহিনি এগিয়ে নিয়ে যান অলংকরণের দায়িত্ব মূলত পালন করতেন গোবিন্দ্ব্রাহমনিয়া গেরুয়া রঙের কুর্তা আর জিনস পড়া বাহাদুরের স্টাইল আশির দশকে বেশ ছড়িয়ে পড়েছিল বাহাদুরের পর ইন্দ্রজাল কমিক্ দারা নামে আরেক ভারতীয় হিরোকে নিয়ে আসার চেষ্টা করে দারা একেবারেই জনপ্রিয় হতে পারনি তবে ফ্যানটমের মতোই দারা ইন্দ্রজাল কমিক্সের সঙ্গে বিশেষভাবে যুক্ত থেকে যাবে তার ঐতিহাসিক গুরুত্বের জন্য

-----
বাহাদুরের একটি কমিক্সের প্রচ্ছদ

১৬ এপ্রিল, ১৯৯০ প্রকাশিত হয় দারার অভিযানদ্য জস অব্ট্রেচারি ইন্দ্রজাল কমিক্সের ৮০৩তম এই সংখ্যাটির (দুটি অমুদ্রিত সংখ্যা যোগ করলে ৮০৫তম) সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয় ২৭ বছরের এক দীর্ঘ, রোমাঞ্চকর যাত্রা ফ্যানটম আর দারা থেকে যায় সেই যাত্রার দুই বিন্দুতে তারপর কেটে গেছে বত্রিশটি বছর ইন্দ্রজাল কমিক্ আর ফিরে আসেনি পুরোনো কমিক্সগুলোর কদর অবশ্য বেড়েছে প্রথম সংখ্যাটির দাম মনে আছে তো? ষাট পয়সা ছিল সেই সংখ্যাটি পেতে এখনকার এক কমিক্সপ্রেমী নাকি পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতেও রাজি হয়েছেন ভাবা যায়? তোমরা অবশ্য ইন্দ্রজাল কমিক্ পড়তে চাইলে পুরানো বইয়ের দোকানে গিয়েও খোঁজ নিতে পার এখনও বেশ কিছু সংখ্যা পেয়েই যেতে পারো সেখানে তবে একটা কথা বলি তোমাদের? ইন্দ্রজাল কমিক্ কিন্তু আরও সহজেও পেয়ে যেতে পারবে তোমরা যেদিন তোমরা ভালো করে পড়াশোনা করবে, বাবা-মা তোমাদের বকা-ঝকা করার কোনো কারণ পাবে না, সেদিন বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করে দেখো তো ইন্দ্রজাল কমিক্সের কথা? আমি নিশ্চিত বাবা তখন চিলেকোঠার ঘরের কোনো জং ধরা ট্রাঙ্ক থেকে বের করে আনবে বেশ কিছু ইন্দ্রজাল কমিক্সের সংখ্যা তোমার পড়ার জন্য পাতাগুলো কিছুটা বিবর্ণ কিন্তু পড়তে অসুবিধা হয় না মা তখন মিটিমিটি হাসছে পরের বার যখন মামার বাড়ি যাবে সেখান থেকেও পেয়ে যাবে আরও অনেক কমিক্ ইন্দ্রজালের জাদুতে ধরা দেবে তোমরাও বাবা-মায়ের শৈশবের সঙ্গে মিশে যাবে তোমাদের শৈশবও এর থেকে ভালো আর কী- বা হতে পারে?
----------
ফোটো - লেখক

No comments:

Post a Comment