গল্প:: সংঘর্ষের পরে - সুমন মিশ্র


সংঘর্ষের পরে
সুমন মিশ্র

এক

গুহার প্রবেশ পথ দিয়ে ব্লাইন্ডার নক্ষত্রের লালচে আলো এসে পড়ছে নেলসনের খড়ের বিছানার উপর খড় বলছি বটে, তবে এটা আমাদের পৃথিবীর খড়ের মতো আরামদায়ক নয় শক্ত, মোটা, অস্বস্তিকর তবে গুহার সবজে তীক্ষ্ণ পাথরের বিছানায় এই ব্যবস্থা ছাড়া আর উপায়ই বা কী?
এ এক অদ্ভুত গ্রহ প্রথম যখন এর অস্তিত্বের কথা জানা যায় তখন নাম দেওয়া হয়েছিল এন ই ফিফটি মানে নিউ আর্থ ফিফটি। পৃথিবীর পরিপূরক হতে পারে এমন যে সব গ্রহের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল তার মধ্যে পঞ্চাশতম ছিল এটি।
পৃথিবীর পরিপূরক কি আদৌ হতে পারে এই গ্রহ? এখানে যতদূর চোখ যায় শুধু বিস্তীর্ণ প্রান্তর, দুই মানুষ সমান লালচে উঁচু শরের বনে ঢাকা উচ্চভূমি থেকে দেখলে মন্দ লাগে না কিন্তু একবার সেই বনে প্রবেশ করলে দিগ্‌ভ্রষ্ট হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা প্রান্তরের চারপাশে ঘিরে আছে রুক্ষ পাথুরে পাহাড় কী অদ্ভুত বৈপরীত্য পৃথিবীতে পাহাড় বলতে সবুজ বনানিতে ঢাকা প্রকৃতির নরম স্পর্শের কথা মনে পড়ে আর এখানে পাহাড় আছে, সবুজও আছে, নেই শুধু আরণ্যক মাদকতা পাহাড়ের গায়ে কোনো উদ্ভিজ্জ প্রাণের ছোঁয়া চোখে পড়ে না। পাহাড়ের পাথরের রংই হালকা সবুজ। পাথরগুলো কিছুটা স্বচ্ছ আলো পড়লে নরম সবুজ আভা ছড়িয়ে পরে। এই গ্রহের বাতাসে একপ্রকার ঘন গ্যাসের আস্তিত্ব রয়েছে, হাঁটাচলা করতে গেলে অনুভব করা যায়, যেন কিছু ঠেলে এগিয়ে যেতে হচ্ছে তবে শ্বাস প্রশ্বাসের জন্য আলাদা কোনো যন্ত্রের সাহায্যের প্রয়োজন হয় না। পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে এখানকার বাতাসে পঁয়ত্রিশ রকম পৃথক উপাদান থাকলেও অক্সিজেন আর কার্বন ডাই অক্সাইড ছাড়া অন্য কোনোটাই মানুষের চেনা নয় এই গ্রহ দিনের বেলায় লালচে আলোয় মেখে থাকে, আর গভীর রাতেও এখানে পুরো আঁধার নামে না। এক ধূসর বিষণ্ণতায় ম্লান হয়ে যায় চরাচর। মাঝে মাঝে মনে হয় কত গবেষণার সুযোগ ছিল, আরও কত নতুন তথ্য হয়তো জানা যেত যদি এই গ্রহের বুকে আমরা পরিকল্পনা মাফিক অবতরণ করতে পারতামকিন্তু একটা দুর্ঘটনা সবকিছু শেষ করে দিল।

দুই

আলো এসে সরাসরি চোখের উপরে পড়লেও ঘুম ভাঙছে না নেলসনের তিন দিন ধরে বেচারার ধুম জ্বর আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা চালাচ্ছি যাতে সে সুস্থ হয়ে ওঠে, কিন্তু অনুভব করতে পারছি যে অবস্থা ক্রমশ অবনতির দিকে যাচ্ছে এই গ্রহের শরবন এবং পাথুরে জমির সঙ্গে সংঘর্ষের মুহূর্তে মহাকাশযানের এনার্জি রিট্রিভারের ছোটো কিছু টুকরো ঢুকে গিয়েছিল নেলসনের পিঠে তীব্র তেজস্ক্রিয় পদার্থ মিশে ছিল সেগুলিতে অপারেশন করে বার করা হলেও বিষক্রিয়া ততক্ষণে ছড়িয়ে গিয়েছিল নেলসনের রক্তে সব কটা টুকরো যে বার করতে পেরেছি তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। বড়োজোর দিন দুই নেলসন এই যন্ত্রণা সহ্য করতে পারবে, তারপর চারজনের দলের মধ্যে আমিই একা বেঁচে থাকব
বেঁচে থাকব এই কথাটা ভাবলেও কেমন বিষণ্ণতা গ্রাস করছে আমার চেতনাকে কতদিন পারব এই প্রাগৈতিহাসিক মৃত্যু উপত্যকায় টিকে থাকতে! কতটুকুই বা সম্বল আছে আমার কাছে? মহাকাশযানের ভগ্নস্তূপ থেকে যাত্রা শুরুর সময় যেটুকু ওষুধ, যন্ত্রপাতি, খাবার উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল সেইটুকু দিয়ে কতদিন চলবে? একমাস, দুইমাস, তারপর নিয়তিলতার কাছে সঁপে দিতে হবে নিজেকে আর এই গ্রহ যে জীবনশূন্য নয় তা এই কয়েকদিনেই ভালো মতো বুঝেছি

অথচ আজ থেকে সাতদিন আগেও আমরা ভাবতে পারিনি এমন ভাগ্য বিপর্যয় ঘটতে পারে। পৃথিবীতে এখন ৩০১১ সাল। আজ থেকে দুশো বছর আগে পৃথিবীর তাবড় তাবড় বিজ্ঞানীরা একত্রে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে পৃথিবীর আয়ু আর বড়োজোর সাড়ে তিনশো বছর। সমুদ্রতলের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে দুটি মহাদেশ অবলুপ্ত হয়ে গেছে। অস্তিত্ব রক্ষার যুদ্ধে অবসন্ন পৃথিবীর জনসংখ্যা আজ নগণ্য। দিনের বেলা তীব্র তাপপ্রবাহের ফলে মানুষ মাটির নিচে বসবাস করছে প্রায় পাঁচশো বছর ধরে। পৃথিবীতে আজ আর শীত, বসন্তের খেলা দেখা যায় না। সারা বছরই চামড়া ঝলসানো গ্রীষ্ম।
নতুন গ্রহের সন্ধান তখন থেকেই শুরু হয়েছিল। সমস্ত অনুসন্ধান, গবেষণা, পরিকল্পনা এবং পরীক্ষামূলক অভিযানের পর দশ বছর আগে একশো পনেরোটি গ্রহের উদ্দেশে পৃথিবী থেকে মহাকাশযান পাঠানো হয়। উদ্দেশ্য একটাই প্রতিটা অনুসন্ধানী দল এক-একটা গ্রহে গিয়ে সেখানকার আবহাওয়া কতটা মানুষের বাসযোগ্য সেটা পরীক্ষা করবে। তারপর সেই রিপোর্ট মহাজাগতিক সংকেতের মাধ্যমে ফেরত পাঠাবে পৃথিবীর বুকে। তার পরের ধাপটা অনিশ্চিত, পৃথিবী প্রযুক্তিগতভাবে উন্নতি করলেও অভিযানগুলো দ্বিমুখী করা সম্ভব হয়নি। এ যেন অভিমন্যুর চক্রব্যূহে প্রবেশ। পনেরো বছরের বেশি রসদ নিয়ে আজ অবধি কোনো মহাকাশ অভিযান হয়নি। অর্থাৎ অভিযানে বেশি সময় লাগলে পৃথিবীতে ফেরার সম্ভাবনা ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে যাবে। পৃথিবীর সঙ্গে সংযোগ ছিন্ন হওয়ার আগে অবধি খবর, একশো পনেরোটির মধ্যে মোটে দশটির থেকে সফল অবতরণের সংকেত এসেছে। পঞ্চান্নটি মাঝপথে হারিয়ে গেছে। তিনটির ক্ষেত্রে অবতরণের আগে সংকেত পাঠালেও তারপর কী হল জানা যায়নি। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সেই তালিকায় চতুর্থ সংযোজন আমাদের অভিযান। বাকি মহাকাশযানগুলির যাত্রা এখনও অব্যাহত।

আমাদের ক্ষেত্রেও সব ঠিকঠাকই চলছিল। আমাদের ধারণা ছিল এন ই ফিফটি’-র কোনো উপগ্রহ নেই। ধারণাটা আংশিক সত্য, উপগ্রহ নেই বটে, তবে অসংখ্য গ্রহাণু এক জায়গায় জড়ো হয়ে এই গ্রহকে প্রদক্ষিণ করে। এই তথ্য আমাদের কাছে ছিল না। এন ই ফিফটি’-কে সামনে থেকে দেখে আমরা তখন উত্তেজিত। সবুজ গ্রহ, তার উপর বাদামি ছোপ। বড়োজোর তিন দিন পরেই আমরা এই নতুন গ্রহে পা রাখব নতুন গ্রহে পা রাখা সফল অভিযাত্রীদের তালিকায় আমাদের নাম উঠবে ভাবলেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল
অবতরণের আগের দিন কোনোরকম বিপদের সম্ভাবনা না থাকায় আমরা যখন শুতে গেলাম তখন মহাকাশযানটিকে অটো পাইলট মোডে রাখা হয়েছিল। ঘণ্টা তিনেক পরে হঠাৎ বেজে উঠল বিপদ ঘণ্টা। ছুটে গিয়ে দেখলাম মহাকাশযান এসে পড়েছে সেই গ্রহাণুপুঞ্জের মাঝে। আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স দিয়ে এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়া সম্ভব নয়। নেলসন দ্রুত গিয়ে বসল চালকের আসনে দক্ষ হাতে একের পর এক মারণ ফাঁদ কাটিয়ে এগিয়ে চলল আমাদের মহাকাশযান তবে শেষরক্ষা হল না শেষ মুহূর্তে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময়ে সংঘর্ষ হল একটা ভাসমান ক্ষুদ্র মহাজাগতিক প্রস্তরখণ্ডের সঙ্গে মহাকাশযানের পিছনের দিকটা প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হল আমাদের অবতরণের যে বিশেষ পরিকল্পনা ছিল, তাকে মুহূর্তে তছনছ করে তীব্র গতিতে আমরা এগিয়ে চললামএন ই ফিফটি’-র দিকে এখানকার ভারী বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে সংঘর্ষে একসময় মহাকাশযানের তাপ নিরোধক বর্ম ধ্বংস হয়ে গেল পৃথিবীর মতো গভীর বায়ুমণ্ডল হলে আমাদের মহাকাশযান অবতরণের আগেই ধ্বংস হয়ে যেত বাতাস ভারী বলে বায়ুস্তরের গভীরতা কম, তাই মহাকাশযান জ্বলে যাওয়ার আগেই আছড়ে পড়ল শক্ত শরবনে তারপর বেশ কিছুটা ছেঁচড়ে এগিয়ে গিয়ে স্থির হল। এক্ষেত্রে আমাদের ভাগ্য আমাদের সঙ্গে ছিল। পাথুরে জমিতে পড়লে মুহূর্তে আমাদের মহাকাশযান টুকরো টুকরো হয়ে যেত। শক্ত শরবন এই যাত্রায় আমাদের বাঁচিয়ে দিলেও মহাকাশযানের যে ক্ষতি হয়েছিল তাতে পৃথিবীতে ফিরে যাওয়ার সমস্ত আশা অস্তমিত হলকতক্ষণ সংজ্ঞাহীন ছিলাম জানি না। জ্ঞান ফিরে ধাতস্থ হতেই দেখলাম আমাদের মহাকাশযান এক ধাতব ধ্বংসস্তূপে পরণত হয়েছে। ডেভিডের প্রাণহীন দেহ পড়েছিল আমার পাশেই, উইলসন তখনও সংজ্ঞাহীন, চালকের আসনে নেলসন রক্তাক্ত অবস্থায় কাতরাচ্ছিল। মহাকাশযানের সম্মুখভাগ, ছাদ ভেঙে বেরিয়ে গেছে, সেখান থেকে ঝুলছিল যন্ত্রাংশ আর খোলা তারের গোছা। কোনোমতে উঠে দাঁড়ালাম, ডান পায়ে চোট লেগেছে। নেলসনের প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য ব্যথা উপশমের ঔষধ দিলাম। কিছু সময় পরে উইলসনের জ্ঞান ফিরে আসতেই হাতের কাছে যেটুকু খাদ্য, যন্ত্রাদি, অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ করা সম্ভব তা জড়ো করে আহত নেলসনকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম মহাকাশযান থেকে। মহাকাশযানের অবস্থান নির্ণায়ক যন্ত্র চালু করা হল, একসঙ্গে সব সামগ্রী নেওয়া সম্ভব নয়, আবার কিছুদিন পর ফিরে আসা হবে। কিন্তু কোথায় যাব? চারপাশে প্রাচীরের ন্যায় শরবন, যেদিকে তাকাই শুধু অনিশ্চয়তার তমসা। দলপতি হিসাবে আমাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হল। আমরা উত্তর দিকে যাত্রা শুরু করলাম, যা আছে ভাগ্যে তাই হবে। সারা দিন চলার পর শরবনের শেষপ্রান্তে পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছোলাম, আরও ঘণ্টাখানেক খোঁজ চালানোর পর এই গুহার খোঁজ পাওয়া গেল। গুহাটা মোটামুটি বসবাসযোগ্য, স্যাঁতস্যাঁতে নয় একেবারেই, সবুজ পাথরের থেকে বেরোনো আভায় এক অদ্ভুত আলো আঁধারির খেলা চলছেনেলসনের চিকিৎসার জন্য একটা আশ্রয়ের দরকার ছিল। এই গুহাতেই বসবাস করা মনস্থির করলাম আমরা।

তিন

আবার সেই তীক্ষ্ণ স্বর ভেসে এল নিচের শরবনের উপত্যকার মধ্য থেকে প্রাগৈতিহাসিক কোনো দানবের শিকার ধরার পর মত্ত উল্লাসের শব্দ। সেই শব্দ শুনলে শিরদাঁড়া বেয়ে হিমস্রোত বয়ে যায়, মনের মধ্যে অজানা আশঙ্কা দানা বাঁধে। বিশেষ করে গতকাল রাতের ঘটনা মনে করলে এখনও মনের মাঝের সমস্ত সাহসিকতা মুহূর্তে কুঁকড়ে যাচ্ছে তীব্র আতঙ্কে।
গতরাতের আগে আমি সেই প্রাণীদের সরাসরি কখনও দেখিনি, তবে তাদের উপস্থিতি উপলব্ধি করেছিলাম গুহায় আশ্রয় গ্রহণের পরে দ্বিতীয় দিন বিকেলেই। আমি আর উইলসন তখন গুহার মুখে বসেছিলাম। আকাশের রং ক্রমশ লাল থেকে ধূসর হচ্ছে। তখনই প্রথমবার সেই অপার্থিব আদিম স্বর শুনলাম। একবার নয় পর পর অনেকবার, একটা প্রাণীর নয়, অনেকগুলো প্রাণীরতারা যেন একে অপরের সঙ্গে কথা বলছে। তারপর দেখলাম শরবনের উপত্যকায় আলোড়ন শুরু হল। তারপর দেখলাম চারপাশ থেকে সরু কিছু রেখা ছুটে যাচ্ছে একটা কেন্দ্রবিন্দুর দিকে, শরবন দুমড়ে প্রাণীগুলো ছুটে চলেছে শিকারের খোঁজে। কী শক্তি তাদের শরীরে! অমন শক্ত শরবন তাদের ধাক্কায় তোলপাড় হচ্ছে। তারপর ঠিক অভীষ্ট কেন্দ্রের একটু দূরে গিয়ে তারা থামল, শিকারকে ঘিরে ধরেছে। তারপর শুরু হল তীব্র তোলপাড়, ভেসে এল শিকারের আর্তনাদ। উইলসন আমার হাত চেপে ধরল আতঙ্কে। আমারও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছিল, তীব্র হচ্ছিল হৃৎস্পন্দন। এই প্রাণীগুলো আমাদের খোঁজ পেলে কী হবে?

পরের দুইদিন একইরকম দৃশ্য দেখলাম। প্রাণীগুলো দিনের বেলায় শিকার করে না, সন্ধে হলেই এই মৃত্যুদূতেরা ঘুরে বেড়ায় উপত্যকা জুড়ে। একটাই স্বস্তি উপত্যকার বাইরে তারা বেরোয় না। অন্তত আমাদের পর্যবেক্ষণ তাই বলছিল সব হিসাব পালটে গেল গতকাল রাত্রে
রাত তখন গভীর, গুহার ভিতর প্রায় অন্ধকার, গুহামুখ দিয়ে বাইরের ধূসর আকাশ দৃশ্যমান একটা অস্পষ্ট শব্দে ঘুম ভেঙে গেল ঘুমজারিত চোখে সবকিছু বুঝতে বেশ কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল, কিন্তু তারপরে যা দেখলাম তাতে রক্ত হিম হয়ে গেল বিশালাকার এক ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে বেরিয়ে যাচ্ছে গুহামুখ দিয়ে আলো অপ্রতুল, তবুও বুঝলাম এ এক প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী, ঠিক যেমন পৃথিবীর বুকে ঘুরে বেড়াত লক্ষ কোটি বছর আগে প্রাণীটার গা-ময় কাঁটা, একটা মেছো গন্ধ খুব ধীরে ধীরে চলেছে, নিঃশব্দ তার গতিবিধিতার মোটা লেজের সঙ্গে পাথুরে মেঝের ঘর্ষণে খসখস আওয়াজ হচ্ছে, ব্যস ওটুকুই শব্দ কখন এসেছে জানা নেই, কিন্তু কেন এসেছে তা হয়তো নজর গেল নেলসনের বিছানার দিকে সে অসুস্থ তাই তার বিছানা গুহার মেঝেতে আমার আর উইলসনের শয্যা অপেক্ষাকৃত উঁচুতে, আমরা সুরক্ষিত কিন্তু আবছায়ায় যা দেখতে পাচ্ছি নেলসন বিছানাতেই আছে, তাহলে? প্রাণীটা গুহা থেকে বেরোনোর সময় একবার মাথা ঘোরালো আমার দিকে দেখলাম তার মুখ থেকে ঝুলছে একটা অস্পষ্ট ছায়া, দুটো হাত, দুটো পা, একটা মৃতদেহ চকিতে তাকালাম উইলসনের বিছানার দিকে মৃত্যুপথযাত্রী নেলসনকে ছেড়ে উইলসনকে নিজের শিকার হিসাবে বেছে নিয়েছে প্রাণীটা নিয়তি আমার সঙ্গেও এটাই ঘটতে পারত ঘটেনি, আমি ভাগ্যবান বিছানার পাশে হাতড়ে হাতড়ে খুঁজে পেলাম আমার আগ্নেয়াস্ত্র কিন্তু তা চালাতে পারলাম না মৃত্যু উইলসনকে আলিঙ্গন করেছে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে প্রাণীটাকে মারা যাবে এমন নিশ্চয়তা নেই, উপরন্তু ক্রোধের বশে সে আমাদের আক্রমণ করতে পারে তাতে আমাদের প্রাণসংশয় হবে প্রাণীটা ধীর পায়ে গুহা থেকে বেরিয়ে গেল আমি অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে থাকলাম সেই দিকে

চার

উইলসনের মৃত্যু হয়েছিল দুইদিন আগে নেলসন কাল রাতে মারা গেল আমার আর কোনো পিছুটান রইল না মৃত্যুর আগের মুহূর্তে তার জ্ঞান এসেছিল বিড়বিড় করে বলল, ক্যাপটেন, পৃথিবী আর কত দূর?” তারপর সব নিস্তব্ধ হয়ে গেল সারারাত আকাশের দিকে চেয়ে বসে রইলাম এতদিনের সহযাত্রীরা মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে আমায় ছেড়ে চলে গেল কিন্তু আমার যে এখনও একটা কাজ বাকি আছে আমাদের খুঁজে পাওয়া গ্রহের হাল হকিকত পৃথিবীতে না পাঠাতে পারলে আমার কাজ যে শেষ হবে না ঠিক করলাম পরের দিন সকালেই রওনা হতে হবে মহাকাশযানের উদ্দেশে অর্ধেক দিনের পথ তারপর মহাজাগতিক সংকেতের মাধ্যমে পৃথিবীতে সব জানাতে হবে সংকেত পাঠানোর যন্ত্রটা অক্ষত আছে, সেটা আমি মহাকাশযান ছাড়ার আগেই দেখেছিলাম
সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম দিক-নির্দেশক যন্ত্র মহাকাশযানের অবস্থান বলছে আমি ছুটে চলেছি মাঝে মাঝে থামছি দম নিতে, তারপর আবার ছুটছি হাতে সময় কম সন্ধ্যা হলেই এই উপত্যকায় মৃত্যুর তাণ্ডব শুরু হবে হয়তো আজই আমার শেষ রাত, কিন্তু কর্তব্যপূরণের আগে যে মৃত্যুর নাগপাশে নিজেকে সঁপে দেওয়া যাবে না
শক্ত শরগুলির আঘাতে পোশাক ছিন্ন হচ্ছে, রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছি কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও দাঁড়ানো যাবে না হঠাৎ মনে হল আরও যেন কেউ চলেছে আমার পাশে পাশে থমকে দাঁড়ালাম, চারপাশ নিরীক্ষণ করলাম ভালো করে না, কেউ নেই, পুরোটাই মনের ভুল আজ শোঁ শোঁ করে হাওয়া বইছে শরের বনে এর আগে এমন কোনোদিনই দেখিনি এই গ্রহে যে বাতাস বয়ে যায়, এ অভিজ্ঞতাও এই প্রথম
মহাকাশযানে যখন পৌঁছোলাম তখন বিকেল হয়ে এসেছে সংকেত পাঠানোর যন্ত্রটা চালু করতে একটু সমস্যা হচ্ছিল সেটা সারাই করতে বেশ কিছু সময় গেল যন্ত্রটা চালু হতেই তাড়াতাড়ি প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো লিখতে শুরু করলাম ভূত্বক, পাহাড়, বায়ু এবং প্রাণের অস্ত্বিত্ব সম্পর্কে যা যা সন্ধান পেয়েছি সব লিখলাম আমাদের দলের কথা, দুর্ঘটনার কথা লিখলাম প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীদের বিবরণ সংক্ষেপে লিখছি, এমন সময় দূর থেকে সেই ভয়ংকর তীক্ষ্ণ আওয়াজ ভেসে এল তারা আসছে, কিন্তু এখনও তো সন্ধে হয়নি, তাহলে কি বাতাস বয়ে চলার জন্য আমার ঘ্রাণ তারা পেয়েছে আমার হাত কাঁপতে শুরু করল তাড়াতাড়ি লিখলাম এই গ্রহ পৃথিবীর থেকে কয়েক কোটি বছর পিছিয়ে আছে মানুষ ডাইনোসরের সময় আবির্ভূত হলে যে সংঘর্ষের মুখে পড়ত, এখানেও বসতি গঠন করতে গেলে তাই হবে
সময় আর নেই মৃত্যুর আওয়াজ ক্রমশ এগিয়ে আসছেসেন্ডবোতামটা টিপে দিলাম যন্ত্র থেকে টি টি করে আওয়াজ হচ্ছে সংকেত পাঠানো শুরু হয়ে গেছে কয়েক মিনিট পরে স্ক্রিনে দেখাল সংকেত পাঠানো সমাপ্ত হয়েছে আর সেই মুহূর্তে তিনটে প্রাগৈতিহাসিক মৃত্যুদূত দৃশ্যমান হল কী বীভৎস দর্শন জীবগুলি! আমি পালাতে তৎপর হতেই বুঝতে পারলাম সংখ্যায় তারা আরও অনেক বেশি আমায় চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছে আমি চোখ বুজে বসে পড়লাম আমার পথ যে এখানেই শেষ হল শুধু মনে মনে ঈশ্বরের কাছে বললাম, মানবসভ্যতা যেন তার সঠিক পথ খুঁজে পায়
----------
ছবি - আন্তর্জাল

No comments:

Post a Comment