অন্যরকম রূপকথা
ঈশানী রায়চৌধুরী
দুটো শোবার ঘর, মাঝে একটা চৌকো মতো দালান, একপাশে
রান্নাঘর, একটা খাবার ঘর, আর রাস্তার দিকে কালো রেলিং ঘেরা একটা মস্ত বারান্দা। ব্যস,
এটুকু নিয়েই ঝিনিদের ভাড়ার আস্তানা। দোতলায়। কলঘরে আবার মাঝে মাঝে জল আসে না। তখন
বাড়িওয়ালার সঙ্গে গলা তুলে ঝগড়া করতে হয়। এ বাড়িতে কোনও বৈঠকখানাও নেই। কেউ এলে ওই
দুটো শোবার ঘরের যে কোনো একটাতে খাটের ওপরেই জাঁকিয়ে বসে। ঝিনির ঠাম্মা-দাদুর
আপনার জন হলে ওদের ঘরে যায়, আর মা-বাবার চেনা হলে তাদের ঘরে। তবে হ্যাঁ, একটা
অলিখিত নিয়ম আছে। ঝিনির মা-বাবার কাছে কেউ এলে তাকে অন্য ঘরেও হাজিরা দিতে হয়,
কিন্তু উলটোটা কক্ষনো হয় না। ঝিনির মা-বাবাকেই তখন এ ঘরে এসে বসতে হয়। ঝিনি তখন কী
করে? সে দাঁত দিয়ে গভীর মনোযোগে নখ কাটতে কাটতে তার খরগোসের কানজোড়া পুরোপুরি কাজে
লাগিয়ে সব কথা গোগ্রাসে গেলে।
আসলে ঝিনির খুব তাড়াতাড়ি টুক করে বড়ো হয়ে যেতে ইচ্ছে করে।
বড়ো হলে তবেই বন্ধুবান্ধব হয়, ঝিনি জানে। এখানে তো তার কোনও বন্ধুই নেই! শুধু
রেলিংগুলো আছে। ঝিনির বয়স চার। সে দুষ্টু নয়, তবে সেয়ানা খুব। সে পাড়ার একটা
নার্সারি ইস্কুলে ভর্তি হয়েছে এবং চট করে শিখে নিয়েছে কী করে ক্লাসে দিদিমণির
মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেও মনে মনে সাত পাঁচ চিন্তা করা যায়। অবিশ্যি দিদিমণির মুখের
দিকে তাকালে চিন্তার চেয়ে ভয় দানা বাঁধে বেশি! তিনি যেমনি কালো, তেমনি দশাসই। মাথায়
চুড়ো করে চুল বাঁধা। খোঁপা নয়, বিচ্ছিরি গুটলিমতো। চোখ দুটো একটু লাল লাল, হাতে
খটখটে কাঠের স্কেল। ঝিনি একদিন কপালে বাড়ি খেয়েছে, টিফিনে অসভ্যের মতো জ্যাম
বিস্কুট খুলে ভেতরের জ্যাম চেটে চেটে খাচ্ছিল বলে।
ঝিনি যখন ইস্কুল থেকে ফিরে ধাঁই ধপ করতে করতে সিমেন্টের
চলটা ওঠা সিঁড়ি টপকাতে টপকাতে ওপরে ওঠে, তার মা তখন বাড়িতে থাকে না। মা পড়তে যায়
বড়ো কলেজে। দাদু বলে, ‘ইউনিভার্সিটি।’ ঝিনি ঠাম্মার কাছে চান করে, ভাত খায়, তারপরে
ঠাম্মা যখন দুপুরে নাকে চশমা এঁটে বড়ো পালঙ্কটাতে গা এলিয়ে দেয় খবরের কাগজ হাতে
নিয়ে, সে গুট গুট করে ঢুকে যায় পালঙ্কের নিচে। ওখানে তার একঘর ছেলেপুলে নিয়ে সংসার।
ঝিনির বাবা আছে, ঝিনির বাবার আর মায়েরও বাবা আছে, কিন্তু কোনও অজানা কারণে ঝিনির
ছেলেপুলেদের তো বাবা নেই! তাই সব কিছু ঝিনিকেই দেখতে হয়। ঘরের কাজ, বাইরের কাজ। বাইরের
কাজ বলতে ঝিনিও ‘আপিস’ যায়। সে ইস্কুলে পড়ায়। বারান্দার কালো রেলিংগুলো সব তার
ছাত্রছাত্রী। তবে সে ইস্কুল বসে বিকেলে, যখন ঝিনির মুখে সাদা দুধের গোঁফ গজায়। ঝিনি
তখন কাচ্চাবাচ্চাদের ঘুম পাড়িয়ে একটা স্কেল বগলদাবা করে ক্লাস নিতে আসে। কতক্ষণ?
যতক্ষণ না তার মায়ের চেনা শাড়ির আঁচল দেখা যায় রেলিঙের ফাঁক দিয়ে।
আসল কথাটা হল, ঝিনি তার মাকে যমের মতো ভয় পায়। বাড়ির
তিনজন তাকে নির্বিকার আহ্লাদ দিলেও তার মা জননীটি বড়ো কঠিন ঠাঁই। ঝিনির এই যে
ইস্কুলের পড়া করতে যাচ্ছেতাই লাগে, মানে ইস্কুলেই যেতে ভালো লাগে না, রোজ টিফিনে
সিঙ্গাপুরি কলা আর জ্যাম-বিস্কুট খেতে বমি পায়, সে কথা মায়ের কানে গেলে রক্ষে নেই
আর! মা ঝিনিকে বুঝিয়েছে, কত গরিব লোক পেট ভরে খেতে পায় না, কত বাচ্চা ইস্কুলে যেতে
পারে না! ঝিনির খুব ইচ্ছে করে ওই কলা আর বিস্কুট সামনের বস্তির বাচ্চাদের দিয়ে দেয়।
ঝিনির বদলে ওরা ইস্কুলে গেলেও ঝিনির কোনও আপত্তি নেই। যোগ বিয়োগ, হাতের লেখা,
বাংলা রিডিং, ইংরিজি রাইমস... সবই অপছন্দ তার। খাতায় ভুলভাল লিখলে মা গালে ঠোনা
মারে, বকে খুব। ঝিনি কাঁদে না। সে চুপিচুপি শিখে নেয় এই সব শাসন। তার জের টানে
বোবা রেলিংগুলো।
এইভাবে এক রুটিনে চলতে চলতে ঝিনির একা থাকা অভ্যেস হয়ে
গেছে। সত্যি বলতে কী, একা থাকতেই তার যেন বেশি বেশি করে ভালো লাগে। সে বই ভালোবাসে
খুব, তবে শুধুই গল্পের বই আর ছড়ার বই; পড়ার বই একেবারেই নয়। মানে নিজের পড়ার বই
এড়িয়ে চলে যথাসম্ভব। ঝোঁক তার মোটাসোটা ইংরিজিতে লেখা বাবার বইগুলোর ওপরে। বাবাও
তো মাস্টারমশাই। কলেজের ছেলেপুলেদের পড়ায়। হয়তো এইজন্যই তারও সুযোগ পেলেই ভরদুপুরে
রেলিং পেটানোর ঝোঁক! সে সব বইয়ের মাথামুণ্ডু ভারী তো বোঝে ঝিনি! শুধু পেটের ওপরে
চেপে ধরে হাঁচোড়পাঁচোড় করতে করতে বিরাট বিজ্ঞের ভান করে উঠে বসে বাবা-মায়ের শোবার
ঘরের জানলার ধাপির ওপরে। এই জানলাটা খোলে পাশের সরু গলিটার গায়ে। সেখানে টাইমের
কলে জল নিতে ভিড় জমায় উলটোদিকের বস্তির মেয়ে-বউ। তারা লাইনে দাঁড়িয়ে ওপরপানে
তাকিয়ে হেসে বলে, ‘কী করছ গো ঝিনি?’
ঝিনি উঁচু করে তুলে ধরে মোটা ইংরিজি বই। গম্ভীর গলায় বলে,
‘পড়ার খুব চাপ বেড়েছে আজকাল। পড়ছি।’
বই তো খোলা, কিন্তু ঝিনির কান থাকে ওই কলতলায়। প্রচুর
নতুন শব্দ শেখা যায়, যদিও তার বেশিরভাগই ‘মন্দ’ কথা। এই যে এগুলো সব মন্দ কথা,
ঝিনি সেটা বুঝল কী করে? একদিন ভুল করে বলে ফেলেছিল সে, মায়ের সামনে। মা ধুপধুপিয়ে
রান্নাঘর থেকে আঁশবঁটি বাগিয়ে তেড়ে এল। ঝিনির জিভ কেটে নেবে কুচুত করে। শেষ
পর্যন্ত জিভটা ঠাম্মার দয়ায় বেঁচে গেলেও পিঠ আর কান বাঁচেনি। সেই থেকে ঝিনি শোনে
সব, মনেও রাখে কিছু কিছু, কিন্তু মুখে উচ্চারণ করে না।
ঝিনির খুব এটা সেটা কিছু একটা পুষতে ইচ্ছে করে। কুকুরছানা,
বিড়ালছানা, এমনকী কেলেকুষ্টি কাকের ছানাও তার বেশ লাগে! সে দেখেছে কাকের ছানার
হাঁ-মুখটা কী সুন্দর লাল!
তার চিরকালই মানুষের থেকে জন্তুজানোয়ার
পাখি প্রজাপতি ঢের বেশি পছন্দ। কিন্তু ছোটো মেয়ের পছন্দ-অপছন্দের দাম আজ পর্যন্ত কোনো বাড়ির
বড়োরা দিয়েছে বলে তো শোনা যায় না! এই যেমন সে চেয়েছিল মুরগির ছানা পুষতে। ছোট্ট ছোট্ট
গুল্লি গুল্লি সাদা-হলুদ কদমফুলের মতো। কিন্তু কেউই গা করে না দেখে মাথায় একটা সহজ বুদ্ধি খেলেছিল
তার। চুপি চুপি সেটা সরলা দিদিকে বলল। সরলা দিদি ঝিনিদের বাড়িতে কাজ করত আর তার বহু বায়নাবাটি
মেটাত বটে, এই প্রস্তাব শুনে চোখ কপালে তুলে দৌড়ে গিয়ে অমনি ঝিনির মায়ের কাছে চুকলি কেটে
এল। অথচ প্রস্তাবটা এত হইচই করার মতো ছিলই না! শুধু বাজার থেকে ডিম আনা হয়েছে দেখে
দুটো ডিম লুকিয়ে নিয়ে গিয়ে সরলাদিদিকে সে বলেছিল তা দিতে। ছানা ফুটলে ঝিনিই না হয় পালত
তাদের!
সে যাত্রা সরলাদিদির
বিশ্বাসঘাতকতায় ডিমগুলো বেঁচে গেল বটে, কিন্তু ভবি ভোলার নয়। কিছুদিন পরে বাড়ির লোকজন
বুঝলও সে কথা। ঝিনির মাথার পোকা নড়েছে যখন একবার, ডিমে তা দিতেই হবে। চুপিচুপি বাজার থেকে কিনে আনা মুরগির
ডিমের ওপরে এবার নিজেই বসার চেষ্টা করল সে। ছানা-টানা কিচ্ছুই হল না, মাঝখান থেকে
ভ্যাচ করে ডিমটা ভেঙে গিয়ে তার সাদা টেপ জামা আর জাঙিয়াটা নষ্ট হয়ে গেল। মা অমনি
দু-ঘা কষিয়ে দিল পিঠে।
ঝিনির ঘ্যানঘ্যানানিতে অতিষ্ঠ হয়ে ঝিনির মামা একদিন
জলভরা প্লাস্টিকের থলি করে চারটে মাছ নিয়ে এল। লাল মলি আর কালো মলি। কী কিপটে রে
বাবা! এইটুকু-টুকু মাছ, তাও মোটে চারটে ! হরলিক্সের খালি শিশিতে জল দিয়ে রাখা হল
তাদের। আর তারপর ঝিনির ঘুম, খাওয়া, লেখাপড়া মাথায় উঠল। এই যে মাছগুলো একটানা
সাঁতার কাটছে, ওদের গায়ে ব্যথা হবে, এতক্ষণ জলে থেকে সর্দিও হবে নির্ঘাত!
এমনি জামা না পড়ুক, অন্তত সাঁতারের জামা
তো পরতেই পারে! যতক্ষণ বাড়িতে থাকে ঝিনি, তার অখণ্ড মনোযোগ ওই গেঁড়ি গেঁড়ি মাছের
ওপরে। ঘরে কেউ না থাকলে বিড়বিড় করে ওদের সঙ্গে গল্পও করে সে। নাম দিয়েছে লালি ১,
লালি ২ আর কালি ১, কালি ২। একবার ‘ঝিনি’ হয়ে কথা বলে ওদের সঙ্গে আর একবার কোনও না
কোনও ‘লালি’ বা ‘কালি’ হয়ে। কী করে যে ১ আর ২ নম্বরদের আলাদা করে কে জানে, কিন্তু
ও নাকি ঠিক চিনতে পারে! তারপর একদিন ঝিনি অবাক হয়ে দেখল জলের মধ্যে সরষের দানার
মতো গুঁড়ো গুঁড়ো কী যেন! মা বলল, লালি-কালি মাছের ছানা বেরিয়েছে ডিম ফুটে। এক্ষুনি
আলাদা করে দিতে হবে। না হলে মা ছানাগুলোকে কপকপিয়ে খেয়ে ফেলবে। ছোটো শিশি, চানের
মগ নিয়ে আসা হল। দূর, ও সব কি সোজা কথা! গেঁড়িগুলো অক্কা পেল প্রথমে, কারণ তাদের
বাপ মা তাদের খেয়ে সটান হজম করে ফেলল। ধাড়ি চারটেও যে এক এক করে কখন পটল তুলল কে জানে!
এরপর ঝিনির বছর সাড়ে পাঁচ বয়স যখন, তারা বাড়ি বদলাল। নতুন বাড়িতে
মালপত্তর পৌঁছনোর পরে ঝিনি একদিন উল্লসিত হয়ে আবিষ্কার করল, তার ঠাম্মার বিয়ের সময়কার
ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে নেংটি ইঁদুর বাচ্চা দিয়েছে। কী যে মিষ্টি হালকা গোলাপি কুট্টি
কুট্টি দেখতে!
তিনটে মিষ্টি আর কুট্টি ইঁদুরছানা। ফুটফুটে কচি সাহেব বাচ্চাদের
মতো ফরসা আর গোলাপি। ন্যাজগুলো এত খুদে যে ম্যাগনিফাইং গ্লাস
দিয়ে দেখতে হয়। কালো জিরের মতো চোখ। ওদের মা-বাবা খুব বজ্জাত। ‘জন্মেছিস, খুঁটে খে গে যা,’ নির্ঘাত এই বলেই
ওদের ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর মা ওদের ড্রয়ারের মধ্যে ফেলে রেখে চম্পট দিয়েছে। ঝিনি সেই কী
একটা সিনেমায় দেখেছিল যেমন... বাচ্চা ফেলে রেখে মা চলে গেছে ওই বৃষ্টি মাথায় করে। কোন
চার্চের সিঁড়িতে নাকি মন্দিরের চাতালে... ওইরকম। শুধু ইঁদুরদের বেলায় জায়গাটা
আলাদা। ঠাম্মার বার্মা টিকের ড্রেসিং টেবিলের আয়নার নিচে দুটো খুদে ড্রয়ার ছিল, তার
একটার মধ্যে। দাদুর সেই আদ্যিকালে বন্ধ হয়ে যাওয়া ফাটা কাচের ধ্যাবড়াপানা ট্যাঁকঘড়িটার
পাশে।
ঝিনি
স্রেফ চেপে গেল ইঁদুরছানাদের কথা। সে সুযোগ পেলেই ওই ড্রয়ার খুলে ডিঙি মেরে উঠে হাঁপাতে
হাঁপাতে সাত জন্মের অচল ট্যাঁকঘড়িতে দম দেয় বাঁই বাঁই করে, ঘেঁটেঘুঁটে দেখে কী মণিমুক্তো মেলে আর
চুপি চুপি ইঁদুরদের দেখাশুনো করে।
উফ,
কী তুলতুলে আর নরম নরম। কী সুন্দর মুখের ছিরি, এক
পছন্দে বিয়ে হয়ে যাবার মতো। নিয়মিত বিস্কুটের
গুঁড়ো, চালের খুদ এইসব রান্নাঘর থেকে লুকিয়ে এনে খাওয়াতে খাওয়াতে এক সময়ে তার সঙ্গে
ছানাগুলোর যথারীতি কথোপকথনও শুরু হয়ে যায়। কয়েকদিন বাদে এক চিলতে খবরের কাগজে ওদের
তুলে পুতুলের বাক্সের ডালা খুলে লুকিয়ে রাখল ঝিনি। একটু ফাঁক করে। খাটের তলায়।
আহা রে, সবে আধো আধো বুলি ফুটেছে। ফিসফিস করে জানতে চাইল, কী খাবি?
আহা রে, সবে আধো আধো বুলি ফুটেছে। ফিসফিস করে জানতে চাইল, কী খাবি?
তিনটে
খুদে ফোকলা মাড়ি বের করে ফিক করে হেসে বলল, ছন্দেছ।
ওপলে কিচমিচ দেওয়া।
ঠাম্মার
পুজোর থালায় ছিল। এদিক ওদিক তাকিয়ে একটু ভেঙে দিল ঝিনি। আহা, খাক ওরা। ঠাম্মা
চেঁচামেচি করলে টপ করে বলে দেওয়া যাবে, ঠাকুর খেয়েছে। এবার জল খাবে তো ওরা! কিন্তু
কী করে? মায়ের নাক বন্ধ হলে নাকে ওষুধ দেয়; ড্রপার
দিয়ে। ওইটে ঝেঁপে দিল ঝিনি। তবে বেশ করে জলে ধুয়ে। ওষুধ থাকলে জলের টেস্ট লাগবে না।
এরপর
থেকে এই এক কাজ হল তার। বিস্কুটের টুকরো, আলুসেদ্ধ, সন্দেশ, চটকানো ভাত। একদিন
রসগোল্লা দিয়েছে... হামলে পড়ে খেতে গিয়ে ব্যাটাদের বিষম খেয়ে
দম আটকে মরার দাখিল। একদিন ঝোলমাখা ভাত দিয়েছে, বলে কিনা, খাব না। এঃ, কেমন নোংরা মতো। ফরসা ভাত দাও।
বিকেলে
রুমালে মুড়ে বা কোট ফ্রকের পকেটে লুকিয়ে তেনাদের হাওয়া খাওয়াতে নিয়ে যেতে হয়। ওদের
নাম দিয়েছে চ্যাঁ, ভ্যাঁ, ট্যাঁ।
ডাকনাম। এখনও ভালো নাম দেয়নি। ইস্কুলে ভর্তির সময় তো দিতেই হবে!
বেশ আছে ওরা। ওরা চার জন। ঝিনির আর ‘বন্ধু
চাই’-এর বায়না নেই। একা থাকার কষ্ট নেই। তিনটেই
গোকুলে বাড়ছে। কেউ জানেই না। ওদের গায়ে রেশমি রোঁয়া, মোটকু-সোটকু
চেহারা, গুটগুট করে হাঁটে, তুরতুর করে ছোটে, কিচকিচ
করে কথা বলে,
কুপকুপ করে খায়। ঝিনিকে নাকি ‘দিদিভাই’ বলে!
ঝিনি
যখন মনে মনে এঁচে রেখেছে এবারে ওদের ভাইফোঁটা আর বোনফোঁটা দেবে, ঠিক তখনই এক কেলোর
কীর্তি হল।
পুতুলের
বাক্সের ডালাটা বুঝি একটু বেশি খোলা ছিল। তিনটেতে ওস্তাদি করে বাইরে এসে পায়চারি করছে
গম্ভীর হয়ে। ব্যস! এ বাড়িতে ঠিক জুটেছে একজন, সরলা মাসির
জায়গায় রাধা মাসি,
তার আবার সবেতেই উত্তেজনা আর চিলচিৎকার!
‘তিনটে
ধেড়ে নেংটি ইঁদুর ভুষ্টিনাশ কল্লো।’
ঝিনি
বলে, ‘নেংটি
কখনও ধেড়ে হয় না, আর এগুলো একে পোষা তায় ছেলেমানুষ।’
কিন্তু
ততক্ষণে সারাবাড়িতে তাণ্ডব! যত সে বোঝাতে
চায় ওরা খুব বাধ্য ততই সব্বাই মিলে তার খোয়ার করে! মুড়ো
ঝাঁটা নিয়ে রাধামাসি, কোমরে আঁচল জড়িয়ে রণরঙ্গিনী ঝিনির মা জননী, তিড়িং বিড়িং তুড়ি লাফে তার ঠাম্মা... উফ, সারা
বাড়ি হুলুস্থুলু! তিন মক্কেল বেগতিক দেখে খোলা দরজা দিয়ে
সোজা ধাঁ।
মা চিল্লিয়ে বাড়ি মাথায় তুলে ঝিনির
বেআক্কেলে বুদ্ধির জন্য বকাবকি করতে করতে কান পেঁচিয়ে দিল জোরসে। আর বাবা কোনো কালেই
জন্তুজানোয়ার সইতে পারে না। তাই কড়া হুকুম হল, বাড়ির মধ্যে কোনদিনই কোনো চারপেয়ে আটপেয়ে
চলবে না।
বাড়ির মধ্যে চলবে না। বাইরে তো চলতে
পারে!
তখন ঝিনি দাদুর হাত
ধরে ঝুলে পড়ল। চিরকালই সে ঘ্যানঘ্যান করতে এক্সপার্ট। অতিষ্ঠ হয়ে শেষে জগুবাবুর বাজার থেকে
একটা স্টেগোসরাসের ছানা নিয়ে এল দাদু। দেশলাইয়ের বাক্স করে। ছোট্ট মাথা, শরীরটা তুলনায় বড়ো, লেজটা চিমড়েপানা। কিন্তু পিঠে ছোট্ট
ছোট্ট কাঁটা আর পাত কই? দাদু বলল, বড়ো হলে হবে। একটু ঘিয়ে আর বাদামি চেহারা। ঝিনি একটু
খুঁতখুঁত করেছিল বটে মাথাটা কেমন ছোটো বলে, দাদু বলল, ‘ছোটো মাথাই ভালো। বুদ্ধি কম হলে তাড়াতাড়ি
পোষ মানবে, কারণ ছোটোদের তো এমনিতে কেউ ধর্তব্যের মধ্যেই আনে না।’
পেছনের বারান্দায় রাখা হবে ওকে। ওদিকে
দু-ধাপ সিঁড়ি পেরোলেই
তাদের এই ভাড়াবাড়িটার সঙ্গে মুফতে পাওয়া একটা আধা-বাগান টাইপ জায়গা। আর স্টেগোৱা তো ঘাসপাতা
ফলফুলুরি খায়...
ঠাম্মা আর মা ওই গুচ্ছের
ষষ্ঠী আর ব্রত করে, প্রতি সোম আর বেস্পতিতে শিবঠাকুরের মাথায় জল ঢালে
আর লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়ে... সপ্তাহভর যা ফলমূল আসে, ওই টুকরো-টাকরাতেই চলে যাবে। শুধু দাদু জানল আর
ঝিনি জানল, যে স্টেগো এল বাড়িতে। আর কেউ ওকে দেখতেও পেত না। কারও সাড়াশব্দ পেলেই
ওকে লুকিয়ে রাখা হত। ওর নাম দেওয়া হল রামদীন পালোয়ান।
রামদীন একটু বড়ো হল যখন, ওর গলায় একটা লাল
সিল্কের ফিতে চেষ্টা করেছিল ঝিনি। ফিতেটা অবিশ্যি সত্যি বলতে কী পুরো বাঁধতে পারেনি। বাঁধার আগেই রামদীন
তুরতুর করে পালিয়ে গেল। আহা, কী যে রূপ খুলত তাহলে! মনে হত, ওকেও একটা কাজলের টিপ পরাতে হবে। দুষ্টু
লোকের নজর লাগে যদি! রামদীন বারান্দার কোণে ঘাপটি মেরে থাকত। শুধু ঝিনি ডাকলে বেরোত। কাঁটা বেরোচ্ছে
না কিন্তু!
অথচ দিব্যি টুকটুক
করে বড়ো হচ্ছে। দাদুকে বলতে দাদু বলল, ‘না বেরোনোই ভালো, বুঝলে দিদিমণি। পিঠে অমন হুদো হুদো
খরখরে কাঁটা থাকলে ওতে চেপে তুমি বড়ো হয়ে বেড়াতে যাবে কী করে বল? গায়ে ফুটে যাবে তো!’
ঝিনি মেনেও নিয়েছিল সে কথা। ওঃ, আর হেঁটে হেঁটে স্কুলে
যেতে হবে না, ভুতো সুযোগ পেলেই চিমটি কাটে আর জমানো ট্রামের টিকিটগুলোর দিকে ভারী লোভ দেয়... রামদীনকে দেখলে সব
ওস্তাদি বেরিয়ে যাবে! তারপর ঠাম্মার দেওয়া টিফিনের ওই অখাদ্য কলা আর বাড়িতে তৈরি সন্দেশ না ছাই... ওই ছানার পিন্ডি ঝিনিকে
আর গিলতে হবে না... রামদীন সোনা মুখ করে খেয়ে নেবে... উফ, ভাবতেই মনটা চনমন করে ওঠে।
রামদীন যখন বেশ ইঞ্চি ছয়েক লম্বা আর
মোটাসোটা, কালো পুঁতির মতো চোখ... দেখা গেল একটা উচ্চিংড়েকে খপ করে ধরেছে। ঝিনি কোমরে
হাত দিয়ে দেখছে। ওমা, গপ করে খেয়ে নিল! দাদুকে গিয়ে বলতে দাদু বলল, ‘তুমি সেদিন ওর সামনেই
তো পেছনের বারান্দায় গিয়ে প্লেটে করে মাংস খাচ্ছিলে। ঠাম্মার কাছে বায়না করে কড়াই থেকে একটা
মেটে আর এক টুকরো মাংস কষানোর সময় চেয়ে নিলে যে! ও দেখেছে! ওর বুঝি ইচ্ছে করে না ভালো-মন্দ খেতে! আর রোজ যা ফলের কুচি দাও... ওর অরুচি ধরেছে নির্ঘাত! কালকেই তো দেখলাম পিঁপড়েদের নেমন্তন্ন
খেতে ডেকেছে। শোনো, আপ রুচি খানা। অত টিকটিক করলে কিন্তু ও চলে যাবে।’
তারপর রামদীনের সাহস বাড়ল একটু একটু।
মাঝে মাঝেই মুখ বের করে। দেওয়াল ঘেঁষে হাঁটে। দাদু বলে, সকালটা মর্নিং ওয়াক আর রাতেরটা হল আফটার
ডিনার ওয়াক আ মাইল। ঝিনি ছটফটিয়ে মরে। কবে পিঠে চড়ে ইস্কুল যাবে?
একদিন তার চোখে পড়ল দেওয়ালের ঘুপচি কোণে
তিনটে গুলি গুলি সাদা সাদা ডিম। আরিব্বাস! একটা রামদীন থেকে চারটে রামদীন হবে! গ্রামার বইতে লেখে... ফ্লিট অফ কারস! ঝিনিরও
তাই হবে। লাফাতে লাফাতে সব প্রতিজ্ঞা ভুলে ঠাম্মা আর মাকে যেই না ডেকে এনে দেখিয়ে সে
কথা বলেছে...
অমনি...
‘ম্যা গো ম্যা... কী বদখত টিকটিকি একটা! আবার ডিমও পেড়েছে! এই মিনতি, শিগগির ঝুলঝাড়ু আনো। কখন আবার টপ করে
ঘরে ঢুকে যাবে আর বাড়ি ভর্তি কুচো কুচো টিকটিকির বাচ্চা! ছি ছি... ঝেঁটিয়ে ফেলে দে তো ডিমগুলো! যাঃ যাঃ... আ মোলো যা, হতচ্ছাড়া টিকটিকিটা! আরে, বাগানের দিকটায় তাড়িয়ে নিয়ে যা না!’
টিকটিকি! রামদীন পালোয়ানকে বলা হল টিকটিকি! রামদীন বাগানে চলে গেল সকলের চোখের সামনে
দিয়ে। যাবার আগে কালো পুঁতির মতো চোখদুটো ঝিনির দিকে তাকিয়েছিল একটুক্ষণ। ওর ঠোঁটের
কোণে একটু মিচকি হাসিও ছিল। দাদু আর ঝিনি ছাড়া ওকে আর কেউ চিনতেই পারেনি বলে।
বাড়ির পেছনদিকের বাগানে ঝাঁকড়া কলকে ফুলের গাছের নিচে বসেছিল
ঝিনি। তার বয়স আট, মাথায় সারাক্ষণ নানা দুর্বুদ্ধি কিলবিল
করছে। এই যেমন এখন। একটু আগে একটা সবজেটে শুঁয়োপোকা শিউলিগাছের নিরাপদ আশ্রয় থেকে কাঠি
দিয়ে টেনে বার করেছে ঝিনি। ঘরে ঢুকে একটা পরিষ্কার করে ধুয়ে রাখা পেটমোটা শিশি হাতিয়ে আবার
বাগানে এল সে। শিশির বড়োসড়ো মুখে একটা কর্কের ছিপি। ক’দিন আগে সারা দুপুর ধরে
দাদুর পাকাচুল তোলার সন্না দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ছিপিতে একটা এবড়োখেবড়ো ছোট্ট ফুটো
করেছে সে। কায়দা করে শুঁয়োপোকাটাকে কাঠিতে তুলে শিশিতে ভরল ঝিনি। কাঠির গায়ে
গুল্লি পাকিয়ে ছিল পোকাটা। কিছুতেই ছাড়বে না কাঠিটা! ‘বাবা, বাছা’ করে ভুলিয়ে
ভালিয়ে শিশির ভেতরে ওটাকে চালান করল ঝিনি। তারপর দু-চারটে সবুজ পাতা ঠুসে দিল
ভেতরে। সে ছবির বইতে দেখেছে শুঁয়োপোকা থেকেই প্রজাপতি হয়। তার একটা পোষা প্রজাপতি
চাই-ই চাই!
ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন
দেখছিল ঝিনি। তার শুঁয়োপোকা গুটি বেঁধেছে কাচ ঘরে। একরাশ সবুজ পাতার বিছানায়। এক দিন, দু-দিন, পাঁচ দিন... কে জানে ক’দিন!
তারপর একদিন গুটি কেটে একটা মস্ত বড়ো ঝলমলে প্রজাপতি বেরিয়ে এল। দরজা খুলে দিল
ঝিনি। প্রজাপতিটা উড়ে যাওয়ার আগে একবার আলতো করে ছুঁল ঝিনির কচি হাতের আঙুল ক’টা। তারপর
আর ওকে দেখাই গেল না। তবে ঝিনি জানে, কখনও না কখনও ও ঠিক খেলা করতে আসবে ঝিনির
কাছে।
ঝিনির চোখের পাতায়
স্বপ্ন লেগে ছিল। আর আঙুলে রেণু রেণু অদৃশ্য রং। প্রজাপতির ডানার।
_____
ছবিঃ
সোমঋতা চ্যাটার্জী
No comments:
Post a Comment