অমিতাভ
প্রামাণিক
শেষপাতে
দই বাঙালি বহুকাল ধরে খেয়ে আসছে, তবে
‘নেপোয় মারে দই’ কথাটা
নেপোলিয়নের জন্মের আগে থেকে চালু ছিল কিনা তাতে ঘোর সন্দেহ আছে।
মিষ্টি দই বাঙালির প্রিয় খাদ্য এবং সারা ভারতে সেটা বেঙ্গলি ডেলিকেসি বলে পরিচিত হলে কী হয়, বাঙালি
বা ভারতীয়দের তুলনায় দধিপ্রীতিতে বহু এগিয়ে আছে ইওরোপের একটি দেশ – বালগেরিয়া। দই
ছাড়া সেখানকার লোকেদের কোনো খাদ্যই মুখে রোচে না।
আমরা যতই দই-ইলিশ, দই-পটল, দই-চিঁড়ে, দধিকর্মা, দইবড়া
বা দৈবাৎ দই-ভাত
খাই বা দহি-হান্ডি
ফাটাই না কেন, তাদের
সব কিছুতেই দই চাই।
তাদের অমল জানালার ধারে বসে থাকলে দইওয়ালা এসে জিজ্ঞেস করবে না দই চাই কিনা।
এমনিই নামিয়ে দিয়ে যাবে দইয়ের ভাণ্ড।
বিশ্বকে লস্যিও নাকি দিয়েছে তারাই।
কিন্তু
দইয়ের মাহাত্ম্য যে কী, তার
পেছনেও গল্প আছে।
১৯০৫
সালে, যখন দুই বাংলার বদমাশরা নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ি আর মারামারি করছিল, সেই
সময় স্ট্যামেন গ্রিগোরভ নামে এক বালগেরিয়ান গবেষক সুইজারল্যান্ডের জেনিভায় গবেষণা করছিল প্রোফেসর লিয়ন মাসোল নামে এক বিজ্ঞানীর ল্যাবরেটরিতে।
তার গবেষণার বিষয় – দই। দুধ
থেকে দই কীভাবে হয়, সেই
বিষয় নিয়ে সে ঘাম ঝরাচ্ছিল এতদিন।
সে বছরই সে বের করে ফেলল যে ব্যাসিলাস গোত্রের এক বিশেষ ব্যাকটেরিয়ার প্রভাবেই দুধ জমে হয়ে যায় দই।
তখন তার বয়স সাতাশ বছর।
উল্লেখ্য, গ্রিগোরভ জন্মেছিল সাতাশে অক্টোবর, ১৮৭৮
সালে এবং মারাও গিয়েছিল সাতাশে অক্টোবরেই, ১৯৪৫
সালে। সাতাশ সংখ্যাটার সঙ্গে তার বেশ ঘনিষ্ঠতা বোঝা যাচ্ছে।
জন্ম তার বালগেরিয়ার এক ক্ষুদ্র শহরে।
ফ্রান্সে ন্যাচারাল সায়েন্সে মাধ্যমিক স্তরের পাঠ শেষ করে সে হাজির হয়েছিল জেনিভায়, সেখানেই
এই আবিষ্কার।
এই আবিষ্কার আধুনিক ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফার্মেন্টেশন বা গাঁজন প্রক্রিয়ার জন্ম দিল।
একজন বালগেরিয়ানের কৃতিত্বকে স্মরণে রাখতে সেই ব্যাকটেরিয়ার নামকরণ করা হল ল্যাক্টোব্যাসিলাস বালগেরিকাস।
এবং তারও পরে অ্যান্টার্কটিকার এক হিমবাহের নামকরণ করা হয় গ্রিগোরভ গ্লেসিয়ার।
গ্রিগোরভ
দই নিয়ে আরও গবেষণা করেছিলেন এবং প্রমাণ পেয়েছিলেন বিভিন্ন আন্ত্রিক রোগে দই খাওয়ার সুফল।
তবে দুধ ঘন হয়ে ঠিক কীভাবে দই হয়, তার
ঠিকঠাক ব্যাখ্যা এসেছে আরও পরে।
তার
মানে এই নয় যে ভারতীয়রা দইয়ের ব্যবহার জানত না।
সেই বৈদিক যুগ থেকে পঞ্চগব্য (দুগ্ধ, দধি, ঘৃত, গোময়, গোমূত্র) ও পঞ্চামৃতের
ব্যবহার জানা –
দধি
দুগ্ধং ঘৃতঞ্চৈব শর্করাসংযুতং মধু।
পঞ্চামৃতমিদং
প্রোক্তং বিধেয়ং সর্বকর্মেষু।।
অর্থাৎ
সমস্ত কর্মে দধি-দুগ্ধ-ঘৃত-শর্করা
এবং মধু – এই
পঞ্চ অমৃতের ব্যবহার বিধেয়।
আয়ুর্বেদে দইয়ের গুণ ফলাও করে বর্ণনা করা আছে। অবশ্য আয়ুর্বেদমতে রাতে দই খাওয়া নিষেধ – ন নক্তং দধি ভুঞ্জীত। দই থেকে যে তক্র প্রস্তুত হয়, তারও প্রচুর কাহিনি। বিদেশিরা যতই দাবি করুক লস্যি তাদের দান, আয়ুর্বেদমতে তক্র পাঁচ প্রকার - ঘোল, মথিত (মাঠা), তক্র, উদশ্বিৎ ও ছচ্ছিকা। সরের সঙ্গে নির্জলা দই মন্থন করলে তাকে বলে ঘোল। সরবিহীন নির্জলা দই মেড়ে তৈরি হয় মথিত বা মাঠা। এক-চতুর্থাংশ জল দিয়ে দই মন্থন করলে তাকে তক্র আর আদ্ধেক জলের সঙ্গে দই মন্থন করলে তাকে উদশ্বিৎ বলে। প্রচুর জল ঢেলে দই মাড়লে যে স্বচ্ছপদার্থ তৈরি হয় তাকে বলে ছচ্ছিকা অর্থাৎ কিনা ছাস।
মেসোপটেমিয়ায়
৫০০০ বছর আগে দই ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
রোমের প্লিনি দ্য এল্ডার লিখে গেছেন এক যাযাবর বর্বর জাতির কথা, যারা
দুধকে ঘন করে অম্ল এক খাদ্য বানাতে পারে।
দই
সম্ভবত যাযাবরদেরই আবিষ্কার।
দুধ তারা বয়ে নিয়ে যেত পশুচর্মের থলিতে।
সেখান থেকেই ল্যাক্টোব্যাসিলাস ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হয়ে তৈরি হত দই।
গ্রিগোরভের
গবেষণায় উৎসাহিত হয়ে প্যারিসের পাস্তুর ইন্সটিট্যুটের নোবেলজয়ী রাশিয়ান বিজ্ঞানী এলি মেশনিকফ দইয়ের ওপর পরীক্ষানিরীক্ষা চালান ও দাবি
করেন দই মানুষের আয়ু বর্ধন করে।
ইনি ফ্যাগোসাইট বা মাইক্রোফাজ আবিষ্কার করেছিলেন যা থেকে মানুষের স্বয়ংক্রিয় রোগ-প্রতিরোধ
ক্ষমতার (ইনেট ইমিউনিটি) প্রথম
হদিশ মেলে।
১৮৮৩ সালে ইনি আবিষ্কার করেছিলেন কিছু শ্বেত রক্তকণিকা শরীরে অনুপ্রবেশকারী ক্ষতিকর পদার্থ যেমন ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হলে তাদের ‘গিলে
খেয়ে’ ধ্বংস করে দিতে পারে, যার
নাম দেওয়া হল ফ্যাগোসাইটোসিস।
এর জন্যেই নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন তিনি ১৯০৮ সালে।
১৯০৮
সালেই প্রকাশিত মেশনিকফের সেই ঐতিহাসিক ‘দ্য
প্রলঙ্গেশন অভ লাইফ – অপ্টিমিস্টিক
স্টাডিজ’ প্রকাশিত হতেই সারা বিশ্বে আলোড়ন পড়ে গেল।
ইনি বললেন অত্যধিক দধিপ্রীতিই বালগেরিয়ানদের, বস্তুত দক্ষিণ-পূর্ব
ইওরোপ ও রাশিয়ার
বিস্তীর্ণ তৃণভূমির অধিবাসীদের বহু বছর সুস্থ অবস্থায় বেঁচে থাকার কারণ।
তাঁর ধারণা ছিল, বার্ধক্যের
কারণ হচ্ছে অন্ত্রে ক্লস্ট্রিডিয়া ধরণের প্রোটিওলাইটিক ব্যাকটেরিয়া, যাদের সংক্রমণে ফেনল, অ্যামোনিয়া, ইন্ডোল ইত্যাদি ক্ষতিকর পদার্থ তৈরি হয়।
প্রোটিওলাইটিক ব্যাকটেরিয়া প্রোটিন ভেঙে ফেলে।
তিনি ভাবলেন, ল্যাকটোব্যাসিলাস
যেহেতু প্রোটিনসমৃদ্ধ দুধ নষ্ট হতে দেয় না, তার
মানে এর মধ্যে এমন কিছু আছে যা প্রোটিওলাইটিক ব্যাকটেরিয়াকে নিষ্ক্রিয় করতে পারে।
আরও দেখলেন উপরোক্ত অঞ্চলের অধিবাসীরা নিয়মিত দই খায় আর সাধারণভাবে বেশিদিন বাঁচে।
দুটোর মধ্যে নিশ্চয় যোগাযোগ আছে, অর্থাৎ
দই খাওয়াই তাদের আয়ুবৃদ্ধির কারণ, বলে
দিলেন তিনি।
ততদিন
অবধি আমেরিকানরা দই কী জিনিস জানত না।
এবার তারা নড়েচড়ে বসল আয়ুবৃদ্ধি করতে।
অমরত্ব পেতে কে না চায়?
সুযোগ
পেয়ে বাণিজ্যিক স্কেলে দই উৎপাদন নিয়ে মাথা ঘামানো শুরু করল খাদ্য প্রস্তুতকারী সংস্থারা।
প্রাচীন অটোমান, বর্তমানে
গ্রিসের সালোনিকা শহরের আইজ্যাক কাসারো নামে এক ব্যবসায়ী স্পেনের বার্সেলোনায় শুরু করেছিল এক ছোটোখাটো দইয়ের ব্যাবসা।
তার ছেলে ড্যানিয়েলের নাম অনুসারে কোম্পানির নাম দিল সে ড্যানন।
ইওরোপ থেকে আমেরিকায় পাড়ি দিয়ে ব্যাবসা ফুলে-ফেঁপে
উঠতে সময় লাগল না।
দইয়ের মধ্যে বিভিন্ন ফ্লেভার ও কাটা
ফল বা তাদের জ্যাম মিশিয়ে পেটেন্ট নেওয়া শুরু হয়ে গেল।
আমেরিকানরাই
বা পিছিয়ে থাকবে কেন? মিশিগানের
জন হার্ভে কেলগ – ভবিষ্যৎ
দুনিয়া যাকে চিনবে ব্রেকফাস্ট সিরিল কর্নফ্লেক্সের জন্যে, যা তিনি শুরু করেছিলেন ভাই উইলিয়াম কীথ কেলগের সঙ্গে কেলগস’ ব্র্যান্ড
দিয়ে – শুরু করলেন দইয়ের ব্যাবসা।
সার্কিস আর রোজ কলম্বোসিয়ান নামে দুই আর্মেনিয়ান ইমিগ্রান্ট ম্যাসাচুসেটসে চালু করল কলম্বো অ্যান্ড সন্স ক্রিমারি নামে এক কোম্পানি।
নিউ ইংল্যান্ডে তারা ঘোড়ায়-টানা
ওয়াগনে দই বিক্রি করত মাদজু নাম দিয়ে।
মাদজু হচ্ছে দইয়ের আর্মেনিয় নাম।
পরে সেটাই তুর্কি ভাষায় পরিবর্তিত হয়ে নাম নিল – ইয়োগার্ট। দইয়ের
বিক্রি বাড়লেও আমেরিকানদের জিভে তা অত্যন্ত টক খাদ্য হিসাবেই বিবেচ্য ছিল।
পরে এর সঙ্গে চিনি ও ফল-টল মিশিয়ে কলম্বো ইয়োগার্ট সুষম খাদ্য হিসাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠল।
বাঙালিদের
মিষ্টি দই ঠিক কবে থেকে চালু হয়েছে, তা
অবশ্য আমি জানি না।
ল্যাক্টোব্যাসিলাস
বালগেরিকাস নিয়ে গবেষণা করে জানা গেছে এরা ৪.৬
থেকে ৫.৪
পি এইচে সবচেয়ে দ্রুত বাড়ে।
দুধ থেকে দই বানাতে এরা একা রাম নয়, বরঞ্চ
এদের সঙ্গে স্ট্রেপ্টোকক্কাস থার্মোফিলাস নামে আর এক সুগ্রীব দোসর থাকলে সুবিধা, এরা
একেবারে মাসতুতো ভাই গোত্রের।
ল্যাক্টোব্যাসিলাস দুধের প্রোটিন, যার
নাম কেসিন, তাকে
ভেঙে অ্যামাইনো অ্যাসিড তৈরি করে, সেটার
ওপর তখন লেগে পড়ে এই স্ট্রেপ্টোকক্কাস, দুজনে মিলে তৈরি করে ল্যাকটিক অ্যাসিড।
এই ল্যাকটিক অ্যাসিডই দইয়ের অম্লত্বের কারণ।
অ্যাসিড তৈরি হতেই দুধের কেসিন প্রোটিন ডিনেচার্ড হয়ে তঞ্চিত (কোয়াগুলেটেড) হয়ে যায়, ফলে
দুধ ঘন হয়ে যায়।
এর সঙ্গে খুব অল্প পরিমাণে অ্যাসিট্যালডিহাইডও তৈরি হয়, যা
দইয়ের টক টক গন্ধের কারণ।
২০১২
সালে ভারতের পরিবেশ, অরণ্য
ও আবহাওয়া পরিবর্তন মন্ত্রক সায়েন্স এক্সপ্রেস বায়োডাইভার্সিটি স্পেশাল নামে এক বিশেষ শিক্ষামূলক ট্রেন চালায়।
প্রধানত স্কুলের শিক্ষার্থীদের জীবাণু সম্বন্ধে বিশেষভাবে অবহিত করে তোলা ছিল এই ট্রেনের উদ্দেশ্য।
যে সমস্ত স্টেশনে এই ট্রেন থামে, সেখানকার
স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের জীবাণু সম্বন্ধে আকৃষ্ট করে তোলা ছাড়াও এক ভোটিং-এর
ব্যবস্থা করা হয় কোন জীবাণুকে ভারতের জাতীয় জীবাণুর সম্মান দেওয়া যায়, তার
ওপর।
ছাত্রছাত্রীদের ভোটের বিচারে এই সম্মানের প্রাপক হয় ল্যাক্টোব্যাসিলাস বালগেরিকাস।
২০১৪
সাল থেকে একে ল্যাক্টোব্যাসিলাস ডেলব্রুয়েকাই নামেও ডাকা হতে থাকে।
দই
খাও, দই
ভালো জিনিস।
যাদের মডারেট ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স আছে অর্থাৎ দুধের ল্যাকটোজ সুগার যারা হজম করতে পার না, তারাও
দই খেতে পার, কেননা
ল্যাক্টোব্যাসিলাস ল্যাকটেজ এনজাইম দিয়ে দুধের ল্যাকটোজ বিভিন্ন মাত্রায় ভেঙে ফেলতে পারে।
আন্ত্রিক গোলযোগে যারা অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে শরীরের উপকারী ব্যাকটেরিয়াদের মেরে ফেলতে বাধ্য হও, তারা
অ্যান্টিবায়োটিক কোর্স শেষ হলে ডাক্তারের পরামর্শে দই খেতে পার, তাতে
অন্ত্রে উপকারী ন্যাচারাল ব্যাকটেরিয়ার কলোনি দ্রুত প্রতিস্থাপিত হয় বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা।
তবে
আর কী! হয় সহজপাঠের মতন ‘বাটি হাতে এ ঐ / হাঁক দেয় দে দই’ শুরু করো, অথবা চণ্ডালিকার
মতো ‘দই চাই গো দই চাই, দই চাই গো!/ শ্যামলী আমার গাই, তুলনা তাহার নাই’ গাইতে লেগে যাও।
_____
ছবিঃ
আন্তর্জাল
মিস্টার প্রামাণিক, অসাধারণ আপনার এই নিবন্ধটি! এত তথ্য সমৃদ্ধ যে, আপনি বিশ্বব্যাপী "ম্যাজিক ল্যাম্প"-এর অগণিত পাঠকবৃন্দকে ঋদ্ধ করলেন। দধিমন্থন করে এমন শারদ উপহার দেওয়ার জন্যে আমার তরফে আপনাকে জানাই অনেক অনেক শুভেচ্ছা ।
ReplyDeleteসুন্দর আলখ্য। ছোটরা ছাড়াও বড়দের জন্যেও এ নিবন্ধ বড়ই রোচক।
ReplyDelete