গল্পের ম্যাজিক:: ইজিপসিয়ান বক্স - সায়ন্তনী পলমল ঘোষ


ইজিপসিয়ান বক্স
সায়ন্তনী পলমল ঘোষ

ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে চুপচাপ এক কাপ কফি নিয়ে বসেছিলেন জ্যোতিষ্ক।
মন খারাপ?” মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলেন নন্দিনী।
হেসে ফেললেন জ্যোতিষ্ক, “হুঁ। জানো তো ছেলেমেয়ে দুটো না থাকলে বাড়িটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে আমার।
সে তো আমারও লাগে, কিন্তু তারা দুজন মজায় আছে। একটু আগে ভিডিও কল করেছিল। পুরী বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান হয়ে গেছে তাদের।
প্রফেসর জ্যোতিষ্ক সেনের যমজ ছেলেমেয়ে সূর্য আর শশীর জন্ম আর বেড়ে ওঠা মার্কিন মুলুকে হলেও সুযোগ পেলেই দুজনে পাড়ি জমায় মাতৃভূমিতে আত্মীয়স্বজনদের কাছে। কাজের চাপে জ্যোতিষ্ক আর নন্দিনী সবসময় যেতে পারেন না। ডক্টর সেনের আদিবাড়ি কলকাতার গড়িয়াহাটের কাছে। ওনার ভাই আকাশ সেন নামকরা একজন ডাক্তার। ভাইয়ের পরিবার ওনার বাবা-মায়ের সঙ্গে কলকাতার বাড়িতেই থাকে। সূর্য আর শশী দেশে গিয়ে নিজেদের পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে খুব পছন্দ করে আর ওরা দেশে গেলেই আকাশ বিভিন্ন জায়গা ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করে ফেলে তাতে ওদের আনন্দটা আরও দ্বিগুণ হয়ে যায়।

ওরে, তোরা এবার ওঠ রে। খাওয়া-দাওয়া সব ভুলে গেলি নাকি!চেঁচিয়ে উঠলেন রুচি।
কাম্মা, আর একটু।
আর দশ মিনিট মা।
সূর্য, শশী আর আদিত্য তিন ভাই বোনের সমুদ্র স্নান আর শেষই হচ্ছে না। ওরা এখানে কোনও হোটেলে ওঠেনি। আকাশের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু রমেশ পারিদার আতিথ্য গ্রহণ করেছে। রমেশের ছোটোবেলা কেটেছে কলকাতায় মামার বাড়িতে। আকাশের সঙ্গে ক্লাস ওয়ান থেকে টুয়েলভ পর্যন্ত একসঙ্গে পড়েছিলেন। রমেশবাবুরা পুরীর আদি বাসিন্দা। পুরোনো আমলের বিশাল দোতলা বাড়ি ওনাদের। খাতির যত্নের কোনও ত্রুটি হচ্ছে না। রমেশবাবুর পরিবারের মানুষজনও খুব আন্তরিক। সেদিন বিকেল বেলায় রমেশবাবু ওদের বললেন, “চল, তোমাদের সঙ্গে একজনের আলাপ করাব। আমাদের কয়েকটা বাড়ির পরেই ওনার বাড়ি।রুচি গল্পে ব্যস্ত, তাই বেরোলেন না। সূর্যর দাদু-ঠাম্মুও বিশ্রাম নিচ্ছেন তাই রমেশবাবুর সঙ্গে আকাশ আর তিন ভাই-বোন বেরিয়ে পড়ল।

বাড়িটার দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে চোখের পলক পড়ছে না কারুর।
এ তো ছোটোখাটো রাজপ্রাসাদ!আদিত্য বিড়বিড় করে।
রমেশ কাকুদের বাড়িতেই কেমন একটা ভিন্টেজ ফিলিংস হচ্ছে, আর এ তো...ফিসফিস করে বলে সূর্য।
সুবিশাল তিনতলা বাড়িটার গঠনশৈলী দেখে মনে হয় যেন জীবন্ত ইতিহাস। তবে পুরোনো হলেও বাড়িটার মোটেও হতশ্রী দশা নয়। বাড়ির মালিক যে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করেন সেটা ভালোই বোঝা যাচ্ছে। রাস্তায় আসতে আসতে ওরা রমেশবাবুর কাছ থেকে মালিকের পরিচয় জেনেছে। বিজেন্দ্র পতি ব্যবসায়ী মানুষ। ওনারা বংশ পরম্পরায় ধনী। ব্যবসায়ীর পাশাপাশি ওনার আরেকটা পরিচয় হল শখের এন্টিক কালেক্টর। ওনার কালেকশন নাকি দেখবার মতো। এসব বিষয়ে ওনার জ্ঞানও আছে ভালো মতো। রীতিমতো পড়াশোনা করেন উনি।
আরে এসো এসো রমেশ। অনেকদিন পর এলে,” বিজেন্দ্র নিজেই গাড়ি বারান্দায় বেরিয়ে এসে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন। রমেশ আগেই ফোন করে আসার কথা জানিয়েছিলেন। বছর ষাটেকের বিজেন্দ্রর চেহারার মধ্যে একটা আভিজাত্য আছে। ওড়িশার অনেক মানুষের মতো ইনিও বেশ ভালো বাংলা বলেন।
সুসজ্জিত বৈঠকখানায় গিয়ে বসল ওরা। বৈঠকখানার সাজসজ্জা মালিকের নেশার সঙ্গে মানানসই। রুচিপূর্ণ দামি কাঠের আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো। দেওয়ালে বিভিন্ন ধরনের ভারতীয় চিত্রকলার নিদর্শন। বসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বড়ো বড়ো কাচের গ্লাসে শরবত চলে এল।
আমি এদের আপনার কালেকশন দেখাতে নিয়ে এলাম। এ হল আমার বাল্যবন্ধু ডাক্তার আকাশ সেন। ওর ভাইপো-ভাইঝি সূর্য আর শশী। আর এ হল আকাশের ছেলে আদিত্য।রমেশ সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বিজেন্দ্র বললেন, “আপনারা কলকাতার বাসিন্দা তো?” আকাশ ঘাড় নেড়ে বললেন, “হ্যাঁ, তবে আমার ভাইপো-ভাইঝি এখানে থাকে না। আমার দাদা-বৌদি আমেরিকায় থাকেন।
আকাশ কথা বলতে বলতেই বিজেন্দ্রর চেয়ে বয়সে কিছুটা ছোটো এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। বিজেন্দ্র পরিচয় করিয়ে দিলেন, “আমার ভাই মহেন্দ্র। আমার নেশা এন্টিক আর ওর গাছপালা। ওর ক্যাকটাসের কালেকশন দেখার মতো কিন্তু।সূর্য আর আদিত্য লাফিয়ে উঠল। মহেন্দ্রকে উদ্দেশ করে সূর্য বলল, “আঙ্কেল, আমি কি আপনার কালেকশন দেখতে পারি? মানে আসলে এন্টিকের প্রতি আমার বিশেষ কিছু আগ্রহ নেই। প্লিজ, বিজেন্দ্র আঙ্কেল কিছু মাইন্ড করবেন না।
আরে না না, সবাই সব বিষয়ে আগ্রহী হবে না সেটাই তো স্বাভাবিক। তুমি কী নিয়ে পড়াশোনা করছ?”
বায়োটেকনোলজি।
সূর্য আর আদিত্য মহেন্দ্রর সঙ্গে চলে গেল আর বিজেন্দ্র বাকিদের নিয়ে এলেন ওনার সংগ্রহশালায়।

যথেষ্ট সুরক্ষিত বিশাল একটা হলঘর। বিজেন্দ্রর সংগ্রহ কিন্তু যথেষ্ট আকর্ষণীয়। রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত জিনিস থেকে শুরু করে মারাঠা দস্যু ভাস্কর পন্ডিতের ব্যবহৃত অস্ত্র সবই আছে তাঁর সম্ভারে। একটা তিব্বতি জপ যন্ত্র ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে হঠাৎ করে শশীর চোখ চলে গেল কাচের আলমারির মধ্যে রাখা সুদৃশ্য একটা বাক্সের দিকে। বাক্সটা দেখতে অনেকটা আগেকার দিনের গয়না রাখার বাক্সের মতন। দেখে মনে হল পিতলের তৈরি। গায়ে অসম্ভব সূক্ষ্ম নকশা কাটা। নকশাগুলোর দিকে তাকিয়ে শশীর মনে হল এই ধরনের নকশা সে আগে কোথাও দেখেছে, কিন্তু ঠিক মনে করতে পারল না।
ওই বক্সটায় কী আছে?” বিজেন্দ্রবাবুর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে শশী। বিজেন্দ্র এগিয়ে এসে চাবি ঘুরিয়ে আলমারি খুলে বাক্সটা বের করে আনলেন।
এটা আমার লেটেস্ট কালেকশন। ব্যাবসার কাজে দিল্লি গিয়েছিলাম। আমার লোক আছে বিভিন্ন জায়গায়। তাদের একজনই খবর দিয়েছিল তখন এটার সম্বন্ধে। আমি ইন্টারেস্টেড জানিয়ে দিয়েছিলাম তখনই। আজ সকালেই জিনিসটা আমার হাতে এসে পৌঁছেছে,” এই বলে বাক্সটা খুলে ফেললেন বিজেন্দ্র। ভেতর থেকে প্রথমে বের করলেন একটা সোনার নেকপিস। লিবিয়া স্যান্ড গ্লাস বা গ্রেট স্যান্ড স্টোন গ্লাস বসানো নেকপিসটা দেখেই চমকে উঠল শশী, “এটা তো ইজিপসিয়ান জুয়েলারি! অনেক আগে ইজিপসিয়ান মহিলারা পরতেন এরকম নেকপিস। এই হলদেটে সবুজ স্টোনগুলো সাহারা মরুভূমিতে পাওয়া যায়। লিবিয়া আর পশ্চিম মিশরে। প্রাচীন মিশরে এই স্টোনের গয়না খুব পছন্দ ছিল মহিলাদের।
বাহ! তুমি এটা দেখেই বুঝলে কী করে?” বিজেন্দ্রর কণ্ঠে বিস্ময় ঝরে পড়ে। এগিয়ে আসেন আকাশ, “এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই বিজেন্দ্রবাবু। আমার ভাইপো বায়োটেকনোলজি পড়লেও আমার ভাইঝি ওর বাবার পথই অনুসরণ করেছে। ইতিহাসের কৃতী ছাত্রী ও, আর আমার দাদার মতো একজন ইতিহাসবিদকে সব সময় কাছে পাচ্ছে। তাছাড়া মিশরীয় সভ্যতার বিষয়ে আমার দাদা পৃথিবীর সেরা এক্সপার্টদের মধ্যে অন্যতম, তাই এটা চিনতে পারা শশীর জন্য এমন কোনও শক্ত ব্যাপার নয়।দাদা আর ভাইঝির জন্য প্রচ্ছন্ন গর্ব ফুটে উঠল আকাশের কণ্ঠে। বিজেন্দ্র অবাক হয়ে বলেন, “তাই নাকি! আপনার দাদার নাম কী? উনি বিদেশে থাকেন শুনলাম তো।
জ্যোতিষ্ক সেন। দাদা এখন মিশিগান ইউনিভার্সিটিতে আছে।
দাঁড়ান, দাঁড়ান, জ্যোতিষ্ক সেন মানে যাঁর সম্বন্ধে শুনেছি যে উনি হায়ারোগ্লিফিক্স এমন ভাবে পড়তে পারেন যেন ইংরেজি কিংবা ওনার মাতৃভাষা বাংলা পড়ছেন। রব উইলিয়ামস আর ডিক টার্নার ছাড়া এ ব্যাপারে ওনার সমকক্ষ বর্তমানে আর কেউ নেই। কী, ঠিক বলছি?” বিজেন্দ্র যে অনেক খবরাখবর রাখেন, পড়াশোনা করেন ওরা আগেই শুনেছিল। এবার হাতেনাতে প্রমাণ পেল। শশী মৃদু হেসে বিজেন্দ্রর কথা সমর্থন করল।
কী ভাগ্য আমার! জ্যোতিষ্ক সেনের মেয়ে আর ভাই আমার কালেকশন দেখছে। তুমি তো তাহলে জ্যোতিষ্ক সেন জুনিয়র,” শশীর দিকে তাকিয়ে বললেন বিজেন্দ্র। এবার শশী লজ্জা পেয়ে গেল, “না,না আঙ্কেল। এসব কী বলছেন।বিজেন্দ্র উৎসাহিত হয়ে বললেন, “দাঁড়াও, এর মধ্যে আরও জিনিস আছে।বিজেন্দ্র আবার বাক্সে হাত ঢোকালেন। জিনিসগুলো দেখে শশী সহজেই চিনতে পারল। প্যাপাইরাস স্ক্রল, প্রাচীন মিশরে কোনও কিছু লেখার জন্য এই প্যাপাইরাস ব্যবহৃত হত। প্রায় খ্রিস্টপূর্ব চার হাজার বছর আগে প্রথম প্যাপাইরাসের ওপর লেখা শুরু হয়। গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলীও অনেক সময় প্যাপাইরাসের ওপর লিপিবদ্ধ করা হত। স্ক্রলটা বিজেন্দ্র শশীর হাতে দিলেন, “খুলে দেখ কিছু বুঝতে পারো কিনা।শশী সাবধানে স্ক্রলটা খুলল। বেশ লম্বা। পাঁচটা প্যাপাইরাস জুড়ে জুড়ে স্ক্রলটা তৈরি হয়েছে। লিপিটা হ্যারোগ্লিফিক্স-এ লেখা। শশী মনে মনে ভাবল যে তার বাবা থাকলে এক্ষুনি এটা পড়ে ফেলতে পারত। বাবার জায়গায় পৌঁছতে তার অনেক সময় লাগবে এখনও। আদৌ কোনও দিন পৌঁছতে পারবে কিনা কে জানে। বেশ কিছুক্ষণ স্ক্রলটা আর নেকপিসটা নাড়াচাড়া করে দেখল শশী। দুটো জিনিসই নিঃসন্দেহে কয়েক হাজার বছরের পুরোনো।
কী রে, কিছু বুঝতে পারছিস এ দুটো দেখে?”
না গো, কাকাই। আমি কি বাবা নাকি? অনেক পুরোনো এটা বুঝতে পারছি আর প্যাপাইরাসগুলোতে সম্ভবত সূর্য দেবতা আমন, যাকে অনেক সময় রা-ও বলা হত তাঁর সম্বন্ধে কিছু লেখা আছে।
বাহ, এই তো অনেক কিছু বুঝেছ,” বিজেন্দ্রর চোখে প্রশংসা।
না, না এ আর কী!
এমন সময় আকাশের ফোনটা গান শোনাতে আরম্ভ করে। ফোনটা ধরে একটু সরে গিয়ে কথা সেরে আকাশ বলেন, “এবার আমাদের যেতে হবে।
এখনও যে আমার পুরো কালেকশন দেখানো হল না,” বাধা দিয়ে বলে ওঠেন বিজেন্দ্র।
আর একদিন আসব। কাল সকালেই তো এসেছি। এখন কয়েকটা দিন থাকব। সারা বছরের ব্যস্ততা থেকে কয়েকটা দিন চুরি করেছি। ওরাও তারপর ফিরে যাবে।

রমেশবাবুদের ড্রইং রুমে ঢুকেই আনন্দে লাফিয়ে উঠল তিন ভাইবোন।
ড্যাড!
মম!
জ্যেঠু-জেম্মা তোমরা!
সবার মুখে মুচকি হাসি। জ্যোতিষ্ক বললেন, “কেমন সারপ্রাইজ দিলাম। তোরা কাল সকালে কলকাতা ছাড়লি আর আমরা বিকেলে পৌঁছে রাতে শোভা মাসির হাতের দুর্দান্ত ভেটকির পাতুরি খেয়ে আজকে চলে এলাম এখানে।
হুম, বুঝলাম। আমাদের কিচ্ছু বলা হয়নি। কাম্মা, ওই জন্য গেল না আমাদের সঙ্গে আর কাকাই ফোন পেয়েই তড়িঘড়ি চলে এল ওখান থেকে,” সূর্য মাথা নেড়ে বলে। ওর বলার ভঙ্গিমায় সবাই হেসে উঠল।
হুম, এখানে এসে একটা জিনিস বুঝলাম অমিতাভ বচ্চনও আমজাদ খান হয়ে যায়,” জ্যোতিষ্ক কথাটা বললেন রমেশের উদ্দেশে। অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে রমেশ বললেন, “ঠিক বলেছ জ্যোতিষ্কদা, আমাকে পুরোনো চেনা পরিচিত, আত্মীয়স্বজন সবাই বলছে কী করে এমন চেহারাখানা বানিয়ে ফেললাম।হাসি-গল্পের মাঝে জ্যোতিষ্ক বলে উঠলেন, “তোরা সব কোনও একজন ভদ্রলোকের এন্টিক কালেকশন দেখতে গিয়েছিলি, তাই না?”
হুম, তবে আমি আর আদি ওই ভদ্রলোকের ভাইয়ের শখের বাগান দেখছিলাম। ক্যাকটাসের দারুণ কালেকশন আছে ওনার। দি আর কাকাই তোমার ভাষায় ইতিহাসে ডুব দিয়েছিল,” সূর্য বলে।
জানো জ্যেঠু, দিভাই না ওখানে একটা নেকপিস দেখেছে, তারপর থেকে ওটার কথা ভাবতে ভাবতে রাস্তায় আসছিল। মমির গলার নেকপিসটা ওর খুব পছন্দ হয়েছে,” চোখ নাচিয়ে বলে আদি।
শশী চোখ পাকিয়ে বলল, “কে বলেছে রে তোকে ওটা মমির গলায় ছিল?”
আচ্ছা, ঝগড়া বাদ দে, কী দেখেছিস আমাকে বল,” আগ্রহী হয়ে ওঠেন জ্যোতিষ্ক। শশী ওখানে কী কী দেখেছে সব জানায়, তারপর ভাবুক কন্ঠে বলে, “ইউ নো ড্যাড, আমার কেমন যেন মনে হচ্ছিল ওই নেকপিস আর স্ক্রলটায় অনেক কথা লুকিয়ে আছে। অনেক কিছু বলতে চাইছে ওরা।

বিজেন্দ্রর একটা স্বভাব হল ওনার নতুন কোনও কালেকশন হাতে পাওয়ার পর দিন তিনেক সেটা রাতের বেলা নিজের কাছে নিয়ে ঘুমোন। এতে তাঁর মনে অন্যরকম একটা তৃপ্তি জাগে। বেশ একটা আত্মপ্রসাদ অনুভব করেন তিনি। সেই অভ্যেসবশেই ইজিপিশিয়ান বাক্সটা হাতে নিয়ে শোবার ঘরে ঢুকলেন। প্রকান্ড একটা পালঙ্কে ঘুমোন তিনি। ওনার স্ত্রী মেয়ের বাড়ি গিয়েছেন, তাই আজ বিজেন্দ্র সম্পূর্ণ একা। বাক্সটাকে খাটের ওপরেই মাথার সমান্তরালে রেখে শুয়ে পড়লেন বিজেন্দ্র। বরাবরই তাঁর গাঢ় ঘুম হয়। এক ঘুমে রাত কাবার করেন, কিন্তু সেদিন মাঝরাতের দিকে ঘুমটা পাতলা হয়ে গেল বিজেন্দ্রর। অর্ধ ঘুমন্ত অবস্থায় তিনি অনুভব করলেন সারা শরীরটা কেমন যেন দুর্বল হয়ে গেছে। চাইলেও উঠতে পারছেন না তিনি। চোখটাও খুলতে পারছেন না, কিন্তু কানের মধ্যে ভেসে আসছে অদ্ভুত একটা সুর। ভাষাটা তাঁর অজানা, কিন্তু কেউ যেন একটানা বিলাপ করে চলেছে। বহুক্ষণ একটা ঘোরের মধ্যে কাটল বিজেন্দ্রর, তারপর নিজের অজান্তেই আবার ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলেন।
সকালে ঘুম থেকে উঠে রোদ ঝলমলে আবহাওয়ার প্রভাবেই হয়তো বা বিজেন্দ্রর মনে হল গতরাতে যা ঘটেছে তা তাঁর ভ্রম মাত্র। শরীরে কোনও অসুবিধার দরুন দুঃস্বপ্ন দেখেছেন। সেদিন রাতে খাটের পাশে রাখা ছোট্ট গোল টেবিলটায় বাক্সটাকে রাখলেন। আজ তাঁর স্ত্রী ফিরে এসেছেন। শুতে যাওয়ার আগে স্ত্রীকে তাঁর নতুন সংগ্রহ দেখিয়ে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে গেলেন বিজেন্দ্র, কিন্তু আবার সেই একই অনুভূতি। আজ আবার সেই বিলাপের সুর কিছু সময় পরে বদলে গেল। শুরু হল দূর্বোধ্য ভাষায় রাগত কণ্ঠের চিৎকার। বিজেন্দ্রর কানের পর্দায় যেন ঘা মারছে সেই কন্ঠ, কিন্তু তিনি নিরুপায়। শরীরটা যেন বিছানার সঙ্গে মিশে আছে। ওঠার সাধ্য নেই তাঁর। ধীরে ধীরে একসময় থেমে গেল সেই কন্ঠ। গাঢ় ঘুম নেমে এল বিজেন্দ্রর চোখে। সেইদিন সকালে ঘুম ভাঙার পর অবশ্য বিজেন্দ্র দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলেন, কারণ তাঁর স্ত্রীরও একই রকম অনুভূতি হয়েছে। তিনি ভীত হয়ে রীতিমতো চিৎকার চেঁচামেচি জুড়েছেন। বাক্সটা আর বাড়িতে রাখতে চান না তিনি। মুখে কিছু না বললেও বিজেন্দ্রর মনেও আতঙ্কের কালো মেঘ উঁকিঝুঁকি মারছে। সেই যৌবনকাল থেকে এন্টিক সংগ্রহের নেশা তাঁর, কিন্তু কখনও এরকম অভিজ্ঞতা হয়নি। অনেক জিনিসের সম্বন্ধেই অনেক রকম মিথ শুনেছেন, কিন্তু হাতে আসার পর বুঝেছেন সেগুলো মানুষের অতিরঞ্জিত কল্পনার ফসলমাত্র। তবে এবারের এই দুদিনের অভিজ্ঞতা তাঁকে যথেষ্ট ভাবাচ্ছে। তাঁর হয়তো ভ্রম হতে পারে, কিন্তু তাঁর স্ত্রীরও একইসঙ্গে ভ্রম হবে এটা সম্ভব নয়। তাহলে

সকলে মিলে সারাদিন হই হই করে চিলকা হ্রদ ঘুরে এসে ড্রয়িং রুমে গা এলিয়ে বসে গল্পগুজব চলছে, এমন সময় ঘরে ঢুকলেন বিজেন্দ্র পতি। দরজা খোলাই ছিল। রমেশ এবং তাঁর বাড়ির সবাই একটু অবাকই হলেন, কারণ বিজেন্দ্র কোনও কারণ ছাড়া কারুর বাড়ি আসেন না সচরাচর। বিস্মিত ভাবটা কাটিয়ে রমেশ অভ্যর্থনা জানালেন, “আসুন, আসুন।বিজেন্দ্র এসে বসলেন, কিন্তু তাঁর চোখমুখ শুকনো। স্বাভাবিক ভাবেই ঘরে উপস্থিত জ্যোতিষ্ক, নন্দিনী আর রুচির ওপর নজর পড়ল তাঁর। এঁদের তিনি চেনেন না।
এঁদের তো ঠিক…”
আমার দাদা জ্যোতিষ্ক সেন, বৌদি নন্দিনী সেন আর আমার মিসেস রুচি সেন,” পরিচয় দিয়ে আকাশ জ্যোতিষ্কর দিকে তাকিয়ে বললেন, “দাদা, এনার এন্টিক কালেকশন দেখতেই গিয়েছিলাম সেদিন।
বিজেন্দ্র একদৃষ্টিতে জ্যোতিষ্ককে দেখছেন।
আপনি, আপনিই পারবেন আমার সমস্যার সমাধান করতে,” বিজেন্দ্রর গলায় ব্যাকুলতা।
কী হয়েছে আপনার?” রমেশ জিজ্ঞেস করলেন।
তোমরা তো সেদিন আমার নতুন কালেকশনটা দেখে এলে। সমস্যা শুরু হয়েছে ওটা নিয়েই।
কী প্রবলেম?” শশীর কণ্ঠে কৌতূহল।
তাঁর অভিজ্ঞতা বলতে আরম্ভ করলেন বিজেন্দ্র। প্রতি রাতেই একই অভিজ্ঞতা হচ্ছিল তাঁর, তাই কাল রাতে বাক্সটা আর শোবার ঘরে না রেখে তাঁর কালেকশন রুমে রেখেছিলেন। শোবার ঘরে কোনও সমস্যা হয়নি, কিন্তু মাঝরাত নাগাদ কৌতূহল বশত বিজেন্দ্র উঠে কালেকশন রুমে যান। রুমে ঢোকার মিনিট খানেকের মধ্যে সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি শুরু হয়। বিজেন্দ্র স্ট্যাচুর মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন। নড়াচড়া করতে পারেন না। তারপর কখন যে তিনি রুমে ফিরে এসে শুয়ে পড়েছেন নিজেই জানেন না। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তাঁর স্ত্রীও বুঝতে পারেননি কিছু। এই সমস্ত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিজেন্দ্র তাঁর দিল্লির এজেন্টকে ফোন করেন যে এই বাক্সটার সন্ধান এনেছিল। সে খোঁজখবর করে খানিক আগে জানিয়েছে যে এই বাক্সটা মাত্র মাস কয়েক আগে মিশরের এক জায়গায় খননকার্য থেকে উদ্ধার হয়েছিল। তারপর কোনও ভাবে চুরি হয়ে এন্টিক মার্কেটে চলে আসে, আর যার কাছ থেকে বাক্সটা কেনা হয়েছে তারও একই রকম অভিজ্ঞতা ঘটেছে, সেই কারণেই কম দামে জিনিসটা বিক্রি করে দিয়েছে সে। একটানা বলে বিজেন্দ্র একটু চুপ করেন।
আপনি তাহলে ওটা নিয়ে কী করবেন ভাবছেন?” রমেশ প্রশ্ন করেন।
কী করা যায় সে বিষয়ে আলোচনা করতেই আমি এখানে এসেছিলাম, কারণ সেদিন শশীর কথাবার্তা আমার খুব ইম্প্রেসিভ লেগেছিল, কিন্তু এখানে আসার পর আমি আমার করণীয় সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে গেছি।
এরপর জ্যোতিষ্কর দিকে ঘুরে বললেন, “প্রফেসর সেন, আমি বাক্সটা আপনাকে দিতে চাই। আমি জানি একমাত্র আপনিই পারবেন এটার রহস্য উদ্ধার করতে। অবশ্য বাক্সটা কেন্দ্র করে যে অলৌকিক ঘটনা ঘটছে তারপর আপনি ওটা নিতে রাজি হবেন কিনা জানি না।
জ্যোতিষ্ক মৃদু হেসে বললেন, “মিশর বিশেষজ্ঞদের এই সব ঘটনায় ভয় পেলে চলে না। মিশরের মরুভূমির প্রতিটি বালুকণায় লুকিয়ে আছে রহস্য। সেইসব রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে কতজনের প্রাণ গিয়েছে তা নিশ্চয়ই আপনার অজানা নয়, তাও তো এক্সপিডিশন বন্ধ হয়ে যায়নি। ইতিহাস নেশার মতো। এই নেশা যাকে একবার ধরে, সারাজীবনেও ছাড়ে না। কোনও ভয়, কোনও আশঙ্কা ইতিহাসের মণি-মুক্তো খোঁজায় বাধা সৃষ্টি করতে পারে না।জ্যোতিষ্ক বলতে বলতে ভাবুক হয়ে ওঠেন।
বিজেন্দ্রর মুখটা খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, “তার মানে আপনি বাক্সটার রহস্য উদ্ধারের দায়িত্ব নিচ্ছেন?”
পারব কিনা জানি না, কিন্তু চেষ্টা তো করবই।

*                          *                          *

কায়রো ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে নেমে আকাশের দিকে তাকালেন জ্যোতিষ্ক। পুরী থেকে ফেরার পর কেটে গেছে দুবছর। যেহেতু ইজিপসিয়ান বক্সটা চোরাইভাবে এন্টিক মার্কেটে এসেছিল, তাই অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তবে জ্যোতিষ্ক ওটা নিয়ে গবেষণা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। একটা অদ্ভুত ব্যাপার, বিজেন্দ্র জ্যোতিষ্কর হাতে বাক্সটা তুলে দেবার পর থেকে কিন্তু বাক্সটা চুপচাপ আছে। একদিনের জন্যও অন্যরকম কিছু ঘটেনি। জ্যোতিষ্ক দিনের পর দিন স্ক্রলটা নিয়ে কাজ করেছেন, কিন্তু কখনও কিছু ঘটেনি। স্ক্রলটা জ্যোতিষ্ককে এক নতুন আবিষ্কারের সন্ধান দিয়েছে। আজ জ্যোতিষ্ক একা মিশরের মাটিতে পা রাখেননি। তাঁর সঙ্গে আছে শশী, তাঁর তিনজন সিনিয়র রিসার্চ স্কলার মাইলি, রবিন, আতিফ, আর সহকর্মী হ্যারি। হ্যারি জ্যোতিষ্কর সহকর্মী শুধু নয়, ঘনিষ্ঠ বন্ধুও। সদালাপী, সদাহাস্যময় জ্ঞানী মানুষটির সঙ্গে ইতিহাস নিয়ে আলোচনায় ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেন জ্যোতিষ্ক। এখন তাঁদের গন্তব্য দ্য ওয়েসিস হোটেল এন্ড রিসর্ট। হোটেলে পৌঁছোনোর কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্যোতিষ্ক বেরিয়ে গেলেন কায়রো ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আমির সরাফের সঙ্গে দেখা করতে। আমির জ্যোতিষ্কর অনেক পুরোনো বন্ধু। দুজনে বেশ কয়েকটি অভিযান একসঙ্গে করেছেন। এবারে যেতে না পারলেও জ্যোতিষ্কর অভিযানের সমস্ত বন্দোবস্ত আমির করে রেখেছেন।

আরে বন্ধু, কতদিন পরে দেখা পেলাম তোমার,” সদাহাস্যময় আমির জ্যোতিষ্ককে জড়িয়ে ধরলেন।
আমি চেক ইন করেই চলে এসেছি। জানি তো ইজিপ্টে আমার নিশ্চিন্ত আশ্রয় তুমি।
জ্যোতিষ্কর কথা শুনে হা হা করে হেসে উঠলেন আমির। তারপর দুই বন্ধু বসে গেলেন প্রয়োজনীয় আলোচনায়। চলে আসার আগে জ্যোতিষ্ক আমিরকে বললেন, “তোমাকে যে ব্যাপারটা বলেছিলাম সেটা কিছু বুঝতে পেরেছ?”
উঁহু, বক্সটা তোমার কাছে এসে কোনও অলৌকিক কান্ড ঘটাচ্ছে না কেন তার কোনও ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই। একটা কথা কি জানো সেন, আমাদের এই দেশের প্রতিটি কোনায় আজও বহু রহস্য অনাবিষ্কৃত অবস্থায় আছে। আমার ধারণা এই বাক্সটা সেইরকম কোনও রহস্যের চাবিকাঠি। সেই রহস্যের সমাধান হলে বাক্স রহস্যও আপনি সমাধান হয়ে যাবে। যাই হোক কোনও সমস্যা হলে কোনও রকম দ্বিধা ছাড়াই আমাকে তক্ষুনি জানাবে।

চারিদিকে ধূ ধূ বালু প্রান্তর আর তার মাঝে অতীতের সাক্ষ্য দিতে দাঁড়িয়ে আছে কিছু ক্ষয়িষ্ণু স্থাপত্য। আমির সরাফের ঠিক করে দেওয়া লোকজন খুবই দক্ষ। জ্যোতিষ্ক আর হ্যারির নির্দেশ মতো অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁবু খাটিয়ে যাবতীয় ব্যবস্থা করে ফেলল। আপাতত লাক্সরের পশ্চিম প্রান্তের এই জনমানবহীন প্রান্তরই তাঁদের কিছুদিনের অস্থায়ী বাসস্থান। জ্যোতিষ্ক আর হ্যারির একটা তাঁবু, রবিন আর অতিফের একটা আর শশী আর মাইলি একটা তাঁবুতে, এই রকম ব্যবস্থাই হল।
স্যার, অনেক ধন্যবাদ আমাকে নিয়ে আসার জন্য। বহুদিনের শখ ছিল আমার মিশরে আসার।
আতিফের কথা শুনে জ্যোতিষ্ক হাসলেন। মালদার ছেলে আতিফ সুযোগ পেলেই জ্যোতিষ্কর সঙ্গে মাতৃভাষায় কথা বলে।
সেন, মনে তো হচ্ছে এই জায়গাটাই হবে।
হ্যারির কথা শুনে মাথা নাড়লেন জ্যোতিষ্ক।
স্ক্রলে আঁকা ম্যাপের সংকেত থেকে তো আমার তাই ধারণা হয়েছে।
কিন্তু সেন, এখানে একদম কাছাকাছি দুটো মন্দিরের ভগ্নাবশেষ আছে। স্ক্রলে উল্লিখিত মন্দির কোনটা বুঝতে পারছ?”
এখন পর্যন্ত না। আরও গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে।
জ্যোতিষ্ক মনে মনে ভাবলেন তিনি একজন হায়ারোগ্লিফিক্স বিশেষজ্ঞ ঠিকই, কিন্তু লোকে যেমন ভাবে তিনি পেপার পড়ার মতো গড়গড় করে স্ক্রল পড়ে ফেলতে পারেন সেটা মোটেই ঠিক নয়। বহু সাধনা, বহু অধ্যবসায় লাগে এ কাজের জন্য।

তখন মিশরে ফ্যারাও আখেনাতেন ও অসামান্য সুন্দরী উপরন্তু ব্যক্তিত্বময়ী রানি নেফারতিতির রাজত্বকাল। আখেনাতেনের সভায় মারহোরেব নামে এক উচ্চবংশীয় ক্ষমতাশালী পারিষদ ছিলেন। তিনি ফ্যারাওয়ের খুব ঘনিষ্ঠ বৃত্তে অবস্থান করতেন। যখন আখেনাতেন ও নেফারতিতি আমেন দেবতার পরিবর্তে অটেন দেবতার প্রচলন করেন তখন মারহোরেবও তাঁদের সঙ্গ দেন। আমেন ছিলেন প্রাচীন সূর্য দেবতা। ফ্যারাও ও তাঁর রানি নতুন দেবতা অটেনের উপাসনা আরম্ভ করেন, যদিও অটেনও প্রকারান্তরে সূর্য দেবতাই ছিলেন। আমেনের সমস্ত মন্দির ধ্বংস করে ফেলা হয়।
মারহোরেবের প্রথম স্ত্রী অল্প বয়সেই মারা যান। তাঁর ছিল এক কন্যা ও এক পুত্র, মুজনেইথ ও দেনখার। মারহোরেবের দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম আতসেন। আতসেনের ছিল এক পুত্র টায়। আতসেন ছিল অত্যন্ত ধুরন্ধর ও ভয়ানক রকম ঈর্ষাপরায়ন মহিলা। শুধু তাই নয়, যথেষ্ট ক্ষমতাশালীও ছিল সে। সৎ ছেলেমেয়ে মুজনেইথ ও দেনখার ছিল তার চোখের বালি, বিশেষ করে দেনখার, কারণ জ্যেষ্ঠ পুত্রটি ছিল মারহোরেবের সর্বাধিক প্রিয় সন্তান এবং তিনি তাকেই তাঁর ভবিষ্যৎ উত্তরসূরি হিসেবে গড়ে তুলতে চাইতেন। তিনি চাইতেন তাঁর পরে দেনখারও ফ্যারাওয়ের সভায় তাঁর মতোই গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করবে। যদিও অন্য দুই সন্তানের প্রতি তাঁর কোনও অবহেলা ছিল না, কিন্তু তাও আতসেনের মনে সবসময় হিংসার আগুন জ্বলত। সে চাইত দেনখারের জায়গা নিক তার পুত্র টায়। এইরূপ মনোভাব সত্ত্বেও কিন্তু সে এমনভাবে চলত যে মারহোরেবের মনে কখনও কোনও সন্দেহের উদ্রেক হয়নি। শুধু তার মনের কালো দিকটার সন্ধান পেয়ে গিয়েছিল মুজনেইথ। সে বুঝতে পারত একটা সুযোগ পেলেই আতসেন তার পথের কাঁটাকে সরাতে দুবার ভাববে না। সে তাই তার ছোটো ভাইটিকে সর্বদা আগলে রাখার চেষ্টা করত। সে জানত তার পিতাকে জানিয়ে লাভ নেই কারণ তিনি বিশ্বাস করবেন না। যখন মুজনেইথ, দেনখার ও টায় যথাক্রমে সতের, পনের ও বারো বছরের তখন আতসেন অভাবনীয়ভাবে একটা সুযোগ পেয়ে গেল। কোনও কারণে মুজনেইথ প্রাসাদে ছিল না, সেইসময় মাত্র একজন দেহরক্ষী নিয়ে দেনখার প্রমোদ ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। অত্যন্ত ধূর্ত আতসেন এই সুযোগ কাজে লাগাতে বিলম্ব করেনি। দেনখার আর প্রাসাদে ফিরে আসেনি। মরুভূমির বিশালতার মাঝে সে বেমালুম হারিয়ে যায়। তার আর তার দেহরক্ষীর দেহ তো দূরের কথা, তার অস্তিত্বের কোনও চিহ্নই আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। মারহোরেব সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়লেও একবারের জন্যও আতসেনকে সন্দেহ করেননি। শুধু নিঃসন্দেহ ছিল একজন, মুজনেইথ। সে গোপনে আতসেনের বিরুদ্ধে প্রমাণ খুঁজতে থাকে। আতসেন ছিল শৃগালের চেয়েও ধূর্ত, তাই কিশোরী মুজনেইথের অনুসন্ধানের খবর তার কাছে গোপন থাকেনি। সে প্রমাদ গুনতে থাকে। মুজনেইথের বয়স অল্প হলেও সেও যথেষ্ট বুদ্ধিমান। যদি কোনও বিপদ ঘটিয়ে ফেলে! হঠাৎ করেই আতসেন এমন এক তথ্য জানতে পারেন যে তাঁর পক্ষে মুজনেইথকে চিরতরে শেষ করে দেওয়া খুব সহজ হয়। মারহোরেব ফ্যারাও এবং রানির প্রচলিত অটেন দেবতার উপাসক ছিলেন, কিন্তু তাঁর কন্যার বিশ্বাস ছিল পুরোনো দেবতা আমেনের ওপর। সে গোপনে আমেন দেবতার উপাসনা করত। আতসেন মারহোরেবের কানে এই কথাটি তুলে দেন এবং তাঁকে বোঝান মুজনেইথের এই কর্মকাণ্ডের ফলে অটেন দেবতা রুষ্ট হয়েছেন, যার ফলস্বরূপ তিনি দেনখারকে কেড়ে নিয়েছেন। পুত্র শোকে মুহ্যমান মারহোরেব অতি সহজেই আতসেনের কথা বিশ্বাস করে নেন এবং নিজ কন্যাকে নির্বাসনের আদেশ দেন, কিন্তু স্বভাবতই বিধ্বস্ত মুজনেইথ সেই সুযোগ না দিয়ে নীল নদের জলে নিজের প্রাণ বিসর্জন দেয়। আতসেনের পথের সমস্ত কাঁটা দূর হয়ে যায়। সে প্রাসাদ থেকে মুজনেইথের সমস্ত চিহ্ন মুছে ফেলে। শুধু রয়ে যায় মুজনেইথের প্রিয় এই নেকপিসটি। আতসেন ভাবে পৃথিবীতে কেউ কোনও দিন তার অপরাধের কথা জানতে পারবে না, কিন্তু তার ধারণা ভুল ছিল। কয়েক হাজার বছর পরে হলেও আজ জ্যোতিষ্ক জানেন আতসেনের সেই জঘন্য অপরাধের কথা, জানেন হতভাগ্য দুই ভাই-বোনের কথা। এই স্ক্রলের লেখক অত্যন্ত গোপনে আতসেনের অপরাধের কথা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। তিনি নিজের নামোল্লেখ না করলেও নিজের পরিচয় দিয়েছেন আতসেনের অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন রূপে। আতসেনের প্রতিটি পদক্ষেপের সাক্ষী এবং সহযোগী সে। জ্যোতিষ্কর ধারণা, আতসেনের ভাই বা কোনও আত্মীয় হবেন তিনি। আতসেনকে সহযোগিতা করলেও মুজনেইথের মৃত্যুর এক সপ্তাহের মধ্যে পর পর নিজের দুই পুত্রকে হারিয়ে তাঁর চৈতন্যোদয় ঘটে। আতসেনের বিরুদ্ধাচারণ করার ক্ষমতা তাঁর ছিল না, তাই নিজের সান্ত্বনার জন্য এই সমস্ত ঘটনাবলী লিপিবদ্ধ করে মুজনেইথের স্মৃতিস্বরূপ এই নেকপিসটি বাক্সে ভরে বাক্সটি এক পবিত্র অথচ সুরক্ষিত জায়গায় রেখে দিয়েছিলেন।
এই স্ক্রলের শেষ দুটি পৃষ্ঠায় লেখক সাংকেতিকভাবে দেনখারের অন্তিম পরিণতি সম্পর্কে ইঙ্গিত দিয়েছেন। সরাসরি কিছু লেখেননি। তাঁরই আঁকা একটা ম্যাপজাতীয় ছবি থেকে জ্যোতিষ্ক এই জায়গাটা সম্বন্ধে আভাস পেয়েছেন। খোঁজখবর নিয়ে যখন জানতে পারেন এইখানে আমেন দেবতার জোড়া মন্দির ছিল, একসময় যা ফ্যারাও আখেনাতেনের আমলে ভেঙে ফেলা হয়, তখন জ্যোতিষ্ক নিশ্চিত হয়ে যান যে এই দুই মন্দিরের কোনও একটিতেই লুকিয়ে আছে দেনখারের অন্তর্ধান রহস্য। মন্দির দুটি অনেকাংশে ভেঙ্গে পড়লেও যেটুকু অবশিষ্ট আছে তা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে তাদের গঠনশৈলী একদম একইরকম। জোড়া মন্দির বলা যায় তাদের, কিন্তু এই মন্দির দুটির মধ্যে কোনটি তাঁদের অভিষ্ঠ এখনও বুঝতে পারছেন না জ্যোতিষ্ক। তাঁর সামনে স্ক্রলটির একটি নকল পড়ে আছে। কাজের সুবিধার জন্য নিজে হাতে এটি বানিয়েছেন জ্যোতিষ্ক। সবসময় ওই কয়েক হাজার বছরের পুরোনো স্ক্রল নিয়ে কাজ করা সম্ভব নয় তো, তাই। তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে এলেন জ্যোতিষ্ক। মাথাটাকে একটু বিশ্রাম দেওয়া প্রয়োজন। জনমানবহীন মরু প্রান্তরে রাতের রূপ অন্যরকম। আকাশ জুড়ে তারার চাঁদোয়া। তার মাঝে রানির মতো পূর্ণিমার চাঁদ। জ্যোৎস্নার আলো পিছলে যাচ্ছে বালির ওপর। দিগন্ত জুড়ে নিঃসীম নিস্তব্ধতা। অন্যান্য তাঁবুর সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, কিন্তু জ্যোতিষ্কর চোখে ঘুম আসছে না। এটা তাঁর বরাবরের অভ্যেস, মাথার মধ্যে কিছু ঘুরলে প্রায়ই বিনিদ্র রাত্রি কাটে তাঁর। গোল থালার মতো চাঁদটার দিকে তাকিয়ে তাঁর ঠোঁটের কোণে একঝলক হাসি দেখা দিল। তাঁর ছেলে-মেয়ে দুজনে তো সূর্য আর চাঁদ। ভাইপোর নামের অর্থও সূর্য। তাঁদের বাড়িতেই দুখানা সূর্য। এইসব কথা ভাবতে ভাবতেই জ্যোতিষ্ক চমকে উঠলেন। আরে! এত সহজ কথাটা এতক্ষণ তাঁর মাথায় আসেনি কেন! তাড়াতাড়ি করে আবার স্ক্রলটা নিয়ে বসলেন তিনি।
অটেনও বিমুখ তার থেকে, এমন স্থানে নিদ্রিত সে।অটেন দেবতার প্রতিরূপ হল সূর্যের গোল চাকতি। মন্দির দুটোর একটা পূর্বমুখী, আরেকটা পশ্চিমমুখী। জ্যোতিষ্ক নিশ্চিত ওই পশ্চিমমুখী মন্দিরেই লুকিয়ে আছে দেনখারের অন্তিম পরিণতির সূত্র, কারণ অটেন অর্থাৎ সূর্য উদিত হয় পূর্ব দিকে।

পরের দিন সকালেই হ্যারির সঙ্গে আলোচনা করে নিজেদের কর্মপন্থা ঠিক করে নিলেন জ্যোতিষ্ক।
তুমি তাহলে নিশ্চিত, ওই মন্দিরটাই?”
প্রায় নিশ্চিত ধরতে পার। তোমার কি অন্য কিছু মনে হচ্ছে?”
নাহ, তোমার বিশ্লেষণটাই ঠিক বলে মনে হচ্ছে। আরে, চল না দেখাই যাক এই মন্দিরে কী আছে। এটা মিশর, হয়তো দেখবে যা খুঁজছি তার চেয়েও বিস্ময়কর কিছু অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্য,” হাসতে হাসতে বললেন হ্যারি। জ্যোতিষ্কও সায় দিলেন, “তা যা বলেছ তুমি।
ওদের কথাবার্তার মাঝেই আতিফ এসে বলল, “স্যার, সবকিছু রেডি। আমরা শুরু করতে পারি।
ওকে।তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে এলেন সবাই।

পশ্চিমমুখী মন্দির এলাকায় প্রবেশ করলেন ওঁরা। মন্দিরের সামনে অনেকখানি প্রশস্ত খোলা জায়গা। সেখানে দুটি সারিতে মোট আটটি থাম আছে। প্রতিটি থামের গায়ে কিছু ছবি, কিছু অলংকরণ ছিল বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু সে সব নষ্ট হয়ে গেছে।
আখেনাতেনের আমলে বেশিরভাগ আমেন দেবতার মন্দির এভাবেই ধ্বংস করা হয়েছিল,” জ্যোতিষ্ক বললেন। কথা বলতে বলতে ওঁরা মূল মন্দিরে প্রবেশ করলেন। মন্দির চত্বরটি বিশাল কিন্তু ভগ্নপ্রায়। সারাদিন বিভিন্ন জায়গায় অনুসন্ধান চালিয়েও বিশেষ লাভ কিছু হল না। স্ক্রলটায় পরিস্কার করে কিছু বলা নেই। সবশেষে মূল মন্দিরের ডানপাশের একটি ছোট্ট কক্ষে প্রবেশ করলেন জ্যোতিষ্ক। কক্ষের মেঝেতে লাল আর সবুজ রঙের বৃত্ত আঁকা। অন্য কোনও কক্ষের মেঝে কিন্তু এরকম নয়। মাঝখানের বৃত্তটিতে আবার ফুল-লতা আঁকা। জ্যোতিষ্কর মনে সন্দেহের উদ্রেক হতেই একটা লোহার দন্ড নিয়ে মেঝেতে ঠুকতে লাগলেন। তাঁর ধারণাই ঠিক। মাঝখানটা ফাঁপা। বাকিদের ডাকলেন জ্যোতিষ্ক। শুরু হল খননকার্য। অবশেষে দেখা গেল ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে নিচের এক সুড়ঙ্গে। জ্যোতিষ্ক আর হ্যারি সুড়ঙ্গে নেমে সিদ্ধান্ত নিলেন যে পরের দিন এই সুড়ঙ্গ পথ ধরে অনুসন্ধান কার্য শুরু করা হবে। ওপরে এসে তাঁরা ঘোষণা করলেন যে আজকের মতো কাজ বন্ধ, কারণ সন্ধে নেমে আসছে। সারাদিনের পর সবাই ক্লান্তও হয়ে গেছে, তাই কাল আবার অনুসন্ধান শুরু হবে। তাঁদের সঙ্গে আসা লোকজনদের নেতা আবদুল্লাহকে রাতে পাহারার বন্দোবস্ত করতে বললেন।

ব্যাপার কী, আমার কন্যাটি সকাল থেকে আমার খোঁজ নেয়নি। এ তো অবাক কান্ড!
সত্যি সেন, তোমাদের ভারতীয়দের ফ্যামিলি বন্ডিংটা আমার খুব ভালো লাগে। অনেক স্ট্রং বন্ডিং হয় তোমাদের মধ্যে,” হ্যারির কথা শুনে জ্যোতিষ্ক স্মিত হাসলেন।
স্যার, শশীর খুব জ্বর,” মাইলি বেরিয়ে এসেছে ওদের তাঁবু থেকে।
সে কী!জ্যোতিষ্ক তড়িঘড়ি ওদের তাঁবুতে ঢুকে দেখেন শশী শুয়ে আছে। চোখ-মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে অসুস্থ।
ড্যাড, আজ আর তোমাদের সঙ্গে যাওয়া হবে না। প্রায় উঠতেই পারছি না বিছানা ছেড়ে। আজকেই সুড়ঙ্গে ঢোকা হবে আর আজকেই আমার এই অবস্থা।
কাজের কথা পরে, তুই ওষুধ খেয়েছিস?”
হুম, চিন্তা কোরো না, কালকের মধ্যে ঠিক হয়ে যাব।
তোকে এই অবস্থায় ছেড়ে যাব কী করে? মন্দিরে কত সময় লাগবে, কী হবে কিছুই তো বুঝতে পারছি না।
আপনি চিন্তা করবেন না স্যার। আমি শশীর কাছে থাকছি। আপনারা যান। ও সুস্থ হয়ে গেলে কাল আমরাও যাব,” মিষ্টি হেসে বলল মাইলি।
ইউ আর এ রিয়েল ফ্রেন্ড মাইলি। এই অভিযান নিয়ে তুমি কতটা উত্তেজিত আমি জানি। তাও বন্ধুর জন্য তুমি….”
ওহ, স্যার, এভাবে বলবেন না। ও যেমন আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, তেমনি ও আপনারও মেয়ে। ওর জন্য এটুকু করতে পারব না? এখানে এক একটা দিন মূল্যবান। আপনারা নিশ্চিন্তে যান।
থ্যাঙ্কু, মাইলি।
ইউ আর ওয়েলকাম স্যার।
এরপর শশীর দিকে ঘুরে বললেন, “নেকপিসটা তোর কাছে তো?”
হুম।নেকপিসটার প্রতি অদ্ভুত এক মায়া জন্মেছে শশীর। সেটা সে কাছ ছাড়া করেনি।

আগের দিন খুঁজে পাওয়া সুড়ঙ্গ পথ ধরে এগিয়ে চলেছেন সবাই। একটুখানি যাওয়ার পর একটা ছোট্ট গোল চাতালের মতো জায়গা। সেখানে সবাই জড়ো হলেন। চাতাল থেকে দুদিকে দুটো গলি চলে গেছে।
এবার কোন দিকে যাবে?” হ্যারি প্রশ্ন করেন।
সেটাই ভাবছি।
আমার মনে হয় দুদলে ভাগ হয়ে দুদিকে যাওয়া ভালো।
ঠিক বলেছ হ্যারি।
হ্যারি ঠিক করলেন যে তিনি আর জ্যোতিষ্ক ডানদিকের গলি বেয়ে এগোবেন, বাকিরা মানে রবিন আর আতিফ বামদিকে যাবে, আর আবদুল্লাহ এখানেই অপেক্ষা করবে তাঁদের জন্য।
বুঝলে সেন, বুড়ো হয়েছি, তাই তোমাকে আমি ছাড়ছি না। আমি তোমার সঙ্গেই থাকব।
বুড়ো আর আপনি!
হুঁ, তোমার চেয়ে দশ বছরের বড়ো আমি। ভুলে গেলে?”
আপনি চির তরুণ মানুষ,” জ্যোতিষ্ক হাসতে হাসতে বললেন।
সেটা অবশ্য ঠিকই বলেছ। চল আর সময় নষ্ট না করে এগোনো যাক। আমার ধারণা এই দুটো গলির শেষে কিছু না কিছু বিশেষ জিনিস তো আছেই।

অন্ধকার গলিটা ধরে এগিয়ে চলেছেন জ্যোতিষ্ক আর হ্যারি। আচমকা, “হ্যান্ডস আপ। টুঁ শব্দটি না করে হাত ওপরে তোল।ওঁরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখলেন সামনে পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে আছে রবিন।
হেই রবিন, তুমি এখানে? আর তুমি এটা কী করছ?” চেঁচিয়ে উঠলেন হ্যারি।
চুপচাপ কোনো শব্দ না করে এগিয়ে চল, না হলে আমার হাতের যন্ত্রটা শব্দ করবে,” দাঁতে দাঁত চিপে হিসহিসিয়ে উঠল রবিন।
রবিন, তুমি এসব কেন করছ? কী চাই তোমার?” উত্তেজিত জ্যোতিষ্ক প্রশ্ন করেন।
তোমাদের দুজনের মৃত্যু। প্রফেসর জ্যোতিষ্ক সেন আর হ্যারি থমসন, এই নাম দুটো আমি পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে মুছে দিতে চাই,” রবিনের চোখ দুটো শিকারি বিড়ালের মতো জ্বলছে।
কিন্তু কেন? অকারণে তুমি আমাদের মারতে চাইছ কেন?” হ্যারির গলা কেঁপে উঠল।
অকারণ? কীসের অকারণ? মনে পড়ে লরেন্স মার্কেলকে? নাকি বেমালুম ভুলে গেছ?” রাগে ফুঁসছে রবিন।
জ্যোতিষ্ক আর হ্যারি দুজনের কপালেই চিন্তার ভাঁজ। স্মৃতির অন্দরে লরেন্স মার্কেল নামটা খুঁজতে থাকেন তাঁরা। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না। দুজনেই চমকে ওঠেন। লরেন্স মার্কেল! জার্মানির একটা মিউজিয়ামের কিউরেটর ছিল, কিন্তু তলে তলে চোরাই এন্টিকের ব্যাবসা করত। মিউজিয়ামের বহু জিনিসও সরিয়ে ছিল। একটা গবেষণার সূত্রে জ্যোতিষ্ক আর হ্যারি দুজনেই ওই মিউজিয়ামে গিয়েছিলেন আর ওঁদের চোখেই প্রথম বিভিন্ন অসঙ্গতি ধরা পড়ে। ফলস্বরূপ শেষ পর্যন্ত লরেন্স মার্কেল ধরা পড়ে পুলিশের হাতে এবং তার সমস্ত কুকর্ম প্রকাশ পায়, কিন্তু এই ঘটনা আজ থেকে প্রায় বছর দশেক আগেকার। সেই লরেন্স মার্কেলের সঙ্গে রবিনের কী সম্পর্ক?
লরেন্সের সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক?” প্রশ্ন করেন জ্যোতিষ্ক।
হি ইজ মাই ড্যাড। আমার বাবাকে জেলের ঘানি টানতে হচ্ছে তোমাদের দুজনের জন্য। বাবা জেলে যাওয়ার পর থেকে আমি মায়ের পরিচয়ে বড়ো হই। সেই পরিচয় নিয়েই তোমাদের শেষ করার জন্য আমি ইউনিভার্সিটি জয়েন করি। বুঝতেও পারনি তোমরা। সুযোগ খুঁজছিলাম আমি, আর সেন নিজেই সেই সুযোগ করে দিলে আমাকে। এই এক্সপিডিশনে আমাকে সঙ্গে এনে। এখন বেশি কথা না বলে চুপচাপ এগিয়ে চল।
রবিন, বোঝার চেষ্টা কর, তোমার বাবা একজন অপরাধী তাই…” জ্যোতিষ্ক বলার চেষ্টা করেন।
শাট আপ,” পিস্তলটা উঁচিয়ে ধরে রবিন।
এমন সময় হঠাৎ রবিন মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। পিস্তলটা তার হাত থেকে ছিটকে গেল।
আমার সন্দেহই ঠিক ছিল। এ ব্যাটার কোনও বদ মতলব আছে সে ব্যাপারে আমি কাল রাতেই নিশ্চিত হয়ে গেছিলাম,” রবিনকে মাটিতে চেপে ধরে বলে আতিফ।
আতিফ, তুমি এখানে!
হ্যাঁ, স্যার। রবিন যখন আমাকে ভুজুং ভাজুং দিয়ে ওদিকের গলি থেকে সরে পড়ল তখনই আমার মনে সন্দেহ হয়েছিল কিছু গন্ডগোল আছে, তাই আমি ওকে ফলো করি। হুঁ হুঁ, বাঙালির সিকস্থ সেন্স বলে কথা, ভুল হতে পারে না।
আহ!কথা বলতে বলতেই লুটিয়ে পড়ল আতিফ। জ্যোতিষ্করা অবাক হয়ে দেখলেন হাতে একটা রড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আবদুল্লাহ। তাঁদের দলেরই একজন।
মুহূর্তের মধ্যে পিস্তলটা তুলে দাঁড়িয়ে পড়ল রবিন।
ওয়েল ডান আবদুল্লাহ,” পিস্তলটা আবার জ্যোতিষ্কদের দিকে তাক করে ব্যঙ্গ করে রবিন বলল, “খুব অবাক হচ্ছ তাই না? জানো, প্রফেসর, আমার বাবাকে তোমরা জেলে ঢোকানোর আগেই বাবা আমাদের জন্য গোপনে বিপুল সম্পত্তি তৈরি করে নিয়েছিল, তাই এমন দু-চারজনকে টাকার বিনিময়ে নিজের দলে টানা কোনও ব্যাপার নয় আমার কাছে। এখন বাধ্য ছেলের মতো যা বলছি তাই কর। এগিয়ে চল।জ্যোতিষ্কর হাত থেকে স্ক্রলটা কেড়ে নিয়ে শেষের কথাগুলো প্রায় ধমকের সুরে বলল রবিন। উপায়ান্তর না দেখে এগিয়ে চললেন জ্যোতিষ্করা।

এই ঘরটার সন্ধান রবিন পেল কী করে?” নিজের মনেই বিড়বিড় করেন জ্যোতিষ্ক।
সম্ভবত কাল রাতে ও সুড়ঙ্গে নেমেছিল। পাহারার দায়িত্ব তো ছিল আবদুল্লাহর ওপরেই,” জ্যোতিষ্কর পাশে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসেছিল আতিফ। জ্যোতিষ্কর আস্তে করে বলা কথাগুলো কানে গিয়েছে তার।
কাল রাতে আমার জলের বোতলে রবিন সম্ভবত ঘুমের ওষুধ মিশিয়েছিল, কারণ জল খাওয়ার পরই আমার প্রচন্ড ঘুম পেয়ে গিয়েছিল, তারপর সারারাত আমি অঘোরে ঘুমিয়েছি। রবিনকে আমি অনেকবার আবদুল্লাহর সঙ্গে কথা বলতে দেখেওছি। জিগ্যেস করলে বলত ওদের স্থানীয় সংস্কৃতি সম্বন্ধে জানার চেষ্টা করছে। আমার ঠিক বিশ্বাস হত না, তবে তলে তলে এই ব্যাপার তাও বুঝতে পারিনি। বুঝতে পারলে এইভাবে বন্দি হতে হত না,” হতাশা ঝরে পড়ে অতিফের গলায়।
জ্যোতিষ্ক আস্তে করে হাত রাখেন আতিফের কাঁধে। কপালের ডানপাশটা কেটে গিয়েছে ছেলেটার। রবিন গলির শেষ প্রান্তে এই ঘরটায় তাঁদের তিনজনকে বন্দি করে দরজা লাগিয়ে চলে গেছে। কয়েক হাজার বছর পুরোনো কারুকার্য করা ভারী ধাতব দরজা, একে ভাঙ্গা কোনও মতেই সম্ভব নয়। কেউ জানতেও পারবে না তাঁরা এখানে বন্দি। রবিন ওপরে গিয়ে কী বলবে কে জানে? শশী আর মাইলি তো বুঝতেও পারবে না যে ও কত বড়ো শয়তান। ওর কথায় বিশ্বাস করে ফেলবে। হ্যারির মতো সদা হাস্যময় মানুষও মুখ শুকনো করে একদম চুপচাপ বসে আছেন। হ্যারির চোখের সামনে ভেসে উঠছে তাঁর ফুলের বাগানে ঘেরা ছোট্ট বাড়িটা। মেয়ে লাইরাকে কথা দিয়ে এসেছিলেন এখান থেকে ফিরে সবাই মিলে মিয়ামি যাবেন ছুটি কাটাতে। ওরা জানতেও পারছে না এই শতাব্দী প্রাচীন কক্ষে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন হ্যারি। ছটফটে আতিফের চোখের কোণেও জল জমা হচ্ছে। ছোটোবেলাতেই গাড়ি দুর্ঘটনায় আব্বু-আম্মিকে হারানোর পর নানা-নানীর কাছেই মানুষ হয়েছে সে। নানা ইতিহাসের প্রফেসর ছিলেন। তাঁর কাছ থেকেই ইতিহাসের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয় তার। সুদূর ভারতবর্ষের একটা ছোট্ট শহরে বসে দুটো বৃদ্ধ মানুষ তার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছে। তারা তো জানেও না যে তাদের আদরের খোকন আর কোনও দিন ফিরবে না।

জ্যোতিষ্ক ব্যাগ থেকে বোতল বের করে জল খেলেন একটু। ভাগ্যিস ওরা ওঁদের পিঠের ব্যাগগুলো নিতে ভুলে গেছে। টর্চগুলো না থাকলে এই অন্ধকার কক্ষে এতক্ষণে প্রায় অর্ধমৃত হয়ে পড়তেন। একবার আতিফের দিকে তাকালেন, আর একবার হ্যারির দিকে, তারপর উঠে পড়লেন। জীবনে হারতে শেখেননি তিনি। দরজা ভাঙ্গা সম্ভব নয়, কিন্তু এই ধরনের কক্ষে দ্বিতীয় কোনও পথ থাকা বিচিত্র নয়। পুরো কক্ষের দেওয়ালে বিভিন্ন ধরনের চিত্র অঙ্কিত আছে। মূলত কালো, উজ্জ্বল নীল আর সবুজের আধিক্য সেইসব ছবিতে। মাটির নিচে হওয়ায় সময় সেখানে বিশেষ ছাপ ফেলতে পারেনি। ছবিগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন জ্যোতিষ্ক। একটা দেওয়ালে বিশাল একটা নৌকার ছবি। সাতজন মাঝি দাঁড় বাইছে। অন্য একটা দেওয়ালের টুকরো টুকরো ছবি দেখে মনে হল কোনও রাজসভার দৃশ্য। আরেকটা দেওয়ালে ফুল, লতা, পাখি এইসব আঁকা। হ্যারি যে দেওয়ালটিতে ঠেস দিয়ে বসে আছেন সেই দেওয়ালে একটি শোভাযাত্রার ছবি। দেওয়ালের মাঝখানে একটি বড়ো মন্দিরের ছবি। শোভাযাত্রা এসে সেই মন্দিরে মিলিত হচ্ছে। জ্যোতিষ্ক চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর মস্তিষ্কের নিউরনগুলোর কাছে সংকেত চাইছেন। জ্যোতিষ্কর গ্রে ম্যাটার তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। কয়েক মিনিট পরে চোখ খুললেন জ্যোতিষ্ক। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন শোভাযাত্রা অঙ্কিত দেওয়ালের দিকে। দেওয়ালের বিভিন্ন অংশে হাত দিয়ে কিছু যেন বোঝার চেষ্টা করতে লাগলেন।
আতিফ, উঠে এসো তাড়াতাড়ি।জ্যোতিষ্কর উত্তেজিত কন্ঠস্বর শুনে তড়িঘড়ি উঠে পড়ল আতিফ। যদিও সে বুঝে উঠতে পারেনি যে স্যার তাকে কেন ডাকছেন।
এই জায়গাটা হাত দিয়ে জোরে ঠেলে দেখ তো।জ্যোতিষ্কর নির্দেশ অনুসারে আতিফ মন্দিরের একটি অংশ গায়ের জোরে ঠেলতে লাগল, কিন্তু কোনও ফল হল না। জ্যোতিষ্ক সাময়িক ভাবে হতাশ হয়ে পড়লেন। আতিফ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে জ্যোতিষ্ক আবার মন দিয়ে দেওয়ালের দিকে তাকালেন, তারপর আতিফকে আবার ইশারা করলেন। আতিফ যে অংশটি ঠেলছিল জ্যোতিষ্ক তার পাশের অংশটা ঠেলতে লাগলেন। ঘর ঘর শব্দ করে দেওয়ালটা সরে গিয়ে এক মানুষ সমান ফাঁক হয়ে গেল। মন্দিরের ছবিটা সমান ভাবে দুভাগ হয়ে গেছে। এবার হ্যারিও সমস্ত চিন্তা ঝেড়ে ফেলে লাফ দিয়ে উঠেছেন।
সত্যিই, কয়েক হাজার বছর আগেও কী অসাধারণ প্রযুক্তি!
চল দেখাই যাক কী আছে আমাদের ভাগ্যে,” জ্যোতিষ্ক বাকি দুজনের উদ্দেশে বললেন। তারপর উঁকি দিয়ে দেখলেন সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে। আস্তে আস্তে তিনজনে সেই ফাঁক দিয়ে গলে সিঁড়িতে পা রাখলেন। সিঁড়ির সংখ্যা বেশি নয়। পাঁচ-ছয় ধাপ নামার পরেই তাঁরা দেখলেন একটা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেছেন তাঁরা। টর্চের আলো চারিদিকে ঘুরিয়ে জ্যোতিষ্ক দেখলেন এই ঘরটির দেওয়ালও চিত্র-বিচিত্র। হঠাৎ টর্চের আলো ঘরের অপর প্রান্তে পড়তে চমকে উঠলেন সবাই। একটা উঁচু চৌকো জায়গার ওপর রাখা আছে একটা সারকোফেগাস।
স্যার, দেখুন।আতিফের দৃষ্টি অনুসরণ করে জ্যোতিষ্ক দেখলেন কক্ষের অন্য দুটি দেওয়ালের গায়ে আরও দুটো সারকোফেগাস দাঁড় করিয়ে রাখা আছে, কিন্তু এই দুটো সারকোফেগাস আকারে অনেকটাই ছোটো। হ্যারি আর আতিফ একটা সারকোফেগাসকে শুইয়ে দিয়েছে। হ্যারি ঢাকনাটা খোলার চেষ্টা করতে অতি সহজেই সেটা খুলে গেল। ভেতরে একটা মমি, কিন্তু সেটা কোনও মানুষের নয়। জ্যোতিষ্ক আর হ্যারির অভিজ্ঞ চোখ সেটা দেখেই বুঝল এটা কোনও শ্বাপদের মমি, সম্ভবত কুকুরের। তাঁরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। দীর্ঘদিনের সহকর্মী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ার সুবাদে জ্যোতিষ্ক আর হ্যারি পরস্পরের চোখের ভাষা বুঝতে পারেন, তাই কোনও কথা না বলেই তাঁরা দ্বিতীয় সারকোফেগাসের দিকে এগোলেন। ঢাকনা খুলতে একই দৃশ্য।
ব্যাপার কী বল তো সেন? এরকম তো সচরাচর দেখা যায় না।
হুম, তৃতীয় সারকোফেগাসটা খুলে দেখা যাক কী আছে। হয়তো কোনও আইডিয়া পাওয়া যাবে।
এগিয়ে গিয়ে ঢাকনাটা খোলার চেষ্টা করলেন জ্যোতিষ্ক। ঢাকনাটার ওপর হায়ারোগ্লিফিক্স লিপিতে কিছু লেখা আছে। আপাতত সেদিকে নজর না দিয়ে ঢাকনাটা খুলে ফেললেন জ্যোতিষ্ক। নাহ! এখানে কোনও শ্বাপদের নয়, পরিষ্কার একজন মানুষের মমি রক্ষিত আছে। জ্যোতিষ্কর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তাঁর অভিযান বোধহয় সফলতার দোরগোড়ায়, কিন্তু তাঁর এই আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হল না।
হঠাৎ একটা তীব্র ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজে চমকে উঠলেন তাঁরা। এই কক্ষের মূল দরজা আস্তে আস্তে খুলে যাচ্ছে আর সেখান দিয়ে প্রবেশ করছে রবিন আর আবদুল্লাহ। জ্যোতিষ্করা যেমন চমকে উঠেছিলেন তেমনি তাঁদের দেখে রবিনরাও চমকে উঠল। চমকালেও কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিয়ে রবিন জ্যোতিষ্ককে উদ্দেশ্য করে বলল, “ওহ! প্রফেসর রিয়ালি ইউ আর জিনিয়াস। স্ক্রলটা কেড়ে নিলাম, তাও ঠিক এখানে পৌঁছে গেছ!রবিনের হাতে আবার পিস্তল উঠে এসেছে।
তবে দুঃখের বিষয়, এখানে পৌঁছলেও তোমরা কেউ আর বেঁচে ফিরতে পারবে না, আর এই আবিষ্কারের কৃতিত্ব হবে শুধু আমার। রবিন মার্কেলের,” রবিনের চোখ দুটো দেখে এবার জ্যোতিষ্কও ভয় পেয়ে গেলেন। রবিনের নীল চোখ দুটোতে শ্বাপদের হিংস্রতা। আবদুল্লাহর হাতেও একটা পিস্তল। হ্যারি আর আতিফ মৃত্যু ভয়ে চোখ বন্ধ করে দিয়েছে।
আমাকে মেরে ফেললে তুমি এই আবিষ্কারের সম্পূর্ণ কৃতিত্ব কখনোই পাবে না, কারণ এই কক্ষের দেওয়ালে হায়ারোগ্লিফিক্স-এ যা লেখা আছে তার মর্মোদ্ধারের ক্ষমতা আমি ছাড়া এই মুহূর্তে পৃথিবীর কোনও ইতিহাসবিদের নেই, আর এই লেখাগুলোর মানে ছাড়া শুধু মমি নিয়ে হয়তো তোমার বাবার মতো এন্টিক স্মাগল করতে পারবে, কিন্তু ইতিহাসের সাম্রাজ্যে নিজের জায়গা কোনও দিনই করতে পারবে না।
জ্যোতিষ্কর চোখে ধূর্ততা খেলা করছে। রবিনের মতো শয়তানও জ্যোতিষ্কর কথায় একটু ভাবনায় পড়ে যায়। কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে সে তার পিস্তলটা হ্যারির মাথায় ঠেসে ধরল। তার ইশারায় আবদুল্লাহও তার পিস্তলটা আতিফের মাথায় ঠেকাল।
সেন, কী লেখা আছে তাড়াতাড়ি পড়ে আমাকে বল, না হলে তোমার সঙ্গীদের লাশ পড়তে কয়েক সেকেন্ড লাগবে। কোনও রকম চালাকি করার চেষ্টা করবে না।
ঠিক আছে, কিন্তু একটু সময় লাগবে। তাড়াহুড়ো করে কোনও কাজ হবে না। আর একটা কথা, আমি যা করব তাতে বাধা দিও না, তাতে তোমারই ক্ষতি। বল আমার শর্তে রাজি কিনা?”
রাজি।

জ্যোতিষ্ক খানিকক্ষণ মন দিয়ে ছবিগুলো দেখলেন, তারপর সারকোফেগাসের দিকে এগিয়ে গেলেন। আসলে কিছুটা সময় তিনি হাতে চাইছেন। হয়তো কিছু করতে পারবেন না, তাও মনে হচ্ছে যদি এদের হাত থেকে বাঁচার কোনও পথ বের করতে পারেন। মমিটার ওপর একটা তরোয়াল রাখা আছে। চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা শ্বাস নিলেন জ্যোতিষ্ক। পঞ্চাশ পার করে দিলেও নিয়মিত শরীরচর্চার দরুণ জ্যোতিষ্ক যথেষ্ট শক্ত-সমর্থ আছেন। শেষ চেষ্টা হিসেবে তিনি তরোয়ালটায় হাত দিলেন, তারপর আচমকা একটু দূরে দাঁড়ানো রবিনের হাতে মারলেন এক কোপ। পিস্তলটা হাত থেকে খসে পড়ল। হাত চেপে বসে পড়ল রবিন, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই আবদুল্লাহর পিস্তল গর্জে উঠল। জ্যোতিষ্কর হাতে এসে লেগেছে গুলি। হ্যারি আর আতিফের মুখ দিয়ে আতঙ্কমিশ্রিত একটা চিৎকার বেরিয়ে এল। জ্যোতিষ্ক যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছেন।
ইউ, স্ক্রাউন্ডেল। আমাকে বোকা বানানোর চেষ্টা! তোমাকে নিজে হাতে মারব আমি,” দাঁত কিড়মিড় করে উঠল রবিন। হাত চেপেই উঠে দাঁড়িয়েছে সে। পিস্তলটা কুড়িয়ে নিয়েছে। জ্যোতিষ্ক বুঝতে পারলেন আর রক্ষা নেই।
প্রফেসর, ইউ আর ফিনিশ।
রবিনের পিস্তলটা জ্যোতিষ্কর বুকে তাক করা।
শেষ মুহূর্তের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলেন জ্যোতিষ্ক। আর কিছু করার নেই।
আঁ আঁ আঁ…” আবদুল্লাহর হাত থেকে পিস্তলটা পড়ে গেছে। তার চোখে মুখে প্রবল আতঙ্ক। আতিফ আর হ্যারিও ছাড়া পেয়ে সরে এসেছে। আবদুল্লাহর দৃষ্টি অনুসরণ করে পেছনে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন জ্যোতিষ্ক। দেনখারের মমি সারকোফেগাস থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। তার চোখের জায়গায় দুটুকরো জ্বলন্ত অঙ্গার। জ্যোতিষ্ক অনুভব করলেন তাঁদের পায়ের তলার মাটি কাঁপছে। দেনখার এগিয়ে আসছে। অপ্রত্যাশিত এই ঘটনায় রবিনও হতভম্ব হয়ে গেছে। আবদুল্লাহ হঠাৎ করে খোলা দরজা দিয়ে পালানোর চেষ্টা করল, কিন্তু দড়াম করে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল, আর আবদুল্লাহর ডান হাতটা চিপে গেল দরজার ফাঁকে। যন্ত্রণায় প্রবল চিৎকার করে উঠল সে। দেনখারের মমি এগিয়ে আসছে। সবাই দেওয়ালের সঙ্গে সেঁটে দাঁড়িয়ে আছেন। জ্যোতিষ্করা যে পথে এসেছিল রবিন সেই পথে পালানোর চেষ্টা করল, কিন্তু তার পরিণতিও হল আবদুল্লাহর মতোই। দেনখারের মমি এগিয়ে যাচ্ছে রবিনের দিকে। তার হাত দুটো সাঁড়াশির মতো চেপে বসল রবিনের গলায়। ততক্ষণে জ্ঞান হারিয়েছে আবদুল্লাহ। জ্যোতিষ্ক কী করবেন ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছেন না। বাকিদের অবস্হাও একইরকম। জ্যোতিষ্ক ভালোমতো বুঝতে পারছেন যে কোনও মুহূর্তে রবিনের শেষ নিঃশ্বাস বেরিয়ে যাবে।

ক্যাঁচ করে দরজাটা খুলে গেল। সেদিকে তাকিয়ে চমকে উঠলেন জ্যোতিষ্ক। এ কী দেখছেন তিনি! দরজায় দাঁড়িয়ে আছে শশী। গলায় তার মুজনেইথের সেই নেকপিস। শশীর পরনে পটচিত্র আঁকা একটা লং স্কার্ট আর কুর্তি। কিছুদিন আগে যখন ওর কাকুরা আমেরিকায় এসেছিল তখন ওর কাকিমা ওর জন্য ওই পোশাকটা এনেছিল। একমাথা কোঁকড়ানো চুল, পটচিত্র আঁকা পোশাক, গলায় শতাব্দী প্রাচীন নেকপিস আর ঘোর লাগা চোখমুখ, নিজের মেয়েকেই কেমন যেন অচেনা লাগছে জ্যোতিষ্কর। হঠাৎ করেই দুর্বোধ্য এক ভাষায় কীসব বলতে বলতে কক্ষে প্রবেশ করল শশী। শশীর গলা দিয়ে যে কন্ঠস্বর বেরোচ্ছে সেটা সম্পূর্ণ অচেনা জ্যোতিষ্কর কাছে। শশীর এই অকস্মাৎ আগমনে দেনখারের মমির মধ্যে এক অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। রবিনকে ছেড়ে সে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। রবিন ততক্ষণে জ্ঞান হারিয়েছে। শশী সেই অচেনা ভাষায় কথা বলতে বলতে দুহাত বাড়িয়ে দেনখারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। জ্যোতিষ্ক অবাক হয়ে দেখলেন শশীর চোখের মণি দুটো নীলাভ সবুজ হয়ে গেছে, অথচ শশীর চোখের মণি ঘন কালো। তার দুচোখ বেয়ে উপচে পড়ছে জলের ধারা। সে দুহাত বাড়িয়ে হাঁটু গেড়ে মেঝেতে বসে পড়ল যেন কোল পেতেছে। শশীর কন্ঠে কাতর, করুণ আহ্বান। দেনখারের মমি শশীর কাছে এসে তার কোলে মাথা রাখল। শশী পরম মমতায় তাকে আঁকড়ে ধরে চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে মন্ত্রোচ্চারণের মতো কীসব বলছে। গোটা কক্ষটা ভয়ঙ্করভাবে দুলছে। হঠাৎ গোটা কক্ষটা হালকা নীল আলোয় ভরে গেল আর দেনখারের মমিটা থেকে থেকে কেঁপে উঠতে লাগল। অবশেষে মমি থেকে গাঢ় হলুদ একটা আলোক রশ্মি বেরিয়ে কক্ষের ছাদ ভেদ করে বেরিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে প্রবল বজ্রপতনের আওয়াজ। জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন সকলে।

তুমি ছিলে আমার পথের কাঁটা, আমার প্রচণ্ড ঘৃণার পাত্র, তাই মৃত্যুর পরেও আমি তোমাকে শান্তি পেতে দেব না। তোমার শবাধারের সঙ্গে আমি তোমার কোনও প্রিয় বস্তু রাখব না। আমি রাখব তোমার ঘৃণার বস্তু যাতে মৃত্যুর পরবর্তী জগতেও তুমি শান্তি না পাও।দেনখারের সারকোফেগাসের ঢাকনাতে লেখা ছিল এই কথাগুলো। দেনখারের দেহরক্ষীর দেহ বালির সমুদ্রে পুঁতে দিলেও দেনখারের দেহটা গোপনে সমাধিস্থ করার ব্যবস্থা করে আতসেন। অত্যন্ত ঈর্ষাকাতর মহিলা ছিল এই আতসেন, সেই কারণে দেনখারের মমির সঙ্গে দুটি কুকুরের মমি রাখে, কারণ দেনখার কুকুর একদম পছন্দ করত না। মিশরীয়রা মমির সঙ্গে সমাধির মধ্যে সাধারণত ভালো ভালো জিনিস, মৃত ব্যক্তির পছন্দের জিনিস রাখত, কারণ তাদের বিশ্বাস ছিল মৃত্যুর পরেও একটা জীবন থাকে, কিন্তু আতসেন রেখেছিল দেনখারের অপছন্দের জিনিস, কারণ সে চায়নি মৃত্যুপরবর্তী জীবনেও দেনখার শান্তি পাক। শুধু দেনখারের প্রিয় তলোয়ারটি তার মমির সঙ্গে রাখা ছিল। দেনখারের সমাধিকক্ষের বিভিন্ন লেখা আর ছবি বিশ্লেষণ করে জ্যোতিষ্ক এই তথ্যই খাড়া করেছেন, তবে সেদিন ঘটে যাওয়া অলৌকিক ঘটনার ব্যাখ্যা নিয়ে তাঁর নিজের মনেই ধোঁয়াশা আছে।
কী ভাবছ?” আমির শরাফ ঘরে ঢুকলেন। জ্যোতিষ্করা আমিরের বাড়িতেই আছেন। সেদিন মাইলির হঠাৎ চোখটা লেগে গিয়েছিল। ঘুম ভেঙ্গে উঠে শশীকে আশেপাশে খুঁজে না পেয়ে খুব ভয় পেয়ে যায় সে, কারণ শশীর গায়ে প্রচন্ড তাপ ছিল। মাইলি মন্দিরের কাছে যখন যায় তখন আচমকা বজ্রপাত আর কম্পন অনুভব করে। করণীয় কী ঠিক করতে না পেরে সে আমিরকে ফোন করে, কারণ যে কোনও সমস্যায় পড়লে আমিরকে জানাতে হবে এরকম নির্দেশ ছিল জ্যোতিষ্কর। আমির খবর পেয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেন। মন্দিরের ভেতর থেকে অচেতন অবস্থায় সবাইকে উদ্ধার করা হয়। শশীর গা তখন জ্বরে একদম পুড়ে যাচ্ছিল। রবিনের কীর্তি জানাজানি হতে তাকে আর আবদুল্লাহকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। অল্প চিকিৎসার পরেই জ্যোতিষ্করা সবাই সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং অসমাপ্ত কাজ শেষ করেন। দেনখারের মমি তুলে আনা হয়। এই ধরনের সমাধি আবিষ্কার করে জ্যোতিষ্ক প্রভূত প্রশংসা পাচ্ছেন। মিশর ছেড়ে যাওয়ার আগে আমিরের আবদারে তাঁর বাড়িতে দুদিনের জন্য আতিথ্য গ্রহণ করেছেন।
কী, বললে না তো কী ভাবছ?” আমির এসে বসলেন জ্যোতিষ্কর পাশে।
আমির, অনেক কিছুই ঘটে গেল কিছুদিনের মধ্যে, কিন্তু আমি এখনও একটা জিনিসের ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছি না।
কীসের ব্যাখ্যা?”
বিজেন্দ্র পতি, মানে যাঁর কাছ থেকে নেকপিসটা পেয়েছিলাম তাঁর অলৌকিক অভিজ্ঞতা আর সেদিন শশীর আচরণ…, বাকি যা কিছু ঘটল...।
জ্যোতিষ্কর কাঁধে হাত রেখে তাঁকে থামিয়ে দিলেন আমির, “আমি এসবের একটা ব্যাখ্যা খুঁজে পেয়েছি নিজের মতো করে। শুনবে?”
অবশ্যই।
তবে তার আগে তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার আছে। আবদুল্লাহকে আমিই তো...।
একদম না, একদম না। নিজেকে একদম দোষী ভাববে না তুমি। আবদুল্লাহ এরকম বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে জানলে তুমি নিশ্চয় ওকে আমাদের সঙ্গে দিতে না। ওসব কথা ভুলে গিয়ে এখন যা বলছিলে সেটা বরং বল।
বুঝলে সেন, আমাদের এই দেশ সুদূর অতীত থেকেই ভারী রহস্যময়। কত যে অজানা রহস্য এখনও এই মরুভূমির বুকে লুকিয়ে আছে কেউ জানে না। তেমনই একটি রহস্য হল দেনখারের সমাধি রহস্য। আমার মনে হয় মুজনেইথের অতৃপ্ত আত্মা চাইছিল দেনখারের সঙ্গে হওয়া অন্যায়ের কথা জানুক সকলে। ওই ইজিপিসিয়ান বক্সটা দীর্ঘদিন সূর্যালোক দেখেনি। একটা প্রাচীন মন্দিরের ভূগর্ভস্থ কক্ষে লুকানো ছিল। কিন্তু যখনই ওটা সূর্যালোকের মুখ দেখে তখনই হয়তো বা মুজনেইথের আরাধ্য সূর্য দেবতা আমেনের লীলাতেই মুজনেইথের অতৃপ্ত আত্মা জেগে ওঠে। একটা জিনিস লক্ষ করে দেখেছ, বাক্সটা তোমার কাছে আসার পর থেকে চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। আমার মনে হয় মুজনেইথের আত্মা বুঝতে পেরেছিল যে তুমিই সেই ব্যক্তি যার পক্ষে দেনখারের সমাধি খুঁজে পাওয়া সম্ভব। আর সেদিন শশী যখন ঘুম থেকে উঠে খেয়ালবশত নেকপিসটা পরে ফেলে মুজনেইথের আত্মা ওর দেহে আশ্রয় নেয়।
হুম, আমরা আধুনিক মানুষরা মানি কি না মানি, এখনও এমন অনেক ঘটনা ঘটে যুক্তিতে যার বিচার করা যায় না। তোমার ব্যাখাটাই বোধহয় ঠিক। আমার একটা জিনিস মনে পড়ল যে স্ক্রলটাতে মুজনেইথের সম্বন্ধে একটা জায়গায় লেখা ছিল, সবুজ চোখের সুন্দরী, আর সেদিন শশীর চোখ দুটোও সবুজ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু দেনখারের মমি হঠাৎ জেগে উঠল কী করে এটাও রহস্য। জানো, আমির, আমার ধারণা প্রাচীন মিশরে অনেক সময় পুরোহিতরা অনেক জাদু বা কালো জাদু জানতেন। দেনখারের মমিও হয়তো মন্ত্রপূত ছিল। আমি মমির ওপর থেকে তরোয়ালটা সরাতেই সে জেগে ওঠে, আবার শশীরূপী মুজনেইথের স্নেহস্পর্শে দেনখারের আত্মা চিরমুক্তি লাভ করে। সেদিন শেষে শশী যে মন্ত্রোচ্চারণ করছিল, আমার মনে হয় দেনখারের মুক্তির জন্য প্রার্থনা করছিল।
হুম, তোমার ধারণাই ঠিক মনে হচ্ছে, আর সবকিছু ধরে নেওয়া বা নিজেদের মতো ব্যাখ্যা করা ছাড়া তো আমাদের কাছে কোনও উপায় নেই। কয়েক হাজার বছর আগে সঠিক কী হয়েছিল বা আজকের সময়েও কী ঘটল, কেন ঘটল নিশ্চিতভাবে জানার তো কোনও উপায় নেই। এত রহস্য, এত আজানা কাহিনি - এসবের টানেই তো ইতিহাসপ্রেমীরা বার বার ছুটে আসে আমার দেশে,” আমিরের দৃষ্টি হারিয়ে যাচ্ছে জানালার ওপারে নীল দিগন্তে।

প্লেনের জানালা দিয়ে মেঘ দেখতে দেখতে শশীর মনটা উদাস হয়ে গেল। আজ অনেকদিন পর তারা বাড়ি ফিরছে। সকালেই সূর্য ফোন করেছিল। মাত্র সাত মিনিটের ছোটো বড়ো হলেও শশীর সূর্যকে নিজের ছোট্ট ভাইটিই মনে হয়। কাকুর ছেলে হলেও আদিত্যকেও ও খুব ভালোবাসে। সূর্য আর আদিত্যর কোনও ক্ষতির কথা ভাবলেও শশীর বুক কেঁপে ওঠে। মুজনেইথের কষ্টটা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারছে সে। মা-হারা দুটি ভাই-বোন পরস্পরের আশ্রয় ছিল। হতভাগিনী মুজনেইথ একদিন বাড়ি ফিরে দেখল তার ভাই নেই, কোথাও নেই। তার পরিণতি কী হয়েছে তাও সে জানতে পারল না। শেষে আবার ভাইয়ের নিখোঁজ হওয়ার দায় তার ওপরেই এসে পড়ল। কয়েক হাজার বছর আগের এক অভাগী দিদির কথা ভেবে আজকের অত্যাধুনিক যুগের এক দিদিরও চোখের কোল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।
_____

2 comments: