গল্পের ম্যাজিক:: জুতোজোড়া - প্রকল্প ভট্টাচার্য


জুতোজোড়া
প্রকল্প ভট্টাচার্য

টাবলুর বাবার বাড়ি ফিরতে কাল অনেক রাত হল। টাবলুর মা জেগে বসে ছিল, কিন্তু টাবলুকে খাইয়ে শুইয়ে দিয়েছিল ঠিক। ছোটোদের নাকি রাতজাগা ভালো নয়!
এই ছোটোদের যে কী কী করা ভালো নয়, এই নিয়ে মা কোনো বই লিখলে সেটা নির্ঘাত ঐ বসার ঘরে উঁচু তাকে রাখা ‘শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত - অখণ্ড সংস্করণ’ লেখা বইটার থেকেও মোটা বই হবে, টাবলু নিশ্চিত। একবার সেটা বলেওছিল মাকে, কিন্তু মা একদম খুশি হয়নি। উলটে বলেছিল, ছোটোদের সব ব্যপারে এত পাকামিও নাকি...
সে যাই হোক। ঘটনাটা শুরু হল বাবা বাড়ি ফেরার পর। চোখ না খুলেও টাবলু শুনতে পাচ্ছিল, বাবা সঙ্গে করে দু’জোড়া নাগরা জুতো নিয়ে এসেছে। বাবা-মায়ের যে কথাবার্তা শোনা যাচ্ছিল তা এইরকমঃ
- ওকি! ওগুলো আবার কার জুতো নিয়ে এলে!
- আমাদের নাটকে লাগবে। চোরবাজারে হঠাৎ শস্তায় পেয়ে গেলাম, কিনে ফেললাম।
- উফ! ঐ থিয়েটার তোমার মাথায় ঢুকেছে, আর তুমি এইসব জঞ্জাল এখন বাড়িতে...
- জঞ্জাল কী বলছ! এ সব অ্যান্টিক জিনিসের কী দাম জানো!
- থাক, আমার আর জেনে কাজ নেই! রাত চোদ্দটায় বাবু বাড়ি ফিরলেন, তাও হাতে জোড়া ইলিশের মতো যত্ন করে জোড়া জুতো ঝুলিয়ে। তাও পুরোনো, কার না কার পরা... রাখো ঐ দরজার কাছে!
বাবা অফিস ফেরত একটা ক্লাবে শখের থিয়েটার করে, মায়ের সেটাও পছন্দ নয়। টাবলুর খুব কৌতূহল হল জুতো দুটো দেখবার, কিন্তু মায়ের মেজাজ বুঝে ভাবল তখুনি ওঠাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তার চেয়ে কিছুক্ষণ ঘাপটি মেরে শুয়ে...
একটু পরে বাড়ির সব আলো নিভে গেলে টাবলু চুপিচুপি উঠে পড়ল। গা-টা একটু ছমছম করছিল, কিন্তু টাবলু কি আর বাচ্চা ছেলে, যে অন্ধকারে ভয় পাবে! চোখটা একটু সয়ে যেতেই পা টিপে টিপে দরজার কাছে পৌঁছে একটু ঠাহর করতেই জুতোজোড়া দেখতে পেল। কী অদ্ভুত একটা নকশা... খুব চেনা, কোথায় যেন দেখেছে... ইয়েস!! একটু ভাবতেই মনে পড়ে গেল! এ তো সেই গুপী বাঘার জুতো! ভূতের রাজা যেটা বর দিয়েছিলেন!! মুহূর্তে টাবলুর সারা শরীরে যেন শিহরণ খেলে গেল! এক্ষুণি ব্যাপারটা টিটোনকে জানাতেই হবে যে, কাল সকালে বড্ড দেরি হয়ে যাবে!!
টিটোন হল টাবলুর বন্ধু। ছোটোবেলা থেকেই গলায় গলায় ভাব। পাশের বাড়িতেই থাকে, এক স্কুলেও পড়ে দু’জন। কিন্তু এত রাতে কি ওকে ডাকা ঠিক হবে! এক মুহূর্ত দোটানায় থেকেই সে মন স্থির করে ফেলল। নাঃ, এ সুযোগ আর আসবে না। একবার বাবা-মায়ের ঘরের দিকে তাকাল টাবলু। কোনো সাড়াশব্দ নেই। খুব সাবধানে ছিটকিনি খুলে সে বেরিয়ে পড়ল।
টিটোনও, কী আশ্চর্য, জেগেই ছিল। জানলার কাছে গিয়ে ফিসফিস করে ডাকতেই সেও বেরিয়ে টাবলুর সঙ্গে তাদের বাড়ি এল। আবার সাবধানে দরজা খুলে দু’জনে চুপিচুপি জুতোজোড়া নিয়ে বাইরে বারান্দায় চলে এল।
ভালো করে দেখে টিটোনের চোখদুটোও চকচক করে উঠল। নিশ্চিত, এ দুটো সেই গুপি বাঘার জুতোই। দু’জন দু’জোড়া জুতো পায়ে পরতে বেশ ফিট করেও গেল। চোখে চোখে ইশারা করে দু’জনে তালি মেরে ফিসফিস করে বলল, “ছাদ!” ব্যস, এক মুহূর্তে দু’জনে টাবলুর বাড়ির ছাদে এসে গেল!
এবার নিশ্চিন্ত, কেউ তাদের দেখতে বা কথা শুনতে পাবে না!
টিটোন বলল, “চল, কিছু খাবার চেয়ে দেখি।”
- “আইসক্রিম খাবি? কর্নেটো?”
শুধু তালি মারার অপেক্ষা! আবার দু’জনের হাতে দুটো আইসক্রিম কোন এসে হাজির!
উফফফ, মনে হচ্ছিল যেন দুই বন্ধু বিশ্বজয় করে ফেলেছে! টাবলুর বাবা না জেনেই যে কী দুর্দান্ত একটা জিনিস নিয়ে এসেছেন বাড়ি!!
চেটেপুটে আইসক্রিম খেল দুই বন্ধু। তারপর কী করা যায়?
- চল কোথাও বেড়াতে যাই!
- কোথায় যাওয়া যায় বল তো? চাঁদে যাবি?
- চাঁদে! কিন্তু আমাদের পোশাক কই!!
- হুম, সেটা একটা সমস্যা বটে। আচ্ছা, পোশাকও তো চেয়ে নেওয়া যায় হাততালি দিয়ে!
- নাঃ, তিনটে বর মনে করে দ্যাখ, যাহা খুশি খাইতে পারি, যেথা খুশি যাইতে পারি, সারেগামাপাধানিসা গাইতে পারি... কেমন সুন্দর!
- থাক, তোকে আর এখন রাতবিরেতে গান গাইতে হবে না, পাড়ার কুকুরগুলো ডাকতে আরম্ভ করবে। আচ্ছা চল, অন্য কোথাও যাই তাহলে!
আবার তারা হাততালি দিয়ে বলল, “স্কুলের মাঠ!”
রাত্তিরবেলা মাঠটা কেমন অন্যরকম দেখায়! কেউ নেই, খাঁ-খাঁ করছে, শুধু গোলপোস্টগুলো দাঁড়িয়ে আছে একা! ওদের পছন্দ হল না।
- আমেরিকা যাবি?
- ওখানে এখন দিনের বেলা, জানিস তো? কারোকে তো চিনিসও না! যেখানেই যাবি, সোজা পুলিসে ধরে গারদে পুরে দেবে!
- তাহলে তোর মামার বাড়ি?
- সবাই তো ঘুমোচ্ছে, মামার বাড়ি গিয়ে কী হবে! তার চেয়ে নতুন কোনো দেশেই যাই চল।
- আচ্ছা, সেই শুণ্ডি দেশেই যাবি নাকি?
- সত্যি ওই নামে কোনো দেশ আছে নাকি!!
- দেখাই যাক না! চল, হাতে তালি দিই!!
দু’জনে একসঙ্গে তালি দিয়ে বলে উঠল, “শুণ্ডি!”
সঙ্গে সঙ্গে চারদিকের সমস্ত কিছু কেমন যেন দুলে উঠল... হু-হু করে হাওয়া এসে মুহূর্তে দু’জনকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে কোথায় এনে ফেলল... হুঁশ ফিরতে দেখল তারা একটা নদীর মধ্যে গলা অবধি ডুবে রয়েছে!!
- এ কী রে, এ কোথায় নিয়ে এল!
- সে সব পরে ভাবা যাবে। তুই সাঁতার জানিস?
- সুইমিং ক্লাসে যাই, কিন্তু এখনও ভাসতে শিখিনি!
- আমিও শিখিনি। কিন্তু এখন বাঁচতেই হবে! আয়, ট্রেনারের শেখানো কায়দায় প্যাডল করে দেখি...
একটুখানি ঘাপুচ ঘুপুচ করে ওরা দেখল লাভ হচ্ছে না, জল বাড়ছে, চোরা স্রোতও আছে যেন, তাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে... হঠাৎ টিটোন বলে উঠল, “ইয়াহু! ঐ দ্যাখ একটা নৌকো!!”
নাকে মুখে জল ঢুকে যাচ্ছে টাবলুর, তবু মাথা তুলে দেখল দূরে সত্যিই একটা নৌকো যাচ্ছে! দু’জনে প্রাণপণে হাত-পা ছুঁড়ে নৌকোর কাছে গিয়ে দেখল একজন মাঝি, তার মুখটা ঠিক তাদের অঙ্ক স্যারের মতন!
কিন্তু এখন প্রাণে বাঁচতেই হবে, সে মাঝিকে যেমন দেখতেই হোক। দু’জনে তার নৌকোতে উঠতে চেষ্টা করতেই মাঝি হাঁউমাউ করে ‘ভূত ভূত!’ বলে জলে লাফিয়ে পড়ে সাঁতার কেটে পালিয়ে গেল! টাবলু আর টিটোন অগত্যা নিজেরাই হাঁচোড়পাচোঁড় করে নৌকাতে উঠে কোনোমতে হাঁফ ছাড়ল। হঠাৎ তাদের খেয়াল হল পায়ের দিকে।
- এ কী রে, জুতো দুটো!!
- এই রে, আমার জুতো খুলে জলে তলিয়ে গেছে সাঁতার কাটতে কাটতে!
- আমারও! তাহলে বাড়ি গিয়ে কী বলব বাবাকে!
- সে সব পরে ভাববি, আগে বাড়ি তো পৌঁছোই!
- হ্যাঁ রে, এই নৌকো চালিয়েই কোথাও একটা পৌঁছতে হবে আমাদের।
- কিন্তু আমি তো কোনোদিন নৌকো চালাইনি!
- আরে ধুর, সে কি আমিও চালিয়েছি নাকি!! কিন্তু এখন ওসব ভেবে লাভ নেই, আয় হাত লাগা!
- খুব খিদে পেয়েছে রে...
- আমারও, কিন্তু উপায় কী, জুতো দুটোও তো নেই এখন... নে, দাঁড় টান!
আনাড়ি হাতে দাঁড় বাইতে গিয়ে তারা খেয়াল করল, কোনো এক স্রোতে তাদের নৌকো এক দিকে ভেসে যাচ্ছে... স্রোতের সেই টান ক্রমেই বাড়ছে, অন্যদিকে নৌকোর মুখ ফেরানো যাচ্ছে না... অসহায়ভাবে কিছুটা এগোবার পর তারা দেখতে পেল নদীটা একটা পাহাড়ের দিকে এগোচ্ছে... তারপর সেটা একটা জলপ্রপাত হয়ে অনেক নিচে পড়ছে!!
- কী রে, এবার কী হবে!
- আয় জলে ঝাঁপ দিই, নয়তো নির্ঘাত দু’জনে ডুবে মরব...
বলতে বলতে দু’জনে জলে ঝাঁপ দিল... টাবলুর কোমরে খুব ব্যথা লাগল, সে ডেকে উঠল, ‘ও মা গো!!’
মা সাড়া দিল, “কী হয়েছে? ধাড়ি ছেলে, বিছানা থেকে পড়ে গিয়ে আবার মাকে ডাকা হচ্ছে!!”
টাবলু চোখ খুলে দেখল সকাল হয়ে গেছে, সে মাটিতে শুয়ে আছে, আর মা তাঁকে দেখে মুখ টিপে হাসছে! তার সব গুলিয়ে গেল। শুধু বলল, “মা, সেই জুতো জোড়া...”
- “ও, কাল সব শুনেছিস বুঝি? ঐ দ্যাখ, তোর বাবার সম্পত্তি!”
যাক! তাহলে জুতো দুটো হারায়নি! নিশ্চিন্ত হয়ে টাবলু তাকিয়ে দেখল। দরজার ধারে রাখা দু’জোড়া নাগরা জুতো... পুরোনো... ব্যবহার করে অল্প ছেঁড়াখোঁড়া...
আর দিনের আলোয় স্পষ্ট দেখা গেল যে কোনোভাবেই সে দুটো ভূতের রাজার বর দেওয়া জুতোজোড়ার মতো নকশাকাটা নয়!!
_____
ছবিঃ সুমিত রায়

No comments:

Post a Comment