অনন্যা দাশ
“ঋভুকে
আমি মনে প্রাণে ঘৃণা করি!”
নাহ!
কথাটা ঠিক হল না! বাংলা স্যার বলেছেন ঘৃণা কথাটা বড্ড কঠিন, বড্ড কঠোর! ওটাকে
দুমদাম ব্যবহার করতে নেই। তাই আবার শুরু করছি। ঋভুকে আমি কোনোদিনই খুব একটা পছন্দ করি
না। শুধু আমি কেন ক্লাসের কেউই ওকে পছন্দ করে না। আমি হয়তো বা কিছুটা সহ্য করতে
পারি আমার বোন ঝিল্লি একেবারেই পারে না! ঝিল্লি আর আমি একই ক্লাসে পড়ি, যদিও ও
আমার থেকে এক বছরের ছোটো। ঝিল্লির মাথায় খুব বুদ্ধি আর আমি
কিছুটা বোকা, তাই এখন আমরা দুজনে একই ক্লাসে আর ওই ক্লাসেই ঋভু সবাইকে জ্বালিয়ে
পুড়িয়ে খায়! সে ক্লাসে আমার পিছনেই বসে আর... ঋভু হল যাকে ইংরাজিতে বলে ‘Bully’,
বুলির বাংলা আমার জানা নেই। ওর শুধুই সবার উপর চোটপাট আর হম্বিতম্বি!
ঋভুরা আবার আমাদের অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সেই থাকে।
সেই জন্যেই এই ছুটির দিন সন্ধেবেলা আমাদের বাড়িতে ওর আগমন! মা বাবা পিসির বাড়ি
গেছেন পিসির শরীরটা ভালো নেই বলে। বাড়িতে এখন শুধু আমি আর ঝিল্লি। সুমতি মাসি কাজ
করে বাড়ি চলে গেছে। এমন সময় ঋভুবাবু এসে হাজির!
এমনিতে ওকে আমার বাড়িতে ঢুকতে দেওয়ার কথা নয়, ওই যে
বললাম না, ওকে আমি পছন্দ করি না! হাড় জ্বালিয়েছে আমাকে স্কুলে! দরজাটা খুলে ওকে
দেখে আমার ওই কথাই মনে হয়েছিল কিন্তু ওর চেহারা দেখে আমি একটু অন্যমনস্ক হয়ে
পড়লাম! মাথা থেকে পা পর্যন্ত তার সপসপে ভেজা! মাথার চুলগুলো খাড়া! বাইরে যদিও
বৃষ্টি পড়ছে কিন্তু তাও ওরা থাকে দোতলায় আর আমরা চারতলায়, সেটুকু উঠে আসতে ওর তো
ভেজার কথা নয়! ঠক্ঠক্ করে কাঁপছে ঋভু, চোখগুলো উদ্ভ্রান্তের মতন!
“ঝন্টু, আমি ভিতরে আসতে পারি?”
ওর কথা শুনে আমি আরও হকচকিয়ে গেলাম! ঋভুর একি হয়েছে
রে বাবা! আমি যে ঋভুকে চিনি সে তো কারও কাছে অনুমতি চায় না, সে তো কেড়ে নেয়,
ছিনিয়ে নেয়, দাবি করে!
আমি কিছু বলছি না দেখে ও আবার বলল, “প্লিজ!”
অত পীড়াপীড়ির পর আমি আর কী করব!
বললাম, “হ্যাঁ আয়! কী হয়েছে তোর? কিছু দরকার?”
“একটু গরম কিছু খাওয়াবি? বড্ড শীত করছে!”
“তা তো করবেই! ভিজে তো একেবারে ঝোড়ো কাক হয়েছিস!
কিন্তু গরম কিছু তো খাওয়াতে পারব না। আমরা বাড়িতে একা তাই গ্যাস জ্বালানোর অনুমতি
নেই।”
“ঠিক আছে তাহলে থাক। তবে আমার একটু সাহায্য দরকার
ছিল!”
“তাই নাকি? ও আচ্ছা দাঁড়া মনে পড়েছে। গরম কিছু
খাওয়াতে পারব না বটে কিন্তু চকোলেট খাওয়াতে পারি! এই নে!” বলে আমি চকোলেটের
প্যাকেটটা বার করে ওকে দিলাম। ওর ওই রকম দশা দেখে আমার কেমন যেন মায়াই হচ্ছিল!
ঠিক তখুনি, “কে এসেছে রে দাদা?” বলতে বলতে ঝিল্লি এসে
ঘরে ঢুকল।
ঋভুকে দেখেই তো ওর মুখ থমথমে!
আমাকে হিড়হিড় করে টেনে অন্য ঘরে নিয়ে গিয়ে বলল, “তোর
কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? ওই বদমাইশটাকে তুই দরজা খুলে ঘরে ঢুকতে দিয়েছিস! নিজের
পায়ে নিজেই কুড়ুল মারার এত ইচ্ছে তোর? তাছাড়া ক্লাসের সবাই জানতে পারলে তোকে একঘরে
করবে সেটা খেয়াল আছে?”
আমি মাথা নিচু করে বললাম, “তুই বললে তবে তো ওরা জানতে
পারবে! তুই যদি ওর অবস্থা দেখিস তাহলে তোরও মায়া হবে! ভিজে জবজবে হয়ে এসেছে
বেচারা!”
“ও! আর সেই দেখে তুই গদগদ হয়ে ওকে চকোলেট খেতে
দিয়েছিস! দেখিস ও সব কটা চকোলেট খেয়ে ফেলবে! তুই ভুলে গেছিস ও কী করেছে? সঙ্ঘমিত্রার স্কুলের ফিসের টাকা চুরি করে ও আর ওর
বন্ধুরা চাইনিজ খেয়ে নিয়েছিল মনে আছে? বেচারা বিমল তোতলায় বলে ওর জীবন দুর্বিসহ
করে রেখেছে! মারামারি, ভয় দেখানো, ঝগড়া ছাড়া কোনও কিছু বোঝে না সে! ওর বাবা
স্কুলের বোর্ডে আছেন বলে একেবারে ধরাকে সরা জ্ঞান করে বসে আছে! তোর শার্টের পিছনে
পেন দিয়ে কী লিখেছিল মনে নেই তোর?”
“মনে আছে! ‘ফেলুরাম’ লিখেছিল!”
“তাহলে?”
“রেগে যাস না ঝিল্লি! আমি সবই জানি কিন্তু আজ ওর দশা
সত্যি করুণ! আর বলছে সাহায্য চাই তাই... একবার শুনেই নে না কী বলছে। তারপর যদি কিছু করতে পারি তো করব, না হলে করব না!”
“হুঁ! কী চায় চল গিয়ে দেখি তারপর
তাড়াতাড়ি বিদায় করতে হবে!”
বাইরের ঘরে গিয়ে দেখি ঋভু ততক্ষণে সব চকোলেট খেয়ে
ফেলেছে! ঝিল্লি আমার দিকে ‘কী বলেছিলাম তোকে’ গোছের একটা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ওকে
বলল, “কী দরকার তোর শুনি?”
“আয়না আছে?”
“আয়না?” ঝিল্লি আর আমি দুজনেই একটু চমকালাম।
“আয়না কেন বাবা?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“তাহলে তোদের একটা জিনিস দেখাতাম।”
শোওয়ার ঘরের তাকে একটা ছোটো আয়না থাকে।
ঝিল্লি গিয়ে সেটা নিয়ে এল। আয়নাটাকে দেখেই কেমন যেন হয়ে গেল ঋভু, ভীষণ যেন ভয়
পেয়েছে!
আস্তে আস্তে আয়নাটাকে মুখের সামনে ধরল সে। ওটার দিকে
তাকিয়েই আঁতকে উঠল!
“না, না!” বলে চিৎকার করে আয়নাটাকে উলটো করে সোফায়
রেখে দিল!
আমরা দুজনেই বেশ অবাক হলাম! আয়নাতে তো ঋভুর মুখই দেখা
যাচ্ছে তাহলে সে অত ভয় পাচ্ছে কেন?
আমি একটু বিরক্ত হয়েই বললাম, “কী হয়েছে তোর? ওই রকম করছিস কেন?”
পায়ের দিকে তাকিয়ে ঋভু বলল, “ছাদের বুড়োটাকে দেখেছিস
কখনও?”
“কে ছাদের বুড়ো?”
“জানি না কে। আজকেই দেখলাম লোকটাকে। বৃষ্টির
মধ্যে বসেছিল। ওকে দেখে আমি বললাম, ‘এই বুড়ো এখানে কী করছিস?
ডাকব নাকি দারোয়ানকে?’ আমার কথা শুনে লোকটা কেমন যেন অদ্ভুতভাবে আমার দিকে তাকাল।
উফফ, কী ভয়ানক সেই চাহনি! আমাকে বলল, ‘তোমার সঙ্গে একটা
দৈত্য বা দানবের কোনও তফাৎ নেই! আমি সেটাই দেখতে পাচ্ছি আর তুমিও তাই দেখবে!’ তাই
শুনে আমি ভয়ানক রেগে গিয়ে বুড়োকে মারতে ছুটলাম আর সে হঠাৎ বেপাত্তা হয়ে গেল! তখনও
লোকটা যে ঠিক কী বলতে চাইছে আমি বুঝিনি। যাই হোক ভিজে একসা
হয়ে বাড়ি ফিরে বাথরুমে ঢুকেছি ওমনি আয়নায় চোখ পড়তেই ভয়ে আমার ভিরমি লাগার জোগাড়!
আয়নায় আমার মুখ দেখা যাচ্ছে না! তার বদলে একটা দৈত্য তাকিয়ে রয়েছে! কোনও আয়নাতেই
আর আমি নিজেকে দেখতে পাচ্ছি না!
আমি তো প্রথমে ভেবেছিলাম আমার মুখটাই ওই রকম হয়ে গেছে, কিন্তু তোরা আমাকে দেখে
চিনতে পারলি যখন তার মানে আমার মুখটা বদলে যায়নি! এখন অবশ্য তোদের
দেখে বুঝতে পারছি যে অন্যরা আয়নাতে দৈত্য দেখছে না, আমিই কেবল আয়নাতে... যাই হোক
সেই জন্যেই তোদের কাছে ছুটে এসেছি। তোরা যদি কোনও উপায় বাতলে দিতে পারিস! আর কাউকে
কিছু বলিনি! বাবাকে বললে বাবা খুব বকবেন, বলবেন বানিয়ে বানিয়ে গল্প
বলছি!”
“বুড়োটাকেই আবার ধরলে হয় না?”
“আমি ছাদে গিয়েছিলাম কিন্তু ওকে আর দেখতে পেলাম না!
ওকে খুঁজতে গিয়েই তো আরও ভিজে গেলাম!”
এবার অন্তত এটা বোঝা গেল যে ঋভু কেন এমন ভিজে সপসপে
হয়ে আমাদের বাড়িতে এসে হাজির হয়েছে!
ঝিল্লির মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ওর ওই দৃষ্টি আমি
খুব চিনি! ওর ইচ্ছে এই সুযোগে ঋভুকে নিয়ে একটু মশকরা করে নেওয়া যাক!
“কী রকম দৈত্য দেখেছিস তুই?” ঝিল্লির কথায় ঋভু ওর দিকে
ফিরে তাকাল। ও যেন ভুলেই গিয়েছিল ঝিল্লি ঘরে রয়েছে।
“মানে?”
“আয়নায় যে দৈত্যটাকে দেখেছিস সেটাকে কী রকম দেখতে?” ঝিল্লির চোখ চকচক করছে! এটা ওর খুব প্রিয়
বিষয়! দৈত্য দানব নিয়ে পড়তে খুব ভালোবাসে সে। বাবা মাঝে মাঝে ওকে খেপান, “ঝিল্লি
মনে হয় দৈত্যদের নিয়ে পি এইচ ডি করবে!”
ওর কথা শুনে ঋভু বলল, “কী রকম আবার
কী করে বোঝাব! যেমন দৈত্য হয় সেই রকম আবার কি!”
ঝিল্লি প্রথমে হি হি করে হেসে ফেলল, তারপর নিজেকে
সামলে নিয়ে বলল, “দৈত্য কি আর এক রকম হয় নাকি!”
ঋভুর দিশাহারা ভাবটা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল যে সে নিজে দৈত্যর
মতন আচরণ করলে কী হবে, দৈত্যদের সম্পর্কে তার জ্ঞান খুবই কম!
“মানে কী রকম দৈত্য দেখছিস সেটা জানতে
পারলে তোকে সাহায্য করতে সুবিধা হত! আসলে আমরা তো আর কী রকম
দৈত্য দেখতে পাচ্ছি না, আমরা কেবল তোকেই দেখতে পাচ্ছি। যদিও তুইও আমাদের কাছে
দৈত্যেরই মতন, তাও তুই ঠিক কী মুখ দেখছিস জানতে পারলে ভালো হয়। যেমন ধর স্কটল্যান্ডের
বেশ কিছু হ্রদে লোকে একটা বিশালকায় প্রাণীকে দেখতে পেয়ে তাকে লক নেস মনস্টার বলে
ডাকে। সেই দৈত্যটাকে কিছুটা নাকি ডাইনোসরের
মতন দেখতে, অনেকেই মনে করে সেটা প্লেসিওসর জাতীয় কোন একটা জীব! তুই কী...?”
“না, না, আয়নায় ডাইনোসর দেখতে পাইনি আমি!” ঋভু ব্যকুল
হয়ে বলল।
“হুঁ, তাহলে তো বেশ মুশকিল হল। তাহলে কোন দৈত্য? কিং কং
দৈত্য, ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন দৈত্য, মেডুসা দৈত্য?”
“কিং কং তো বিশাল গোরিলা সেটা জানি, সিনেমাটা দেখেছি
কিন্তু সেটার মতন নয়! বাকি দুটো কী?”
ঝিল্লি তো মজা পেয়ে গেছে, ওর প্রিয় বিষয় নিয়ে বক্তৃতা
দিয়ে ফেলল, “ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন একজন ডাক্তার ছিলেন, রসায়ন এবং অন্য অনেক
বিষয়তেও পারদর্শী ছিলেন তিনি। উনি মানুষের মতন একটা জীব বানাতে চেয়েছিলেন মানুষ এবং
বিভিন্ন জন্তুদের মৃতদেহ জুড়ে! উনি ভেবেছিলেন অপরূপ সুন্দর একটা কিছু বানাবেন
কিন্তু শেষ পর্যন্ত একটা কদাকার জীব বানাতে সক্ষম হন! ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের দৈত্য
আট ফুট লম্বা, হলুদ চোখ, চামড়া এতটাই ফ্যাকাসে যে শরীরের ভিতরকার শিরা উপশিরা আর
মাংসপেশি সব দেখা যায়! তার সাদা দাঁত, কালো ঠোঁট আর লম্বা কালো চুল।”
আমি আমার জ্ঞান দেখাবার জন্যে বললাম, “মেরি শেলির লেখা
বই ফ্র্যাঙ্কেন্সটাইন মনস্টার।”
ঝিল্লি অবশ্য কটমট করে আমার দিকে তাকাল। ওটা যে
গল্পের চরিত্র সেটা ওর আদৌ জানাবার ইচ্ছে নেই মনে হল!
ঋভু মাথা নাড়ল, “না, ওরকম দেখতে নয়! অন্যটা কী মোডেসা না কী জানি বললি?”
“মেডুসা, গর্গনদের তিন বোনেদের মধ্যে একজন ছিল।
ভয়ঙ্কর দেখতে দানবী, বড়ো বড়ো দাঁত আর চুলের বদলে হিসহিস করছে সাপ! ওরা আগে নাকি
খুব সুন্দরী ছিল কিন্তু ওদের বড্ড গর্ব ছিল, তাই দেবী অ্যাথেনা ওদের অভিশাপ দিয়ে
কুৎসিত করে দেন! ওদের মুখের দিকে যেই তাকাত সে পাথরের মূর্তি হয়ে যেত!”
“হ্যাঁ, পার্সিয়াস বলে একজন ওর মাথাটা কেটেছিল! ক্লাস
ফোরে একটা গল্প ছিল এবার মনে পড়েছে! তুই বলতে মনে পড়ল! না, ওই রকম দেখতে ছিল না!”
“তাহলে কি এক চোখো দৈত্য সাইক্লোপ্স? নাকি তিন
কুকুরের মাথা দেওয়া নরকের পাহারাদার সারবেরস?”
“না, না!”
একে একে কাউন্ট ড্র্যাকুলা, সাপের মাথা দেওয়া
হাইড্রা, ষাঁড়ের মাথা আর মানুষের ধর মিনোটার সবাই বাদ পড়ে গেল। শেষে ঋভু অত
দৈত্যের ভারে একেবারে নুয়ে পড়ছে দেখে আমি ছুটে গিয়ে ঘর থেকে ঠাকুমার ঝুলিটা নিয়ে
এলাম!
সেখান থেকে একটা রাক্ষসের ছবি দেখাতে ঋভু খুশি হয়ে
বলল, “হ্যাঁ, একেবারে এই রকম!”
আমার ওই রকম হস্তক্ষেপে মোটেই খুশি হল না ঝিল্লি। ওর
খুব সম্ভব মনে হচ্ছিল যে ঋভুকে আরও কিছুক্ষণ ওই সব দৈত্যদের প্যাঁচে ফেলে রাখলে
ভালো হত!
“যাই হোক, এটা স্পষ্ট যেসব দৈত্যরা ঐ রকম হয়েছে সেটা তাদের
জঘন্য কাজের জন্যে! আর তুইও সেই কারণেই দৈত্য হয়েছিস!”
ঋভুর প্রায় কেঁদে ফেলার জোগাড়, “তাহলে এখন উপায়?”
“এই নে কাগজ আর পেন। এত দিন ধরে তুই ক্লাসে যা যা
বাজে কাজ করেছিস, যার মনে কষ্ট দিয়েছিস সব লেখ এতে!”
“তাতেই হবে?”
“খেপেছিস! না, শুধু তাতে হবে না! তাদের সবার কাছে
তোকে ক্ষমা চাইতে হবে! তারপর বুড়ো যদি ক্ষান্ত হয়!”
সেই থেকে শুরু হল। ঋভু সেদিন আমাদের বাড়িতে বসে বসে
লম্বা লিস্টি তৈরি করেছিল। কিছু ওর মনে পড়ছিল, কিছু আমরা মনে করিয়ে দিচ্ছিলাম।
তারপর থেকে ও জনায় জনায় গিয়ে গিয়ে ক্ষমা চেয়েছে। হঠাৎ ওর এই পরিবর্তন কেন হল সেটা
অবশ্য আমরা ছাড়া আর কেউ জানল না! সব থেকে বড়ো কথা হল ঋভু একদম বদলে গেছে! সেটাই
এখন সারা স্কুলের আলোচনার বিষয়!
ঝিল্লি ওকে প্রায় রোজ জিজ্ঞেস করে, “কী রে ঋভু তোর লিস্টে আর ক’টা নাম?” কি “আর ক’জন
আছে?” বা “আর ক’টা
কীর্তির জন্যে ক্ষমা চাওয়া বাকি?”
এমনি করে দিন সাতেক বাদে একদিন ওর লিস্টের সবার কাছে ঋভুর
ক্ষমা চাওয়া হয়ে গেল।
তখন ঋভুর আনন্দ দেখে কে! সে একবার চুপিচুপি আমাকে আর
ঝিল্লিকে জিজ্ঞেস করে গেল, “আজকেই আয়নার দৈত্যের শেষ দিন তাই তো? দৈত্যের চুল
আঁচড়ে আর দাঁত মেজে আমার শরীর খারাপ হয়ে যাওয়ার জোগাড় হয়েছিল, তাই এখন আর আয়নার
দিকে আদৌ তাকাই না!”
আমি কী বলব ভেবে পেলাম না কিন্তু ঝিল্লি বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে
জবাব দিল, “হ্যাঁ, আজই ওই দৈত্যের শেষ দিন! আজ রাতে তুই ছাদে যেতে ভুলিস না যেন!”
সেদিন স্কুলবাস থেকে নেমেই ঝিল্লি বাড়ির দিকে ছুট
দিল, “তাড়াতাড়ি চল বিশুদাকে ফোন করতে হবে!”
আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম, “বিশুদা? কেন?”
ঝিল্লি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “উফফ, দাদা, তুই না সত্যি! ছাদের বুড়োটা কে ছিল?”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “কে ছিল?”
“বিশুদা! ঋভুর জ্বালায় আর পারা যাচ্ছিল না, তাই আমি
বিশুদাকে বলেছিলাম ওকে একটু শায়েস্তা করতে! ও যে পরিত্রাণের জন্যে আমাদের কাছেই
এসে হাজির হবে সেটা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি!” ঝিল্লি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল।
“কিন্তু কিন্তু...” আমার মাথায় সব তালগোল পাকিয়ে
যাচ্ছিল! বিশুদা হল আমাদের মামার বাড়ির পাড়ার এক দাদা। সে একটু আধটু নাটক করে,
জাগলিং ম্যাজিক ইত্যাদি জানে, আর ফাটাফাটি গোয়েন্দা গল্প বলতে পারে!
“বিশুদা কী করে? বিশুদা তো বুড়ো নয়
তাহলে...।”
ঝিল্লির মুখ গম্ভীর হয়ে গেল, “বিশুদা নাটক করে সেই সূত্রে
বুড়ো সাজা ওর পক্ষে শক্ত নয়। তাছাড়া সে আর কী জানে
আর জানে না তা আমি জানি না, কিন্তু দাওয়াই যে মোক্ষম হয়েছে সেটা তো স্বীকার করতেই
হবে!”
সেই রাতেই ঋভু এসেছিল। ওর মুখ উজ্জ্বল আর হাতে
চকোলেট।
আমাদের দেখেই এক গাল হেসে বলল, “দৈত্যটা চলে গেছে রে!
আমি ভাবতেই পারিনি এই রকম হতে পারে! এই নে সেদিন তোদের সব চকোলেট খেয়ে ফেলেছিলাম,
তাই এটা তোদের। তোরা না থাকলে আমি কোনোদিন ভালো হতে পারতাম না! তোদের কাছে
আমি সারা জীবন ঋণী থাকব!”
* * *
পরের বার মামার বাড়ি গিয়ে বিশুদাকে ধরেছিলাম, “তুমি কী করে ওটা করলে বিশুদা? তুমি ওই রকম ভালো ম্যাজিক জানো সেটা
বলনি তো! ঋভুকে কি তুমি হিপনো্টাইজ করেছিলে নাকি?”
বিশুদা আমাদের কথা শুনে মুচকি হেসেছিল, “জাদুকররা
কখনও বলে না!”
তাও যখন আমরা ছাড়ছিলাম না তখন বলেছিল, “আমি তো সাধারণ
একজন মানুষ। আহামরি
কিছু ম্যাজিকও আমার জানা নেই। আসল কথটা হল মানুষের মন জিনিসটাই বড়ো অদ্ভুত রে! আমি
সেই তথ্যটাকেই কাজে লাগাবার চেষ্টা করেছিলাম! এরপর আর যা হয়েছে তাতে আমার কোনও হাত
ছিল না! যা করেছে তা করেছে ঋভু আর করেছে ওর মন! তবে হ্যাঁ, যারা অন্যদের অযথা কষ্ট
দেয় আমি তাদের একদম পছন্দ করি না!” বলে চোখ টিপেছিল বিশুদা!
_____
ছবিঃ সপ্তর্ষি
চ্যাটার্জী