গল্পের ম্যাজিক:: হয়তো বা সে সত্যি নয় - ধূপছায়া মজুমদার


হয়তো বা সে সত্যি নয়
ধূপছায়া মজুমদার

(১)

"দাদু, ওই গল্পটা বল না আরেকবার! ওই যে, সেই খোকন ইস্কুলে যেত, জঙ্গলের রাস্তা পেরিয়ে, একলা যেতে ভয় করত, মা বলে দিয়েছিল জটিলদাদাকে ডাকতে, ডাকলেই দাদা আসবে, আর ভয় করবে না, খোকন তাই শুনে জটিলদাদাকে ডাকত, দাদা এসে ওর পাশে পাশে হেঁটে জঙ্গলের রাস্তা পার করে দিত, আর ফেরার সময় বাঁশি বাজিয়ে ওর সারাদিনের ক্লান্তি ভুলিয়ে দিত, ওই গল্পটা!"
"আমি আর কী বলব দিদিভাই, তুমিই তো বলে দিলে সবটুকু!"
"না না, সবটা বলিনি, ওই দইয়ের ভাঁড়ের জায়গাটা বাকি আছে যে? ইস্কুলের পিকনিকে খোকনের ওপর ভার পড়েছিল সবার জন্য দই নিয়ে যাওয়ার, ওর মা অত পয়সা কোথায় পাবে, তাই খোকন বলেছিল জটিলদাদাকেই, দাদা একটা ছোট্ট এইটুকুনি ভাঁড় দিয়েছিল ওকে, ইস্কুলে সবাই হো হো করে হেসেছিল ভাঁড় দেখে, তারপর খাওয়ার সময় কী হল দাদু?"
"তুমি যেন জান না? খাওয়াদাওয়ার শেষে যখন দই দিচ্ছে সবাইকে, ওইটুকু ছোট্ট ভাঁড়ের দই আর ফুরোয় না, ফুরোয়ই না! শেষে সবাই খোকনকে জিজ্ঞাসা করে বুঝতে পারল ওর জটিলদাদা আসলে সর্বশক্তিমান পরমেশ্বর। তাই তো তিনি অমন অলৌকিক কাণ্ড ঘটাতে পারলেন।"
"সত্যি হয় দাদু এরকম? দোকান থেকে বাবা দই আনলে তো এরকম হয় না? হুট করে ভাঁড় শেষ হয়ে যায়, দিদি আমায় রোজ ভাঁড়টা খেতেও দেয় না, ঠিক মনে রাখে, একদিন আমায় দেয়, একদিন নিজে খায়, আমাদের ভাঁড়গুলোও না ফুরোলে কত ভালো হত বল?"

এতক্ষণ পড়ার টেবিলে বসে দাদু আর বোনের গল্প শুনছিল কুহু। এবার ওকে নাক গলাতেই হল "দোকানের ভাঁড় না ফুরোলে ওদের দই যে আর বিক্রি হত না বনি, তখন ওদের বিজনেস কী করে চলত বল? তাছাড়া ওরকম অলৌকিক কাণ্ড বোধহয় শুধু গল্পেই হয়, তাই না দাদু?"
জানি না দিদিভাই, হয়তো শুধু গল্পেই হয়। তাও ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি তো, অলৌকিক কাণ্ডে বিশ্বা করতে ভালো লাগে। জানিস তো, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর! কোনও কাজ করতে পারার জন্য মন থেকে বিশ্বাস রাখ, দেখবি ঠিক পারবি কাজটা করতে।" কুহু চুপ করে রইল, ভাবছে কিছু।
বাদ দে দিদিভাই, এসব জটিল কথা ভেবে কাজ নেই। কত কী- যে বকে ফেলি, বুড়ো হয়েছি তো!" অমনি দুই বোনে হইহই করে ওঠে "বুড়ো না, একদম বুড়ো না, আমাদের দাদু ইয়ং দাদু, এভারগ্রীনকুহু ফুট কাটে, "দেবানন্দ সাবের মতো।"

তখনই ঘরে ঢুকল বকুলপিসি "হুটোপুটি কোরো না মেয়েরা, চল, ভাত বেড়েছি, বসবে চল। কুহু, তুমি দাদুর ডানপাশটা ধর, চেয়ারে বসাই, আজ ছাতে পড়ে গেছি, হাতে লেগেছে, একা হাতে তোমায় তুলতে পারব না মেসো, নাতনিকে খাটাচ্ছি, মাইনে কেটো না যেন!" হাসতে হাসতে বলে বকুলপিসি, কুহুর সঙ্গে হাত লাগিয়ে অমরেশকে খাট থেকে নামিয়ে হুইলচেয়ারে বসাতে বসাতে। তখনই কুহুর মাথায় এল একটা প্রশ্ন। জিজ্ঞাসা করবে কী করবে না ভাবতে ভাবতে বলেই ফেলল মুখ ফুটে, "দাদু, তুমি মন থেকে বিশ্বাস কর না, না?"
"কী রে?"
তুমি নিজে দাঁড়াতে পারবে, নিজে হাঁটতে পারবে, মন থেকে বিশ্বাস কর না তুমি?" জগদ্দল পাথরের মতো অনড় ডানহাতটা নাড়ানোর একটা বৃথা চেষ্টা করে অমরেশ বড়ো নাতনির দিকে অসহায় চোখে তাকালেন, "হাতটা কিন্তু বিশ্বাস করেই নাড়িয়েছিলাম দিদিভাই, বিশ্বাস কর! হাত আমার কথা না শুনলে কী করব?"

()

বিকেলবেলা, হাউজিংয়ের গার্ডেনে বসে ফোনটাকে এহাতে ওহাতে বদল করে অন্যমনস্ক হয়ে খেলছে কুহু, মন রয়েছে দাদুর দিকে। দাদু বাচ্চাদের মতো পিসির কাছে বায়না করছে, "আমায় ওই শিউলিগাছটার নিচে নিয়ে বকুল।" হুইলচেয়ার ঠেলে ঠেলে শিউলিগাছের কাছে নিয়ে গিয়ে দাদুর কথায় পিসি গাছের গায়ে একবার টোকা দিতেই ঝরঝর করে শিউলি ঝরে পড়ে দাদুর গা মাথা ভরে গেল, কুহুর মনে হল গাছটাও দাদুর মতোই খুশি হয়েছে। গাছ না হলে হয়তো অ্যাদ্দিনে ওদের ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখা করেই আসত, তা পারেনি, তাই আজ গলা জড়িয়ে আদর করছে।

ওদের কমপ্লেক্সটায় খোলা জায়গা অনেক, সবুজও প্রচুর, চোখকে আরাম দেয়। কেকা রোজই বিকেলে খেলতে নামে, একদল বন্ধু আছে, পিসি সঙ্গে যায়। দাদুকে অ্যাক্সিডেন্টের পর থেকে এই চার বছরে একদিনও বাইরে বের করা যায়নি। চেক আপ থাকলে আলাদা ব্যাপার, তখন বেরোতেই হয়, তাছাড়া নিজের ইচ্ছেয় বাড়ি থেকে বেরোন না দাদু, আজ চার বছর হল।
আজ হঠাৎ কী হল কুহু জানে না, বিকেলে কেকা যখন রেডি হচ্ছে নিচে নামবে বলে, কুহুর হঠাৎ জেদ চেপে গেল, দাদুর বিছানার কাছে গিয়ে বলল, "দাদু, চল আজ নিচে নামব সবাই।"
"অ্যাঁ? সে কী? আমি অথর্ব বুড়োহাবড়া, ওই দামড়া চেয়ারে করে আমায় নিয়ে কোথায় যাবি?"
"ওসব ফালতু কথা রাখ, এস, আমি ধরছি, আস্তে আস্তে উঠে বস, হ্যাঁ, হ্যাঁ, এই তো!"
শোয়া অবস্থা থেকে দাদুকে তুলে বসানো, একা একা, কুহুর আজকেই প্রথম, হাত পা কাঁপছিল, নিজেকে সামলাল। এরপর আরও বড়ো কাজ আছে, হুইলচেয়ারে দাদুকে বসিয়ে লিফটে করে নিচে নামানো, আবার ভালোভাবে ফেরত আনা, মা বাবা অফিস থেকে ফিরে শুনে রাগ করলে তাদের বোঝানো, কুহুর এখন অনেক কাজ, এখনই হাত পা কাঁপলে হবে না বকুলমাসিকে ডাকল কুহু, খাট থেকে হুইলচেয়ারে নামাতে একা পারবে না। বকুলমাসি এসে সব শুনে হাঁ
"মেসো নিচে নামবে? কুহু, দাদারা বাড়ি নেই, কিছু যদি হয়!"
"বাজে বোকো না তো! কী হবে? দাদু চেক আপে যায় না? তখন কিছু হয়? কিচ্ছু হবে না, আমি বলছি। শুধু শুধু ভয় পেও না।"
"দিদিভাই, আমায় আজ ছেড়ে দে। আমি নিচে নামব, বিনু, অলি ওরা যেদিন থাকবে, শনি-রবি, সেদিন নামব, আজ নয়।"
"আজই নামবে তুমি, একটা কথাও শুনব না।"
চোখ পাকিয়ে কোমরে হাত রেখে ধমকে উঠল কুহু, ঠিক যেমন ছোটোবেলায় মিছিমিছি দুধের গ্লাস শেষ না করলে দাদুকে বকত, সেইভাবে। তখন দাদু ঘোড়াও হতেন দিব্যি, মনে পড়ে কুহুর গলা ব্যথা করে উঠল। ততক্ষণে দাদুকে চেয়ারে বসানো হয়ে গেছে, তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে কেকাকে নিয়ে বাইরে এল দাদু নিশ্চয়ই ওর মুখের দিকে তাকাননি?

()

দাদুকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে লিফটে করে নিচে যখন নেমেছিল ওরা, সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ছে। তাও সেই পড়ে আসা সূর্যে আলোতেই দাদুর চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল, দু’হাতে চোখ ঢেকে ফেলেছিলেন নিচে নেমে বাইরে বেরিয়েই। হবে না? এই এতদিন পর সময় কাটানোর জন্য বাইরে বেরোনো, চোখ ধাঁধিয়ে যাবেই তো! কুহু দাদুর চেয়ারটা ঠেলে এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগল বাগানের দিকে। সেখানে তখন দাদুর চার-পাঁচজন বন্ধু বসে রয়েছেন স্টিলের বেঞ্চটায়, কেকার বন্ধুরা হুটোপাটি করে খেলছে, একটু বড়ো ছেলেদের একটা গ্রুপ ক্রিকেট খেলছে পাশের ছোট্ট মাঠটায়, আর বিভিন্ন ব্লকের আন্টিরা একটা গাছের নিচের বেদিতে বসে গল্প করছেন। ওদের এই কমপ্লেক্সটা তৈরির সময়ে বিল্ডার একটা ভালো কাজ করেছিল, জমিটায় যে বড়ো বড়ো গাছগুলো ছিল, চেষ্টা করেছে সেগুলো না কাটার। ওগুলোকে ঘিরে বেদি বানিয়ে রেখে দিয়েছে। বেশ ছায়াঘেরা একটা ব্যাপার আছে সেজন্য ওদের কমপ্লেক্সটায়, ভালো লাগে। বাগান আর পাশের ছোট্ট গ্রাউন্ডটার মাঝে একচিলতে জায়গাটায় একটা টাওয়ার আছে, তার মাথায় একখানা ঘড়ি লাগানো। অনেকটাই উঁচু, রাস্তা থেকে দেখা যায়। ওই ক্লক টাওয়ারটার জন্য এই অঞ্চলে ওদের হাউজিংটাকে লোকে 'টাওয়ার কমপ্লেক্স' নামেই চেনে, 'মায়া এনক্লেভ' বললে চিনতে পারে না।
দাদুর বন্ধুরা, আন্টিরা দাদুকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল থমকানি কেটে যেতেই হইহই করে উঠলেন অবনীদাদু, বিকাশদাদুরা।
"আরে আরে অমরেশ, এসো এসো এসো!"
"বলতে পার কোথায় থাকে জগজীবনের মেসো?"
"জগজীবন আজ দুধ দিতে এলে জিজ্ঞাসা করব।" নিজেদের রসিকতায় নিজেরাই হা হা করে হেসে উঠলেন দাদুরা। কুহুকে ওর স্কুল পড়াশোনা নিয়ে দুই একটা মামুলি কথা জিজ্ঞাসা করে বিকাশদাদুরা মেতে গেলেন নিজেদের গল্পে। কুহুও আস্তে আস্তে সরে এসে অন্য একটা বেঞ্চে বসল। অন্যান্য দিন বিকেলে ক্লাস থাকে বলে বিকেলটা সেভাবে দেখা হয় না। আজ দাদুকে নিয়ে বাইরে আসার টেনশনে ফিজিক্স ক্লাসের কথা ভুলেই মেরে দিয়েছিল, এখন খেয়াল হতে ফোনটা পকেট থেকে বের করে দেখল অয়ন মনীষারা মেসেজ করেছে, রাই কলও করেছিল, সাইলেন্ট করা ছিল ফোনটা। রাই এখানে ওর একমাত্র বন্ধু, অনেক ছোটো থেকে স্কুল, পাড়া সবই এক, দুজনকে হরিহর আত্মা বললেও কম বলা হবে। এখন আর ফোন করা যাবে না, তিনজনকেই টেক্সট করে দিয়ে ফোনটা নিয়ে -হাত -হাত করে খেলতে লাগল কুহু। মনে একটা চাপা টেনশন রয়েছেই, ভালোয় ভালোয় দাদুকে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া অবধি অস্থিরতা কাটবে না। বাবার ফিরতে রাত হয়, মায়ের আসার সময় হবে একটু পরেই। তখনও ওরা বাগানে থাকলে মা দেখে কী বলবে, সে নিয়েও চিন্তা হচ্ছে।

"কুহুদিদি, এস এদিকে, দেখ মেসো কী শুরু করেছে!"
পিসির ডাকে ঘোর কাটল কুহুর, দাদু বায়না জুড়েছেন বাগানের বেড়া পেরিয়ে ওপাশে ক্লক টাওয়ারটার কাছে যাবেন বলে। অথচ বাগান থেকে ওপাশে যাওয়া মুশকিল, হুইলচেয়ার তোলার মতো জায়গা নেই। ওদিকে মাঠের ক্রিকেট টিমের খেলা শেষ ততক্ষণে, কেকা-রা বাগান ছেড়ে মাঠে গিয়ে খেলছে, লুকোচুরি না ছোঁয়াছুঁয়ি, কী একটা খেলতে খেলতে মাঝেমাঝেই দুড়দাড় করে ওকে ঠেলেঠুলে টাওয়ারের সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামা করছে। বাগানে ঢোকার ঢালু জায়গাটা দিয়ে বেরিয়ে বাঁধানো রাস্তাটা দিয়ে দাদুকে নিয়ে গিয়ে টাওয়ারের কাছে দাঁড়াল কুহু আর বকুলপিসি

"দাদু, এবার কিন্তু আস্তে আস্তে বাড়ি ফিরব, হ্যাঁ?"
"আরেকটু থাকি দিদিভাই? ওই সূর্যটা পুরোপুরি চলে যাক, তারপর ফিরে যাব? কতদিন পর এখানে দাঁড়িয়ে সূর্য ডোবা দেখছি, না রে?" ওদের কমপ্লেক্সের বাউন্ডারির বাইরে একটা ঝিল আছে। এই টাওয়ারটার কাছে দাঁড়ালে সেই ঝিলের বেশ ভালো ভিউ পাওয়া যায়, বিশেষ করে সূর্য যখন ডোবে সারা আকাশ রাঙিয়ে দিয়ে, ঝিলের জলটাও কেমন আলোমাখা হয়ে যায়, কুহু নিজেকে বিশেষ প্রকৃতিপ্রেমিক বলে জানে না, ওরও বুকের ভেতরটা কেমন করতে থাকে দৃশ্যটা দেখলে। নো ডাউট, টাওয়ারের ওপর থেকে দেখলে আরও ভালো লাগে, দাদু সেটা জানেনও, কিন্তু এখন ওখানে ওঠা সম্ভব নয়, তাই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো আর কি! তিনজনেই তন্ময় হয়ে গিয়েছিল, একটা 'হি হি' হাসির সঙ্গে ধুপধাপ আওয়াজ আর 'মাআআ' চিৎকারে ফিরে তাকাল তিনজনেই। টাওয়ার থেকে কে যেন নিচে পড়ে যাচ্ছে! কে, বুঝতে পারার আগেই কুহুর গলা দিয়ে একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এল, চোখ বন্ধ করে ফেলল ও। পরের মুহূর্তেই চোখ খুলে দেখল দাদু হুইলচেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে কয়েক পা হেঁটে টাওয়ারের নিচে গেছেন, যে নিচে পড়ে যাচ্ছিল, তাকে দু'হাত দিয়ে লুফে নিয়ে বুকে জড়িয়ে টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেলেন মাটিতে
"দাদু!!"
চিৎকার করে দৌড়ে গেল কুহু, টাওয়ার থেকে বাকি বাচ্চারা নেমে এসেছে ততক্ষণে, এদিকে ওদিকে ইভনিং ওয়াকে বেরোনো আঙ্কেল আন্টিরাও দৌড়ে এসেছেন, সবাই মিলে দাদুকে তুলে ধরে ধরে হুইলচেয়ারে বসানো হল। দাদু প্রায় অজ্ঞান, কপালে একজায়গায় কেটেও গেছে, রক্ত গড়াচ্ছে অল্প। দাদুকে আঁকড়ে ধরে কাঁদছিল টু--থ্রি' দিঠি, - পড়ে যাচ্ছিল টাওয়ার থেকে, দাদু না থাকলে এতক্ষণে ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটে যেত দিঠির মা এসে মেয়েকে কোলে নিয়ে ভোলাতে লাগলেন, কেয়ারটেকার রাঘব আঙ্কেল অফিস থেকে ফার্স্ট এইড বক্স এনেছেন, কপালের কাটাটা ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ বাঁধতে লাগলেন শম্পা আন্টি, কুহু রিস্ক না নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করল, চেক আপ দরকার ইমিডিয়েটলি

"কুহু! কী করে হল সব? বকুল কী বলছে?" মায়ের ঠান্ডা গলাটা শুনে ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল কুহুর। "মা, অ্যাম্বুলেন্স আসছে, তুমি ডক্টর আঙ্কেলকে আর বাবাকে ফোন কর, দাদুকে নিয়ে যেতে হবে, যেতে যেতে বলছি সব।" বলেই থমকে গেল কুহু, পাশে দাঁড়িয়ে ফোঁপাতে থাকা কেকার হাতটা জড়িয়ে ধরে অদ্ভুত একটা গলায় বলে উঠল, "মা, দাদু পড়ে যাওয়ার আগে আজ হেঁটেছে, হেঁটে গিয়ে একটা জীবন বাঁচিয়েছে। আমি দেখেছি।"

(৪)

"কী বলছেন ম্যাডাম? এটা হয় কখনও? না না, আপনার মেয়ে ভুল দেখেছে। ইটস ইমপসিবল।"
"কিন্তু, যে জোর দিয়ে বলছে স্যার। ওখানে আর আমাদের হেল্পিং হ্যান্ড বকুল ছিল তখন।"
"সেও দেখেছে একই জিনিস?"
"বকুলপিসি ভয়ে চোখমুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে ছিল। কিছু দেখেনি।" মা আর আঙ্কেলের কথার মাঝে কথায় ঢুকল কুহু, "আঙ্কেল বিলিভ মি, আমি ভুল দেখিনি। আমার চোখ তখন খোলা ছিল। স্পষ্ট দেখলাম দাদু হুইলচেয়ার থেকে নিজে নিজে উঠে দাঁড়িয়ে কয়েক পা হেঁটে গিয়ে দু'হাত বাড়িয়ে দিঠিকে লুফে নিয়ে টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল। দিঠি টাওয়ার থেকে পড়ে যাচ্ছিল, দাদু না ধরলে মাটিতে আছড়ে পড়ত, শেষ হয়ে যেত আঙ্কেল। বিশ্বাস না হলে দিঠিকে জিজ্ঞাসা কর না মা! তো জানে ওকে কে বাঁচিয়েছে!" একটানা কথাগুলো বলে কুহু হাঁপাতে লাগল
ডাক্তারের ইশারায় মা ফোন নিয়ে বাইরে গেলেন। ডাক্তার নরম স্বরে কুহুকে বললেন, "বেটা, তুমি বড়ো হয়েছ, সায়েন্সের স্টুডেন্ট, মি. মিত্রর কন্ডিশন তুমি তো জান। হাত বা পায়ের একটা আঙুল নাড়ানোর ক্ষমতাও গত চার বছর ধরে ওঁর নেই। সেই মানুষটা কী করে কয়েক পা হেঁটে গিয়ে হাত বাড়িয়ে একটা বাচ্চাকে হাওয়ায় লুফে নেবেন বল? ইজ ইট লজিক্যাল?"
"নো আঙ্কেল, ইটস নট লজিক্যাল, আই নো। বাট হাউ ক্যান আই ডিনাই হোয়াট আই হ্যাভ সীন? লজিকের বাইরেও কিছু কিছু ব্যাপার থাকে আঙ্কেল, সেরকমই একটা কিছু হয়েছে, আমি জানি। আপনারা সবাই আমায় অবিশ্বাস করলেও আমি বিশ্বাস করবই।"
কথাগুলো বলতে বলতে কুহুর মনে পড়ে যায় দুপুরে দাদুর বলা কথাগুলো, সেই মুহূর্তটায় দাদুও নিশ্চয়ই বিশ্বাস করেছিলেন, আর, বিশ্বাস থেকেই তো জন্ম নেয় মিরাকল!
"ডক্টর, বাচ্চা মেয়েটির সঙ্গে কথা হল, ইটস ভেরি স্ট্রেঞ্জ!"
উত্তেজিত হয়ে ঘরে ঢুকলেন বিনয় মিত্র আর তাঁর স্ত্রী অলিভিয়া, "দিঠি বলছে ওকে একজন সেইন্ট এসে রেসকিউ করেছেন। তিনি নাকি দু'হাত বাড়িয়ে ওকে ধরে নিয়ে বুকে জড়িয়ে মাটিতে শুয়ে পড়েছিলেন।"
"দেয়ার স্টেটমেন্টস আর সেম। বাট হাউ ইজ ইট পসিবল? হাউ?"
নিজের মনে বিড়বিড় করতে করতে ডানহাতের তেলোয় বাঁ হাত দিয়ে ঘুষি মারতে থাকেন ডক্টর বর্মন। চিন্তিত বিনয় আর অলি তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে বসে থাকেন, ঘরের আরেক কোণে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে কেকা আর বকুল, তাদের মুখেও মেঘ। শুধু কুহুর মুখেই কেমন যেন অদ্ভুত একটা প্রশান্তি খেলা করছে, বিশ্বাস করতে পারার প্রশান্তি

ভিজিটিং আওয়ার শুরু হল, এবার দাদুর সঙ্গে দেখা করা যাবে। ইতিমধ্যে এক্সরে রিপোর্ট এসেছে, সেটা দেখে আরেক প্রস্থ হতাশার মেঘ এসে জড়ো হয়েছে বাবা মা আর ডক্টর আঙ্কেলের মুখে। এবার কোমরের হাড়ে ফ্র্যাকচার, এই বয়সে শরীরের এই অবস্থায় সার্জারির প্রশ্নই ওঠে না, রিকভারির অন্যান্য উপায় নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে। কুহু মায়ের কাছে ভিজিটর্স কার্ডটা চেয়ে নিয়ে কেকার হাত ধরে পায়ে পায়ে এগিয়ে চলে দাদুর কেবিনের দিকে। ঘরের দেওয়ালগুলোয় হালকা নীল রং করা, বেডের চাদরও হালকা নীল, বিছানায় মিশে শুয়ে রয়েছেন দাদু, হাতে চ্যানেল করে নিডল ঢোকানো। তাঁকে দেখেই কুহুর গলাটা ব্যথা করতে থাকে আবার, কেকা তো কেঁদেই ফেলল। ওর কান্না শুনে নার্স আর দাদু দুজনেই তাকালেন এদিকে, ইশারায় দাদু কাছে ডাকলেন ওদের। নার্স আন্টি নিচু গলায় "বাচ্চাদের একলা আসতে দেয় কেন রে বাবা?" বলতে বলতে হাতের কাজ সারতে লাগলেন

দাদুর দিকে তাকাতেই কুহুর চোখ ছলছল করে উঠল ওর জেদেই দাদুকে আবার ভুগতে হচ্ছে। যদি বিকেলে জোর করে দাদুকে নিয়ে নিচে না নামত, এসব কিছুই হত না। 'এসব কিছুই হত না' ভাবতে গিয়েই শিরদাঁড়া দিয়ে ভয়ের স্রোত নেমে যায়। দাদু বাগানে না গেলে দিঠির কী হত? চোখের জলটাকে ঠেলে ভেতরে ফেরত পাঠিয়ে দাদুর হাত ধরে সে। সে হাতে সাড় নেই যথারীতি, বিকেলের ঘটনাটা তাহলে সত্যিই মিরাকল ছিল?
কানে আসে দাদুর ক্ষীণ কন্ঠ, "দিদিভাই, দিদিভাই!"
"বলো দাদু।"
"বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর!"
_____
ছবিঃ পুষ্পেন মন্ডল

6 comments:

  1. বাঃ, দারুন

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাঙ্কিউ দিদি

      Delete
  2. বিষয়টা বড্ড ভালো। খুব ভালো লাগলো।

    ReplyDelete
  3. অলৌকিক সংখ্যায় এটি একটি দারুণ লেখা। প্রতি মানুষের মধ্যে কিছু দৈবশক্তি সুপ্ত অবস্থায় থাকে। মানসিক ব্যায়াম বা ধ্যান, কোনো অতিপ্রাকৃত শক্তির সংস্পর্শে আসা বা নিজের থেকেই কোনো ঘটনা ঘতবার সময় এই সুপ্ত শক্তি জাগ্রত হতে পারে। এই গল্পে এই শেষোক্ত গবস্থার ফলে অলৌকিক ঘটনাটি ঘটেছে।

    ReplyDelete