পেছল
ভূতের পাঁচালি
সৈকত মুখোপাধ্যায়
গোরাবাজার গ্রামে বাস করত
বিখ্যাত চোর রাসু মুস্তাফি। নিজের গ্রামের মধ্যে সে চুরি করত না; কোনও চোরই
তা করে না। কিন্তু গোরাবাজারের আশেপাশে যত গ্রাম কিংবা শহর ছিল, সেখানকার
লোকেরা রাসুর চুরির জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল।
রাসু ছিল বনেদি চোর। তার ঊর্ধ্বতন
চোদ্দপুরুষ চুরি ছাড়া কিছু করেনি। বাপ-ঠাকুর্দার মতনই রাসুও মনে করত ছবি আঁকা
কিংবা গানে সুর দেওয়ার মতোই চুরি করাও একটা শিল্প, যাকে বলে আর্ট। প্রতিভা ছাড়া কেউ বড়ো
চোর হতে পারে না। বনেদি চোর রাসু চুরিটাও করত একেবারে বনেদি কায়দায়। লোকে বলে
বনবেড়ালের মতন তার চোখদুটো নাকি অন্ধকারে জ্বলত; অমাবস্যার রাতেও রাস্তায় পড়ে থাকা
একটা দেশলাই-কাঠি তুলে নিতে তার কোনোই অসুবিধে হত না। তার চলাফেরাও ছিল বেড়ালের
মতন নিঃশব্দ।
এক-একরকম দেয়ালে সিঁধ কাটার জন্যে এক-একরকমের সিঁধকাঠি
ছিল রাসুর। মাটির কুঁড়েই হোক আর পাকা বাড়ি, রাসু যদি একবার মনে করত সিঁধ কেটে
ঢুকবে তো কেউ তাকে আটকাতে পারত না। আর সে সব সিঁধেরই-বা কতরকমের বাহার। কোনোটা ময়ূরের পেখমের মতন, কোনোটা
ত্রিশূলের মতন আবার কোনোটা ছিল মাছের ল্যাজের মতন দেখতে। লোকে বলে যার বাড়িতে চুরি
হয়েছে, যার
পেতলের ঘটিটা অবধি আগের রাতে রাসু নিয়ে পালিয়েছে, সেও নাকি সকালে ঘুম থেকে উঠে মুগ্ধ
হয়ে নিজের ঘরের দেয়ালে সিঁধের বাহার দেখত আর ‘বাহ্ বাহ্’ বলে তারিফ
করে উঠত।
আরও অনেক কায়দাকানুন ছিল
রাসুর। তার ঠোঁটে থাকত নিদুলি বিড়ি। চুরি করার আগে ঘরের জানালার ফাঁক দিয়ে সেই বিড়ির
ধোঁয়া ঘরের মধ্যে ছেড়ে দিলেই বাড়ির যত লোক, সবাই মরার মতন ঘুমিয়ে পড়ত। রাসু
কুকুরের মুখবন্ধনের মন্ত্র জানত। তাকে দেখলে
রাস্তার কুকুরেরা চেঁচাতে ভুলে যেত। এইসব কারণে যদিও রাসুর ধরা পড়ার সম্ভাবনা ছিল
প্রায় শূন্য, তবুও
সে বাপ-ঠাকুর্দার কথা মেনে গায়ে জবজবে করে তেল মেখে চুরি করতে বেরোত। সেই
তেলের ফর্মুলাও রাসুর পরিবারের বাইরে কেউ জানত না। রাসুর দিদি নিজের হাতে পোড়া
মোবিলে পাটশাক, শ্যাওলা
এবং আরও চোদ্দরকমের কী সব জ্বাল দিয়ে সেই তেল বানিয়ে দিত। তার না ছিল কোনও বর্ণ, না কোনও
গন্ধ। কিন্তু অমন ভয়ংকর হড়হড়ে তেল এই দুনিয়ায় আর দ্বিতীয়টি ছিল না এ কথা নিশ্চিত।
বছর বারো আগে একবার
গাঁদালতলার জমিদারবাড়ির পেয়াদারা রাসুকে হাতের নাগালে পেয়ে গিয়েছিল। বারো জন
পেয়াদা চারদিক থেকে ডাইভ দিয়ে রাসুর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ঠিকই, কিন্তু সেই তেলের কল্যাণে রাসু তাদের মুঠোর ফাঁক দিয়ে পাঁকাল মাছের মতন
স্লিপ কেটে বেরিয়ে গিয়েছিল। একবার দু-বার নয়, সব মিলিয়ে
একুশবার।
রাসু পালিয়ে যাওয়ার পরেও সেই
বারো জন পেয়াদা আরও এক সপ্তাহ নিজেদের হাতে ধরে কিছুই খেতে পারেনি, কারণ তারা
যখনই জলের গ্লাস, চায়ের
কাপ কিংবা ভাতের গরাস মুঠোয় ধরতে যেত, তখনই সে সব তাদের হাত থেকে পিছলে পড়ে
যেত — এমনই ভয়ংকর ছিল সেই তেলের গুণ।
গোরাবাজারের আশেপাশের
তিরিশখানা গ্রাম-শহরের লোক যখন হতাশ হয়ে মেনেই নিয়েছে যে, রাসুর হাত
থেকে তাদের মুক্তি নেই,
তখনই একদিন রাসু ধরা পড়ল। না, মানুষের হাতে নয়, ভগবানের
হাতে।
রাতটা ছিল অমাবস্যার রাত। তার
ওপরে শ্রাবণ মাস। ঝমঝম করে অবিশ্রান্ত বৃষ্টি হয়েই চলেছিল। চারদিক নিঝুম অন্ধকার।
লোকজন ন’টা বাজতে না বাজতেই ঘরে খিল দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। এমন রাতই তো
চুরির পক্ষে সবচেয়ে অনুকূল। রাসু তাই ভারি খুশি মনে কোমরে সিঁধকাঠি গুঁজে, আপাদমস্তক
জবজবে করে সেই ম্যাজিক তেল মেখে বেরিয়ে পড়ল।
পচাডাঙার শ্মশানের লাগোয়া
মাঠটা যখন সে পেরোচ্ছে তখনই একটা বাজ পড়ল ঠিক রাসুর ধারালো সিঁধকাঠিটির ডগায়।
পরদিন বেলার দিকে রোদ উঠলে মানুষজন দেখতে পেল রাসু একটা কালো পুতুলের মতন মাঠের
মাঝখানে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সত্যি কথা বলতে কী, কারুর তেমন মনখারাপ হল না। চুরির অত্যাচারটা বড্ড বাড়িয়ে ফেলেছিল রাসু।
* * *
রাসুর নিজেরও মরে গিয়ে তেমন
মনখারাপ হল না। বেঁচে থাকতে সে ধরেই নিয়েছিল মরার পরে নরকে যাবে। সেখানে যমদূতেরা
তাকে গরম তেলে ভাজবে। কিন্তু অমাবস্যার রাতে শ্মশানের চৌহদ্দির মধ্যে মৃত্যু ঘটলে
যে অনেক পাপ-টাপ মাফ হয়ে যায় সেটা সে জানত না। সেইজন্যেই রাসু স্বর্গেও গেল না, নরকেও গেল
না। সে ভূত হয়ে গেল — পেছল ভূত।
ভূতেদের ইতিহাসে রাসুর আগে
কোনও পেছল ভূতের জন্ম হয়নি। কাজেই সেটা কেমন জিনিস, কেমন করেই বা সম্ভব হল, তার পেছনের
সায়েন্সটা একটু বুঝে নেওয়া দরকার।
ভূতেদের শরীর থাকে না ঠিকই, কিন্তু
শরীরের খোলসটা থাকে। সেইজন্যেই বেঁটে লোকের ভূত বেঁটে হয়, লম্বা লোকের
লম্বা। দেখবে, জ্যান্ত
অবস্থায় কারুর বোঁচা নাক থাকলে, ভূত-জন্মেও তার বোঁচা নাক হয়। গোল কান থাকলে গোল কান। তার
মানে ভূত-জন্মেও মনুষ্য শরীরের একদম বাইরের পাতলা খোলটা ঠিক থেকে যায়।
এখন, রাসুর
ক্ষেত্রে সেই খোলটায় তো জবজবে করে তেল মাখানো ছিল। কাজেই ভূত হওয়ার পরেও তার
আত্মার গায়ে সেই পেছলা ভাবটা শুধু যে রয়েই গেল তাই নয়, শরীরের
ঝামেলা না থাকায় সেটা আরও চোদ্দ গুণ বেড়ে গেল।
রাসুর আত্মা শরীর ছেড়ে বেরিয়ে
আসামাত্রই পচাডাঙার শ্মশানের বটগাছটা থেকে একগাদা চ্যাঙড়া ভূত ‘ওয়েলকাম
ওয়েলকাম, আসুন
দাদা, আলাপটা
সেরে ফেলি’, এইসব
বলতে বলতে মহা উল্লাসে তার দিকে দৌড়ে আসছিল। কিন্তু রাসুর ছ-ফুটের মধ্যে
আসতেই তারা সব মাথা নিচের দিকে, পা ওপরদিকে করে ধপাধপ আছাড় খেয়ে পড়ল। শুধু
যে পড়লই তা নয়, তার
পরেও যতবারই সোজা হয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করে ততবারই পিছলে পড়ে।
রাসু প্রথমটায় অবাক হলেও খুব
শিগগিরি বুঝে নিল কেসটা কী। সে ধীরে ধীরে ফুট দশেক পিছিয়ে যেতেই ভূতেদের ছেলেগুলো
উঠে দাঁড়াতে পারল। তারপর তারা দূর থেকে রাসুকে হাতজোড়
করে পেন্নাম ঠুকে বলল,
“দাদা গো, বেঁচে
থাকতে তুমি যে সাধারণ মানুষ ছিলে না সে তো বুঝতেই পারছি। তুমি এখানে থাকলে আমরা আর
কোনোদিন সোজা হয়ে হাঁটতে পারব না। গো-ভূতের মতন আমাদেরও
চার পায়ে হাঁটতে হবে। তুমি প্লিজ এখান থেকে কেটে পড়ো, এক্ষুনি।”
কেটেই পড়ল রাসু। সে বরাবর
লোভী মানুষ। প্রচুর পয়সা থাকবে, ভালো খাবে, দামি দামি জামাকাপড় পড়বে, দামি গাড়ি চেপে বেড়াবে — বেঁচে থাকতে
এই ছিল তার স্বভাব। শ্মশানের ধারে মাঠের মাঝখানে পড়ে থাকতে তার ভালো লাগবে কেন? তাই বাজে পোড়া
শরীরটার মায়া ত্যাগ করে রাসু হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল একেবারে গোরাবাজারের হাটতলায়।
হাটতলায় ঢুকবার মুখে মজে
যাওয়া গোরাই নদীর ওপরে একটা সিমেন্টের কালভার্ট রয়েছে। ওই কালভার্টটার ওপর দিয়েই
শয়ে শয়ে মানুষ আর গাড়ি হাটতলার দিকে যাতায়াত করছিল। রাসু সেই কালভার্টের রেলিংয়ের
ওপরে পা ঝুলিয়ে বসল।
বসল ঠিকই, কিন্তু ঠিক স্বস্তি করে বসতে পারল না। ও দেখল, ওর হাত-পা সবই কেমন যেন জেলির মতন একটু করে ছড়িয়ে যাচ্ছে। ভূতেদের এরকমই হয়।
মানুষের মতন হাড়ের কাঠামো থাকে না বলে শরীরটা একটু ছড়িয়ে ছেতরিয়ে যায়। রাসু তখন
সবেমাত্র ভূত হয়েছে বলে ব্যাপারটার সঙ্গে অভ্যস্ত ছিল না। ও যথাসম্ভব পা দুটো
গুটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু তবুও অনেকখানি করে পা
রাস্তার ওপরে পড়ে রইল।
একটু বাদেই ওর পায়ের ওপর দিয়ে
একটা পটলের বস্তাভর্তি ম্যাটাডোর চলে গেল। তার পরে পরেই একটা বাঁশ বোঝাই ঠেলাগাড়ি।
রাসু চেয়ে চেয়ে দেখল কিন্তু কোনও ব্যথা-ট্যাথা টের পেল না।
রাসু কালভার্টের রেলিংয়ে বসে
পা দোলাতে দোলাতে ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করছিল আর হাটতলার দোকান থেকে ভেসে আসা গরম
জিলিপির গন্ধ শুঁকছিল। হঠাৎ ওর সামনের রাস্তায় একটা কেলেঙ্কারি কান্ড শুরু হয়ে গেল। একসঙ্গে
কুড়ি-পঁচিশজন করে লোক আছাড় খেয়ে পড়তে আরম্ভ করল। এর
ফুলকপির ঝুড়ি উলটে গেল ওর মাথায়, ওর ছানার বালতির জলে চান করে উঠল
আরেকজন। শুধু মানুষই নয়, হাটতলার পোষা ষাঁড় শম্ভু অবধি চার পা নিয়েও সামলাতে পারল
না। ল্যাগব্যাগ করতে করতে বিশাল শরীরটা নিয়ে উলটে পড়ল একেবারে কালভার্টের
মাঝখানটাতে।
পড়ে যাওয়ার হিড়িক তাতেও থামল
না। হই হই আর্তনাদ শুনে যারা উদ্ধার করার জন্যে দৌড়ে আসছিল তারাও রাসুর সামনে দিয়ে
যাবার সময় আছাড় খেল। মানুষের ওপর ষাঁড়, ষাঁড়ের ওপর
মানুষ — এইভাবে একটা ঢিবিই তৈরি হয়ে গেল। একশো মানুষের গলায় ‘বাবা গো মা গো’, শম্ভুর তারস্বরে গাঁ গাঁ গর্জন — সব মিলিয়ে সে এক দক্ষযজ্ঞ
কান্ড।
রাসু বসে বসে সবটাই দেখল। শেষ
অবধি যখন দমকলের গাড়ির ঘণ্টা শোনা গেল, তখন সে রেলিং থেকে উলটোদিকে ঘুরে
নদীর মধ্যে নেমে গেল। পড়ে যাওয়া লোকগুলোও তক্ষুনি দিব্যি উঠে দাঁড়াতে পারল। সবাই
নয় অবশ্য। শম্ভুর বিশাল শরীরের নিচে যে তেরোজন লোক চাপা পড়েছিল, তাদের চ্যাংদোলা
করে তুলে নিয়ে যেতে হল।
তারপরে দমকল আর পুলিশের বড়োকর্তারা
অনেকক্ষণ ধরে খুঁজে বার করার চেষ্টা করলেন, এত লোকের পা পিছলোনোর কারণটা কী। এমন নয় যে
জায়গাটায় কোনও গাড়ির মোবিল ট্যাঙ্ক ফুটো হয়ে মোবিল পড়ে গেছে কিংবা ঝোলা গুড়ের
নাগরি ভেঙেছে। দিব্যি সুন্দর কংক্রিটের খড়খড়ে রাস্তা। তার ওপরে সকাল থেকে বৃষ্টি
থেমে চড়া রোদ উঠেছিল বলে জল-টলও জমে ছিল না কোথাও। তাহলে এতক্ষণ ধরে এতগুলো লোক
উলটে পড়ল কেমন করে?
তাছাড়া, শম্ভু ছাড়া
বাকি সকলেই পুলিশের সামনে হলফ করে বলেছে যে, ভয়ংকর রকমের স্লিপারি একটা কিছুর
ওপরে তাদের পা পড়েছিল। সে জিনিসটা কী? আর সেটা গেলই বা কোথায়?
* * *
গোরাই নদীর পাড় ধরে রাসু হাঁটছিল।
কিছুটা যাবার পরে নদীর তীর থেকে ডানদিকে বাঁক নিলেই মুস্তাফিপাড়া, যেখানে
রাসুর বাড়ি। অভ্যেস মতন বাড়ির দিকেই হাঁটছিল রাসু। সে খেয়াল করল না যে, তার পেছন
পেছন, একটু
দূরত্ব রেখে, একজন
লোক তাকে ফলো করছে।
লোকটার চেহারাটা ছোটোখাটো।
বয়স পঞ্চাশের ওপরেই হবে। বাবরি চুল, কাঁচাপাকা দাড়ি। পরনে একটা ময়লা ধুতি, লাল
পাঞ্জাবি আর কাঁধে কাপড়ের ঝোলা ব্যাগ। গলায় রঙিন পাথরের মালা। লোকটা কিন্তু যে-সে
লোক নয়। ওঁর নাম সিদ্ধেশ পাকড়াশি, নামকরা তান্ত্রিক। মেদিনীপুরে বাড়ি। সেদিন গোরাবাজারের হাটে
কিছু দরকারি শেকড়বাকড় কিনতে এসেছিলেন। অন্য আরও অনেকের মতন সিদ্ধেশ তান্ত্রিকও
সেদিন পেছল-ভূতের দয়ায় আছাড় খেয়েছিলেন, তবে তাঁর শরীরটা হালকা পাতলা বলে
তেমন আঘাত পাননি।
জামাকাপড় ঝেড়ে-ঝুড়ে উঠে
দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই একটা গন্ধ পেয়েছিলেন সিদ্ধেশ তান্ত্রিক — অনেকদিনের বন্ধ ঘর
খুললে যেরকম ভ্যাপসা গন্ধ ছাড়ে, সেরকম একটা গন্ধ। সিদ্ধেশের চিনতে ভুল হয়নি, গন্ধটা
ভূতের। তিনি ওখানে দাঁড়িয়েই তিনবার সঞ্জয় মন্ত্র জপ করলেন। সঙ্গে সঙ্গেই তার চোখের
সামনে আমাদের এই জীবিতের জগতের পাশাপাশি যে ভূতেদের জগৎ রয়েছে সেটা ভেসে উঠল। তিনি
দেখলেন কাছেপিঠের মধ্যে একটিই ভূত রয়েছে — ওই যে, নদীর পাড় ধরে হেঁটে যাচ্ছে। তখনই
সিদ্ধেশ ভূতটাকে, মানে
রাসুকে অনুসরণ করে হাঁটতে শুরু করলেন।
রাসুর পেছনে হাঁটতে হাঁটতেই
সিদ্ধেশ পাকড়াশি খেয়াল করলেন, অদ্ভুত ব্যাপার! ভূতটার কাছাকাছি কেউ
স্থির হয়ে দাঁড়াতে কিংবা বসতে পারছে না। তিনটে লোক নদীর ধারে ছিপ ফেলে বসে ছিল।
ভূতটা তাদের পাশ দিয়ে চলে যেতেই তারা তিনজনেই স্লিপ খেয়ে জলের মধ্যে গিয়ে পড়ল। তারপর
জল থেকে উঠে বোকার মতন এদিক ওদিক তাকাতে লাগল।
সিদ্ধেশ পাকড়াশি ওদের সামনে
গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। বললেন,
“কী হল?”
হাতের ছিপের হ্যান্ডেল দিয়ে
শুকনো মাটিতে খোঁচা মারতে মারতে লোকগুলো বলল, “সেটাই তো বুঝতে পারছি না। হঠাৎই যেন
পায়ের নিচের জমিটা কাচের মতো তেলা হয়ে গেল। হুড়হুড়িয়ে নেমে গেলাম জলের দিকে।
কিন্তু এখন তো আবার সব ঠিকই আছে দেখছি।”
লোক তিনটে গামছা দিয়ে মাথা
মুছতে শুরু করল আর সিদ্ধেশ পাকড়াশি একরকম দৌড়ে গিয়েই রাসুর ভূতের গলাটা চিপে
ধরলেন।
যে ভূতকে কেউ চোখেই দেখতে পায়
না, যার
বাতাসের মতন শরীর, তার
গলা যে সত্যিকারে চেপে ধরা যায় না তা তো বুঝতেই পারছ। আসলে রাসুকে চেপে ধরল
সিদ্ধেশ পাকড়াশির মন্ত্র। ‘ওং
হ্রিং ট্রিং করালবদনী রক্তদ্রংষ্ট্রা’ এইসব বলতে বলতে উত্তেজনার বশে
সিদ্ধেশ তান্ত্রিক পেছল-ভূতের একটু বেশি কাছে চলে গিয়েছিলেন। একবার আছাড় খেয়েই
বুঝতে পারলেন, কাজটা
ভুল হয়ে গেছে। তখন তিনি ঝোলার মধ্যে থেকে একটা নরকরোটি বার করে রাসুকে তার মধ্যে
ভরে ফেললেন। এবার নিশ্চিন্ত। ওই গোরাই নদীর পাড়ে দাঁড়িয়েই সিদ্ধেশ কিছুক্ষণ ভাবলেন, ভূতটাকে
নিয়ে কী করা যায়। তারপর তাঁর মাথায় কী প্ল্যান এল কে জানে, মুচকি হেসে
বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে মেদিনীপুরের বাস ধরলেন।
* * *
মেদিনীপুর শহরের বাইরের দিকে
সম্প্রতি একটা খুব বড়োলোকদের পাড়া তৈরি হয়েছে। ধরা যাক পাড়াটার নাম গ্রিন ফিল্ড।
সেখানে চওড়া রাস্তার দু-পাশে গাছের সারি। দুটো সুইমিং পুল, দুটো পার্ক।
আর এইসবের মাঝখানে ছবির মতন সুন্দর সব বাগানঘেরা একতলা দোতলা বাড়ি। প্রত্যেক বাড়ির
সামনেই দু-তিনটে দামি গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে। শহরের যত ডাক্তার, উকিল, বড়ো ব্যবসায়ী
— তাঁরা পুরনো শহরের ঘিঞ্জি এলাকার বাড়ি ছেড়ে এই গ্রিন ফিল্ডে বাড়ি বানিয়ে চলে
এসেছেন বা আসছেন।
এরকমই একটা বাড়ির একতলায় জনৈক
অর্থোপেডিস্ট, মানে
অস্থি-বিশেষজ্ঞ মানে হাড়ের ডাক্তারের চেম্বার। বোর্ড দেখলে বোঝা যায়
ডাক্তারবাবুর নাম বিশ্ববন্ধু জানা আর তাঁর অনেক ডিগ্রি।
সন্ধে সাড়ে সাতটা বাজে।
চেম্বারের মধ্যে ডক্টর জানা উদাস মুখে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছিলেন আর মাঝে মাঝে
দাঁতমুখ খিঁচিয়ে একটা ‘ফিমার’ মানে
মানুষের ঊরুর হাড় দিয়ে পিঠ চুলকোচ্ছিলেন। এই বৃষ্টি-থামা গুমোট
গরমে ডাক্তারবাবুর পিঠে খুব ঘামাচি হয়েছে। ডাক্তারবাবুর মেজাজটা একেবারেই ভালো
নেই। মাঝে মাঝেই তিনি আপনমনে ঘাড় নেড়ে বলছিলেন, “নাহ্, মস্ত ভুল
হয়ে গেছে। আর একটু ভাবা উচিত ছিল।”
সবটা শুনলে তোমাদেরও মনে হবে, সত্যিই
ডক্টর বিশ্ববন্ধু জানা মস্ত ভুল করে ফেলেছেন। হয়েছে কী, দু-বছর আগেও
ডাক্তারবাবুর চেম্বার ছিল মেদিনীপুরের চকবাজার অঞ্চলে। সেখানে শ্যাওলা-জমা ইটের রাস্তা। একটু বৃষ্টি হলেই রাস্তায় হাঁটু জল। লোকগুলো সব এতই গরিব
যে, গাড়ি
তো দূরের কথা, রিকশায়
অবধি চাপার পয়সা ছিল না তাদের। তাই তারা ভাঙা রাস্তা ধরে পায়ে হেঁটে যাতায়াত করত
আর পড়ে গিয়ে কখনও হাত, কখনও পা, আবার কখনও-বা কলার বোন ভাঙত। সেই সব হাড়-ভাঙা পেশেন্টদের নিয়ে রমরমা ব্যাবসা ছিল ডক্টর জানার। ফি ছিল মাত্র দুশো
টাকা, কিন্তু তাতেও মাসে কয়েক লক্ষ টাকা কামাতে তাঁর আটকাত
না।
দু-বছর আগে ডক্টর জানার যে কী
দুর্মতি হল কে জানে,
তিনি চকবাজারের চেম্বার আর বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে এই গ্রিন ফিল্ডে
বাড়ি বানিয়ে চলে এলেন। ফিজ করে দিলেন সাড়ে সাতশো টাকা। ভাবলেন এবার বোধ হয় আরও
উন্নতি হবে। কিন্তু ঘোড়াড্ডিম। গত দু-বছরে তাঁর কাছে হাড় জোড়া লাগাতে এসেছেন
সাকুল্যে বারো জন পেশেন্ট। তাও তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগই গ্রিন ফিল্ডের বাইরের লোক।
এখন হাড়ের ডাক্তার হাড়ে হাড়ে
বুঝতে পেরেছেন, তিনি
যতই হা-পিত্যেশ করে বসে থাকুন না কেন, এখানকার লোকের হাড়-টাড় ভাঙবে না। কেন ভাঙবে? কখন ভাঙবে? তারা কি
গাড়ি ছাড়া এক পাও হাঁটে?
তাদের বাথরুমে কি শ্যাওলা জমে? তাদের সিঁড়ির ধাপগুলো কি ছোটো বড়ো? প্রত্যেকটি প্রশ্নেরই
উত্তর হচ্ছে না, না
এবং না। তাহলে? হাড়
ভাঙবে কেমন করে? ডক্টর
জানা সিরিয়াসলি ভাবছিলেন,
এবার গ্রিন ফিল্ডের বাড়িটা বিক্রি করে দিয়ে আবার চকবাজারে ফিরে যাবেন।
ঠিক তখনই তাঁর চেম্বারের ভারী
পর্দাটা সরিয়ে একজন লোক বেশ কনফিডেন্টলি ভেতরে ঢুকে এল। লোকটাকে
দেখলে সাধু-টাধু গোছের মনে হয়। মুখভর্তি দাড়ি, লাল পাঞ্জাবি, কাঁধে একটা
শান্তিনিকেতনী ঝোলা। ডক্টর জানার উলটোদিকে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে লোকটা বলল, “ব্যোমকালী।”
‘বুজরুক,’ মনে মনে
বললেন ডক্টর জানা। মুখে বললেন, “কী হয়েছে?”
লোকটা উত্তর না দিয়ে ঝোলা
থেকে একটা নরকরোটি বার করে ডাক্তারবাবুর টেবিলে রাখল। ডাক্তারবাবু
খুলিটার দিকে এক পলক তাকিয়ে বিরস মুখে বললেন, “মাথার পেছনে একটা ফ্র্যাকচারের দাগ
আছে দেখছি। কিন্তু তার জন্যে এখন চিকিৎসা করাতে এলে নাকি? লাভ কী? এ তো বহুদিন
আগেই মরে গেছে।”
আগন্তুক লোকটা যে সিদ্ধেশ
পাকড়াশি সে তো তোমরা নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝতে পেরে গেছ। সিদ্ধেশ হাঃ হাঃ হাঃ করে
একটা তান্ত্রিকমার্কা অট্টহাস্য হেসে বললেন, “মরেনি ডাক্তারবাবু, কেউ মরে না।
জাগিয়ে তুলতে জানতে হয়।”
ডক্টর জানা বললেন, “না না। মরা
জাগানোর দরকার নেই। তুমি এখন এসো দেখি।”
সিদ্ধেশ পাকড়াশি হঠাৎ মুখটা
ডাক্তারবাবুর কানের কাছে নিয়ে গিয়ে রহস্যময় স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, “পেশেন্ট চাই, ডাক্তারবাবু? এই ধরুন
দিনে কুড়িটি পেশেন্ট?
চাই?”
ডক্টর জানা আঁতকে উঠলেন।
বললেন, “এই, এসব কী কথা? তুমি কি
লোকের মাথায় ডান্ডা মেরে তাদের এখানে পাঠাবে নাকি? একদম ওইসব ক্রিমিনাল অ্যাক্টিভিটির
মধ্যে আমাকে জড়াবে না। আমি বেশ আছি। তুমি এখন যাও।”
“আহা, ডাক্তারবাবু, ঘাবড়াচ্ছেন
কেন? কাকপক্ষীতেও
জানবে না। আমরা তো কিছু করছি না। যা করবার করবে এই পেছল-ভূত।” করোটিটার
ওপরে আঙুল দিয়ে তবলা বাজালেন সিদ্ধেশ তান্ত্রিক। তারপর মেরুদণ্ড সোজা করে বসে বেশ জোরালো
গলায় বললেন, “একবার
পরীক্ষা করে দেখতে আপত্তি আছে?”
পরীক্ষার ফল যা দাঁড়াল, সে এক কথায়
অবিশ্বাস্য। ওই রাতেই গ্রিন ফিল্ডের মোট তেরোজন বাসিন্দা পা পিছলে পড়ে হাড় ভাঙলেন।
কেউ বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিলেন। কেউ এ.টি.এম-এ টাকা তুলে কাউন্টার থেকে বেরোচ্ছিলেন। সবচেয়ে
বেশি লোকের পা ভাঙল পার্কে ইভনিং ওয়াক করতে গিয়ে। সাতজন বয়স্ক লোক পাশাপাশি
হাঁটছিলেন। তাঁরা একসঙ্গে চিৎপাত হয়ে পড়লেন।
রাত বারোটার সময় শেষ রুগিটির
পায়ে প্লাস্টার করে তাঁকে বাড়ি পাঠিয়ে, ডক্টর জানা টাকা গুনতে বসেছিলেন। এমন
সময় অ্যান্টি-চেম্বারের দরজাটা একটু ফাঁক করে সিদ্ধেশ তান্ত্রিক বললেন, “আমার
কমিশনটা এখনই দিয়ে দেবেন নাকি? রাসু বলছে টায়ার্ড লাগছে।”
“রাসু!”
“সে আপনার না জানলেও চলবে। বেশি জানলে
আবার বিপদের আশঙ্কা। এরা সব কাঁচাখেকো আত্মা কিনা।”
“কত দেব?”
“তিন হাজার এক টাকা আর একটা হরতুকি।
আমি সন্ন্যাসী মানুষ,
আমার জন্যে ওই হরতুকিটা। আর বাকিটা মায়ের পুজোর জন্যে। জয় মা করালবদনী!”
টাকা নিয়ে সিদ্ধেশ যখন বেরিয়ে
যাচ্ছেন তখন ডক্টর বিশ্ববন্ধু জানা ফিসফিস করে বললেন, “কাল বাদ
দিয়ে আবার পরশু এসো,
কেমন? রোজ
রোজ এসব কান্ড হলে লোকের চোখ টাটাবে। আমার বাড়িতে আসার দরকার নেই। ভোর ভোর পার্কে
চলে যেও, তাহলেই
হবে।”
সিদ্ধেশ ঘাড় নেড়ে চলে গেল।
* * *
মরার খুলির ভেতরে গুটিসুটি
মেরে বসে ছিল রাসু, মানে রাসুর ভূত। অসহ্য এক অবস্থার মধ্যে
পড়েছে সে। চারদিকে হাড়ের দেয়াল। বাইরে বেরোনো তো দূরের কথা, ভালো করে
নড়াচড়া করারও জায়গা নেই। খুলিটার দুটো চোখ আর নাকের জায়গায় ফুটো আছে ঠিকই, কিন্তু সেই
ফুটোর মধ্যে দিয়ে বেরোনো যাবে না। রাসু চেষ্টা করে দেখেছে, ফুটোগুলো
বড়োই ছোটো।
করোটির মাথার হাড়টা একটা কবজা
দিয়ে আটকানো। বাক্সের ঢাকনার মতন খোলা-বন্ধ করা যায়। তার
গায়ে ছিটকিনিও আছে,
তালা লাগানো। একমাত্র সেই তালা খুললে তবেই রাসু বাইরে বেরোতে পারে। কিন্তু
তালার চাবি সিদ্ধেশের গলার মালার সঙ্গে গাঁথা।
গতকাল রাতে বদমাইশ
তান্ত্রিকটা তাকে গ্রিন ফিল্ডের পার্কে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিয়েছিল। ছেড়ে দিলেও রাসু
পালাতে পারেনি। তার চারদিকে গণ্ডি কেটে দিয়েছিল সেই তান্ত্রিক। রাসু কেবল একদিকে
গাছের তলায় হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে ছিল আর পাশের রাস্তা দিয়ে যারাই যাচ্ছিল, তারাই পা
পিছলে পড়ছিল। পড়বেই। রাসু নিজেও এখন বুঝতে পারছে যে, সে এক ভয়ানক পেছল-ভূতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু তার মধ্যে দিয়ে মানুষের এই যে ক্ষতি হচ্ছে সেটা
রাসুর মোটেই ভালো লাগছে না। মৃত্যুর পরে রাসু ভালোমানুষ হয়ে গেছে।
করোটির চোখের ফুটোয় মুখ
লাগিয়ে রাসু বুঝবার চেষ্টা করছিল বাইরের হালচাল কেমন। এটা বুঝতে পারছিল, তার এখনকার
জেলখানা ওই করোটিটা রাখা আছে একটা পাথরের সিংহাসনের নিচে। সিংহাসনের ওপরে নিশ্চয়
ঠাকুরের মূর্তি রয়েছে। সামনে লাল সিমেন্টের মেঝের ওপরে পুজোর কাঁসর-ঘণ্টা, থালা-টালাও
রয়েছে। সকালে ঘণ্টার আওয়াজ আর মন্ত্রপাঠ শুনেছিল রাসু। সিদ্ধেশ তান্ত্রিক কালীপুজো
করছিল। সে এখন কোথায় কে জানে।
রাসু বুঝতে পারছিল, সময়টা দুপুর।
রাস্তায় বেশি লোকজন বা গাড়িঘোড়ার সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। হঠাৎ ঘরের মধ্যে একটা
বাচ্চা ছেলের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল, “দাদু! দাদু-উ-উ!”
রাসু জানে এই বাচ্চাটা কে। এ
হল রুনু, সিদ্ধেশ
তান্ত্রিকের নাতি। আট বছর বয়স আর মহা গুন্ডা। আগেরদিন রাতেও একে দেখেছে রাসু।
পুজোর ঘরে কাউকে দেখতে না পেয়ে
ঠান্ডা মেঝেটার ওপরে বসে পড়ল রুনু। বসে পড়ল বলেই ওকে সিংহাসনের নিচ থেকে দেখতে
পাচ্ছিল রাসু। রুনু পুজোর থালা থেকে অন্যমনস্কভাবে ডেঁয়ো পিপড়ে ছাড়িয়ে দুটো গুজিয়া
খেল। তারপর ধুনুচি থেকে ছাই ছড়িয়ে পরিষ্কার
মেঝের ওপরে একটা খরগোশ আঁকল। তারপর আর কী
বজ্জাতি করবে বুঝতে না পেরে যখন এদিক ওদিক তাকাচ্ছে, তখনই ওর চোখে পড়ল সিংহাসনের নিচে
লুকিয়ে রাখা নরকরোটিটার দিকে।
লুকিয়ে না রাখলে হয়তো রুনু
ওটার দিকে হাত বাড়াত না। জন্ম থেকে সে দাদুর কাছে বাঘের চামড়া, শকুনের ঠোঁট, মানুষের
হাড়গোড় এসব এত দেখেছে যে ওসবে তার আর ভয়ও নেই, ইন্টারেস্টও নেই।
এমনকি ভূতুড়ে কান্ডকারখানা দেখে দেখেও তার চোখ পচে গেছে। তবুও করোটিটাকে আজ দাদু
সিংহাসনের নিচে লুকিয়ে রেখেছে বলেই রুনু হাত বাড়িয়ে সেটাকে বার করে আনল।
করোটির চোখের মধ্যে দিয়ে
ভেতরে উঁকি মারল রুনু, কিন্তু কিছু দেখতে পেল না। তবে সে বুঝতে
পারল, ভেতরে একটা ভূত আছে। কুঁক-কাঁক
আওয়াজ পাচ্ছিল। কী একটা যেন এদিক থেকে ওদিকে নড়াচড়াও করছিল। ব্যাপারটা ভালো করে
বুঝবার জন্যে এরপর রুনু যা করল তাই দেখে রাসুর আর একটু হলে হার্ট অ্যাটাক হয়ে
যাচ্ছিল। হার্ট ছিল না তাই রক্ষে।
রুনু একটা ফল কাটার ছুরি নিয়ে
এসে মহা উৎসাহে করোটির ভেতরটা খোঁচাতে শুরু করল। নেহাত রাসু মানুষ থাকাকালীন
অসম্ভব ফিট ছিল, তাই
প্রত্যেকটা খোঁচা এদিকে বেঁকে, ওদিকে বেঁকে এড়াতে পারল।
কিছুক্ষণ খোঁচাখুঁচি করেও লাভ
হল না। তার ওপরে বাইরে খেলার সঙ্গীদের গলা পাওয়া যাচ্ছিল। রুনু সবে ভাবছিল, ছুরিটা ঠিক
জায়গায় রেখে আসবে, কিন্তু
তার আগেই মড়ার খুলির ভেতর থেকে কে যেন টুক করে ছুরিটা টেনে নিল। রুনু কিছুক্ষণ
ভেতরে আঙুল গলিয়ে ছুরিটাকে বার করে আনার চেষ্টা করল। কিন্তু
বার বারই কে যেন তার হাতের নাগাল থেকে ছুরিটাকে সরিয়ে নিচ্ছিল। শেষমেশ রুনু রেগে
গিয়ে বলল, “তুমি
অত্যন্ত পাজি ভূত, বুঝলে? মরো তুমি
অন্ধকারের মধ্যে।” এই বলে করোটিটাকে আবার ঠাকুরের সিংহাসনের নিচে ঠেলে দিয়ে দুড়দাড়িয়ে
বাড়ির বাইরে বেরিয়ে গেল।
পরদিন দুপুরে গ্রিন ফিল্ড
থেকে গাড়ি চালিয়ে ডক্টর জানা নিজেই চলে এলেন চকবাজারে সিদ্ধেশ তান্ত্রিকের বাড়ি।
গম্ভীর গলায় হাঁক পাড়লেন,
“সিদ্ধেশ কোথায়?”
সিদ্ধেশের স্ত্রী ডক্টর
জানাকে বললেন, “কী
যে হয়েছে বুঝতে পারছি না ডাক্তারবাবু। সকালে পুজো করতে গিয়েছিল। পুজোর ঘর থেকে
ফিরেই শুয়ে পড়ল। কিছুই বলছে না, খালি হায়
হায় করছে। দামি কিছু হারিয়ে গেছে মনে হচ্ছে।”
ডক্টর জানা সিদ্ধেশ
তান্ত্রিকের শোবার ঘরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিলেন। বিছানার পাশে বসে বললেন, “কী হল
পাকড়াশি? তোমার
সঙ্গে ছ-মাসের কনট্র্যাক্ট করলাম, আর তুমি দ্বিতীয় দিনেই এইভাবে ডুব মারলে? তোমার ওপরে
তো ডিপেন্ড করা যাবে না দেখছি।”
“আর ডিপেন্ড।”
সিদ্ধেশ তান্ত্রিক অতিকষ্টে
বিছানার ওপর উঠে বসলেন। তারপর তোষকের নিচে হাত গলিয়ে মড়ার খুলিটা বের করে এনে
ডাক্তারবাবুর চোখের সামনে ধরলেন। ডাক্তার জানা দেখলেন, খুলির
পেছনদিকে, যেখানে
সেদিন ফ্র্যাকচারের দাগটা দেখেছিলেন, সেখানে ময়ূরের পেখমের মতন একটা বড়োসড়ো
গর্ত। তিনি অবাক হয়ে বললেন,
“এটা কী?”
সিদ্ধেশ তান্ত্রিক হাহাকার
করে উঠে বলেন, “সিঁধ ডাক্তারবাবু, সিঁধ। রাসু
মরার পরেও তার চুরি বিদ্যে ভোলেনি। সারারাত ধরে করোটির গায়ে এই ছুরি দিয়ে সিঁধ
কেটে পালিয়েছে। হায় রে আমার পেছল-ভূত। হাউ হাউ হাউ হাউ হাউ।”
_____