ভার্সাইতে একদিন
অনসূয়া খাসনবীশ
পিএইচডির পড়াশুনা করতে আমি তখন প্যারিসে। যাদুর
নগরী প্যারিস। কিন্তু পকেটে রেস্ত ভালো না
থাকায়, তেমন ঘুরে দেখতে পারি না।
অনেক জায়গাতেই ভালো রকম এন্ট্রি ফি নেয়। তাও
বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে, পাস জোগাড় করে অপেরা
দেখেছি, পিকাসোর মিউজিয়াম ঘুরেছি।
হুডখোলা বাসে করে নোটরডাম গেছি। ভার্সাই
প্রাসাদে যাওয়ার খুব ইচ্ছে। হল
অফ মিররস দেখব, সেখানে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের
বিখ্যাত ভার্সাই চুক্তি সই হয়েছিল। সেই
আয়না লাগানো ঘরে রাজা রানিরা নাচ করতেন নাকি। তখনকার
বিখ্যাত আঁকিয়েরা ছাদের ছবিগুলো হাতে এঁকেছিলেন। উফ
ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয়।
সুযোগ এনে দিল আর্থার। আমার
সঙ্গে একই ডিপার্টমেন্টে কাজ করে। এখানকার
ছেলেমেয়েরা পড়াশুনার সঙ্গে সঙ্গে আর্টের কত কিছু বিষয়ে জানে। আর্থার
ডক্যুমেন্টারি বানায়। এবার নাকি ও ভার্সেই প্রাসাদে
একটা ডক্যুমেন্টারি বানাবে।
আমায় বলল, “মারি আতোঁয়ানেতকে
নিয়ে একটা ডক্যুমেন্টারি বানাব। ভার্সাই
প্রাসাদের পেতিত্রিয়ানো, যেখানে রানি থাকতেন, সেখানেই শ্যুটিং করব। মোট
ষোলোজনের টিমের অনুমতি মিলেছে। আমাদের
তো মোটে চোদ্দজন। তুমি চাইলে আসতে পার।”
আমি তো এককথায় রাজি। যদিও
মারি আঁতোয়ানেত সম্পর্কে কিছুই তেমন জানি না। বললাম,
“এই রানিই বলেছিলেন না, ‘ব্রেড খেতে না পারলে,
কেক খাক?’”
আর্থার হেসে বলল, “না না, ওটা সত্যি নয়। মারি
আঁতোয়ানেত চরিত্রটা খুব ট্র্যাজিক। আমার
তাই মনে হয়। অস্ট্রিয়ার প্রিন্সেস ছিলেন।
ষোড়শ লুইয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়ে এলেন ফ্রান্সে।
কতই বা আর বয়স তখন তাঁর। ছোটোবেলায়
সামান্য ডিসলেক্সিক সমস্যা ছিল, জানো অ্যানা।
দশ বছর অবধি ভালো করে লিখতে পারতেন না। কিন্তু
আর্টের দিক থেকে চমৎকার ছিলেন। খুব
ফ্যাশানেবল ছিলেন। নিজের নতুন রকমের ড্রেস নিজেই
ডিজাইন করেছেন। কাপড় সম্পর্কে দারুণ জ্ঞান
ছিল। ভালো কাপড়, ভালো গয়না, বিলাস-ব্যসনে মেতে থাকতেন।
বিয়ের আট বছর অবধি কোনও সন্তান ছিল না তাদের।
সে সময়, জানোই তো, বিপ্লব আসার মুখে, ফ্লাওয়ার ওয়ার চলছে।
দেশ জুড়ে রায়ট চলছে তখন, খেতে পাচ্ছে না গরিব প্রজারা, ব্রেডের দাম বেড়ে ধরা
ছোঁয়ার বাইরে। অন্যদিকে রাজা রানির কাজকর্মের
তীব্র সমালোচনা চলছে। এই সময়ে ভীষণ দামী একটা হিরের
হারের চক্রান্তে রানি জড়িয়ে পড়লেন। আসলে
তাকে ফাঁসানো হয়েছিল। এক দম্পতি মিলে এই কাজটা করেছিল।
জঁন ডু লা মট নামের ওই মহিলা রানির সই নকল করে, রানির পুরোনো অনুরাগীকে দিয়ে হারটা কিনিয়েছিল এবং হিরেগুলো বিভিন্ন বাজারে
বেচে দিয়েছিল। এই দামী হিরের হার কেনার কথা
স্যাঁকরা প্রকাশ করে দিয়েছিল প্রজাদের মধ্যে। প্রজারা
ভেবেছিল, যেখানে প্রজারা খেতে পাচ্ছে না, সেখানে রানি কোষাগারের টাকা দিয়ে হিরের গয়না কিনছেন! তারা রানির বিরুদ্ধে চলে গেল। দেশ
তখন উত্তাল। রাজা রানি বোঝাতেও চেয়েছিল, যে এসব কথা সত্যি নয়। কিন্তু
হিতে বিপরীত হল। প্রজারা রাজা রানির উপর থেকে
ভরসা হারাল। এর কিছু বছর পরই, ষোড়শ লুই এবং রানি মারি আঁতোয়ানেতকে কারাগারে বন্দি করা হয়।
ষোড়শ লুইয়ের ন’মাস পর গিলোটিনে রানিরও মাথা কেটে ফেলা হয়।
মাত্র একটা হারের জন্য রানি নিজের জায়গা হারিয়েছিলেন প্রজাদের
মন থেকে। কিন্তু,
ট্র্যাজেডিটা কী জানো অ্যানা, ষোড়শ লুই ওই হারটা
রানিকে উপহার দিতে চেয়েছিলেন যখন, রানি বলেছিলেন, এখন আমার হারের চেয়ে প্রজাদের সুরক্ষা বড়ো কথা।
ও হার আমার চাই না। কিন্তু
সময় তাঁর পক্ষে ছিল না।”
আমি হাঁ করে শুনছিলাম। জিজ্ঞেস
করলাম, “সেই মহিলা ধরা পড়েনি? শাস্তি
হল না কেন ওর?”
আর্থার বলল, “হ্যাঁ জঁন
ডু লা মট ধরাও পড়েছিল, তার শাস্তিও হয়েছিল।
কিন্তু সে মহিলা এতই ধূর্ত যে কারাগার থেকে পালিয়ে রানির বিরুদ্ধে
পত্রিকা লিখে প্রকাশ করত। সে সময়ে এসব খুব পড়ত মানুষ।
এখনকার ফেসবুক ইন্সটাগ্রামের মতো ব্যাপার আর কি।
জঁন সেই হিরের হারের জন্য ক্রমাগত রানিকে দায়ী করে গেছিল।
অদ্ভুত ব্যাপার জানো, জঁন কিন্তু আত্মহত্যা করেছিল, হোটেলের জানলা থেকে লাফ
দিয়ে। কারণটা কেউ জানে না।
যে কোনও জাঁকজমকপূর্ণ প্রাসাদের মধ্যেই থাকে কত ভয়াবহ রক্তাক্ত
ইতিহাস। সেটাই আমরা ডক্যুমেন্টারিতে
দেখাতে চাই।”
আমি অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। খারাপ
লাগছিল, রানির জন্য। বললাম, “খুব ভালো উদ্যোগ, আর্থার।”
আর্থার বলল, “মারি আঁতোয়ানেত
ইতিহাসে কুখ্যাতই। কিন্তু আমি তাকে অন্যভাবে দেখাতে
চাই।”
তারপর কফিতে একটা চুমুক দিয়ে বলল, “এই অ্যানা, আমার একজন দর্শক চাই।
আমার শ্যুটিংয়ের মধ্যেই যে ঘুরে বেড়িয়ে দেখবে ঘটনাগুলো।
অনেকটা, বর্তমান দেখছে
অতীতকে - এরকম। কিন্তু
অতীতের চরিত্ররা দেখতে পাবে না এই দর্শককে। আমার
এই রোলের অভিনেতাটি জবাব দিয়েছে। সে
অন্য কোনও কাজে ভালো রোল পেয়েছে। আমি
ভাবছিলাম কাকে নেওয়া যায়। কোনও ডায়লগ নেই।
প্র্যাকটিসও লাগবে না। করবে
তুমি রোলটা?”
“আমি? আমায় মানাবে?”
“হ্যাঁ, তোমার ভারতীয় স্কিন কালার আর কালো চুল,
বাকি চরিত্রদের থেকে আলাদা। তাই
একটা কনট্রাস্ট কাজ করবে। সহজেই তোমাকে বোঝা যাবে,
যে তুমি অতীতের কেউ নও। করবে?”
আমি রাজি হয়ে গেলাম। বেশ
সুযোগ এটা। সঙ্গে ভার্সাই প্রাসাদটা ঘুরেও
নিতে পারব। আর্থার আগামী রবিবার বেলা এগারোটার
মধ্যে ভার্সেই প্রাসাদে পৌঁছাতে বলল।
আমি সেদিন সময়ের একটু আগেই পৌঁছে গেলাম। তখনও
দশটাও বাজেনি। ট্রেনে বুঝে বুঝে আসতে সময়
লাগে বলে অনেক আগেই বেরিয়েছিলাম। এখানকার
স্টেশন একেবারে চক্রব্যূহ।
পৌঁছে দেখি ট্যুরিস্টদের ভিড়। লাইন
পড়েছে প্রাসাদের সামনে। মনে পড়ল, আর্থার বলেছিল মূল গেটের ডান দিকে চলে যেতে। সেখানে
কোনও ট্যুরিস্ট যায় না। স্পেশাল এন্ট্রিগুলো এখান থেকে
হয়। আর্থারের দেওয়া কার্ডটা দেখাতেই
ওরা একটা দরজা খুলে আমায় প্রাসাদের ভেতরে যেতে দিল। চেকিং
হওয়ার পর, আমি ওখানেই জিজ্ঞেস করে নিলাম যে পেতিত্রিয়ানো
কোন দিকে গেলে পাব। ওরা
বলে দিল। ষোড়শ লুই তার রানিকে এই ব্যক্তিগত
প্রাসাদটা উপহার দিয়েছিলেন। ওটা
বিকেলে খোলে ট্যুরিস্টদের জন্য। তাই
শ্যুটিং সকালেই হবে।
আমি এদিক ওদিক ঘুরে, হল অফ মিররস, নেপোলিয়ানের যুবক বয়সের ছবি, রাজাদের করোনেশনের ছবি-টবি দেখে প্রাসাদের একটা উঠান মতো জায়গায় এসে পড়লাম।
এখান থেকে কোন দিকে যেন যেতে হবে,
রাস্তাটা ঠিক করতে পারলাম না। আশেপাশে
কাউকে দেখতেও পেলাম না। জায়গাটায় কোন ট্যুরিস্ট নেই
তখনও। প্রাসাদের কর্মচারীদের কাউকেই
দেখা গেল না। আমি আন্দাজ মতো, একটা করিডোর ধরে এগোতে লাগলাম। শুনশান
প্রাসাদে আমার একার পায়ের আওয়াজ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। গা'টা কেমন ছমছম করে উঠল। করিডোরের
বাইরে আকাশে তখন রোদ মুছে গেছে। মেঘ
করে এসেছে। ভেতরে আলো জ্বলেনি তখনও।
ফলে,আবছায়া করিডোর।
বাইরে বিশাল বিশাল মূর্তিগুলোকে দেখে মাঝে মাঝে চমকে উঠছি।
আর্থারকে রিংয়ের পর রিং করছি। তুলছে
না। করিডোরটা শেষ হতেই দেখি একটা
ঘোরানো সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে।
আমি পিছন ফিরে একবার তাকিয়ে, নামতে থাকলাম নিচে। সিঁড়ি
দিয়ে নিচে নামতে নামতে, এক অদ্ভুত অজানা কারণে
বুকের ভেতরে ঢিপ ঢিপ করতে লাগল। মনে
হল, সিঁড়ির নিচে গেলেই কিছু দেখতে পাব।
সিঁড়িটা নিচে নেমে একটা বারান্দায় শেষ হয়েছে।
বারান্দাটার খানিক পরেই সেই বিখ্যাত বাগান।
তার উপরেই মুখ বাড়িয়ে আছে ধূসর মেঘ। দরজা
ঠেলে বেরোতে যাব বারান্দায়, শুনি পিছন থেকে চটাপট
পায়ের আওয়াজ। পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি দু’জন
মহিলা আর দু’জন লোক তাড়াতাড়ি ছুটে আসছে ভেতর থেকে, দরজার দিকে। মহিলাদের
গায়ে পুরোনো আমলের সাদা গাউন, মাথায় স্কার্ফ
বাঁধা। সেই ছবি দেখেছিলাম, রাজার সেপাইদের, লোকদুটোর গায়ে সেরকম টেইল কোট,
বুট। আমি
শান্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। এরা নিশ্চয়ই আর্থারের নাটকের
চরিত্র।
আমি হাত নেড়ে বললাম, “বঞ্জুর। আর্থার কোথায়?”
ওরা আমাকে যেন দেখতেই পেল না। দরজার
দু’পাশে লাইন করে দাঁড়িয়ে গেল।
আমি ভাবলাম, শ্যুটিং কি
শুরু হয়ে গেছে! আমিও ওদের পাশে দাঁড়িয়ে গেলাম।
দেখলাম, বারান্দার
সিঁড়ি দিয়ে একজন মহিলা উঠে আসছেন। মাথায়
বিশাল বড়ো পাফ। প্রায় তিন ফুটের মতো চুলটা
ফাঁপানো। অজস্র ফ্রিল দেওয়া পুরোনো দিনের
গাউন। মাথায় সুন্দর পাথর বসানো হারের
মতো, গলায় চোকার পরা, তাতেও সুন্দর চকচকে একটা বড়ো
নীলাভ পাথর। মহিলার চোখগুলো নীলচে, লাল টুকটুকে ঠোঁট। পাশে
পাশে একটি মেয়ে হাঁটছে তার মাথায় ছাতা ধরে। পিছনে
আরও দু’জন মেয়ে। তারা এসে বারান্দার এক জায়গায়
দাঁড়াল।
আমি একটু ঘাবড়ে গেলাম, একেবারে শ্যুটিংয়ের ফ্রেমের মধ্যে এসে পড়েছি তাহলে!
এসবে আমার কোনও অভিজ্ঞতা তেমন নেই। আর্থারের
কথায় দুম করে রাজি হয়ে গেলাম, আর আর্থারকেই এখন দেখতে পাচ্ছি না কোথাও।
আমার রোল তো দর্শকের ছিল। আমি
তাহলে এই লাইনে না দাঁড়ালেও চলবে! মনের মধ্যে
হাজারটা প্রশ্ন গিজগিজ করছে। আমি
এদিক ওদিক মাথা ঘুরিয়ে দেখতে চেষ্টা করলাম, আর্থার তার ক্যামেরা নিয়ে কোথায় বসে আছে।
দেখলাম ভেতর থেকে আরও দু’জন সেপাই গোছের জামা পরা লোক একটি মেয়েকে
জোর করে ধরে নিয়ে আসছে দরজার দিকে। মেয়েটা
হাঁচড়পাঁচড় করছে তাদের হাত থেকে বেরোবার জন্য।
চোখেমুখে তার বিরক্তি আর ভয়। বুঝতে
পারছিলাম না মেয়েটি কোন চরিত্রে অভিনয় করছে, কিন্তু সে অসাধারণ অভিনয় করছে তা সত্যি।
মেয়েটিকে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করানো হল আগের সেই সুন্দর জামা পরা, চুল ফাঁপানো মহিলার সামনে।
মেয়েটি হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল তার সামনে।
“রানিমা আমায় ক্ষমা করে দিন। আমি
জানি না কিছু।”
“তোমাকে কে পাঠিয়েছিল আমার নামে এসব রটানোর জন্য?”
“আমি কিছু জানি না রানিমা। আমায়
ক্ষমা করে দিন।”
“না, কখনোই না। কোথায়
সেই হিরের হার? কোথায়? যে হার আমি প্রজাদের কথা ভেবে রাজাকে কিনতে না করেছিলাম, সেই হারের জন্যই আমায় বদনাম কুড়োতে হচ্ছে! তার জন্য
দায়ী তুমি জঁন। প্রহরী একে চাবুক মারো।”
আমি হাঁ করে দেখছিলাম। এই
না হলে অভিনয়!
এই মহিলাই তাহলে রানি আঁতোয়ানেত সেজেছে!
মেয়েটিকে প্রহরী চাবুক মারতে শুরু করল। প্রতিটা
চাবুকের সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটা চিৎকার করে কুঁকড়ে যেতে লাগল। আমার
গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। উফ কী অভিনয়!
যেন সত্যি সত্যি চাবুক মারছে।
রাণী আঁতোয়ানেতের সহচরীরা তখন তার চুল ঠিক করে দিচ্ছে।
মেয়েটি অসহায়ভাবে চিৎকার করে কাঁদছে মাটিতে পড়ে।
কিছুক্ষণ পর দেখলাম, মেয়েটির পিঠ থেকে রক্ত গড়াচ্ছে, আর প্রহরীও অভিনয় করছে বলে মনে হল না।
মেয়েটি প্রচণ্ড কষ্টে ছটফট করতে করতে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে আমার
দিকে এগোতে শুরু করল। আমার পা ধরে হঠাৎ বলতে শুরু
করল, রানিমা আমায় ছেড়ে দিন।
ভুল হয়ে গেছে আমার।
আমি প্রচণ্ড অবাক হয়ে গেলাম। এ
কী! আমার পা ছুঁচ্ছে কেন? আমাকেই বা এসব বলছে কেন?
আমার রোল তো দর্শকের। চরিত্রদের
কাছে তো সেটা অদৃশ্য থাকার কথা। দু'একবার আর্থার আর্থার করে নিচু গলায় ডাকলামও। মেয়েটি
আমার পা ছুঁয়েছিল। এবার ধীরে ধীরে আমার পা ধরে
ফেলল। ঠাণ্ডা বরফের মতো হাত তার।
মেয়েটিকে প্রহরী তখনও চাবুক মারছে, কিন্তু মেয়েটার মুখে একটা ক্রূর
হাসি। ওর লম্বা ধারালো নখ আমার পায়ে
গেঁথে বসতে লাগল।
আমি ওর হাত থেকে আমার পা ছাড়ানোর চেষ্টা করতে গিয়ে পড়ে গেলাম আর
পিছিয়ে যেতে চেষ্টা করলাম। সে
হিসহিসে গলায় 'রানিমা' বলে ডাকতে ডাকতে সরীসৃপের মতো বুকে ঘষে আমার দিকে আরও এগিয়ে আসল।
এই অক্টোবর মাসেও আমার ঘাম ছুটে গেল। আমি
আর্থার আর্থার করে চিৎকার করে উঠলাম। দেখলাম, যে সব লোকজন করিডোরের মুখে দাঁড়িয়েছিল, তাদের কেউ নেই।
করিডোরটা অন্ধকার। চারিদিক
থেকে সেই অন্ধকার চাদরটা আমার চোখের উপর এসে পড়ল। আমি
কিচ্ছু দেখতে পেলাম না। হাঁসফাঁস করে উঠলাম।
দমবন্ধ হয়ে এল, যেন কেউ গলা টিপে ধরেছে তার লম্বা লম্বা নখওয়ালা
হাত দিয়ে।
আমি কাশতে কাশতে মাথা তুলে দেখতে পেলাম, দূর থেকে একটা আলো আসছে শূন্যে ভাসতে ভাসতে। নিশ্চয়ই
প্রাসাদের কোনও কর্মচারী। নয়তো আর্থার। আমি
চিৎকার করতে চেষ্টা করলাম, বাঁচাও বাঁচাও আর্থার।
আলোটা কাছে আসতে গলা থেকে অদৃশ্য হাতটা সরে গেল।
দেখলাম, একজন লম্বা
লোক, হাতে মোমবাতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
তার আর আমার মাঝে লোহার গরাদের মতো একটা দরজা।
সে দরজা খুলে আমায় হাত ধরে টেনে বার করে নিল।
মোমবাতির আলোয় স্পষ্ট দেখলাম, তার কালো কালো দাঁত, নোংরা মুখ।
সে হাসতে হাসতে বলল, রোবস্পীয়ারের সরকার, মানুষের সরকার এসে গেছে।
রাজা শেষ, এবার রানিও
শেষ হবে… বলে আমার হাত দুটোকে পিছনে দড়ি দিয়ে বেঁধে দিল, আর আমায়
অন্ধকার গুহাটা থেকে বের করে নিয়ে চলল টানতে টানতে। আমি
দেখলাম, সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছি না।
কোমরের হাড় যেন ভেঙে গেছে, এত যন্ত্রণা। হাঁটু
শিথিল হয়ে গেছে। পায়ে পায়ে জড়িয়ে পড়ছি।
আমার প্রচণ্ড কান্না পেতে লাগল। কিচ্ছু
বুঝতে পারছিলাম না। এত যন্ত্রণা হচ্ছিল সারা গায়ে!
আর্থারকেও দেখতে পাচ্ছিলাম না কোথাও। যত
এগোলাম দেখতে পেলাম আলো। লোকটাকে বার বার বলতে চাইলাম, এই রোলটা আমার নয়। কোথাও
ভুল হচ্ছে। আর্থারকে একবার ডেকে দাও।
আমার ফোনটা দাও। আমার
ব্যাগ কোথায়?
দেখলাম আমার পাশে পাশে আরেকজন অভিনেতা একটা কাঠের ক্রস হাতে হাঁটছে।
আমি তাকেও বলার চেষ্টা করলাম, আর্থারকে একটু ডেকে দাও একবার।
কিন্তু আমার গলা দিয়ে একটুও আওয়াজ বেরোল না।
একটা দরজা পেরিয়ে গিয়ে দেখলাম, হাজার হাজার লোক দাঁড়িয়ে আছে একটা খোলা জায়গায়, আর তাদের মাঝখানে একটা মঞ্চ, তাতে বিশাল বড়ো একটা ধাতব যন্ত্র - যার উপরে একখানা
বড়ো ব্লেডের মতো ধারালো ধাতুর পাত, নিচে কাঠের পাটাতন।
উপরেরটা টেনে নিচে নামালে পশু কী মানুষও কাটা পড়বে।
মানুষ, হ্যাঁ মানুষও।
গা শিউরে উঠল আমার, টের পেলাম যন্ত্রটা গিলোটিন।
আমাকে বাইরে এনে দাঁড় করাতেই, লোকটা হঠাৎ আমার চুলের দিকে আঙুল তুলে বলে উঠল, উইচ।
তারপর, চিৎকার করে ভিড়টাকে উদ্দেশ্য
করে বলল, উইচ। ভিড়টাও
চিৎকার করতে লাগল, উইচ উইচ উইচ উইচ।
কয়েকশো মানুষ আমার দিকে আঙুল তুলে আছে, তাদের চোখে রাগ, ঘৃণা। ভয়ে
আমার গলার স্বর, চোখের জল শুকিয়ে গেছে।
হাত পা কাজ করছে না।
টানতে টানতে আমায় ঐ যন্ত্রের কাছে নিয়ে যাওয়া হল।
তারপর একটা চওড়া পাটাতনের উপর শুইয়ে দেওয়া হল, আর আমার মাথাটা
জোর করে চেপে বসিয়ে দেওয়া হল গিলোটিনের নিচে দুটো কাঠের পাটাতনের মধ্যে।
ভিড়টা চিৎকার করে উঠল, ভিভ লা রিপুব্লিক।
পাশবিক যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠলাম। তারপর
আর কিচ্ছু মনে নেই আমার।
চোখ খুললাম জলের ছিটেয়। চোখ
খুলেই আমার মনে হল, অনেকক্ষণ দমবন্ধ অবস্থা
থেকে খোলা হাওয়ায় এসে পড়েছি। আমি
উঠে বসে টেনে টেনে শ্বাস নিতে লাগলাম। খানিক পরে
একটু সুস্থ হলে দেখলাম আর্থার, পাশে দু’জন
প্রাসাদের কর্মচারী, আর পিছনে কয়েকজন ছেলেমেয়ে হাঁ করে একে অপরের
ঘাড়ের উপর থেকে উঁকি মেরে আমাকে দেখছে।
আর্থার আমায় জল দিল খেতে। আমি
ঢক ঢক করে পুরো জল খেয়ে, বললাম, “আর্থার কেন আমায় অন্য রোলে দিয়েছিলে তুমি? উফ কী যন্ত্রণা!”
আর্থার অবাক হয়ে বলল, “অন্য রোলে মানে? শ্যুটিং শুরুই তো হয়নি।
আমি গার্ডের কাছ থেকে জানলাম তুমি অনেক আগে ঢুকে গেছ প্রাসাদে।
আমাদের আসতে দেরি হয়েছে। আমি
খুঁজছিলাম তোমায়। তোমার ফোনের কী হয়েছে?
আমি ফোনের পর ফোন করে যাচ্ছিলাম তোমাকে।”
তারপর অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “এ কী, তুমি চুলে সাদা রং করালে কেন অ্যানা? রোলটার
সঙ্গে মানাবে না তো।”
আমি বললাম, “সাদা রঙ? আমি
চুলে সাদা রঙ কেন করাব?”
এরপর বহু বছর কেটে গেছে। আমিও
দেশে ফিরে এসেছি। সেদিনের কথা আমার এখনও মনে
পড়ে।
সেদিন ভার্সাই প্রাসাদে আর্থারের ডক্যুমেন্টারিটা আর হয়নি।
আর কখনোই আর্থার ওটা বানাবে না ঠিক করেছিল।
ও একদিন আমার প্যারিসের অ্যাপার্টমেন্টে এসেছিল।
বলেছিল, “অ্যানা, তোমার চুল কী করে কিছু ঘণ্টার মধ্যে কালো থেকে সাদা হয়েছে জান? এটাকে আঁতোয়ানেত সিনড্রোম বলে। এটা
কোনও রোগ নয়। লোকে বলে মারি আঁতোয়ানেতের
চুলও এরকম রাতারাতি ধবধবে সাদা হয়ে গেছিল। শোন
অ্যানা, আমি ধরে নিতাম, তুমি কোনও
কারণে হ্যালুসিনেট করে অজ্ঞান হয়ে গেছিলে সেদিন। কিন্তু
তোমার চুলটা...”
আমি হেসে বলেছিলাম, “তুমি কী ভাবছ আর্থার?”
“জানি না, অ্যানা। কিছু
ঘটনার কোনও ব্যাখ্যা থাকে না। মারি
আঁতোয়ানেতকে দুই মার্কিনি মহিলাও দেখেছিল নাকি একবার। তবে
সেটা চোখের ভুল। কিন্তু তোমার মতো এভাবে পুরো
চুল সাদা হয়ে যাওয়াটা… আমি এক ফাদার-এর সঙ্গে
যোগাযোগ করেছি। উনি এক্সরসিজম করেন।
তুমি একবার চলো আমার সঙ্গে।”
আমি খুব হেসেছিলাম সেদিন। আর্থার
ভয় পাওয়া চোখে তাকিয়েছিল আমার দিকে।
ফাদারের কাছে যাইনি। বরং
টিকিট কেটে দেশে ফিরে এসেছিলাম। ফাদারের
কাছে গেলে, সবাই জেনে যেত, সেদিন আমার
চুলই শুধু সাদা হয়নি, স্কার্ফের তলায়, আমার
গলা ঘিরে গোল একটা কালচে লাল দাগও হয়ে গেছিল… জমাট রক্তের দাগ।
No comments:
Post a Comment