বারিধারা
রিয়া ব্যানার্জী
* * *
* * *
* * *
* * *
Rain Rain forever stay!
_____
ছবিঃ সম্বিতা
রিয়া ব্যানার্জী
রামধনুর নীল রঙে তুলিটা ডুবিয়ে আকাশ দাদার গায়ে মেঘ আঁকার চেষ্টা
করছিল নূপুর। তুলিটা পক্ষীরাজের কেশর দিয়ে তৈরি! ভারী নরম। তাই দিয়ে সে একবার করে মেঘ আঁকছে তারপর নাক কুঁচকে ঘাড় নেড়ে হাত দিয়ে মুছে দিচ্ছে। ও কী করবে, কিছুতেই মনের মতো হচ্ছে না যে।
কিন্তু ওকে যে আঁকতেই হবে।
আকাশ দাদার কোলে চেপে যেদিন থেকে এই পচা জায়গাটায় এসেছে সেদিন
থেকে সে আর মেঘ আঁকতে পারছে না। কিন্তু তার যে মেঘ আঁকতে সব থেকে ভালো
লাগে। অলক মেঘ, জলধ মেঘ, পুঞ্জ মেঘ, বর্ষা মেঘ কত ধরণের মেঘ হয়।
ওর তো এটাই কাজ। আকাশদাদার কোলে চড়ে এদিক সেদিক
যাওয়া আর বিভিন্ন রঙের বিভিন্ন রকমের মেঘ আঁকা। জীমূত দাদার সব থেকে প্রিয় ছাত্রী সে৷ তাই তো তাকে আকাশদাদার জন্য মেঘ বানানোর দায়িত্ব দিয়েছে। অবশ্য বৃষ্টি মা জীমূতদাকে বলেছিল, “নূপুর এত ছোটো, ও পারবে কেন? তাছাড়া ওর তো পড়াশুনো আছে, তারপর ঝুপঝুপি নাচ শিখতে হবে, মলহরী তান শিখতে হবে। ওর কী সময় আছে?”
জীমূতদা মিষ্টি করে হেসে মা’কে কী সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়েছিল, “দিদি, ওর যেটা ভালো লাগে সেটাই করতে দাও না! আর এই যে ও আকাশের সঙ্গে এত জায়গায় ঘুরবে, জানবে না?
শিখবে না?
তুমি ভেবো না একদম।”
জীমূতদাকে খুব সুন্দর দেখতে। সাদা ধবধবে গায়ের রঙ। মাথায় কী সুন্দর একটা স্ফটিকের মুকুট পরা। হাসলে আরও সুন্দর লাগে। সকালে যখন সূর্য্যিদাদুর ঘুম ভাঙে,
জীমূতদাই প্রথম তাকে সুপ্রভাত জানায়। নূপুরের ভারী ভালো লাগে জীমূত দাদাকে।
জীমূতদা আকাশদাদার বন্ধু। তবে সে এখানে থাকে না। অনেক উঁচুতে যেখানে ভগবান জ্যেঠু থাকে, সেই জায়গার কাছাকাছি থাকে। মাঝে
মাঝে আসে ওদের কাছে।
এবার এসেই নূপুরকে টপ করে কোলে তুলে ওর পেটে নাক ঘষে কিড়িকিড়ি করে কোঁকড়া চুলগুলো ঘেঁটে কিছুক্ষণ ব্যাতিব্যস্ত করে তারপর কাঁধে বসিয়ে বলল,
“আমার নুপ্পুসোনা তো দিব্যি বড়ো হয়ে গেছে!”
এতক্ষণ জীমূতদাদার কার্যকলাপে নূপুর হেসে-টেসে একেবারে নাজেহাল হয়ে গেছিল। এবার কাঁধে চড়ে দাদার গলা জড়িয়ে কিছুটা সুস্থির হয়ে বলল, “ওমা!
আমি বড়ো হব না নাকি! সারাজীবন ছোটোই থাকব!”
পাশে আকাশদাও ছিল। বোনের কথায় দুই বন্ধুতে হো হো করে হেসে উঠল। নূপুরের ভারী রাগ হয়েছিল ওদের ওপর, কেন অমন হাসবে। ও কী এমন ভুল বলেছে। তাই দেখে জীমূত দাদা কাঁধ থেকে নামিয়ে সামনের সুন্দর শতরঞ্চিতে বসিয়ে বলল, “ওমা!
বেটি আমার রাগ করেছে। গাল ফুলেছে। আইক্রিম খাবে!” বলে টুক করে ভেসে গিয়ে ওই সামনের বিশাল পাহাড়টার একদম মাথা থেকে একখন্ড নীলচে সাদা বরফ তুলে নিয়ে এল। এই জন্যই তো সে জীমূত দাদাকে সবথেকে বেশি ভালোবাসে,
অবশ্য আকাশদাদার পরে৷
নূপুর তো মহাখুশি।
জীমূতদাদা চলে যাওয়ার পর আকাশদাদার সঙ্গে প্রথমেই একটা ভারী সুন্দর জায়গায় গেছিল সে।
ওখানে গিয়েই আকশদাদা তার ঘন নীল রঙের শালটা গায়ে জড়িয়ে নিল, ভারী শীত যে৷
তবে যখন সূর্য্যিদাদু ওঠে, আকাশদাদা একটা কমলা রঙের নরম উড়নি পরে। কী সুন্দর যে দেখায় তখন।
সেখানে একটা পাহাড় ছিল, নাম কাঞ্চনজঙ্ঘা! নূপুরকে দাদা একদম ভোরে ওই পাহাড়ের ওপর বসিয়ে দিত।
পাখির কিচকিচির গান শুনতে শুনতে আর সূর্য্যিদাদুর নরম আদর গায়ে মাখতে মাখতে বুঁদ হয়ে বসে থাকত নূপুর।
সূর্য্যিদাদু তাকে বলেছে এই নরম রোদ গায়ে মাখলে তার গায়ের চামড়া নাকি আরও তকতকে ঝকঝকে হবে।
তারপর একটু বেলা বাড়লে আড়মোড়া ভেঙে হাতে তুলি তুলে নিত। রোজ এই এত্ত সাদা সাদা তুলোর মতো মেঘ এঁকেছিল ওইখানে।
তারপর যেখানে গেল ওরা,
সেখানে সারাক্ষণ আকাশদাদার গায়ে কালো বা ধূসর রঙের শাল। সেখানে তো নূপুরের হাত থামছিলই না, একের পর এক কালো কালো হাতীর মতো মেঘ এঁকে যাচ্ছিল। সেখানে তাদের সঙ্গে বৃষ্টি মাও এসেছিল। মায়ের হাত ধরে সেও নেচেছিল ঝুপঝুপ নাচ।
কী যে ভারী আনন্দ হয়েছিল তা বলে বোঝাতে পারবে না নূপুর।
আর তারপরেই এই পচা জায়গাটায় এসেছে ওরা! আসা ইস্তক আকাশ দাদা একটা ময়লাটে ধূলোভরা পোড়াগন্ধওলা চাদর জড়িয়ে বসে আছে৷ আর মাঝে মাঝেই খকখক করে কাশছে! নিচের দিকে তাকালে খালি ফাটাফুটি মাটি, দেখে দেখে চোখ পচে গেল।
নূপুরের ভারী মনখারাপ তাই।
সেই থেকে একটুও মেঘ আঁকতে পারছে না সে। ওর যে বৃষ্টি মাকেও দেখতে ইচ্ছে করে।
ধুর,
ভালো লাগে না!
“ধুর, ভালো লাগে না!” টুপুর হাতের ট্যাবটা সরিয়ে রেখে জানালা দিয়ে বাইরে দেখল। কেন যে বাবাই এই পচা জায়গাটাতে ওদের নিয়ে এল। কিচ্ছু নেই এখানে। অবশ্য দোষ তারই।
কিন্তু জায়গাটা যে এমন হবে যে জানত।
চারিদিকে শুধু মাটির মাঠ অথচ কেউ খেলেই না। আর খেলবে কী করে, বাইরে যা রোদ। মাম্মাম তো আসার পরে একদম বারণ করে দিয়েছে বাইরে বেরোতে। এটা একদম বাজে জায়গা।
সামার ভ্যাকেশনে স্কুলের সব বন্ধুরা বাইরে ঘুরতে গেছে। পিয়ালী আর ঋদ্ধি তো ইন্ডিয়ার বাইরে গেছে আর এ্যালিস, জিয়া,
সুরেন্দর ওরা কেউ কেউ ইন্ডিয়ার মধ্যেই ঘুরছে। করিনা ওর আংকেলের কাছে মুম্বাইতে গেছে। মা কাল রাতে ছবি দেখাচ্ছিল।
They are having lots of
fun there.
ব্যাজার মুখে আবার ট্যাবটা খুলে বসল টুপুর। গুগল খুলতেই সামনে সব সুন্দর সুন্দর ভিলেজের ছবি।
কী যেন ছিল কবিতার লাইনগুলো...
‘নমো নমো নমো,
সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি গঙ্গার তীর, স্নিগ্ধ-সমীর, জীবন জুড়ালে তুমি। অবারিত
মাঠ, গগনললাট চুমে তব পদধূলি - ছায়াসুনিবিড়
শান্তির নীড় ছোটো ছোটো গ্রামগুলি!’
স্কুলের রিসাইটেশন কম্পিটিশনের জন্য দাদাই শিখিয়ে দিয়েছিল কবিতাটা। আর গল্প শুনিয়েছিল নিজের গ্রামের। পুরো ছবির মতো ছায়াঘেরা কলাগাছ আর নারকেল গাছের বাগান ঘেরা গ্রাম ছিল তাদের। দাদাইরা নাকি ছোটোবেলায় বন্ধুরা মিলে পুকুরের ধারে ইয়াব্বড়ো বড়ো ঝুরিওলা গাছের ঝুরিতে দোল খেয়ে পুকুরে গিয়ে ঝাঁপাত। তারপর সাঁতার দিয়ে ডুব দিয়ে স্নান,
সে নাকি ভারী মজার ব্যাপার।
গ্রামে সবাই নাকি সকাল সকাল জাল ফেলে পুকুর থেকে মাছ ধরে। সেই জ্যান্ত মাছের খুব স্বাদ। ওখানে বিশাল বিশাল মাঠ আছে। বিকেলে ওখানে সবাই মাঠে ফুটবল খেলে, কুমীরডাঙা খেলে, কাবাডি খেলে, খোখো খেলে। গ্রামের পাঠশালাতে পড়াশুনোর প্রেশারও কম হয়। সন্ধেবেলা গ্রামের ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা গোল করে গল্প শুনতে বসে পাড়ার বুড়ো দাদু দিদার কাছে। তারপর পান্তাভাত আর আলুর চপ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ভারী শান্তির জায়গা গ্রাম।
টুপুর তো শুনেই লাফিয়ে উঠল। সেও ভিলেজ দেখবে। পুকুরে স্নান করবে, কুয়োর মিষ্টি জল খাবে। গাছ থেকে পেয়ারা পেড়ে খাবে। ভোরবেলা খেতের আল ধরে হাঁটবে। ওর ফ্ল্যাটের বন্ধু দীপনের গ্রামের বাড়ির কথা সে শুনেছে। প্রত্যেক দুর্গাপূজার পর ঘুরে এসে কত কী গল্প করে। আখের রস, তালের গুড়, মাটির উঠোন, ছোটো কুঁড়েঘর। তাছাড়া টুপুর তো দেখেছে ট্রেনে যেতে যেতে। ঠিক ওই কবিতাটার মতো দৃশ্য...
‘পল্লবঘন আম্রকানন রাখালের
খেলাগেহ,
স্তব্ধ অতল দিঘি কালোজল, নিশীথশীতল স্নেহ।
বুকভরা মধু, বঙ্গের বধূ জল লয়ে যায় ঘরে..’
না, সেও যাবে গ্রামে।
মাম্মামের কোমর ধরে যাকে বলে প্রায় ঝুলে পড়ল টুপুর।
“মাম্মাম, আমিও তোমাদের সঙ্গে এবার ভিলেজ দেখতে যাব।”
মাম্মাম আর বাবাই প্রত্যেক মাসে একবার করে বিভিন্ন গ্রামে যায় ক’দিনের জন্য ভিলেজার্সদের চিকিৎসা করতে আর ফ্রিতে মেডিসিন দিতে।
“না সোনা,
তোমার ওখানে খুব কষ্ট হবে। আরেকটু বড়ো হও, তারপর যাবে!”
“না, না, না, আমি এখনই যাব। এবারেই যাব। যাব যাব যাবই!”
টুপুর পা ছড়িয়ে মার্বেলের মেঝেতে বসে পড়ল।
“তোমার ওখানে খুব কষ্ট হবে টুপুর। তুমি পারবে না!” মাম্মাম বোঝানোর চেষ্টা করছিল টুপুরকে।
টুপুর নাছোরবান্দা!
সে যাবেই।
ভাগ্যিস বাবাই ছিল।
“বেশ তো,
এবারের ট্রিপে তোকে নিয়ে যাব!”
শোনামাত্র মাম্মাম ধমকে উঠল বাবাইকে, “তোমার কী মাথা খারাপ হয়েছে,
জানো না কোথায় যাচ্ছি এবার আমরা! ও ছোটো মানুষ।”
“কেন ওখানে আর ছোটো মানুষ নেই? নাকি সব ছোটোলোক বলে ওরা মানুষ না? ওকেও বুঝতে দাও মান্তু। জানতে দাও!”
বাবাই-এর কথাগুলো ঠিক বুঝতে পারেনি টুপুর, কিন্তু তারপর মাম্মাম আর কোনও কথা বলেনি।
শুধু গম্ভীর হয়ে বলেছিল, “মিনিমাম পাঁচ থেকে ছ’টা কুড়ি লিটারের বিসলারির বোতল তুলে নেবে!
জলের যা অবস্থা ওদিকে!”
“যা অবস্থা ইদিকে বাবু, নোকে তেষ্টায় ছাতি ফাটিয়ে মইরে যাচ্ছে।
জলই নাই তো ওষুধ গিলবে কী কইরে!”
টুপুর দরজার আড়াল থেকে ময়লা ধুতি আর শার্ট পরা লোকটার পাশে দাঁড়ানো মেয়েটাকে দেখছিল। এখানে আসা ইস্তক কাউকে টুপুর খেলার সঙ্গী হিসেবে পায়নি। সবাই কেমন যেন ধুঁকছে। প্রথম দিন মাম্মামকে বলে ওদের ড্রাইভার কাকুর সঙ্গে আশপাশটা ঘুরতে বেরিয়েছিল,
হাতে ছিল এক বোতল জল।
সেদিনও এই মেয়েটাকে দেখেছিল সে। একটা বালতি নিয়ে কিছু লোকের সঙ্গে মিশে একটা কুয়োর থেকে দূরে কিন্তু কুয়োর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিল। তখন কুয়োর সামনে বেশ ক’জন কাকিমা জল তুলছিল। তাকে দেখে একটা কাকিমা হেসে বলেছিল, “ও মা!
এ তো ডাক্তারবাবুর মেয়ে। কী গ্রাম দেখতে বেরিয়েছ বুঝি? আর কী দেখবে, সব তো পোড়া রোদ জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে।
তোমার হাতে ওটা কী, জল?”
টুপুর ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলাতে মুখ নিচু করে কী সব বিড়বিড় করতে করতে নিচু হয়ে জল তুলতে লাগল। টুপুরের কী মনে হওয়াতে একটু জোর গলাতে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার দিকে আঙুল তুলে জিজ্ঞেস করেছিল, “ওরা জল তুলছে না কেন?”
মুখটা বিকৃত করে ঐ কাকিমা উত্তরে বলল, “ওরা নীচু জাত! আমাদেরই জল জোটে না তায় ওদের জন্য! ও তুমি বুঝবে না!”
কিন্তু টুপুর তো মহেশ পড়েছে৷ সে নীচু জাত জানে উঁচু জাত জানে।
ব্রাহ্মণ জানে শুদ্র জানে।
সেইদিন ওর জলের বোতলটা ও ওই মেয়েটাকে দিয়ে দিয়েছিল।
“এই! তুমি আমার সঙ্গে খেলবে গো!”
দরজার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে ওই মেয়েটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল টুপুর। মেয়েটা তখন তাদের ঘরের জানালা দিয়ে উঁকি মেরে ভিতরে অন্য কিছু দেখছিল।
টুপুর দেখল
বাবাই তখন মেয়েটার সঙ্গে থাকা লোকটার পেট টিপে চেক করছে।
“এই!” চমকে উঠে মেয়েটা টুপুরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মিষ্টি করে একটা হাসি ছুঁড়ে দিয়ে বলল, “তোমাদের কাছে কত জল গো!”
মাম্মাম, বাবাই মিলে ওরা প্রায় নয়-দশজন এসেছে এই গ্রামে। একটা মাঠে টেন্ট খাটিয়ে থাকছে৷ আসার সময় মাম্মামের কথামতো প্রায় দশটা বড়ো বড়ো জলের বোতল আনা হয়েছে।
বাকিরাও এনেছে। এখানে নাকি বৃষ্টি হয় না, তাই খুব জলের কষ্ট।
জল তো নল খুললেই পাওয়া যায়, বৃষ্টি না হলে জল পাওয়া যাবে না কেন?
জলের আবার কষ্ট কী?
যদিও সেদিন মাম্মাম ড্রাইভার আংকেলের মুখে শুনে টুপুরকে খুব বকেছিল, কেন সে জলের বোতল দিয়ে দিয়েছে।
বাবাই ওকে বাঁচাতে কী যেন বলতে চাইলে মাম্মাম চুপ করিয়ে দিয়েছিল বাবাইকে, “দ্যাখ, তোর কথা শুনে আমি এই নির্জলা গ্রামে মেয়েকে নিয়ে এসেছি। এখন ওর জন্য আনা জল যদি ও এইভাবে বিলিয়ে দেয় তাহলে এদের লোভ বেড়ে যাবে। এদের জন্য সরকার যা করার করবে। আমরা এ্যাজ আ ডাক্তার যা করছি দ্যাটস এনাফ ফর দেম।
তুই একটা কথা এই নিয়ে আর বলবি না!”
মাম্মাম রেগে গেলেই বাবাইকে তুই করে বলে৷ ওরা নাকি ছোটোবেলার ওল্ড বাডিজ,
তাই।
অবশ্য রাতে বাবাই মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল সে ঠিক কাজ করেছে।
টুপুর একবার ঘাড় উঁচু করে মাম্মাইয়ের
অবস্থানটা দেখে নিয়ে এক গ্লাস বিসলারি ওয়াটার মেয়েটার হাতে ধরিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোমার নাম কী?”
মেয়েটা চোঁ চোঁ করে জলের শেষ বিন্দুটুকু
অবধি শেষ করে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, “টাপুর, তোমার?”
টুপুর নিজের নাম বলে টাপুরের হাত ধরে জিজ্ঞেস করল, “খেলবে?”
এদিক ওদিক তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, “রোজ এক গ্লাস করে জল খেতে দেবে? এখানে বৃষ্টি পড়ে না আজ ছত্রিশ মাস!”
“ও আকাশদাদা,
ছত্রিশ মাস তো হয়ে গেল!
আর ক’দিন এখানে থাকতে হবে!”
আজকাল আকাশদাদা তার ওপর খুব রেগে থাকে।
এমনকি বৃষ্টি মাও কথা বলছে না! কিন্তু সে কী করবে! সে
তো মেঘ আঁকতেই ভুলে গেছে। ইশ! যদি জীমূতদা এখন আসত, আরেকবার শিখে নিত তাহলে৷
আকাশদাদা একবার তার দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। অগত্যা নূপুর ব্যাজার মুখে নিচের দিকে দেখতে লাগল।
আজকাল ওর একজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে খুব ইচ্ছে করে। ওই যে ওই মেয়েটা যে রোজ বাবা-মা’কে
লুকিয়ে তার বন্ধুর জন্য এক বোতল করে জল আনে। আজ ওর সঙ্গে আলাপ করতেই হবে। তবে ওর ওই বন্ধুটা কেমন যেন, কই সে তো কিছু দেয় না? খালি নেয়।
“এই আমার বন্ধু হবে তুমি?”
নূপুর
টুক করে নিজের ডানা দুটো ভ্যানিশ করে টুপুরের সামনে এসে দাঁড়াল!
টাপুর তখন টুপুরের চুল বেঁধে দিচ্ছিল। দু’জনেই একসঙ্গে ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কে তুমি?”
“আমি নূপুর। তুমি তো টুপুর, আর তুমি টাপুর! এই টুপুর তুমি রোজ টাপুরকে জল খেতে দাও, কই ও তো তোমায় কিছু দেয় না!”
“এমা! ও তো আমার ফ্রেণ্ড। ফ্রেণ্ডশিপে আবার দেওয়া নেওয়া হয় নাকি!”
নূপুর কিছুক্ষণ ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করল। বুঝতে না পেরে বলল, “চল না, একটু খেলি!”
টাপুর উঠে দাঁড়িয়ে গম্ভীর হয়ে বলে, “না,
আমি এখন যাই! তোমরা খেল!” বলে কেউ কিছু বলার আগেই তাড়াহুড়ো করে চলে গেল।
টুপুর আর নূপুর তো বেজায় অবাক৷ খেলাটাও জমল না তেমন। নূপুরের ভারী রাগ হল টাপুরের ওপর। ভারী স্বার্থপর মেয়ে তো। টুপুরকে সাবধান করতে হবে। টাপুর ভালো বন্ধু নয়৷ এইসব ভাবতে ভাবতে কখন সন্ধে হয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি।
এই টেন্টগুলো আর কিছু বাড়ি ছাড়া সারা গ্রাম অন্ধকারে ডুবে গেছে। থমথমে অন্ধকার৷ এই রে! আকাশদাদা যে ভারী রাগ করবে৷
নূপুর সবে উড়তে যাবে, এমন সময় একটা চাপা গলার ডাক শুনতে পেল, “এই টুপুর, টুপুর!”
আরে, এ তো টাপুর! মেয়েটা নির্ঘাত আবার জল চাইতে এসেছে৷ ইশ!
এখনই বারণ করতে হবে টুপুরকে। নয়তো এই রাক্ষুসী মেয়েটা টুপুরের ভাগের সব জল খেয়ে নেবে৷
ওই তো টুপুর বেরিয়ে আসছে।
“কী রে টাপুর?
তেষ্টা পেয়েছে?
সে তো পাওয়ারই কথা, সারা
দিনে এক গ্লাস জল। তাও ভাই বোনের সঙ্গে ভাগ করে। দাঁড়া,
জল দিচ্ছি!”
“না টুপুর, আমি জল চাইতে আসিনি। টুপুর, তোমরা জলের বোতলগুলো লুকিয়ে রাখো, আজ আমাদের বাবা কাকু জ্যেঠুরা তোমাদের ওই জলের ক্যানগুলো চুরি করতে আসবে৷ জল না পেয়ে ওরা সব মরিয়া হয়ে উঠেছে!”
টুপুর চমকে উঠল টাপুরের কথায়, “কিন্তু চুরি করা তো মহাপাপ!”
“জলের নাম জীবন, জানো তো! জীবন না থাকলে পাপই বা কী পুণ্যিই বা কী!”
টাপুর আজ কত বড়ো বড়ো কথা বলছে।
এতক্ষণ নূপুর আড়াল থেকে সব শুনছিল। বেরিয়ে এসে কাঁদো
কাঁদো গলায় টাপুরের হাত ধরে বলল, “আমার জন্য আজ এই অবস্থা। একবার, একবার তোমরা আমায় সাহায্য কর। আমি ঠিক মেঘ আঁকতে পারব। ঘন কালো জলে ভরা মেঘ। সেই মেঘ থেকে ঝরবে অঝোরে জল। একটু সাহায্য কর!”
আজ সকাল থেকে সারা গ্রাম আনন্দে মত্ত। ভোরবেলা থেকে আকাশদাদা হাসছে, বৃষ্টি মা ঝমঝম করে মনের আনন্দে ঝুপঝুপিয়ে নেচেই চলছে।
আর টাপুর টুপুর নূপুর দু’হাত তুলে চিৎকার করে টুপুরের শেখানো ছড়া বলছে...
Rain
Rain Don’t go away!Rain Rain forever stay!
_____
ছবিঃ সম্বিতা
No comments:
Post a Comment