বন্ধু
[মূল গল্প: ‘দ্য বয় হু টকড উইথ অ্যানিম্যালস’ – রোয়াল্ড ডাল]
অনুবাদঃ রাজর্ষি গুপ্ত
* * *
* * *
_____
ছবিঃ লাবণি চ্যাটার্জি
[মূল গল্প: ‘দ্য বয় হু টকড উইথ অ্যানিম্যালস’ – রোয়াল্ড ডাল]
অনুবাদঃ রাজর্ষি গুপ্ত
খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। আমি ওয়েস্ট ইন্ডিজে কিছুদিন ছুটি
কাটাব ভেবেছিলাম। বন্ধুরা বলেছিল সে নাকি দারুণ জায়গা। সারাদিন হাত-পা ছেড়ে ঘুরে
বেড়ানো, রুপোলি সমুদ্রতটে রোদ পোহানো আর সমুদ্রের উষ্ণ সবুজ জলে যত ইচ্ছে সাঁতার
কাটা—এই করেই দিন কাটিয়ে দেওয়া যায়।
ঠিক করলাম জামাইকা যাব। ফ্লাইট ধরে লন্ডন থেকে সোজা
চলে গেলাম কিংস্টন। উত্তরের সমুদ্রতীর বরাবর এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল যেতে লাগল
পাক্কা দু-ঘণ্টা। এ দ্বীপটা পাহাড়ে ভর্তি, আর পাহাড়গুলো ভর্তি
জটপাকানো ঘন জঙ্গলে। লম্বাচওড়া চেহারার যে জামাইকান লোকটি আমার ট্যাক্সি চালাচ্ছিল, সে বলল ওইসব জঙ্গল নাকি আজও ভুডু-কালোজাদু-তন্ত্রমন্ত্র নিয়ে কারবার করা
লোকেদের আস্তানা। ভয়ংকর লোক তারা।
“ভুলেও এইসব পাহাড়ি জঙ্গলে পা দেবেন না!”
চোখ গুলিগুলি করে সে বলল, “ওসব জায়গায় যা
সমস্ত কাণ্ডকারখানা হয় না, সে দেখলে আপনার মাথার চুল সব পেকে
যাবে।”
“তাই বুঝি? কী হয়?”
“অত প্রশ্ন করবেন না। আর ওসব বলে কি দুটো
পয়সা বেশি পাব?”
ব্যস! এই বিষয়ে ওই শেষ কথাবার্তা।
মুক্তোর মতো ঝলমলে একটা বিচের উপর আমাদের হোটেল।
আমার কল্পনাও ছিল না যে তার চারপাশের প্রকৃতি এতটা সুন্দর হবে। কিন্তু হোটেলের
বিরাট দরজার পাল্লা ঠেলে ঢোকামাত্র কেমন যেন একটা অস্বস্তি শুরু হল। তার কোনও
কারণই ছিল না কিন্তু,
সব কিছু একদম ঠিকঠাক। কিন্তু অস্বস্তিকর অনুভূতিটা আঠার মতো আমার
সঙ্গে সেঁটে রইল, কিছুতেই সেটাকে ঝেড়ে ফেল গেল না। পুরো
জায়গাটার মধ্যে অত্যন্ত অমঙ্গলজনক কী যেন একটা রয়েছে। যতই সুন্দর করে সাজানো আর
তোফা আরামের বন্দোবস্ত থাক না কেন, একটা ঘোর বিপদ যেন আমাদের
চোখের আড়ালে এখানেই গুঁড়ি মেরে রয়েছে। বিষাক্ত গ্যাসের মতো তার গন্ধ হোটেলের বাতাস
ভারী করে রেখেছে। আর শুধু হোটেলই নয়, গোটা দ্বীপ জুড়ে এই
গন্ধটা রয়েছে। ওই দূরের উঁচু পাহাড় আর ঘন জঙ্গল, সমুদ্রের
ধারে পড়ে থাকা কালো মোষের মতো পাথরগুলো, টকটকে লাল ফুলের
ভারে নুয়ে পড়া গাছের সারি—এইসবই যেন চামড়ার তলায় আমার
রক্তমাংসকে কুঁকড়ে দিচ্ছিল। এই দ্বীপের মাটির নিচে অত্যন্ত অশুভ একটা কিছুর
অস্তিত্ব আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলাম।
আমার ঘরটার ছোট্ট বারান্দা দিয়ে সোজা বিচের বালির
উপর নেমে যাওয়া যায়। চারদিকে উঁচু উঁচু নারকেল গাছের সারি। থেকে থেকেই এক-একটা
ফুটবলের আকারের নারকেল যেন শূন্য থেকেই নেমে এসে ধপাধপ বালির উপর পড়ছে। গাছগুলোর তলায়
দাঁড়ানো আদপেই নিরাপদ নয়। ও-জিনিস একটি মাথার উপর নামলে তৎক্ষণাৎ খুলি ফেটে চৌচির
হয়ে যাবে। আমার ঘর পরিষ্কার করতে এসেছিল একটি জামাইকান মেয়ে। তার কাছ থেকে জানতে
পারলাম, মাস দুয়েক আগে মিঃ ওয়াসারম্যান নামে এক আমেরিকান
ভদ্রলোক নাকি ঠিক ওইভাবেই মারা গিয়েছেন।
আমি অবাক হয়ে বললাম, “ইয়ার্কি হচ্ছে?”
“ইয়ার্কি করব কেন সাহ্?” মেয়েটা বেজায় অবাক হয়ে বলল, “নিজের চোখে দেখেছি আমি।”
“শোরগোল হয়নি ব্যাপারটা নিয়ে?”
“চাপা পড়ে গিয়েছিল,” গম্ভীরমুখে
বলল মেয়েটা, “হোটেলওয়ালারা আর কাগজওয়ালারা মিলে চাপা দিয়ে
দিয়েছিল। ব্যাবসা খারাপ হয়ে যাবে যে জানাজানি হয়ে গেলে। কেউ আর আসতে চাইবে না তখন
এখানে।”
“তুমি নিজের চোখে দেখেছ?”
“নিজের চোখে দেখেছি। মিঃ ওয়াসারম্যান গিয়ে
ওই নারকেল গাছটার তলায় দাঁড়ালেন, তারপর ক্যামেরা বের করে
সূর্যের দিকে তাক করলেন। সূর্য ডুবছিল কিনা তখন। চারদিক লালে লাল হয়ে ছিল, ভারি সুন্দর দেখাচ্ছিল। ঠিক তক্ষুনি হঠাৎ আকাশ থেকে সোজা নেমে এল একটা
কাঁচা ডাব। ধড়াম! অ্যাক্কেবারে ঠিক টেকো ব্রহ্মতালুর মাঝখানে। ব্যস,” মেয়েটা একটু
থেমে বেশ রসিয়ে রসিয়ে যোগ করল, “মিঃ ওয়াসারম্যানের সূর্যাস্ত
দেখা জীবনের মতো শেষ।”
“মানে? তক্ষুনি
একেবারে সব শেষ?”
“তক্ষুনি কি না জানি না সাহ্। প্রথমে দেখলাম
ক্যামেরাটা হাত থেকে পড়ে গেল। তারপর হাত দুটো আস্তে আস্তে নেমে এসে পাশে মড়ার মতো
ঝুলতে লাগল। তারপর আরও আস্তে আস্তে উনি দুলতে আরম্ভ করলেন সামনে পেছনে। দুলেই
যাচ্ছেন, দুলেই যাচ্ছেন—আমি ভাবছি বুঝি
মাথায় চক্কর লেগে গেল নাকি কে জানে, হয়তো অজ্ঞানই হয়ে যাবে
লোকটা। এইসব ভাবতে ভাবতেই দেখি দড়াম করে মুখ থুবড়ে সামনে পড়ে গেলেন। সব শেষ।”
“মরে গেলেন?”
“মরে কাঠ একেবারে।”
“উফ্! ভয়ংকর!”
“তাই তো বলছি। যখন হাওয়া চলে তখন নারকেল গাছের
তলায় দাঁড়িয়ে থাকা মোটে ভালো নয়। বড়োসড়ো বিপদ হতে পারে।”
“ধন্যবাদ। বলে ভালো করলে। মনে রাখব।”
পরের দিন সন্ধের মুখে মুখে বারান্দায় বসে আছি। হাতে
গ্লাস, কোলে একটা বই খোলা—কিন্তু পড়ছিলাম না। বারান্দার
মেঝেতে একটা ছোটো সবুজ গিরগিটি তারই মতো আরেকটার পিছনে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে যাচ্ছিল,
তাদের দিকেই চোখ পড়ে ছিল আমার। প্রথম গিরগিটিটা নিঃশব্দে দ্বিতীয়টার
পিছনে এসে দাঁড়াল, তারপর সড়াৎ করে তার লম্বা জিভ বের অন্যটার
ল্যাজের ডগাটা চেটে দিল। চমকে উঠে ঘুরে সেটা প্রথমটার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
দুটোই মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে, পিঠ বেঁকে গিয়েছে, পলক পড়ছে না, হাত-পা-ল্যাজ একটুও নড়ছে না—চরম টান টান মুহূর্ত। তারপর কথা নেই, বার্তা নেই
হঠাৎ দুটিতে মিলে লাফিয়ে লাফিয়ে এক অদ্ভুত নাচ শুরু করল। সে কী নাচ! মুহুর্মুহু
বাতাস কেটে লাফিয়ে উঠছে। এই লাফাতে লাফাতে সামনে এগোয়, আবার
পিছনে সরে যায় লাফাতে লাফাতে। একবার লাফ মেরে ডানদিকে সরে তো পরক্ষণেই বাঁদিকে লাফ
মারে। যুযুধান বক্সারদের মতো একে অপরের দিকে মুখ করে চক্কর কেটেই যাচ্ছে, সঙ্গে অবিরাম চলেছে বীররসাত্মক লম্ফ-নৃত্য। অবশ্য
মনে হল ব্যাপারটা বীররসের মতো দেখতে হলেও আদতে শৃঙ্গাররসেরই বহিঃপ্রকাশ—বেজায় বিচিত্র বহিঃপ্রকাশ যদিও, মানতেই হবে। আমি
চুপটি করে বসে রইলাম। এরপর কী হয় দেখি।
কিন্তু সে আর আমার দেখা হল না, কারণ ঠিক তখনই
খেয়াল করলাম নিচের সমুদ্রতীরে কী যেন একটা গোলমাল পাকিয়ে উঠেছে। জলের ধারে কী একটা
ঘিরে যেন অনেক লোক জড়ো হয়েছে। তাকিয়ে দেখি একটা সরু লম্বা ক্যানো জাতীয় নৌকা,
যাতে চড়ে জেলেরা মাছ ধরতে যায় সমুদ্রে, আবির্ভূত
হয়েছে কাছাকাছি বালির উপর জলের কিনারায়। স্বাভাবিকভাবেই মনে হল নির্ঘাত যার নৌকা
সেই জেলে প্রচুর মাছ ধরে ফিরেছে আর সেই মাছের বোঝা দেখতেই লোকে ভিড় জমিয়েছে।
সমুদ্র-ফেরত জেলেদের মাছের বোঝা দেখতে আমার বরাবরই
দারুণ মজা লাগে, কাজেই বই মুড়ে রেখে উঠে দাঁড়ালাম। দেখি
হোটেলের অন্যান্য বারান্দা থেকেও লোকজন বেরিয়ে সমুদ্রের ধারের ভিড়টার দিকে চলেছে।
পুরুষদের পরনে হাঁটু পর্যন্ত বারমুডা আর যত ক্যাটক্যাটে রঙের চকরাবকরা নকশা করা
শার্ট। মহিলাদের রুচি পুরুষদের তুলনায় ভালো, তাঁদের পরনে
সুতির পোশাক। প্রায় প্রত্যেকেরই হাতে একটা করে গ্লাস। আমিও আমার গ্লাসটা
হাতে নিয়ে বারান্দা থেকে নামলাম। মিঃ ওয়াসারম্যানের নারকেল গাছটা এড়িয়ে একটু ঘুরে
সাদা বালির উপর দিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম ভিড়ের একপাশে।
ভুল করেছিলাম। ভিড়ের কেন্দ্রবিন্দু মাছের ডাঁই নয়, কাছিম। বালির উপর
চার পা তুলে উলটো হয়ে পড়ে আছে একটা সামুদ্রিক কাছিম। কিন্তু সে কী ভীমকায় কাছিম!
সাক্ষাৎ কূর্ম অবতার। কাছিম যে এত বড়ো হতে পারে, আমার কোনও
ধারণাই ছিল না। কতটা বড়ো তার আন্দাজ দিতে গেলে বলতে হয় তার পিঠের উপর একজন প্রমাণ
সাইজের মানুষ খাড়া হয়ে বসলেও তার পা মাটি ছোঁবে না। লম্বায় অন্তত পাঁচ ফুট আর
চওড়ায় চার ফুট তো কম করে হবেই। সবচেয়ে চোখ কাড়ে তার বিপুল উঁচু আর অপরূপ সুন্দর
খোলটা। জন্তুটা যাতে পালাতে না পারে তাই সেটাকে উলটে দেওয়া হয়েছে। খোল-সমেত শরীরের
মাঝবরাবর একটা মোটা দড়ি বাঁধা। দড়িটার একপ্রান্ত হাতে ধরে একটু দূরে গর্বিত ভঙ্গিতে
দাঁড়িয়ে রয়েছে একজন নেংটিসার কুচকুচে কালো চেহারার জেলে।
প্রকাণ্ড সুন্দর প্রাণীটা অসহায়ভাবে বালির উপর উলটে
পড়ে পাগলের মতো তার মোটা মোটা পাগুলো বাতাসে ছুড়ছে। খোলসের মধ্যে থেকে তার লম্বা
কোঁচকানো গলাটা টানটান হয়ে বেরিয়ে এসেছে। লক্ষ করলাম, তার পায়ের আঙুলে
লম্বা লম্বা ছুরির মতো ধারালো নখ রয়েছে। জেলেটি চেঁচিয়ে উঠছে মাঝেমাঝেই, “আরে সরে দাঁড়ান, সরে দাঁড়ান সব! এত ভিড় করবেন না। ওই
নখ একবার গায়ে লাগলে আর দেখতে হবে না, হাত শরীর থেকে ছিঁড়ে
বেরিয়ে যাবে! তফাত যান সব, তফাতে দাঁড়ান!”
এইরকম একটা দৃশ্য দেখে হোটেলে ওঠা টুরিস্টদের
উত্তেজনা আর পুলক আর ধরে না। খচাখচ ক্যামেরা বেরোচ্ছে আর ছবি উঠছে। মহিলাদের দল
উল্লাসে তাদের পুরুষসঙ্গীদের হাত ধরে প্রায় ঝুলে পড়ে ‘চিক্কুর’ পাড়ছে। পুরুষদেরও বাহাদুরি নিতে হবে বৈকি! তারা যে কেউ এই বিরাট
জন্তুটাকে ডরায় না সে কথাটা হেঁড়ে গলায় হাঁকডাক করে আর নানান আলটপকা মন্তব্য করে
জানান দিতে কসুর করছে না।
“কী রে অ্যাল, ওই
খোলাটা থেকে একটা চশমার ফ্রেম বানিয়ে নিবি নাকি? হি হি হি!”
“এহ্, এটার হেসে খেলে
এক টনের ওপর ওজন হবে, তাই না?”
“এ মালটা জলে ভাসে? সত্যি
বলছ?”
“ভাসে না কী বলছেন মশাই? কঠিন সাঁতারু! একটা আস্ত নৌকো টেনে নিয়ে চলে যাবে।”
“আচ্ছা, এগুলোকেই কি
স্ন্যাপার কচ্ছপ বলে?”
“না না, সেগুলো এত বড়ো
হয় না। কিন্তু তুই বেশি কাছে যাস না। স্ন্যাপার-চপার যাই হোক, খ্যাঁচ করে তোর
হাত কেটে নেবে।”
“সত্যি?” এক মহিলা
জেলেটিকে প্রশ্ন করলেন, “এরা মানুষের হাত কেটে নিতে পারে?”
“আজ্ঞে পারে বৈকি!” ঝকঝকে
সাদা দাঁতের পাটি বের করে জেলে বলল, “এই ইনিই পারেন, এক্ষুনিই পারেন। জলে থাকার সময় কাউকে কিচ্ছুটি বলবে না এরা। কিন্তু আপনি
এনাকে ধরবেন, জল থেকে দড়ি বেঁধে টেনে হিঁচড়ে আনবেন পাড়ে,
উলটে ফেলে গা জোয়ারি করবেন, তাতেও কিছু বলবেন
না ইনি? তখন খুব সাবধান! তখন মুখের কাছে এরা যা পায় তাই
কামড়ে একেবারে ফালাফালা করে দেয়।”
“আহা গো, ওর মতো
অবস্থায় পড়লে আমিও খিটখিটে হয়ে যেতাম,” মহিলা দীর্ঘশ্বাস
ফেলে বললেন।
বেশ বড়োসড়ো একটা ডাল, ফুট পাঁচেক লম্বা আর চওড়ায় প্রায়
এক ইঞ্চি হবে, জলে ভেসে এসে বালিতে পড়েছিল। একটা বোকাসোকা
দেখতে লোক সেটা কুড়িয়ে নিয়ে বীরদর্পে কচ্ছপটার কাছে গিয়ে সেটা দিয়ে তার মাথার কাছে
খোঁচাতে লাগল। জেলে বলে উঠল, “অমন করবেন না, ওতে আরও খেপে যাবে কিন্তু!”
ডালের প্রান্তটা কচ্ছপটার ঘাড় ছুঁতেই তার বিরাট
মুণ্ডুটা বোঁ করে সেটার দিকে ঘুরে গেল। তারপর পলক ফেলতে না ফেলতেই রাক্ষুসে একটা
হাঁ দেখা গেল আর মট করে একটা আওয়াজ হল। চিজের মতো ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল ওই লম্বাচওড়া
ডাল কচ্ছপটার দাঁতে। লোকজন হৈ হৈ করে উঠল।
“দেখলি, দেখলি?
খুব জোর হাতটা বেঁচে গিয়েছে।”
“ভাগ্যিস আমার হাতটা যায়নি বাবা!”
জেলেটি আবার চেঁচিয়ে উঠল, “ছেড়ে দিন না
ওকে! কেন ওকে আরও খ্যাপাচ্ছেন? ও খেপলে বিপদ হবে।”
একজন হোঁৎকা চেহারার লোক বেঁটে বেঁটে পায়ে গুট গুট
করে জেলের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, “ওহে শোনো, ওই খোলটা আমি নেব।
কিনব তোমার থেকে।” তারপর তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তার বেঢপ
মোটা বউকে বলল, “বুঝলে মিলড্রেড, এটা
বাড়ি নিয়ে গিয়ে একজন এক্সপার্ট লোককে দিয়ে ভালো করে পালিশ করিয়ে আমাদের লিভিং
রুমের ঠিক মাঝখানটায় সাজিয়ে রেখে দেব। দারুণ দেখাবে না?”
“অ-সা-ধা-রণ লাগবে। এক্ষুনি কিনে ফ্যালো না!”
মুটকি বউ আদুরে গলায় বলল।
“চিন্তা কোরো না, ওটা
এখন আমাদেরই হয়ে গিয়েছে,” লোকটা তার বউকে আশ্বস্ত করল। তারপর
জেলেকে বলল, “কী, খোলটা কত নেবে তাহলে?”
“ও তো সাহ্ বিক্কিরি হয়ে গিয়েছে খোল-টোল সবসুদ্ধু,”
জেলে উত্তর দিল।
“অ্যাঁ, সে আবার কী?”
হোঁৎকা বলল, “অত জলদি কীসের হে তোমার? আমি আরও বেশি পয়সা দেব। কত দামে ওটাকে বেচেছ, অ্যাঁ?”
“আজ্ঞে না, একবার বেচে
ফেলেছি তো,” জেলে ভদ্রলোকের এক কথা।
“কাকে বেচেছ?”
“ম্যানেজারকে।”
“কে ম্যানেজার?”
“আজ্ঞে হোটেলের।”
ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন চেঁচিয়ে উঠল, “ওই দ্যাখ! শুনলি
কী বলল? ম্যানেজারকে বিক্রি করেছে কাছিমটা। তার মানে বুঝতে
পারছিস? তার মানে টার্টল স্যুপ রে! আজ টার্টল স্যুপ হবে।”
“যা বলেছিস! আর টার্টল স্টেক। টার্টল স্টেক
খেয়েছিস কখনও বিল?”
“নাহ্, আজই প্রথম খাব।
আর তর সইছে না রে জ্যাক!”
“ঠিক করে জমিয়ে রাঁধতে পারলে, বুঝলি, টার্টল স্টেক বিফ স্টেককেও হার মানায়।
একেবারে তুলতুলে নরম, আর তেমনই তার সোয়াদ। আহ্!”
“এই যে, শোনো,”
হোঁৎকা লোকটা জেলেকে বলল, “এটার মাংস নিয়ে
আমার মাথাব্যথা নেই। ম্যানেজারকে বলো সে এটার মাংস-টাংস যা চায়, যত ইচ্ছে চায়, এমনকি পা-নখ-নাড়িভুঁড়ি সব সমেত নিয়ে
যেতে পারে। কিন্তু ওই খোলটা আমার চাই।”
তার বউ পাশ থেকে বলে উঠল, “তুমি খোলটা
পকেটে পুরেই ছাড়বে জানি সোনা। তোমাকে চিনি তো আমি।”
আমি চুপ করে একপাশে দাঁড়িয়ে এই মানুষগুলোর কথা
শুনছিলাম। এরা এমন একটা প্রাণীকে মেরে, কেটে, উদরস্থ করে ঢেঁকুর
তোলার চিন্তায় উল্লসিত হয়ে চেঁচিয়ে হল্লা জুড়েছে, যাকে এই চিত
হয়ে পা ছেতরে চরম অসহায় অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেও মনে চরম মর্যাদা আর সম্ভ্রম
উদ্রেক হচ্ছে। একটা কথা নিশ্চিতভাবেই বলা চলে, এখানে যতজন
প্রাণী এই মুহূর্তে উপস্থিত তাদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ এ-ই। অন্তত দেড়শো বছর ধরে এই
মহাকূর্ম ওয়েস্ট ইন্ডিজের সবুজ সমুদ্রে জলবিহার করছে। জর্জ ওয়াশিংটন যখন আমেরিকার
রাষ্ট্রপতি, তখনও এ ছিল। নেপোলিয়ন যখন ওয়াটার্লুর মাঠে
নাজেহাল হচ্ছিলেন, তখনও এ ছিল। হ্যাঁ, হয়তো
ছোটো ছিল, কিন্তু ছিল অবশ্যই।
আর এখন এই সমুদ্রের ধারে পা তুলে চিত হয়ে পড়ে আছে
সে, কখন
স্যুপ আর স্টেক হয়ে কয়েকটি অপোগণ্ড মনুষ্য সন্তানের ভোগে লাগবে সেই অপেক্ষায়।
চতুর্দিকের চিৎকার-চেঁচামেচিতে সে যে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে তা বোঝাই যাচ্ছিল। খোলের
ভিতর থেকে লম্বা ঘাড়টা টানটান হয়ে বেরিয়ে আসছিল, প্রকাণ্ড
মাথাটা এদিক ওদিক ছটফট করে ঘুরছিল। যেন কাউকে খুঁজছে সে, এমন
একটা কাউকে যে তাকে বুঝিয়ে বলতে পারবে তার প্রতি এই দুর্ব্যবহারের কারণটা ঠিক কী,
কেন তার এই চরম অপমান আর হেনস্থা।
হোঁৎকা লোকটা আবার জিজ্ঞাসা করল, “এটাকে হোটেল
অবধি নিয়ে যাবে কী করে তুমি?”
জেলে বলল, “দড়ি দিয়ে বেঁধে টানতে টানতে। হোটেল থেকে লোকজন আসছে আরও। দশ জন লোক একসঙ্গে হাত
লাগালে তবে উনি নড়বেন।”
এইবার ভিড়ের মধ্যে থেকে মুশকো লোমশ শরীরে কেবল
গরগরে লাল-সবুজ বারমুডা পরে থাকা একটা অল্পবয়সি ছেলে চেঁচিয়ে উঠল, “আরে, আমরাই তো এটাকে হোটেলে টেনে নিয়ে যেতে পারি! এটাকে নিয়ে যেতে খাটাখাটনি
হবে, সাপারের আগে খিদে বাড়বে বেশ। কী বলো সবাই?” তার সারা শরীর জুড়ে জেগে থাকা পেশিগুলোয় যেন ঢেউ খেলে গেল।
সবাই হৈ হৈ করে উঠল, “আরে দারুণ তো!” “ঠিক বলেছে!” “এর চেয়ে ভালো আর কিছু হয় না!”
পুরুষেরা সকলে তাদের হাতের গ্লাস নিজের নিজের
সঙ্গিনীদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে হুড়মুড়িয়ে চলল দড়ির দিকে। তারপর ঠিক দড়ি টানাটানি
খেলায় নামার মতো কাছিমটার পাশে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে পড়ল। সেই লোমশ মুশকো যুবক যেন
তাদের স্বঘোষিত ক্যাপটেন। সে সবার শেষে দাঁড়িয়ে খুঁটি হয়ে দড়িটা নিজের কোমরে
পেঁচিয়ে নিয়ে হাঁক পাড়ল,
“শোনো সবাই, আমি যেই ‘হেঁইও’
বলে ডাকব ঠিক তখনই সবাই মিলে একসঙ্গে টান দেবে, বুঝেছ?”
জেলের এই গোটা ব্যাপারটা পোষাচ্ছিল না, বোঝাই যাচ্ছিল।
সে বলল, “আপনারা কেন শুধুমুধু এসব করছেন? হোটেলের লোকদের ওপরই ছেড়ে দিন না।”
“ফালতু বকবক কোরো না তো!” ছোকরা এক দাবড়ানি দিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে হাঁক পাড়ল, “হেঁইও! মারো টান সবাই মিলে, হেঁই-ও!”
সবাই মিলে একসঙ্গে টান মারতেই কচ্ছপের বিরাট শরীরটা
প্রচণ্ড দুলে উঠে একদিকে প্রায় কাত হয়ে গেল। জেলে আতঙ্কিত গলায় চেঁচিয়ে উঠল, “কাত করবেন না,
কাত করবেন না! ওইরকম করে দোলালে ও কাত হয়ে সোজা হয়ে যাবে। আর একবার
পায়ের তলায় মাটি পেয়ে গেলে আর ওকে ধরে রাখার সাধ্যি হবে না কারোর!”
যুবক বলে উঠল, “চেপে বসো তো কাকা। পালাবে মানে? দড়ি বাঁধা আছে না? আমরা এতজন রয়েছি না?”
“ওরে, এ বুড়ো কচ্ছপ,”
জেলে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “একবার সুযোগ পেলে
তোদের সব্বাইকে টান মেরে ফেলে দিতে পারে। তোদের সকলকে একসঙ্গে টেনে নিয়ে সাগরে
নেমে যাবে, তোরা কেউ আঙুলটিও নাড়াতে পারবি না তখন।”
তার কথায় কর্ণপাত না করে ক্যাপটেন পূর্ণ উদ্যমে
তারস্বরে চেঁচিয়ে চলল,
“হেঁইও! হেঁইও জোয়ান, হেঁই-ও!”
আর এইবার কাছিমের অতিকায় শরীরটা সমুদ্রবেলা বেয়ে
আস্তে আস্তে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে হোটেলের দিকে যেতে থাকল। সেই হোটেলে, যার রান্নাঘরে
ছুরি-বঁটি-কাটারি শানিয়ে সাজিয়ে রাখা রয়েছে তার অভ্যর্থনার জন্য। তার পাশে পাশে
হুল্লোড় করতে করতে, উন্মত্ত আনন্দে চেঁচিয়ে উৎসাহ দিতে দিতে
চলল মহিলাদের দল আর সেইসব পুরুষেরা যারা বয়স, ভুঁড়ি কিংবা
স্বাস্থ্যের কারণে দড়ি টানার খেলায় যোগ দিতে পারেনি।
“হেঁই-ও! হেঁই-ও!” তুমুল
চিৎকার করেই যাচ্ছিল কোমরে দড়ি প্যাঁচানো সর্দার ছেলেটা, “সাবু
খেয়েছ নাকি সব? জোরে টানো সবাই! পিঠের জোরে, হেঁইও! হবেই হবে, হেঁইও! আরো জোরে, হেঁইও!”
ঠিক তখনই হঠাৎ আমার কানে এল একটা চিৎকার। আমার একার
নয়, প্রত্যেকেরই
কানে গেল। এমন তীক্ষ্ণ, জোরালো আর উদ্বেগে ভরা চিৎকার যে সব
হৈ-হট্টগোল ভেদ করে আকাশ বাতাস রনরনিয়ে উঠল সেই আওয়াজে, “না-আ-আ-আ-আ!
না, না, না, না!”
সমস্ত হট্টগোল মুহূর্তে থেমে গিয়ে ভিড়টা স্থাণু হয়ে
দাঁড়িয়ে পড়ল। দড়ি টানতে থাকা লোকগুলোর পা জমে গেল বালিতে, দর্শকদের অবস্থাও
তথৈবচ। সব ক’টা মাথা একযোগে ঘুরে গেল যেদিক থেকে চিৎকারটা আসছে
সেইদিকে।
খানিক ছুটে, খানিক হেঁটে হোটেলের দিক ভিড়ের দিকে এগিয়ে
আসছে তিনজনের একটা ছোট্ট দল—এক ভদ্রলোক, এক মহিলা আর একটি আট-ন’ বছরের বাচ্চা ছেলে। বাচ্চা
ছেলেটি ভদ্রলোককে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে আসছে, তাই তার
সঙ্গে তাল রাখবার জন্যেই কিছুটা অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাকিদের খানিকটা দৌড়োতেই হচ্ছে।
ভদ্রলোকই বাচ্চাটির কবজি ধরে আছেন যদিও, কিন্তু হাজার চেষ্টা
করেও তার গতি রোধ করতে পারছেন না। বাচ্চাটি সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করছে হাত ছাড়িয়ে
কোনোরকমে ছুট মারার। তার মুখ থেকেই বেরোচ্ছে চিৎকার।
“ওকে ছেড়ে দাও! ছেড়ে দাও এক্ষুনি! প্লিজ,
ওকে মেরো না!”
ভদ্রমহিলা নিশ্চয় বাচ্চাটির মা হবেন। তিনি তার অন্য
হাতটা ধরার প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছেন কিন্তু পারছেন না, ছেলেটি এত
লাফঝাঁপ করছে। সে আবার চিৎকার করে উঠল, “ছেড়ে দাও ওকে!
প্লি-ই-জ! এটা খারাপ কাজ! তোমরা খারাপ কাজ করছ!”
মা বাচ্চাটার হাত কিছুতেই ধরতে পারছিলেন না। তিনি
ধমকে বলে উঠলেন, “ডেভিড, বাচ্চামি করিস না! লোকে কী বলবে?”
ছেলেটি এবার ভদ্রলোকের দিকে ফিরে কাকুতি মিনতি করতে
লাগল, “ড্যাডি, ওদের ওকে ছেড়ে দিতে বলো না বাপি! প্লিজ
ড্যাডি, বলো না ওদের।”
ভদ্রলোক বললেন, “না ডেভিড, সেটা হয়
না। আমাদের ব্যাপার নয় এটা, এতে আমরা নাক গলাতে পারি না।”
এদিকে দড়ি টানার লোকেরা সবাই ন যযৌ ন তস্থৌ, অবাক দৃষ্টিতে
তারা তাকিয়ে আছে বাচ্চা ছেলেটির দিকে। তাদের হাতে কচ্ছপের দড়িটা ধরা আছে যদিও,
কিন্তু তাদের মুখচোখ দেখে বোঝাই যাচ্ছে যে তারা একটু থতোমতো খেয়ে
গিয়েছে। তাদের হাবভাব কেমন গোরু চোরের মতো—যেন একটা কোনও
কুকর্ম করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ে গিয়েছে।
ছেলেটিকে টেনে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করতে করতে
ভদ্রলোক বললেন, “ডেভিড, কথা শোন বাবা। যে যা করছে করতে দে। চল,
হোটেলে ফিরে চল।”
“না-আ-আ,” ছেলেটির
চিৎকার আরও চড়া এবার, “আমি যাব না-আ-আ! হোটেলে যাব না আমি!
আগে ওরা ওকে ছেড়ে দিক।”
“ডেভিড, বাড়াবাড়ি
হচ্ছে কিন্তু এবার!” ডেভিডের মায়ের গলায় এবার কড়া সুর।
এদিক থেকে ক্যাপটেন ছোকরা বলে উঠল, “বাচ্চু, মানে মানে ঘরে চলে যাও।”
বাচ্চাটি এইবার তাদের দিকে ফিরে গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে
উঠল, “তোমরা নিষ্ঠুর! তোমরা খুব খারাপ! তোমরা সব্বাই খারাপ লোক! ভয়ংকর খারাপ
লোক!”
বিচ জুড়ে প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশ জন প্রাপ্তবয়স্ক
লোকের মুখের উপর ওইটুকু পুঁচকে বাচ্চা বোমার মতো কথাগুলো ছুড়ে মারল। কিন্তু একটি
মানুষের, এমনকি তাদের সর্দার ওই মুশকো জোয়ানেরও মুখে একটি কথাও জোগাল না। কারোর
সাহস হল না বাচ্চা ছেলেটার সম্মুখে দাঁড়িয়ে উত্তর দেওয়ার।
ডেভিড আবার চেঁচিয়ে বলল, “ও তোমাদের কী
করেছে? ওকে ছেড়ে দাও না! যাও, ওকে আবার
সমুদ্রে ছেড়ে দিয়ে এসো।”
ডেভিডের বাবা ছেলের ব্যবহারে যথেষ্ট বিব্রত হয়ে
পড়েছিলেন বটে, কিন্তু লজ্জিত নয়। এবারে বিশেষ কাউকে নয়, পুরো
জমায়েতকে উদ্দেশ্য করেই তিনি বললেন, “ও আসলে পশুপাখি বলতে
পাগল। পৃথিবীতে যতরকমের জন্তুজানোয়ার হয় সব আমাদের বাড়িতে ঢুকিয়েছে। তাদের সঙ্গে
আবার কথাও বলে ও।”
“সত্যিই ওদেরকে ও খুব ভালোবাসে,” ভদ্রমহিলা সায় দিলেন।
জনতার মধ্যে এবার একটা উশখুশে ভাব দেখা গেল।
লোকেদের মেজাজে যে একটা পরিবর্তন এসেছে সেটা বোঝাই যাচ্ছে। অনেকের মধ্যেই কেমন
একটা অস্বস্তির ভাব,
হয়তো কিছুটা লজ্জারও। ডেভিড এতক্ষণে বাবার সঙ্গে ধ্বস্তাধ্বস্তি করা
থামিয়েছে। বাবা এখনও তার হাত ধরে থাকলেও আর জোর খাটানোর চেষ্টা করছেন না। ডেভিডের
চোখ দুটো তারার মতো জ্বলছে। সমুদ্রের হু হু হাওয়ায় উড়ছে তার চুল। বিরাট ভিড়ের
সামনে পুঁচকে শরীরটা মাথা সোজা করে দাঁড়িয়ে আছে রাজার মতো। আবার সে চেঁচিয়ে বলল,
“কই, ছেড়ে দিলে না তো ওকে? ছেড়ে দাও! দড়িটা খুলে দাও ওর!”
বাবা বললেন, “ডেভিড, এখানে
আমাদের কিচ্ছু করার নেই বাবা। কথা শোন, চল হোটেলে ফিরে যাই।”
“না!” বলে একটা
তীক্ষ্ণ চিৎকার দিয়ে উঠেই ডেভিড এক রাম-ঝাঁকুনিতে বাবার হাত
ছাড়িয়ে নিল। তারপর বিদ্যুৎবেগে বালির উপর দিয়ে ছুট লাগাল উলটে পড়ে থাকা কচ্ছপটার
দিকে।
“ডেভিড!” ভয় পেয়ে
চেঁচিয়ে উঠলেন ভদ্রলোক, “থাম! ফিরে আয় বলছি!”
চেঁচাতে চেঁচাতে ভদ্রলোক দৌড়োলেন ছেলের পিছনে।
ডেভিড ততক্ষণে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ে এর ওর পায়ের ফাঁক দিয়ে সাপের মতো এঁকে বেঁকে
প্রায় কচ্ছপটার কাছে পৌঁছে গিয়েছে, কারোর তাকে বাধা দেওয়ার সাধ্য নেই।
একেবারে শেষ মুহূর্তে সেই জেলে তার পথ আটকানোর একটা
চেষ্টা করল। “ওর কাছে যেও না খোকা!” বলে চেঁচিয়ে সে লাফ মারল তিরের
মতো দৌড়োতে থাকা ডেভিডকে ধরার জন্য। কিন্তু পাকা ফুটবল খেলোয়াড়ের মতো ডেভিড তাকে
পাশ কাটিয়ে গেল, তার দৌড় থামল না। জেলে পিছনে চেঁচাতেই থাকল
আতঙ্কে, “তোমাকে ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ফেলবে! থামো, ও খোকা, থামো থামো!”
আর থামো! ততক্ষণে ডেভিড কাছিমটার একেবারে মাথার
কাছে চলে গিয়েছে। তাকে নজর করা মাত্রই কাছিমের উলটে ঝুলতে থাকা বিরাট মাথাটা
বিদ্যুতের মতো তার দিকে ঘুরে গেল।
“ডে-ভি-ই-ড!” ডেভিডের
মায়ের আতঙ্ক-চিৎকারে সমুদ্রপাড়ের সন্ধ্যার আকাশ ফালা ফালা হয়ে গেল যেন।
পরমুহূর্তেই বালির উপর হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে দু-হাত দিয়ে ডেভিড
তার বুকে জড়িয়ে ধরল বয়সের সহস্র ভাঁজে কুঁচকে যাওয়া কাছিমের লম্বা গলাটা। তার গাল
ঘষা খাচ্ছে কাছিমের মাথায়, ঠোঁট নড়ছে—যদিও
অস্ফুট স্বরে কী যে বলছে সে তা শুনতে পাচ্ছে না কেউই।
আর সেই মহাকূর্ম? তার চার পায়ের পাগলামি বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
সব ছটফটানি, সব উত্তেজনা থেমে গিয়ে সে স্থির হয়ে পড়ে রয়েছে
বালির উপর, ডেভিডের হাতের বাঁধনের মধ্যে।
গোটা জমায়েতের ভিতর থেকে একযোগে একটা হাঁফ ছাড়ার
নিঃশ্বাস পড়ল। এ কোন অদ্ভুত নাটকের অভিনয় হচ্ছে চোখের সামনে তা কারোরই বোধগম্য
হচ্ছে না। অনেকে থতোমতো খেয়ে দু-এক পা পিছিয়ে গেল। কেবল ডেভিডের বাবা-মা এগিয়ে এসে
তাঁদের বাচ্চার থেকে ফুট দশেক দূরে দাঁড়ালেন। ছেলেটা বিরাট বাদামি রঙের মাথাটায়
পরম মমতায় আদর করেই চলেছে। আদর করতে করতেই সে কাতর গলায় বলে উঠল, “ড্যাডি, প্লিজ কিছু একটা করো ড্যাডি। ওদেরকে বলো না ওকে ছেড়ে দিতে, বলো না!”
“আমি কিছু সাহায্য করতে পারি কি?”
একজন গোলাপি রঙের মুখ আর বাঁকা নাকওয়ালা দীর্ঘদেহী
সাদা স্যুট পরা ইংরেজ ভদ্রলোক হোটেল থেকে বেরিয়ে এগিয়ে এসেছেন। এঁকে সবাই চেনে।
ইনি হোটেলের ম্যানেজার মিঃ এডওয়ার্ডস। দৃশ্যটা দেখে তাঁর চোখ কপালে উঠে গেল। অবাক গলায় বললেন, “তাজ্জব ব্যাপার!
ওর কপাল ভালো যে ওর মুণ্ডু মাটিতে গড়াগড়ি যাচ্ছে না! এই ছেলে, তুমি উঠে এসো ওখান থেকে। ওটা ভয়ানক জানোয়ার, তোমায়
চিবিয়ে খেয়ে নেবে।”
“ওকে ছেড়ে দাও আগে। ওদের বলো আগে ওকে ছেড়ে
দিতে,” ডেভিডের এক রা।
“কী আপদ! এক্ষুনি যে ওর প্রাণ নিয়ে টানাটানি
পড়ে যাবে, দেখতে পাচ্ছেন না?” ম্যানেজার
উদ্ব্যস্ত হয়ে বাবাকে বললেন।
“ও যা করছে করতে দিন,” বাবা উত্তর দিলেন।
“যত্ত সব! যান যান, খুব
সাবধানে কাছে গিয়ে তাড়াতাড়ি ওকে তুলে আনুন।”
“না।”
“না মানে?” ম্যানেজার
যেন জীবনে এমন অসম্ভব কথা আর শোনেননি, “এগুলো এক মুহূর্তে
জীবন নিয়ে নিতে পারে, জানেন?”
“জানি।”
“জানেন? তবে জেনেশুনেও
হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছেন কেন মশাই? গিয়ে ওকে তুলে আনুন। নইলে
একটা অনর্থ ঘটে যাবে যে!”
“এই কাছিমটা,” বাবা জিজ্ঞাসা
করলেন, “এটা কার?”
“আমার। মানে হোটেলের,” ম্যানেজার বললেন,
“আমরা কিনেছি।”
“একটা কথা রাখবেন?” বাবা
বললেন, “কাছিমটা আমাকে বিক্রি করে দিন।”
ম্যানেজার কিচ্ছুটি না বলে গোল গোল চোখে ভদ্রলোকের
দিকে চেয়ে রইলেন।
ভদ্রলোক শান্ত গলায় বললেন, “আপনি চেনেন না
আমার ছেলেকে। এই কাছিমকে যদি এখন হোটেলের রান্নাঘরে নিয়ে গিয়ে মেরে কেটেকুটে রাঁধা
হয়, অনর্থ বাধবে তখন। ও পাগল হয়ে যাবে। ফিট হয়ে
যাওয়াও বিচিত্র নয়।”
আবার ম্যানেজারের মুখ দিয়ে বেরোল, “ওকে সরিয়ে নিন
তাড়াতাড়ি।”
“ও জন্তুজানোয়ারদের ভালোবাসে,” মরিয়া হয়ে বাবা বললেন, “সত্যিকারের ভালোবাসে। ও কথা
বলে ওদের সঙ্গে। বুঝতে পারছেন?”
দুই ভদ্রলোক, একটা বাচ্চা একটা মহাকায় কাছিমকে ঘিরে এত বড়ো
জনতা সম্মোহিতের মতো দাঁড়িয়ে আছে। কারোর আঙুলও নড়ছে না। সবাই চুপ করে শোনার চেষ্টা
করছে দু’জনের কথাবার্তা।
“ওটাকে যদি ছেড়েও দিই,” ম্যানেজার বললেন, “জেলেরা আবার ওটাকে ধরে ফেলবে।”
“সে ধরে ফেলতে পারে, আবার
নাও পারে। এগুলো প্রচণ্ড জোরে সাঁতার কাটে,” বাবা বললেন।
“সেকথা আমি জানি,” খিঁচিয়ে
উঠলেন ম্যানেজার, “কিন্তু তবুও ওরা একে ধরবে। এটা একটা দামি
জিনিস। বুঝতে
পারছেন আমি কী বলছি?
কেবল ওই খোলটারই কত টাকা দাম হবে কোনও আন্দাজ আছে আপনার?”
“দাম নিয়ে আমি মাথা ঘামাচ্ছি না,” বাবা বললেন, “আপনাকেও ঘামাতে হবে না। বলেছি যখন তখন
কাছিমটা আমি কিনব।”
বাচ্চা ছেলেটা বালির উপর বসে একমনে কাছিমটার মাথায়
হাত বুলিয়ে যাচ্ছে তখনও। ম্যানেজার একবার সেদিকে চেয়ে পকেট থেকে একটা সাদা রুমাল
বের করে হাতের আঙুলগুলো ভালো করে মুছতে লাগলেন। কাছিমটা হাতছাড়া করতে মন চাইছে না
তাঁর। হয়তো এতক্ষণে হোটেলের রাতের মেনুও ঠিক হয়ে গিয়েছে। উলটোদিকে এটাও ঠিক যে
তাঁর হোটেলে একই বছরে আরেকটা খুনোখুনি তিনি চান না। মিঃ ওয়াসারম্যানের নারকেল
এমনিতেই তাঁর হাড়ে যথেষ্ট দুব্বো গজিয়ে দিয়েছে।
ডেভিডের বাবা আবার বললেন, “মিঃ এডওয়ার্ডস,
আপনি কাছিমটা আমাকে বিক্রি করলে ব্যক্তিগতভাবে বড়ো উপকৃত হব। ক্ষতিপূরণ
নিয়ে কিচ্ছু চিন্তা করবেন না, আপনার যা লোকসান হবে তা আমি
পুষিয়ে দেব ঠিকঠাকই।”
ম্যানেজারের ভুরু দুটো এক ইঞ্চির ভগ্নাংশ উঠেই আবার
নেমে পড়ল। কথাগুলোর অর্থ জলের মতো পরিষ্কার, ভদ্রলোক ঘুষ দিতে চাইছেন তাঁকে। এবার
ব্যাপার আলাদা। কয়েক সেকেন্ড ধরে তিনি হাত মুছেই চললেন পরিষ্কার রুমালে। তারপর
কাঁধ উঁচিয়ে বললেন, “ঠিক আছে, তাতে যদি
আপনাদের ছেলে শান্ত হয় তবে না হয়…”
“ধন্যবাদ,” ডেভিডের বাবা
বললেন।
“ওহ্, অনেক অনেক
ধন্যবাদ!” ডেভিডের মা প্রায় কেঁদেই ফেললেন, “কী বলে যে আপনাকে…”
“উইলি!” ম্যানেজার
হাতছানি দিয়ে জেলেকে ডাকলেন।
উইলি এল। সে ব্যাপার-স্যাপার দেখে হতভম্ব হয়ে গিয়েছে।
বলল, “অ্যাদ্দিন যা যা ভয়ংকর হিংস্র প্রাণী ধরেছি, এই কাছিমটার কাছে সে সব কিস্যু নয়। বীরের মতো লড়াই দিয়েছিল বটে। বাগে আনতে আমাদের ছ-জনের জান নিকলে
গিয়েছিল। কিন্তু এমন ঘটনা এর আগে জীবনে কোনোদিন দেখিনি। এ ছেলেটা… পাগলা আছে!”
“সে সব ঠিক আছে,” ম্যানেজার
বললেন, “এবার ওটাকে ছেড়ে দে।”
“ছেড়ে দেব?” উইলি চমকে
আঁতকে উঠল, “কী বলছেন মিঃ এডওয়ার্ডস? এই
পেল্লায় কাছিম... এই দ্বীপে এমন পেল্লায় কাছিম কোনোদিন ধরা
পড়েনি। এত
বড়ো কাছিম কোথাও কোনোদিন কেউ ধরেনি! একে ছেড়ে দেবেন না মিঃ এডওয়ার্ডস। আর আমাদের
টাকা? তার কী হবে?”
“টাকা যেমনকার তেমন পেয়ে যাবি।”
“আমায় ওদেরকেও পয়সা দিতে হবে তো,” একশো গজ দূরে জলের ধারে আরেকটা নৌকার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পাঁচটা অর্ধনগ্ন
কালো অবয়বের দিকে হাত দেখিয়ে উইলি বলল, “সবার সমান ভাগ। টাকা
না পেলে ওটাকে ছাড়ব না।”
“আমি তো বলছি টাকা পেয়ে যাবি। আমার কথায়
বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি?” ম্যানেজার বললেন একটু কড়া সুরেই।
“আমি কথা দিচ্ছি তোমরা তোমাদের টাকা ঠিক
পেয়ে যাবে,” ডেভিডের বাবা এবারে এগিয়ে এসেছেন, “আর যদি কাছিমটাকে এক্ষুনি এই মুহূর্তে ছেড়ে দাও তবে বকশিসও পাবে—ছ-জনের সমান সমান বকশিস।”
উইলি একবার ভদ্রলোকের দিকে তাকাল, একবার
ম্যানেজারের দিকে তাকাল, তারপর মিনমিন করে বলে উঠল, “ঠিক আছে, আপনাদের যখন তাই ইচ্ছে…”
ভদ্রলোক বললেন, “কিন্তু একটা কথা আছে। টাকা পাওয়ার আগে
তোমাদের কথা দিতে হবে যে ও ছাড়া পাওয়ামাত্রই ওকে তোমরা আবার ধরার চেষ্টা করবে না।
অন্তত আজ রাত্রে নয়। বুঝেছ?”
“ঠিক আছে, তাই হবে,”
বলে উইলি দুর্বোধ্য ভাষায় কী যেন চেঁচাতে চেঁচাতে তার সঙ্গীদের দিকে
দৌড়োল।
তাদের নিয়ে দু-মিনিট পর যখন ফিরে এল, দেখা গেল তাদের পাঁচজনের হাতে রয়েছে কাঠের লম্বা, মোটা
ডান্ডা।
ডেভিড তখনও কাছিমের মাথার পাশে হাঁটু গেড়ে বসেই আছে, কোনোদিকে তার
হুঁশ নেই। তার বাবা তার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে নরম গলায় বললেন, “ডেভিড,
সব ঠিক হয়ে গিয়েছে রে। ওরা ছেড়ে দেবে ওকে।”
ডেভিড মুখ ঘোরালো তাঁর দিকে, কিন্তু কাছিমের
গলা থেকে হাত সরাল না বা উঠেও দাঁড়াল না। জিজ্ঞাসা করল, “কখন?”
“এই তো, এক্ষুনিই। তুই
বরং উঠে আয়।”
“সত্যি বলছ?”
“সত্যি বলছি।”
ডেভিড এইবার কাছিমের গলা থেকে হাত খুলে নিয়ে উঠে
পিছনে সরে এল। উইলি হাঁক পাড়ল, “সবাই পিছনে সরে যান!”
ত্রস্ত পায়ে কয়েক গজ সরে গিয়ে ভিড় জায়গা করে দিল।
দড়ি টানার দল বালির উপর দড়ি নামিয়ে রেখে বাকিদের সঙ্গে সরে গিয়ে দাঁড়াল।
উইলি খুব সন্তর্পণে হামাগুড়ি দিয়ে কচ্ছপের একপাশে
গিয়ে বসল। তারপর সাবধানে নিজেকে বিপুল চারটে পায়ের নাগালের বাইরে রেখে খুব সতর্কভাবে
দড়ির গিঁটটা খুলতে লাগল। খোলা হয়ে গেলে আবার একইভাবে হামাগুড়ি দিয়ে সরে এল। তখন
বাকি পাঁচজন জেলে ওই সাত ফুট লম্বা আর তেমনই মোটা লাঠি হাতে সামনে এগিয়ে গেল।
কাছিমের পিঠের নিচে লাঠিগুলো গুঁজে দিয়ে খুব ধীর লয়ে তারা প্রাণীটাকে দোল দিতে
আরম্ভ করল। কাছিমের বিরাট উঁচু গম্বুজের মতো খোলের জন্য এপাশ ওপাশ দোল দেওয়ায়
সুবিধেই হল তাদের। দোল দিতে দিতে জেলেরা সুরেলা গলায় তালে তালে বলতে থাকল, “হেঁইও—হো! হেঁইও—হো! হেঁইও—হো!”
বুড়ো কাছিমটা যেন খেপে উঠল। আর সে বেচারারই বা কী
দোষ? লম্বা
নখ সমেত পাগুলো খ্যাপার মতো আকাশে ছুড়তে ছুড়তে সে ছটফট করে মুণ্ডুটা একবার খোলের
ভিতরে আর একবার বাইরে করতে লাগল। জেলেরা লাঠিতে চাড় দিতে দিতে সুর টেনে টেনে ছন্দে
তালে চেঁচিয়ে যেতে লাগল —
“হেঁইও—হো—জোরে ঠ্যাল! হেঁইও—হো—আরেকবার!
হেঁইও—হো—উলটে দে! হেঁইও—হো—উলটেছে—ব্যস!”
কাছিমের জগদ্দল শরীরটা কাত হয়ে পর্বতের মতো আকাশের
দিকে উঠে গিয়ে পরমুহূর্তেই প্রচণ্ড শব্দ করে মাটিতে নেমে এল, ভূমিকম্পের মতো
বালি ছিটিয়ে পড়ল চতুর্দিকে।
কাছিম চার পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছে। পায়ের তলায় মাটি
খুঁজে পেয়েই কিন্তু সে নড়ল না। বিশাল বাদামি মাথাটা খোলের ভিতর থেকে বের করে এনে
খুব সাবধানী চোখ মেলে চারদিক দেখতে লাগল।
“যাও কাছিম, সমুদ্রে
চলে যাও!” রিনরিনে গলায় ডেভিড চেঁচিয়ে উঠল।
ভারী চোখের পাতার তলা থেকে কুতকুতে দুই চোখ তুলে
বাচ্চা ছেলেটাকে নিরীক্ষণ করল অতিবৃদ্ধ কাছিম। তার মিশকালো চোখজোড়ায় ঝকঝক করছে
আনন্দ আর দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতায় অর্জিত জ্ঞান।
ডেভিডও অপলক চেয়ে রইল কাছিমের দিকে। তারপর যখন সে
মুখ খুলল তখন তার স্বর নরম,
গভীর, নিপাট আন্তরিকতার মায়া মাখানো। “গুড বাই কাছিমদাদু,” বলল সে, “এবার
অনেক দূরে চলে যেও।”
কালো চোখজোড়া আরও কয়েক মুহূর্ত ডেভিডের উপর নিবদ্ধ
রইল। আশেপাশের সবাই নিস্তব্ধ। তারপর রাজকীয় ভঙ্গিতে মাথা ঘুরিয়ে সেই মহাকূর্ম ধীরে
ধীরে সমুদ্রের দিকে চলতে আরম্ভ করল। যেন কোনও তাড়া নেই তার। গজেন্দ্রগমনে সে বালির
উপর দিয়ে হাঁটতে থাকল,
চলার তালে তালে এপাশ ওপাশ দুলতে থাকল তার কুঁজের মতো উঁচু খোলের
চূড়াটা। হোটেলের সামনে জড়ো হওয়া ভিড় নিশ্চুপে দেখতে লাগল সেই দৃশ্য।
কাছিম সমুদ্রে নামল। খানিকটা এগিয়ে গিয়েই মাটি শেষ, এবার সে সাঁতার
শুরু করল। সে যে এখন স্বক্ষেত্রে ফিরে গিয়েছে তা তার সাঁতারের সহজ সরল অনায়াস ভঙ্গি
দেখেই বোঝা যায়। মাথা উঁচিয়ে তিরবেগে সাঁতার কাটছে সে, শান্ত
সমুদ্রের নিস্তরঙ্গ জলে উঁচিয়ে থাকা মাথাটার দু-পাশ দিয়ে
উছলে উঠছে সফেন ঢেউয়ের সারি—জাহাজের যাত্রাপথে যেমন তৈরি হয়।
অনেকক্ষণ আমরা চুপ করে তার দিকে অপলক তাকিয়ে রইলাম। তারপর একসময়, ততক্ষণে সে দিগন্তরেখার পথে অর্ধেক রাস্তা পাড়ি দিয়ে ফেলেছে, আমাদের চোখ কাছিমপ্রবরকে হারিয়ে ফেলল।
অতিথিরা সবাই এবার আস্তে আস্তে হোটেলমুখো হল। সবাই
কেমন চুপচাপ, কেমন যেন দমে গিয়েছে। কোনও হাসিঠাট্টা, কোনোরকম হৈ-হল্লার
লেশমাত্র তাদের মধ্যে নেই। কী যেন একটা হয়ে গিয়েছে তাদের মনের মধ্যে। কেমন যেন
অদ্ভুত একটা হাওয়া আজ সমুদ্রতীরে উড়ে এসে তাদের ধাক্কা মেরে গিয়েছে।
ঘরের বারান্দায় ফিরে গিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে
বসলাম। একটা প্রবল অস্বস্তি হচ্ছিল আমার। কেন জানি না মনে হচ্ছিল ঘটনা এখানেই শেষ
হল না।
পরের দিন সকালে সেই জামাইকান মেয়েটি আমার ঘরে ফলের
রস পৌঁছে দিতে এল। গ্লাসটা টেবিলে রেখে জানালার পর্দা সরাতে সরাতে বলল, “মা গো মা,
হোটেল জুড়ে কী হুলুস্থুলু কান্ডই না চলছে সক্কাল থেকে! সবকিছু
একেবারে ওলঢোল করে ফেললে সব্বাই!”
“কেন, কী আবার হল?”
আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
“ওই যে বারো নম্বরের বাচ্চাটা, হাওয়া হয়ে গিয়েছে। কাল রাত থেকে উধাও।”
“বারো নম্বরের… ওই
কাছিমকুমার?”
“হ্যাঁ, সেই ছেলেটাই।
তার বাপ-মা একেবারে আকাশ ভেঙে ফেলছে। ম্যানেজারবাবুর তো পাগল পাগল দশা।”
“কতক্ষণ হল ওকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না?”
“ঘণ্টা দুয়েক আগে ওর বাবা দেখেছে বিছানা
ফাঁকা। কিন্তু রাত্তিরে যে-কোনো সময়েই সটকে থাকতে পারে।”
“তা পারে।”
“হোটেলের সক্কলে তন্নতন্ন করে খুঁজে আকাশপাতাল
এক করে ফেলছে। পুলিশের গাড়িও একটা এইমাত্র এল, আসার আগে দেখে
এলাম।”
“হয়তো ছেলেটা সকাল সকাল উঠে পাহাড়ে চড়তে
গিয়েছে। হতেই তো পারে!” আমি বললাম।
মেয়েটা তার কালো দু-চোখ মেলে খানিকক্ষণ আমাকে জরিপ করল।
তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে কেবল বলল, “আমার তা মনে হয়
না।”
আমি ঝটপট কিছু জামাকাপড় গায়ে চড়িয়ে বিচে নেমে এলাম।
সেখানে খাকি পোশাক পরা দু’জন এদেশিয় পুলিসের সঙ্গে মিঃ এডওয়ার্ডস দাঁড়িয়ে ছিলেন। কথা যা বলার তিনিই
বলছিলেন, পুলিশের লোক দু’জন মন দিয়ে
শুনছিল। দূরে বিচের দু-মাথায় ছোটো ছোটো জটলা চোখে পড়ল—হোটেলের কাজের লোকেরা আর অতিথিরা মিলে দু-ভাগে ভাগ
হয়ে পাহাড়ের মুখে চলেছে। সকালটা ভারি সুন্দর। ঝকঝকে পরিষ্কার ধূসর-নীল আকাশে হালকা
হলুদের ছোঁয়া, জ্বলজ্বলে সূর্য অনেকটা উপরে উঠে পড়ে শান্ত
সমুদ্রজুড়ে লক্ষ হিরের কুচি ছড়িয়ে দিচ্ছে। আর সামনে মিঃ এডওয়ার্ডস প্রবল বেগে
হাত-পা ছুড়ে তারস্বরে পুলিস দু’জনকে কীসব বলে চলেছেন।
আমি সাহায্য করতে চাইছিলাম। কিন্তু কী করব? কোনদিকে যাব?
অন্যদের পিছু পিছু যাওয়া অর্থহীন, তাই মিঃ
এডওয়ার্ডসের দিকেই হেঁটে চললাম। ঠিক তখনই মাছধরা নৌকোটা আমার নজরে পড়ল। খয়েরি
পালওয়ালা সরু লম্বাটে এক-মাস্তুল নৌকোটা তখনও সমুদ্রের বেশ ভিতরে, কিন্তু এদিকেই যে আসছে তা বোঝা যায়। নৌকোর দুই মাথায় দু’জন এদেশি লোক বসে প্রাণপণে বৈঠা বাইছে। একমাত্র বাইচ খেলার সময়েই এত জোরে
নৌকা বাইতে দেখেছি। এত তাড়া কীসের এদের? কিছু কি বলতে চায়
এরা? আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বাঁদিক থেকে কানে ভেসে আসছিল
মিঃ এডওয়ার্ডসের গলা, “মামদোবাজি নাকি? জলজ্যান্ত লোকগুলো আমার হোটেল থেকে টপাটপ হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে—না না, এ আমি বরদাস্ত করব না! আপনারা যত শিগগির
পারেন ছেলেটাকে খুঁজে বের করুন। কী, বুঝতে পারলেন কথাটা? ছেলেটা হয়তো এদিক ওদিক চলে গিয়েছে ঘুরতে ঘুরতে, কিংবা
তাকে কেউ তুলে নিয়ে সটকেছে। সে যা-ই হোক, তাকে উদ্ধার করা
পুলিসের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, এ কথাটা…”
নৌকোটা জলের ধারে এসে লাগতেই তার থেকে জেলে দু’জন বৈঠা ফেলে তড়াক
করে বালিতে লাফিয়ে নেমেই ছুটতে শুরু করল। সামনের জনকে চিনতে পারলাম, উইলি। ম্যানেজারের দিকে চোখ পড়তেই সে বোঁ করে তাঁর দিকে মোড় ঘুরে দৌড়োতে
দৌড়োতে চেঁচাতে থাকল, “মিঃ এডওয়ার্ডস! মিঃ এডওয়ার্ডস! এ কী দেখলাম
মিঃ এডওয়ার্ডস! এ যে… অদ্ভুত!”
ম্যানেজারের সারা শরীর শক্ত হয়ে গিয়ে ঘাড় উঁচিয়ে
উঠল। পুলিশ দুটির কোনও ভাবান্তর হল না জেলেদের দেখে, তারা উত্তেজিত জনগণ দেখে দেখে
ধাতস্থ হয়ে গিয়েছে। উইলি এসে তাঁদের সামনে দাঁড়াল, তার পিছনে
তার সঙ্গী। ঘামে তাদের কালো শরীর চিকচিক করছে। দু’জনেরই পরনে
সামান্য কপনি ছাড়া আর কিছু নেই। হাপরের মতো উঠছে নামছে উইলির বুক।
“আমরা… অনেক দূর থেকে…
যত জোরে পারি… নৌকো বেয়ে আসছি!” হাঁপাতে হাঁপাতে উইলি বলল, “কথাটা যত তাড়াতাড়ি হয়
আপনাদের জানা দরকার, তাই ফিরে এলাম।”
“কী কথা? কী দেখেছিস
তোরা?” ম্যানেজার জিজ্ঞাসা করলেন।
“আজব দৃশ্য! ওহ্, সে
এক তাজ্জব ব্যাপার!”
“খুলে বল উইলি, ভ্যানতাড়া
করিস না।”
“সে আপনি বিশ্বাসই করবেন না,” উইলি বলল, “কেউ বিশ্বাস করতেই চাইবে না, তাই না রে টম?”
অন্য জেলেটি ঢক ঢক করে মাথা নেড়ে বলল, “আলবাত। এই উইলি
যদি আমার সঙ্গে না থাকত আমি নিজেই বিশ্বাস করতাম না।”
“আরে কী বিশ্বাস করতিস না? ঝেড়ে কাশ তো!” ম্যানেজার বললেন।
উইলি বলল, “আজ্ঞে আমরা আজ সেই ভোর হওয়ারও আগে
সমুদ্রে বেরিয়েছি, বুঝলেন? তখনও আলো
ফোটেনি। যখন আকাশ একটু ফরসা হল তখন আমরা প্রায় মাইল দুয়েক চলে গেছি। তারপর যেমন না
টপ করে সূর্য ওঠা, ঠিক নাক বরাবর দেখি কী, এই আমাদের থেকে পঞ্চাশ গজ মতো দূর হবে, দেখি কী—ওরে বাবা, নিজের চোখকে বিশ্বাস হয় না গো!”
“ঘোড়াড্ডিম, বল না কী
দেখেছিস?” ম্যানেজার এবার রেগে চেঁচালেন।
“দেখলাম সেই কালকের পেল্লায় কাছিমটা আমাদের
সামনে সাঁতার কাটছে আর তার পিঠের উপর ঘোড়সওয়ারের মতো খাড়া বসে আছে ওই বাচ্চা
ছেলেটা।”
“বিশ্বাস করুন, বিশ্বাস
করুন আপনারা, আমিও দেখেছি!” অন্য
জেলেটিও উত্তেজিত গলায় বলে উঠল।
মিঃ এডওয়ার্ডস পুলিশ দু’জনের দিকে চাইলেন।
পুলিশ দু’জন জেলেদের দিকে চাইল। তারপর তাদের একজন বলল,
“আমাদের সঙ্গে চ্যাংড়ামি করলে কী হয় জানিস?”
“আজ্ঞে একবর্ণও মিথ্যে বলছি না!” উইলি প্রায় কেঁদে ফেলে আর কী, “এই দিব্যি গেলে বলছি।
বাচ্চাটা দিব্যি আরাম করে কাছিমটার পিঠে বসে ছিল। তার শরীর, বিশ্বাস
করবেন না, একেবারে শুকনো খটখট করছে, এমনকি
তার পা-ও জল ছুঁচ্ছিল না। তা আমরা ওদের পিছু নিলাম। কাছিম শিকারের সময় যেমন চুপিসারে
পিছন থেকে কাছাকাছি গিয়ে হামলা করি, তেমনই করতে গেলাম।
কিন্তু ছেলেটা দেখে ফেলল। তখন কাছিমটার থেকে আমরা খুব দূরে নই, এই মনে করুন এখান থেকে জলের ধার পর্যন্ত যতটা হয় ততটা। আমাদের দেখেই
বাচ্চাটা সামনে কাছিমটার মাথার কাছে ঝুঁকে পড়ল—ঠিক যেন কানে
কানে কিছু বলছে, আর তক্ষুনি কাছিমটা গলা বাড়িয়ে একেবারে দে
দৌড় দে দৌড়! সে যে কী জোর সাঁতার সেও আপনারা না দেখলে বিশ্বাস করতে চাইবেন না। এই
টম আর আমি একসঙ্গে হলে নৌকা আমাদের হাতে কথা কয়, কিন্তু
আমাদেরকেও একদম ঘোল খাইয়ে ছেড়ে দিল ওই দানো কাছিম! যতই জোরে আমরা বৈঠা বাই,
আমাদের দুনো জোরে সাঁতার কেটে সে বেরিয়ে যায়! কী বলিস, টম?”
“দুনো কী বলছিস?” টম
উত্তর দিল, “আমাদের তিনগুণ জোরে সাঁতার কাটছিল ব্যাটা। নইলে
কি আর ওই রকম দশ-পনেরো মিনিটের ভিতর আমাদের ছাড়িয়ে মাইল খানেক চলে যায়?”
“হায় কপাল! তোরা কাছিমটার পিছু পিছু গেলি তো
ছেলেটাকে চেঁচিয়ে ডাকলি না কেন? যখন কাছাকাছি ছিলি তখনই
একবার ডাকতে পারলি না?” ম্যানেজার জিজ্ঞাসা করলেন।
“কে বলল ডাকিনি? ডাকা
থামাইনি এক পলকের জন্যেও,” উইলি প্রতিবাদ করে উঠল, “যেই বুঝেছি ছেলেটা আমাদের দেখে ফেলেছে তখন থেকেই আর লুকোছাপা করিনি গো।
সমানে চিৎকার করে ডেকে গেছি, বাবা-বাছা করে বোঝাতে কোনও
ত্রুটি রাখিনি। কত করে বললাম, ‘ও সোনাবাবু, চলে এস! আমাদের নৌকোয় উঠে এস, তোমায় আমরা বাড়ি পৌঁছে
দেব। এ তুমি কোথায় চলেছ? কেন চলেছ? তোমার
মা ওদিকে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসিয়ে ফেলল যে গো! এখনও সময় আছে, জলে
ঝাঁপিয়ে পড়, আমরা তোমায় নৌকোয় তুলে নিচ্ছি।’ আরও বললাম, ‘আমাদের সঙ্গে ফিরে চল, কথা দিচ্ছি এই কাছিমকে আর তাড়া করব না।”
“ছেলেটা উত্তর দিল না?” ম্যানেজার জিজ্ঞাসা করলেন।
“ঘাড় ঘুরিয়েও চাইল না। কেবল কাছিমের পিঠে
সটান বসে সামনে পিছনে জোরে জোরে দুলতে লাগল, যেন কাছিমটাকে
ছোটাচ্ছে। মিঃ এডওয়ার্ডস, যত তাড়াতাড়ি পারেন একটা ব্যবস্থা
করে গিয়ে বাচ্চাটাকে ওই কাছিমের খপ্পর থেকে ফিরিয়ে আনুন। জোর করে ফিরিয়ে আনুন, নইলে ওকে আর
পাওয়া যাবে না, সর্বনাশ হয়ে যাবে!”
ম্যানেজারের গোলাপি মুখ কাগজের মতো সাদা হয়ে
গিয়েছে। তীক্ষ্ণস্বরে তিনি প্রশ্ন করলেন, “কোনদিকে গেল ওরা?”
“উত্তর। উত্তর ঘেঁষে,” উইলি একটু ভেবে
বলল।
“বেশ,” ম্যানেজার
বললেন, “আমরা স্পিড বোট নিয়ে এক্ষুনি বেরোব। উইলি আর টম,
তোরাও আয়।”
খানিক দূরে বালির উপর হোটেলের ওয়াটার-স্কি করার
স্পিড বোটটা রাখা ছিল। দু’জন পুলিশ আর দুই জেলেকে নিয়ে ম্যানেজার সেদিকে ছুটে গেলেন, তারপর সবাই মিলে ঠেলাঠেলি করে সেটাকে জলে নামানো হল। এমনকি ম্যানেজারও হাত
লাগালেন। তাঁর ধপধপে সাদা ট্রাউজার্সের হাঁটু অবধি ভিজে গেল। তারপর সবাই মিলে
সেটায় চড়ে সমুদ্রে মিলিয়ে গেলেন। আমি তীরে দাঁড়িয়ে রইলাম।
দু-ঘণ্টা পর তাঁদের ফিরে আসতে দেখলাম। তাঁরা
কিছুই দেখতে পাননি।
সেদিন গোটা দিন জুড়ে এলাকার সব হোটেলের স্পিড বোট
আর ইয়টের দল তীর বরাবর সমুদ্র তোলপাড় করে ফেলল। দুপুরের দিকে ছেলেটার বাবা একটা
হেলিকপ্টার ভাড়া করে প্রায় ঘণ্টা তিনেক সমুদ্রের ভিতরের দিকে তল্লাশি চালালেন।
কিন্তু কোথায় কাছিম আর কোথায়ই বা কাছিমকুমার।
এক সপ্তাহ জুড়ে চিরুনি তল্লাশি চলল, কিন্তু সবার সব
প্রচেষ্টা বৃথা গেল।
এই ঘটনার পর প্রায় এক বছর কেটে গিয়েছে। এর মধ্যে
উল্লেখযোগ্য খবর একটাই পেয়েছি, বাহামা দ্বীপপুঞ্জের নাসাউ থেকে আমেরিকানদের একটা দল
ইল্যুথেরা নামের একটা বড়ো দ্বীপের পাশে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়েছিল। সেখানে
হাজার হাজার ছোটো ছোটো প্রবালদ্বীপের ছড়াছড়ি। সে সব দ্বীপের বেশিরভাগেই মানুষের পা
পড়ে না। এই মাছধরা ইয়টের ক্যাপটেন হঠাৎ দূরবিনের ভিতর দিয়ে সেইরকমই একটা দ্বীপের
উপর একটা ছোটোখাটো মানুষের অবয়ব দেখতে পায়। সমুদ্রের ধারে বালির উপর সেই ক্ষুদ্র
মনুষ্যমূর্তি হেঁটে চলে বেড়াচ্ছিল। দলের প্রত্যেকেই পালা করে দূরবিন
দিয়ে এই দৃশ্য দেখে যারপরনাই অবাক হয়ে যায় এবং সকলেরই মনে হয় যে ওটা একটা বাচ্চা
ছেলে। সবাই খুব উত্তেজিত হয়ে ওঠে, ছিপ-সুতো সব গুটিয়ে ইয়টের মুখ দ্বীপের দিকে ঘুরিয়ে
দেওয়া হয়। প্রায় আধমাইল যাওয়ার পর দূরবিন দিয়ে দেখে সবাই নিঃসন্দেহ হয় যে ওটা একটা
বাচ্চা ছেলেই বটে। শুধু তাই নয়, তার গায়ের রং রোদে পুড়ে
গেলেও সে যে আদতে সাদা চামড়ার তা বুঝতে কারোর কোনও অসুবিধে হয় না। ঠিক এই সময় ইয়টের
দর্শকদের চোখ পড়ে, বাচ্চা ছেলেটির কাছেই বালিতে শুয়ে থাকা
একটি অতিকায় কাছিমের উপর। তারপরের ঘটনা খুব সংক্ষিপ্ত। পলক ফেলতে না ফেলতেই ছেলেটি,
যে সম্ভবত এগিয়ে আসতে থাকা ইয়টটাকে দেখতে পেয়ে গিয়েছিল, চড়ে বসে ওই বৃহৎ কাছিমের পিঠে এবং কাছিমটা তাকে পিঠে নিয়ে সড়সড় করে জলে
নেমে গিয়ে অবিশ্বাস্য গতিতে সাঁতার কেটে এদের চোখের আড়ালে মিলিয়ে যায়। ইয়টটি আরও
প্রায় দু-ঘণ্টা ধরে খুঁজেও কাছিম বা বাচ্চা ছেলে কারোরই
টিকির ডগাটুকুরও দেখা পায়নি।
এই খবরকে অবিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই। ইয়টের পাঁচ জনের
মধ্যে চার জন ছিল আমেরিকান আর ক্যাপটেন নাসাউয়েরই লোক, বাহামার মানুষ।
তারা প্রত্যেকেই দূরবিন দিয়ে খুব ভালো করে বাচ্চা ছেলেটাকে আর কাছিমটাকে দেখেছিল।
জামাইকা থেকে সমুদ্রপথে ইল্যুথেরা যেতে হলে প্রথমে
উত্তর-পূর্বে আড়াইশো মাইল গিয়ে কিউবা আর হাইতির মাঝখানে উইন্ডওয়ার্ড প্রণালী
পেরোতে হয়, তারপর আবার উত্তর-উত্তর-পূর্বমুখে আরও অন্তত তিনশো মাইল পাড়ি দিতে হয়। সব
মিলিয়ে সাড়ে পাঁচশো মাইলের ধাক্কা। একটা বাচ্চা ছেলের পক্ষে সামুদ্রিক কাছিমের
পিঠে চড়ে সাড়ে পাঁচশো মাইল পাড়ি দেওয়া একটু বাড়াবাড়ি নয় কি?
কে জানে এসবের কী অর্থ।
হয়তো কোনোদিন ছেলেটা ফিরে আসবে। যদিও আমার সন্দেহ
আছে ফিরে আসবে কিনা। আমার কেমন জানি মনে হয় সে যেখানেই থাকুক না কেন, আনন্দে আছে।
ছবিঃ লাবণি চ্যাটার্জি
কতদিন পর এই গল্পটা পড়লাম। অসাধারণ গল্প, তেমনই সুন্দর অনুবাদ। খুব ভাল লাগল।
ReplyDeleteঅদ্ভুত কাহিনি। অসামান্য অনুবাদ।
ReplyDeleteরোয়াল্ড ডালের গল্প সবসময়ে ভাবনার খোরাক জোগায়। এটিও তেমন এক কাহিনী। আর তেমনই সুন্দর অনুবাদ।
ReplyDeleteবাঃ!
ReplyDeleteখাসা গল্প, ঝরঝরে অনুবাদ, নতুন চিন্তার খোরাক । অসাধারণ
ReplyDelete