নোটোর
গল্পঃ স্যামুয়েল ভঁদু
সুজন
দাশগুপ্ত
[আমার
বন্ধু নোটো ভারী সুন্দর গল্প বলে, কিন্তু লিখতে তার মহা আলস্য। ভালো ভালো গল্পগুলো
সব মাঠে মারা যাচ্ছে দেখে ঠিক করলাম আমিই ওর হয়ে কলম ধরব। ছাপা অক্ষরে এটাই হল
নোটোর প্রথম গল্প। এর ভাগ্যে যদি কোনও প্রশংসা জোটে সেটা হবে পুরোপুরি নোটোর
প্রাপ্য।]
আমার দাদু
ধীরেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি ছিলেন ডিস্ট্রিক্ট জজ। যে সময়ের কথা বলছি সে সময় ইংরেজ
রাজত্ব চলছে পুরোদমে। ভারতীয় জজদের সংখ্যা প্রায় হাতে গোনা যায়। অবশ্য ভারতীয় হলে
হবে কী, ব্যবহারে দাদু ছিলেন পাক্কা সাহেব। পাইপ মুখে ঠোঁট চেপে চেপে ইংরেজি
বলতেন, ড্রেসিং গাউন পরে সকালবেলা কর্নফ্লেকস্ খেতেন, এমনকি আম খেতে গেলেও তাঁর
ছুরি কাঁটা লাগত।
দিদিমা
অবশ্য ছিলেন পুরোপুরি হিন্দু নারী। তাঁর ঠাকুর ঘর ছিল। তাছাড়া সন্ধ্যা দেওয়া, উপোস
করা ইত্যাদি যা যা করণীয় সব কিছুই করতেন।
দাদু-দিদিমা
তাঁদের তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে একটা বিরাট কম্পাউন্ড-ওয়ালা বাংলোতে থাকতেন। দরজায়
দারোয়ান, বাগানে মালি, ঘরে বাবুর্চি-খানসামা-ঝি-চাকর – সব মিলিয়ে বাড়ি গমগম করত।
আর ছিল ভঁদু। একটা কুকুরের ছানা কী করে কী জানি একদিন কম্পাউন্ডের মধ্যে ঢুকে
পড়েছিল। কেষ্টর অসহায় জীব বলে দিদিমা সেটাকে আর তাড়াতে দেননি। চাল-চলনে বুদ্ধির
বিশেষ ছাপ না দেখতে পেয়ে তার নামকরণ হয়েছিল ভঁদু।
পেট পুরে
ডাল ভাত খেয়ে গায়ে গতরে ভঁদু চন্দর বেড়েছিল বেশ ভালোই। তবে জাতে তো নেড়ি, চেহারাটা
আর সুন্দর হবে কোত্থেকে! লোম শরীরে আছে কি নেই, নেংটি ইঁদুরের মতো লেজ, নোংরা
বাদামি রং! বাড়ির ছেলেমেয়েরা, অর্থাৎ আমার মা-মাসিরা ভঁদুকে নিয়ে ছিল ভারী বিব্রত।
ওদের বন্ধুদের কুকুররা হচ্ছে টেরিয়ার, রিট্রিভার, পুডলস্-এর মতো সব নামিদামি জাতের
পেডিগ্রি। তাদের কুষ্ঠি ঠিকুজি নিয়ে গর্ব করা চলে। তখন ভঁদুর কথা উঠলে কী-ই বা বলা
যায়! ভঁদুর অবশ্য তাতে ভ্রূক্ষেপ ছিল না। বারান্দার কোণে সে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে
থাকত। দুপুরে গরমটা বাড়লে মাথাটা মেঝেতে সোজা করে রেখে মুখ খুলে হ্যা হ্যা করে
নিঃশ্বাস ফেলত, আর চোখমুখ কুঁচকে কুঁচকে মাছি তাড়াত। ভঁদুর কাজকর্ম বিশেষ ছিল না।
কাজের মধ্যে সকালবেলা কোমর দোলাতে দোলাতে কম্পাউন্ডের কোণে গিয়ে প্রাতঃক্রিয়া সেরে
আসা, আর বিকেলে খাওয়া দাওয়া সেরে একটু সান্ধ্যভ্রমণে বেরোনো। তবে সেটাও বেশিক্ষণের
জন্য হত না। দাদুর বাড়ির পাশেই ছিল ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট টমসন সাহেবের বাড়ি।
সেখানে থাকত জ্যাকি আর জিমি নামে দুই পিওর ব্রেড অ্যালসেশিয়ান। ষাঁড়ের ডালনা খেয়ে
খেয়ে দুটোর চেহারাই দাঁড়িয়েছিল ছোটোখাটো দৈত্যের মতো। আর তাদের মেজাজটাও ছিল
সাংঘাতিক – মালিক টমসন সাহেবের থেকে কিছুমাত্র কম নয়! নেটিভ ভঁদুকে ওরা মোটেই
বরদাস্ত করতে পারত না। ভঁদুকে বাগানে ঘুরঘুর করতে দেখলেই দাঁতমুখ খিঁচিয়ে এমন
সম্বর্ধনা জানাত যে বেচারা ভয়-টয় পেয়ে মাটির সঙ্গে প্রায় মিশে গিয়ে তুর তুর করে
পালিয়ে আসত। সঙ্গে সঙ্গে জ্যাকি জিমির বিক্রম বেড়ে উঠত দশ গুণ। চিৎকারে তখন কান
পাতা দায়! এই ভাবেই সুখে দুঃখে ভঁদুর দিন কাটছিল।
একদিন ভঁদু
বেড়াতে বেরিয়ে জ্যাকি জিমির কথা ভুলেই টমসন সাহেবের কম্পাউন্ডের দেয়ালে ঠেসান দিয়ে
একটু জিরোচ্ছে। জ্যাকি আর জিমি ভেতরের মাঠে ছুটোছুটি করে খেলছে। খেলতে খেলতে হঠাৎ
পাঁচিলের ধারে এসে ভঁদুকে দেখে ওদের মেজাজ গেল বিগড়ে। ঘাউ ঘাউ হাউমাউ এত জোরে
চেঁচিয়ে উঠল যে ভঁদু তৎক্ষণাৎ বাড়ির দিকে ছুটল পড়ি কি মরি করে। সাধারণত জ্যাকি আর
জিমি শুধু চেঁচিয়েই ক্ষ্যান্ত দেয়, কিন্তু সেদিন ভঁদুকে তাড়াহুড়ো করে পালাতে দেখে
জিমির মাথায় রক্ত চড়ে গেল। দিল এক লাফ। ব্যস! এক্কেবারে পাঁচিলের এপাশে। তারপরেই
তিরের বেগে ভঁদুকে তাড়া। ভঁদুর অবস্থা তখন যদি কেউ দেখে! চোখ দুটো ভয়ে একেবারে
সাদা, লেজটা পাক মেরে পেটের নিচে ঢোকানো, একটা বিচ্ছিরি রকমের কেঁউ কেঁউ শব্দ করতে
করতে পালাচ্ছে, আর পেছনে ঘাতক জিমির গররর্ সিংহনাদ! কিন্তু তিন গুণ সাইজের জিমির
হাত থেকে নিস্তার পাওয়া কি এতই সহজ! মালি কোদাল দিয়ে মাটি কোপাচ্ছিল, ব্যাপার
সঙ্গিন বুঝে সে ‘ভাগ ভাগ’ করতে করতে কোদাল হাতে ছুটে এল। যারা খেলছিল বাগানে – ওরা
তো সবাই ভয়ে পাথর! চারিদিকে গেল গেল ভাব!
তারপরের
ঘটনাটাই অবিশ্বাস্য! ভঁদুর মাথায় কী যে ভর করল! বাঁচবার শেষ তাগিদেই বোধহয় ঘুরে
দাঁড়াল ভঁদু। তারপর পায়ের নখ বার করে, মাড়ি শুদ্ধ দাঁত দেখিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল জিমির
ওপরে। আঁচড়ে কামড়ে কাঁউ কাঁউ আওয়াজ করে এমন একটা বদখত কাণ্ড করল যে না দেখলে বা না
শুনলে বিশ্বাস করা যায় না। এমন যে কিছু ঘটতে পারে জিমি নিশ্চয় স্বপ্নেও ভাবেনি।
কয়েক মুহূর্ত ও কী যে করবে কিছুই বুঝতে পারল না। একটু সামলে উঠে আত্মরক্ষার চেষ্টা
করল বটে, কিন্তু ভঁদুর প্রবল বিক্রমের কাছে নিমেষেই বিধ্বস্ত হয়ে গেল।
এর পরের
দৃশ্যে পুরোপুরি পাত্র বদল। দেখা গেল জিমি লেজ গুটিয়ে টমসন কুঠির দিকে ছুটেছে,
পেছনে উঁচু-লেজ খাড়া-লোম যুদ্ধ-জয়ী ভঁদু!
তারপর?
তারপর ভঁদুকে নিয়ে সবার কি প্রচণ্ড নাচানাচি। এমনকি দাদু পর্যন্ত ভঁদুর পিঠ চাপড়ে
একটা বিলিতি বিস্কুট পুরস্কার দিয়ে বললেন, “ওরে ব্যাটা, আজ তুই ব্যাপটাইজড হলি। আজ
থেকে তোর নাম হল স্যামুয়েল ভঁদু।”
ভঁদুও যেন
ব্যাপারটার গুরুত্ব চটপট বুঝে ফেলল। লেজ নেড়ে চোখ পিট পিট করে বিস্কুট চিবোতে লাগল
পরমানন্দে। ভাবটা – এ তো সবই আমার প্রাপ্য!
গল্পটা শেষ
করে নোটো বলেছিল, “আসল কথা কি জানিস? আসল কথা শুধু ক্ষমতা নয়, তার সঙ্গে চাই
আত্মবিশ্বাস। সেটা এলেই দেখবি আমরা সবাই স্যামুয়েল ভঁদু হয়ে গেছি।”
_____
ছবিঃ
স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়
ohh.. Darun
ReplyDeleteSweetie
ReplyDelete