এহসানের বাপ
দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
রাতে
শুতে যাবার সময় অপু বলেছিল, “শিয়রের কাছে জানালাটা রাতে আর খুলিস
না ধীরেন। পর্দাটাও সরাস না।” তারপর কেমন একটু অপ্রস্তুত মুখ করে
ব্যাখ্যাটাও দিয়েছিল, “ওদিকটাতে খোলা মাঠ আছে। চোরছ্যাঁচোড় কখন উঁকি মারে! এখানটা
এখনও তো বেশ ফাঁকা ফাঁকাই আছে।”
কথাটা
অবশ্য ঠিকই। ইউনিভার্সিটিটা চালু হয়ে গেছে আজ বছর তিন হল, তথাপি লোকজন
এখনও বিশেষ বাড়েনি এখানে। দিনের বেলা ছাত্রছাত্রীর ভিড় থাকে বটে, কিন্তু
সূর্য ডুবলে এখনও শুনশান।
বছর
দশেক আগেও যখন এদিক দিয়ে কখনও বাসে-টাসে করে
গেছে, দেখত
শুধু হা হা করছে রুক্ষ, উঁচুনিচু মাঠ। প্রায় দিগন্তের কাছে
আকাশসীমায় মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকত জেলখানাটা। কুখ্যাত হারিয়া জেল। ব্রিটিশ আমলে
একে বিহারের সেলুলার জেল বলা হত। গোটা এলাকার সবচেয়ে কুখ্যাত অপরাধীদের ঠিকানা হত
এইখানে। তাছাড়াও, স্বদেশিদের মধ্যে যাদের সবচেয়ে বিপজ্জনক মনে হত, তাদের
আন্দামানে পাঠাবার সুবিধে না থাকলে এই হারিয়াতে পাঠিয়ে দিয়েই নিশ্চিন্ত থাকতে পারত
সরকার।
তারপর, কিছুকাল
পর একবার অপুর কাছে ঘুরতে এসে হঠাৎ দেখে, যেন ভোজবাজির মতোই ভোল পালটাতে শুরু
করে দিয়েছে জায়গাটা। ফাঁকা, শুনশান মাঠের মধ্যে ইট-পাথরের স্তূপ, ট্রাক, সিমেন্ট
মিক্সার আর রোড রোলারের ঘন ঘন আনাগোনা। দুপুরবেলা তার পাশ দিয়ে আসতে আসতে গাড়ি
থামিয়ে সেইদিকে দেখিয়ে অপু বলেছিল, “ওই দ্যাখ। আমাদের ইউনিভার্সিটির নতুন
ক্যাম্পাস তৈরির কাজ শুরু হয়ে গেছে। আর বড়োজোর এক বছর, বুঝলি? তারপর
আর ওই শহরের মধ্যে ঘিঞ্জি বাড়িটাতে রোজ রোজ ক্লাস করতে যেতে হবে না। এইখানে, ফাঁকায়
ফাঁকায় বেশ তপোবন স্টাইলে…”
তারপর, অপু
যেমনটা করে,
গাড়ি থেকে হাত ধরে টেনে নামিয়ে, খাড়া রোদে ফাঁকা মাঠের মধ্যে দৌড়
করিয়ে করিয়ে দেখানো শুরু করেছিল, “এখানটায় আমাদের ফিজিক্স ডিপার্টমেন্ট, এইখানটাতে
অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিং, এইখানটাতে বসবে আমাদের কোয়ার্টার
কমপ্লেক্স…”
এর
প্রায় বছর তিনেক বাদে এইবার ফের অপুর কাছে আসা। জায়গাটা বদলে গেছে পুরো। বড়ো বড়ো
বাড়ি উঠে গেছে চারদিকে। লাল পাথুরে মাটির প্রান্তর জুড়ে অজস্র গাছ আর ফুলের
কেয়ারি।
ক্যাম্পাসের
একেবারে পশ্চিম প্রান্তের কাছে অপুদের স্টাফ কোয়ার্টার। দুটো চারতলা টাওয়ারে আট আট
ষোলোটা ফ্ল্যাট। একটা টাওয়ার টাইপ সিক্স। সেটা অপুদের জন্য। অন্যটা টাইপ ফোর, তাতে
ইউনিভার্সিটির নন টিচিং স্টাফের থাকবার কথা। টাইপ সিক্স টাওয়ারের একতলার একটা
ফ্ল্যাটে অপুর আড্ডা। উপস্থিত সেখানেই ধীরেনের ঠিকানা হয়েছে। বাকি গোটা টাওয়ারটাই
আনঅকুপায়েড। এ বিষয়ে অপুর একটা থিওরি আছে। সেটা হল এই যে, লোকজন মুখে
যতই প্রকৃতি প্রকৃতি বলে চেঁচাক, আসলে তারা শহরের ধুলো-ধোঁয়ায় মুখ গুঁজরে পড়ে থাকতেই ভালোবাসে বেশি। এছাড়া তার
মতে এই সুন্দর হাউজিংটা এভাবে খালি পড়ে থাকবার কোনও কারণ নাকি নেই। অন্য
টাওয়ারটাতেও গ্রাউন্ড ফ্লোরের একটা ফ্ল্যাটে অ্যাকাউন্টস ক্লার্ক হরেন ধর এসে বাসা
বেঁধেছেন। সেটারও বাকিটা এখনও বেবাক ফাঁকা।
ভদ্রলোকের পাঁচ মেয়ে। অপু জানিয়েছে, বড়ো সংসারের চাপে ভাড়া দিয়ে শহরে
থাকার মতো পয়সা নেই, তাই এসে কোয়ার্টারে উঠেছেন। নইলে নাকি তিনিও এ-মুখো হতেন
না।
বাসিন্দার
অভাবে অপুদের টাইপ সিক্স টাওয়ারে ওর কোয়ার্টারের মুখোমুখি ফ্ল্যাটটাতে
ইউনিভার্সিটির পোস্ট অফিসটাকেই বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। পোস্ট মাস্টারমশাই লোকটা
ভালোমানুষ। রোজ সাইকেল চালিয়ে শহর থেকে পনেরো কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে কাজে আসেন।
কথায় কথায় ধীরেন একবার জিজ্ঞেস করেছিল, “এত কষ্ট করে গরমের মধ্যে আসেন, তার
বদলে এখানেই একটা ঘর নিয়ে নেন না কেন মাস্টারমশাই? সব তো ফাঁকা
পড়ে আছে।”
ভদ্রলোক
জবাবে চোখ দু-খানা
কপালে তুলে বলেছিলেন, “ওরে বাবা, এই কবরস্থানে বৌ-বাচ্চা নিয়ে থাকবার হিম্মত আমার নেই ধীরেনবাবু। অপূর্ব স্যারের
মতো ঝাড়া হাত-পা লোক তো আর নই, তার ওপর উনি
তো আবার বিজ্ঞানী মানুষ…”
ওঁর
কথাটা শেষ হবার আগেই অপু কোত্থেকে এসে বলে, “ওই শুরু হল।
আচ্ছা মাস্টারমশাই, আপনি নতুন লোক পেলেই গুল মারতে শুরু করবেন এটা কেমন কথা!
তার চেয়ে নিজের কাজ করুন গে যান। আমার একটা বুক পোস্ট আসবার কথা ছিল কলকাতা থেকে।
সেটা পৌঁছেছে?”
নিতান্তই
স্বাভাবিক কথাবার্তা। তবুও ধীরেনের কেমন যেন মনে হয়েছিল, অপু কথাটা
ঘুরিয়ে দিয়ে গেল। তবে ব্যাপারটা নিয়ে বেশি মাথা ঘামায়নি সে। ডালহৌসি পাড়ায় কলম
কারখানার আপিসে উদয়াস্ত ঘাম ঝরাতে হয় সপ্তাহে ছ-দিন। ওরই
মধ্যে সাহিত্য-টাহিত্যও চর্চা করে মাঝেমধ্যে। বাড়িতে থাকলে হয় না, তাই
বড়োসড়ো কোনও লেখা মাথায় এলে কলকাতা ছেড়ে এই নির্জন শহরটাতে এসে
দু-চারদিন
কাটিয়ে লেখাটা তুলে নিয়ে ফিরে যায়। দু-দিনের
মেহমান, অতসব
ভেতরের কথায় তার দরকার কী?
এবারে
অপুর কাছে এসে তার ভারি সুবিধে হয়েছে। ওর আগের কোয়ার্টারটা ছিল শহরের একেবারে
পেটের ভেতর একটা এঁদো গলির মধ্যে। তার তুলনায় এ জায়গাটা তো স্বর্গ। চারপাশে যতদূর
চোখ চলে ফাঁকা মাঠের ভেতর এখানে ওখানে দুটো একটা গাছ। তার মধ্যে একটা ছোট্ট দ্বীপের
মতো জেগে আছে নতুন তৈরি ক্যাম্পাসটা। সকাল বিকেল সবসময় হাওয়ার শনশন শব্দ শোনা যায়।
দক্ষিণ দিকটা অবশ্য পুরো ফাঁকা নয়। কয়েক একর পতিত জমি ছাড়িয়ে তারপর ক্যাম্পাসের
সীমানাজ্ঞাপক তারকাঁটার বেড়া। তার ওধারে জেলখানাটা দাঁড়িয়ে থাকে ভূতুড়ে বাড়ির
মতো। জমিটাতে নাকি একসময় ওই জেলখানায় মারা
যাওয়া কয়েদিদের মৃতদেহ পুঁতে ফেলা হত। সাহেবি আমল শেষ হবার পরে প্রথাটাতে কিছু বদল
এসেছিল। তখন বডিগুলো যার যার ধর্ম অনুযায়ী পোড়ানো বা কবর দেওয়া হত বটে, তবে
সে-ও এই মাঠেরই ওপরে। জায়গাটা ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের ভেতর ঢুকে যাবার পর সেটা
এখন বন্ধ হয়েছে বটে, তবে খালি পায়ে ওদিকের মাঠটাতে
অন্ধকারে হাঁটা এখনো রিস্কি। হাড়ের টুকরো-টাকরা
পায়ে বিঁধে যাবার ভয় থাকে।
অপুর
কাছে এলে রাতটা অন্তত একা একা থাকাটা ধীরেনের একটা শখ। টানা লিখে যাওয়া যায়। অপুও
ওর ইচ্ছেটার মূল্য দেয়। ছোটোবেলার বন্ধু তো! ওর ব্যাপারটা বোঝে ভালো। ধীরেন এলে
তাই অপু চিরটা কালই নিজের ঘর ওকে ছেড়ে দিয়ে আর কারও বাড়ি গিয়ে রাতে শুয়েছে।
এবারেও এসে চান-টান করে মেঝেতে খেতে বসে দুপুরবেলা ধীরেন তাই
জিজ্ঞেস করেছিল,
“এ-যাত্রা কোন বাড়িতে শুতে যাবি অপু? এখানে
তো আর তোর সেই পুরোনো পাড়ার দাশবাবু নেই!”
অপু
একটু ইতস্তত করেই বলেছিল, “রাতে শোবার জায়গার অভাব হবে না, কিন্তু
একেবারে ফাঁকা শুনশান জায়গা, রাতবিরেতে কখন কী সুবিধে অসুবিধে হয়… তাই
ভাবছিলাম,
এবারে রাতগুলোও তোর সঙ্গেই থেকে যাই।”
ধীরেন
রাজি হয়নি। তিনটে মাত্র রাত হাতে আছে। হাতের কাজটা প্রায় দশ হাজার শব্দের মতো
দাঁড়াবে বলে মনে হচ্ছে। তার ভাবনা-চিন্তা আছে, তাকে
সাজিয়ে তোলা,
লেখা,
কাটা,
ফের লেখা,
তার ঘষামাজা —সবই সারতে হবে ওই তিন রাতের ভেতর। অতএব কিছুক্ষণ
তর্কবিতর্কের পর অপু হরেন ধরের বাড়িতে গিয়ে রাতে শোবার বন্দোবস্ত করেছে। এ ঘরের
উত্তরের জানালা দিয়ে ধরবাবুর ঘরের জানালাটার একটুখানি দেখা যায়।
রাতে
শুতে যাবার আগে জানালাগুলো সব ভালো করে দেখে-টেখে
নিয়ে অপু বলে গিয়েছিল, “কোনো অসুবিধে হলে উত্তরের এই জানালাটা খুলে ধরবাবুর বাড়ির
দিকে মুখ করে চিৎকার করিস, আমি চলে আসব। কিন্তু দক্ষিণের দিকের
জানালাটা…”
তার
কথাটা শেষ করতে না দিয়ে ধীরেন পাদপূরণ করে দিয়েছিল, “খুলব না, তাই
তো?”
“হ্যাঁ।
খুলবি না। এমনকি পর্দাটাও খোলার চেষ্টা করবি না।”
অপু
চলে যাবার পর ঘরের দরজা বন্ধ করতে গিয়ে ধীরেন দেখে ছিটকিনিটা লাগছে না। অপুটা এত
অগোছালো যে বলার নয়। এদিকে চোর-ছ্যাঁচোড়ের
ভয়ে জানালা বন্ধ করে শোবে, ওদিকে দরজার ছিটকিনি নেই। শেষে এদিক
ওদিকে তাকাতে তাকাতে তাকের ওপর একটা তালাচাবি পাওয়া গেল। দরজায় সেটা ভালো করে
লাগিয়ে দিয়ে একবার টেনে দেখে নিল ধীরেন। এবারে নিশ্চিন্ত।
লেখাটা
সবে জমে এসেছে, এমন সময় আলো চলে গেল। এসব অঞ্চলে এটাই দস্তুর।
এতক্ষণ যে ছিল সেটাই মহা আশ্চর্যের ব্যাপার। ধীরেনের যতদূর অভিজ্ঞতা আছে তাতে এখন
ঘণ্টা দুয়েকের মতো মোটামুটি নিশ্চিন্ত। তার আগে কারেন্ট ফিরছে না। কলমটার খাপ বন্ধ
করে একটা সিগারেট ধরাল সে। তারপর পাশে রাখা কিট-ব্যাগ
খুলে মোমবাতি আর মশার ধূপের একটা কয়েল বার করে জ্বালাতে বসল। ভাঁজ করা হাতপাখাও
একটা দিয়ে দিয়েছিল পর্ণা, কিন্তু এখন এই অন্ধকারে ব্যাগ হাঁটকে
সেটা বার করবার মতো ধৈর্য ধীরেনের নেই।
এবারে
এখানে গরম পড়েছে খুব। এখানকার স্ট্যান্ডার্ডেও বেশ চড়া। হরেন ধর এসে বলছিল
দুপুরবেলায়। এতটা রাত হল তবুও তার তেজ কমেনি। এতক্ষণ তবুও তাও একটা ফ্যান ঘুরছিল
মাথার ওপর টিক টিক করে। তাতে হাওয়া বেশি না থাকলেও মানসিক সান্ত্বনা একটা থাকে যে
ফ্যানটা তো যা হোক আছে! এবারে সেটাও গেল। অস্থির অস্থির লাগছিল ধীরেনের। উত্তরের
জানালার বাইরে খানিক দূরে একটা মহুয়াগাছের সরু সরু ডালগুলো অল্প অল্প নড়ছে দেখা
যাচ্ছিল। হাওয়া ছেড়েছে। ধীরেন উঠে গিয়ে ওদিকের জানালাটা খুলে দিল। লাভ হল না
অবশ্য। একে তো দক্ষিণদিক থেকে হাওয়া আসছে,
তার ওপর দু-দিকের জানালা খুলে ক্রস ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা না
করলে হাওয়া খেলবে কী করে?
একফালি
হলদেটে আলো এসে মেঝের ওপর পড়ছিল খোলা জানালা দিয়ে। আলোটা অনুসরণ করে ধীরেন দেখল, ধরবাবুর
বাড়ির সিঁড়ির আলো। তার মানে কারেন্ট আছে। তবে কি এদিকের ফিউজ গেল? তাহলেই
তো চিত্তির। কোথায় ফিউজ আছে কে জানে। তার মানে সকালের আগে পাখা আর ঘুরছে না। ধীরেন
সতৃষ্ণ চোখে দক্ষিণের জানালাটার দিকে একবার চাইল। অপু ব্যাটার চোরের নিকুচি করেছে।
উঁকি দেওয়া কেন,
সাক্ষাৎ এসে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লেও আর তার পরোয়া নেই। উপস্থিত এই ভয়ানক গরমের
হাত থেকে বাঁচা দরকার।
পর্দাটার
কাছে যেতে একটা অদ্ভুত গন্ধ এসে লাগল নাকে। অচেনা ভেষজ গন্ধ। মৃদু, মিষ্টি
সুবাস তার। পর্দাটার গায়ে কিছু একটা মাখানো রয়েছে। অবশ্য সেদিকে মন দেবার অবস্থা
তখন আর তার নেই। ঘামের নোনতা ফোঁটাগুলো চোখের মধ্যে ঢুকে এসে চোখ জ্বলছিল। ছিটকিনি
খুলে জানালার কাচের পাল্লা দুটো দু-পাশে সরিয়ে দিল ধীরেন। তারপর পর্দাটা
ধরে টান দিতে সেটা খুলে পড়ে গেল বাইরে। আবছা আলোয় দেখা যাচ্ছিল উলটোপালটা হাওয়ার
ধাক্কায় পাক খেতে খেতে সেটা গিয়ে খানিক দূরে একটা গাছের গায়ে ঠেকেছে। অপুর কাজ তো!
কোনোকিছুই ঠিকঠাকভাবে করতে পারে না। যাক গে, সকালে উঠে
আবার খুঁজে এনে লাগিয়ে দেওয়া যাবে’খন।
হাওয়াটা
গায়ে লাগতে ভারি আরাম বোধ হল ধীরেনের। আহ্, কী
মিষ্টি! হাওয়ার ঠেলায় মোমবাতি নিভে গেছে। ধূপের জ্বলন্ত মাথাটা অন্ধকার ঘরের
এককোণে একটা লাল চোখের মতো জ্বলছিল। একটা আলস্য এসে ঘিরে ধরছিল ওকে। লেখাপড়া আজ
আর হবে না। সিগারেটের লেজটা জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়ে ও এসে মেঝের বিছানার ওপর
টান টান হয়ে শুয়ে পড়ল।
* * *
অনেকক্ষণ
ধরেই পায়ের কাছটা ধরে কে যেন আস্তে আস্তে ধাক্কা দিচ্ছিল। অবশেষে ঘুম ভাঙতে ধীরেন
চোখ খুলে দেখল,
চারপাশে একটু একটু ফরসা হয়ে এসেছে। তারপরেই চমক ভেঙে খেয়াল হল, ভোরের
আলো নয়, শেষরাতের
চাঁদ উঠেছে। তারই আলো এসে পড়ছে তার সারা শরীরে। পায়ের কাছে যে লোকটা বসেছিল তাকে
পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে সেই আলোয়। সাদামাটা চেহারা। একটা খাকি ট্রাউজার আর বুশ শার্ট
পরে আছে। ধীরেন চোখ খুলে তাকাতে লোকটা তার পা ছেড়ে দিয়ে একগাল হাসল। তারপর বলল, “বাড়ি
চল এহসান। আর ঘুমায় না।”
ধীরেনের
অবশ্য তখন ঘুম-টুম সব উড়ে গেছে। ধড়মড় করে উঠে বসেছে একেবারে।
চাঁদের ম্লান আলো ছড়িয়ে রয়েছে তার চারপাশের বিস্তীর্ণ মাঠটাতে।
কিছু দূরে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে থাকা জেলখানাটা বাদে আর কোনও ঘরবাড়ির চিহ্নও নেই
কোথাও। নিতান্তই অভ্যেসবশে মাথাটা ডানদিকে ঘুরে গিয়েছিল তার, লাইব্রেরি
বিল্ডিংয়ের আলোগুলো যদি দেখতে পায় সেই আশায়। কিন্তু সেদিকে তাকিয়ে বেশ খানিকটা
দূরে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা একটা চিতা চোখে পড়ল শুধু। একা একাই জ্বলে চলেছে
চিতাটা। আশেপাশে কোনও মানুষজনের দেখা নেই।
লোকটা
আবার তার পা ধরে নাড়াল। এবার যেন সেই ঝাঁকুনিতে একটু বিরক্তিরই স্পর্শ। ধীরেন চোখ
পিটপিট করে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি…
মানে, এখানে…”
লোকটা
বলল, “আমিও
সেই কথাটাই ভাবছিলাম রে বেটা। এই জায়গাটা জুড়ে রোজ রাতে সেই বদমাশ লোকটা শুয়ে
থাকে। আজ সে নেই। সেই বিশ্রি গন্ধটাও নেই।”
“তার
মানে?”
“তোকে
খুঁজতে খুঁজতেই একদিন এখানে এসে পড়েছিলাম। আমি ঠিক জানতাম এখানেই পাব তোকে।”
“আমি
এহসান নই।”
লোকটা
যেন চমকে উঠল একবার। তারপর সেই মৃদু চাঁদের আলোয় ধীরেনের মুখের খুব কাছাকাছি তার
মুখটা নিয়ে এল। একটা গা বমি বমি করা মিষ্টি পচা পচা গন্ধ উঠছিল তার গা থেকে। তার
সঙ্গে মিশে ছিল মৃদু, সোঁদা মাটির গন্ধ…
কিছুক্ষণ
সেইভাবে থেকে আবার ধীরেনকে ছেড়ে একটু দূরে গিয়ে বসল সে। তারপর কেমন দুঃখী দুঃখী
গলায় বলল,
“নাহ্! তুমি তো সে নও!”
“এহসান
কে?”
“আমার
ছেলে স্যার। একমাত্র ছেলে। নবাবজাদার মতো চেহারা
ছিল। নেশা-ভাং কিচ্ছু করত না। শুধু
লেখাপড়ার কাজ করত বাড়িতে বসে। গান্ধীবাবার পুজো করত। গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে
ইস্কুল করাত। সেবারে যখন যুদ্ধ বাধল, একদিন পুলিশ এসে আর চারজন ছেলের
সঙ্গে ওকেও ধরে নিয়ে গেল গ্রাম থেকে। তারপর ছেলে আমার আর ফেরেনি। থানেদারের কাছে
গিয়ে হাতে পায়ে ধরলাম ছেলের খবরের জন্য। সে আমার দশা দেখে খোঁজ-টোজ নিয়ে বলল, হারিয়া জেলে নিয়ে গিয়ে ফেলেছে ওদের।
পূর্ণিয়া থেকে কম দূরের রাস্তা নয়। তবুও খুঁজতে খুঁজতে এসে পৌঁছেছিলাম ঠিক। কিন্তু
ছেলেটাকে আর পেলাম না।
“এই
যে এখানটাতে আপনি শুয়ে আছেন, এইখানটাতেই ও-ও শুয়ে আছে। সেই
খবরটুকু জোগাড় করে উঠতে পেরেছিলাম জেলের জমাদারদের কাছে খোঁজ করে। তারপর একদিন
রাতের বেলা চুপি চুপি এখানটাতে এসে একটা গাঁইতি নিয়ে… কিন্তু...
তারপরে কী যে একটা হল, ভয়ানক একটা কিছু... উহ্,
ঠিক মনে করতে পারছি না। কখনোই মনে করতে পারি না, জানেন!
তখনকার খানিকটা সময়ের কোনও হিসেব নেই আমার কাছে। সেই সময়টার শেষে যখন আবার জ্ঞান
ফিরে এল,
দেখলাম এইখানে ঘোরাঘুরি করছি। এই মাঠটাতে। আমার এহসানের একদম কাছে। ঠিক
এইখানটাতে শুয়ে ছিল সে! তার পায়ে নাড়া দিয়ে আস্তে আস্তে ডাকলাম, এহসান...
“তাতে
লোকটা ধড়মড় করে উঠে বসতে খেয়াল করে দেখি সে আমার এহসান নয়। মুশকো, কালো
চেহারার একটা লোক! আমায় দেখেই সে ভয়ানক চিৎকার করে উঠল। তারপর কেমন যেন পাগলের মতো
এদিক ওদিক ছুটতে লাগল আর বার বারই যেন কোন অদৃশ্য দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়তে
লাগল ভেতরের দিকে। যেন তার চারপাশে কোনও ঘরের চারটে দেয়াল খাড়া হয়ে রয়েছে! আমি
দেখতে পাচ্ছি না এই যা।
“দু-তিনবার ধাক্কা খেয়েই লোকটা অজ্ঞান
হয়ে আছড়ে গিয়ে পড়ল গিয়ে একপাশে। আর তারপর... তারপর, আবার সেই
ঘটনাটা... হ্যাঁ, এইবারে মনে পড়েছে। ওরা তিনজন!
টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে এগিয়ে আসছিল এদিকে। আমায় হাত
তুলতে বলল। ওদের হাতে বন্দুক ছিল। আমি হাতের গাঁইতিটা দিয়ে... তারপর... উহ্...
“একবছর
পরে আবার
সেই দিনটাতে ঘুরতে ঘুরতে এদিকে এসেছিলাম। কিন্তু এ-জায়গাটাতে এসেই দেখি সেই লোকটা
শুয়ে আছে। ওকে দেখেই ঠিক করে নিয়েছিলাম, গাঁইতির এক ঘায়ে খুলিটা দু-ফাঁক
করে দিয়ে এহসানকে ডেকে নিয়ে পালাব, ওই বন্দুকওয়ালারা আসবার আগেই। কিন্তু
তার কাছে এগোতে পারিনি সেদিন। জানালার গায়ে একটা কাপড় ঝুলিয়ে রেখেছিল লোকটা। একটা
ভয়ানক পচা গন্ধ ঘিরে ছিল কাপড়টার চারপাশে। আমার সহ্য হয়নি। মাথা ঘুরে উঠেছিল।
কাছাকাছি আসবার চেষ্টা করতে যেন একটা ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়েছিলাম দূরে।
“পালিয়ে
গেছিলাম স্যার। ভেবেছিলাম গন্ধটার ভয়ে আর কোনোদিন
বোধ হয় এদিকে পা বাড়াতে পারব না। কিন্তু আজ আবার কেমন করে জানি না, দেখি
ঠিক ঘুরতে ঘুরতে এখানে এসে পৌঁছেছি। গন্ধমাখা কাপড়টা নেই। বদমাশ লোকটাও নেই। আপনি
একটু সরে বসুন স্যার। আমার এহসানকে বার করে আনি। তারপর
চিরকালের মতো এখান থেকে চলে যাব স্যার। অনেক দূরে।
আর কোনোদিন আসব না। ভগবানের নামে কথা দিচ্ছি স্যার!”
মন্ত্রমুগ্ধের
মতো একপাশে সরে বসল ধীরেন। ঠিক যেখানটাতে ও শুয়েছিল একটুক্ষণ আগে, লোকটা
গাঁইতি নিয়ে সেখানটাতে কোপের পর কোপ মারতে শুরু করল। শক্ত মাটিতে ঠং ঠং শব্দ
উঠছিল।
হঠাৎ
মাটি কোপানো বন্ধ করে লোকটা ধীরেনের পেছনে জেলখানাটার দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে চাপা
গলায় বলল,
“এ-যাত্রাও আর হল না। ওরা আসছে।”
তার
দৃষ্টি অনুসরণ করে মাথা ঘুরিয়ে ধীরেন দেখে, প্রায় একশো
হাত পেছনে তিনটে টর্চের আলো জ্বলে উঠেছে। শক্তিশালী রশ্মিগুলো বার বার ওদের
কাছাকাছি দিয়ে ঘুরে যাচ্ছিল। তারপর হঠাৎ আলোটা এসে স্থির হল লোকটার গায়ে।
অন্ধকারের ভেতর থেকে একটা গম্ভীর গলা ভেসে এল, “হল্ট! হ্যাণ্ডস আপ।”
লাফিয়ে
উঠে ছুটে পালাতে গিয়ে কীসের সঙ্গে যেন ধাক্কা খেয়ে ছিটকে উঠে লোকটার একদম কাছে এসে
পড়ল ধীরেন। গরাদ দেয়া একটা জানালার মতো লেগেছিল ছোঁয়াটা। হাতড়ে হাতড়ে আবার
সেইখানটাতে গিয়ে হাওয়ার গায়ে হাত বুলিয়ে নিশ্চিত হল সে। এখানে একটা জানালা আছে।
অপুও ঠিক এমনি করে ধাক্কা খেয়েছিল দেয়ালের গায়ে। লোকটা একটু আগেই তাহলে কালো মুশকো
লোকটা মানে অপুর কথাই বলেছে! তার মানে ঘরটা আছে! এইখানেই! তার চারপাশেই। শুধু সেটাকে আর
দেখা যাচ্ছে না।
আলোগুলো
দ্রুত এগিয়ে আসছিল কাছে। পালানো সম্ভব নয় আর। অদৃশ্য একটা দরজাকে সে খুঁজে পাবে
কেমন করে?
আর পায়ও যদি-বা, দরজায় তো
তালা দেয়া। সে নিজেই মেরেছে ঘণ্টা কয়েক আগে। নিজের নিরাপত্তার জন্য।
নিরাপত্তা!
হাহ্! এত বিপদের মধ্যেও হাসি পাচ্ছিল ধীরেনের।
এইজন্যেই তবে ঘরের দরজায় ছিটকিনি লাগায় না অপু!
লোক
তিনটেকে এবারে পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল। দু’জনের
গায়ে পুলিশের উর্দি। তিন নম্বর লোকটা সাধারণ প্যান্ট-জামা পরে আছে। কাছাকাছি পৌঁছেই সামনের উর্দিধারী লোকটা তার
টর্চটা বাঁ হাতে নিয়ে বেল্টের খাপ থেকে একটা রিভলভার বার করে উঁচিয়ে ধরেছে সামনে।
তারপর ধীরেনের
প্রায় গায়ের ওপর দিয়ে চলে গিয়ে লোকটাকে ঘিরে দাঁড়াল ওরা তিনজন। ধীরেনকে যেন দেখতেই
পায়নি। ওদের ঠান্ডা ক্রূর চোখগুলো স্থির হয়ে আছে টর্চের আলোর
ফলায় বিদ্ধ সেই লোকটার গায়ে।
সবার
পেছনের উর্দি ছাড়া লোকটাই প্রথম মুখ খুলল, “খবর একদম
পাক্কা ছিল স্যার। ব্যাটা লাশচোর ক’দিন ধরেই রাতের দিকে এই মাঠে ঘোরাফেরা করছে। এইবারে একেবারে
হাতেনাতে ধরেছি।”
লোকটা
সেদিকে না তাকিয়ে পাগলের মতো গাঁইতি চালাচ্ছিল মাটির গায়ে। আস্তে আস্তে গর্তটা বড়ো
হচ্ছে। পচা মাংসের একটা তীব্র দুর্গন্ধ উঠে আসছিল সেখান থেকে।
সামনের
পুলিশটা ততক্ষণে পজিশন নিয়ে হাতের রিভলভারটার নিশানা স্থির করে ধরেছে লোকটার ওপর।
গম্ভীর গলায় বলছে, “দিস ইজ দা লাস্ট অ্যান্ড ফাইনাল ওয়ার্নিং, ইউ মাস্ট স্টপ অর…”
“এহসান
রে! বাপ আমার…”
একটা
তীক্ষ্ণ চিৎকার করে লোকটা বসে পড়ল গর্তটার পাশে। গর্তের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে পচাগলা
একটা হাতকে দু-হাতে চেপে ধরে টান লাগাচ্ছিল সে। মাংস গলে খসে
পড়ছে মৃত হাতটার থেকে, এখানে
ওখানে সাদা সাদা হাড় বার হয়ে এসেছে…
কানফাটানো
শব্দের সঙ্গে আগুনের তীব্র একটা ঝলক ছুটে এল লোকটার দেহ লক্ষ্য করে। তারপর, পর পর
আরও কয়েকটা গুলি... পুলিশটা পাগলের মতো রিভলভারের ম্যাগাজিন পুরো খালি করে দিচ্ছে
লোকটার গায়ে। আর, তার সঙ্গে সঙ্গেই, বিস্ফোরণের শব্দগুলোকে ছাপিয়ে হিংস্র
একটা চিৎকার উঠে আসছিল, “গো টু হেল, ইউ মনস্টার, ইউ
গ্রেভ স্ন্যাচার সান অফ আ ডেভিল!”
নিঃশব্দে, যেন
স্লো মোশনে চলা ছবির মতো লোকটা একবার একটু ছিটকে উঠেই মুখ থুবড়ে গিয়ে পড়ল সেই
গর্তটার মধ্যে। পচাগলা মৃতদেহটার সারা শরীরে ছড়িয়ে যাচ্ছিল তার বাপের দেহ থেকে
বার হয়ে আসা ফিনকি দেয়া লাল রক্তের ধারা।
তারপর
সব চুপচাপ। অস্তগামী চাঁদের আলোয় সেই গর্তটার মধ্যে জড়াজড়ি করে পড়ে রইল দুটো
লাশ। বন্দুকওয়ালা পুলিশটা চুপচাপ একটা সিগার ধরিয়ে দাঁড়িয়ে রইল একপাশে। অন্য দু’জন মানুষ তখন উবু হয়ে বসে মাটি দিয়ে ঢেকে দিচ্ছে গভীর সেই
কবরটাকে। তারপর আমারও আর কিছু মনে নেই।
* * *
জ্ঞান
ফিরেছিল অপুর ঠেলাঠেলিতে আর চোখেমুখে জলের ঝাপটা খেয়ে। ধীরেন চেয়ে দেখে ফটফট করছে
দিনের আলো। বেলা প্রায় দশটা মতো হবে তখন। অপুর পেছনে হরেনবাবুর বাড়ির লোকজনও ভিড়
করে কৌতূহলী চোখে দাঁড়িয়ে ছিল। ধরবাবুর মুখেই শুনলাম, সকালে ধীরেনকে
ঘুম থেকে না উঠতে দেখে অপু প্রথমে বলেছিল অনেক রাত অবধি পড়াশোনা করেছে বলে দেরি
হচ্ছে বোধ হয়। কিন্তু বেলা সাড়ে ন’টা অবধি কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে শেষে
এ-ঘরের খোলা জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে সে দেখে ধীরেন মেঝেতে মুখ গুঁজরে পড়ে আছে। শেষমেশ
পাতলা কাঠের দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিয়ে তার জ্ঞান ফেরানো হয়েছে।
ঘণ্টা
খানেক বাদে স্নান-টান করে একটু সুস্থির হয়ে অপুকে ধরে
বসল গিয়ে ধীরেন। প্রথমে খানিক তা-না-না-না করে
শেষপর্যন্ত তার চাপে একরকম বাধ্য হয়েই সে বলল, “দ্যাখ ধীরেন, কোনও
একটা রহস্যময় অস্তিত্ব এখানে ঘুরে বেড়ায় সেটা আমি জানি। আমি তাকে দেখেওছি একবার।
রাত্রিবেলা আমায় ধরেছিল এসে। সে এক কান্ড। উঠে ঘরটার
কিছুই দেখতে পাই না, শুধু পালাতে গেলেই ধাক্কা খেয়ে উলটে পড়ি। তুই শুধু-মুধু ভয় পবি, তাই রাতে
কিছু ভেঙে বলিনি। তবে, সেইজন্যেই তোকে বলেছিলাম জানালাটা না খুলতে।
“যেদিন
আমার এই অভিজ্ঞতাটা হয়েছিল তার পরদিন সব শুনে হরেনদা কোত্থেকে ওই ওষুধমাখা কাপড়টা
এনে দিয়েছিল। ওটা ওদিকের জানালায় পর্দার মতো করে ঝুলিয়ে রাখতাম। তারপর আর কোনোদিন
কোনও সমস্যাই হয়নি। তুই কেন মধ্যে থেকে পর্দাটা…”
তাকে
থামিয়ে দিয়ে ধীরেন বলল, “না অপু। সবটা তুই জানিস না। জানলে এত
নিশ্চিন্তে এই ঘরের মেঝেয় বিছানা পেতে এতগুলো রাত শুয়ে ঘুমোতে পারতিস না। তুই পুরো
ঘটনাটা দেখার আগেই জ্ঞান হারিয়েছিলি। আমি সবটা দেখেছি।”
অপু
অদ্ভুত দৃষ্টিতে একবার ধীরেনকে দেখল। তারপর বলল, “আমি যে
অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম সে কথা তুই কী করে জানলি?”
হরেনবাবু
আর তার মেয়েরাও ততক্ষণে কৌতূহলী হয়ে ধীরেনের দিকে এগিয়ে এসেছেন। তাঁদের দিকে চোখ
ফেলে সে বলল,
“আমি জেনেছি। আর সেই সঙ্গে গল্পের যে অংশটা তোরা জানতে পারিসনি
সেটাও বলি শোন।”
নিস্তব্ধ
হয়ে বসে ছিল সকলে। ধীরেনের গল্প শেষ হয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ। বাইরে চৈত্রের দুপুরের
গরম হাওয়া শাঁ শাঁ শব্দ করে গুমরে মরছে শুধু।
হঠাৎ
একটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে দাঁড়াল অপু। তারপর বলল, “হরেনদা, আপনার
ঘরে গাঁইতি আছে না? নিয়ে আসুন। এ-ঘরের মেঝেটা একবার খুঁড়ে দেখতে হবে।”
নিঃশব্দ
সেই দুপুরবেলায় গাঁইতির কয়েকটা ঘায়েই খসে এল মেঝের সিমেন্টের পাতলা আস্তর। তারপর
হাত তিনেক গর্ত খুঁড়তে উঠে এসেছিল জড়াজড়ি করে পড়ে থাকা দুটো কঙ্কাল। তাদের
দুটোরই হাড়ে বেশ কয়েকটা করে বুলেটের ক্ষত।
সেটা
ছিল শুক্রবারের দুপুর। ইউনিভার্সিটি-ভর্তি
লোকজন। কথাটা বাইরে চাউর হয়ে যেতে দেরি হয়নি। কিছুক্ষণের মধ্যেই পিল পিল করে লোক
এসে ভিড়ে ভিড়াক্কার হয়ে গেল জায়গাটা। একটা কঙ্কালের পাশে উর্দুতে লেখা একটা
জীর্ণ কুরআন দেখে মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল, লোকদুটো
মুসলমান। ধীরেন পকেট থেকে দুটো একশো টাকার নোট বার করে হরেন ধরের হাতে ধরিয়ে দিয়ে
বলল, “কাছাকাছি
কোনো মৌলবি-টৌলবি থাকলে খবর দিন হরেনদা। এদের একটু প্রপারলি
নিয়মকানুন মেনে গোর দেওয়া দরকার। শান্তি পাক বেচারারা।”
কাজ-টাজ সেরে সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে সেদিন রাতেই জ্বর এসে
গিয়েছিল অপুর। এতদিন ধরে দুটো অপঘাতে মরা লোকের কঙ্কালের ওপর বিছানা পেতে শুয়ে
থেকেছে সেটা জানতে পেরে ঠিক হজম হচ্ছিল না ওর। বিকারের ঘোরে শুধু ভুল বকছে, “ওই
এল… ওই এল…
আমাকেও গর্তে ফেলবে…”
এখন
একে সামলায় কে! ধীরেনের গল্প লেখা তখন মাথায় উঠেছে। শেষমেশ ট্রেনের দুটো টিকিট
কেটে ওকে একেবারে সঙ্গে করে এনে চুঁচুড়ার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে নিশ্চিন্দি। তবে
অপুটা যা ভিতু! সেরে ওঠবার পরেও ওখানে আর ফিরলে হয়!
_____
ছবিঃ স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়
দারুণ
ReplyDelete