চোর
[মূল গল্পঃ দ্য থিফ, লেখকঃ রাস্কিন বন্ড]
ভাবানুবাদঃ ঈশান মজুমদার
(১)
(২)
(৩)
(৪)
_____
ছবিঃ লাবণি চ্যাটার্জি
[মূল গল্পঃ দ্য থিফ, লেখকঃ রাস্কিন বন্ড]
ভাবানুবাদঃ ঈশান মজুমদার
অরুণের সঙ্গে যখন আমার প্রথম আলাপ হয়,
তখনও আমি একজন পনেরো বছর বয়সি চোরই ছিলাম।
একটু আধটু অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলাম এবং হাতসাফাইয়ের কাজে আমার
বেশ ভালোই সাফল্য লাভ হচ্ছিল।
দুর্গাপুরের উন্নয়নী ক্লাবে তখন টেবিল টেনিসের চর্চা ছিল ছেলেমেয়েদের
মধ্যে। খেলা দেখতে ভিড়ও হত অল্প-বিস্তর।
সেই ভিড়েই অরুণকে প্রথম দেখি। লম্বা, বছর কুড়ি-বাইশের মধ্যে বয়েস, মুখটা একটু ভালোমানুষ গোছের।
ওকে দেখেই, আমার কার্যসিদ্ধির জন্য একেবারে যোগ্য প্রার্থী বলে মনে হয়েছিল।
আসলে, মানুষের বিশ্বাস অর্জনে আমার খুব বেশি সময় লাগত না।
কী কারণে জানি না, হয়তো আমার সরল মুখশ্রীর জন্য অথবা আত্মবিশ্বাসী কন্ঠস্বরের দাপটে, লোকে আমাকে সহজেই বিশ্বাস করে
ফেলত; অরুণও
করেছিল। দূর থেকে তাকে কিছুক্ষণ নজরে
রেখে, আমি
তার দিকে এগোলাম। সে তখন মন দিয়ে খেলা দেখছিল, আর মাঝে মাঝেই বলে উঠছিল, “আরে ডানদিকে, ডানদিকে মার।
ওর ব্যাকহ্যান্ডটা ভালো না।”
প্রায় তার গায়ে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আমিও তার দেখাদেখি বলতে লাগলাম, “একদম। কী
যে করছে, ওইদিকে
খেললেই পয়েন্ট দিয়ে দেবে। আরে ডানদিকে, জোরে মার, মার -”
অরুণ আমার দিকে আড়চোখে দু-একবার দেখছিল, হয়তো ওর মতের সমর্থক বলেই বেশ
আগ্রহ নিয়ে তাকাচ্ছিল আমার দিকে। ঠিক
এমন সময় অরুণের পছন্দের খেলোয়াড়টি বিপক্ষের ডানদিকে মারতেই, ছেলেটি বলটা মিস করল।
আর সুযোগ বুঝে আমিও বলে উঠলাম,
“তোমরা চোখটা কিন্তু দারুণ;
তেমনি তোমার খেলাটা সমন্ধে জ্ঞান। কী
দারুণ ধরে ফেললে ওর দুর্বলতা। চেহারাটা
দেখে মনে হচ্ছে খেলাধূলা করতে কোনও একসময়।”
তার চেহারা আদৌ খেলোয়াড়সুলভ ছিল না;
তবুও আমার পূর্ব অভিজ্ঞতায় দেখেছি,
যে কোনও মানুষ চেহারা নিয়ে প্রশংসা পেলে খুশিই হয়।
মানে, খুব মোটাসোটা কাউকে দেখে যদি আপনি বলেন, স্বাস্থ্যটা বেশ ভালো হয়েছে
তো আগের থেকে, অনেক
রোগা লাগছে। সে দশবারের মধ্যে আটবারই সেই
গুণকীর্তন মেনে নেবে; সে
সত্যি হোক ছাই না হোক।
আমার বিপুল প্রশস্তির উত্তরে অরুণ একটু হেসে বলল, “তোমারও তো দেখছি বেশ ভালো ধারণা
রয়েছে খেলাটা নিয়ে।” অরুণের কথায় আমি বেশ থতোমতো
খেয়ে গেলাম; বলে
কী! আমি
ওর শুনে শুনে দুটো তারিফ করলাম আর এত সহজে বাগে এসে গেল!
তার কারণ আমার সঙ্গে খেলা নিয়ে দুটো কথা বললে যে কেউ বুঝে ফেলত
যে, ওই
বিষয়ে আমার এক্কেবারে ভাঁড়ে মা ভবানী। কিন্তু
সেই মুহূর্তে থেমে যাওয়া মানে শিকারকে হাত থেকে বেরিয়ে যেতে দেওয়া।
তাই কথোপকথন চালিয়ে যেতে লাগলাম আমি।
-
“হ্যাঁ, একটা সময় তো একটু আধটু খেলতাম। তারপর
ভাগ্য নিয়ে গিয়ে ফেলল এমন জায়গায়… এখনও কোথাও খেলা হলে দেখতে বসে যাই। ফিরে
যাই সেই দিনগুলোয়।”
আড়চোখে লক্ষ করি অরুণের দৃষ্টি কেমন কোমল হতে শুরু করেছে।
‘এক্কেবারে সাধাসিধে,’ মনে মনে বলে উঠলাম আমি।
অরুণ প্রশ্ন করল আমায়, “ভাগ্য
এনে ফেলল বলছ কেন?”
-
“আমি মেদিনীপুরের খুব সাধারণ ঘরের ছেলে। বাবা
কলের মিস্তিরি ছিল, আমাকেও
কাজ শেখাত। একবার যাত্রা শুনে ফেরার সময়
মাঝরাস্তায় টেম্পোটা উলটে গেল; বাবা-মা দুজনেই শেষ। আমি
মাসখানেক বাদে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলাম। এক
মামা ছিলেন, তার
দোকানেই কাজে নিয়ে নিলেন। বছর চারেক সেখানে ভালোই কাজ
করছিলাম; তারপর
গত মাসে মামা হঠাৎ মারা গেলেন হার্টফেল করে। মামার
ছেলেরা আমায় একটুও পছন্দ করত না। আসলে, গলগ্রহ তো, বুঝতেই পারছ।
তারা আমায় রাখতে চাইল না;
তাড়িয়ে দিল। সেই
থেকে ঘুরে বেড়াচ্ছি। কখনও এখানে, কখনও ওখানে, দু-চারদিনের কাজ পাই; চলে যায় কোনোমতে।”
-
“নাম
কী তোমার?”
-
“শ্যামল।”
এটা বোধহয় আমার পঞ্চম বা ষষ্ঠ নাম ছিল। এর
আগে রবি, ভোলা, তারেক এমন বহু নাম নিয়ে কাজ
করেছি। তার ওপর, আমার মতো অনাথের পক্ষে বাবা-মার এই গল্পটা তৈরি করে নেওয়াও
প্রয়োজনীয় বলে আমার আগেই মনে হয়েছিল। শুধু
ক্ষেত্র ও অবস্থার বিশেষে গল্পটা বদলে যেত। খেলা
প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল, আমার
গল্প শুনে অরুণ ধীরে ধীরে ভিড়ের বাইরে বেরিয়ে এল। তারপর
উলটোদিকের রাস্তায় হাঁটতে শুরু করল সে; আমিও অনুসরণ করলাম তাকে। সে
কিছুটা অস্বস্তি কাটানোর জন্যই বলল, “কেমন লাগল খেলা?”
আমি সে কথার উত্তর দিলাম না, বরং একটা অনুরোধ আর দাক্ষিণ্য প্রত্যাশী গলায় বলে উঠলাম, “আমায় তোমার কাছে কাজ করতে দেবে?”
সে কিন্তু হাঁটা থামাল না, বরং
আমার দিকে পালটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, “তা
তোমার হঠাৎ এমন মনে হল কেন যে আমার কাজের লোক দরকার?”
-
“সারাদিন ঘুরে বেড়াচ্ছি এমন একজনের খোঁজে যে আমায় একটা কাজ দেবে।
আমার অন্তত কোনও একটা হিল্লে হবে। তুমি
সেই লোক, যে
আমায় আমার কথা জিজ্ঞাসা করলে। তাই
মনে হল, হয়তো
তোমাকেই বলা যায় এই বিষয়ে।”
কখন কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে,
এটা আমার ঠোঁটের গোড়ায় প্রস্তুত থাকত সবসময়।
অরুণ অল্প হেসে বলল, “তুমি একটু বেশিই প্রশংসা করছ আমার!”
-
“মোটেই
না, আমি শুধু মনের কথাটাই বলছি।”
-
“কিন্তু
তুমি আমার কাছে কাজ করবে কীভাবে?”
-
“কেন? তুমি যে কোনও কাজ বল,
যে কোনও; আমি করে দেব।”
-
“আরে ব্যাপারটা সেটা নয়। তোমায়
মাইনে দিতে পারব না।”
এবার আমি একটু থমকে গেলাম;
ক্ষণিকের জন্য মনে হল আমি বোধহয় ভুল লোককে বেছে নিয়েছি আমার কার্যসিদ্ধির
জন্য। তারপর একটু ভেবে বললাম, “আমার
খাবারটুকু দিতে পারো?”
-
“তুমি
রান্না করতে পার?”
-
“পারি।”
-
“তাহলে তোমার খাবারও দিতে পারি।”
ডাহা একটা মিথ্যে বলে আমার হিল্লে হয়ে গেল।
কারণ ভাত ছাড়া অন্য কিছু করা আমার পক্ষে শুধু কঠিন নয়, একেবারেই অসাধ্য ছিল।
তাও হোটেলের ক্যাশবাক্স থেকে রবিবারে টাকা হাতানোর আগে ওইটুকু
শিখেছিলাম ওখানকার রাঁধুনির কাছে। ফলে, সেই নামমাত্র বিদ্যেটুকুই আমার
পেটে ছিল। তবে, একটা ব্যাপারে আমি একেবারে
নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে, বিশ্বাস
অর্জনে আর মিথ্যাচরণে আমার দক্ষতা প্রশ্নাতীত।
হাঁটতে হাঁটতে একসময় অরুণের বাড়ি পৌঁছে গেলাম।
একটা একতলা বাড়ি, খুবই ছোটো, একটা ঘর, একটা বারান্দা, আর একটা কলঘর। রান্নার
জায়গাটা বাইরের বারান্দার এক কোণে অবস্থিত। বাড়ির
দিকে যাওয়ার সময়ই অরুণ বলছিল, যে তার মা জন্মের সময় থেকেই নেই। বাবা
এই বাড়িটুকুই রেখে গিয়েছিল তার জন্য। তাই
মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই সে চিরকালই পেয়ে এসেছে। পরে
অবশ্য আরও কিছু জেনেছিলাম তার সমন্ধে। যাই
হোক বাড়িতে ঢুকে বারান্দাটা দেখিয়ে সে বলল,
“এখানে শুতে আপত্তি নেই তো তোমার?”
-
একেবারেই না।
তবে আমার সঙ্গে দুটো জামা প্যান্ট রয়েছে আর একটা চাদর।
শোয়ার জন্য কোনোকিছু তো আনিনি আমি।”
অরুণ অল্প ভেবে বলল, “সে ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
আমার কাছে আরেকটা পুরোনো গদি আছে। যদিও
ফাটা, তবে
এখনকার মতো কাজ চালিয়ে নিতে পারবে। ওটার
উপর শোয়ার ব্যবস্থা করে নাও। একটা
লেপ আর বালিশও আছে তবে একটু ছেঁড়াখোঁড়া, সেটাই যা সমস্যার।”
-
“তাতে আমার কোনও অসুবিধা হবে না।”
আমি দ্রুত অরুণকে আশ্বস্ত করে বলে উঠলাম। এমন
অবস্থায় যা পাওয়া যায়, তাতেই
মঙ্গল।
সেদিন রাতে অবশ্য আমি যে খাবারটা রান্না করলাম, সেটাকে খাবার না বলাই ভালো।
অরুণ তার দু-গ্রাস গলঃদ্ধকরণ করে,
নাক মুখ কুঁচকে বাকিটা রাস্তার বিড়ালটিকে খাইয়ে দিল।
শুধু তাই নয়, আমাকেও পত্রপাঠ বিদায় নিতে বলল বেশ কড়া গলায়।
কিন্তু আমি আমার সেই অতি সরল হাসিমুখটি নিয়ে তার পিছন পিছন ঘুরতে
লাগলাম। কখনও বা দাঁড়িয়ে রইলাম তার
সামনে। সে খানিক অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে
থাকার পর, হঠাৎই
হাসতে শুরু করল। হাসতে হাসতেই বলল, “উফ, বাবারে বাবা, যা খাবার খাওয়ালে! ঠিক আছে, ঠিক আছে, অত ভাবার কিছু নেই।
আজকে তো আর হবে না, কাল থেকে তোমায় রান্না করা শেখাব।”
অরুণের সঙ্গে কাজ করতে আমার ভালোই লাগছিল।
সকালবেলা চা বানিয়ে দিয়ে আমি বাজারে চলে যেতাম; আর প্রায়ই সেখান থেকে দশ-কুড়ি টাকা সরিয়ে, বাড়ি ফিরে নির্লিপ্তভাবে বাজারমূল্য
বৃদ্ধির দুশ্চিন্তা ব্যক্ত করতাম। সেই
কারণেই, প্রতিদিনের
জিনিসপত্র কেনায় আমার কিঞ্চিৎ সময় লাগত। কখনও
কখনও মনে হত, অরুণ
বোধহয় বুঝতে পারছে ব্যাপারটা, শুধু কিছু বলছে না। আসলে, সে কেমন যেন খামখেয়ালি প্রকৃতির
মানুষ ছিল। আরও একটা কারণ ছিল, আমি ঘরের অনেক কাজই করতাম; অথচ সে তো আমায় একটা টাকাও
মাইনে দিত না। তাই একটা অনুকম্পার জায়গা থেকেই
ব্যাপারটাকে এড়িয়ে যেত।
অরুণ আমায় লিখতেও শিখিয়েছিল। তার
আগে অবধি আমার বিদ্যে ছিল সঙ্গীন। এর
ওর দ্বারে লাথি ঝাঁটা খাওয়া একটা ছেলেকে আর অ আ ক খ কে শেখাবে বলুন! অরুণ শিখিয়েছিল, স্লেট পেনসিল কিনে দিয়েছিল; তারপর হাত ধরে ধরে লেখা শেখাত, পড়তে শেখাত।
এমনকি আমার নিজের নামটাও আমায় লিখতে শিখিয়েছিল অরুণ।
আমি যদিও এই সব অত্যাচার মেনে নিচ্ছিলাম শুধুমাত্র একটা বড়ো দাঁও
মারার অপেক্ষায়। আসলে প্রথম প্রথম যতই মনে হোক
যে অরুণের বিশেষ উপার্জন নেই; সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জেনেছিলাম যে তা ঠিক নয়।
নিয়মিত উপার্জন না থাকলেও,
সে অল্পবিস্তর সুদের কারবার করত। এক
সপ্তাহে সে একজনের থেকে ধার করত, অন্য সপ্তাহে ধার দিত। আসলে, ওর বাবার কিছু জমানো টাকা ছিল; তা দিয়েই ব্যাবসাটা শুরু করে।
মুশকিল হল, আয় খুব নিয়মিত না হলেও;
কিছুমাত্র আয় হলেই সে বন্ধুদের সঙ্গে আমোদ প্রমোদে বেরিয়ে পড়ত।
এটা একটা আজব ব্যাপার হয়ে উঠেছিল আমার কাছে।
মাঝে মাঝেই দেখতাম, ও মাথায় হাত দিয়ে ভাবছে পরের মাসটা কেমন করে চলবে।
আবার পরের দিনই কিছু টাকা হাতে আসতেই,
বেরিয়ে পড়লেন বাবু সেগুলো ওড়াতে।
তবে আজ স্বীকার করতে দ্বিধা নেই,
যখন অরুণ আমার সঙ্গে অক্ষরগুলোর পরিচয় করিয়ে দিত, তখন কখনও কখনও মনের মধ্যে অদ্ভুত
সব চিন্তা খেলে যেত। মনে হত, একদিন আমি লিখতে শিখব; সেদিন আর যাই হোক পেট চালানোর
তাগিদে আমায় চুরি করতে হবে না। অরুণের
আন্তরিকতার জন্যই বা আমার মনের একটা অন্য দিকের কারণেই,
মাঝে মাঝে আমার ভালো হতে ইচ্ছে করত। তখন
অজান্তেই চোখটা কেমন ভিজে যেত, আর মাকে দেখতে ইচ্ছে করত খুব। কিন্তু ‘মা’ ‘বাবা’ এই শব্দগুলোর মানেই তো জানতাম
না সেভাবে। বারো বছর অবধি একটা অনাথ আশ্রমে
বড়ো হচ্ছিলাম, যেখানে
শুধু খাটাত, আর
মারত। ভালো লাগত না, তাই একদিন সেখান থেকে চুরি
করে পালালাম। সেই আমার প্রথম হাতেখড়ি; আর প্রথম সাফল্যের স্বাদ আমাকে
যেন একটা অন্য মানুষে বদলে দিল। কেউ
ধরতে পারল না আমায়। তারপর আবার চুরি করলাম, তারপর আবার এবং তারপর আবারও
একই কাজ করে বেশ পারদর্শী হয়ে উঠলাম অচিরেই। শেষ
চার বছরে ওই একটি বিদ্যেই রপ্ত করেছিলাম মনে-প্রাণে।
যাই হোক, অরুণের বাড়িতে আমার দিন বেশ কেটে যাচ্ছিল, আর আমি সুযোগের সদ্ব্যবহারের
অপেক্ষায় প্রহর গুনছিলাম। দেখতে দেখতে বেশ কয়েকমাস কেটে
গেল।
একদিন দুপুরে অরুণ তাড়াতাড়ি বাইরে থেকে ফিরে এল।
দেখলাম বেশ মোটা একটা পাঁচশো আর একশো টাকা মেশানো বাণ্ডিল সে বালিশের
তলায় রাখল। বেশ কয়েক মাস তার বাড়িতে কাজ
করার পরেও আমার নিজের প্রয়োজনে সেভাবে তাকে ব্যবহার করতে পারিনি আমি।
কিন্তু ব্যবহার করার অবকাশ আমার কাছে ছিল।
তার কারণ, চাবি সে আমার জিম্মায় রেখে যেত। যখন
খুশি চাইলেই তার ঘরে আসা যাওয়া করতে পারতাম আমি। আসলে, আমায় অবাক করে দিত তার বিশ্বাস।
আমার উপর তার কীসের টান ছিল আমি জানি না; কিন্তু তার এই আস্থার কারণেই
আমি আমার সহজাত প্রতিভার দিকে নজর দিতে পারিনি সেভাবে।
একজন লোভী মানুষের অর্থ ছিনিয়ে নেওয়ার মধ্যে আমি কোনোদিনও গ্লানি
খুঁজে পাইনি; কারণ
আমি চিরকাল সেটা তার প্রাপ্য বলে মেনে এসেছি। একজন
বড়োলোকের টাকা চুরি করাও সহজ, কারণ সেটা তার পুষিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে।
কিন্তু একজন সাধারণ মানুষ,
যার উপার্জন নিয়মিত নয়?
যার টাকাপয়সার লালসাও নেই,
প্রাচুর্যও নেই; রয়েছে একরাশ খামখেয়ালিপনা। তার
সঙ্গে মিশেছে অগাধ বিশ্বাস আর ভরসা একজন সম্পূর্ণ অচেনা মানুষের প্রতি।
তার সৎ পথের আয় চুরি করা কি এতই সোজা?
বালিশের তলায় রাখা অতগুলো টাকা অরুণের অজ্ঞাতে সরিয়ে ফেলা, আমার পক্ষে এমন কিছু দুরূহ
ব্যাপার ছিল না। আমি আমার মনকে ধমক দিয়ে বললাম, ‘এবার আসল কাজ করার সময় এসেছে।
বেশি ভাবতে গিয়েই আমি অভ্যাসের বাইরে চলে যাচ্ছি।
ওই টাকাগুলো না নিলে,
সে তো বন্ধুদের সঙ্গেই আজেবাজে খরচা করে অপচয় করবে।
তার উপর সে আমায় মাইনেও দেয় না।’ কাজেই যাবতীয় দ্বন্দ্ব প্রতিদ্বন্দ্ব কাটিয়ে আমি প্রস্তুত হয়ে
গেলাম মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য।
বিকেলে বাজার করার অছিলায় একবার স্টেশন চত্বর থেকে ঘুরে এলাম।
একটা টিকিট কেটে রাখা দরকার,
যাতে পালাবার পথটা প্রশস্ত থাকে।
শীতের রাত্তির, এমনিতেই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে পাড়াগুলি। অরুণও
সেদিন একটু আগেই খেয়ে শুয়ে পড়ল। সাড়ে
এগারোটার দিকে আমি উঠে বসলাম। বারান্দা
দিয়ে জ্যোৎস্নার আলো এসে পড়েছে ঘরের মধ্যে। মাঝে
মাঝেই মেঘ এসে ঢেকে দিচ্ছে চাঁদটাকে। আবার
লুকোচুরি খেলার ফাঁকেই মেঘেদের ফাঁকি দিয়ে আড়াল-আবডাল থেকে বেরিয়ে আসা চাঁদ,
মায়াময়ী করে তুলছে চারপাশ। উঠে
বসে পরিকল্পনাটা নিয়ে খানিকক্ষণ ভাবলাম। অনেক
টাকার ব্যাপার; যা
ভেবেছিলাম তার চেয়ে অনেকটাই বেশি। বারোটা
পঁচিশের বাঘ এক্সপ্রেসটা রয়েছে; ওটা ধরতে পারলেই...
আমি সন্তর্পণে দরজা ঠেলে ভিতরে এলাম। একমুখ
প্রশান্তির ছায়া মেখে ঘুমোচ্ছে অরুণ। চুপিসারে
তার দিকে এগিয়ে এলাম; একটু
নড়ে উঠল কী সে? নাহ, চোখের ভুল।
ধীরে ধীরে হাত বাড়ালাম তার বালিশের তলায়; টাকা! বাণ্ডিলটা বেশ মোটা, বার করে আনলাম।
তারপর পা টিপে টিপে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে। বাইরে
যাওয়ার মুখে একবার অরুণের দিকে তাকিয়েছিলাম। কেমন
একটা আবছায়া খেলা করছে তার মুখে। অল্প
একটু হাসি লেগে আছে কি তার ঠোঁটে? ঠিক দেখলাম কিনা, তা আর যাচাই করা হল না।
বাইরে বেরিয়েই প্রাণপণে ছুটতে লাগলাম অলিগলি ধরে।
বাজারের ভিতর দিয়ে শর্টকাট করার চেয়ে,
আমি একটু নির্জন রাস্তাগুলোই বেছে নিলাম পালানোর জন্য।
কে বলতে পারে, তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে যদি ঝুঁকি নেওয়া হয়ে যায়।
দোকানপাট সব বন্ধ, শুধু দূরে কোথাও একটা টিমটিমে আলো জ্বলছে।
বারোটা কুড়ি বেজে গেছে,
আর মিনিটখানেকের মধ্যেই স্টেশনে ঢুকে যাব।
হঠাৎ নোটগুলো গোনার কথা মনে হল। কিন্তু
দেরি হয়ে যাবে এই ভেবেই আর গুনলাম না। শুধু
একবার পকেটে হাত ঢুকিয়ে আঙুল চালিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করলাম - প্রায় খান ত্রিশেক নোট রয়েছে
বাণ্ডিলটায়! এই
টাকায় যে আমার আগামী চার-পাঁচ মাস বেশ নিশ্চিন্তেই কেটে যাবে,
সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ রইল না।
স্টেশনে যখন পৌঁছলাম,
তখন বাঘ এক্সপ্রেস ঢিমে তালে তার যাত্রা শুরু করেছে।
আমি ইচ্ছে করলেই দৌড়ে গিয়ে উঠে পড়তে পারতাম; দৌড় শুরুও করেছিলাম, কিন্তু হঠাৎ কী মনে হতে দাঁড়িয়ে
পড়লাম। কেন যে দাঁড়িয়ে পড়লাম, তার উত্তর আমার কাছে সেদিন
ছিল না; আজও
নেই। ট্রেনে উঠে পড়লে হয়তো আজ এখানে
এই গল্পটা বলতাম না। প্রায় ফাঁকা স্টেশনে দাঁড়িয়ে
দেখলাম বাঘ এক্সপ্রেস স্টেশন ছেড়ে চলে গেল।
পকেটের মধ্যে থাকা টাকাগুলো আমার শরীর ছুঁয়ে জানান দিচ্ছিল তাদের
উপস্থিতি। কিন্তু কোথাও একটা অদ্ভুত একাকীত্ব, একটা বিছিন্নতাবোধ আমার মনকে
গ্রাস করছিল। কোথায় রাত কাটাব তা জানতাম
না। ওই শহরের কাউকেই তো চিনতাম
না আমি; একজনকে
ছাড়া। সেই মানুষটা যার থেকে এই টাকাগুলো
আমি…
আমার ভিতর থেকে নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।
স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে এসে,
আমি বাজারের রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলাম। চারিদিক
অন্ধকার, নিস্তব্ধ।
মনে মনে অরুণের কথা ভাবছিলাম
- কী নিশ্চিন্তেই না ঘুমোচ্ছে সে! তার ক্ষতির কথা এখনও সে জানেই
না। চুরি করতে করতে একটা ব্যাপারে
আমি বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছিলাম - তা হল মানুষের মুখভঙ্গী। অনেক
কিছু বুঝতে পারতাম আমি তার মাধ্যমে। কোনোকিছু
হারানোর পর, ধনীর
মুখে রাগের ছাপ আসে। আবার, দরিদ্রের মুখে ভয়ের ছাপ পড়ে
ধীরে ধীরে। কিন্তু অরুণের মুখে যে কী ছাপ
গাঢ় হবে, তা
ঠাহর করতে পারছিলাম না। রাগ বা ভয় কোনোটাই তার হবে
না এই বিষয়ে আমি নিশ্চিত ছিলাম। আমার
মনে হল, তার
মধ্যে একটা অদ্ভুত শোক জন্ম নেবে এবং সেটা কখনোই টাকা হারানোর দুঃখে নয়; বিশ্বাস হারানোর দুঃখে।
আমি একটা রাস্তার ধারের দোকানের ভাঙা শেডের নিচে এসে বসলাম।
সোয়েটার পরে ছিলাম, ভিতরেও গরম জামা ছিল,
তবুও শীত করছিল। ‘কেন
যে চাদরটা নিয়ে এলাম না,’ মনে মনে ভাবলাম আমি। বেশ
কিছুক্ষণ আগে থেকেই এক খন্ড কালো মেঘ জমতে শুরু করেছিল;
ঢেকে গিয়েছিল চাঁদটাও। এবার
বৃষ্টি শুরু হল, ঝিরঝির
করে পড়তে লাগল, দোকানের
শেডে। আমার অস্বস্তি বাড়তে লাগল, তার সঙ্গে বৃষ্টিও বাড়ল।
ভাঙা শেড বেয়ে জল আমার গায়েও পড়তে লাগল - অচিরেই ভিজে গেলাম আমি।
জামাকাপড়গুলো আমার গায়ের সঙ্গে সেঁটে যেতে লাগল ধীরে ধীরে।
আমি আমার অস্বস্তিকে প্রশমিত করার জন্যই মনকে বোঝালাম, ‘এ কী! আমার তো অস্বস্তি হবার কথা
নয়। পার্কের বেঞ্চে আমি তো অনেকবার
রাত কাটিয়েছি।’ কিন্তু বুঝতে পারলাম অরুণের
বারান্দায় শোয়ার অভ্যেস আর তার ভালোবাসার উত্তাপ,
এই সবকিছু আমায় পালটে দিয়েছে।
আমি এক দৌড়ে বাজারের মধ্যেই অন্য আরেকটা দোকানের ছাউনির তলায় গিয়ে
বসলাম। একঝলক তাকিয়ে বুঝলাম, সেখানে জল পড়বে না; চালটাও ঠিকঠাকই রয়েছে।
পকেটে থাকা নোটগুলোর কথা হঠাৎ মনে হল। আগের
মতো কড়কড়ে নেই সেগুলো, অনেক
নরম হয়ে গেছে জলে ভিজে। অতগুলো নোট, অরুণের সেই ঘুমন্ত মুখ, আমার ট্রেনে না ওঠা এই সমস্ত
ভাবনারা আমার মনের মধ্যে লুকোচুরি খেলতে লাগল।
আমার মনের আকাশেও হয়তো মেঘ জমছিল ধীরে ধীরে; এবার, তা অঝোর বারিধারা ঢেলে দিল
মনের ভিতর।
অরুণের টাকা!
কে জানে, হয়তো
সকালে উঠে সে আমায় কিছু টাকা দিয়ে বলত, “যাও আজ একটা সিনেমা দেখে এসো।”
কিন্তু এখন আর তা বলার অপেক্ষা রাখে না, কারণ সবটাই আমার।
আমি এখন যা খুশি করতে পারি টাকাগুলো নিয়ে! সত্যিই কী করতে পারি? আমার মনের মধ্যে এক অদ্ভুত
আলো-আঁধারির
খেলা চলতে লাগল।
অরুণের বাড়িতে রান্না করা,
বাজার যাওয়া, এই সবকিছুর মধ্যে একটা আলাদা আনন্দ পেতে শুরু করেছিলাম আমি।
ভালোবাসার আনন্দ, বন্ধুত্বের আনন্দ, বিশ্বাসের আনন্দ এবং আরও অনেক কিছুর একসঙ্গে মিলে যাওয়ার আনন্দ।
কিন্তু অরুণের তাগিদে,
লেখার জন্য পেনসিলটায় যখনই হাত ছোঁয়াতাম, আমার যেন প্রতিবার নবজন্ম হত।
হয়তো একটা বাচ্চাকে খুঁজে পেতাম,
যে আর পাঁচজনের মতোই বড়ো হতে চেয়েছিল,
স্কুলে যেতে চেয়েছিল এবং কখনোই চুরি করতে চায়নি।
একটা গোটা বাক্য একদিন লিখতে শেখার যে স্বপ্নটা অরুণ আমার মধ্যে
জাগিয়ে তুলেছিল, সেটাই
আমার মনের দরজায় বার বার কড়া নাড়তে লাগল।
আসলে, মোটা টাকার বান্ডিলের ভার আমায় অনেক কিছু ভুলিয়ে দিয়েছিল।
আমার মনে হল, যদি লিখতে শিখি, পড়তে শিখি, তাহলে হয়তো একদিন সৎপথে অনেক টাকা আমি উপার্জন করব।
তখন আমাকে আর পালিয়ে বেড়াতে হবে না। বিশ্বাস
ভাঙায় খেলাতেও মেতে থাকতে হবে না প্রতিনিয়ত। চুরি
করা কাজটাকে আমার খুব সহজ লাগত, বিশ্বাস ভাঙার মতোই। কিন্তু
নিজের পায়ে দাঁড়ানো, সৎপথে
উপার্জন করা যে তার চেয়ে অনেক অনেক কঠিন! তবুও সেটাই তো পথ। আমার
মনের মধ্যে কে যেন বলে উঠল, “এরপর আরেকটা ট্রেন আছে,
পালাও, পালাও।” আমি
উঠে দাঁড়ালাম, পা
বাড়ালাম - স্টেশনের
দিকে নয়, অরুণের
বাড়ির দিকে।
বাড়ি পৌঁছে আমি ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকলাম। বৃষ্টি
তখন অল্প ধরে এসেছিল। তবুও, মেঘ তার মন্দ্রিত স্বরে গর্জে
উঠছিল কারণে-অকারণে।
আমার মনে হল, মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে এই ঘরেই ঠিক এমনই সন্তর্পণে চুরি করতে ঢুকেছিলাম
না? নিঃশব্দে
অরুণের মাথার কাছে এগিয়ে গেলাম আমি। বালিশের
নিচে টাকাগুলোকে ঢুকিয়ে দিয়ে হাতটা বার করার সময়,
অরুণের চুলে আমার আঙুলগুলো অকস্মাৎ ছুঁয়ে গেল।
নাহ, অরুণ জাগল না; শুধু দেখলাম, তার ঠোঁটে সেই আলতো হাসির রেশটা যেন লেগে রয়েছে।
তার নিঃশ্বাস আমার হাত ছুঁয়ে গেল;
মুখে আলোছায়ার খেলা চলছিল তখনও।
পরদিন যখন ঘুম ভাঙল, দেখলাম অরুণ নিজেই চা বানিয়ে ফেলেছে। সকালের
তীব্র আলোয়, তার
মুখোমুখি হতে কিঞ্চিৎ দ্বিধাবোধ হচ্ছিল। হয়তো
একটা চাপা লজ্জাও মাঝে মধ্যে ঘিরে ধরছিল আমায়। হঠাৎই
অরুণ আমার দিকে তার হাতটা বাড়িয়ে দিল। দেখলাম, সেই হাতে ধরা রয়েছে দুটো একশো
টাকার নোট। আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকাতেই
সে বলল, “বেশ
কিছু টাকা কামিয়েছি; তাই
এবার থেকে তোমায় মাইনে দিতে পারব।”
আমার বেশ আনন্দ হল, চুরির লজ্জা থেকে মুক্তির জন্য শুধু নয়, অরুণ যে সেটা বুঝতে পারেনি
একথা ভেবেই স্বস্তি পেলাম। টাকাগুলো
ফিরিয়ে দিয়ে আমি যে কোনও ভুল করিনি, এমন একটা বিশ্বাস মনের মধ্যে জন্মাল। সে
এক অদ্ভুত আনন্দ। এমন আনন্দ আমি কক্ষনও পাইনি; অন্তত চুরি করে পালানোর পর
নিশ্চিতভাবে পাইনি কোনোদিনও। হাসিমুখে
আমি টাকাটা নিলাম, আর
আমার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। টাকাটা
ভেজা!
হ্যাঁ, তখনও টাকাটা ভেজাই ছিল। গত
রাত্রের বৃষ্টির জল তখনও শুকোয়নি। অরুণ
জানত, সবটা
জানত। মুখ নামিয়ে রেখেছিলাম আমি।
অরুণ কাছে এগিয়ে এল, তারপর আমার মাথার চুলগুলো ঘেঁটে দিয়ে সে বলল, “আজ থেকে শুধু নিজের নাম লেখা
নয়, ভালোভাবে
পড়াশোনাটা শেখাব তোমায়।”
গতরাত্রের ঘটনার সবটুকুই সে জানত। তবুও
অরুণের স্নেহের ছটা আর উত্তাপের পরশ আমায় এক লহমায় যেন আরও অনেক বেশি কাছে টেনে নিল।
আমার অভিভাবকহীনতাও ঘুচিয়ে দিল নিমেষের মধ্যে।
আমি বুঝলাম যে এমন কিছু বৃষ্টি মানুষের জীবনে মাঝেমধ্যে আসে, যা শুধু সিক্ত করে দিয়ে যায়
না; সব
পাপ ধুয়ে দিয়ে যায়। সব গ্লানি মুছে দিয়ে যায়।
আমি চোখ তুললাম, আর আমার সেই সরল হাসিটা হাসলাম অরুণের দিকে তাকিয়ে।
তবে এবার আর সেটা জোর করতে আনতে হল না… নিজে থেকেই এল।
ছবিঃ লাবণি চ্যাটার্জি
No comments:
Post a Comment