সামান্য একটা খেলা
অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী
“ডু ইউ ওয়ান্ট টু প্লে চেস?” – ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে একটু
গম্ভীর গলায় কে যেন দূর থেকে বলে উঠল।
প্রশ্নটা শুনে চারদিকে তাকালাম। খেয়াল করলাম আমি যে
বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, সেই বাড়ির কাচের গার্ডেনরুমে বসা এক বৃদ্ধ
আমাকে ডাকছেন। গার্ডেনরুমের
সামনের দিকের কাচের দরজা খোলা। বৃদ্ধের গায়ে একটা ঢোলা প্যান্ট, ফুলহাতা সাদা শার্ট। গলায় স্কার্ফ জড়ানো।
ভদ্রলোক যেন এতক্ষণ দাবাখেলার সঙ্গীর জন্যই অপেক্ষা
করছিলেন।
“আমাকে বলছেন?”
“হ্যাঁ, আর কি কেউ আছে এখানে? ডু ইউ ওয়ান্ট টু প্লে চেস?”
বৃদ্ধ ইতিমধ্যে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। আমার
দিকে একটু এগিয়ে এলেন। বাড়ির বাগানের লন পেরিয়ে পাথরের নীচু দেয়ালের পাশে এসে ফের
বলে উঠলেন –
“তুমি কীরকম
খেলো? ভালো না হলে আমি আবার
খেলি না। মাঝখান থেকে আমারই সময় নষ্ট হবে।”
একটু অপমানিত বোধ করলাম। দাবায় বাংলার হয়ে একসময়
স্টেট লেভেলে খেলেছি। এখনও নিয়মিত খেলি। সেজন্যে স্বাভাবিকভাবেই এই দাবার বোর্ডের
দিকে দৃষ্টি গিয়েছিল।
সাদা-কালো মার্বেল দিয়ে তৈরি আঠেরো বাই আঠেরো ফুটের
স্কোয়ার চাতালই হল এখানকার দাবার বোর্ড। পাহাড়, সুইস কটেজ, উপত্যকা - সব কিছুর
মধ্যেও একটা চোখে পড়ার মতো বিশাল দাবার বোর্ড।
তবে এই ভদ্রলোক সম্বন্ধে আমি কিছুই জানি না। কীরকম
খেলেন তাও জানি না। তবে এত উৎসাহ যখন, তখন অ্যাভারেজ প্লেয়ার হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। খুব ভালোরা
এরকম উৎসাহ দেখায় না।
কয়েকদিনের জন্য ইংল্যান্ড থেকে সুইজারল্যান্ডে
অফিসের কাজে এসেছি। মাঝে একটু সময় পেয়ে বেড়াতে বেরিয়ে পড়েছি। আজ শনিবার। ছুটির দিন। সকাল ছ-টায়
জুরিখ থেকে বেরিয়ে এসেছি। জুরিখ থেকে ট্রেনে ইন্টারলেকেন। সেখান
থেকে ট্রেনে লেটারব্রুনেন হয়ে তারপরে কেবিলকারে আল্পসের উপরে ছোটো পাহাড়ি গ্রাম
মুরেন-এ। পৌঁছোতে পৌঁছোতে
দুপুর বারোটা বেজে গেছে। মুরেনে কোনো বাস বা গাড়ি চলে না। সব রকম গাড়ি চলাচল এখানে
নিষিদ্ধ।
তবে এখানে পা রাখার পর
থেকেই বুঝতে পেরেছি যে এই পরিশ্রম সার্থক। এরকম সুন্দর গ্রাম খুব কমই দেখেছি।
আল্পসের কোলে ছবির মতো সুন্দর সুইস ভিলেজ। এসব গ্রামের ছবিই বিশ্ব জুড়ে লাখো
পর্যটকের কাছে সুইজারল্যান্ডকে স্বপ্নের দেশ হিসেবে গড়ে তুলেছে।
একই সঙ্গে এই গ্রাম সাধারণ ট্যুরিস্টের পরিচিত
ম্যাপের বাইরে। সেজন্য মানুষের ভিড় নেই। সেলফিতে হারিয়ে যাওয়া ট্যুরিস্ট নেই।
দেড়ঘণ্টা ঘোরাঘুরি ও আল্পসকে কাছ থেকে দেখার পরে
পাহাড়ের খাদের ধারে একটা রেস্টুরেন্টে ইতালিয়ান পিৎজা দিয়ে বেশ ভালোই লাঞ্চ
সারলাম। তারপরে হাঁটতে হাঁটতে সেই গ্রাম পেরিয়ে আরও দূরে কোথাও এসে পড়েছি। এখানে
পাহাড়ের কোলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দু–একটা বাড়ি। মনে হচ্ছে যেন ক্যালেন্ডারের ছবির
উপর দিয়ে হেঁটে চলেছি।
সেরকমই একটা বাড়ির পাশে আমি এখন দাঁড়িয়ে। এরকম
বিশাল দাবার বোর্ড দেখে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। পাথরের বোর্ডের দু-দিকে
রাখা বড়ো বড়ো কাঠের গুটি। সেগুলো টেনে টেনে নিয়ে গিয়ে চাল দিতে হবে। বেশ
ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। কিন্তু সেটা দেখার জন্য উঁকিঝুঁকি দিতে গিয়ে বাড়ির ভেতর
থেকে যে এরকম খেলার ডাক আসবে, সেটা আগে ভাবিনি।
আমার উত্তর না পেয়ে আবার প্রশ্ন এল, “কী, বললে না যে? কীরকম খেলো? দিস ইজ নট এ গেম ফর
ইডিয়টস। মগজ লাগে।”
বৃদ্ধ তো বেশ উদ্ধত! নাকি আমি যাতে খেলি সেজন্য উসকানোর
চেষ্টা করছেন!
একটু অতিরিক্ত বিনয় দেখিয়ে বললাম, “না, না, আমি কিছুটা জানি। মাঝারি
মানের প্লেয়ার বলতে পারেন।”
মনে মনে বললাম, “মজা দেখাচ্ছি। কে জেতে দেখাচ্ছি। আপনি না আমি!”
“বাহ, তাহলে একটা ম্যাচ হয়ে যাক। তবে খেলা শেষ না করে কিন্তু
যাওয়া যাবে না। এ আমি আগেই বলে রাখলাম।”
হাতঘড়ির দিকে তাকালাম। বিকেল তিনটে বাজে। এই বছর
সত্তরের বুড়োকে হারাতে মিনিট কুড়ির বেশি লাগবে বলে মনে হয় না। তাছাড়া এরকম অপূর্ব
পরিবেশের মাঝে বসে খেলার লোভ সামলানো যায় না।
কাঠের বিশাল সুইস কটেজের তিনদিক দিয়ে ফুলের বাগান।
সে বাগানে যেন রঙের প্লাবন লেগেছে। লাল, হলুদ, কমলা, নীল কত রঙের ফুল। সে বাগান যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানেই শুরু হয়েছে ঘাসে
ছাওয়া সবুজ উপত্যকা। সে উপত্যকার ঢাল উপরের দিকে ক্রমশ উঠে পাহাড়ে মিশে গেছে। দূরে
পাইনের বন ও তারও উপরে বরফঢাকা পাহাড় দেখা যাচ্ছে।
এরকম দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য রোজ হয় না।
দূর থেকে টুং টুং শব্দ ভেসে আসছে। গোরুর গলার ঘন্টির থেকে এই আওয়াজ। ভারী মিষ্টি সুর। যেন কোনো
শিল্পী আপনমনে বাজিয়ে চলেছে। আশেপাশের উপত্যকাতেই কোথাও গোরুগুলো চরছে। মাথার উপরে
নির্মেঘ নীল আকাশ। নীল আকাশ, সবুজঘাসে ঢাকা উপত্যকার মাঝে কেউ যেন এই বাড়ির ছবি তুলির
রঙে এঁকে রেখেছে।
খেলব বলে সম্মতি জানালাম।
বৃদ্ধ সেটা শুনে ভারী খুশি হয়ে উঠলেন। দুটো চেয়ার
টেনে বোর্ডের দু-দিকে রাখলেন। দূরে একটা টেবিলে কফির সরঞ্জাম
রাখা ছিল। ওঁর অনুরোধে এক কাপ ব্ল্যাক কফি খেয়ে খেলা শুরু করলাম।
খেলতে গিয়ে শুরুর কিছু দান দেওয়ার পরপরই বুঝলাম
বৃদ্ধকে আন্ডার-এস্টিমেট করে বড়ো ভুল করেছি। বৃদ্ধ মোটেই সাধারণ কোনো প্লেয়ার নন।
আমি সাদা গুটি নিয়ে চাল দিচ্ছিলাম। আমার ফেভারিট
ওপেনিং রুই লোপেজ-এর একটা বিশেষ ভ্যারিয়েশন ধরে খেলাটা এগিয়ে চলল। মিডল গেমে যখন পৌঁছোলাম, তখনও বেশ সমান-সমান
অবস্থা। বৃদ্ধ বেশ ভালোই লড়াই করছেন।
এর মধ্যে বৃদ্ধ দেখি বিড়বিড় করে বলে উঠলেন, “ঠিক এই খেলাটাই ইমানুয়েল
লাস্কার সাদা ও উইলিয়াম স্টাইনিৎজ কালো গুটি নিয়ে খেলেছিল ১৮৯৬ সালে মস্কোতে। স্টাইনিৎজ-এর একটা ভুলে
লাস্কার জিতেছিল সে ম্যাচটা। কিন্তু এবারে তো আর সেটা হবে না।”
বলে নিজের দানের মধ্যে দাবার বোর্ডের চারদিক দিয়ে
ঘুরে ঘুরে খানিকক্ষণ হাঁটতে লাগলেন। নিজের মনে কীসব যেন বলতে লাগলেন। হাঁটতে হাঁটতে বোর্ডের
বিভিন্ন দিক থেকে তাকিয়ে নানান লেভেল থেকে দেখতে লাগলেন। প্রথমবার প্রশ্ন মনে এল, লোকটা স্বাভাবিক তো?
আমি ফের পাহাড়ের দিকে তাকালাম।
বাগানের পাশে পাহাড়ের ঢাল বরাবর বিস্তৃত ঘাস
উপত্যকায় অনেক সাদা ভেড়া চরে বেড়াছে। কিছু ভেড়ার বাচ্চাও আছে।
ইতিমধ্যে দান দিয়ে আমার
দৃষ্টি লক্ষ্য করে বৃদ্ধ বলে উঠলেন, “ওগুলো
সবই আমার ভেড়া। প্রায় একশোর বেশি আছে। ওদের নিয়ে আমার বেশ সময় কেটে যায়। এ ছাড়া
আমার বাড়িতে তিনটে ঘোড়া আছে।
এখানে গাড়ি নেই বলে ওদের নিয়ে বেরোই মাঝে-মধ্যে। তবে ঘোড়াগুলোর ভালোই বয়স হয়েছে
আমার মতোই। তবু এখনও আমার মতোই লড়াকু।”
বৃদ্ধকে দেখে মনে হয় বয়স সত্তরের উপরে হবে। তবে বেশ
শক্তসমর্থ আছেন এখনও। চোখের চাউনিটা অদ্ভুত। ইস্পাত কঠিন। যেন কোনো অনুভূতির
স্পর্শ নেই তাতে।
বলে উঠলেন, “বুঝলে দাবা খেলাটা হল জীবন-মরণের
মতো সত্যিকারের যুদ্ধ। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে থামার কোনো জায়গা নেই। এখানকার বোড়ে, গজ, নৌকো, রানি প্রত্যেকে রাজাকে
বাঁচানোর জন্য যে-কোনো
সময়ে মৃত্যুবরণ করতে প্রস্তুত। দে উইল ফাইট টিল ডেথ।”
এই কথার অর্থ বুঝলাম না। অবশ্য এরকম প্রত্যন্ত
জায়গায় থাকতে থাকতে মানুষ যে একটু অস্বাভাবিক হয়ে যাবে, একটু উলটোপালটা কথা বলবে, এতে আর আশ্চর্য কী!
“আপনি কতদিন আছেন এখানে?” জিজ্ঞেস করে উঠলাম।
“এখানেই জন্ম। ছোটো থেকেই আছি।”
“আপনি এখন একা থাকেন?”
হেঁয়ালি করে বলে উঠলেন, “আমার সৈন্যরা আছে, রানি আছে। একা থাকব কেন?”
বলে আরেকটা চাল দিলেন।
কেন জানি না যত খেলা এগোচ্ছে, মনে হচ্ছে এই বৃদ্ধ কোনো
সাধারণ দাবাড়ু নয়। কিছু বড়ো টুর্নামেন্ট জিতে থাকলেও অবাক হব না। যেভাবে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিচ্ছেন, পরের দু-তিন চাল ভেবে
নিয়ে ফাঁদ পাতছেন,
তাতে উনি যে একসময় অসাধারণ দাবাড়ু ছিলেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
আরও কয়েকটা চালের পরে একটা চালে সত্যি বিপদে পড়ে
গেলাম। একেবারে আন-এক্সপেক্টেড। আমার এক বোড়ে খেয়ে ওনার গজ স্যাক্রিফাইস করলেন। তারপরে যেন মুচকি হাসলেন
নিজের মনে।
গজটা আমি একটা বোড়ে দিয়ে খেয়ে নিতেই পারি, কিন্তু লক্ষ করলাম তার
কয়েক চাল পরে আমার নৌকো চলে যাবে। বিপদে পড়ে যাব। তবে এখনই সবকিছু শেষ হয়ে
যায়নি।
আরও বেশ কিছুক্ষণ খেলা চলল।
খেলা যতই এগোতে লাগল, ততই বুঝতে পারলাম আমার হারা
অবশ্যম্ভাবী। পজিশন বেশ খারাপ। বৃদ্ধ কোনোরকম ভুল না করলে আমি হারবই।
যদিও গেম শেষ হতে এখনও বেশ খানিকক্ষণ লাগবে।
সময় হাতে বেশি নেই। এবারে বেরোতে হবে। খেলতে খেলতে
দেড়ঘণ্টা হয়ে গেছে। জুন মাসের দীর্ঘদিন। তাই বাইরের আলো ন-টা অবধি থাকলেও ফেরার
কেবিলকার থাকবে না। ছ-টায় এখান থেকে শেষ কেবিলকার। সেটা মিস করলে আর ফেরার
কোনো উপায় থাকবে না।
বলে উঠলাম, “আমি খুব দুঃখিত। এবারে আমাকে উঠতে
হবে।”
বৃদ্ধ যেন কথাটা শুনলেনই না।
আবার বলে উঠলাম।
এবারে আমার দিকে তাকালেন। মুখে অবিশ্বাসের চিহ্ন।
রেগে বলে উঠলেন, “হোয়াট ডু ইউ মিন? খেলা ছেড়ে মাঝপথে চলে
যাবে? এরকম হতেই পারে না।”
বলে আবার বোর্ডে মনোনিবেশ করলেন।
ফের বলে উঠলাম, “জুরিখে আছি। কাল ভোরে ইংল্যান্ডে
ফেরার ফ্লাইট। এখনই না বেরোলে শুধু কেবিলকার নয়, জুরিখ যাওয়ার ট্রেনও মিস করব। তার
পরের ট্রেন তো ভোরবেলা। কাল সকালের ফ্লাইটও মিস করব সেক্ষেত্রে। আর বড়োজোর দশ মিনিট।
আমাকে দশ মিনিটের মধ্যে বেরোতেই হবে।”
“উঁহুঁ, সে হচ্ছে না। খেলা শেষ না করে কোনোভাবেই বেরোতে পারবে না।
শুরুতেই বলে দিয়েছিলাম। এটা কী শুধু একটা খেলা! তাকিয়ে দেখো বোর্ডের দিকে। তোমার
কাজ হল এখানে ডাক্তারের মতো। যতই তাড়া থাকুক না কেন, যত দরকারি কাজই থাকুক না
কেন, ওদের বাঁচানোর দায়িত্ব
তোমার, শুধু তোমার। ওদের জীবন-মরণ তোমার উপরে
নির্ভর করছে। কী করে তুমি ওদের এভাবে ফেলে পালিয়ে যাবে! আর ইউ ম্যাড?” চিৎকার করে উঠলেন বৃদ্ধ।
আমি বুঝলাম এ নির্ঘাত কোনো পাগলের পাল্লায় পড়েছি।
আমি তবু মরিয়া হয়ে খেলা ছেড়ে উঠতে গেলাম। বৃদ্ধ এবারে গম্ভীর গলায় ‘ডেভিড’
বলে কাউকে ডাক দিলেন। ভাবলাম কোনো বৃদ্ধ চাকর হবে হয়তো। কিন্তু যে ঘর থেকে বেরিয়ে
এল, সেই ডেভিডের দেখা পেয়ে হাত-পা
ঠান্ডা হয়ে গেল। একটা বেশ বড়ো সাইজের কুকুর বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে।
রট হুইলার। কুকুর আমি ভয় পাই। এ কুকুর আবার হিংস্র বলে পরিচিত।
এ কী বিপদে পড়লাম!
কুকুরটা কাছে এসে আমার গন্ধ শুঁকে পাশেই একহাত দূরে
বসে পড়ল। ওর হিংস্র চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হল বৃদ্ধের অর্ডার পেলেই আমার উপরে
ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমি বেরোতে গেলে এরকম পাগল বৃদ্ধ যে সেরকম করতে দ্বিধা করবেন না, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত।
বৃদ্ধ আমার দিকে তাকিয়ে ফের বলে উঠলেন, “আমার সঙ্গে ম্যাচ অসমাপ্ত
রেখে কেউ কোনোদিন এখান থেকে বেরোতে পারেনি।”
বৃদ্ধের চোখ যেন জ্বলে উঠল। সে চোখ ওই কুকুরের
থেকেও বেশি হিংস্র।
আরও পাঁচটা দানের পরে আমি বলে উঠলাম, “আমি সারেন্ডার করছি। হেরে
গেছি।”
বৃদ্ধ ফের মাথা নাড়িয়ে বলে উঠলেন, “উঁহুঁ। এখনও অনেক খেলা বাকি আছে।
এখনও আমি ভুল করলে হেরে যেতেও পারি। সহজ জয় আমি চাই না। একেবারে শেষ অবধি খেলতেই
হবে। একেবারে রাজার মৃত্যু অবধি।”
বুঝলাম এঁকে অন্য কোনোভাবে বোঝানো যাবে না। খেলতেই
হবে।
মাথা কাজ করছিল না। এই বিদেশ-বিঁভুই-তে এসে কী
বিপদে পড়া গেল! এ কোন পাগলের পাল্লায় পড়লাম।
বাইরে আলো কমে এসেছে। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে
বৃদ্ধ বলে উঠলেন, “দেখো
হারা-জেতা হতেই পারে। জীবনটাই তো হারা-জেতার। কিন্তু শেষ অবধি লড়তে হবে। এই যে এক-একটা
গুটি পড়ে যাচ্ছে, তার
সঙ্গে সঙ্গে তোমার-আমার সৈন্যরাও বিদায় যাচ্ছে। এটা শুধু খেলা নয়। আসলে
জীবন-মৃত্যু।”
“আমাকে এবারে প্লিজ যেতে দিন,” কাঁদোকাঁদো হয়ে ফের বলে উঠলাম, “প্লেন মিস হয়ে যাবে।”
“এ আবার বড়ো কথা কী? অন্য প্লেনে যাবে। ফোকাস অন ইয়োর
গেম। এত হালকাভাবে নিয়ো না। অনেকের জীবন-মৃত্যু এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে।”
বৃদ্ধ যে পুরোপুরি অস্বাভাবিক, এরকম কিছু কথা শুনলেই
বোঝা যাচ্ছে।
উনি ফের বলে উঠলেন, “ওই যে দূরে ভেড়াগুলো দেখছিলে, ওদের মধ্যে আমার বোড়েরাও
আছে। দেখো ক’টা বোড়ে গেছে আমার। তিনটে, তাই না?”
“হ্যাঁ,” অবাক হয়ে ফের বলে উঠলাম, “হ্যাঁ, তিনটে কালো বোড়ে গেছে।”
বৃদ্ধ হঠাৎ উপত্যকার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, “ভালো করে দেখো। দেখতে পাচ্ছ? আমার তিনটে ভেড়া মারা
গেছে।”
কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলাম। গলা কেঁপে উঠল, “কী হচ্ছে ওখানে?”
তিনটে বড়ো সাদা ভেড়া যেন মাঠের মধ্যে মরে পড়ে আছে।
আমি উত্তেজিত হয়ে ওদিকে এগিয়ে গিয়ে বলে উঠলাম, “আচ্ছা, ওই ভেড়াগুলো আগে তো
চলছিল-ফিরছিল। এখন? সত্যি
মারা গেছে?”
“সে কী? তুমিই তো মারলে! এর মধ্যে ভুলে
গেলে। একটা একটা করে গুটি বাইরে যাবে আর ওরা মারা যাবে। সেজন্যই তো এত সাবধানে
খেলতে হয়।”
হঠাৎ মনে হল বৃদ্ধ শুধু পাগল নয়। যেন তার থেকেও
অনেক বেশি কিছু। এ কী বলছেন! কিছুক্ষণ বাদে আমি একটা সাদা বোড়ে দিয়ে ওনার একটা
কালো বোড়ে খেলাম। অবাক হয়ে উপত্যকার দিকে তাকিয়ে দেখলাম আরেকটা ভেড়া, হ্যাঁ, ঠিক তাই, আরেকটা ভেড়া মাঠের মধ্যে
যেন বসে পড়ল। তারপরে আর নড়ল না।
মারা গেল? এ কী আমি স্বপ্ন দেখছি? হাত-পা সব যেন ঠান্ডা হয়ে গেল।
এরপরে কোনো কথা আর বলিনি। খেলা আরও বেশ খানিকক্ষণ
হল। শেষে হারলাম। আমার রাজা চেকমেট হতেই বৃদ্ধ উত্তেজিত হয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, “মারিয়া, মারিয়া। বেরিয়ে এসো।”
তারপরে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে করমর্দন করলেন। বললেন, “মন খারাপ কোরো না। ইউ
রিয়ালি প্লেড ওয়েল। তুমি যে এতটা ভালো খেলবে, সেটা আমি আশা করিনি। আমি খুব
নিশ্চিন্ত হলাম। আমার স্ত্রী মারিয়া এখন তাহলে সুস্থ হয়ে উঠবে। খুব অসুস্থ ছিল।
আমার কুইন। তুমি জিতলে বা আমি মন্ত্রী হারালে আজই মারা যেত। মারিয়া!”
বলে জোরে চেঁচিয়ে উঠলেন।
দেখি এক বৃদ্ধা ইতিমধ্যে দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন। দেখেই মনে হল খুব অসুস্থ।
বৃদ্ধ বলে উঠলেন, “আর
ইউ ফিলিং বেটার?”
অত্যন্ত রুগ্ন চেহারার সেই বৃদ্ধা মাথা নাড়িয়ে
সম্মতি জানালেন।
আমি কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। এ কোন
পাগলের পাল্লায় পড়েছি! আমি এবারে উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ালাম। কেবিলকার পাই বা না
পাই, এখানে আর একমুহূর্ত থাকা
উচিত নয়।
আমি ছুটে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলাম। কিছুদূর গিয়ে
আমার মাথায় এক অদ্ভুত প্রশ্ন এল। কেন এরকম অস্বাভাবিক প্রশ্ন এল, সেটা জানি না।
ফিরে এলাম। সেই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এখন দুজনে পাশাপাশি
বসে আছেন।
আমি জোরে চেঁচিয়ে বলে উঠলাম, “আচ্ছা, আমার সৈন্য তাহলে কারা? আমারও কী ওরকম সৈন্য
আছে!”
“অবশ্যই। আশ্চর্য, তুমি সেটা না জেনেই আমার
সঙ্গে খেলতে বসে গেলে। আমি তোমাদের এপিক মহাভারত পড়েছি। সেখানে যেমন যুধিষ্ঠির না
বুঝে-শুনে পাশাতে চাল দিচ্ছিল, সেরকম দেখছি তুমিও না বুঝে একের পর এক চাল দিয়ে দিয়েছ?”
আমি কোনোরকমে বলে উঠলাম, “আমার বোড়ে কারা? ওখানে ওই ভেড়াদের মধ্যে
আছে?”
“নো, নো, দে আর অল মাইন। আমার। তোমার ভেড়া, তোমার রানি, তোমার নৌকো কোথায় - তা
আমি কী করে জানব? তোমার
সেটা জানা উচিত।”
আমার মনে হল ছুটে গিয়ে বৃদ্ধের টুটি চিপে ধরি।
কিন্তু বৃদ্ধ দেখি ফের বলে উঠলেন, “ওই যে আমার দুটো ঘোড়া
মারা গেল আজ খেলতে খেলতে, তা নিয়ে আমি কিছু বলেছি? ইটস অল পার্ট অফ আ গেম। তুমি
দেখে আসো আমার তিনটে ঘোড়ার মধ্যে দুটো ঘোড়া, দুটো এতদিনের প্রিয় ঘোড়া - সুগার
ও ডাস্টি - দুটোই এখন মৃত। আমি কী কেঁদেছি সেজন্যে? কে বলতে পারে তোমার জন্য আজ কে
কে প্রাণ দিল?”
আমি আর একমুহূর্ত দাঁড়ালাম না। থাকলে বৃদ্ধকে খুন
করে ফেলব। এসব আমি কী ভাবছি!
অবসন্ন হাতে আমার ফোনের দিকে তাকালাম। ফোনে চার্জ নেই। কখন যে
সুইচড অফ হয়ে গেছে,
খেয়াল করিনি।
রাস্তা দিয়ে ছুটতে শুরু করলাম। যদি এখান থেকে এখনও
ফেরার কেবিলকার পাওয়া যায়। বাড়ির সবাই, সবকিছু ঠিক আছে তো?
টের পেলাম বুকের মধ্যে যন্ত্রণা হচ্ছে। দৃষ্টি যেন
অস্পষ্ট হয়ে আসছে। তবু কোনোরকমে কেবিলকারের দিকে ছুটতে শুরু করলাম। আমি কী বৃদ্ধের
কথা বিশ্বাস করতে শুরু করেছি? এরকম একটা অবিশ্বাস্য কথা!
মুরেনের সরু রাস্তা দিয়ে ছুটতে লাগলাম। খানিক বাদে
একটা ছোটো স্টেশনারি দোকান পড়ল। তার মধ্যে টিভি চলছে। কী জানি
ভেবে দোকানে ঢুকে টিভির দিকে তাকাতেই খবরটা চোখে পড়ল।
ব্রেকিং নিউজ – ‘মেজর বম্ব ব্লাস্ট ইন অক্সফোর্ড
সার্কাস এরিয়া অফ লন্ডন।’
২১ জন মৃত, অজস্র আহত।
আচ্ছা, আমার স্ত্রী, দুই পুত্র - ওদের আজ ওখানেই যাওয়ার কথা ছিল না?
বসে পড়লাম দোকানের মেঝের উপরে। মনে হল চোখের সামনে
হঠাৎ যেন ঘন অন্ধকার নেমে এল। এক চেকমেট হওয়া রাজার মতো।
বোর্ডে আমার রানি আর দুটো নৌকো হারানোর সঙ্গে সঙ্গে
কী ওরা আর নেই?
সত্যি নেই?
আস্তে আস্তে চোখের সামনে আবার সব স্পষ্ট হয়ে আসছিল।
খেয়াল করলাম আমাকে ঘিরে এখন অনেকজনের ভিড়।
জার্মান ভাষায় কথা হচ্ছে।
কে যেন বলে উঠল, “লোকটার জ্ঞান ফিরেছে।”
পাশ থেকে আরেকজন বলল, এবারে আমাকে লক্ষ করে, “কেমন মনে
হচ্ছে?”
আমি আস্তে আস্তে উঠে বসলাম।
বলে উঠলাম, “ভালো, বেটার মনে হচ্ছে। হঠাৎ শরীরটা কেন জানি...”
সঙ্গে সঙ্গে খেয়াল হল আবার, খানিক আগেই খেলায় হেরে কী
হারিয়েছি আমি।
কান্নায় গলা
অবরুদ্ধ হয়ে এল।
কেউ নেই আর!
ফ্যামিলি বলে আর কিছু নেই। এবারে একজন আমার কাঁধে হাত দিয়ে বলে উঠল, “কী হয়েছে?”
কোনোরকমে বলে উঠলাম গত দেড়ঘণ্টার ঘটনা, কীভাবে আমি আমার
স্ত্রী-পুত্রদের হারিয়েছি। লোকটা শোনার পরে হেসে উঠল, সঙ্গে অন্যরাও।
আবার বলে উঠল লোকটা, “মিলার পারেও বটে, গল্প বানাতে। শোনো, আমি নিশ্চিত তোমার
কিছুই হয়নি।
তোমার ফোন
তো সুইচড অফ, আমার ফোন থেকে বাড়িতে ফোন করো। দেখবে সব ঠিক আছে, কারও কিছু হয়নি, সব বানানো গল্প।”
“কিন্তু ওই ভেড়াগুলো? একটা একটা করে যারা মারা যাচ্ছিল?”
“কিছু হয়নি, বললাম তো। মিলার শুধু ভালো দাবাড়ু নয়, দারুণ
ম্যাজিশিয়ান, ইলিউশনিস্ট। যা
চাইবে তাই দেখিয়ে দেবে। নাও
বাড়িতে ফোন করো।
ও এভাবে মজা
করে সবার সঙ্গে,” বলে আমার হাতে ফোনটা দিল।
কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পরেই ফোনের উলটোদিকে চেনা গলা শুনলাম,
“হ্যালো, কে বলছেন?” – আমার স্ত্রী মীনার গলা।
আমি শুধু বলে উঠলাম, “তোমরা সবাই ঠিক আছ তো?”
----------
ছবি - অতনু দেব