অর্জুন মাঝি
অঙ্কন মুখোপাধ্যায়
তখনও দেশ স্বাধীন হয়নি। ইংরেজ বাহিনী
দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এই বঙ্গে, তথা গোটা দেশের বুকের উপর। আর সেই শোষণ কার্যে ইংরেজ দস্যুদের সদা সাহায্য করে চলেছেন দেশীয় কিছু
অর্থলোলুপ জমিদার শ্রেণির মানুষ। নারায়ণ
রায় ছিলেন তেমনি একজন জমিদার। পুরুলিয়ায় রাইসুলো গ্ৰামে তার পৈতৃক বাড়ি। আশেপাশের কয়েকটি গ্ৰাম নিয়ে তাঁর
জমিদারি। তখনও অবশ্য পুরুলিয়া জেলার
জন্ম হয়নি। পাথুরে জঙ্গলে ঢাকা সারা
অঞ্চলটাই জঙ্গলমহল হিসেবে পরিচিত ছিল। এই ঘটনা সেই সময়ের। রাইসুলো গ্ৰামের উত্তর দিক দিয়ে বয়ে গেছে শিলাবতী নদী।
কেউ কেউ বলে শিলাই নদী। নদীতে সারাবছর জল থাকে না। জল হয় বর্ষার দিনে। বর্ষায় ফুলে-ফেঁপে ওঠে শিলাবতী। পুরুলিয়ায় জন্ম নিয়ে শিলাবতী বয়ে গেছে এখনকার বাঁকুড়া ও পরে
মেদিনীপুরের মধ্যে দিয়ে।
সেই শিলাবতী নদীতে খেয়া বায় অর্জুন মাঝি।
নামের সঙ্গে ‘মাঝি’ শব্দ জুড়ে থাকলেও তার জাত কেউ জানত না।
অর্জুন মাঝি জাতিতে বামুন, কায়স্থ, চাষা, দুলে, ডোম, সাঁওতাল
ইত্যাদি আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোক ছিল নাকি মুসলমান তা কেউ বলতে পারত না।
তাকে দেখে বোঝাও যেত না কিছু। ডাঙায় তার কোনো ঘর ছিল না। নদীর উপর নৌকা, সেই নৌকায় ছিল অর্জুন
মাঝির ঘর-বসত। সেখানেই বসা, সেখানেই শোয়া। গ্ৰামের মানুষজন অর্জুন মাঝিকে বড়ো পছন্দ করত। ভালোবাসত সকলে।
অর্জুন মাঝি গরিব-গুর্বো মানুষের কাছে দাম নিত না নদী
পারাপারের জন্য। কত বয়স্ক মানুষকে সে
এমনিই পার করেছে মূল্য ছাড়া। কোনো বৃদ্ধা হয়তো মূল্য দিতে গেছেন নদী পারাপারের জন্য, তখন অর্জুন মাঝি হাত
জোড় করে থামিয়ে দিয়েছে তাকে, ‘রাখো গো
তুমি, ও ট্যাকা তুমার কাছপানেই রাখো।
মায়ের কাছ থিকা কি দাম লিয়া যায়। আমার পাপ লাগবেক নাই।’
সেবার জমিদার নারায়ণ রায় নদী পেরিয়ে বাসবপুর গ্ৰামে যাবেন খাজনা আদায়
করতে। রাইসুলো গ্ৰামের ঘাটে নৌকা
বাঁধা হয়েছে। অর্জুন মাঝির নৌকা।
অর্জুন মাঝি ভোর-ভোর সব গুছিয়ে অপেক্ষা করছিল নারায়ণ
রায়ের জন্য। সূর্য একটু উঠতেই নায়েব জনার্দন
চৌধুরী ও দু-জন পশ্চিম-দেশীয় লাঠিয়ালকে নিয়ে এসে নৌকায় উঠলেন জমিদার নারায়ণ
রায়। একটা বসার কাঠের আসন আগে থেকে রাখা ছিল জমিদারের জন্য।
সেই আসনে বসেই নারায়ণ রায় ভাবছিলেন তাঁর উজ্জ্বল
ভবিষ্যতের কথা। নৌকা দুলছে মৃদু তালে, সেই
তালে দুলছে জমিদার নারায়ণ রায়ের হৃদয়। নদীর বাতাসে উড়ছে তাঁর গায়ের চাদর। এবারের
খাজনার বিষয়টা যদি ঠিক থাকে, যদি
ইংরেজ হেমিলটন সাহেবকে খুশি করা যায় তা দিয়ে, তবে ‘রায়বাহাদুর’ খেতাবটা পাওয়ার স্বপ্ন
পূরণ হবে। নারায়ণ রায়ের বহুদিনের শখ
নামের শেষে ‘রায়বাহাদুর’ উপাধিটা পাওয়া।
বাঁকুড়ার সোনামুখীর জমিদার নবীনরামকে পাল্লা দেওয়া যায় তবে।
নবীনরাম আগেই একটা উপাধি বাগিয়েছেন সাহেবকে ধরে।
এই একটা জায়গায় একটু পিছিয়ে ছিলেন রাইসুলোর নারায়ণ
রায়। এবার ভালোয় ভালোয় সবটা
হলে পাল্লাখানা সমান হবে অন্তত। আজকের দিনটা বড়ো গুরুত্বপূর্ণ তাই তাঁর কাছে।
বাঘা বাঘা দু-জন লাঠিয়াল তো নিয়েছেনই, বেগতিক কিছু দেখলে শেষে কথা বলবে তাঁর হাতের চাবুক। বেঁকে বসা প্রজাদের কীভাবে সোজা করতে হয়, তা ভালো করেই জানেন নারায়ণ রায়। বাঁকা
হাসি খেলে গেল ওনার ঠোঁটে। হাতে ধরা শংকর মাছের চামড়া দিয়ে তৈরি চাবুকটা একবার শূন্যে ঝালিয়ে নিলেন। অর্জুন মাঝির দৃষ্টি পড়ল নারায়ণ রায়ের হাতে ধরা চাবুকটার দিকে।
অর্জুন মাঝির নৌকা দুলে দুলে এসে নোঙর করল বাসবপুরের ঘাটে।
সূর্য কড়া হয়েছে খুব।
গরমের সময়। নায়েব জনার্দন চৌধুরী বগলের নীচে ধরা ছাতাটা খাটিয়ে মেলে ধরলেন নারায়ণ
রায়ের মাথায়, “ইবার চলেন কর্তা।”
লাঠিয়াল বাহিনীর সঙ্গে চলে গেলেন নারায়ণ রায়।
অর্জুন মাঝি অপেক্ষা করতে লাগল নিজের নৌকায় বসে।
চারিদিকে ঘন সবুজ জঙ্গল। সেই জঙ্গলের স্থানে স্থানে উঁচু-নীচু পাথুরে
জমি। সেই বন্ধুর জঙ্গুলে
পরিবেশের কিছুটা বাসযোগ্য করে তুলেছে এখানকার আদিবাসী নর-নারীরা তাদের রক্ত জল করে। জঙ্গল
ভেদ করে গড়ে তোলা সেই জমিতে স্থাপন করেছে তাদের বসতি। পাথুরে মাটিকে চাষযোগ্য করে শুরু করেছে ধান বোনা। পালন করছে হাঁস, মুরগি, ছাগল ইত্যাদি প্রাণী। জমিদার নারায়ণ রায় আজ এসেছেন খাজনা আদায় করতে।
কারণ এই জমিতে আদিবাসীরা বসবাস করলেও এই জমি খাতায়-কলমে
জমিদারের। আর জমিদার ইংরেজের অধীনে। জমির আসল মালিক ইংরেজ কোম্পানি। তাই, জমিদারের দফতর হয়ে খাজনা যাবে ইংরেজের ঘরে।
“বীরেশ্বর মাহাতো...? বীরেশ্বর এসচ্ছিস...? ও বাপ
বীরেশ্বর এসচ্ছিস না আসিস নাই?” জমিদারের
নায়েব জনার্দন চৌধুরী কয়েকবার হাঁক দিতে ভিড়ের মধ্যে থেকে এগিয়ে এল একজন
স্থানীয় প্রায়-বৃদ্ধ মানুষ। গ্ৰামের ঠিক মধ্যিখানে একটা পলাশছায়ায় বসেছে জমিদার নারায়ণ রায়।
তাঁর ডাইনে-বাঁয়ে বিশ্বস্ত লাঠিয়াল দু-জন ভীমকায় হয়ে
দাঁড়িয়ে। গ্ৰামের মানুষজন গোল করে
ঘিরে আছে কাছে-দূরে। পুরুষেরা
কাছে কাছে, মহিলারা দূরে দূরে। নায়েব জনার্দন চৌধুরীই সবটা দেখছেন তদারকি করে, “বীরেশ্বর মাহাতো তুমার হয়েছে এগারো গন্ডা চার কড়া আর সঙ্গে দশ বস্তা ধান।” জাবেদা খাতা থেকে মুখ তুলে নায়েব
জনার্দন চৌধুরী বললেন, “তু উই দশ গন্ডা চার কড়া
দিস। তুর জন্য জমিন্দারবাবু একগন্ডা
মাফ দিয়েছেন।”
বীরেশ্বরের মেয়ে রাংতি জমিদার বাড়িতে যায় বেগার খাটতে।
জমিদারের বাড়ির নানান কাজ করে রাংতি।
বড়ো বাড়ি, ওখানে কাজের অভাব নেই। খামার পরিষ্কার, ঘরদোর পরিষ্কার, গোয়াল কাটা, গোরু ছাগল ছাড়িয়ে আনা সহ যত কাজ রাংতি করে আসে। তার বদলেই একগন্ডা মাফ পেয়েছে রাংতির বাপ বীরেশ্বর মাহাতো আজ।
“বাদি মুড়া কুথায়? সামনেপানে আয় বাপ!” বীরেশ্বর মাহাতো ভিড়ে মিশে গেলে এগিয়ে এল বাদি মুড়া। বাদি মুড়ার শিরদাঁড়া নুয়ে পড়েছে সামনে দিকে। কালো চামড়া আবৃত দেহটায় একটুও মেদের চিহ্ন নেই। যেন একটা জীবন্ত নরকঙ্কাল। মাথার চুল পড়ে গিয়ে নেড়া।
উঠতে বসতে শরীর কাঁপে।
বাঁশের লাঠিতে ভর দিয়ে কোনোরকমে পায়ে পায়ে এসে
দাঁড়াল বাদি মুড়া।
“বাদি মুড়ার হয়েছে পনেরো গন্ডা পাঁচ কড়া।
আর সঙ্গে পাঁচ বস্তা ধান।”
অত বড়ো হিসেব জানে না বৃদ্ধ বাদি মুড়া।
খুব হিসেব জানত বাদি মুড়ার বেটা নান্দি মুড়া।
কিন্তু সে জোয়ান ছেলেটা ভেদবমি হয়ে মরল গত বছর। মড়ক লেগেছিল যেন গত বছর এই অঞ্চলে। গ্ৰামের
বাকি দুর্ভাগাদের সঙ্গে বাদি মুড়া বেঁচে গেছিল। কিন্তু ছেলেটা বাঁচেনি। একটা
নাতি আছে আশার প্রদীপের মতো এখন শুধু। নাতির
বয়স ছয়, বাধ্য হয়ে একাই এসেছে বাদি মুড়া আজ এই খাজনার আসরে। সে একবস্তা ধান জোগাড় করে এনেছে কোনোরকমে। এর বেশি দেওয়ার ক্ষমতা বাদি মুড়ার আর নেই।
কিন্তু একবস্তা ধানে তো আর জমিদারের গোলা ভরবে না।
জমিদারের ধানের গোলা জমিদারের লোভের মতোই বৃহৎ। যত দেওয়া হোক, ও গোলা ভরে না কিছুতেই।
যেন এক সর্বগ্রাসী গহ্বর!
“এইটুকুন মাত্র ধান নিয়ে বদন দেখাতেক এসেছিস বটে।
এতক বুড়া হয়েছিস, লাজ শরম নাই রে তোর? দেখেন
কর্তা দেখেন, বুড়ার কাণ্ডখান দেখেন...” শেষ
কথাগুলো জমিদার নারায়ণ রায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন নায়েব জনার্দন চৌধুরী।
“ছাওয়ালটা ছিল চাষবাস করতক। আমি আর পারিক নাই গো হুজুর। শরীর সাথ দেয় নাই। শুধু
লাতিটার জন্য দুটো দুটো করি। আপনের
জন্য এই একবস্তায় ভরতে পারিছি।”
“আর ঘরকে ক-বস্তা
তুলিছিস রে শয়তান?” জলদগম্ভীর কণ্ঠে বলে
উঠলেন জমিদার নারায়ণ রায়।
জমিদারের এই একটা কথায় কেঁপে উঠল বাদি মুড়ার বুক। হ্যাঁ, সে আরও একবস্তা ধান জোগাড় করে
লুকিয়ে রেখেছে তার ঘরে। তবে যা
করেছে তা নিজের জন্য নয়, সবটাই ওই
ছোট্ট নাতিটার মুখ চেয়ে। কিন্তু
জমিদার নারায়ণ রায় বড়ো চতুর। তার চোখকে ফাঁকি দেওয়া কঠিন কাজ।
লাঠিয়াল দু-জন জমিদারের নির্দেশ পাওয়ামাত্র বাদি মুড়ার ঘরে তাণ্ডব
চালিয়ে লুকিয়ে রাখা একজালা ধান তুলে আনল ভরা সভায়। বাদি মুড়ার বুক কাঁপছে দুরু দুরু করে। যেন করম পূজার মাদল।
জমিদারের চোখে আগুন, “বটে...” উঠে দাঁড়ালেন জমিদার, “খাজনার ধান লুকাই রাখিছ ঘরকে। আর বলছ
খাজনা জোগাড় হয় নাই। জমিন্দারকে বোকা ভাবিছ? শয়তান...” নায়েব জনার্দন চৌধুরী তাঁর হাতে তুলে দিলেন সঙ্গে আনা শংকর
মাছের চামড়ার তৈরি চাবুকটা। জমিদার নারায়ণ রায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন বাদি মুড়ার উপর।
চাবুকের আঘাতে ফালা ফালা হতে লাগল বৃদ্ধর পিঠ, বুক সহ সারা গা। করম
পূজার মাদলের শেষ শব্দটুকু ঢেকে গেল জমিদারের চাবুকের আঘাতে।
ভয়ংকর দৃশ্যটা ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা বাকি মানুষজন নিশ্চল পাথরের মূর্তিতে
পরিণত হয়েছে।
তাদের বুক ফাটলেও, মুখে কিছু বলার সাহস নেই জমিদারের বিরুদ্ধে। সবাই চুপ করে দেখতে লাগল বাদি মুড়ার করুণ পরিণতি।
একসময় থামল জমিদারের চাবুক। ফিরে গেল সকলে একে একে। জমিদার ফিরলেন নায়েব লাঠিয়াল সঙ্গে খাজনার পাহাড় নিয়ে।
বাকিরা ফিরল নিঃস্ব, সর্বস্বান্ত হয়ে।
শুধু দু-জন পড়ে
রইল শূন্য ভূমির উপর। একজন
বাদি মুড়া আর একজন তার ছয় বছরের ছোট্ট নাতি। তবে আরও একজন এসবের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল কিছু দূরে জঙ্গলের মধ্যে
লুকিয়ে। সে সাক্ষী হল বাদি মুড়ার
রক্তাক্ত শরীরের। সাক্ষী হয়ে রইল বাদি
মুড়ার ছোট্ট নাতির চোখের জলের আর অভুক্ত পেটের!
“কুথায় ছিলি বটে? হামরা কখন থিকা নাওয়ে আসি বসি আছি। তুর দেখা নাই।” অর্জুন
মাঝিকে এই দিকে আসতে দেখে বলে উঠলেন নায়েব জনার্দন চৌধুরী।
কিছু বলে না অর্জুন মাঝি, নোঙর তুলে বইঠায় হাত দেয়।
বেলা তখন দ্বিপ্রহর। জমিদার নারায়ণ রায় হিসেব-পত্র দেখে রেখে অন্দরমহলের দিকে প্রবেশ করলেন। জমিদার-গিন্নি ইতিমধ্যে তিনবার
কাছারিবাড়িতে ভৃত্য পাঠিয়েছেন স্নানাহারের জন্য। সিন্দুকের চাবি পাঞ্জাবির পকেটে রাখতে গিয়েই চিঠিটা পেলেন নারায়ণ রায়।
“ই আবার কী আছে বটে।
কুথা থিকা এল? দেখে তো মনে হচ্ছে চিঠি কুনো।” তারপর পড়তে শুরু করলেন আকস্মিক
পাওয়া চিঠিটা -
শুন হে জমিন্দার,
যে পাপগুলান করে চলেছ সর্বক্ষণ তার ফল
তুমাকে ভুগতে হবেক। গরিব মানুষের রক্তের কুনো
দাম নাই তুমার কাছে, গরিবের চোখের জলের কুনো দাম নাই তুমার কাছে। আমরা আসছি তুমার
ঘরকে। পরের অমাবস্যার রাইতকে।
গরিবের রক্ত আর চোখের জলের শক্তি কতখানি তার টের পাবেক
সেই রাইতকে। দেখি তুমার কুন ইংরেজ বাপ তুমাকে
বাঁচায়।
চিঠি প্রেরকের কোনো নাম উল্লেখ করা নেই চিঠির শেষে। কিন্তু জমিদার নারায়ণ রায় বুঝতে পারলেন এ হল ডাকাতের পাঠানো চিঠি।
ইদানীংকালে খুব বেড়েছে ডাকাতদের রমরমা।
প্রায়ই ডাকাতি হচ্ছে এই জঙ্গলমহলের নানান জায়গায়
নানান বাড়িতে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ডাকাতি
হচ্ছে জমিদারদের বাড়িতে। হেমিলটন সাহেবের কাছে রিপোর্ট
পাঠানো হয়েছে বারংবার জমিদারদের তরফ থেকে। কিন্তু দুর্ভেদ্য পাহাড় জঙ্গল ভেদ করে ডাকাত দমন করা সম্ভব হয়নি এখনও।
তাই ইংরেজ কোম্পানির উপর ভরসা নেই জমিদার নারায়ণ রায়ের।
নিজেকেই যা করার করতে হবে।
ঠাকুরঘরে লক্ষ্মীর আসনের পাশের কুলুঙ্গিতে পঞ্জিকা রাখা
থাকে। নাওয়া-খাওয়া ভুলে জমিদার
নারায়ণ রায় আগে সেদিকেই গেলেন পরের অমাবস্যা কবে তা দেখার জন্য।
বাদি মুড়া মারা গেছে সেই দিনের অকথ্য অত্যাচারের পর।
একদিন, একরাত
ভুগে নাতির কোলে মাথা রেখে অবশিষ্ট প্রাণবায়ু ত্যাগ করেছে বাদি মুড়া। একা করে
দিয়ে গেছে ছয় বছরের ছোট্ট নাতিটাকে। কেঁদে
কেঁদে অভুক্ত পেটে ঘুমিয়ে পড়েছিল ছেলেটা। হঠাৎ ওর
নাম ধরে টোকা পড়ল দরজার উপর, “বনাই... বনাই... আগলটাক
খোল। ও বনাই...?”
“কে বটে?” ঘুম
চোখে দরজার ভিতর থেকে জিজ্ঞেস করল বাদি মুড়ার নাতি।
“তুর জন্য দুটো চিঁড়া ভিজাই আনছি।
দরজা খোল। পেটে তো কিছু পড়ে নাই।”
পেটের খিদেটা চাগাড় দিয়ে উঠল আবার বনাইয়ের। দু-দিন ধরে খাওয়া জোটেনি ওর। খাওয়ার
লোভেই দরজাটা খুলে দিল বনাই। লোকটাকে চেনে বনাই। পরিচয় নেই শুধু।
“খেয়ে নে বাপ আগে। তারপর কুথা বুলব।”
হাপুস-হুপুস করে ভিজানো চিঁড়ে খেতে শুরু করল বনাই। শুধু চিঁড়ে নয়, দুটো বড়ো বড়ো মন্ডাও ট্যাঁক থেকে বের করে দিল লোকটা, “খা বাপ, ভালো করে
খা।” গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল বনাইয়ের।
যেন কত আপনজন। খাওয়া
শেষে ঘরের এক কোণে রাখা কুঁজোর জলে আঁচিয়ে আর তা থেকে কিছুটা জল খেয়ে একটা ঢেকুর
তুলল বনাই।
“আয় এবার। আমার
কাছপানে বোস।” লোকটা কাছে ডাকল। বনাই বসল
তার কোল ঘেঁষে। খানিক চুপ করে থেকে লোকটা
বলল, “তর দাদুকে যারা মারল তাদের শাস্তি
দিবিক নাই?”
চমকে উঠল বনাই। এমন কথা
আশা করেনি ছোট্ট ছেলেটা। বলে কী লোকটা! চোখগুলো বড়ো বড়ো হয়ে গেল ওর।
লোকটা বলে চলেছে, “ভাব তো, কত কষ্ট পেয়ে মরল বুড়ো।
দাদুর শরীরের রক্ত, তোর চোখের জলের বদলা নিবি নাই?”
শুকিয়ে যাওয়া চোখ আবার ছলছল করে উঠল। বনাইয়ের গাল বেয়ে নেমে এল জলের ধারা।
“ধুর বোকা, কুথায় কুথায় চোখে জল গড়ালে ওদের বিরুদ্ধে
লড়াই করবিক কী করে। কি লড়তে হবেক নাই?”
“হবেক গো হবেক, লইড়বক আমি।” চোখের জল মুছে নিল বনাই।
“এই তো, এই না
হলে বেটাছিলা।” লোকটা বনাইয়ের পিঠে চাপড় মারল একটা, “শোন, আগামী অমাবস্যার রাইতে তুকে যেতে
হবেক হামাদের সঙ্গে।”
“কুথায়?”
”বুলবক বুলবক। চিন্তা নাই। আর একটা কুথা...”
“কী?”
“আজ থিকা তুর সব ভার হামার।
কুনো ভয় নাই তুর। এখুন চলি। সময় হলে ঠিক আসবক। জানবিক আমি তুর বাপ।”
“শুনো...”
লোকটা চলে যাচ্ছিল। বনাই
থামিয়ে দিল পিছু ডেকে।
“কী বল?”
স্বপ্নালু চোখে বনাই বলল, “আমাকে
নৌকা চালানো শিখাই দিবে? তুমার
মতো? শিলাই নদীতে ভেসে ভেসে বেড়াবক।”
হা হা হা করে হেসে উঠল লোকটা, ডানহাতটা রাখল বনাইয়ের মাথায়, “শুধু নৌকা চালানো কেনো।
তুকে আরও অনেক কিছু শিখতে হবেক রে বাপ।
নৌকা চালানো, তলোয়ার চালানো, তির-ধনুক, রণপা চড়া, কুস্তি... পারবিক নাই? বল?”
হঠাৎ করম পূজার মাদলের শব্দ শুনতে পেল বনাই নিজের বুকের ভেতর থেকে। মাদলের শব্দটা একটা থেকে দুটো হল। দুটো
থেকে চারটে। বাড়তে লাগল, বাড়তে লাগল, আর
বাড়তেই লাগল সেই শব্দ। যেন থামবেই
না আর, “হ হ পাইরবক।
আমি পাইরবক।”
অমাবস্যার রাত্রি। সেই অমাবস্যার অন্ধকার ঘুচিয়ে শিলাবতীর
এক তীরে জ্বলে উঠল প্রায় পনেরো জোড়া মশাল। বাঁশের
তৈরি লম্বা লম্বা রণপাতে চড়ে হনহনিয়ে সেই ভয়ংকর আলোর দল এগিয়ে চলল রাইসুলো
গ্ৰামের দিকে হুল্লা করতে করতে, ‘হারে রে
রে... হারে রে রে... হারে রে রে...’
জমিদার নারায়ণ রায় প্রস্তুত ছিলেন আগে থেকেই।
ডাকাত দমনের জন্য পশ্চিমদেশি বাঘা বাঘা লাঠিয়াল বাহিনী
আনিয়েছেন উনি। সেই লাঠিয়াল বাহিনী যেমন
বলশালী তেমন ভয়ংকর দর্শন। পাকানো
গোঁফ, গালপাট্টা, মাথার উপর চুল ঝুঁটি করে
বাঁধা। ঠিক যেন ডাকাত। জমিদার বাড়ির আনাচে কানাচে লুকিয়ে আছে সেই পশ্চিমদেশি বাহিনী।
নির্দেশ পাওয়ামাত্র শুরু হবে তাদের কাজ।
জমিদার নারায়ণ রায় সস্ত্রীক ঘুমিয়ে ছিলেন নিজের ঘরে।
ঘুম ভাঙল প্রচণ্ড এক শব্দে।
মড়মড় করে দরজা ভেঙে ঢুকে এল জনা বিশেক দেশীয় ডাকাত। মুখে কালি মাখা, চুকচুকে
তেল মাখা বিশালাকার সব দেহ, হাতে
পায়ে লোহার বালা। প্রত্যেকের হাতে হাতে
বিভিন্ন অস্ত্র। সেই অস্ত্রের মধ্যে তির-ধনুকটাই
বেশি।
“ওরে ওরে কে কুথায় আছিস রে... শিগগিরই আয় ইদিকে... ডা ডা
ডাকাত...”
কিন্তু কেউ সাড়া দেয় না। কী করেই বা সাড়া দেবে! সকলেই যে জমিদারবাড়ির নতুন রাঁধুনি ঠাকুরের রান্না
খেয়ে ঘুমে আচ্ছন্ন। পশ্চিমদেশি
লাঠিয়াল বাহিনী যে যেখানে ছিল সেখানেই রয়ে গেছে অচৈতন্য অবস্থায়।
নতুন রাঁধুনি ঠাকুর হাতের রান্নার গুণে কাজ পেয়েছিল গত
পরশু। দু-দিনে তাক লাগিয়ে
দিয়েছে সবাইকে রান্না করে খাইয়ে।
“কাজে বহালের আগে রাঁধুনি ঠাকুরকে আর একটু যাচাই করা উচিত
ছিল বটে গিন্নিমায়ের। সময় কাল তো আর আগের মতো না। কে জানে, কে কোন ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে।” বাড়ির পুরোনো রাঁধুনি ঠাকুর মুখ
বাঁকিয়ে বলেছিল ঝি শঙ্করাকে।
“যাই বল। লোকটার রান্নার হাত খাসা।” শঙ্করা থামিয়ে দিয়েছিল জমিদার বাড়ির পুরোনো রাঁধুনিকে।
পুরোনো রাঁধুনি কিছু ভুল বলেনি সেদিন। নতুন লোক রাখার আগে আরও একটু যাচাই করা উচিত ছিল।
না হলে, এত পূর্ব
পরিকল্পনা থাকা সত্ত্বেও আজকের এই দশা ঘটত না হয়তো।
“ডা ডা ডাকাত... বাঁচাও...” জমিদার নারায়ণ রায় শত চিৎকার
করেও সাহায্যের জন্য কাউকে পেলেন না।
“চুপ মার বলছি। একদম চুপ।” ধমকে ওঠে একজন ডাকাত।
তারপর ভেঙে যাওয়া দরজা দিয়ে ঢুকে আসে দুটি মানুষ। একটির চেহারা বড়ো, অন্যটির ছোটো। অন্ধকারে দৈত্যের মতো মনে হয়। তারা দুজন এসে দাঁড়াল ঠিক জমিদার নারায়ণ রায়ের পালঙ্কের পাশে।
তারপর বড়ো মানুষটা চারিদিকে চোখ বুলিয়ে উত্তর দিকের
দেয়ালে টাঙানো চাবুকটা দেখতে পেল।
“উই যে চাবুক দড়ি। নিয়ে আয়।”
বড়ো মানুষটার নির্দেশ পেয়ে ছোটো চেহারার মানুষটা নিয়ে এল চাবুকটা।
“যা ইবার তুর দাদুর খুনের পুতিশোধ নে বাপ।
শেষ পর্যন্ত পুতিশোধ না নেওয়া হলে থামবিক নাই।”
মশালের আলোর মতো ধকধক করে জ্বলে উঠল ছোটো চেহারার মানুষটার দু-চোখ।
বুকের ভেতর বেজে উঠল আবার সেই করম পূজার মাদলের শব্দটা।
হাত চলতে লাগল অনবরত। জমিদার নারায়ণ রায়ের আর্তনাদ চাপা পড়ে যেতে লাগল ডাকাতদের হাসির নীচে।
অর্জুন মাঝির নৌকায় চড়ে দু-জন ইংরেজ কোম্পানির পুলিশ চলেছে রাইসুলো
গ্ৰামের দিকে। জমিদারবাড়িতে কিছু দিন
আগে ভয়ংকর ডাকাতি হয়েছে। অবস্থা
খুব সাংঘাতিক! খুন হয়েছেন জমিদার নারায়ণ রায়। তারই রিপোর্ট করার জন্য হেমিলটন সাহেব পাঠিয়েছেন এঁদের।
“ও তোমার কে হয় মাঝি?” নৌকার গলুইয়ের এক ধারে বইঠা হাতে বসছিল বনাই। তাকে দেখিয়েই বললেন একজন পুলিশ। অর্জুন মাঝি একগাল হেসে নির্দ্বিধায় উত্তর করল, “ও আমার ব্যাটা, বনাই।”
শিলাবতী বয়ে চলল শান্ত গতিতে।
----------
ছবি - শুভশ্রী দাস
No comments:
Post a Comment