দুঃস্বপ্নের আড়ালে
অনন্যা দাশ
পূর্বকথা
গাড়িটা দেখেই চমকে উঠল লিলি। আরে এটা তো দাদার গাড়ি! তির বেগে ছুটে চলেছে। দাদা বরাবরই খুব স্পিডে গাড়ি চালাতে ভালোবাসে। কিন্তু এই মরেছে, রাস্তায় কী সব পড়ে রয়েছে। বড়োসড়ো ধাতব কী সব। দাদার গাড়িটা সেগুলোর ওপর গিয়ে পড়ল আর ওই জিনিসগুলো গাড়ির তলার অংশ ভেদ করে ভিতরে ঢুকে এল। কী ভয়ংকর ক্যাঁচ কোঁচ শব্দ।
“দাদা” বলে চিৎকার করে ধড়মড় করে উঠে বসল লিলি। এই ভয়ানক দুঃস্বপ্ন এই নিয়ে তিনবার দেখল সে। সারা গা-হাত-পা ঘামে ভিজে গেছে। নিশ্বাস জোরে জোরে পড়ছে। মাথায় টিপটিপ ব্যথা। মোবাইল ফোনটা তুলে নিয়ে দাদাকে ফোন লাগাল লিলি।
“দাদা তুমি ঠিক আছ তো? আমি ওই দুঃস্বপ্নটা আবার দেখেছি!”
-
“সে কী! গাড়ির তলা ফুঁড়ে লোহার পাত ঢুকে গেছে! ওটাই তো আমি স্বপ্নে দেখলাম এখুনি!”
-
“ও পুলিশ এসেছে? তুমি ঠিক আছ তো?”
-
“তুমি ঠিক আছ শুনে শান্তি পাচ্ছি। আচ্ছা, তোমার দেরি হবে সেটা মাকে বলে দেব।”
-
“না, না দুর্ঘটনার কথা বলব না, মা অযথা চিন্তা করবে। ঠিক আছে রাখি তাহলে? সাবধানে থেকো।”
ফোন ছেড়ে মাথা ধরে বসে পড়ল লিলি। ব্যথায় মাথাটা ফেটে যাচ্ছে এখন। এ কীরকম এক রোগে ধরেছে ওকে রে বাবা। সুইমিং পুলে ডাইভ দিতে গিয়ে মাথায় চোট পাওয়ার পর থেকেই এটা শুরু হয়েছে। স্বপ্নে অনেক কিছু দেখে ফেলছে সে। ঘুম তো একে আসতেই চাইছে না আর এলেও
সঙ্গে স্বপ্ন আসছে। আর ভালো স্বপ্ন যত না দেখছে তার চেয়ে ঢের বেশি খারাপ স্বপ্নই দেখছে। মার বাথরুমে পড়ে যাওয়াটা স্বপ্নে দেখেছিল, বিলের বেসবল লেগে চোট পাওয়াটাও, তারপর আজকে দাদার অ্যাক্সিডেন্ট, আরও কত কী যে দেখেছে! দুর্ঘটনাগুলোর আগাম জানান দেওয়ার চেষ্টা করছে সে, কিন্তু কতদিন আর এই রকম চলবে? আর গতকাল রাতের স্বপ্নটা তো সব চেয়ে ভয়ানক।
দরজায় টোকা পড়ল আর মা, “ললিত আসার কথা ছিল, এখনও এল না তো!” বলতে বলতে ঢুকলেন।
“ও, দাদার সঙ্গে কথা হল এখুনি। একটা জরুরি কাজে আটকা পড়েছে। আসতে চেষ্টা করবে বলেছে, কিন্তু কখন আসতে পারবে কোনো ঠিক নেই। খুব বেশি দেরি হয়ে গেলে আর আসবে না। অনেকটা পথ তো।”
“তোমাকে ফোন করল কেন? আমাকে ফোন করা উচিত ছিল তো! জন্মদিনটা তো আমার!”
“আরে বাবা ও ফোন করেনি। আমি করেছিলাম। হয়েছে তো শান্তি?”
আর দুটো কথা বলে মা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় দুম করে আগের দিনের বিশ্রী মানুষ মরে যাওয়ার স্বপ্নের কথাটা মাকে বলে ফেলল লিলি।
মা ভীষণ অবিশ্বাসের দৃষ্টি দিয়ে ওর দিকে তাকালেন। “কী যা-তা আজে-বাজে কথা বলছ তুমি!”
“যা-তা নয় মা! আমি দেখলাম। যদি অন্য স্বপ্নগুলোর মতন ওটাও সত্যি হয়ে যায়?”
“মাথায় আঘাত লাগার পর থেকে দেখছি তোমার মাথাটা একেবারেই গেছে। সব সময় আজে-বাজে চিন্তা! তোমার বাবাকে ভুলেও ওই সব স্বপ্নের কথা বলতে যেয়ো না, ভয়ংকর কাণ্ড ঘটে যাবে। ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করো,” বলে মা রাগে গজগজ করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। রাগ দেখালেন বটে মা, কিন্তু লিলির মনে হল মা আসলে কিন্তু ভয় পেয়েছেন।
লিলি আস্তে আস্তে গিয়ে টেবিলে বসে কম্পিউটারে একটা ফাইল খুলে লিখতে শুরু করল, ‘দুঃখ আসলে দুটি বাগানের মাঝের দেয়াল!’
কিছুক্ষণ লেখার পর দরজায় খুট করে একটা শব্দ হল। ফাইলটা ঝপ করে বন্ধ করে দিল লিলি।
(১)
“লিলিটা না একেবারে যা-তা! এত করে বলে দিলাম আমার ফ্ল্যাশ ড্রাইভটা ধার নিচ্ছিস নে, কিন্তু কালকে অবশ্যই নিয়ে আসিস, কারণ ওটার মধ্যে আমার দরকারি সব কিছু সেভ করা আছে আর সে কিনা আজকেই বেপাত্তা হয়ে গেল!” কিম রেগেমেগে রিয়াকে বলল।
রিয়া মুচকি হাসল, “আমাকে বলে কী হবে? তোমার ফ্ল্যাশ ড্রাইভ, তুমি ধার দিয়েছ, এবার বোঝো ঠ্যালা! আর দিলেই যখন তখন প্রেজেন্টেশনটা তো ল্যাপটপে বা কম্পিউটারে কপি করে নিতে পারতে। তাহলে আর এত দুশ্চিন্তা করতে হত না।”
“হুঁ, সেটা বিশাল ভুল হয়েছে। আসলে মেয়েটা এমন করুণভাবে চাইল যে না করতে পারলাম না। ওর নিজের কাছে নাকি একটাও ফ্ল্যাশ ড্রাইভ নেই আর জরুরি কিছু একটা সেভ করে নিয়ে যেতেই হবে। সেটা এত বড়ো যে ই-মেলও হচ্ছে না। ওই মাথায় আঘাত লাগার পর হাসপাতালে ভরতি হয়েছিল না? তারপর থেকে কেমন যেন একটা হয়ে গেছে মেয়েটা। সব সময় যেন অন্যমনস্ক হয়ে থাকে। পরীক্ষাতেও তেমন ভালো করেনি। বাজে গ্রেড পেয়েছে সব। কী সমস্যা হচ্ছে ওর কে জানে।”
“হ্যাঁ, সে সব তো জানি, কিন্তু সোমবার তো তোমার প্রেজেন্টেশন। আজকে না পেলে এরপর শনিবার-রবিবার। তাহলে কী করবে? ওর বাড়ি যাবে? সোমবার প্রেজেন্টেশন না দিতে পারলে স্যার তো দেবেন তোমাকে।”
কিম একটু ভেবে বলল, “বাড়ির ল্যাপটপে একটা ভার্শন আছে কিন্তু সেটা আপডেট করা নয়। ওই ফ্ল্যাশ ড্রাইভেরটায় অনেক কিছু বদল করেছিলাম। স্যার যা যা চেঞ্জ করতে বলেছিলেন সব ঢুকিয়েছিলাম। এখন আর সব কিছু মনে করে করে করা সম্ভব নয়। চলো ওর বাড়িতেই যাই। যদিও এই ভয়ানক শীতে বাইরে বেরোতে ইচ্ছে করে না, তাও যেতেই হবে। তা তুমি জানো ও কোথায় থাকে?”
“না, আমি জানি না, কিন্তু ডিপার্টমেন্টের সেক্রেটারি বেথ জানে। ওর কাছে সব স্টুডেন্টদের ঠিকানা আর ফোন নম্বর আছে। চলো ওকে গিয়ে জিজ্ঞেস করি। ফোন করেও দেখা যেতে পারে লিলিকে। সে যদি বলে আসছে তাহলে আর আমাদের কষ্ট করে যেতে হবে না।”
বেথের কাছ থেকে ঠিকানা আর ফোন নম্বর পাওয়া গেল বটে কিন্তু ফোন করে কোনো লাভ হল না, সোজা মেসেজে চলে গেল।
(২)
“লিলি আছে বাড়িতে? আমরা ওর বন্ধু, মানে এক সঙ্গে পড়ি। ওর সঙ্গে একটু দরকার ছিল।”
“না, লিলি তো নেই। ও ফ্লোরিডাতে নিজের পিসির বাড়ি চলে গেছে। সেখানে থেকেই পড়াশোনা করবে। ওর এখানে এই ঠান্ডায় থাকতে আর ভালো লাগছিল না। কলেজে যে সব বিষয় নিয়েছিল সেগুলোও আর ওর পছন্দ হচ্ছিল না।”
“আপনি ওর কে হন জিজ্ঞেস করতে পারি?”
“হ্যাঁ, আমি লিলির দাদা ললিত চৌধুরী।”
“কিন্তু ও কাউকে কিছু না বলে-কয়ে কী করে…”
“আরে ওর মাথায় ওই চোটটা লাগার পর থেকেই লিলি কেমন যেন আনমনা মতন হয়ে গেছে। কাল রাতে হঠাৎ ঠিক করল যে ওকে ফ্লোরিডা যেতে হবে, এই ভীষণ শীত ওর আর সহ্য হচ্ছে না। কলেজের পড়াশোনাতেও মন বসছে না। তাই আজ সকালের ফ্লাইট ধরে ফ্লোরিডা পাড়ি দিয়েছে সে। তা তোমাদের ওর সঙ্গে কী দরকার বললে না তো?”
কিম বলল, “আমার ফ্ল্যাশ ড্রাইভটা ওকে ধার দিয়েছিলাম কিছু একটা কপি করে আনার জন্যে। ক্রুজারের ১৬ জি বি ফ্ল্যাশ ড্রাইভ, নীল রঙের। ওটা কি ফেরত পাওয়া যাবে?”
“ও তাই নাকি? ঠিক আছে তোমরা এখানে বোসো। আমি ওর ঘরে গিয়ে দেখে আসছি। ওই রকম কিছু দেখতে পেলে নিয়ে আসব।”
রিয়া আর কিম বাইরের ঘরের সোফায় বসল। দারুণ সুন্দর করে সাজানো ঝকঝকে বিশাল বাড়ি। লিলির বাবা নাকি বিরাট কোনো এক কোম্পানির মালিক।
একটু পরেই ফিরে এলেন লিলির দাদা। হাতে কিমের ফ্ল্যাশ ড্রাইভটা, “এটাই কি?” উনি জিজ্ঞেস করলেন।
কিম হ্যাঁ বলতেই সেটা ওর হাতে দিয়ে দিলেন।
“ব্যস আর কিছু চাই?”
ওদের চলে যেতে বলা হচ্ছে সেই ইঙ্গিত বুঝতে পেরে ওরা দুজনেই ‘থ্যাংক ইউ’ বলে বেরিয়ে পড়ল।
বাইরে বেরিয়ে রিয়া বলল, “ব্যাপারটা কেমন জানি গোলমেলে ঠেকছে। কাউকে কিছু না বলে বেপাত্তা হয়ে যাওয়াটা ঠিক যেন বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। বেথ তো কিছু জানে না। নাহলে বলত। স্টুডেন্টরা নাম কাটালে বেথের জানার কথা। স্টুডেন্টরা তো ফিজ দেয়। সেটা ফেরত চাইলে বেথ জানত।”
“ওরা বিরাট বড়োলোক। ওদের হয়তো ফিজের অর্থ ফেরত চাই না। মেয়ের খুশিটাই ওদের কাছে বড়ো।”
“ওর দাদার হাবভাব ঠিক যেন নর্মাল নয়। আমার মন বলছে উনি কিছু লুকোবার
চেষ্টা করছেন।”
“না, না, বোন চলে গেছে তার মধ্যে লুকোবার
কী আছে? আমি তো আগেই বলেছিলাম লিলি ভীষণ অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে, পড়াশোনায় মন নেই।”
“দাঁড়াও, ওই পাশের বাড়ির মহিলা গেট দিয়ে ঢুকলেন, ওঁর সঙ্গে একটু কথা বলে দেখি।”
“উফ! যেখানে রহস্য নেই সেখানেও রহস্য খোঁজার চেষ্টায় আমাদের দেরি হয়ে যাবে…!”
কিন্তু রিয়া ততক্ষণে ‘এক্সকিউজ মি’ বলে মহিলার দিকে এগিয়ে গেছে। মধ্যবয়স্ক সাদা আমেরিকান ভদ্রমহিলা ওদের দেখে যেন বেশ ঘাবড়েই গেলেন, বললেন, “ইয়েস? কী চাই তোমাদের? কিছু বিক্রি করতে যদি এসে থাকো তাহলে সরি, আমার কিছু চাই না।”
“না, না, কিছু বিক্রি না। আমরা লিলির বন্ধু, তাই ভাবছিলাম আপনাকে ওর সম্পর্কে দুয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করব।”
“লিলি? কে লিলি?” মহিলার গলার স্বর শুনে মনে হচ্ছিল ভয়ার্ত। এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখছিলেন।
“লিলি মানে আপনার পাশের বাড়িতে আমাদের বয়সি যে মেয়েটা থাকে, তার কথা বলছি।”
“ও, তোমরা ওর বন্ধু। হ্যাঁ, হ্যাঁ, লিলিকে চিনি। খুব ভালো মেয়ে। আমার বয়স হয়েছে। আর্থ্রাইটিসে ভুগি। ও তাই মাঝে মাঝে এসে আমাকে সাহায্য করে দেয়। বাগানের আগাছা পরিষ্কার করে দেয়, কেক বানিয়ে দিয়ে যায়, ঘর ভ্যাকিউম করে দেয়, বাসনও ধুয়ে দেয় মাঝে মাঝে। তার বদলে কিছু দিতে গেলে কিছুতেই নেয় না।”
“তা ও যে ফ্লোরিডা চলে গেছে সেটা আপনি জানতেন?”
“ফ্লোরিডা!” মহিলা যেন আকাশ থেকে পড়লেন, “লিলি আমাকে কিছু না বলে ফ্লোরিডা চলে গেল? তা কী আর করা যাবে। যাই সুকে জিজ্ঞেস করে আসি।”
“সু আবার কে?”
“কেন লিলির মা। বিরাট বড়ো একটা ইন্ডিয়ান নাম আছে ওর, কিন্তু আমি সেটা বলতে গেলে আমার জিভে গিঁট পড়ে যাবে। তাই আমি ওকে সু বলেই ডাকি। তোমরা না হয় আগামীকাল এসো, তখন গল্প করা যাবে,” বলে মহিলা কোনোদিকে না তাকিয়ে হনহন করে হেঁটে লিলিদের বাড়ির দিকে চলে গেলেন।
গাড়িতে উঠতে উঠতে রিয়া কিমকে বলল, “লিলিদের বাড়ির দোতলার একটা ঘর থেকে কেউ একজন আমাদের উপর নজর রাখছিল খেয়াল করেছ?”
“হ্যাঁ, পর্দাটা অল্প অল্প নড়ছিল। এই শীতকালে তো কেউ আর ঘরে পাখা চালাবে না! আর ফাঁকটাও বাড়ছিল কমছিল। ওর দাদাই হবেন হয়তো। আমরা গেলাম কিনা দেখছেন।”
“হুঁ, লিলি যদি ফ্লোরিডাই গিয়ে থাকে তাহলে অত লুকোচুরির কী আছে? আর আমরা কী করছি না করছি তাতেই বা অত কৌতূহল কেন?”
(৩)
“এই রিয়া দেখে যাও! কী অদ্ভুত ব্যাপার!”
রিয়া বিকারে একটা সলিউশন ঢালছিল। হাত থেকে সেটাকে নামিয়ে কিমের ডেস্কের কাছে গেল। কিম ফিরে এসেই ফ্ল্যাশ ড্রাইভটাকে কম্পিউটারে ঢুকিয়ে প্রেজেন্টেশনটা নিয়ে বসেছিল।
“এই দ্যাখো! আমার ফ্ল্যাশ ড্রাইভে একটা বাড়তি ফাইল খুলেছে কেউ। ফাইলটা গতকাল খোলা হয়েছে। তার মানে লিলি খুলেছে।”
“কী লিখেছে?”
“তেমন কিছুই নয়, কয়েকটা লাইন লেখা শুধু। ‘দুঃখ আসলে দুটি বাগানের মাঝের দেয়াল’, ‘সুখ শব্দটার কোনো মানেই থাকত না যদি না দুঃখ থাকত’, ‘চোখের জল যেন কিছু শব্দ যা লেখার অপেক্ষায় রয়েছে’, ‘দুঃখ কোরো না, যা হারিয়ে যায় তা অন্য কোনো রূপে ঠিক ফিরে আসে’ আর সব শেষে ‘আমি একা নই। সবার জীবনে দুঃখ আছে। সবাই তাদের নিজস্ব লড়াই লড়ে চলেছে’।”
“অ্যাঁ! এগুলো আবার কী? দুঃখ নিয়ে কোটেশন? আর কিছু লেখেনি?”
“না। এই যে এই ফাইলটা। নাম দিয়েছে আনলাকি থার্টিন!”
“হুঁ। ব্যাপারটা ভারী
গোলমেলে। ওই রকম কথাগুলো লিখল কেন? কাল একবার সময় হলে ওর ওই প্রতিবেশিনীর সঙ্গে কথা বলতে হবে। আর ওর তৈরি ওই ফাইলটা আমাকে পাঠিয়ে দিয়ো তো।”
(৪)
“আপনি বিশ্বাস করুন কালকেই ওঁর সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। আর আজকে গিয়ে দেখি বাড়িটা খালি, কেউ নেই সেখানে!”
“তোমরা যে বাড়িটার কথা বলছ, বা যা ঠিকানা দিচ্ছ সে বাড়িটা অন সেল। সেটা তো খালি হবেই। বাড়িটার মালিক ফ্লোরিডায় থাকেন। তাঁর নাম কাইল ম্যাথিউ। তোমাদের কাছে না আছে মহিলার ছবি, না আছে মহিলার নাম। তিনি যে ঠিক কে তাও তোমরা জানো না। তাহলে আমরা কাকে খুঁজব আর কীভাবেই বা খুঁজব?”
“ওই যে ফ্লোরিডায় বাড়ির মালিক থাকেন তাঁকে একবার ফোন করে দেখলে হয় না?”
পুলিশ অফিসার অধৈর্য হয়ে ওদের দিকে তাকালেন। যেন ওঁর সময় নষ্ট করার জন্যে উনি বেশ বিরক্ত।
কিম ব্যাপারটাকে সামাল দেওয়ার জন্যে বলল, “আপনি যদি নম্বরটা আমাদের দেন তাহলে আমরাও ফোন করে দেখতে পারি।”
ওদের নম্বর দেবেন না বলেই বোধহয় ভদ্রলোক প্রচণ্ড অনিচ্ছার সঙ্গে ফোন লাগালেন।
“মিস্টার ম্যাথিউ? কাইল ম্যাথিউ?”
-
“আমি পেরি কাউন্টি পুলিশ ডিপার্টমেন্ট থেকে অফিসার ল্যাম্ব বলছি। ৩৪ ওক কোর্ট কি আপনার বাড়ি? ওটাকে কি আপনি বিক্রির জন্যে দিয়েছেন? কেউ থাকে ওখানে?”
-
“ও, আপনার মা থাকতেন?”
-
“আচ্ছা অনেক ধন্যবাদ। আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত।”
ফোন ছেড়ে দিয়ে রাগতভাবে ওদের দিকে তাকালেন অফিসার ল্যাম্ব, “তোমাদের মতিভ্রম হয়েছে আর আমি বুনো হাঁস ধাওয়া করে মরছি! যাই হোক বাড়িটা ওঁরই। ওঁর মা কিছুকাল ওখানে ছিলেন, কিন্তু এখন বস্টনে ওঁর দাদার কাছে থাকেন। বাড়িটা মাস ছয়েক হল খালি পড়ে রয়েছে। রিয়েল এস্টেট এজেন্ট বিক্রির চেষ্টা করছে। এবার তোমরা আসতে পারো। আরেকটা কথা জেনে রাখো, তোমাদের বন্ধুর পরিবারই যখন মিসিং পার্সন রিপোর্ট করছে না তখন তোমাদের রিপোর্ট আমি নিতে পারি না। সে যদি ছোটো বাচ্চা হত তাহলে না হয় কথা ছিল, কিন্তু একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মাথায় কী ঢুকল, সে পড়া ছেড়ে দিয়ে কোথায় চলে গেল তার জন্যে আমরা ট্যাক্স পেয়ারদের দেওয়া অর্থ তো তছনছ করতে পারি না।”
পুলিশ স্টেশন থেকে বেরিয়ে কিম বলল, “ওদের বাড়িটা বাবাদের পুলিশ স্টেশনের আওতায় পড়ে না তাই ওই ল্যাম্বের মুখ শুনতে হচ্ছে। আমি ইচ্ছে করেই বলতে চাইনি যে আমি অফিসার ডি মার্কোর মেয়ে।”
রিয়া বলল, “হ্যাঁ, সেটা ঠিকই আছে। ও সব বলার দরকার নেই। প্রবল শীতকাল বলে বাগানে কিছু নেই, নাহলে বাগানে ফুল-টুল থাকলে বোঝা যেত ওখানে লোক থাকে।”
কিম মাথা নাড়ল, “না, অনেক সময় বাড়ি বিক্রির জন্যে রিয়েল এস্টেটের লোকজন বাগানটাকে ঠিকঠাক করেই রাখে যাতে ভালো দাম পাওয়া যায়। তাই ফুল থাকলেও কিছু লাভ হত না।”
রিয়া বলল, “হুঁ, তবে মহিলা যে ভয় পেয়েছিলেন সেটা বোঝা যাচ্ছিল, কিন্তু তখন তো কিছু করতে পারলাম না। এখন বড্ড আপশোশ হচ্ছে। কোথায় যে গেলেন উনি। অন্তত ওঁর নামটা যদি জিজ্ঞেস করে রাখতাম।”
“পোস্ট অফিসে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে হয়?”
পোস্ট অফিসে গিয়েও সেই একই উত্তর পাওয়া গেল। ছ-মাস হল ম্যাথিউদের সব চিঠি ফ্লোরিডা রিডাইরেক্ট করা হচ্ছে।
রিয়া বলল, “এ তো মহা সমস্যায় পড়া গেল। কে ছিলেন ওই মহিলা? আর কেনই বা ভয় পাচ্ছিলেন? আচ্ছা লিলিদের বাড়িতে যাবে আরেকবার?”
কিম আঁতকে উঠে বলল, “ওরে বাবা না! এবার গেলে ওর দাদা জানালা দিয়ে গুলি করে দেবে আমাদের!”
(৫)
মাঝ রাতে সেল ফোন বেজে ওঠার শব্দে ঘুমটা ভেঙে গেল কিমের। ঘুম-চোখে স্ক্রিনটার দিকে তাকিয়ে দেখল সে – আননোন নম্বর। তাও ফোনটা রিসিভ করল সে, “হ্যালো?” ওর কথা শুনেও ওপাশের জন কোনো কথা বলল না। ফোনটা কেটে গেল একটু পরেই। কিমের শুধু মনে হল সে একটা ট্রেনের শব্দ শুনতে পেল আর শুনতে পেল একটা অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের আবছা শব্দ।
পরদিন সকালে সে রিয়াকে বলল ব্যাপারটা। রিয়া জিজ্ঞেস করল, “আননোন নম্বর জানার কোনো উপায় আছে?”
কিম বলল, “হ্যাঁ আছে, তবে অনেক খরচা করতে হবে।”
“ও তাহলে থাক। রং নাম্বারও তো হতে পারে।”
কিম বলল, “হ্যাঁ, তা তো হতেই পারে। সেটার সম্ভাবনাই বেশি, কিন্তু আমি শুধু ভাবছিলাম ওই ফ্ল্যাশ ড্রাইভটা দেওয়ার সময় লিলিকে আমার সেল-ফোন নম্বরটা দিয়েছিলাম। তাই ও যদি হয়।”
“হুঁ, কিছু করার নেই। আচ্ছা লিলির ভালো বন্ধু কে জানা আছে?”
“সঠিক জানি না। ওর সঙ্গে আমার শুধু একটা ক্লাস থাকে। তবে সেই ক্লাসে ওকে একটা চাইনিজ মেয়ের সঙ্গে বসতে দেখেছি। এমনিতে লিলি মেয়েটা খুব ইন্ট্রোভার্ট। বেশি বন্ধু-টন্ধু নেই বলেই মনে হয়। কারোর সঙ্গেই খুব একটা মেশে না। আমার কাছে সেদিন ফ্ল্যাশ ড্রাইভটা চেয়েছিল কেন সেটাই একটা রহস্য!”
খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল লিলির বন্ধু মেয়েটা আসলে চাইনিজ নয়, সাউথ কোরিয়ান। নাম শি হুয়া। কিন্তু অনেক খুঁজেও তাকে ক্যাম্পাসে কোথাও পাওয়া গেল না। অগত্যা আবার বেথের শরণাপন্ন হল ওরা। বেথ শুনে বলল, “ও তোমরা জানো না বুঝি? খুব খারাপ খবর। শি হুয়া গতকাল সাইকেল নিয়ে কোথাও যাচ্ছিল, এমন সময় একটা গাড়ি গ্যাঁক করে এসে ওকে মেরে পালিয়েছে। হিট অ্যান্ড রান। বেচারি এখন এমারজেন্সিতে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। আজকাল লোকজন যে কীভাবে গাড়ি চালায়। আমি পঞ্চাশ বছর এখানে রয়েছি তাই বুঝতে পারি জায়গাটা কীভাবে পালটে যাচ্ছে।”
বেথ তার পঞ্চাশ বছরের অভিজ্ঞতার দিকে পা বাড়াবার আগেই রিয়া বলল, “শি হুয়ার বাড়ির ঠিকানাটা পাওয়া যাবে?”
(৬)
শি হুয়াদের বাড়ির সামনে গাড়ি পার্ক করে ওরা একফালি ড্রাইভওয়ে দিয়ে হেঁটে যেতেই বাড়ির দরজাটা খুলে গেল। লাঠি হাতে নিয়ে একজন বৃদ্ধ কোরিয়ান ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। ওদের দেখে লাঠি উঁচিয়ে বললেন, “গো, গো, নো, নো!”
রিয়া আর কিম মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। ততক্ষণে ওদের চারপাশে প্রচুর চিনা, কোরিয়ান লোকজন জমা হয়ে গেছে। তাদের সবার হাতে হয় লাঠি নয়তো বেসবলের ব্যাট। দুজনের হাতে তো মনে হল খোলা তলোয়ার!
“নো নিউজ, গো গো!” করে চিৎকার করতে লাগল ওরা সবাই।
কিম ওদের বোঝাতে চেষ্টা করতে লাগল যে ওরা শি হুয়ার সঙ্গে এক কলেজে পড়ে, কিন্তু কেউ বুঝল বলে মনে হল না। ওরা দুজনে কী ভাবে পালিয়ে বাঁচবে ভাবছিল এমন সময় পিছন থেকে একজন কী সব বলতে বলতে এগিয়ে এল।
কিম বলল, “আরে ওই তো শি হুয়া, লিলির বন্ধু। কিন্তু তাহলে আই সি ইউ-তে কে আছে?”
শি হুয়া এসে পড়াতে সে যাত্রা ওরা প্রাণে বেঁচে গেল। শি হুয়া ওদের বাড়ির ভিতর নিয়ে গিয়ে ডাম্পলিং খাওয়াল। বলল, “যে হাসপাতালে রয়েছে সে আমার বোন। আমার চেয়ে দু-বছরের ছোটো কিন্তু আমারই মতন দেখতে। তাই প্রথমে সবাই ভেবেছিল ওটা আমি। খবরের কাগজেও উলটো-পালটা ছেপেছে। আমাদের এখানে ওরা এমনিতেই রিপোর্টারদের ওপর ভরসা করে না, তায় আবার ভুল খবর দেখে সবাই খাপ্পা। তোমাদেরকে ওরা রিপোর্টার ভেবেছিল তাই ওই অবস্থা। ওরা মনে করে যারা আমাদের কমিউনিটির খবর সবার পড়ার জন্যে ছেপে দিচ্ছে তারা আসলে আমাদের শত্রু। যাই হোক, ওই গাড়িটা মনে হয় আমাকেই মারতে এসেছিল। আমার বোনকে একই রকম দেখতে বলে ভেবেছে আমি। বোন এখন অনেকটাই ভালো আছে তাই রক্ষে।”
“হ্যাঁ, আমরাও তো ভেবেছিলাম তুমি হাসপাতালে, তাই তোমার মা-বাবার সঙ্গে কথা বলতে এসেছিলাম। লিলি তো তোমার বন্ধু ছিল। ও হঠাৎ ফ্লোরিডা চলে গেল কেন সেই বিষয়ে তুমি কিছু জানো?”
কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে শি হুয়া বলল, “আমাকে বিশেষ কিছু বলেনি তবে এইটুকু বলেছে যে কয়েকদিন আগে সাঁতারের জন্যে ডাইভ করতে গিয়ে লিলি মাথায় চোট পেয়েছিল। সেটা তোমরা জানো তো?”
“হ্যাঁ, সেটা জানি,” কিম বিড়বিড় করে বলল।
“হাসপাতালে ছিল বেশ কিছু দিন। বাড়ি ফেরার পর ওর একটা অদ্ভুত উপসর্গ দেখা দেয়। ও স্বপ্ন দেখতে শুরু করে, না ভুল হল, দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করে।”
“স্বপ্ন? কী রকম স্বপ্ন?”
“বাজে বাজে স্বপ্ন। যাকে বলে দুঃস্বপ্ন, বা নাইটমেয়ার। এবং ওর দেখা দুঃস্বপ্নগুলো সব সত্যি হয়ে যাচ্ছিল। ওর দাদার গাড়ির দুর্ঘটনা ও স্বপ্নে দেখেছিল, ওর মার পড়ে যাওয়া। এবং কয়েকদিন আগে ভয়ানক একটা মৃত্যুর স্বপ্ন দেখে, কার মৃত্যু সে সব আমি জানি না।”
(৭)
“তোমরা তো আচ্ছা নাছোড়বান্দা মেয়ে দেখছি! আবার এসে হাজির হয়েছ!”
“আপনাকে আজ আর বেশি বিরক্ত করব না। শুধু দুয়েকটা প্রশ্ন করব। আমাদের কলেজের ভাইস ডিন ফর এডুকেশনের কাছ থেকে অনুরোধের চিঠি এনেছি। উনি আপনাকে ফোন করার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তখন আপনাকে পাওয়া যায়নি। তাছাড়া আমাদের কথা শুনলে ওই কোরিয়ান মেয়েটার হিট অ্যান্ড রান কেসেও আপনাদের সুবিধা হতে পারে।”
ভাইস ডিনের চিঠিটা পেয়ে অফিসার ল্যাম্ব মনে হয় একটু খুশি হলেন। ভাগ্যিস রিয়া বুদ্ধি করে ওটা এনেছিল।
“কী প্রশ্ন আছে তোমাদের?”
“এখানে কোনো জায়গা থেকে অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন আর ট্রেনের আওয়াজ এক সঙ্গে শোনা যেতে পারে? হয়তো রেললাইনের ধারের কোনো হাসপাতাল হতে পারে।”
“পেরি কাউন্টিতে একটাই হাসপাতাল আছে যেটা রেললাইনের ধারে। মানে হাসপাতাল বললে ভুল হবে, ওটা একটা প্রাইভেট ক্লিনিক – নাম হারমনি গার্ডেন। আর কী জানতে চাও?”
“গত কুড়ি বছর ধরে আপনাদের এখানে যত লোক নিখোঁজ
হয়েছে এবং এখনও নিখোঁজ রয়েছে তার একটা তালিকা পাওয়া যাবে?”
“আমাদের এখানে ক্রাইম রেট খুব কম। ছোটো জায়গা। নিখোঁজরা বেশিরভাগই নিজেদের ইচ্ছেতে পালিয়ে যাওয়া গোছের সব। বেশিরভাগকেই পরে পাওয়া যায়,” বলে কম্পিউটারে খুট-খাট করে কী টিপে কিছু একটা প্রিন্ট করতে দিলেন। প্রিন্টার থেকে লিস্টটা তুলে হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে ওঁর নিজেরই ভ্রূ কুঁচকে গেল। রিয়ার হাতে তালিকাটা তুলে দিতে গিয়েও থমকে গেলেন।
“সতেরো বছর আগে এই এলাকা থেকে একজন নিখোঁজ হয়েছিল। তার নাম ছিল হাওয়ার্ড ম্যাথিউ, ঠিকানা ৩৪ ওক কোর্ট! আমি সাত বছর হল এখানে আছি তাই আমি ওই কেসটার কথা জানতাম না!”
রিয়া তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বলল, “আপনি প্লিজ হয় নিজে আমাদের সঙ্গে চলুন, না হয় দুজন পুলিশের লোক দিন। আমাদের ওই হারমনি গার্ডেনে যেতে হয়। একজনকে বাঁচাতে হবে, জানি না সে এখনও বেঁচে আছে কিনা।”
(৮)
অফিসার ল্যাম্বকে নিয়ে ওরা যখন হারমনি গার্ডেনে পৌঁছোল
তখন রাত্রি নেমে এসেছে। রিসেপশনের ষন্ডা মার্কা লোকটা পুলিশ দেখেও একটুও দমল না, বলল, “এটা একটা সাইকিয়াট্রিক হাসপাতাল। এখানে কে ভরতি আছে না আছে সেই সব নাম দিতে আমি বাধ্য নই। পেশেন্টদের প্রাইভেসি এখানে একটা বিশাল ব্যাপার। ওয়ারেন্ট ছাড়া আমি কোনো কিছু বলতে বা দেখাতে বাধ্য নই।”
অফিসার ল্যাম্ব তৈরি হয়েই এসেছিলেন। নিঃশব্দে পকেট থেকে ওয়ারেন্টটা বার করে দেখালেন।
পুলিশের লোক দরজা ভেঙে ২০৫ নম্বর ঘরে ঢুকতেই বিছানায় শিকল দিয়ে বাঁধা অবস্থায় লিলিকে দেখতে পেল ওরা। অত্যন্ত দুর্বল দেখাচ্ছিল তাকে। রিয়া আর কিমকে দেখে একটা ক্ষীণ হাসি হেসে বলল, “আমি জানতাম তোমরা আসবে। কিছু বলতে পারার আগেই ওরা ফোন কেড়ে নিয়েছিল তাও আমি আশা ছাড়িনি। কিছু ঘটে যাবে সেই আশঙ্কাতেই ফ্ল্যাশ ড্রাইভটা নিয়ে ওতে সব লিখেছিলাম। এরা আমাকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল জানো? যাতে আমাকে আর দুঃস্বপ্ন না দেখতে হয়, কিন্তু সেটা কি অত সহজ? যার জন্ম তেরো তারিখে সে তো বরাবরই আনলাকি! শকের পর শক দিয়েও ভোলাতে পারছে না।”
রিয়া বলল, “তুমি মোটেই আনলাকি নও! আজ থেকে সতেরো বছর আগে একটা খুন হয়। হাওয়ার্ড ম্যাথিউ নামের এক ভদ্রলোক খুন হন।”
লিলির চোখগুলো গোল গোল হয়ে গেল, “কিন্তু, কিন্তু… মানে কাইলের বাবা? আমার বাবার পার্টনার? যিনি নিখোঁজ হয়েছিলেন?”
“হ্যাঁ, তুমি তখন খুব ছোটো, কিন্তু খুব সম্ভব ওই খুনটা তোমার চোখের সামনে হয়েছিল। তুমি স্বপ্নে তোমার বাবাকে যে খুনটা করতে দেখেছ সেটা আসলে সতেরো বছর আগে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা। মাথায় চোট লাগার জন্যেই হোক আর যে জন্যেই হোক সেটা ফিরে এসেছে। এই মুহূর্তে পুলিশ তোমার বাবাকে গ্রেফতার করছে। সতেরো বছর আগের খুনের কোনো প্রমাণ নেই বটে, কিন্তু শি হুয়ার বোনের দুর্ঘটনা আর তোমার এই দশা করার জন্যে তাঁকে শাস্তি পেতে হবে। তোমাকে আর আনলাকি থার্টিন হতে হবে না, লাকি থার্টিন হলেই হবে। পৃথিবীতে শত শত লোকের জন্মদিন তেরো তারিখে, তাই তেরো তারিখ আনলাকি হতে যাবে কেন?”
“কিন্তু অন্য দুঃস্বপ্নগুলো? ওগুলো তো সত্যিই হয়ে গিয়েছিল!”
“অন্য স্বপ্নগুলোর সত্যি হয়ে যাওয়াটা নেহাতই কাকতালীয়! তোমার মা তুমি দুঃস্বপ্ন দেখার আগেও দু-বার বাথরুমে পড়ে গিয়েছিলেন, বিল তো বেসবল খেলে, ওর বেসবল লেগে চোট পাওয়াটাও নতুন কিছু নয় আর তোমার দাদার এই নিয়ে চতুর্থ গাড়ির দুর্ঘটনা। উনি মনে হয় বেশ জোরে অথবা অন্যমনস্ক হয়ে গাড়ি চালান।”
(৯)
“তুমি কী করে সব বুঝলে?” সব মিটে যাওয়ার পর কিম রিয়াকে প্রশ্ন করল, “আমার তো এখনও মাথা ভোঁ ভোঁ করছে!”
“আমার শার্লক হোমস বা আরকিউল পোয়রোর মতন বুদ্ধি আর অনুসন্ধান ক্ষমতা আছে বলতে পারলে খুশি হতাম, কিন্তু সেইরকম কিছুই নেই। তোমার ওই ফ্ল্যাশ ড্রাইভটা থেকে লিলির খোলা যে ফাইলটা পাঠিয়েছিলে তাতেই লেখা ছিল ওর ওই স্বপ্নগুলোর কথা। তুমি শুধু দুঃখের কোটেশনগুলো দেখতে পেয়েছিলে
কিন্তু অন্য লেখাগুলো সাদা প্রেক্ষাপটে সাদা ফন্টে লেখা ছিল যাতে পিছন থেকে কেউ এসে পড়লেও দেখতে না পায়। আমি শুধু ফন্টের রংটা বদল করে নিতেই সব পরিষ্কার হয়ে যায়। আজ সকালে আমি অনেকক্ষণ কম্পিউটারে বসেছিলাম।”
“সে আর নতুন কী, তুমি তো প্রায়ই বসে বসে জার্নাল আর্টিকেল পড়ো।”
“আমি লিলির পরিবার নিয়েও কিছুটা রিসার্চ করছিলাম।”
“ও সেই জন্যে ওদের সম্পর্কে অত কিছু জানতে পেরেছিলে! কিন্তু ওই পাশের বাড়ির মহিলা কে ছিলেন? যিনি আমাদের সঙ্গে সেদিন কথা বললেন, বেশ ভয় পেয়েছিলেন? তিনি কোথায় গেলেন?”
“উফফ! সেটা তো সবচেয়ে সোজা ব্যাপার! আমাদের আগেই বোঝা উচিত ছিল! আমরা দুজনেই ভয়ানক বোকা বনেছিলাম ওই ব্যাপারটায়। পরে ওই রিসার্চ করে বুঝতে পারলাম। ওই মহিলা তো আসলে লিলির মা। ওর মা আমেরিকান আর বাবা বাঙালি। উনি আমাদের দেখতে পেয়ে পাশের বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকেছিলেন যাতে আমাদের সঙ্গে কথা না বলতে হয়। আমি জোর করে কথা বলতে গেলাম বলে উনি মিথ্যে মিথ্যে সব বানিয়ে বলে দিলেন। একমাত্র উনি আর লিলির দাদা বুঝেছিলেন ওর ওই স্বপ্নের তাৎপর্য, তাই ওঁরা বেশ ভয়ে ছিলেন। ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে কথা বলেন দুজনেই আমাদের। আসলে ওঁদের ভয় দেখানো হয়েছিল যে কিছু বললেই ওঁদেরও লিলির মতন হারমনি গার্ডেনে নিয়ে গিয়ে মগজ ধোলাই করে দেওয়া হবে। ও ভালো কথা, অফিসার ল্যাম্ব ফোন করেছিলেন একটু আগে। লিলির বাবা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ভেঙে পড়ে সতেরো বছর আগের খুনটা কবুল করে নিয়েছেন। বডিটা কোথায় লুকিয়েছিলেন সেটাও বলে দিয়েছেন।”
অফিস থেকে বেথ এসে বলে গেল, “তোমাদের জন্যে চকোলেট আর ফুলের তোড়া এসেছে অফিসে। ল্যাবে তো খাবার জিনিস আনার নিয়ম নেই তাই অফিসে এসে দেখে যাও।”
রিয়া আর কিম মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল, ফুল আর চকোলেট আবার কে পাঠাল? লিলি তো এখনও খুব দুর্বল, তার চিকিৎসা চলছে, সে ফুল পাঠানোর মতন অবস্থায় নেই।
অফিসে গিয়ে ফুল আর চকোলেটের সঙ্গে আসা কার্ডটা খুলে দেখল ওরা। তাতে কয়েকটা লাইন লেখা রয়েছে।
“তোমাদের জন্যেই বাবা কেন হারিয়ে গিয়েছিলেন বুঝতে পারলাম। আমি, আমার মা ও ভাই-বোনরা ভাবতাম বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। এখন সত্যি কথাটা জানতে পেরে খুব শান্তি পেয়েছি আমরা। বাবার আত্মাও শান্তি পাবে। তোমরা না থাকলে এটা সম্ভব হত না, থ্যাংক ইউ। - কাইল ম্যাথিউ।”
----------
ছবি - উপাসনা কর্মকার
No comments:
Post a Comment