ওয়ারেন হেস্টিংসের কারচুপি
দীপন ভট্টাচার্য্য
(১)
প্রতুলবাবুর সঙ্গে আমার আলাপ হয় দার্জিলিঙে। বেশ
ভদ্র মার্জিত বছর পঞ্চাশের এক ভদ্রলোক। মাথায়
হালকা টাক। মাঝারি উচ্চতা।
গায়ের রং ফরসা। চোখে
মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। গায়ে শার্টের উপর হাফস্লিভ
সোয়েটার, সঙ্গে ট্রাউজার আর গলায় মাফলার।
এই ছিল তার পোশাক। কাঁধে
সবসময় ঝুলত একটা শান্তিনিকেতনী ঝোলা। এহেন
প্রতুলবাবুর সঙ্গে কী করে আলাপ হল সেটাই বলি।
আমি সপ্তর্ষি সেন। বয়স
ছত্রিশ। বাড়ি মফস্সলে হলেও বিগত ছ-বছর
কলকাতার পাইকপাড়ায় একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে আছি। আমি
ছাড়াও চাকর রতন থাকে। ওকেই আমার লোকাল গার্জেন বলা
যেতে পারে। ব্যাংকে চাকরি করি।
গত একবছরে একটা দিনও ছুটি নিইনি বলে ডিসেম্বরের শেষে দিন সাতেকের
ছুটি পেতে অসুবিধা হল না। আমাদের ব্যাংকের প্রদীপবাবুই
সব ব্যবস্থা করে দিলেন। দার্জিলিঙে ওর ভায়রার একটা
বাড়ি আছে, সেটা ফাঁকাই থাকে সারাবছর।
তবে একতলাটা সিজনে ভাড়া দেওয়া হয় ট্যুরিস্টদের। কেয়ারটেকার রবিন লাই আছে দেখাশোনা
করার জন্য। ঠিক হল ওখানেই কাটিয়ে আসব
ক’দিন। সেই
মতো টিকিট কেটে রেডি।
যাবার দিন সকালে রতন বলল, “দাদাবাবু আপনার গল্পের বইটা নিয়েছেন তো? যেটা কাল কিনে
আনলেন ট্রেনে পড়বেন বলে। বাকি
সব আমি গুছিয়ে দিয়েছি।”
শেভিং করতে করতে আমি প্রায় আঁতকে উঠলাম ওর কথা শুনে।
সত্যিই তো বইটা নেওয়া হয়নি। আসলে
প্রথমবার দার্জিলিঙ যাচ্ছি বলে আমার ডোপামিনের ক্ষরণ বেড়ে গেছে বেশ কিছুটা।
তৎক্ষণাৎ বইটা এনে রতনকে দিতেই ও ভরে দিল ব্যাগে।
একা থাকি, তাই বইয়ের
মতো বন্ধু আর হয় না। তাছাড়া
ইদানীং একটা নতুন শখ হয়েছে আমার। সেটা
হল এমন লেখকদের বই সংগ্রহ করা যারা তেমন প্রচারের আলো পাননি কিন্তু গল্প লেখেন বেশ
মনোগ্রাহী। এদের মধ্যে ‘চন্দ্রকেতু’ আর ‘মেঘদূতের’
লেখার আমি প্রায় অন্ধ ভক্ত। যেমন
অভিনব প্লট তেমন সুন্দর ভাষা। একেবারে
আনপুটডাউনেবল।
দার্জিলিঙে পৌঁছে প্রথম যার সঙ্গে আলাপ হল তিনি হলেন প্রতুল চন্দ্র বসাক। উনিও
আমার সঙ্গে আছেন একই বাড়িতে তবে অন্য ঘরে। ভদ্রলোক
বেশ মিশুকে। তাই আলাপ হতে দেরি হল না।
অবশ্য এর একটা কারণ বোধহয়, দুজনের ইন্টারেস্টই কমন। গোয়েন্দা
গল্প পড়তে ভালো লাগে না এমন বাঙালি পাওয়া ভার। প্রতুলবাবুও
তার ব্যতিক্রম নন। গরম জলে স্নান করে ফ্রেশ হয়ে
যখন লনে এলাম তখন দেখি লনে একটা চেয়ারে প্রতুলবাবু একটা বই হাতে নিয়ে বসে আছেন।
যদিও দৃষ্টিটা সামনের দিকে। যেখানে
বিরাজমান ট্যুরিস্টদের ভাষায় – ‘দ্যা
স্লিপিং বুদ্ধা’। মানে বাঙালির চিরকালের প্রিয়
কাঞ্চনজঙ্ঘা।
“কি কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে বইয়ের কথা ভুলে গেলেন নাকি?”
আমি একটা চেয়ার টেনে ওনার পাশে বসে বললাম।
ভদ্রলোক কিছুটা চমকে আমার দিকে তাকালেন। তারপর
হেসে বললেন, “বারবার এ দৃশ্য দেখেও
পুরোনো হয় না।” ইতিমধ্যেই রবিন চা দিয়ে
গেছে। ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ে চুমুক
দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কি প্রায়ই আসেন?”
“বছরে একবার তো আসি,” বইটা ঝোলায় ঢোকাতে ঢোকাতে ভদ্রলোক উত্তর দিলেন।
তখনই দেখলাম বইটার নাম ‘সাগরদ্বীপের আতঙ্ক’, লেখকের নাম ‘চন্দ্রকেতু’। তারপর
ভদ্রলোক বললেন, “শহরের বিষাক্ত বাতাসের
থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এর চেয়ে ভালো জায়গা আর হয় না।
ফিরে গিয়ে নতুন উদ্যমে কাজ করার জন্য যাবতীয় এনার্জি আমি এখান
থেকেই আহরণ করে নিয়ে যাই।”
“আজ বিকেলে জলাপাহাড়ের রাস্তাটা ঘুরিয়ে আনব। দেখবেন
আপনার মন-প্রাণ একেবারে তরতাজা হয়ে যাবে,” লাঞ্চের সময় মুরগির ঠ্যাং চিবিয়ে নিয়ে প্রতুলবাবু বললেন, “তা মশাই আপনি এখানে ফার্স্ট টাইম তো?”
আমি ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলতেই ভদ্রলোক বাড়তি উৎসাহ নিয়ে বললেন,
“তাহলে তো আপনি লাকি। আমি
আপনার গাইড। ঘোরার পর কেভেন্টার্সে বসে
কফিও খাওয়াব।”
ভদ্রলোক যে আমায় ছাড়বেন না সেটা বেশ বুঝতে পারছি।
তাই কথা না বাড়িয়ে ঘরের দিকে পা বাড়ালাম।
(২)
জলাপাহাড় রোডটা সত্যিই অতুলনীয়। লিখে
বা বলে বোঝানো যাবে না। হাঁটতে হাঁটতে কখন যে চিড়িয়াখানার
কাছে পৌঁছে গেছি খেয়ালই নেই।
“যাবেন নাকি মশাই ভেতরে?” জিজ্ঞাসা
করলেন ভদ্রলোক। ঘড়িতে প্রায় পৌনে চারটে বাজে
তাই বললাম, “আজ থাক। পরে
আসা যাবে ’খন।”
ম্যালে যখন ফিরলাম, তখন সব দোকানেরই আলো জ্বলতে শুরু করেছে। লোকজনের
ভিড়ও বেড়েছে। আকাশে মেঘ থাকায় কাঞ্চনজঙ্ঘা
দেখা যাচ্ছে না। ঠান্ডাটাও বাড়ছে।
তাই প্রতুলবাবুর কথামতো পা বাড়ালাম কেভেন্টার্সের দিকে।
একটা জিনিস অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ করছিলাম যে প্রতুলবাবু কিছুক্ষণ
অন্তর নিজের কাঁধে ঝোলানো শান্তিনিকেতনী ঝোলাটায় হাত ঢুকিয়ে কী যেন চেক করে নিচ্ছেন।
চৌরাস্তা দিয়ে হেঁটে ভিড়কে ড্রিবল করে এগোবার সময়ও দেখলাম ভদ্রলোক
নিজের বুকের কাছে চেপে রেখেছিলেন ঝোলাটাকে। কফি
খাবার সময়ও দেখলাম ভদ্রলোক ব্যাগটাকে আগলে রেখেছেন আর বারবার ওটার ভেতর হাত দিয়ে
কিছু দেখছেন। ওনার এহেন আচরণে আমি যারপরনাই
অবাক হলাম। শুধু অবাক বলি কেন!
একটা চাপা কৌতূহলও যে হচ্ছে না তা নয়! এমন কী
আছে যার জন্য বারবার ওটা দেখছেন আর অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছেন।
একবার ভাবলাম জিজ্ঞেস করেই ফেলি। কিন্তু
যার সঙ্গে মাত্র কয়েক ঘণ্টার আলাপ, তাকে তার পার্সোনাল ব্যাপারে প্রশ্ন করাটা সমীচীন হবে বলে মনে হল না।
কে জানে ঠাকুরের জিনিসও থাকতে পারে। প্রতুলবাবু
যে ঈশ্বর-ভক্ত সেটা আমি টের পেয়েছি। ম্যালের
দোকানগুলোর সামনে দিয়ে আসার সময় দুটো দোকানে ঠাকুরের ছবি দেখেই কপালে হাত ঠেকিয়ে
প্রণাম করেছেন। একটা কালী ঠাকুরের ছবি।
অন্য দোকানে গণেশের। ধোঁয়া
ওঠা গরম কফিতে চুমুক দিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে দেখলাম প্রতুলবাবুর কাপে এখনও কফি
রয়েছে। ভদ্রলোক এদিকে ডানপাশের পাহাড়ের
দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছেন। বেশ
চিন্তামগ্ন লাগল ওনাকে। আর থাকতে না পেরে প্রশ্ন করলাম,
“আপনি কি কোনো ব্যাপার নিয়ে চিন্তায় আছেন?”
আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ভদ্রলোক একচুমুকে কফিটা শেষ করে বেশ গম্ভীরভাবে
বললেন, “আসুন।”
তারপর আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই চেয়ার ছেড়ে উঠে কাউন্টারে
বিল মিটিয়ে হন হন করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে সোজা রাস্তায়। এরপর
চৌরাস্তা ক্রস করে আমাদের আস্তানায় পৌঁছতে লাগল ঠিক সাড়ে ছয় মিনিট।
প্রতুলবাবু বাড়ির গেট খুলে দ্রুত পায়ে লন পেরিয়ে সটান নিজের
ঘরের দিকে চলে গেলেন। আমিও এগোলাম নিজের রুমের দিকে।
করিডরে দেখা হল রবিনের সঙ্গে।
আমাকে দেখে ও জিজ্ঞেস করল, “স্যার, আজকের ডিনার কি ঘরে খাবেন নাকি ডাইনিং
হলে দেব?”
বিন্দুমাত্র না ভেবে বললাম ঘরেই খাব। ওই
পাগল লোকের সঙ্গে খাওয়ার কোনো মানেই
হয় না।
“আর শোনো, এখন টিফিনে কী দেবে?”
“এখন তো চা আর ভেজ পকোড়া। আপনি
ঘরে যান আমি দিয়ে আসছি।”
আমি যখন আমার ঘরের সামনে তখন দেখি প্রতুলবাবু নিজের ঘরে ঢুকে দরজা
বন্ধ করছেন। নিজের বুকের কাছে এখনও সেই
ঝোলাটা চেপে ধরে আছেন।
“কোনো প্রকার প্রয়োজন হলে বলবেন,” আমি ভদ্রতা করে বললাম।
কিন্তু আশ্চর্য, আমার কথায় কান না দিয়ে, আমায় সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে
ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন। এ
কীরকম ব্যবহার ওনার! বিকেল অবধি এমন করলেন
যেন আমি ওনার কতকালের পরিচিত আর এখন আমার অস্তিত্বটাকে গ্রাহ্যই করছেন না ভদ্রলোক।
ঘণ্টাকয়েকের মধ্যে একজন মানুষের এমন আমূল পরিবর্তন ভাবা যায়
না।
রবিনের এনে দেওয়া চা আর ভেজ পকোড়া খেয়ে খাটে বসে গল্পের বইটা
খুললাম। মেঘদূতের লেখা ‘মৃত্যু বিভীষিকা’। দারুণ ইন্টারেস্টিং প্লট। কিন্তু
মন বসাতে পারলাম না। খালি প্রতুলবাবুর কথা মনে হতে
লাগল। আজ সারাদিনের কথা রোমন্থন করতে
লাগলাম, যদি মেলাতে পারি।
(৩)
ভদ্রলোক চুঁচুড়ায় থাকেন। একা,
নিঃসন্তান। স্ত্রী
গত হয়েছেন পাঁচ বছর হল। এখানে এসেছেন ছুটি কাটাতে।
নিজের ঝোলার মধ্যে এমন কিছু আছে যেটা ওনার কাছে খুবই দামি।
তাই বারবার হাত দিয়ে সেটার উপস্থিতি পরীক্ষা করছেন।
আর হ্যাঁ, জলাপাহাড়ে
ঘোরার সময় একটা ফোন ওনার মোবাইলে এসেছিল। ওনাকে
বলতে শুনেছি, “চিন্তা নেই,
কাজ হয়ে যাবে। ফিরে
মিট করছি।”
কাকে বললেন কথাগুলো? কী কাজের কথা বলছেন?
কোনো গর্হিত কাজ নয় তো!
ভদ্রলোকের হাসিখুশি চেহারার পেছনে কি কোনো অপরাধী লুকিয়ে আছে?
হঠাৎ আমায় উপেক্ষা করার কারণই বা কী!
নাহ্, ভেবে কোনো কিনারা পাওয়া
যাচ্ছে না। অতএব আর ভাববই না।
কাল থেকে আমি নিজের মতো ঘুরব। যতদূর
জানি ভদ্রলোকের ছুটি শেষ হয়ে এসেছে। দু-একদিনের মধ্যেই চলে যাবেন, কাজেই আমি -
ভাবনায় বিরতি পড়ল, কারণ দরজায় টোকা পড়েছে। খাট
থেকে নেমে দরজা খুলতেই দেখি প্রতুলবাবু দাঁড়িয়ে। আমি
কিছু বলার আগেই ঘরের ভেতর ঢুকে বললেন, “দরজাটা বন্ধ করুন।”
ভদ্রলোকের স্বর অসম্ভব রকমের কঠিন। আমিও
মন্ত্রমুগ্ধের মতো দরজা বন্ধ করে দিলাম। একটা
চেয়ার টেনে বসতে দিয়ে নিজে খাটে বসলাম।
ভদ্রলোকের হাতে এখনও ঝোলাটা রয়েছে।
“কি, কিছু হয়েছে? আপনাকে রীতিমতো
চিন্তিত লাগছে!”
প্রতুলবাবু আমার কথার সরাসরি উত্তর না দিয়ে উলটে আমায় এমন একটা
প্রশ্ন করলেন যাতে আমার ভিরমি খাওয়ার জোগাড়।
“আপনি ভূতে বিশ্বাস করেন?”
“ভূত!”
“আজ্ঞে হ্যাঁ, ভূত! ভূত মানে অতীতকাল
নয়। এখানে ভূত মানে আত্মা।”
এবার আমি হেসে বললাম, “বিশ্বাস করার মতো কোনো কারণ আজ অবধি ঘটেনি।”
ভদ্রলোক পকেট থেকে একটা বিড়ি বের করে সেটা ধরিয়ে বেশ গম্ভীরভাবে
বললেন, “জানি আপনি বিশ্বাস করবেন না।
তাহলে আপনাকে পুরো ঘটনাটা খুলেই বলি।” বিড়িতে টান দিয়ে ধোঁয়া
ছেড়ে আবার বলতে শুরু করলেন ভদ্রলোক, “সতেরোশো তিরাশি সাল।
কলিকাতার মসনদে তখন ওয়ারেন হেস্টিংস। সুতানুটির
রাজা তার খুব কাছের লোক। একদিন সকালবেলা হেস্টিংস সবে
প্রাতরাশ সেরে উঠেছেন, এমন সময় রাজা এসে হাজির।
তিনি এসে সোজা হেস্টিংসের সামনে গিয়ে ওনার হাতে একটা পিতলের ভাঁড়
তুলে দিলেন উপহারস্বরূপ। সাহেব ভাঁড়ের ঢাকা সরাতেই
তার ভেতর থেকে বেরোল রাশি রাশি সোনার মোহর। জানা
গেল এই মোহর রাজা পেয়েছেন এক জেলের থেকে। সে
কালীঘাটের কাছে আদিগঙ্গায় নৌকা নোঙর করতে গিয়ে এটা পেয়েছে। বকশিশের
আশায় সে মোহর নিয়ে যায় রাজার কাছে। বিচক্ষণ
রাজাও বুঝেছিলেন যে এ জিনিস যদি একবার ইংরেজদের দেওয়া যায় তাহলে তার নিজের কপাল আরও
চওড়া হয়ে যাবে। তাই তিনি জেলেকে বকশিশ দিয়ে
সোজা এসে হাজির হেস্টিংসের কাছে। ধুরন্ধর
হেস্টিংস সানন্দে উপহার গ্রহণ করলেন এবং কিছুদিন পর এর একাংশ পাঠালেন ‘ব্রিটিশ কোর্ট অফ ডিরেক্টরস’-এর কাছে আর কিছুটা রাখলেন
নিজের কাছে। তার মধ্যে থেকে কয়েকটি তিনি
দিয়েছিলেন তার স্নেহভাজন কয়েকজন বাবুকে।”
এতখানি বলার পর প্রতুলবাবু থামলেন। আমিও
মন দিয়ে শুনছিলাম ওর কথা। ভদ্রলোক
হাতের নিভে যাওয়া বিড়িটা আবার জ্বালিয়ে তাতে দুটো টান দিয়ে গলার স্বর ভীষণরকম নামিয়ে
বললেন, “সেই মোহরগুলোর মধ্যে চারটি আমি পেয়েছি।”
আমি অবাক। বলে
কী লোকটা! উত্তেজনা মেশানো
স্বরে বললাম, “কোথা থেকে পেলেন?
আর সেগুলো কোথায় এখন?”
ভদ্রলোক এবার বিড়িটা ফেলে আমার দিকে ঝুঁকে বললেন,
“দেনাগ্রস্ত মদ্যপ এক লোকের থেকে। তিনি
ওই বাবুদের মধ্যে একজনের বংশধর। মাত্র
দশ হাজার টাকার বিনিময়ে পেয়েছি।”
আমি যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না।
কয়েক কোটি টাকার জিনিস মাত্র দশ হাজারে!
প্রতুলবাবু এবার নিজের ঝোলাটার ভেতর হাত ঢুকিয়ে বের করে আনলেন একটা
মেরুন রঙের বটুয়া। ওটার
দড়িটায় টান দিতেই গেরো খুলে গেল। তারপর
ভদ্রলোক বাঁহাতে বটুয়া ধরে সেটা উপুড় করলেন ডানহাতের তালুর ওপর আর সঙ্গে
সঙ্গে ঝন ঝন শব্দ করে বেরিয়ে এল চার-চারটে মোহর।
উজ্জ্বলতা একটু কমেছে বই-কি। তবে এইগুলো যে আসল সেটা বলে
দিতে হয় না। আমি একটা মোহর হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে
ফিরিয়ে দেখতে গিয়ে আবার চমকে উঠলাম। এ
কী! এ যে গুপ্তরাজাদের মোহর।
এর একপিঠে সমুদ্রগুপ্তের বীণাবাদনরত ছবি।
প্রতুলবাবু মৃদু হেসে বললেন,
“এই মুদ্রার জন্যই শুরু হয়েছে ভূতের উপদ্রব।”
আমি মুদ্রা ফেরত দিয়ে জানতে চাইলাম, “কীরকম উপদ্রব?”
“এটা কেনার দশদিনের মাথা থেকে মাঝে মাঝেই রাতে ওয়ারেন হেস্টিংসের ভূত হানা
দিচ্ছে। রাতে ঘুম হয় না।
আলো জ্বালিয়ে বসে থাকি, পাছে হেস্টিংসের ভূত গলা টিপে মেরে মোহরগুলো নিয়ে যায়।
সে এক বীভৎস অবস্থা।”
এবার আমার হাসি পেল। কোনোমতে
সামলে বললাম, “ওটা আপনি স্বপ্ন দেখেছেন।
সব সময় মোহরগুলো নিয়ে ভাবছেন তাই।”
ভদ্রলোক এবার রেগে গেলেন।
“না, স্বপ্ন নয়। এখানে
পালিয়ে এসেও নিস্তার নেই। আজ
সকালবেলায় অবজারভেটরির রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি।”
এবার আর সহ্য করা যাচ্ছে না। মোহরের
ব্যাপারটা সত্যি হলেও বাকিটা পুরোটাই গাঁজাখুরি। ভদ্রলোক
হ্যালুসিনেট করছেন। এই নিয়ে বেশি ভাবতে বারণ করে
বললাম, “ফিরে গিয়ে ওটা জাদুঘরে জমা করিয়ে দিন।
কারণ ওটা এখন সরকারের সম্পত্তি।”
“আমি কালই ফিরে যাব। কিন্তু
আজকের রাতটা কীভাবে কাটাব? সেটাই ভেবে আমি শিউরে
উঠছি!” ভয়ার্ত কণ্ঠে বললেন। ওনার
ভয় কাটছে না দেখে মোহরগুলো আজ রাতের জন্য আমার কাছে গচ্ছিত রাখার প্রস্তাব দিলাম।
“বাঁচালেন। আমিও এই কথাই বলতে এসেছিলাম,”
এই বলে আমায় বটুয়া দিয়ে উঠে পড়লেন। ভদ্রলোককে
দরজা অবধি এগিয়ে দিয়ে এসে খাটে বসলাম। বটুয়াটা
মাথার বালিশের তলায় রেখে একটা সিগারেট ধরালাম। সত্যিই
এত মূল্যবান অ্যান্টিক আইটেম থাকলে যে কারোর মাথাই খারাপ হয়ে যাবে।
(৪)
ডিনার সেরে যখন শুতে যাব তখন বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে।
দু-একবার বাজও পড়ল। বালিশে
মাথা দিয়ে মোহরের কথা ভাবতে লাগলাম। মোহরগুলোর
জন্যই প্রতুলবাবু বারবার ঝোলায় হাত দিচ্ছিলেন। ব্যাপারটা
এতক্ষণে রিয়েলাইজ করলাম।
আচ্ছা, প্রতুলবাবু সত্যি ওগুলো
কিনেছিলেন তো! নাকি...।
ওনাকে দেখে যদিও স্মাগলার-টাইপ মনে হয় না তবুও আজকালকার দিনে
কিছুই বলা যায় না। হয়তো উনি মোহরগুলো পাচারের
জন্য দার্জিলিঙে এসেছেন। হয়তো ওনার পেছনে পুলিশ লেগেছে,
তাই ওটা আমার কাছে রাখার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন।
এই সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না।
ঘুম ভাঙল একটা বাজের শব্দে। মোবাইলটা
হাতে নিয়ে দেখি রাত একটা দশ বাজে। তখনই
শুনলাম বারান্দায় কার যেন পায়ের আওয়াজ। শব্দটা
কাছে আসছে। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে।
হাতড়ে আলো জ্বালাতে গিয়ে দেখলাম লোডশেডিং।
এবার শব্দটা থামল। ঠিক
আমার দরজার সামনে। পিনড্রপ সাইলেন্স কিছুক্ষণের
জন্য। আমি আমার নিজের নিশ্বাসের শব্দ
পাচ্ছি। সত্যিই কি ভূতের অস্তিত্ব আছে
এখানে! নাহলে মাঝরাতে যখন সবাই ঘুমাচ্ছে তখন কে হেঁটে
বেড়াচ্ছে বারান্দায়? আমার গলা শুকিয়ে কাঠ।
তবু সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করলাম উঠে বসবার,
কিন্তু ঠিক সেই সময় আমার ঘরের দরজাটা খুলে গেল।
দরজার মুখে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছায়ামূর্তি।
একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল আমার শিরদাঁড়া দিয়ে।
ছায়ামূর্তিটা এবার এগোচ্ছে আমার দিকে। প্রায়
চারহাত দূরে এসে থামল। সেই মুহূর্তে বাইরে বিদ্যুৎ
চমকাল। যার আলো এসে পড়ল ছায়ামূর্তির
উপর। একলহমায় যা দেখলাম তাতেই আমার
আত্মারাম খাঁচাছাড়া। আমার থেকে চারহাত দূরে যিনি
দাঁড়িয়ে আছেন তিনি ভারতীয় নন, ব্রিটিশ।
পরনে ফ্রক কোট। মাথায়
কালো টপ হ্যাট। হাতে একটা ছড়ি।
ইনি আর কেউ নন, ইনি হলেন স্বয়ং ওয়ারেন হেস্টিং।
আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে
গেছে। বুঝতে পারছি জ্ঞানটাও আর বেশিক্ষণ
ধরে রাখতে পারব না। ছায়ামূর্তি আর-এক পা এগোল
আমার দিকে। তারপর ব্রিটিশ উচ্চারণে বলল,
“গিভ মি ব্যাক মাই কয়েনস।”
এরপর আর কিছু মনে নেই। যখন
জ্ঞান হল তখন সকাল হয়ে গেছে। আমার
খাটের পাশে চেয়ে দেখি প্রতুলবাবু আর রবিন দাঁড়িয়ে।
সকালে চা দিতে এসে রবিন দেখে যে ঘরের দরজা খোলা আর আমি অবিন্যস্ত
অবস্থায় খাটে পড়ে আছি। সেই দেখে সে প্রতুলবাবুকে খবর
দেয়। উনি এসে জলের ঝাপটা দিয়ে আমায়
তোলেন।
“কী হয়েছিল মশাই?” উদ্বিগ্নস্বরে জানতে চাইলেন প্রতুলবাবু।
আমি উত্তর না দিয়ে বালিশের তলায় হাত ঢুকিয়ে দেখলাম যে বটুয়াটা
নেই।
“ওটা নেই!” আমি অস্ফুটস্বরে বললাম।
এবার উঠে বসে ডানপাশে থাকা বেডসাইড টেবিলের উপর থেকে জলের বোতলটা
নিয়ে জল খেলাম। তারপর সবিস্তারে কাল রাতের
ঘটনা বললাম। সব শুনে প্রতুলবাবু বললেন,
“যা হয়েছে ভালো হয়েছে। আপদ
বিদায় হয়েছে। যার জিনিস সেই যখন এসে নিয়ে
গেছে তখন আর কোনো ভোগান্তি হবে না। শুধু
আপনার একটু কষ্ট হল এই যা।” ভদ্রলোককে আজ বেশ রিলাক্সড মনে হল।
ভদ্রলোক আবার বললেন, “এখন চলি। আমি টিকিট পেয়ে গেছি।
আজই ফিরে যাব। গাড়ি
এল বলে আমার।” এই বলে উনি চলে গেলেন।
আমিও ফ্রেশ হয়ে লনে এলাম। চায়ে
চুমুক দেওয়ার সময় দেখি একটা গাড়ি এসে থামল বাড়ির সামনে। প্রতুলবাবু
তখনই বেরিয়ে এলেন। হাতে ট্রাভেল ব্যাগ,
কাঁধে ঝোলা আর মাথায় টুপি।
“চললেন?”
“হ্যাঁ। আপনি হলিডে এনজয় করুন।
আশা করি আর কোনো বিপদ হবে না।”
“হোপ সো,” বলে আমি ভদ্রলোককে গাড়ি অবধি পৌঁছে দিলাম।
ভদ্রলোক গাড়িতে উঠে বললেন, “আবার দেখা হবে। ভালো
থাকবেন।”
গাড়ি স্টার্ট নিয়েছে। আমি
বললাম, “কিন্তু আপনার ঠিকানাটা তো জানা হল না।” ভদ্রলোক চলন্ত গাড়ির জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে
টুপিটা নেড়ে ‘সায়নারা’ ভঙ্গিতে বললেন,
“রবিনের কাছে দেওয়া আছে, নিয়ে নেবেন।”
গাড়িটা চোখের সামনে থেকে আস্তে আস্তে দূরে মিলিয়ে গেল।
কিন্তু এ কী! প্রতুলবাবুর
হাতের এই টুপিটা কোথায় যেন দেখেছি। মনে
পড়েছে! কাল রাতে ওয়ারেন হেস্টিংসের মাথায়।
এ টুপি প্রতুলবাবুর কাছে কেন? তবে কী...! দৌড় লাগালাম বাড়ির ভেতরে।
রবিন লাইও বেরিয়ে এসেছে। সে
একটা ব্রাউন রঙের খাম আমার হাতে ধরিয়ে বলল, “স্যার, এটা আপনার জন্য প্রতুলবাবু দিয়ে গেছেন।” খামটা নিয়ে লনচেয়ারে এসে বসলাম।
ওটা ছিঁড়তেই ভিতর থেকে বেরিয়ে এল একটা চিঠি।
প্রতুলবাবুর লেখা। চিঠিটা
পড়ে মনে হল এরকম শক জীবনে কখনও খাইনি আর কোনোদিন খাবও না। সেই
জন্য আমি হুবহু চিঠিটাই তুলে দিলাম।
স্নেহের সপ্তর্ষি,
শুরুতেই তোমার কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। কারণ
গতকাল রাতে তোমার দুর্দশার জন্য যে আমিই দায়ী সেটা আশা করি এতক্ষণে তুমি বুঝতে পেরেছ।
তুমি বুদ্ধিমান ছেলে। সেই
কারণেই আমার কারচুপি যে ধরে ফেলেছ এ বিষয়ে আমার কোনোরকম সন্দেহ নেই।
গতকাল রাতে সেই ভয়াবহ ওয়ারেন হেস্টিংসের ছায়ামূর্তিটি যে স্বয়ং
আমি অর্থাৎ প্রতুল চন্দ্র বসাক, সেটা নিশ্চয়ই
এখন বুঝতে পারছ। আসলে গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই
আমার প্রকাশক চাপ দিচ্ছেন নতুন কিছু লেখার জন্য যাতে বইয়ের বিক্রি ভালো হয়।
সেইজন্যই নতুন প্লটের সন্ধানে দার্জিলিঙে আসা।
এখানে এসেও প্লট পাচ্ছিলাম না। ঠিক
তখনই আমার পাশের ঘরেই এসে উঠলেন আমার রাইভাল রাইটার ‘চন্দ্রকেতু’। তুমি
তোমার আসল পরিচয় দাওনি। ব্যাংকে চাকরি করার পাশাপাশি
‘চন্দ্রকেতু’ ছদ্মনামে থ্রিলার
লেখাও যে তোমার হবি সেটা আমি জানি। তোমায়
একবার বইপাড়ায় দেখেছিলাম। আমার
প্রকাশক চিনিয়ে দিয়েছিলেন। তাই
এবার চিনতে ভুল করিনি। তোমাকে এখানে দেখার সঙ্গে
সঙ্গে গল্পের এক অভিনব প্লটও আমার মাথায় এসে গেল।
সেই গল্পের প্রধান চরিত্র যে তুমি তা বুঝতেই পারছ।
মুদ্রাগুলো আসল কিন্তু গুপ্তযুগের নয়। ওগুলো
রুপোর ওপর সোনার জল করা। একটা সিনেমায় ব্যবহারের জন্য
তৈরি হয়েছিল। আমি সিনেমার আর্ট ডিরেক্টরের
থেকে কিনেছি। ওগুলো তোমায় দিয়ে গেলাম।
তোমার ঘরেই রাখা আছে। একটু
খুঁজলেই পেয়ে যাবে। আশা করি অগ্রজের থেকে এই উপহার
নিতে তোমার আপত্তি নেই। রবিনকেও ক্ষমা কোরো।
ওর সাহায্য ছাড়া এই প্ল্যানটা সাকসেসফুল হত না।
কারণ কাল রাতে তোমার ঘরের দরজার ডুপ্লিকেট চাবি আর লোকাল ড্রামা
ক্লাব থেকে সাহেবের ড্রেস ওই আমাকে দিয়েছে। আর
ঝড়-বৃষ্টি তো উপরি পাওনা।
তুমি আরও ভালো লেখো। তোমার
সর্বাঙ্গীন উন্নতি কামনা করি।
ধন্যবাদান্তে,
ভবদীয়,
‘মেঘদূত’
পুনশ্চ:
সামনের পয়লা বৈশাখে আমার নতুন বই বেরোবে।
সেটা তোমার বাড়ি গিয়ে আমি নিজে দিয়ে আসব।
বইয়ের নাম রাখব ভাবছি ‘ওয়ারেন হেস্টিংসের কারচুপি’।
----------
ছবি - উপাসনা কর্মকার
No comments:
Post a Comment