ননী বিনির মনোমামা
সঙ্গীতা দাশগুপ্ত রায়
মাকে ননী আর বিনি এমনিতে তেমন ভয় পায় না, কিন্তু এবার মনোমামা এসে থেকেই মা যেন কেমন পালটে গেছে। আগে মা ওদের এত চোখে চোখে রাখত না। ওরা দিব্যি এ ঘর ও ঘর খেলে বেড়াত। টুকটাক যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলার নামে মারামারিও করত মাঝে-সাঝে। কিন্তু এখন মা যেন পিঠেও চোখ লাগিয়ে রেখেছে দু-খানা। খেলার সময় জোরে চেঁচালেই বকাবকি করছে। এর কারণ আর কেউ না। শুদ্ধু মনোমামা। ওদের চেঁচামেচির জন্যই নাকি মনোমামার ডাক্তার হওয়া হবে না।
আগে বাড়িতে মনোমামা এলে সারাদিন হইচই করে কেটে যেত। এবারও তাইই হবে ভেবেছিল ওরা যখন ঢাউস সুটকেস আর দুটো বড়ো ব্যাগ নিয়ে মনোমামা সন্ধের মুখে এসে হাজির হল। মা বলল দ্যাখ মনো, এবার কিন্তু তুই ননী বিনির সঙ্গে খেলে গড়িয়ে আয়েস করে কাটাতে পারবি না। অনেক হয়েছে। আমি মা-বাবাকে কথা দিয়েছি এইবার তুই জয়েন্টে চান্স পাবিই। পরপর দু-বার ফেল করলি। এবারে ফেল করলে মোড়ের মাথায় চায়ের দোকান দিতে হবে। তার চেয়ে নিজের ভালো বোঝ। হাতে এখনও সময় আছে। এই ক-মাস মন দিয়ে পড়াশুনো কর। ডাক্তার তোকে হতেই হবে।
ননী বিনি দুই ভাইবোন এতকাল মনোমামা এলেই বইখাতার পাট তুলে ফেলত। এখন উলটে তাকেই পড়তে বসতে হবে শুনে ওদের তো মাথায় হাত।
পরের দিন স্কুল যাওয়ার সময় মা ননীর চুল আঁচড়ে জুতো জামা পরিয়ে বিনির ঝুঁটি বাঁধতে বাঁধতে বলে দিল দেখ, মনো ডাক্তার হলে তোদেরকেও সবাই কত খাতির করবে। বলবে ওই দেখ মনোময় ডাক্তারের ভাগনে ভাগনি যাচ্ছে। ভাবতে পারছিস! আর এই যে তোদের ঘনঘন সর্দি, কাশি, পেটের গণ্ডগোল সব কেমন এককথায় সারিয়ে দেবে দেখবি। বাড়িতে একটা ডাক্তার থাকলে কত যে সুবিধা তা তো জানিস না।
শুনে ননী তো হেসে বাঁচে না। সামান্য সর্দি-কাশি ও তো নিজে নিজেই সারে। আর পেটব্যথায় তো দাদুর হোমিওপ্যাথি নাক্সভমিকা নিজে নিয়েই খেয়ে নেয়। সেরেও যায়। ওইটুকুর জন্য মনোমামাকে সব ফেলে ডাক্তার হতে হবে! কে জানে বাবা! বড়োদের শখ-টখের থই পাওয়া ভার।
তবে মা যাইই বলুক, ননী বিনি মাঝে মাঝেই ওঘরে হানা দেয়। কিন্তু যখনই ঢোকে দেখে মনোমামা মাথাটা পিছন দিকে হেলিয়ে চোখ বুজে বসে আছে। ওদের দেখে বলে, “যা যা, এখন একদম গোল করিস না এখানে। ভাবতে দে আমাকে।”
বিনি বলে, “কী ভাবছ মামু?”
“আরে ভাবার কি শেষ আছে? এই যে যা পড়ছি সেটা নিয়েই ভাবছি।”
ননী বলে, “ভাবতে গিয়ে নাক ডাকছিলে যে!”
মনোমামা গা ঝাড়া দিয়ে বসে। বলে, “যাঃ বড্ড পেকেছিস তো তুই। কোন ক্লাস হল যেন, সিক্স? জানিস তো সিক্সের সঙ্গে কী মেলে?”
“কী?” বিনির খুব কৌতূহল। ক-দিন আগে ওকে ক্লাস ফোর, জুতো চোর বলে দাদা খেপিয়েছে। আজ দাদার ক্লাস সিক্সের সঙ্গে কী বলতে হয় শিখে ফেলবে ঠিক।
মনোমামা বলল, “সিক্স, খায় এটা-সেটা মিক্স।”
এটা-সেটা মিক্স আবার কেমন খাবার? ভাই
বোন দুজনেই ভারী অবাক হয়। ঠিক তখনই রান্নাঘর থেকে মা হাঁক দেয়, “তোরা দুটোতে আবার মনোকে জ্বালাচ্ছিস? কতবার বলেছি না ওকে পড়তে দে এই ক-টা দিন!”
মনোমামা ইশারায় ওদের মুখে আঙুল দিতে বলে। তারপর ফিশফিশ করে বলে, “সে এক দারুণ জিনিস। খাওয়াব দেখবি। একবার খেলে আর ভুলবি না।”
কবে খাওয়াবে কে জানে। রাতে বাবা খেতে বসে বলে, “পড়াশুনো মন দিয়ে করছ তো মনোময়? দেখো, এবার জয়েন্ট ক্র্যাক না করতে পারলে আমি আর শ্বশুরবাড়িতে মুখ দেখাতে পারব না কিন্তু।”
ওদিকে আবার মাকে বলে, “সারাদিন ছেলেটাকে অত পড়ো পড়ো করো কেন? ও যদি সত্যি ডাক্তার হতে চায় তো ঠিক মন দিয়ে পড়বে।”
ননী বোনকে বলে, “আচ্ছা মনোমামা সারাদিনই তো ভাবে। পড়ে কখন বল তো?”
বিনি অত বোঝে না। বানিয়ে বানিয়ে বলে, “পড়ে তো! তুই দেখতে পাস না। ওই যে সেদিন আমরা পুজোর জামা কিনতে গেলাম মা-র সঙ্গে, ছবিমাসি বলল মনোমামা ঘর থেকে বেরোয়ইনি সারাদিন। দরজায় খিল দিয়ে খালি পড়াশুনো করেছে।”
তা মাঝে মাঝে মনোমামা সত্যিই দিন-রাত এক করে ফেলে পড়তে বসে। মাঝে মাঝে ছাদে যায়। বলে, “দিদি, একটু ছাদে ঘুরে আসি রে। মাথাটা জ্যাম হয়ে গেছে।”
ননী বলে, “মাথা কি বাসরাস্তা? জ্যাম হয়ে গেছে মানে?”
আসলে ওদের স্কুল থেকে ফেরার রাস্তায় খুব জ্যাম হয়। মা ওদের দুজনকে নিয়ে অনেক সময় অটো থেকে নেমে হেঁটেই বাড়ি চলে আসে। কিন্তু মাথা জ্যাম মানে কী তা তো জানে না।
বিনি বলে, “মাথা জ্যাম বলেই মনোমামা এত ভুলে যায় বুঝলি দাদা!”
কথাটা সে ভুল বলেনি। ক-দিন ধরে বাড়িতে সবাইই খেয়াল করেছে মনোমামাকে যাইই বলো, সেটা করতে ভুলে যায়।
মা বলল, “মনো, ছাদে যাচ্ছিস, তোয়ালেটা মেলে দে তোর।”
মনোমামা ছাদে গেল, কাদের সঙ্গে যেন ফোনে কথা-টথা বলে নেমে চলেও এল। তোয়ালে কিন্তু বিছানার ওপর পড়েই আছে।
সেদিন মা বলল, “মনো, বাইরে যাচ্ছিস, আড়াইশো সোয়াবিন নাগেট নিয়ে আসিস। এই নে টাকা।”
মনোমামা টাকা নিল, বাইরে গিয়ে ঘুরেও এল, সঙ্গে খানিক চানাচুর গাঠিয়া ঝুরিভাজা। সোয়াবিনের নাম গন্ধ নেই কোথাও।
মা খুব বকাবকি করল খানিক। তারপর রাত্তিরে আবার খেতে বসেও সেই কথাটাই তুলেছে বাবার সামনে। শুনে-টুনে বাবা বলল, “সে কী মনোময়? দিদি কী বলছে?”
মনোমামা থালার দিকে তাকিয়ে একমনে কী দেখছিল কে জানে। শুধু অল্প সাড়া দিল, “উঁ! কী বলছ দিদি?”
“তুই কি ভাবরাজ্যে থাকিস রে আজকাল! একটা কথাও কানে যায় না! পরশু তোকে বলেছিলাম ওবাড়িতে ফোন করবি একবার। মা বারবার বলেছে তোকে ফোন করতে। করেছিলিস?”
মনোমামা অমনি থালার দিকে তাকিয়েই বলল, “উঁ। কার মা?”
ব্যস, মা তো পারলে তখুনি দু-ঘা বসিয়ে দেয় পিঠে। “কার মা মানে? তোর আর আমার মা। ইয়ার্কি করছিস আমার সঙ্গে?”
বিনি মামুর পাশেই বসেছিল। পায়ে একটা চিমটি কেটে বলল, “মা খুব রেগে যাচ্ছে কিন্তুক!”
বিনি আরও ছোটোবেলায় কিন্তু বলতে গিয়ে কিন্তুক বলে ফেলত। বন্ধুকে বলত বন্দুক। এখনও অনেক সময় কিন্তুক বলে ফেলে। মুখ ফসকে বেরিয়ে যায় আসলে। দাদা তো খুব রাগায় সে নিয়ে। মামুও। তা আজ সে নিয়েও মামু কিছু বলল না।
খালি চিমটি খাওয়া জায়গাটায় একটু হাত দিয়ে ডলে বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, তোর মা। হ্যাঁ মানে আমার মা, বিনির মা, তাই তো? বুঝেছি। করব ফোন।”
মা বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, “কে জানে বাবা কী চাপের পড়া। এ তো একদম ভাবনগরে চলে যাচ্ছে দেখছি দিন কে দিন।”
ক-দিন পরেই দিদা আর দাদু এল। এরকম প্রায়ই আসে। এবার বরং বেশ কিছুদিন পরে এসেছে। বড্ড বৃষ্টিও নেমেছে সেদিন। মা বলল, “খিচুড়ি হবে রাতে। যা তো মনো, রেলবাজারে সন্ধেবেলায় ভালো মাছ বসে। ইলিশ যদি পাস তো নিয়ে আসিস। তোর জামাইবাবুর ফিরতে তো রাত হবে। তখন আর পাবে কোথায় মাছ-টাছ।”
মনোমামা কথাটা শুনল কিন্তু উঠল না। বসে বসে ঘাড় গুঁজে কী সব লিখছিল।
খানিক পরে দিদা বলল, “কই রে মনো, বৃষ্টি তো আরও ঝেঁপে এল। গেলি না বাজারে?”
মনোমামা বলল, “উঁ, হ্যাঁ, এই যে। বলেই বিছানায় গড়িয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ল।”
মা বিরক্ত হয়ে বলল, “দেখেছ তো মা? মনো আজকাল কোন ভাবরাজ্যে যে থাকে ওইই জানে। যাইই বলি কথা কানে নেয় না। যাক গে। এখন ভালোয় ভালোয় পরীক্ষাটা উতরে গেলে বাঁচি।”
ননীর কিন্তু ব্যাপারটা একদম ভালো লাগছে না। বিনির কানে কানে বলল, “এরকম ভাবুক ডাক্তার কি আর কারোর রোগ সারাতে পারবে? সারাদিন ভাববে আর বিছানায় গড়াবে বুঝতে পারছিস?”
তবে সত্যিই যে মনোমামার কী হয়েছে তা কিছুতেই ধরা যাচ্ছে না। আজকাল ঘরের দরজা সবসময়ে ভেজানো। ক-দিন আগে আবার ডোন্ট ডিস্টার্ব লিখে দিয়েছে চক দিয়ে দরজায়। মা মাঝে মাঝেই বাবাকে বলছে, “আমার সন্দেহ হয় মনো কিচ্ছু পড়ছে না, বুঝেছ? খালি দরজা বন্ধ করে ঘুমোয়।”
শুনে বিনি বলে, “হতেই পারে না। মামুর যা নাক ডাকে সে তো পাশের ঘর থেকেও শোনা যায়। ঘুমোলে আমরা বারান্দা থেকে নাক-ডাকা শুনতে পাব না নাকি?”
মাঝে একদিন রাস্তা দিয়ে একটা বুড়ির চুলওয়ালা যাচ্ছিল। মনোমামা তাকে ডেকে খানিক গোলাপি বুড়ির চুল কিনল। তারপর সেটা মাথার ওপর বসিয়ে নিয়ে ননীকে বলল, “দেখ দেখি, আমাকে বেশ ক্লাউন ক্লাউন লাগছে না?”
ইসসস, দেখে তো বিনির কান্নাই পেয়ে গেল তখুনি। বুড়ির চুল খেতে ও খুব ভালোবাসে। সে জিনিস না খেয়ে মাথায় পরে কে ক্লাউন সাজে! ছিঃ খাবারটাই নষ্ট হল একদম।
নষ্ট যদিও হল না ঠিক। মনোমামা নিজেই টুকটুক করে পুরো গোলাপি বুড়ির চুলটা খেয়ে নিল আর বলতে লাগল, “উঁহু, এরকম না। এত চিটচিটে হবে না। একদম শোনপাপড়ির মতো মোলায়েম মুচমুচে হওয়ার কথা এটার।”
মা দাদু-দিদাকে ফোন করে বলল, “মনোর ব্যাপার আমার ভালো লাগছে না। ডাক্তারিতে ভরতি হওয়ার পরীক্ষা দিতেই তো মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে ওর। তোমরা বরং ছেড়ে দাও মা। ওর আর ওসব ডাক্তার-ফাক্তার হয়ে কাজ নেই।”
শুনে দিদার ভারী মনখারাপ। দিদার বাপের বাড়িতে চার ভাই ডাক্তার ছিল। তারা এখন বুড়ো হয়ে খিটখিটে হয়ে গেছে বলে রুগিরা আর আসতে চায় না। চেম্বারগুলো ফাঁকা পড়ে থাকে। দিদার ইচ্ছা ছিল একমাত্র ছেলে মামাদের চারজনের চারটে চেম্বারে ঘুরে ঘুরে রোগী দেখবে। ডাক্তার মনোময় সেনের নাম কাঁকুলিয়া থেকে কল্যাণী লোকের মুখে মুখে ঘুরবে। সে সব স্বপ্নই থেকে গেল তবে।
মনোমামা অবশ্য এসব নিয়ে মাথাই ঘামায় না। যখন ইচ্ছে করে দরজা বন্ধ করে, যখন ইচ্ছে হয় খোলে। কিন্তু ভারী গম্ভীর মুখে হাঁটাচলা করে। সবসময় যেন আকাশ-পাতাল কী সব ভেবেই চলেছে।
শেষে বাবা একদিন বন্ধ দরজায় টোকা দিল – “মনোময়, ব্যস্ত নাকি?”
“হুম্মম…” - ব্যস। আর কোনো কথা নেই ওদিক থেকে।
বাবা অবশ্য ওখানেই থামল না। আবার টোকা দিল দু-বার। তারপর একটু মোলায়েম সুরে বলল, “একটু ব্যস্ততা রেখে দরজাটা খোলো দেখি।”
মনোমামা উঠে দরজা ফাঁক করল। তারপর ফিশফিশ করে বলল, “এনেছেন?”
বাবা ঘাড় নাড়ল, “এই যে।”
বিনি খাবার টেবিল থেকে বই-খাতা তুলে ঘরে রাখতে যাচ্ছিল। পরিষ্কার দেখতে পেল বাবার হাত থেকে একটা সাদা খাম নিয়ে মামু আবার দরজা বন্ধ করে দিল।
পরের দিন সক্কাল থেকেই যেন ম্যাজিক। সবাই ঘুম থেকে ওঠার আগেই মনোমামা উঠে পড়েছে। দরজা দিব্যি হাট করে খোলা। বিছানার চাদরটা অবধি টানটান করে পাতা। মা উঠতেই মনোমামা চেঁচিয়ে উঠল, “দিদি, বাড়ির টি সেট-ফেটগুলো আর কতকাল জমিয়ে রাখবি? মেয়ের বিয়েতে দিবি নাকি!”
মা তো ঘুম-চোখে বুঝেই উঠতে পারছে না ভাই কী বলছে।
মনোমামা টেবিল চাপড়ে হাঁক দিল, “আয় আয়, চা করে রেখেছি তোর টি-পটে। আর এই দেখ লালুভুলুর দোকানের কচুরি এনেছি গরম গরম। জিলিপিটা নিলাম না। ভালো করে না ওরা। বাসি লাড্ডু ছিল গোটা কয়। এ পাড়াটা তোদের ছাড়তে হবে বুঝলি! নইলে কচুরি জিলিপির কম্বিনেশন ঠিকঠাক হচ্ছে না।”
মা মুখে-চোখে জল দিয়ে কোনোরকমে এসে চা ঢেলে নিল কাপে। তারপর বলল, “তুই সাতসকালে উঠেছিস কী করতে!! রাতে ঘুম হয়নি নাকি?”
মনোমামা হাসল একটু, তারপর ঢিপ করে মাকে একটা প্রণাম করে বলল, “আজ একবার বাড়ি যাব বুঝলি। সিনিয়র সিটিজেনদের প্রণাম করে আসতে হবে।”
এত কথাবার্তার মধ্যে ননী বিনিরা উঠে পড়েছে। বাবাও। সবাই মিলে সকালটা একদম সেই আগের মতো লাগছিল।
বিনি বলল, “তুমি সবাইকে প্রণাম করতে যাচ্ছ কেন মামু? এখনও তো পুজোই আসেনি! পুজো হবে, তারপর শুভ বিজয়ার প্রণাম তো! আমরাও তো তোমাকে প্রণাম করব সেদিন।”
মনোমামা কেমন মিষ্টি করে হেসে বলল, “আহা, আগেও করতেই পারিস। অ্যাডভান্স প্রণামে অ্যাডভান্স আশীর্বাদ পেয়ে যাবি। করবি তো করে নে এখনই।”
ননীর কিন্তু এসবের মধ্যেও মনটা খচখচ করছেই। গত দু-মাস ধরে যে মনোমামা সারাদিন কেবল ভাবত আর ভাবত, সে হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠেই আবার আগের মতো হয়ে গেল কী করে?
পুরে সবাই মিলে বেশ জমিয়ে ফ্রায়েড রাইস, চিংড়ির মালাইকারি, চিকেন গার্লিক পেপার, টমেটোর চাটনি আর ক্যারামেল কাস্টার্ড খেল। মনোমামা একা সব রান্না করল। ছবিমাসিকে বলল, “রোজ তো তুমি আর দিদি মিলে আমাদের অখাদ্য খাওয়াও। আজ আমি অখাদ্য রাঁধব আর তোমরা খাবে।”
মাও আর আপত্তি করল না। অনেকদিন ধরে ছেলেটা কেমন অন্যরকম হয়ে যাচ্ছিল পড়ার চাপে। একদিন একটু কমই পড়ুক না হয়। কী একটা কথা আছে না যে অল ওয়ার্ক এন্ড নো প্লে মেকস্ জ্যাক আ ডাল বয়! তা জ্যাকই হোক বা মনোই হোক, ডাল হওয়া মোটেই কাজের কথা নয়।
মনোমামা অবশ্য ননী বিনিকে অ্যাসিস্টেন্ট বানিয়ে নিয়েছিল। মাকে বলল, “বিনিকে তো তুমি রান্না শিখতে বলবেই, কিন্তু ননীকেও শেখাতে ভুলো না। দেখেছ তো? তোমার শরীর খারাপ হলে আর ছবিদি না এলে জামাইবাবু ছেলেমেয়েদুটোর জলখাবার অবধি বানিয়ে দিতে পারে না! এ কিন্তু একদম ভালো না দিদি।”
বাবা শুনে মিটিমিটি হাসছিল কিন্তু আপত্তি করল না।
মনোমামা রান্না করতে করতে কত অদ্ভুত কথাই যে বলল! আলু নাকি ভারতীয় সবজিই না। পেরু না কোন একটা দেশ থেকে নাকি তার আমদানি এদেশে। সেও মাত্র দুশো বছর আগেই। তার আগে ভারতীয়রা আলু কী জিনিস তাইই জানত না।
আবার টমেটোও নাকি ভারতের সবজি না। সেও এসেছে পোর্তুগিজদের ব্যাগে করে।
শুনে-টুনে ননী বলল, “কোনটা ভারতের সবজি বলো, সেটাই কাটব আমি।”
মনোমামা দুটো পেঁয়াজ ওর হাতে ধরিয়ে বলল, “কাটতে হবে না। কান্নাকাটি জুড়বি হয়তো। তবে জেনে রাখ পেঁয়াজ খুব সম্ভবত ভারতে বা এশিয়ার আর কোথাও বহু যুগ আগে থেকেই পাওয়া যেত। ব্রিটিশ বা পোর্তুগিজ কারোর সঙ্গেই আসেনি।”
চিংড়ি ভাজার গন্ধ বেরোচ্ছিল দারুণ। মনোমামা বলল, “কথাটা মোটেই চিংড়ির মালাইকারি নয় জানিস তো? ওটা মলয়কারি। মালয়েশিয়ার জাহাজিরা সমুদ্রের ধার থেকে নারকেল জোগাড় করে সেই নারকেলের দুধ বার করে সামুদ্রিক চিংড়ির ঝোল বানিয়ে খেত। সেই থেকেই মলয়কারি। পরে বাঙালিদের রান্নাঘরে ঢুকে ওটা মালাইকারি হয়ে গেছে মুখে মুখে।”
পরের দিন মনোমামা পিঠে ব্যাকপ্যাকটা চাপিয়ে ননী আর বিনিকে বলল, “চললাম রে। কান্নাকাটি করিস না যেন!”
বিনি হাসে। “কাঁদব কেন? তুমি তো আবার চলেই আসবে। আসবে না?”
মনোমামা চট করে মুখটা ঘুরিয়ে নেয়। তারপর বলে, “আরে! আমার জন্য কাঁদার কথা বলিনি। এত দুষ্টুমি করিস দুটোতে মিলে দিদি তো খেয়ালই করে না। সারাদিন আমার পেছনেই টিকটিক করে। এখন আমি থাকছি না। তোরা কী করছিস না করছিস সব খেয়াল করবে, বকুনিও খাবি বেশি বেশি। তখন কাঁদিস না আর কী।”
মার বোধহয় টানা দু-মাস ভাইকে কাছে পেয়ে আর ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। মুখ ভার করে বলল, “ওখানে গিয়ে বসে থাকিস না। কাল বাদে পরশুই চলে আসবি। এসে আবার পড়তে বসতে হবে মনে থাকে যেন।”
বাবা অফিস বেরোবে বলে রেডি হচ্ছিল। মনোমামা দরজার বাইরে থেকেই হাঁক দিল, “চললুম জামাইবাবু। থ্যাংকিউ।”
তিনদিন হয়ে গেছে। মা এবার ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। দুপুরের দিকে দিদাকে ফোন করল। ইচ্ছে, বলবে এবার মনোকে পাঠিয়ে দাও মা। বই-খাতা কিছুই তো নিয়ে যায়নি। সব এখানে। পড়াশুনো তো লাটে তুলে দিল আবার।
কিন্তু দিদা ওদিক থেকে কী বলল কে জানে। ননী দেখল মা ফোনটা হাতে নিয়ে আস্তে আস্তে চেয়ারে বসে পড়ল।
“কী হয়েছে মা? মামু আসবে না?” বিনি মার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে।
ওদিক থেকে দিদার আওয়াজ পাচ্ছে, “হ্যালো হ্যালো! কী রে! কথা বলছিস না কেন? মনোর কথা কী বলছিলিস! সে তো আসেনি এখানে! কখন বেরিয়েছে?”
মা বোধহয় বুঝতে পারছে না দিদা কী বলছে। কোনোরকমে বলল, “একটু আগে বেরোল তো। ভাবলাম ওখানে গেছে। রাখছি এখন। পরে ফোন করব।”
মার মুখটা একদম কাগজের মতো সাদা হয়ে গেছে। ঠোঁটটা কাঁপছে। ননী বিনি যে কত ছোটো তাও বুঝি ভুলে গেছে। ওদের দিকেই তাকিয়ে বলে, “মনো তো ওবাড়িতে যায়ইনি! পথে-ঘাটে কোথাও কিছু হয়েছে নিশ্চয়ই। হে ভগবান!” হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে মা।
ননী মার কাছ ঘেঁষে আসে। এবার তাহলে সময় হয়েছে চিঠিটা দেওয়ার। মনোমামা যাওয়ার সময় ওর কাছে একটা মুখ আঁটা খাম রেখে গেছে। বলেছে, ‘এটা মাকে দিবি। তুই বড়ো হয়ে গেছিস তো! ঠিক বুঝতে পারবি কখন দিতে হবে।’
“মা, মনোমামা দাদুর বাড়ি যায়নি?” বিনি মার কান্না দেখে কেঁদে ফেলে হঠাৎ।
ননী দৌড়ে ঘর থেকে চিঠিটা মার হাতে এনে দেয়।
“এটা কী রে?” মা চোখ মুছে অবাক হয়ে তাকায়।
“মনোমামা দিয়েছিল তোমাকে দেওয়ার জন্য। বলেছিল তুই বুঝতে পারবি কখন দিতে হবে।”
“শয়তান ছেলে, চিঠি লিখে গেছে আমাকে!” মা রেগে ওঠে কিন্তু কান্না থামে না। কোনোরকমে চোখ-টোখ মুছে চিঠিটা খুলে পড়তে থাকে জোরে জোরেই –
মনোমামা লিখেছে - “দিদি, তোরা আমাকে ডাক্তার বানাতে চাস। কিন্তু আমি কি ডাক্তার হতে চাই? চাই কিনা সেটা ভাবতে ভাবতে ঘুমোলাম। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ভাবলাম। তারপর ভেবেচিন্তে বুঝলাম আমি একদমই ডাক্তার হতে চাই না। রুগি-টুগিদের আমার মোটেই ভালো লাগে না। কাশি কফ রক্ত-টক্ত ওসব দেখলে আমার মাথা ঘোরে, বমি পায়। কিন্তু ডাক্তার না হলেও কিছু না কিছু তো হতেই হবে। সেই কিছুটাই কী? অনেক মাথা খাটিয়ে বুঝলাম এই সারাদিন পড়াশুনোর ফাঁকে কেবল একটা সময়ই আমার ভালো লাগে। যখন তুই রান্না করিস আর রান্নাঘর থেকে কী সুন্দর সব গন্ধ ভেসে আসে। আমার ইচ্ছে করে বইখাতা তুলে রেখে তোর সঙ্গে দাঁড়িয়ে রান্না করি। ছবিদির মতো ত্যাড়াব্যাঁকা আলু না কেটে নিখুঁত মাপে সবজি কাটি, ফোড়ন দিই ডালে। কিন্তু এসব করতে গেলে তুই বকাবকি করবি। তাছাড়া ঘরে বসে এসব করে কিছু হবেও না। তাই ভাবাভাবি শেষ করে আমি চললাম হায়দ্রাবাদ। হোটেল ম্যানেজমেন্টের জন্য ফর্ম ভরেছিলাম। আপাতত ডাক পেয়েছি। জামাইবাবু ফ্লাইটের টিকিটও কেটে দিয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি ফিরে আসব ছুটি ম্যানেজ করতে পারলে। ননী বিনির জন্য এটা-সেটা-মিক্স বানাতে শিখে আসব। তখন যত ইচ্ছে চড়-থাপ্পড় দিস না হয়। এখন চট করে চোখটা মুছে ফেলে আমাকে একবার ফোন করে বলে দে যে তুই রেগে নেই আমার ওপর। বলবি তো দিদি?”
ডাক্তার না, ইঞ্জিনিয়ার না, উকিল না, শেষ অবধি ছেলেটা রাঁধুনি বামুন হতে গেল! তাও অত দূরে! রান্না কি আমরা জানি না! দিদা খুব রাগারাগি করলেন সব শুনে একচোট।
দাদু অবশ্য রাগেননি। শুধু বললেন, “মন্দ কী! সেভাবে ভেবে দেখলে মানুষ যখন খুশি থাকে তখন শেফের কাছে যায় আর যখন অখুশি থাকে তখন যায় ডাক্তারের কাছে। মনো আমাদের এমনিই আমুদে ছেলে। ঠিক কাজই বেছে নিয়েছে।”
ঠিক-ভুল ওসব যারা বোঝে না সেই ননী আর বিনিই শুধু সারাদিন মনমরা হয়ে ঘোরে আর বড়ো রাস্তার মুখে বটতলায় বড়ো ঠাকুরের থানের সামনে দিয়ে যেতে আসতে প্রণাম করে বলে, “ঠাকুর, মনোমামাকে এনে দাও তাড়াতাড়ি। আর কতদিন রান্নার পড়াশুনো করবে!”
----------
ছবি - শ্রীময়ী
No comments:
Post a Comment