পুতুল
সহেলী চট্টোপাধ্যায়
সকালে ঘুম ভাঙতেই একটা
বড়ো চমক অপেক্ষা করছিল। ব্রাশ হাতে নিয়ে ব্যালকনির দরজা খুলে বাইরে গেছি রোজকার মতোই।
তিনতলার ব্যালকনি থেকে রাস্তা দেখতে দেখতে রোজ ব্রাশ করি। তারপর লেবুর রস গরমজলে
একটু মধু দিয়ে খাই। এরপর টবে লাগানো বাহারি গাছগুলোয় একটু জল-টল দিয়ে ওই ব্যালকনিতেই
চেয়ারে বসে বসে পেপার পড়ি। পেপার ব্যালকনিতেই পড়ে থাকে। কায়দা করে ছেলেটি ছুড়ে
দিয়ে যায়। এরপর স্নান সেরে কর্নফ্লেক্স-দুধ খেয়ে অফিসে বেরিয়ে যাই সাড়ে আটটায়।
তারপর বাড়ি ফিরি সেই সাতটায়। চটপট ভাত বসিয়ে দিই, বা রুটি কিনে আনি। আমি একা থাকি
না। আমার রুম পার্টনার জুহি বার্মা। আমারই মতো আইটি সেক্টরে কাজ করে। এই কলকাতা
শহরে আমরা দুজনেই নতুন। আমি মফস্সল থেকে এসেছি আর জুহি পুণে থেকে। আমি বাড়ি বেশি একটা
যাই না। চৌদ্দ
দিনে একদিন
কি দু-দিন। শহর থেকে বেশি দূরে যেতে
ইচ্ছা করে না। তা
সে নিজের বাড়ি হলেও না। সেখানে স্বাধীনতা নেই। মা-বাবা শুধু বিয়ের কথা
বলেন। তাই
আরও ভালো লাগে না। আমার
মনে হয় স্বাধীনভাবে থাকাই বেটার।
আজ সকালে নিউজপেপার-এর
সঙ্গে একটা পুতুল পড়ে আছে দেখতে পেলাম। একটা দু-বেণি করা মেয়ে-পুতুল। ভীষণ মিষ্টি
মুখখানা। পরনে সাদা ফ্রক। চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। আমার ভয়ই লাগল পুতুলটা এমনভাবে
এখানে পড়ে থাকতে দেখে। জুহিও রেডি বেরোনোর জন্য। ওকে দেখালাম। ও বলল, এই ব্যাপারে
কিছু জানে না। আমরা রেডি হয়ে নীচে এলাম। আমি পুতুলটা ফেলে দিলাম একেবারে পৌরসভার
জঞ্জাল ফেলার ডাস্টবিনে। নিজের নিজের অফিস গেলাম। তারপর বেশ কিছুদিন কেটে গেল।
পুতুলের কথা ভুলেই গেছি। এক শনিবার আমরা আইনক্সে মুভি দেখতে গেলাম। কিছু শপিং করে
ফ্ল্যাটে ফিরলাম। আমাদের দরজার সামনে একটা পার্সেল। জুহিকে
বললাম, “মনে হয় তোর বাড়ি থেকে
কেউ গিফট পাঠিয়েছে। সামনেই তোর বার্থডে।”
জুহি বলল, “আমার বার্থডের ঢের
দেরি রিয়াদি। তোমাকেও কেউ গিফট দিতে পারে। এত সুন্দর দেখতে তোমায়!”
জুহি এর আগেও কলকাতায়
ছিল, তাই ভালোই বাংলা বলে।
আমি ঢেউ খেলানো কোঁকড়ানো চুল ধরে একটু টেনে দিলাম। পার্সেল ভেতরে নিয়ে যাই। পার্সেল
আমাজন থেকে এসেছে। ভেতরে সুন্দর একটা পুতুল। আগের দিনের মতোই।
দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করছে। জুহি পুতুলটা কোলে তুলে নিল। বলল, “একে আর ফেলতে দিচ্ছি
না তোমাকে।”
আমি বললাম, “কিন্তু এরকম জিনিস না
রাখাই ভালো। আমার খুব অশুভ মনে হচ্ছে। কে-ই বা পাঠাল!”
জুহি কিছু বলতে পারল
না। পুতুল কোলে করে নিজের রুমে গিয়ে দরজা দিল। আমরা চাউমিন খেয়ে ফিরেছি তাই আর
ডিনার-এর ঝামেলায় গেলাম না। জুহিকে নক করতে ও বলল ও শুয়ে পড়েছে। আমি গুড নাইট বলে
শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ গান শুনলাম, তারপর ঘুমিয়ে পড়লাম। রাতে ঘুমের মধ্যে মনে
হচ্ছিল কেউ যেন চলাচল করছে ঘরের মধ্যে।
পরের দিন রবিবার,
ছুটির দিন। জুহি ব্রেকফাস্ট বানাচ্ছে। পরোটা আর আলু ভাজা। আমার উঠতে দেরি হল, না
হলে ওকে হেল্প করতাম। শনি-রবিবার অনেক কাজ থাকে। ঘর পরিষ্কার, জামা-কাপড় কাচা,
গোছানো এই সব। কোনো কোনো শনিবার কল্যাণীতে আমার বাড়ি চলে যাই। রবিবার বিকেলে চলে
আসি। জুহিও যায় আমার সঙ্গে। ওর তো কলকাতায় তেমন কেউ নেই। দুপুরে জুহি একটু ঘুমোয়।
আমি ফেসবুকে ব্যস্ত। আজ মনে হল জুহি কারোর সঙ্গে কথা বলছে নিজের রুমে। অনেকক্ষণ
ধরেই ও কথা বলছে দেখে খুব অবাক লাগছে। এতক্ষণ ফোনে কথা ও কখনোই বলে না। আমার চোখ
লেগে গেল।
আস্তে আস্তে জুহি বদলে
গেল। আমার সঙ্গে বিশেষ কথাবার্তা হয় না। ওর নাইট ডিউটি শুরু হল। আমি যখন বেরোই তখন
ও বাড়ি এসে ঘুমায়। আবার আমি যখন বাড়ি আসি তখন ও বেরোয়। শনি-রবি মাঝে মাঝে আগের মতোই
আমরা বেড়াতে যাই। নিয়ম করে রেশন আনি। কিন্তু আমার মনে হত তাল কেটে গেছে। জুহি দরজা
বন্ধ করে থাকতেই ভালোবাসে। আমি মাঝে মাঝে ওর অনুপস্থিতিতে ঘরে ঢুকে দেখি পুতুলটা বিছানায়
বসে আছে। একদিন অফিস থেকে ফিরে খুব রাগ হল। পুতুলটার গালে একটা ঠাস করে চড়
কষালাম। মনে হচ্ছিল এর জন্যই আমাদের লাইফে এত সমস্যা। কিন্তু চড় মেরেই আমি বুঝতে
পারলাম চড়টা যাকে মেরেছি সে মানুষ, পুতুল নয়। মানুষের মতোই নরম শরীর, নরম গাল।
পুতুলটা চোখ মেলে চাইল। নিষ্ঠুর হাসি ফুটে উঠল ওর মুখে। চোখ মেলে সে আমার দিকে
তাকিয়ে রইল। ভীষণ ভয় পেয়ে আমি নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলাম। কে
যেন দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে! ওই সর্বনেশে পুতুল ছাড়া আর কে হবে! এর মধ্যে কারেন্টও
চলে গেল। বাইরে তুমুল বৃষ্টি শুরু হল। কীভাবে যে রাতটা শেষ হল জানি না।
পরের দিন আমার জ্ঞান
ফেরাল জুহি। বলল, “তুই
খুব ভুল করেছিস আমার শেলীকে চড় মেরে।”
আমি বালিশে হেলান দিয়ে
বসলাম উঠে। বললাম, “শেলী আবার কে! ওই পুতুলের নাম? ওই
অশুভ পুতুলকে তুই বিদায় কর যে করে হোক।”
জুহি বলল, “শেলী আমার স্কুলের
বন্ধু ছিল। আমার সব চেয়ে প্রিয় বন্ধু। শেলী মারা গেছিল জ্বরে ভুগে। আমাকে সে
বলেছিল কখনও সে আমাকে ছেড়ে যাবে না। সেই শেলীই আবার ফিরে এসেছে।”
“কীসব বলছিস তুই।”
“হ্যাঁ রে। পুতুলটাকে
শেলীর মতোই দেখতে।”
“তুই ওকে বিদেয় কর
প্লিজ।”
জুহি হেসে উঠল।
অন্যদিন হাসলে তাকে খুব সুন্দর দেখাত। আজকে দেখে গা ছম্ছম্ করে
উঠল। একটা বাচ্চার গলায় রিনরিনে হাসি শুনতে পাচ্ছি। জুহির
শেলী বেডসাইড টেবিল-এর ওপর পা ছড়িয়ে বসে হাসছে। জুহি বলল, “এখন যাচ্ছি কিন্তু আবার দেখা হবে।”
দশ বছর পর
সেই সব দিনগুলো ভাবলে
এখনও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে তিনি আমায় ভালো রেখেছেন। এখন পুণায়
থাকি। সেদিন হাসতে হাসতে শেলীকে কোলে নিয়ে জুহি অফিস চলে গেছিল। আর ফেরেনি। ফেরার
সময় লরির ধাক্কায় সব শেষ! আমাকে বাবা এসে নিয়ে গেছিলেন। চাকরি আর করিনি। বিয়ের পর
থেকে পুণায় আছি। হাজবেন্ড এখানে জব করেন। এককথায় ভালোই আছি আমি। পুণায় এসে গল্প-কবিতা
লিখি। এই অবধি লিখেছি,
এমন সময় কাজের মাসি এসে বলল আমার পার্সেল এসেছে। আমি উঠে গেলাম। পার্সেল খুলে
দেখলাম একটা ছোট্ট মিষ্টিমুখের পুতুল। চুলগুলো কোঁকড়ানো। ঠিক যেন জুহি। আমি জানতাম
জুহি ঠিক আসবে। ও আবার ফিরে আসবে কথা দিয়েছিল।
----------
ছবি - সুজাতা চ্যাটার্জী
সুন্দর।
ReplyDelete