দা-ভিঞ্চির
পিস্তল
পুষ্পেন
মণ্ডল
।। এক ।।
ফোনের
স্ক্রিনে যখন তানিয়াদির নাম ভেসে উঠল আমি একটু চমকে উঠেছিলাম। হৃদপিণ্ডটা হয়তো এক
লাফে জোরে চলতে শুরু করেছিল। গলাটা যথা
সম্ভব স্বাভাবিক রেখে আওয়াজ দিলাম, "হ্যাঁ বল!"
"আধ
ঘণ্টার মধ্যে রেডি হয়ে পাড়ার মোড়ে দাঁড়াবি। আমি গাড়ি নিয়ে আসছি। ঝিন্টু আর শ্রীও আসছে
আমার সঙ্গে। আর শোন, কাকিমাকে বলবি ফিরতে সন্ধে হবে।"
"কিন্তু
যাচ্ছি কোথায়?"
"চন্দননগর।"
ফোনটা
কেটে যেতেই আমি তড়াক করে উঠে পড়লাম বিছানা ছেড়ে। দু’মিনিটে স্নান সেরে, নাকে মুখে
গুঁজে, রেডি হয়ে ঠিক ন’টা উনত্রিশ মিনিটে পাড়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আজকে রবিবার।
তাই ট্রাফিক কম। তানিয়া চ্যাটার্জি আমাদের নিজের দিদি নয়। ক্যারাটে ক্লাবে আলাপ।
আমাদের সিনিয়র। এছাড়াও ওর আর একটা পরিচয় হল কলকাতা হাইকোর্টের ক্রিমিনাল ল-ইয়ার।
আর তানিয়াদির বাবা হলেন গোয়েন্দা পুলিশের প্রাক্তন বড়োকর্তা। সেই সূত্রে মাঝেমধ্যে
বেশ কিছু ব্যক্তিগত তদন্তের কাজ আসে ওর হাতে। আর প্রয়োজন মতো আমাদের তিন মূর্তিকে
ডেকে টিকটিকিগিরির কিছু কাজ ভাগ করে দেয়। আমরাও সানন্দে ঝাঁপিয়ে পড়ি। কেস সমাধান
করতে পারলে ভালো ট্রিট পাওয়া যায়। আর না পারলেও
ক্ষতি নেই, বেশ একটা থ্রিলিং অভিজ্ঞতা হয় সব সময়েই।
তানিয়াদির
লাল রঙের সুইফট গাড়িটা দূর থেকে আসতে দেখে রাস্তা পেরোলাম। ঝিন্টুর পাশে পিছনের
সিটে বসতে গাড়ি এগোল এজিসি বোস রোড ফ্লাইওভার দিয়ে দ্বিতীয় হুগলি সেতুর দিকে। আমি
জানতে চাইলাম, "হঠাৎ চন্দননগর? নতুন কোন কেস পেলে নাকি?"
গাড়ির
স্টিয়ারিঙে হাত রেখেই তানিয়াদি জানাল, "একটা রহস্যজনক খুন হয়েছে সপ্তাহ খানেক
আগে। ভিক্টিম চন্দননগরের পর্তুগিজ ক্যাথলিক চার্চের
এক বয়স্ক পাদরি। গতকাল রাতে আমার এক ক্লায়েন্টের বন্ধু প্রফেসর শৈলেন চৌধুরী ফোন
করেছিলেন। ওনার বাড়ির কাছেই সেই তিনশো বছরের পুরোনো চার্চ।
পাদরি ছিলেন শৈলেনবাবুর অনেক দিনের বন্ধু।"
শ্রী
প্রশ্ন করল, "তা বয়স্ক পাদরিকে হঠাৎ খুন হতে হল কেন?"
"সেখানেই
তো খটকা! পুলিশ যদিও কাজ শুরু করেছে। কিন্তু শৈলেনবাবু একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ
নিয়োগ করতে চান। ইনি হলেন ইতিহাসের অধ্যাপক। দুই প্রতিবেশীর
মধ্যে বয়েসের ডিফারেন্স থাকলেও গভীর বন্ধুত্ব ছিল।"
ডানকুনির
আগেই দু’নম্বর ন্যাশনাল হাইওয়ে ছেড়ে আমরা ডানদিকে দিল্লি রোড ধরলাম। চন্দননগর
পৌঁছাতে সময় লাগল পাক্কা আড়াই ঘণ্টা। চার্চ রোড জিজ্ঞেস করতে স্থানীয় একজন পথচারী
দেখিয়ে দিল রাস্তাটি। তারপর কর্পোরেশন
বাড়ি পেরিয়ে দেখা গেল সাদা রঙের বিশাল একটা পুরানো চার্চ। গেটে
আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন শৈলেনবাবু। গাড়ির নম্বরটা ওনাকে তানিয়াদি আগে পাঠিয়ে
দিয়েছিল, তাই আমাদের দেখেই এগিয়ে এলেন সোজা। বেশ সম্ভ্রান্ত চেহারা ভদ্রলোকের। বয়স
আনুমানিক সত্তরের কোঠায়। পরিচয় পর্ব সেরে প্রথমে আমাদের নিয়ে গিয়ে প্রাচীন ফরাসি
চার্চটা ঘুরে দেখলেন।
শৈলেনবাবু
হাঁটতে হাঁটতে বললেন, "ফরাসিরা চন্দননগরে প্রথম পা রাখে সতেরশো সালের শুরুতে।
এখানে তারা কলোনি তৈরি করেছিল ব্যাবসা বাণিজ্য করার জন্য। পরে ইংরেজদের সঙ্গে বেশ
কয়েকবার ঝামেলা হয়। সতেরশো চুয়ান্নতে ব্রিটিশরা চন্দননগর
দখল করে নিয়েছিল। ফরাসিরা আবার যুদ্ধ-টুদ্ধ করে ফেরত
পায় আঠারশো ষোল সাল নাগাদ। তখন ভারতে নিযুক্ত ফরাসিদের চিফ গভর্নর পন্ডিচেরী থেকেই
এই কলোনির দেখাশোনা করতেন।"
চার্চ
থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমরা নদীর দিকে চললাম। তিনি বলে চললেন, "পাদরি
এন্টনি জিরিজমানের পরিবার আগে থাকতেন পন্ডিচেরীতে। এন্টনির দাদুর সঙ্গে এসেছিলেন
এখানে। ওনার বাবা আগেই মারা গিয়েছিলেন একটা রাইটে।
বর্তমানে তিনি প্রধান পাদরি পদ থেকে রিটায়ার করেছিলেন বছর চারেক হল। আমার সঙ্গে
বন্ধুত্ব প্রায় চল্লিশ বছরের, বুঝলে! পাশেই চন্দননগর কলেজে আমি ইতিহাস পড়াতাম।
ওনার নিজের কোনো পরিবার ছিল না। একটা চ্যারিটেবল
ট্রাস্ট চালাচ্ছিলাম আমরা। দুঃস্থ পথ-শিশুদের
বড়ো করা, পড়াশোনার দায়িত্ব, সব কিছু চলছিল ঠিকঠাক। ছেলেমেয়েগুলো
আবার পিতৃহারা হল। খুবই ভালো মনের মানুষ ছিলেন পাদরি মশাই।"
গলাটা ধরে এল ওনার। বুঝলাম ভদ্রলোক খুবই আঘাত পেয়েছেন প্রিয় বন্ধুর মৃত্যুতে।
"খুনটা
কি নদীর ধারেই হয়েছিল?"
"হ্যাঁ,
আমরা রোজ ভোরবেলা হাঁটতে আসতাম এই রাস্তায়। গত পরশু আমি আসতে পারিনি। পায়ে একটা
মোচ লেগেছিল আগের দিন। ভোরে বৃষ্টিও হচ্ছিল। পাদরি সাহেব
একাই এসেছিলেন সেদিন।"
"তারপর?"
"ঐ
যে ঝোপটা দেখছ, ওর মধ্যেই পড়েছিল ওনার মৃতদেহ। পুলিশ জানাল কেউ পিছন থেকে ওনাকে গলায়
তার জাতীয় কিছু পেঁচিয়ে খুন করেছে।"
চোখে
পড়ল নদীর পাড়ে ঝোপটা পুলিশের হলুদ রঙের স্টিকার দিয়ে ঘেরা আছে।
"কোনো
প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যায়নি?"
"না।
ভোর চারটের সময়ে এখানে এমনিতেই লোকজন থাকে না। সেদিন আবার বৃষ্টি পড়ছিল।"
"আপনি
কাউকে সন্দেহ করেন?"
তানিয়াদির
প্রশ্নের উত্তরে শৈলেনবাবু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মাথা নেড়ে জানালেন, "করি।
আমি আন্দাজ করতে পারি যে এই খুন কে করেছে বা করিয়েছে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে সরাসরি
কোনো প্রমাণ আমার কাছে নেই। সে প্রচুর বিত্তশালী লোক।
তাই তার হাত অনেক লম্বা। পুলিশ হয়তো চাইলেও কিছু করতে পারবে না। এক যদি তোমরা
গোপনে অনুসন্ধান করে কিছু তথ্য প্রমাণ জোগাড় করে দিতে পার, তাহলে আমি এর শেষ দেখে
ছাড়ব।"
"পুরো
ব্যাপারটা আমাকে একটু গুছিয়ে বলুন।"
নদীর
পাড়ে একটা বাঁধানো চেয়ারে বসে শৈলেনবাবু শুরু করলেন, "ব্যাপারটা জিরিজমান
পরিবারের বহু পুরোনো ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। ইংরেজদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ফরাসিরাও
তখন দক্ষিণ এশিয়ায় বিভিন্ন বন্দরে ঘাঁটি গেড়ে একটার পর একটা উপনিবেশ স্থাপন করছে। মার্শাল
ডাসফারগাস ছিলেন সতেরশো শতকের এক ফরাসি জেনারেল। তাঁর উপরে দায়িত্ব ছিল ভারতীয়
উপমহাদেশের চারপাশে ফরাসি উপনিবেশ স্থাপন করার। এদেশ থেকে সস্তায় বিভিন্ন ধাতু,
শস্য, সিল্ক ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস তারা দেশে নিয়ে যেত। তাদের দেশের রকমারি
দ্রব্য নিয়ে এসে বিক্রি করত এখানে। এছাড়াও স্থানীয় মানুষের মধ্যে ধর্ম প্রচারের
জন্য ক্যাথলিক মিশনারিদের দেশ থেকে নিয়ে এসে বিভিন্ন জায়গায় গির্জা স্থাপন করেছিল।
ভারতে পন্ডিচেরী ছিল ফরাসিদের মূল ঘাঁটি। বঙ্গোপসাগরের ওপারে থাইল্যান্ডেও ফরাসি
উপনিবেশ ছিল। এন্টনিদের পরিবার কয়েকশো বছর আগে এদেশে এসেছিলেন ধর্ম প্রচারের
উদ্দেশ্যে।"
একটু
থেমে তিনি বলে চললেন, "এন্টনি দু-তিন বছর আগে একটা ফরাসি ভাষায় লেখা ডায়রি
খুঁজে পেয়েছিলেন এই চার্চের পুরোনো লাইব্রেরি থেকে। সেটা ছিল জেনারেল ডাসফারগাসের
সমসাময়িক কোনো নাবিকের দিনলিপি। তা থেকে
অনেক অজানা তথ্য উঠে এসেছে। এন্টনি সেই
ইতিহাসের উপর একটা প্রবন্ধ লিখে প্যারিসের এক পত্রিকার দপ্তরে পাঠিয়েছিলেন। লেখাটা
প্রকাশিত হয়েছে মাস ছয়েক আগে। তারপর থেকেই বিভিন্ন লোক ফোন করছিল ওনাকে। দু-একজন
এখানে দেখাও করতে এসেছেন। যেমন ফ্রান্স থেকে এন্টনির পরিবারের
অ্যান্দিজ জিরিজমান সহ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক এন্টিক ডিলারও আছেন।"
"কেন?"
"নাবিকের
কথা অনুযায়ী জেনারেল ডাসফারগাসের কাছে 'দা ভিঞ্চি'-র ডিজাইন করা একটি বিশেষ ধরনের
পিস্তল ছিল, যেটা নাকি তিনি তাঁর পারিবারিক সূত্রে পেয়েছিলেন।"
"মানে
লিওনার্দো দা ভিঞ্চি?" তানিয়াদির গলাটা কেঁপে উঠল একটু।
"হ্যাঁ।
তোমরা জানো নিশ্চয়ই ইউরোপের নবজাগরণের এক প্রধান কাণ্ডারি ছিলেন এই 'দা ভিঞ্চি'।
১৪৫২ খ্রিষ্টাব্দে জন্মেছিলেন ইটালিতে। একদিকে যেমন অসাধারণ ছবি আঁকাতেন, তেমনি
পাশাপাশি তিনি ছিলেন বিখ্যাত আবিষ্কারক। আর্কিটেকচার, বিজ্ঞান, অঙ্ক, সঙ্গীত,
ইঞ্জিনিয়ারিং, সাহিত্য, শারীরবিদ্যা, ভূবিদ্যা, জীববিদ্যা, অস্ত্রবিদ্যা, ইতিহাস
চর্চা প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর জ্ঞান ছিল অসামান্য। তিনি প্রায় পাঁচশো বছর আগে
তাঁর ডায়রিতে কিছু আগ্নেয়াস্ত্রের ডিজাইন এঁকে গিয়েছিলেন। সেই ছবি থেকে পরে একটি ওয়ানসাটার
হ্যান্ডগান তৈরি করেছিল ফ্রান্সের এক কোম্পানি।
যেটা ছিল পৃথিবীর ইতিহাসের প্রথম পিস্তল। এই যে ছবিটা
দেখ।"
বলে
তিনি ওনার ফোন বের করে একটা ছবি খুললেন। আমরা হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। অদ্ভুত ডিজাইন করা
একটি দেড় হাত সাইজের বন্দুক। নিচে ছোটো ছোটো করে লেখা ‘হুইল লক পিস্তল, ডিজাইন বাই
লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, ১৬০০ সাল’।
ফোনটা
বন্ধ করে তিনি জানালেন, "বন্দুকের বাঁটের সাদা অংশটা হাতির দাঁতের তৈরি। আর
বাকিটা খাঁটি ইস্পাতের। এই মডেলের পিস্তল খুব বেশি তৈরি হয়নি সেই সময়ে। তার
মধ্যে হয়তো দু-তিনটে এখন সারা বিশ্বে খুঁজে পাওয়া যাবে। জিনিসটার এন্টিক ভ্যালু
আকাশ ছোঁয়া।"
ঝিন্টু
হঠাৎ মন্তব্য করল, "আমাদের পাড়ায় নাড়ুদার কাছে একটা 'ওয়ান সাটার' আছে। যদিও
সেটা লোকাল মেড।"
বক্র
চাহনি দিয়ে তানিয়াদি ঝিন্টুকে চুপ করিয়ে প্রশ্ন করল, "ডায়রিতে কি সেই
পিস্তলটির হদিশ দেওয়া ছিল?"
শৈলেন
বাবু উত্তর দিলেন, "হতেও পারে। পুরোনো ফরাসি ভাষায় লেখা সেই ডায়রি পড়ার
ক্ষমতা আমার ছিল না। তবে এন্টনি পাঠোদ্ধার করেছিলেন। জেনারেল
ডাসফারগাস ১৬৮৭ আর ১৬৮৮ সালে দুটো যুদ্ধ জয় করেছিলেন ব্যাঙ্কক আর ফুকেতে।
থাইল্যান্ডে ফ্রেঞ্চ আধিপত্য আর উপনিবেশ স্থাপনের পিছনে এনার উল্লেখযোগ্য অবদান
ছিল। এরপর ১৬৯০-তে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে
ফুকেত থেকে পন্ডিচেরী পৌঁছান। সেখান থেকে ফ্রান্সে ফেরার সময়ে জাহাজেই মৃত্যু হয়
ডাসফারগাসের। পিস্তলটা কিন্তু ফ্রান্সে পৌঁছায়নি।”
"তাহলে?"
"খুব
সম্ভবত জিনিসটি পন্ডিচেরীতে রয়ে গিয়েছিল। আবার এমনও হতে পারে, যে পরে হয়তো কেউ
পিস্তলটা চন্দননগরে নিয়ে এসেছে! অবশ্য এটা আমার অনুমান। এন্টনি হয়তো জানত পিস্তলটা
কোথায় আছে। আমাকে কিছু বলেনি।"
তানিয়াদি
গম্ভীর মুখে নদীর সামনে পায়চারি করতে করতে দাঁড়িয়ে পড়ে প্রশ্ন করল, "তার মানে
'দা ভিঞ্চি'-র পিস্তলের জন্যই পাদরি জিরিজমান খুন হলেন?"
একটা
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শৈলেনবাবু বললেন, "একদম তাই। উনি মারা যাওয়ার পরে আমি সেই
নাবিকের ডায়রিটা অনেক খুঁজেছি ওনার ঘরে, চার্চে, লাইব্রেরিতে।
কিন্তু কোথাও নেই।"
তানিয়াদি
জানতে চাইল, "আর এন্টনি জিরিজমানের যে লেখাটা বেরিয়েছিল প্যারিসের পত্রিকায়,
সেই লেখাটা কি পাওয়া যাবে?"
উনি
বললেন, "সেই পেজগুলির ছবি তুলে রেখেছি মোবাইলে। পাঠিয়ে দিচ্ছি তোমাকে। তবে
তাতে এই পিস্তলটি বর্তমানে কোথায় আছে সে বিষয়ে একটা কথাও লেখা নেই।"
"আচ্ছা,
পাদরিকে কে খুন করল সেই বিষয়ে আপনি কী একটা বলছিলেন?"
শৈলেনবাবু
চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে গলাটা ঝেড়ে নিলেন। "সপ্তাহ খানেক আগের কথা, কলকাতা
থেকে এক বড়ো এন্টিক ডিলার এসেছিল পাদরির সঙ্গে দেখা করতে। মিঃ সারাফ। কলকাতায়
নাকি পুরোনো জুয়েলারির ব্যাবসা আছে ওদের। কয়েক কোটি টাকা অফার করেছিল ঐ পিস্তলটির
জন্য। কিন্তু এন্টনি রাজি হয়নি। সারাফ হুমকি দিয়েছিল, বিশ্বের অনেক ধনী লোকের নজর
পড়েছে ঐ জিনিসটার পিছনে। তাই উনি হয়তো খুনও হয়ে যেতে পারেন। পাদরি
পরে আমাকে জানিয়েছিলেন কথাটা।" আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি ধরা গলায়
বললেন, "আমার সাধ্য হয়তো খুব বেশি নয়। তবু তোমাদের তদন্তের জন্য যা খরচ হবে
তা নিশ্চয়ই দেব। পিস্তলটি পাওয়া না গেলেও আমি চাই এন্টনির খুনি ধরা পড়ুক। ওর আত্মা
শান্তি পাক।"
"সারাফ...
সারাফ..." কয়েকবার বিড় বিড় করে চুপ করে গেল তানিয়াদি।
এই
সময়েই একটা পুলিশের জিপ এসে দাঁড়াল পাশের রাস্তায়। উর্দি পরা এক অল্পবয়সি অফিসার হাসি
মুখে এগিয়ে এলেন, "আপনি নিশ্চয়ই তানিয়া চ্যাটার্জি? আমি এস.আই. রণজিৎ ঘোষাল।
পাদরি মার্ডার কেসের আই.ও.।"
"নমস্কার!"
প্রত্যুত্তর জানাল তানিয়াদি।
"লালবাজার
থেকে ফোন এসেছিল থানায়। আপনাকে তদন্তে সহযোগিতা করতে বলা হয়েছে।"
তানিয়াদি
জানাল, "আমি এখানে আসার আগেই জানিয়ে ছিলাম সি.আই.ডি-র জয়েন্ট কমিশনারকে।
আপাতত ইনভেস্টিগেশন আপডেট কী?"
"কিছু
যদি মনে না করেন, আপনার সঙ্গে একটু আলাদাভাবে কথা বলতে চাই।"
তানিয়াদি
আর অফিসার হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেল নদীর বাঁধ ধরে। আমরা তিনজনে দাঁড়িয়ে থাকলাম
নদীর দিকে তাকিয়ে। চারপাশটা সুন্দর করে সাজানো। ভোঁ আওয়াজ দিয়ে একটা স্টিমার চলে
গেল নদীতে ঢেউ তুলে। একজন বিদেশি ট্যুরিস্ট হাতে বড়ো জুম লাগানো ক্যামেরা নিয়ে
দেখি নদীর ছবি তুলছে। আর একজন টি-সার্ট আর জিনস প্যান্ট পরা মাঝবয়সি লোক হাঁটতে
হাঁটতে এগিয়ে এলেন শৈলেনবাবুর দিকে। তিনি পরিচয় করিয়ে দিলেন, "আমার ছেলে
বিশ্বজিৎ। ও একটা আঁকার স্কুল চালায় এখানে। ভালো ছবি আঁকে।"
।। দুই ।।
দু’দিন
পর সন্ধ্যায় আমাদের আবার ডাক পড়ল তানিয়াদির বাড়িতে। বসার ঘরে ঢুকে দেখি শ্রী আগে
থেকেই উপস্থিত। তানিয়াদি আই-প্যাড হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছে।
"আমি
কিছু হোম ওয়ার্ক করে রেখেছি, বুঝলি। শৈলেনবাবু
বলেছিলেন, পাদরির সঙ্গে যে ব্যবসায়ী দেখা করতে গিয়েছিল তার টাইটেল ছিল সারাফ।
শৈলেনবাবু বললেন, কলকাতায় পুরোনো পৈত্রিক ব্যবসা। এ শহরে যত কিউরিও আর জুয়েলারির
দোকান আছে সেই ডাটা সার্চ করে আমি একটি মাত্র দোকান পেলাম, যার মালিকের টাইটেল
সারাফ। তের নম্বর ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে 'মুন
জুয়েলারি'। এরা বিভিন্ন এ্যান্টিক জিনিসের সঙ্গে জুয়েলারি আর দামি ডায়মন্ডের
কালেকশনও রাখে। তিন পুরুষ ধরে ব্যাবসা করছে কলকাতায়।"
"তবে
আর কী! ওদের দোকান আর বাড়িতে রেড করলেই ল্যাটা চুকে যায়।"
ঝিন্টু সহজ সমাধান বাতলে দিল।
"উপযুক্ত
প্রমাণ ছাড়া কোনো জায়গায় এই ভাবে রেড করা যায় না। আগে পারফেক্ট ইনফরমেশন চাই।
খবরটা আমাদের ভিতর থেকে জোগাড় করতে হবে।"
"কোন
প্ল্যান করেছ তুমি?"
"ভাবছি
ঐ দোকানে একবার ঢুঁ মারব। কিছু পুরোনো জিনিস কেনার ছলে যদি কোনো কথা টেনে বের করা
যায়। সেজন্যই ডেকেছি তোদের।"
ঝিন্টু
উত্তেজিত হয়ে বলল, "বেশ, চল তাহলে বেরিয়ে পড়ি। তুমি তো জানো, দরকার পড়লে কলার
চেপে ধরে আমি পেটের কথা বের করে নিতে পারি।"
তানিয়াদি
ওর দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলল, "আমি ড্রেসটা চেঞ্জ করে আসি।"
মিনিট
দশেক পরে যখন তানিয়াদি আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল, রীতিমতো ঘাবড়ে গেলাম। পরনে কাজ
করা নীল জর্জেট শাড়ি, মাথায় সিঁদুর, দুই হাতে এক গাদা চুড়ি আর গয়না। কানে আর
গলাতেও তাই। সঙ্গে মানানসই লেডিস পার্স। আমাদের হাঁ হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে
মুচকি হেসে বলল, "চ!"
প্রায়
চল্লিশ মিনিট লাগল জ্যাম কাটিয়ে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে 'মুন জুয়েলারি'-র সামনে পৌঁছাতে। বাইরে
থেকে দেখলাম বেশ ঝাঁ চকচকে বড়ো দোকান। তবে সন্ধ্যার সময়ে এ রাস্তায় পার্কিং পাওয়া
খুব সমস্যা। একটু এগিয়ে গিয়ে রাখতে হবে গাড়ি।
তানিয়াদি
বলল, "আমি আর শ্রী নেমে যাচ্ছি। কাস্টমার সেজে ভিতরে ঢুকব। ঝিন্টু আর রণ গাড়ি
পার্ক করে দোকানের বাইরে পাহারা দিবি। ফর
ব্যাকআপ।"
"সে
কী! আমরা ভিতরে যাব না?"
"না।"
কথাটা
বলেই নেমে গেল দু’জনে। নামার সময়ে শ্রী জিব ভেংচে বলল, "তোদের পাহারাদার
হিসেবেই মানায় ভালো।"
তানিয়াদির
উপরে কোনো কথা চলবে না। নইলে আমাদের মিশন থেকে বের করে দিতে পারে। অগত্যা
পাশে একটা গলিতে গাড়ি রেখে দু’জনে গুটিগুটি পায়ে ফিরে এলাম দোকানের সামনে। লক্ষ
করলাম বাইরে একজন বন্দুকধারী পাহারাদার। ভিতরের কোনো দৃশ্য বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে
না। নিরাপত্তার জন্য রাস্তার দিকে সিসি ক্যামেরাও লাগানো আছে একটা। ঝিন্টুকে
বললাম, "চল, উলটো দিকের ফুটপাতে। ঐ এগ রোলের
দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াই।"
ফাস্ট
ফুডের গন্ধ নাকে যেতেই খিদেটা কেমন যেন চাগাড় দিয়ে উঠল। ঝিন্টু দেখলাম আমার মনের
কথা পড়ে নিয়েছে। দুটো এগ-চিকেন রোলের অর্ডার দিয়ে আমাকে জানাল, "সব খরচা বিলে
জুড়ে দেব। চিন্তা করিস না। টাকাটা আপাতত ছাড়।"
এগ রোলটা
গোগ্রাসে গলাধঃকরণ করতে করতে তাকিয়ে ছিলাম উলটো দিকে।
ভাবছি কী করছে দু’জনে ভিতরে ঢুকে কে জানে? এমন সময় হঠাৎ আমাদের পাড়ার মণিদার সঙ্গে
দেখা। আমাকে এগ রোল খেতে দেখে চোখ বড়ো বড়ো করে জিজ্ঞেস করল, "কী রণ, এদিকে
কোথায়?"
"এই
তো এগ রোল খাচ্ছি। বন্ধুর সঙ্গে এসেছিলাম কলেজের একটা প্রজেক্টের কাজে। তুমি কোথায়
চললে?"
মণিদা
জানাল, "আমি তো ডিজাইনার সীমামিত্রার কাছে কাজ করছি। ঐ তো উলটো দিকে
ওয়ার্কশপ। চা খেতে বেরিয়েছি।"
"আচ্ছা।
মুন জুয়েলারির পাশে যে বুটিকটা?"
"হ্যাঁ।"
ঝিন্টু
পাকামো মারল, "এটা তো সারাফদের দোকান, তাই না?"
মণিদা
চায়ের ভাঁড় হাতে নিয়ে বলল, "জুয়েলারির দোকানটা তো? হ্যাঁ। চেন নাকি
ওদের?"
"না,
তেমন নয়। বাবার সঙ্গে একবার এসেছিলাম কয়েক বছর আগে। একটা পুরোনো ব্রিটিশ আমলের ঘড়ি
বিক্রি করার জন্য।"
মণিদা
চোখ গোল করে বলল, "ওতেই তো পয়সা ওদের। পুরোনো মাল কম দামে কিনে বিদেশি পার্টিকে
কত গুণ লাভে যে বিক্রি করে তা ভগবানই জানে! দেখছি তো
দিন রাত। বিদেশিদের ধরে আনার জন্য ব্রোকার আছে। কাস্টমারগুলো আমাদের বুটিকেও ঢোকে
মাঝে মধ্যে।"
"তবে
সারাফরা লোক ভালো, কী বলেন মণিদা?" ঝিন্টু আর একটু খুঁচিয়ে দিল।
"বল
কী হে! তুমি কতটা চেনো ওদের?" ঝিন্টুর কথায় দেখলাম মণিদা বেশ চটেছে, "তিন
ভাই হল তিনটে চশমখোর। বাজারে বেআইনি সুদের ব্যাবসা চালায়
কত কোটি টাকার তা জানো?"
আমি
কথাটা ধরে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, "ওরা তিন ভাই নাকি?"
"হ্যাঁ,
মহেশ, সুরেশ আর রমেশ। আদপে রাজস্থানের লোক। সুরেশ সারাফের মেয়ের বিয়ে তো দু'দিন
পরে। ঐ যে এখন কী একটা বলে, ডেসটিনেশন ম্যারেজ।"
"মানে
বাইরে গিয়ে বিয়ে করা।"
"ঠিক।
বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে বিদেশে।"
"কোথায়?"
"ফুকেত
না কী একটা নাম বলল। হঠাৎ ঠিক হয়েছে। আমাদের
বুটিক থেকে তো সবাই ড্রেস বানিয়েছে। তাই পেলাম
খবরটা। আজকের মধ্যেই সব মাল ডেলিভারি দিতে হবে। যা খুঁতখুঁতে লোক এরা! আমাদের এখন
শিরে সংক্রান্তি যাকে বলে। চলি রে!"
কথাটা
শেষ করে হন্তদন্ত হয়ে মণিদা রাস্তা পেরিয়ে ঢুকে গেল সীমামিত্রার বুটিকে। আর ঠিক
সেই সময়েই তানিয়াদি আর শ্রী বেরিয়ে এল পাশের মুন জুয়েলারির দোকান থেকে।
গাড়িতে
বসে তানিয়াদি জানাল, "এরা সব গভীর জলের মাছ, বুঝলি! অনেক রিকোয়েস্ট করা
সত্ত্বেও আমাদের সাধারণ সব গহনা ছাড়া কোনো এন্টিক জিনিস দেখাল না। মালিকরা না
থাকলে যা হয়।"
কথাটা
শুনে ঝিন্টু হঠাৎ খ্যাঁক খ্যাঁক অবজ্ঞার সুরে পাশ থেকে হেসে উঠল। তানিয়াদি জানতে
চাইল, “তোর আবার কী হল?”
আমি
ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললাম। কথাগুলি শুনে চুপ করে গেল তানিয়াদি। বাড়ি পৌঁছনোর আগে
শুধু ক'বার বলল, “ফুকেত... ফুকেত...”
।। তিন ।।
রাত্রি
এগারোটায় আমরা তিন জনে কলকাতা বিমানবন্দরের গেট নং থ্রি'এ-র সামনে এসে নামলাম
ট্যাক্সি থেকে। এটাই আন্তর্জাতিক বিমান ধরার গেট।
বলে দিয়েছিল তানিয়াদি। বাইরের দেশের বিমানগুলি রাতেই বেশি ওঠানামা করে। বেশ লম্বা
লাইন পড়েছে সামনে।
শ্রী
এক নাগাড়ে কথা বলে চলেছে ফোনে। একটা শব্দই
কানে আসছে বার বার, "কোনো চিন্তা কোর না মা।"
মিনিট পাঁচেক পর বাড়ির ফোন কেটে আমাদের জিজ্ঞেস করল, “কখন আসবে রে দিদি? আমার যেন
বুকের মধ্যে কী রকম হচ্ছে!” ওর বাড়ি থেকে পারমিশন নিতেই সব থেকে বেশি বেগ পেতে
হয়েছে আমাদের। থাইল্যান্ড যাব শুনেই সবাই হই হই করে তেড়ে এল।
তারপর তানিয়াদি বোঝাতে সম্মতি দিয়েছে একে একে।
বাড়িতে বলেছি আমরা সবাই বেড়াতে যাচ্ছি। তানিয়াদির
এক মক্কেল ট্রিট দিয়েছে, সব খরচ তাঁর।
ঝিন্টু
বলল, “কাল সন্ধে পর্যন্ত জানতাম না যে আমরা সত্যিই যাচ্ছি। এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না
কিন্তু!”
শ্রী
চুল ঝাঁকিয়ে উত্তর দিল, “আমার উপর দিয়ে গত চব্বিশ ঘণ্টায় যা ঝড় গেছে, সে আর বলার নয়।
মা তো কিছুতেই ছাড়বে না। আর বাবা সমানে মাকে কনভিন্স করার চেষ্টা করে চলেছে।”
আমি
বললাম, “ভাগ্যিস আমাদের তিনজনেরই পাসপোর্ট করা ছিল আগে থেকে।”
“কিন্তু
ভিসা তো করা হল না।”
শ্রী
জানাল, “তানিয়াদি বলেছে থাইল্যান্ডে অন এরাইভাল ভিসা পাওয়া যায়।”
আমি
বললাম, “ব্যাপারটা এখনও আমার কাছে পরিষ্কার হচ্ছে না রে! হঠাৎ
করে আমাদেরকে নিয়ে থাইল্যান্ড যাচ্ছে কেন তানিয়াদি?”
কথা
বলতে বলতেই তানিয়াদি এসে নামল গাড়ি থেকে। নীল জিন্সের সঙ্গে সাদা টপে দারুণ
স্মার্ট লাগছে ওকে। হাতে একটা লাল হুইল ব্যাগ। আমাদের সবার হাতে একটা করে ই-টিকিট
ধরিয়ে বলল, “ভিতরে চল। বলছি সব কিছু।”
থাই
এয়ারওয়েজের বিমান ছাড়বে ঠিক রাত দুটোয়। আমাদের প্রত্যেকের হাতে একটা করে খাম ধরিয়ে
দিয়েছে এয়ারপোর্টে ঢুকে। খুলে দেখলাম থাইল্যান্ডের টাকা।
তানিয়াদি
জানাল, "একে বলে বাট।"
ঝিন্টু
স্বগতোক্তি করল, "ভাট! তার মানে ও দেশের লোক শুধু ভাট বকে?"
"ভাট
নয়, বাট। ভারতীয় টাকার প্রায় আড়াই গুণ।"
বিদেশের
বিমানে ওঠার অনেক ঝক্কি। বহুক্ষণ
দাঁড়াতে হল লাইনে। বোর্ডিং পাস থেকে শুরু করে হাজার রকম সিকিউরিটি চেকিং পেরিয়ে
আমরা হাজির হলাম লাউঞ্জে। এবার প্লেনে ওঠার অপেক্ষা। হাতে এখনও অনেকটা সময় আছে। তানিয়াদিকে
চেপে ধরতে মুখ খুলল, “ধনী ব্যক্তিদের ডেস্টিনেশন ওয়েডিং বা বাইরে গিয়ে বিয়ে করার
একটা চল হয়েছে ইদানীং। তা এই হিরে আর এ্যান্টিক গুডসের
ব্যবসায়ী সারাফদের সে ক্ষমতা আছে। তবে ফুকেতের নাম শুনে আমার একটা খটকা লেগেছিল।”
“কেন?”
তানিয়াদি
কিছুটা চুপ থেকে উত্তর দিল, “সতেরশো শতাব্দীতে ব্যাঙ্কক আর ফুকেত ছিল ফরাসিদের
উপনিবেশ। এক দিকে পাদরি জিরিজমান খুন হলেন চন্দননগরে। ওনার কাছ থেকে তিনশো বছরের
পুরোনো ফরাসি নাবিকের ডায়রিটা চুরি হল। আর তারপরই সারাফ ফ্যামিলি তড়িঘড়ি ডেসটিনেশন
ম্যারেজ করতে চলল ফুকেতে। ব্যাপারটা কাকতালীয় হলেও খুবই সন্দেহজনক মনে হচ্ছে আমার।"
"ব্যাপারটা
তড়িঘড়ি ঠিক করেছে জানলে কী করে?"
"কেন,
তোর পাড়ার মণিদা সেদিন কী বলেছিল, ভুলে গেছিস?"
আমার
ধাঁ করে মনে পড়ে গেল। "হ্যাঁ, মণিদা বলেছিল বটে হঠাৎ করে ঠিক করেছে এই
ডেসটিনেশন ম্যারেজ।"
"তবে?
তাছাড়া আমি অন্য সোর্সেও যাচাই করেছি, কথাটা সত্যি।"
ঝিন্টু
ভ্রু কপালে তুলে বলল, "বুঝেছি, বিয়ের জন্য অনেক রকম পূজার সরঞ্জাম ও
আনুষঙ্গিক জিনিস নিশ্চয়ই এদেশ থেকে ফুকেতে নিয়ে যাওয়া হবে। তার মধ্যে এই চুরি
যাওয়া বন্দুকটা পাচার করা খুবই সুবিধাজনক।"
তানিয়াদি
মাথা নেড়ে বলল, "ধুর! সারাফরা অত বোকা নয়। তাছাড়া কাস্টমসের চেকিং পেরিয়ে ধাতব
বন্দুক বা পিস্তল বিদেশে নিয়ে যাওয়া কি অতই সোজা নাকি!"
"তাহলে?"
"আমার
মনের মধ্যে একটা অন্য সন্দেহ দানা বাঁধছে।"
"সেটা
কী?"
একটু
থেমে তানিয়াদি বলল, “এন্টনি জিরিজমানের লেখা প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল 'লে-ক্রি-দে
প্যারিস' নামে এক ম্যাগাজিনে। যার ইংরাজি অনুবাদ পড়ে বুঝলাম, থাইল্যান্ডের রাজা
নারাই’এর কাছ থেকে লুট করা বিপুল সোনা আর ধনরত্ন ডাসফারগাস ফ্রান্সে নিয়ে যেতে
পারেননি। গুরুতর আহত অবস্থায় তিনি প্রথমে পন্ডিচেরী ফিরে আসেন। শারীরিক অবস্থার
আরও অবনতি হলে জাহাজে করে দেশের উদ্দেশে পাড়ি দেন। জাহাজেই তাঁর মৃত্যু হয়। এদিকে তাঁর
মৃত্যুর পরে সেই সম্পত্তির আর হদিশ পায়নি কেউ। পাদরি যদিও তাঁর প্রবন্ধে এই বিষয়ে বিশেষ
কিছু লিখে যাননি। কিন্তু আমার ধারণা ডাসফারগাসের
ছায়াসঙ্গী সেই ফরাসি নাবিক তাঁর ডায়রিতে এই গুপ্তধনের বিষয়ে সংকেত দিয়ে গিয়েছিলেন।”
আমি
বললাম, "তার মানে তিনশো বছরের পুরোনো সেই ডায়রি এত বছর পরে চুরি করে ফুকেত
নিয়ে যাওয়া হচ্ছে গুপ্তধন উদ্ধারের জন্য!"
ঝিন্টু
হাতের তেলোয় ঘুষি মেরে বলল, "আর আমরা এখন সেই গুপ্তধনের পিছনে ছুটছি!"
"গাছে
কাঁঠাল আর গোঁফে তেল! আগে তো ডায়রিটা উদ্ধার করি। এখন সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কথাটা
মন দিয়ে শোন।"
আমাদের
সবার মাথাগুলি তখন ভোঁ ভোঁ করছে। তবু অদৃশ্য শক্তির টানে কাছাকাছি চলে এলাম। তানিয়াদি
চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে নিল একবার। আমরা হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছি লাউঞ্জের ডান
প্রান্তে ফাঁকা দিকটায়। এদিকে লোকজন
বেশি নেই। কাচের মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে অন্ধকারে বিমানের ওঠা নামা।
তানিয়াদি
একটু চাপা গলায় বলল, "এই ধরনের ফরেন ডেসটিনেশন ওয়েডিং-এর পিছনে কোনো বড়ো
ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের টিম কাজ করে। আমি খোঁজ
নিয়ে জেনেছি সারাফদের কাজটা করছে 'হ্যাপি ওয়েড' নামে কলকাতারই একটা গ্রুপ। ওরা
তাড়াহুড়ো করে অর্ডার দিয়েছে এই কোম্পানিকে। সেখানে গেস্টদের এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ
করা থেকে শুরু করে, হোটেলে নিয়ে যাওয়া, প্রত্যেকের খাওয়া দাওয়া, অনুষ্ঠানের জন্য
যাবতীয় জিনিস জোগাড় করা, লোকেশন ডেকোরেশন করা, মিউজিক, ডান্স, কোরিওগ্রাফি,
প্রত্যেকের মেকআপ, ফটোগ্রাফি, ভিডিওগ্রাফি, এডিটিং, আর শেষে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসা
পর্যন্ত সব কাজ করবে। এই সমস্ত কাজের জন্য লাগে প্রচুর প্রশিক্ষিত
লোক। কলকাতা পুলিশের ডিজির মাধ্যমে আমি 'হ্যাপি ওয়েডে'র মালিক মিঃ পীযূষ গোয়েলের সঙ্গে
যোগাযোগ করেছিলাম। আমাদের চারজনের নাম ঢুকিয়ে দিয়েছি ওদের গ্রুপে।"
শ্রী
জানতে চাইল, "কেন?"
"অনেকগুলি
কারণ আছে। প্রথম কারণ, সারাফদের তিন ভাইকে চোখে
চোখে রাখা। বিশেষ করে ছোটো ভাই রমেশকে। খবর পেয়েছি যেদিন পাদরি জিরিজমান চন্দননগরে
খুন হয়েছিলেন, সেদিন রমেশ সারাফ ওখানেই ছিল। আমার সন্দেহ
তালিকাতে সবার উপরে তাই এই ব্যক্তির নাম। এছাড়া
বাকিদের উপরেও কড়া নজর রাখতে হবে। কে কোথায় কখন যাচ্ছে, সব রিপোর্ট চাই আমার। তার
জন্য এই পরিবারের কাছাকাছি থাকাটা খুব জরুরি।"
আমি
জিজ্ঞেস করলাম, "ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টে আমাদের কাজটা ঠিক কী?"
"রণ
আর ঝিন্টু ফটোগ্রাফারের হেলপার হিসেবে কাজ করবি। এই বিষয়ে তোদের ছবি তোলার
অভিজ্ঞতা কাজে লাগবে। শ্রী ক্লাসিক্যাল আর ওয়েস্টার্ন ডান্সের কোর্স করেছে। তাই ও
কোরিওগ্রাফারের সহকারী সেজে কাজ করবে। আর আমি থাকব ম্যানেজমেন্টে। যাতে সবার উপর
নজর রাখা যায়। ক্লিয়ার?"
বুঝলাম
দাবার বোর্ড পুরো সাজিয়ে ফেলেছে তানিয়াদি। শুধু নিজের নিজের কাজটা ঠিকঠাক করতে
হবে। আমাদের হাতে একটা করে 'হ্যাপি ওয়েড' কোম্পানির ছবি দেওয়া আই কার্ড ধরিয়ে দিয়ে
বলল, "ওখানে গিয়ে আমরা কিন্তু প্রয়োজন ছাড়া কথা বলব না। তোদের সবার ফোনে আমি
ইন্টারন্যাশেনাল রোমিং করে দিয়েছি। প্রয়োজনে হোয়াটসএ্যাপ করবি। আর একটা কথা। মিঃ
গোয়েল আমাকে বলেছেন, যেন ওনার কোম্পানির রেপুটেশনে কোনো আঘাত না আসে। সো বি
কেয়ারফুল!"
শ্রী
জানতে চাইল, "ওদের প্রোগ্রামের ডিটেলটা কী?"
"এদের
কাস্টে মূল বিয়েটা হয় মূলত চার দিনে। সঙ্গীত, মেহেন্দি, বিয়ে আর বিদাই। এখানে মোট পাঁচ
দিন সময় নিয়েছে এরা। কালকের মধ্যে সবাই ফুকেত পৌঁছচ্ছে।
আগামী পরশু সঙ্গীত হবে। পরের দিন সবাই মিলে যাবে ফিফি আইল্যান্ড ঘুরতে। তারপরের
দিন মেহেন্দির অনুষ্ঠান। তারপর বিয়ে আর বিদাই সেরে ছ'দিন পর ফিরবে।"
ঝিন্টু
বড়ো করে শ্বাস টেনে জিজ্ঞেস করল, "আমরাও কি যাব এদের সঙ্গে ঐ ফিফিতে?"
"ফটোগ্রাফারদের
তো যেতেই হবে।"
মাইকে
ঘোষণা করা হল, কলকাতা থেকে ব্যাঙ্কক যাওয়ার জন্য থাই এয়ারওয়েজের বিমান তৈরি। আমরা
এগিয়ে গেলাম ১৩ নং গেটের দিকে। লাইনে দাঁড়িয়ে লক্ষ করলাম আমাদের সামনে পিছনে বেশ
কয়েকজন অবাঙালী মহিলা ও পুরুষ দাঁড়িয়ে আছেন যাঁদের প্রত্যেকের হাতেই মেহেন্দি দিয়ে
কলকা আঁকা। আড় চোখে ঝিন্টুকে ইশারা করতে সে গুনগুন করে গান গাইতে শুরু করল,
"গুমনাম হ্যায় কোই..."
বিশাল
মাপের দোতলা এয়ারবাসের পেটের ভিতরে ঢুকেই প্রথম চোখে পড়ল থাই পোশাকে সুসজ্জিত
সুন্দরী বিমান সেবিকাদের। ঢুকতেই জোড় হাত আর মাথা নিচু করে বলল, "সোঁদে খাঁ!"
নিজের
সিট নম্বর খুঁজে বসে জিজ্ঞেস করলাম, "এর মানে নিশ্চয়ই ওয়েলকাম!"
তানিয়াদি
জানাল, "আজ্ঞে না, 'সোঁদে খাঁ'র মানে থাই ভাষায় হ্যালো!"
যথা
সময়ে ঝলমলে কলকাতা ছেড়ে বিমান উড়ে গেল অন্ধকার আকাশে। প্রত্যেক সিটের সামনে একটি
করে ভিডিও স্কিন আছে। তাতে দেখা যাচ্ছে যাত্রাপথ। বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে সোজা
দক্ষিণ-পূর্ব বরাবর চলেছি আমরা। কানে
হেডফোন লাগিয়ে স্ক্রিনে কোনো সিনেমা অথবা গানও শোনা যায়। আমি খুঁজে পেতে একটা হলিউডি
মারামারির ছবি চালিয়ে দিয়েছি। তানিয়াদি
মুখ বাড়িয়ে জানাল, "ব্যাঙ্ককের টাইম আমাদের দেশের থেকে আড়াই ঘণ্টা এগিয়ে। সেই
মতো নিজেদের ঘড়ি ঠিক করে নে।"
।। চার ।।
ঘড়িতে
থাইল্যান্ডের সময় সাড়ে ছটা। পূব আকাশে মেঘের উপর লাল জবা ফুলের রং গুলে দিয়েছে
সূর্যিমামা। প্লেন নামল 'সূবর্ণভূমি' আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে। তানিয়াদি কাবার্ড
থেকে হ্যান্ডব্যাগটা বের করে কাঁধে নিয়ে বলল, "এত সুন্দর নাম পৃথিবীর আর কোনো
এয়ারপোর্টের আছে বলে আমার জানা নেই।"
বিমান
থেকে নেমেই আমরা ছুটলাম ভিসার লাইনে। এপ্লিকেশন ফর্ম, পাসপোর্ট আর দুশো বাট করে জমা
নেওয়ার মিনিট দশেকের মধ্যেই ভিসা পাওয়া যাচ্ছে। আর একটি বিনামূল্যে ভিসার লাইন
আছে, সেখানে কম করে দুশো লোকের ভিড়। এদেশে ঢোকার ছাড়পত্র নিয়ে আবার একপ্রস্থ
পরীক্ষা হল সারা শরীরের। তারপর অন্য একটি বিমানে উঠে বসলাম আমরা। যেটি আমাদের
ব্যাঙ্কক থেকে ফুকেত নিয়ে যাবে। আকাশে ওঠার পর বিমানে প্রাতরাশ পর্ব শেষ করে
ঝিন্টু একটা ঢেঁকুর তুলে বলল, "যাক, একটা ব্যাপারে নিশ্চিন্ত!"
জানতে
চাইলাম, "কী ব্যাপার?"
"থাই
খাবারের টেস্টগুলো ভালো। আসার সময় কে একজন বলছিল এরা শুধু আরশোলা, উচ্চিংড়ে ভাজা
আর শামুক, গেঁড়ি সেদ্ধ করে খায়!"
শ্রী
শুনেই মুখ কুঁচকে "ওয়াক! ওয়াক!" করে উঠল। তানিয়াদি জানাল, "ওসব
খাদ্য চাখতে গেলে পাটং-এর ফুড স্ট্রিটে নিয়ে যাব একদিন।"
আমি
সিরিয়াস গলায় বললাম, "ঐ লোকগুলো ব্যাঙ্কক থেকেও এই প্লেনে উঠেছে, দেখেছিস?
মনে হচ্ছে ওরা সারাফদের বিয়েতেই যাচ্ছে।"
শ্রী
আমাকে সমর্থন করে বলল, "ওদের মধ্যে একজন মাঝবয়সি লোক আছে সাদা সার্ট পরা। সব
ক’টা আঙ্গুলে মোটা মোটা পাথর বসানো সোনার আংটি। গলায় মোটা চেন। চেকিং-এ দেখলাম
অনেকক্ষণ সময় লাগছিল।"
"লোকটার
জন্য প্লেন ছাড়তে দেরি হল দশ মিনিট।"
"ঠিক।"
ঝিন্টু
মন্তব্য করল, "কিছুক্ষণ আগে আমি যখন পিছনের দিকে বাথরুমে গিয়েছিলাম দেখি
লোকটা লক না করেই ভিতরে ঢুকে বসে আছে। ভাব একবার!"
বললাম,
"তার মানে লোকটা খুব টেনশনে আছে।"
তানিয়াদি
শুনিয়ে দিল, "উনি হলেন সুরেশ সারাফ। মেজ ভাই। ওনার
মেয়েরই বিয়ে। তাই টেনশনে থাকাটা স্বাভাবিক।"
জিজ্ঞেস
করলাম, "তুমি কী করে জানলে?"
"ভিসা
কাউন্টারে পাসপোর্ট ফেরত নেওয়ার জন্য আমার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন ভদ্রলোক। তখনই
ওনার নামটা চোখে পড়েছে।"
ফুকেত
আসলে থাইল্যান্ডের নিচের দিকে সমুদ্রের মধ্যে লেজের মতো বেরিয়ে থাকা একটা দ্বীপ।
বিমান বন্দরটা একেবারে সমুদ্রের গায়ে লাগোয়া। নামার সময়ে মনে হল সটান সমুদ্রে ঝাঁপ
দেবে হয়তো! আদপে তেমন কিছু হল না। বেল্ট থেকে লাগেজ নিয়ে বাইরে আসতে দেখি সারাফ
পরিবারের সবাই দলবল মিলে একটা বড়ো দোতলা বাসে উঠছে লাইন দিয়ে। 'হ্যাপি ওয়েড'-এর
লোক সেখানে আগে থেকেই হাজির ছিল। তানিয়াদির সঙ্গে আমরা এগিয়ে গেলাম ট্যাক্সি
স্ট্যান্ডের দিকে।
"হোটেল
পাটং রিসর্ট।"
নির্দেশ
দিতে চলতে শুরু করল ট্যাক্সি। সমুদ্রের ধার
দিয়ে ছবির মতো সুন্দর চড়াই উৎরাই রাস্তা পাহাড় আর জঙ্গল ফুঁড়ে এগিয়ে চলেছে। দু’দিকেই
মনোরম দৃশ্য। কখনও পথের পাশে দেখা যাচ্ছে সোনালি
রঙের কারুকার্য করা প্যাগোডা। আবার গাছপালার ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ছে নীল সমুদ্র।
শ্রী
অবাক গলায় বলল, "রাস্তায় কোনো ধুলো, ধোঁয়া, আবর্জনা, প্লাস্টিক, কিছুই নেই।
আশ্চর্য!"
আমি
বললাম, "কোনো গাড়ি হর্ন বাজাচ্ছে না, এটা খেয়াল করেছিস?"
ঝিন্টু
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে স্বগতোক্তি করল, "কালকে এই সময়ে পাড়ার মোড়ে বিশুদার
দোকানে ছবি তোলার জন্য বসে ছিলাম। ভাবা যায়!"
প্রায়
পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় লাগল আমাদের হোটেল পৌঁছাতে। সারাফদের বড়ো বাস তখনও এসে
পৌঁছায়নি। লাউঞ্জে ঢুকতেই হাসিমুখে এগিয়ে এলেন এক হ্যান্ডসাম মাঝবয়সি লোক।
পরিষ্কার বাংলায় বললেন, "এখানে আমি 'হ্যাপি ওয়েড'-এর লোকাল ম্যানেজার। নাম
চন্দন শর্মা। বাড়ি উত্তর কলকাতায়। এখানে ব্যাবসার সূত্রে আসা যাওয়া করি। মিঃ গোয়েল
আপনাদের বিষয়ে আমাকে ফোনে ডিটেল বলেছেন। আমি যতটা
সম্ভব কো-অপারেট করব। যা লাগবে বলবেন।"
তানিয়াদি
সম্মোহনী হাসি দিয়ে বলল, "প্রথমেই আমার যেটা লাগবে, সেটা হল এঁদের পরিবারের
একটা পুরো লিস্ট।"
"সেটা
আমার কাছে রেডি আছে। এই যে। এতে সবার নাম, বয়েস, আর কে কোন ফ্লোরে, কোন রুমে
থাকছেন, সব ডিটেল পেয়ে যাবেন।"
তানিয়াদি
লিস্টটাতে চোখ বুলিয়ে জিজ্ঞেস করল, "সব গেস্ট এসে গেছেন?"
"না।
মোট দেড়শো জন গেস্ট আসবেন। অবশ্য
সবাইকে এক সঙ্গে ঐ বিয়ের দিনেই পাবেন। এখন জনা পঞ্চাশ আছেন।
আজকে ঢুকছেন আরও প্রায় পঞ্চাশ জনের মতো। আপনাদের ফ্লাইটেই এসেছেন তাঁরা।"
"বিয়ের
অনুষ্ঠানটা কি এখানেই হবে?"
শর্মাজি
মাথা নেড়ে জানালেন, "সুইমিং পুলের পাশে ফাঁকা লনে তাঁবু খাটানো শুরু হয়ে
গেছে।"
ছ’তলায়
সুইমিং পুলের দিকেই দুটো রুম দিয়েছে আমাদের। ব্যালকনি থেকে অনুষ্ঠানের জায়গাটা
দেখা যাচ্ছে সরাসরি। তানিয়াদির জুম লাগানো নিকনের ক্যামেরায় পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে কাছ
থেকে কে কী করছে। কিছু কিছু জায়গায় আড়াল পড়েছে রঙিন তাঁবু। তানিয়াদির বক্তব্য
অনুযায়ী ছোটো ভাই সুরেশকে এখনও দেখা যাচ্ছে না কোথাও। আমাদের বলল, "আধ ঘণ্টার
মধ্যে ফ্রেস হয়ে লাউঞ্জে চলে আয়। ওখানে তোদের বুঝিয়ে দেব কী করতে হবে?"
ক্যামেরাটা
আপাতত আমার আর ঝিন্টুর হেফাজতেই থাকছে। 'হ্যাপি ওয়েড'-এর তরফ থেকে আমাদের জন্য
ড্রেস দিয়ে গেছে রুমে। নীল প্যান্ট, গোলাপি ফুল হাতা জামা, তার উপর নীল ওয়েস্ট
কোট। সারা রাতের বিমান ধকল সামলে শরীর আর বইছিল না আমাদের। কিন্তু নিছক ছুটি
কাটানো তো এটা নয়। তাই আলস্য না করে প্রস্তুত হয়ে নিলাম।
দুপুরে
ডাইনিং হলে বুফেতে খাওয়া সেরে আমি আর ঝিন্টু ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম ব্যবস্থাপনা। আত্মীয়
স্বজনরা নিজেদের মধ্যে গল্প করতে ব্যস্ত। ছোটো
ছেলেমেয়েগুলো সারাক্ষণ দৌড়ে বেড়াচ্ছে। মধ্য বয়স্ক লোকগুলো ছোটো ছোটো দলে ভাগ হয়ে
ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। অনেকে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেছে সমুদ্রের ধারে। সুইমিং পুলের এক
পাশে চলছে গান বাজনা। ডিজে মাঝে মাঝে সুর বদলে দিচ্ছে সেই গানের। শ্রী দেখলাম
আমাদের মতোই পোশাক পরে মিশে গেছে ডান্সের দলে। কোরিওগ্রাফার মাথায় কালো ফেট্টি
বেঁধে ওদের নাচের স্টেপগুলি বোঝাতে ব্যস্ত। শর্মাজি আমাদের ডেকে পরিচয় করিয়ে দিল
ফটোগ্রাফার গ্রুপের সঙ্গে। দুটি বড়ো ভিডিওগ্রাফি ক্যামেরা আর তিনটি স্টিল ক্যামেরা
চলছে। আমাদের হাতের ক্যামেরাটি দেখে একজন মন্তব্য করল, "ফ্রেসারদের হাতে এত
দামি ক্যামেরা মানায় না। ছবি তুলতে গেলে এঙ্গেল আর লাইট বুঝতে হয়, বুঝলে?"
আমরা মাথা নেড়ে সরে পড়লাম মানে মানে। সত্যি কথা বলতে কী সবাই এত সুন্দর সেজে-গুজে
ঘুরছে যে ছবি তুলে শেষ করা যাবে না। যদিও এটা আমাদের আসল উদ্দেশ্য নয়, তবুও সবাইকে
দেখিয়ে আমরাও ক্যামেরা বাগিয়ে লেগে পড়লাম কাজে।
সারাটা
দিন আমাদের এভাবেই কাটল। বড়ো ভাই, মানে মহেশ সারাফ তাঁর বিশালবপু সাইজ নিয়ে একটা
বড়ো গদিওলা সোফায় সারাক্ষণ বসে রইলেন। এনার রকমসকম দেখে মনে হয় সন্দেহের তালিকা
থেকে বাদ দেওয়াই যায়। তবু তানিয়াদির নির্দেশ মতো ওনার চারপাশে ঘুরঘুর করলাম
কিছুক্ষণ। কথাবার্তা যা বলছেন সবই পারিবারিক। তবে একবার শুধু মুখ ফসকে একজনকে বলতে
শুনলাম, "ছোটে কো লেকে থোড়া পারেশান হুঁ!" এই ছোটেটা কে? রমেশের কথা
বলছেন কি?
এদিকে
মেজো ভাই মনে টেনশন চেপে রেখে সবার সঙ্গে গদগদ হয়ে গাল ভর্তি হেসে কথা বলে চলেছেন।
আর মাঝে মাঝেই ম্যানেজমেন্টের লোককে ধরে ধমক দিচ্ছেন। এটা কেন এখানে? ওটা কেন এখনও
হয়নি? ইত্যাদি। আর মাঝে মাঝেই ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছেন। পকেট থেকে মোবাইল বের করে চেক
করছেন। মনে হল কোনো কিছুর জন্য বেশ উতলা হয়ে আছেন উনি। বিশেষ কেউ আসবে কি? সন্ধ্যা
গড়িয়ে রাত হল। কিন্তু ছোটো ভাইয়ের দেখা পেলাম না একবারও।
রাতের
খাওয়া সেরে ঝিন্টুকে বললাম, "চল হেঁটে একটু সমুদ্রের হাওয়া খেয়ে আসি।"
রাস্তাটা
পেরিয়ে দুশো মিটার গেলেই পাটং সি-বিচ। অন্ধকার শুনসান ফাঁকা। হাওয়াটা বেশ লাগছে।
ধার দিয়ে নারকেল গাছের সারি। ঝিন্টু আবার গান গাইতে শুরু করল গুনগুন করে। কান পেতে
শুনলাম, "অন্ধেরি রাতো মে, সুনসান রাহো পর ..."
সমুদ্রের
একটানা গর্জন শুনতে শুনতে সি-বিচের ধার ধরে চলে গিয়েছিলাম অনেকটা। মনটা বেশ
ফুরফুরে আনন্দে উড়ে বেড়াচ্ছিল। ফেরার পথে ঝিন্টু জিজ্ঞেস করল, "এই পাটং বিচটা
সমুদ্র পথে দীঘা বা বকখালি থেকে কত দূর হবে বল তো?"
আমি
জানতে চাইলাম, "কেন সাঁতরে যাবি ভাবছিস?"
"চেষ্টা
করে একবার দেখলে হয়। অন্তত একটা ভেলা পেলে..."
ঠিক
সেই সময়েই একটা কাণ্ড হল। নারকেল গাছের ছায়া থেকে বেরিয়ে হঠাৎ একটা লোক দৌড়ে এল আমাদের
দিকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দড়াম করে ধাক্কা মারল। আমি ছিটকে পড়লাম বালিতে। ঝিন্টু
চেঁচিয়ে উঠে ছুটে গেল লোকটির দিকে। কিন্তু চোখের পলকে বাইকে উঠে পালিয়ে গেল সে। আমি
উঠে দাঁড়িয়ে গায়ের বালি ঝাড়তে ঝাড়তে লক্ষ করলাম একটি দলা পাকানো সাদা কাগজ পড়ে
আছে। খুলে ফোনের আলো জ্বেলে দেখলাম ইংরাজি গোটা গোটা অক্ষরে লেখা, "গো ব্যাক
টু ইন্ডিয়া।"
"বোঝ!"
এটা ছিল ঝিন্টুর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া।
।। পাঁচ ।।
পরের
দিনে ছিল সঙ্গীত। সারাদিন ধরে চলল নাচ-গানের অনুষ্ঠান। সঙ্গে এলাহি খাওয়াদাওয়া।
আমরা ছবি তোলার সঙ্গে কান খাড়া করে ঘুরছিলাম চারিদিকে।
তানিয়াদি গত রাতে সমুদ্রের ধারের কথা শুনে চিন্তিত গলায় বলল, "তার মানে আরও
কেউ আছে আমাদের চারপাশে। তাকে আমরা চিনি না। কিন্তু সে আমাদের চেনে। কে সে? এরপর
থেকে সাবধানে ঘোরাফেরা করিস তোরা।"
দুপুরের
দিকে হোটেলে অনুষ্ঠানে যোগ দিলেন রমেশ সারাফ। ছিপছিপে
চেহারা। ফ্রেঞ্চকাট সরু দাড়ি। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। তানিয়াদি ফোন করে চিনিয়ে
দিল আমাদের। ঝিন্টু ক্যামেরা নিয়ে গুটিসুটি পায়ে ছবি তোলার বাহানায় এগিয়ে গেল রমেশের
দিকে। আমি লক্ষ করলাম ওনার বড়দা মহেশ সারাফের সঙ্গে কোনো বিষয় নিয়ে উত্তেজনা তৈরি
হয়েছে। দু’জনেই হাত মুখ নেড়ে একে অপরকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছেন। ঝিন্টু
ওদের ছবি তুলতে যেতেই এক ধমক দিয়ে ভাগিয়ে দিলেন তাকে। সে
চোখ মুখ কুঁচকে "সরি! সরি!" বলে পালিয়ে এসেছে।
"কীরে,
রমেশবাবু তোকে তাড়া করলেন কেন?"
আমার
খোঁচাটা গা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে চাপা গলায় ঝিন্টু বলল, "রমেশবাবু এখনও টাকাটা
পায়নি, বুঝলি!"
"টাকা
পায়নি মানে?"
"আরে
সেই জন্যই তো মহেশ সারাফ ধমক দিয়ে বললেন - ইতনা পয়সা কাঁহাসে আয়গা?"
আমি
একটু ভেবে বললাম, "তার মানে, হয়তো ডায়রিটার এখনও পাঠোদ্ধার করা যায়নি। সেই
জন্য গুপ্তধনের জায়গাটাও মনে হয় খুঁজে পায়নি ওরা!"
"ঠিক
বলেছিস।"
এর
কিছুক্ষণ পর একটা নাচের সিকোয়েন্সে ডাক পড়ল রমেশবাবুর। তিনি কাঁধের ব্যাগটা একটা
চেয়ারে রেখে স্টেজে উঠে গেলেন, আর আমি একটা গোলাপি রঙের পাগড়ির কাপড় ব্যাগটার উপরে
চাপিয়ে দিলাম। এদিকে ঝিন্টু বুঝে নিয়েছে আমার উদ্দেশ্যটা। সে ঠিক কায়দা করে
কাপড়সমেত ব্যাগটা নিয়ে ঢুকল বাথরুমে। আমার বুকের মধ্যে শুরু হল ঢিপ ঢিপ আওয়াজ। তবে
শেষ পর্যন্ত গড়বড় কিছু হয়নি। রমেশবাবু স্টেজ থেকে নামার আগেই ব্যাগটা আবার ঠিক
জায়গায় রেখে দিয়েছে ঝিন্টু।
আড়ালে
ডেকে এনে জানতে চাইলাম, "কী পেলি?"
"কিচ্ছু
না। ভাবলাম নাবিকের ডায়রিটা পাওয়া যাবে। শুধু ভদ্রলোকের পাসপোর্টে দেখলাম গত দু’মাসে
মোট পাঁচ বার থাইল্যান্ড এসেছেন। স্মাগলিং-এর ব্যাবসা করে বোঝাই যাচ্ছে।"
তানিয়াদিকে
সারাদিন আজ খুঁজে পেলাম না। হোয়াটসএপ করেছিলাম একবার। উত্তর পাঠাল, "একটা
ক্যাথলিক চার্চে বসে আছি। রাতে ফিরে কথা হবে।"
শ্রী
দেখলাম কোরিওগ্রাফারের সঙ্গে জুটি বেঁধে একটার পর একটা নাচ দিব্যি করে চলেছে
হিন্দি গানের তালে। সন্ধ্যায় একদল লোক বাসে করে চলে গেল 'ফ্যান্টাসিয়া শো' দেখতে।
কিন্তু রমেশবাবু থেকে গেলেন হোটেলে। দূর থেকে লক্ষ করছিলাম, সমানে ফোনে কথা বলে
যাচ্ছেন কারও সঙ্গে। বেশ চিন্তায় আছেন বোঝা গেল। একবার লাউঞ্জের পুরুষ টয়লেটে না
ঢুকে মহিলাদেরটাতে ঢুকে পড়েছিলেন। ঝিন্টু এসে বলে গেল, "ভদ্রলোক ফোনে কাউকে
বলছেন, কালকে ফিফি আইল্যান্ড যাওয়ার কথা। সকাল আটটায় বাস ছাড়বে।"
রাতে
খাওয়ার পর তানিয়াদি ঢুকল হোটেলে। জিজ্ঞেস করতে বলল, "প্রথমে চার্চ, তারপর
পুলিশ হেড অফিস, আবার একটা চার্চ, তারপর সিমেট্রি। এই করতে গিয়ে কেটে গেল সারাদিন।
তবে কেসটা জমে গেছে রে!"
ঝিন্টু
জানতে চাইল, "একটু খোলসা করে বল না! আমাদের পেটে তো বিড়াল আঁচড়াচ্ছে।"
শ্রী
ভ্রু কুঁচকে বলল, "এর মধ্যে আবার সিমেট্রি এল কোথা থেকে?"
তানিয়াদি
রহস্যজনক মুচকি হেসে জানাল, "ক্লাইম্যাক্সের পর্দা উঠতে এখনও বাকি। ধৈর্য ধরো
বৎস!"
আমরা
রমেশ সারাফের সারাদিনের আচরণ আর কথোপকথন ওকে জানালাম। তানিয়াদি সব শুনে মন্তব্য
করল, "আপাতত তোরা তিনজনে চোখ কান খোলা রেখে আরও কিছু তথ্য সংগ্রহ করে যা। কালকে
তোদের সঙ্গে শ্রীও যাবে ফিফি আইল্যান্ড। আমি শর্মাজিকে বলে দিয়েছি।"
"তুমি
যাবে না?"
"না
রে! আমাকে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তাভাবনা করতে হবে অনেক কিছু। অঙ্কটা
সাজাতে হবে ঠিকঠাক। তারপর সিঁড়ি ভাঙার খেলা শুরু হবে। অনেক প্ল্যানিং আছে।"
শ্রী
বলল, "তোমার ধোঁয়াটে কথা আমার মাথায় ঢোকে না। গোটা দিন নেচে নেচে আমার পা
দুটো ব্যথা হয়ে গেছে। আপাতত আমি শুতে চললাম। বাড়িতে একবার ফোন করতে হবে। দশটা মিস
কল এসেছে সারাদিনে।"
পরের
দিন প্রাতরাশ সেরে দুটো বড়ো বাসে করে আমরা পৌঁছলাম 'রাসাদা' বন্দরে। সেখান থেকে
মাঝারি মাপের জাহাজে করে সমুদ্রের মাঝখানে ফিফি দ্বীপ যেতে সময় লাগল প্রায় আড়াই
ঘণ্টা। নীল সমুদ্রের মাঝে ছোটো বড়ো মিলিয়ে এটা একটা দ্বীপপুঞ্জ। বড়ো বড়ো রিসর্টও
আছে দ্বীপের মধ্যে। সারা পৃথিবী থেকে সমুদ্রপ্রেমী পর্যটকরা আসেন এখানে। যে দিকেই
ক্যামেরা ঘোরাচ্ছি ওয়ালপেপারের মতো ছবি উঠছে। উপরে আর নিচে ঘন নীল আকাশ আর সমুদ্র
মিশেছে দিগন্তে। সাদা টুকরো টুকরো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে মুক্ত-বিহঙ্গের
মতো। মাঝে মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ স্যান্ডস্টোনের পাহাড়।
জাহাজ
থেকে ছোটো নৌকা করে আমরা পৌঁছলাম অসাধারণ সুন্দর এক সাদা বালির তটে। শ্রী স্বগতোক্তি
করল, "আমি এত সুন্দর সমুদ্র এর আগে দেখিনি।" কথাটা মনে প্রাণে অনুভব
করছি আমরা সবাই। গেস্টরাও মেতে উঠলেন আনন্দে। আমি আর ঝিন্টু ক্যামেরা বাগিয়ে ঘুরে
বেড়াচ্ছি চারিদিকে। মাঝে মাঝে এসে বসছি সমুদ্রের পাড়ে। রমেশবাবুর উপর লক্ষ
রাখছিলাম দূর থেকে। জুম করে ছবি তুলে যাচ্ছি পর পর। সমুদ্রের পাড়ে রেস্টুরেন্টের
চেয়ারে বসে উনি বার বার ঘড়ি দেখছিলেন নিজের বেখেয়ালে।
কারোর অপেক্ষা করছেন কি? এদিকে শ্রী আমাদের মাথা খারাপ করে দিচ্ছে, "চল
সমুদ্রে নামি।"
শেষ
পর্যন্ত ওর কথা রাখতে আমরা তিনজনেই নামলাম সমুদ্রে। কিন্তু ঘটনাটা ঘটল ঠিক সেই
সময়েই। একটা হই হই শুনে আমরা সমুদ্র ছেড়ে দৌড়ে গেলাম রেস্টুরেন্টের পিছন দিকে। সবাই
মিলে ঘিরে ধরেছে জায়গাটা। ভিড় ঠেলে মাথা গলিয়ে দেখি রমেশবাবু পড়ে রয়েছেন উপুড় হয়ে।
মাথাটা ভিজে গেছে রক্তে। নাড়ি ধরে দেখলাম বেঁচে আছেন। তবে মাথায় চোট লেগেছে ভালোই।
জ্ঞান নেই। ধরাধরি করে নিয়ে এসে মাথা ধুয়ে, ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেওয়া হল।
বেড়াতে
আসার আনন্দ মিইয়ে গেছে। সবার মুখে তখন একটাই প্রশ্ন, "কে করল এটা?"
মেজ
ভাই সুরেশ দেখলাম খুব হম্বিতম্বি করছেন। রমেশবাবুর জ্ঞান ফিরতে আরও কিছুটা সময়
লাগল। কিন্তু তিনি কিছুই মনে করতে পারলেন না। শুধু বিকৃত মুখে তাকিয়ে রইলেন ভুলভুল
করে। তাড়াতাড়ি খাওয়া পর্ব সেরে জাহাজে উঠে পড়া হল। ফেরার সময়ে সবার মুখগুলো কেমন
যেন বিস্বাদ হয়ে গেছে। তানিয়াদি আসার সময়ে পইপই করে বলে দিয়েছিল রমেশবাবুর দিকে
সর্বক্ষণ নজর রাখার জন্য। আর আমাদের সামান্য বেখেয়ালে
কিছুক্ষণের মধ্যেই কী যে হল বুঝে উঠতে পারলাম না।
।। ছয় ।।
রমেশ
সারাফকে হসপিটালে শুধু প্রাথমিক চিকিৎসা করেই ছেড়ে দিয়েছে। আপাতত হোটেলে নিজের ঘরে
বিশ্রাম নিচ্ছেন তিনি। তবে এখানের পুলিশ দেখলাম খুবই সক্রিয়। একে একে সবাইকেই
জিজ্ঞাসাবাদ করছে। বাদ যাইনি আমরাও। কিন্তু কোনো সূত্র পেয়েছে কিনা বুঝলাম না।
তানিয়াদি নিজেও একবার রমেশবাবুর সঙ্গে কথা বলে এসেছে ওনার ঘরে গিয়ে। তারপর রাতের
খাবার খেয়ে আমাদের ক্যামেরায় তোলা ছবিগুলি ল্যাপটপে নিয়ে প্রত্যেকটা খুঁটিয়ে
খুঁটিয়ে দেখছিল ব্যালকনিতে বসে। হঠাৎ একটা
ছবিতে জুম করে প্রশ্ন করল, "রমেশবাবুর সঙ্গে কথা বলছেন এই দু’জন ব্যক্তিকে লক্ষ
করেছিস?"
উঁকি
মেরে দেখলাম, একজন সাদা চামড়ার বিদেশি লোক দাঁড়িয়ে আছেন ক্যামেরার দিকে পিছন করে।
পরনে জিনসের হাফ প্যান্ট, সাদা হাতা কাটা গেঞ্জি, মাথায় বাদামি কাউবয় টুপি, হাতে
একটা বড়ো ক্যামেরা। আমি বললাম, "ছবির টাইমিংটা লক্ষ করো। এর কিছুক্ষণের
মধ্যেই কিন্তু রমেশবাবুর উপরে এটাক হয়েছিল।"
ঝিন্টু
মন্তব্য করল, "এই লোকটাকে আগে কোথাও দেখেছি মনে হচ্ছে। ঠিক
মনে করতে পারছি না। ঐ টুপি আর ক্যামেরাটা দেখে চেনা চেনা লাগছে।"
"হুম!
শ্রী, সেদিন চন্দননগরে নদীর পাশে যে সেলফিটা তুলে ফেসবুকে পোস্ট করেছিলি, সেটা দেখ
একবার।"
তানিয়াদির
কথায় শ্রী ছবিটা বের করল ফোনের গ্যালারি থেকে খুঁজে। জুম করে দেখা গেল শ্রীর ঘাড়ের
কাছে, বেশ কিছুটা পিছনে একজন বিদেশি লোক ক্যামেরা তাক করে দাঁড়িয়ে আছে নদীর দিকে।
"এই
দু’জন যে একই ব্যক্তি সে আর বলে দিতে হয় না।"
তানিয়াদি
মন্তব্য করল, "আর এই দ্বিতীয় জন তো মনে হচ্ছে ভারতীয়। বড়ো বড়ো চুল দাড়ি, চোখে
গগলস। সারাফদের দলে তো এরকম কেউ নেই।"
আমি
বললাম, "না, এই হোটেলে এরকম কেউ থাকছেন না। তাহলে আমাদের চোখে নিশ্চয়ই পড়ত।
জাহাজেও এরকম কেউ ছিল না।"
"তোদের
আগে পরে নিশ্চয়ই আরও জাহাজ গিয়েছিল ওখানে। পর্যটক তো অনেকই ছিল। তাই তাদের মধ্যে
যে কেউ হতে পারে।"
তানিয়াদির
ফোনটা বেজে উঠল ঠিক সেই সময়ে। স্ক্রিনে
নাম দেখলাম, এস.আই. ঘোষাল। তারপর আমরা যা শুনলাম সবই একতরফা কথোপকথন।
শুনতে শুনতেই উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়লাম সবাই।
"হ্যাঁ,
বলুন ঘোষালদা। ...বলেন কী! ডায়রিটা পাওয়া গেছে? ...কোথায়? ...আচ্ছা, অনুবাদ
করিয়েছেন? ...বাহ! ...জোসেফ বালাটিকের কবর ...পুরানো সিমেট্রি ...ফাইন ...ইন্টারপোলের
অফিসারটির নাম কী? ...ওকে ...রাখছি।"
ফোনটা
কেটেই লাফিয়ে উঠল তানিয়াদি। "কেস জমে গেছে। লেটস গো!"
দৌড়ে
হোটেলের বাইরে এসে রাস্তার উপর থেকে আমরা একটা ট্যাক্সি নিলাম। তানিয়াদি
ড্রাইভারকে নির্দেশ দিল, "পুলিশ হেড অফিস, ফুকেত টাউন। কুইক!"
ঝলমলে
রাস্তা বেয়ে গাড়ি ছুটতে শুরু করেছে শাঁ শাঁ করে। ঢোঁক গিলে কোনোরকমে জানতে চাইলাম,
"কোথায় পাওয়া গেল ডায়রিটা?"
"বারুইপুরে
সারাফদের ফার্ম হাউসের লকারে। ইন্সপেক্টর রণজিৎ ঘোষাল একটা ছিঁচকে চোরকে কাজে
লাগিয়ে উদ্ধার করেছেন জিনিসটা। তারপর এক ফরাসি ভাষার বিশেষজ্ঞকে দিয়ে অনুবাদ
করিয়েছেন।"
শ্রী
মন্তব্য করল, "তার মানে ডায়রিটা ফুকেত আসেইনি। আমরা বেকার ঘুরে মরছি?"
"মনে
হয় ডায়রির স্ক্যান কপি এসেছে। আর সেটা হাতানোর জন্যই কেউ একজন ফিফি আইল্যান্ডে রমেশ
সারাফকে আহত করেছে আজকে।"
"কে
সেই লোক?"
"সেটা
জানতে পারলে তো তদন্ত মিটেই যেত!"
"কিন্তু
ঐ বিদেশি লোকটা তো আমাদের চন্দননগর থেকে ফলো করছে?"
তানিয়াদি
চিন্তান্বিত গলায় সাড়া দিল, "হুম!"
আমি
জানতে চাইলাম, "ক্লু পাওয়া গেছে কিছু?"
"হ্যাঁ,
সে জন্যই তো দৌড়চ্ছি। তিনশো বছরের পুরোনো এক সিমেট্রি আছে
এই দ্বীপের উত্তর-পূর্ব দিকে সমুদ্রের পাড়ে। ফরাসি আমলের এই কবরস্থানেই আছে ঐ
ডায়রির লেখক নাবিক জোসেফ বালাটিকের সমাধি। ঐ ডায়রির একদম শেষে অন্য কোনো ব্যক্তির
হাতের লেখায় লাল কালিতে স্টার মার্কস দিয়ে এই সমাধির উল্লেখ আছে। নিশ্চয়ই এটা কোনো
সংকেত। তার নিচে পেনসিল দিয়ে একটা লাইন টানা আছে। এই
পেনসিলের দাগ নিশ্চয়ই পাদরি দিয়েছিলেন ডায়রিটা পড়ার সময়ে।"
তানিয়াদি ফোনে সেই পেজের ছবি বের করে দেখাল। "ঘোষালবাবু ছবিটা হোয়াটসএপে
পাঠিয়েছেন আমাকে।"
ঝিন্টু
বলল, "ফরাসি ভাষা তো সবাই পড়তে পারবে না! হতে পারে ঐ বিদেশি ফ্রান্সের নাগরিক।"
"হতেও
পারে। তবে কলকাতা পুলিশের আই জি এই বিষয়ে
ইন্টারপোলকে অফিসিয়ালি চিঠি পাঠিয়েছেন। ইন্টারপোল থেকে যোগাযোগ করা হয়েছে থাই
পুলিশের সঙ্গে।"
পুলিশের
সদর দপ্তরে সিনিয়র অফিসারের সঙ্গে দেখা করার জন্য তানিয়াদি একাই ঢুকল অফিসে। আমরা
বসে রইলাম বাইরে। তার মিনিট পনেরোর মধ্যে দুটো পুলিশের গাড়ি রওনা হল আমাদের নিয়ে।
তানিয়াদি জানাল, "থাই পুলিশ খুবই কো-অপারেট করছে আমাদের সঙ্গে। বিশেষ
করে যখন বললাম, এই কেসের সঙ্গে থাইল্যান্ডের ইতিহাস আর ঐতিহ্য জড়িত তখন এরা রীতিমতো
সিরিয়াসলি নিয়েছে ব্যাপারটা। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কী হয়!"
ঘণ্টা
খানেকের রাস্তা পেরিয়ে একটা শুনসান অন্ধকার জঙ্গলে গিয়ে দাঁড়াল গাড়িগুলি। নেমে
দেখলাম জায়গাটা একটা পাহাড়ের পাদদেশে। গুমোট
করেছে খুব। আকাশে একটাও তারা দেখা যাচ্ছে না। জমাট বাঁধছে মেঘ। গাড়ি থেকে নেমে
আমরা চললাম পুলিশ দলটির সঙ্গে। তখন মনের ভিতরে ও বাইরে শুধুই অন্ধকার। কিছু দূর
হাঁটার পর টর্চের আলোয় চোখে পড়ল সিমেট্রির পুরোনো স্টাইলের গেট। সেখানে দু’জন লোক
অপেক্ষা করছিলেন আমাদের জন্য। তানিয়াদি আমাদের জানাল, "এনারা স্থানীয়
ক্যাথলিক চার্চ থেকে এসেছেন। আগে আমি
কথা বলে গিয়েছিলাম এঁদের সঙ্গে।"
গেট
দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ল দু’দিকে পর পর কবরের সারি। বুনো ঝোপঝাড় গ্রাস করেছে
সমাধিগুলিকে। মাঝে মাঝে ঝাঁকড়া বড়ো গাছ দাঁড়িয়ে আছে ভূতের মতো। তবে কোনো গাছের
একটা পাতাও নড়ছে না। লম্বা, চৌকো, ত্রিকোণ, গম্বুজাকৃতি, কত রকমের শ্যাওলা পড়া সমাধি
শুয়ে আছে পরপর। ঝিন্টু কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, "চিন্তা হচ্ছে রে!"
"কীসের?"
"তিনশো
বছরের পুরোনো ফরাসি ভূতের পাল্লায় পড়লে আর দেশে ফেরা হবে না!"
শ্রী-ও
দেখলাম ভয়ে গা ঘেঁষে থাকছে আমাদের। জায়গাটা বিশাল বড়ো। আর রাতের অন্ধকারে বেশ গা-ছমছমে
পরিবেশ। ঝিঁঝিঁর শব্দ কানে আসছে একটানা। টর্চের আলোয়
লক্ষ করছি মাঝেমধ্যে বড়ো প্রাচীন গাছের গুঁড়ি আর শিকড় গ্রাস করেছে কবরের
পাথরগুলিকে। একেবারে শেষ প্রান্তে ম্যানগ্রোভ গাছের সারি। চার্চের লোকগুলি জানালেন,
"পুরোনো সমাধিগুলি ছিল একদম সমুদ্রের দিকে। তাদের মধ্যে অনেকগুলি নষ্টও হয়ে
গেছে। বিশেষ করে গতবারের সুনামিতে অনেকটা অংশ তলিয়ে গেছে সমুদ্রের জলে। রাতের
অন্ধকারে জোসেফ বালাটিকের সমাধি খুঁজে বের করা খুবই কঠিন কাজ। তাছাড়া আগের আমলের
সমাধিগুলির কোনো রেজিস্টারও নেই আমাদের কাছে।"
তবু
পুলিশের বড়ো কর্তার নির্দেশে অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রতিটা ফলক থেকে নামগুলি খুঁজে
খুঁজে দেখতে লাগল তারা। আমরাও ছবি তুলছিলাম একটা একটা করে
ফলকগুলির। কিন্তু ঠিক সেই সময়েই প্রচণ্ড শব্দে
গর্জে উঠল আকাশ। শুরু হল মুষলধারায় বৃষ্টি। সঙ্গে ভীষণ বজ্রপাত। ফলে পিছন দিকে দৌড়
দিলাম আমরা। গাড়িতে যখন উঠলাম তখন প্রত্যেকেই কাক ভিজে। পুলিশকর্তা মাথা নেড়ে
জানালেন, "আজ রাতে আর কাজ হবে না ম্যাডাম! সকালে বৃষ্টি থামলে আবার
আসব।"
ফেরার
পথে হোটেলে নামিয়ে দিলেন আমাদের। তানিয়াদি অনুরোধ করল, "রাতে একটা পাহারার
ব্যবস্থা করুন সিমেট্রিতে।"
।। সাত ।।
পরের
দিনের মেহেন্দি অনুষ্ঠানটি একটু নির্লিপ্তভাবেই সেরে ফেলল বাকিরা। নাচ গান সবই
চলল, তবু কোথায় যেন সুরটা কেটে গেছে, বুঝতে পারছিলাম আমরা। সকাল থেকে উঠে
তানিয়াদির আর দেখা পাইনি। ব্রেকফাস্ট না খেয়েই বেরিয়ে গেছে ভোরে উঠে।
ফোন করছিলাম। কিন্তু কেটে দিচ্ছিল বারবার। এদিকে রমেশ সারাফ নিজের রুম থেকে একবারও
বেরোননি। বড়ো ভাই, মানে মহেশবাবু হঠাৎ আমাদের লাউঞ্জে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন,
"তোমরা এই কোম্পানিতে কতদিন কাজ করছ?"
হেসে
বললাম, "মাস দুয়েক হল। ট্রেনিং নেওয়ার পর এটাই আমাদের প্রথম প্রজেক্ট।"
"কাল
রাতে কোথায় গিয়েছিলে তোমরা?"
ঝিন্টু
উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে বলল, "আমাদের অন্য একটা হোটেলে ডিউটি পড়েছিল স্যার।
কোম্পানির কাজেই গিয়েছিলাম।"
"হুম!
দেশের বাইরে তোমাদের মতো অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের মাঝরাতে বাইরে ঘোরা ঠিক নয়। কোথায়
কখন বিপদ নেমে আসে!" ভদ্রলোকের কথার মধ্যে যেন প্রচ্ছন্ন হুমকি লুকিয়ে ছিল।
আমরা
কিছুক্ষণ ব্যোমকে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর আবার
শুরু করলাম নিজেদের কাজ। দুপুরের পরে ফিরল তানিয়াদি। তারপরেই ওর রুমে ডেকে পাঠাল
আমাদের। দেখলাম বেশ বিধ্বস্ত লাগছে ওকে। জুতোয় লক্ষ করলাম কাদা ভর্তি।
জিজ্ঞেস
করলাম, "সিমেট্রিতে গিয়েছিলে আবার?"
আমার
প্রশ্নটা শুনে মাথা নেড়ে গম্ভীর গলায় জানাল, "যেটা ভয় করছিলাম, সেটাই হয়েছে।
পুলিশের লোক যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে পাহারা দেয়নি। ভোর রাতে বৃষ্টি থামার পর কয়েকজন
ঢুকেছিল সিমেট্রিতে।"
"তারপর?"
"জোসেফ
বালাটিকের সমাধি ভাঙা। ভিতরের কফিন খুলেছিল কেউ। আসল জিনিস হাওয়া হয়ে গেছে।"
"মানে
গুপ্তধনের ম্যাপ নিয়ে চম্পট দিয়েছে?"
তানিয়াদি
পরিষ্কার করল ব্যাপারটা, "জোসেফ বালাটিকের সমাধির মধ্যে গুপ্তধনের কোনো হদিস
ছিল কিনা জানা নেই। তবে পিস্তল ছিল একটা। কারণ ঐ
বন্দুকের মাপে খোপ করা কাঠের একটি ভাঙা বাক্স পাওয়া গেছে সমাধির পাশে ঝোপের মধ্যে।
বহুকাল মাটির নিচে থাকার জন্য বাক্সটি ঘুণ ধরে নষ্ট হয়ে গেছে। তাই কবর যারা
খুঁড়েছিল তারা ঐ ভাঙা বাক্সটি ফেলে দিয়ে চলে গেছে।"
"মানে
'দা-ভিঞ্চির পিস্তল' গায়েব!" ধপাস করে সোফায় বসে স্বগতোক্তি করল ঝিন্টু।
তানিয়াদি
হাতে ঘুসি মেরে বিড়বিড় করে বলল, "কালকে বৃষ্টিটা না এলে... ইস... হাতের মধ্যে
এসেও ফসকে গেল রে! এত দূর ছুটে আসা বেকার হয়ে গেল।"
আমি
কিছুক্ষণ মাথা চুলকে জিজ্ঞেস করলাম, "জিনিসটা পাওয়া গেলেও থাইল্যান্ড সরকার
আমাদের তো ভারতে নিয়ে যেতে দেবে না নিশ্চয়ই?"
"না,
তা দেবে না। হয়তো এখানেই কোনো মিউজিয়ামে স্থান
পেত দা-ভিঞ্চির পিস্তল। কিন্তু পাদরির খুনিকে অবশ্যই দেশে নিয়ে গিয়ে কোর্টে চালান
করতে পারতাম।"
"ফসকে
যায়নি... ফসকে যায়নি..." তড়াক করে লাফিয়ে উঠে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল শ্রী। আমরা তো
অবাক! সে জানাল, "তানিয়াদির জুতোতে যেমন কাদা লেগে আছে, ঐ রকম টাটকা কাদা
লাগা জুতো দেখেছি আজকে সকালে। ব্রেকফাস্ট
খেতে গিয়ে।"
"কে
সে?"
"সুরেশ
সারাফ।"
"মানে
কনের বাবা!"
সঙ্গে
সঙ্গে তানিয়াদি ছুটল হোটেলের লাউঞ্জে। আমরাও পিছু
নিলাম। লিফট দিয়ে নেমে 'হ্যাপি ওয়েড'-এর ম্যানেজার চন্দন শর্মাকে ধরে জিজ্ঞেস করলাম,
"সুরেশবাবু কোথায়?"
তিনি
একটু থতোমতো খেয়ে উত্তর দিলেন, "ব্রেকফাস্টের সময় দেখা হয়েছিল। তারপর থেকে তো
..."
"এখনই
একটা ফোন করে লাউঞ্জে আসতে বলুন। আর্জেন্ট!"
"কী
ব্যাপার ম্যাডাম?"
"পরে
বলছি, আগে ফোনটা করুন," তানিয়াদি জোর দিয়ে কথাটা বলতে চন্দনবাবু পকেট থেকে
ফোন বের করে চেষ্টা শুরু করলেন। কিন্তু ওনাকে ফোনে ধরা গেল না। তারপর ফোন সুইচ অফ
হয়ে গেল। তানিয়াদির কপালের ভাঁজ চওড়া হচ্ছে ক্রমশ। আবার নির্দেশ দিল, "ওনার
রুমে ফোন করুন।"
রিসেপশন
থেকে রুমে ফোন করতে ওনার স্ত্রী ধরে জানালেন, "উনি সকালেই বেরিয়ে গেছেন।
বললেন, এক বন্ধুকে এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করতে যাচ্ছি।"
তানিয়াদি
জিজ্ঞেস করল, "কাল রাতে উনি নিজের রুমে ছিলেন?"
"হ্যাঁ।"
"ভোরবেলা
উনি কোথায় গিয়েছিলেন?"
ভদ্রমহিলা
একটু কাঁপা গলায় জানালেন, "জানি না। আমি তখন ঘুমোচ্ছিলাম। উনি
রোজ ভোরে উঠে মর্নিং ওয়াকে যান।"
ফোন
রেখে দিয়ে তানিয়াদি বলল, "আমাদের এখুনি পুলিশ হেড অফিসে যেতে হবে। চল!"
চার
জনে মিলে দৌড়লাম বড়ো রাস্তার দিকে। বেরোতেই পেয়ে গেলাম একটা ট্যাক্সি। দুপুরের
দিকে ট্রাফিক বেশি থাকে রাস্তায়। ড্রাইভার বাইপাস ধরল। চওড়া সিক্স লেনের রাস্তায়
ছুটছে গাড়ি।
"সুরেশবাবুই
কি আসল কালপ্রিট?"
"উনি
একা নন, আরও কেউ আছে সঙ্গে," মন্তব্য করল তানিয়াদি।
"আর
কে আছে?"
"কেন,
সেই বড়ো বড়ো চুল-দাড়িওলা লোকটা।"
আমি
বললাম, "আর সেই ইউরোপিয়ান লোকটা? চন্দননগর থেকে যে ধাওয়া করছে আমাদের।"
"এরা
কি সবাই একসঙ্গে কাজ করছে? না আলাদা আলাদা? ছবিটা পরিষ্কার হয়েও হচ্ছে না পুরোপুরি।"
বিড়বিড় করে বলল তানিয়াদি।
আমাদের ট্যাক্সিটা তীরবেগে ছুটতে ছুটতে হঠাৎ গোঁৎ
খেয়ে ঢুকে গেল বাঁদিকের একটা সরু গলিতে। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করতে জানাল, "দিস
ইজ শর্টকাট।" দেখছি দু’পাশে শুধু জঙ্গল। আরও লক্ষ করলাম
আমাদের পিছনে একটি বড়ো গাড়ি তীরবেগে এসে ঢুকেছে এই রাস্তাতেই। হয়তো ফলো করে আসছিল
আমাদের। মনে হচ্ছে ফাঁদে পড়ে গেছি আমরা। আড়চোখে তানিয়াদির দিকে তাকাতে দেখি ওর
মুখটাও বেশ ফ্যাকাসে লাগছে। ফিস ফিস করে বলল, "গাড়িতে জ্যামার লাগানো আছে।
ফোন কাজ করছে না।"
সত্যিই
তাই। আমাদের ফোনগুলিতেও কোনো টাওয়ার নেই। বুকের ভিতরটা যেন ফাঁকা হয়ে গেল
মুহূর্তের মধ্যে। তানিয়াদি গলাটা যতটা সম্ভব গম্ভীর করে নির্দেশ দিল, "গাড়ি
পিছনে ঘোরাও। এ রাস্তায় আমরা যাব না।"
স্বাভাবিকভাবেই সে কথায় কোনো কাজ হল না। ঝিন্টু বসেছিল ড্রাইভারের পাশের সিটে। সে
হঠাৎ বিদ্যুৎগতিতে ডান হাতে এক রদ্দা মারল ড্রাইভারের ঘাড়ে। স্টিয়ারিং সামলাতে না
পেরে গাড়ি দড়াম করে ধাক্কা খেল একটা মোটা গাছের গুঁড়িতে। মেরেই হেলে গেল পাশের
খাদে। ঝিন্টু তড়াক করে গেট খুলে নেমে পড়েছে ততক্ষণে। আমরাও প্রাথমিক ঝটকা কাটিয়ে
নেমে পড়লাম।
পিছনের
গাড়িটাও এসে গেছে। তানিয়াদি চেঁচিয়ে বলল, "দৌড়ওওও
...!" আমরা জঙ্গলের মধ্যে এঁকে-বেঁকে ছুটতে শুরু করলাম। পিছনে ধাওয়া করেছে
লোকগুলো। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম ছ-সাতজন হবে। কিন্তু ওদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র আছে। গুলি
চালাতে শুরু করল পিছন থেকে। গাছের গুঁড়িতে, ডালপালায় গুলি লেগে ছিটকে উঠছে ছাল।
জঙ্গলটা ক্রমশ পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উপর দিকে উঠছে। আমি একটা পাথর কুড়িয়ে নিয়ে ছুড়ে
দিলাম সজোরে। কিন্তু নিশানায় লাগল না। মাথাটা সরিয়ে নিয়েছে লোকটা। পরক্ষণেই
একটা গুলি এসে লাগল আমার পায়ের কাছে একটা গাছের গুঁড়িতে।
তারপরেই
একটা চিৎকার কানে এল। শ্রীয়ের গলা। থমকে গেলাম আমরা সবাই। দেখি
শ্রী পাথরের গায়ে গড়িয়ে পড়েছে। ওকে ধরে
ফেলেছে ওরা। একজন চেঁচিয়ে ভাঙা ভাঙা ইংরাজিতে বলছে, "নো ফানি বিজনেস ফারদার।
অল কাম এন্ড সারেন্ডার নাউ।"
এবারে
পালানোর আর পথ নেই। মাথার উপরে হাত তুলে আস্তে আস্তে নেমে এলাম আমরা গাছের আড়াল
থেকে। সেই ড্রাইভারটা এগিয়ে এসে প্রথমেই
সপাটে একটা চড় কষাল ঝিন্টুর গালে। ছিটকে পড়ে গেল ঝিন্টু। তারপরেই আমাদের ফোনগুলি
কেড়ে নিল ওরা। হাতগুলি পিছমোড়া করে বেঁধে মুখে চওড়া আঠা টেপ লাগিয়ে দিল। চোখগুলি বেঁধে
দিল কালো কাপড়ে। সবাইকে ঠেলে তুলে দিল পিছনের কালো কাচ দেওয়া গাড়িটাতে। তারপর চলতে
শুরু করল গাড়িটা। আনুমানিক ঘণ্টাখানেক ছোটার পর থামল। আমাদের
আবার টেনে হিঁচড়ে নামানো হল। তারপর ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যাওয়া হল অনেকটা। চোখে
কালো কাপড় বাঁধা থাকায় কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
অনেকক্ষণ
পর চোখগুলি খুলে দিল ওরা। চারপাশটা দেখে মনে হল এটা পরিত্যক্ত কোনো কারখানা। একটা
মোটা পিলারে আমাদের চারজনকে একসঙ্গে বেঁধে দিয়ে চলে গেল ওরা। কথা বলার কোনো উপায়
রাখেনি। মুখে টেপ আঁটা রয়েছে যথারীতি। অতএব গোঁঙানি ছাড়া আর কিছুই শব্দ বের হচ্ছে
না।
আলো
কমে গিয়ে সন্ধ্যা নামল। অন্ধকার হয়ে এল চারপাশ। ঘরে ফেরা পাখিদের কিচিরমিচির বন্ধ
হয়ে শান্ত হয়ে গেল সব কিছু। নিস্তব্ধতা ভেঙে দু-একটা ছুঁচোর আওয়াজ কানে আসছে মাঝেমধ্যে। এরপর
শুরু হল ঝাঁকে ঝাঁকে মশার কামড়। খোলা হাত-পা আর মুখে বসে মনের সুখে রক্ত টেনে পেট
মোটা করে উড়ে যাচ্ছে এক দল। আবার পরের ব্যাচ খেতে বসছে।
মনটা
অন্যদিকে ঘোরানোর চেষ্টা করলাম। ভাবলাম কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে মা বাড়িতে কী
করছে। নিশ্চয়ই সিরিয়াল চালিয়ে বসেছে এতক্ষণে। সিরিয়ালের টানটান উত্তেজনা গোগ্রাসে
গিলছে চা টিফিন সহযোগে। আমরা এত দূরে এই ভাবে পড়ে রয়েছি জানতে পারলে নির্ঘাত ভিরমি
খেত। আসল উত্তেজনা কাকে বলে বুঝত তখন!
অন্ধকারের
মধ্যে চোখ সয়ে গেছে। মুণ্ডু ঘুরিয়ে লক্ষ করলাম শ্রীকে।
বেচারি হাঁটু জোড়ায় মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে চুপ করে। তানিয়াদির মাথাটা পিছন দিকে
হেলানো। চোখ বন্ধ করে কী ভাবছে কে জানে? ঝিন্টু মুখ বিকৃত করে সমানে চেষ্টা করে
যাচ্ছে যদি হাতের বাঁধনটা খোলা যায়। আমি জানি ও চেষ্টাটা বৃথাই করছে। নাইলনের
শক্ত দড়ি যত টানাটানি করবে আরও টাইট হবে বসবে হাতের কবজিতে। যন্ত্রণা বাড়বে।
গলা
তেষ্টায় ফেটে যাচ্ছে। তারপর খিদেটাও চাগাড় দিয়ে উঠেছে বীরবিক্রমে।
বেশ কিছুক্ষণ পর সেটাও মরে গেল ক্রমশ। ধীরে ধীরে
অবশ হয়ে আসছে শরীর। ঝিনঝিন করছে হাত পায়ের জোড়। মাথাটা যেন আর কাজ করছে না।
নিস্তব্ধতার মধ্যে শুধু একঘেয়ে টিকটিক করে আওয়াজ করে চলেছে হাত ঘড়িটা। যদিও
ক'ঘণ্টা কাটল সেই সময়ের কোনো আন্দাজ নেই। ছুঁচোর দল মাঝে কয়েকবার এসে শুঁকে গেছে
আমাদের। গায়েও উঠেছিল সুড়সুড় করে। টের পাচ্ছি,
আস্তে আস্তে ভয়ডর কমে যাচ্ছে মনের ভিতর থেকে। পরিস্থিতি কত কিছু শিক্ষা দেয়! এই
জায়গায় না এলে জানতেই পারতাম না। 'চারজন বাঙালি সত্যসন্ধানীর মৃত্যু থাইল্যান্ডের গুমনাম
স্থানে।' এটা কী খবরের কাগজের হেডলাইন হতে পারে? কিম্বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়
ব্রেকিং নিউজ! কিন্তু খবরটা বাইরের লোক জানলে তবে তো হবে। সে আশা ক্ষীণ!
খেয়াল
হল ভোরের আলো ফুটছে ক্রমশ। পাখিদের ডাকাডাকি শুনতে পাচ্ছি ঘোরের মধ্যে। তারপর একদল
লোকের পায়ের শব্দ। কয়েকটা টর্চের আলো এসে পড়ল আমাদের মুখে। শয়তানগুলো আবার ফিরে এল
তাহলে! আমাদের কি এবার খতম করবে এরা?
"মিস
চ্যাটার্জি, আর ইউ অল রাইট?"
দৌড়ে
এসে ওরা হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিল আমাদের। চোখে মুখে জলের ছিটে দিতে একটু ধাতস্থ
হলাম। এরা তাহলে গুণ্ডা নয়। পুলিশ!
তানিয়াদি
মাথা নেড়ে অফিসারকে বলল, "সুরেশ সারাফের ফোন নম্বরটা ট্র্যাক করতে হবে। আর
হোটেলেও পুলিশ পোস্টিং করুন যাতে অন্য কেউ পালাতে না পারে।"
"যাক
বাবা, এ যাত্রা বেঁচে গেলাম মনে হচ্ছে!" ঝিন্টুর উক্তি শুনে হাসি পেল এতক্ষণ
পর। হাত-পায়ের অবশতা কাটিয়ে উঠে দাঁড়ালাম ধীরে ধীরে।
সেখান
থেকে দৌড়ে বেরিয়ে উঠে পড়লাম গাড়িতে। হুটার
বাজিয়ে ছুটল পুলিশের গাড়ি। অফিসার জানালেন, "ঐ ফোন নম্বরটা কিছুক্ষণ আগে একবার
চালু হয়ে আবার বন্ধ হয়েছে 'টাপু পির'-এর কাছে।"
তানিয়াদি
জিজ্ঞেস করল, "ওটা তো একটা জেটি?"
"হ্যাঁ,
'জেমস বন্ড আইল্যান্ড' যাওয়ার গেটওয়ে। ওখানেই যাচ্ছি আমরা।"
কিছুক্ষণ
সবাই চুপচাপ। রাস্তা দিয়ে গাড়ি দুটি ছুটেছে ঝড়ের বেগে। ঝিন্টু মুখ খুলল,
"দ্বীপের নাম 'জেমস বন্ড আইল্যান্ড'! তাজ্জব ব্যাপার!"
তানিয়াদি
আমাদের জানাল, "আসল স্থানীয় নাম 'খাও পিং খান'। ফুকেতের উত্তর-পশ্চিম দিকে 'পাং
নাগা' সমুদ্রের একগুচ্ছ দ্বীপ। অসাধারণ সুন্দর লোকেশন।"
ঝিন্টু
আবার ফুট কাটল, "'খাও পিং খান' মানে তো খাও পিও মৌজ করো! কিন্তু আমার খিদেটা
মরে গেছে বুঝলে।"
তানিয়াদি
জানাল, "সত্তরের দশকে এখানে জেমস বন্ডের একটা সিনেমার শুটিং হয়েছিল। দ্য
ম্যান উইথ দ্য গোল্ডেন গান। তারপর থেকে বিশ্বের পর্যটক মানচিত্রে এই নামটা উঠে আসে। শোনা
যায় জলদস্যুরাও এই সব দ্বীপে আনাগোনা করত এক সময়ে।"
"কেন?"
"গুপ্তধন
লুকানোর আদর্শ জায়গা যাকে বলে। দেখলেই বুঝতে পারবি।"
পুলিশের
গাড়িতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগল 'টাপু পির' পৌঁছোতে। অফিসার রাস্তাতেই কয়েকটা তথ্য
দিলেন আমাদের, "সোর্স মারফৎ আমরা খবর পেয়েছি, একটা স্থানীয় এন্টিসোশাল গ্যাং
একটিভ হয়েছে কিছুদিন ধরে। এদের পিছনে আছে কোন মাল্টি মিলিওনিয়ার। সিঙ্গাপুরের একটা
একাউন্ট থেকে মোটা অঙ্কের ফান্ড ট্রান্সফার হয়েছে গ্যাং লিডারের একাউন্টে। এরাই গত
রাতে কিডন্যাপ করেছিল তোমাদের। তাদের সবার ফোন ট্যাপ করা হচ্ছে। কারেন্ট মুভমেন্ট
'মাকা আইল্যান্ড’-এর দিকে।"
গাড়ি
থেকে নেমে দেখলাম কালো পোশাক পরা সশস্ত্র পুলিশের একটা টিম রেডি রয়েছে জেটিতে।
আমাদের সবাইকে একটা করে লাইফ জ্যাকেট পরিয়ে দিল। তারপর সরু লম্বা স্পিড বোটে গিয়ে
চড়ে বসলাম। এক একটা নৌকায় প্রায় পঞ্চাশ জন ধরে। তীর বেগে ছুটতে শুরু করল নৌকাটা জল
কেটে। খাঁড়ি পথটা অনেকটা
সুন্দরবনের মতো। একইরকম ঘন শ্বাসমূলযুক্ত সুন্দরী আর গরান গাছের ভিড় দু’ধারে। কিছুক্ষণের
মধ্যেই আমরা গিয়ে পড়লাম পাং নাগা সমুদ্রে। পলকের মধ্যে পালটে গেল ছবিটা। তীরবেগে
যেন আমরা উড়ে যাচ্ছি নীল সমুদ্রের পেট চিরে। হাওয়ার সঙ্গে হু হু করে উড়ে আসছে নোনা
জলের ছিটে। ভিজে যাচ্ছি আমরা। পিছনে দেখলাম এরকমই পুলিশের আর একটি বোট আসছে আমাদের
ফলো করে। দূরে ছড়িয়েছিটিয়ে বালি পাথরের টিলা সবুজ রং মেখে জল থেকে উঠে সোজা মাথা
উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নীল আকাশের গায়ে। বুকের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা পাকিয়ে উঠছে।
আমরা ধাওয়া করেছি ইন্টারন্যাশনাল মাফিয়া দলকে। গত রাতের হেনস্থার বদলা নিতেই হবে।
জেদটা চেপে বসছে মাথার মধ্যে।
বেশ
কিছুক্ষণ পর একটা বড়ো দ্বীপ দেখা গেল সমুদ্রের মাঝখানে।
ক্রমশ তার দিকেই এগিয়ে গেলাম আমরা। আরও কাছে গিয়ে
বুঝলাম ইউ আকৃতির চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে খাড়াই একটা পাহাড়। বেড় দিয়ে ঘুরে ইউ'এর
ভিতরে ঢুকে পড়ল আমাদের স্পিড বোটটি। এরকম
নৈসর্গিক পরিবেশ আমি এর আগে দেখিনি কখনও। সরু একটা
মুখের ভিতর দিয়ে ঢুকে দেখি চারপাশে আকাশ ছোঁয়া জঙ্গলে মোড়া পাহাড়। মাঝের নীল
আকাশটা প্রায় গোল। সাদা বালির তটে আগে থেকেই অন্য একটা নৌকা দাঁড়িয়ে ছিল। পুলিশের
বোটটি তার পাশে গিয়ে ভিড়তেই নিস্তব্ধতা ভেঙে গুলির আওয়াজে কেঁপে উঠল জায়গাটা।
গাছ থেকে পাখির দল চেঁচিয়ে ডানা ঝাপটে উড়ে গেল এক সঙ্গে। গুলিটা এসে লেগেছে আমাদের
নৌকার গায়ে।
সঙ্গে
সঙ্গে পুলিশও ফায়ারিং শুরু করে দিয়েছে। দু’পক্ষই মেতে উঠল গুলির লড়াইয়ে।
বুঝলাম মাফিয়া দলটা তৈরি হয়েই ছিল। গাছের আড়াল থেকে মুহুর্মুহু ফায়ারিং শুরু করেছে
পুলিশকে লক্ষ করে। আমরা চারজনেই বোটের নিচে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লাম মাথায় হাত দিয়ে। গুলির
আওয়াজে কান পাতা দায়। তবে পুলিশের দল খুবই ক্ষিপ্র গতিতে
দক্ষতার সঙ্গে অবস্থাটা নিয়ন্ত্রণ করল। মিনিট পাঁচেকের
মধ্যেই শেষ হল গুলির লড়াই।
সবুজ
সংকেত পেয়ে আমরা লাফ দিয়ে নামলাম নৌকা থেকে। পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে অনেকে। বেশ
কয়েকজন আহত। বালির তট পেরিয়ে শুরু হয়েছে ঘন জঙ্গল। আমরা সেই দিকেই এগোলাম। ঝিন্টু
হঠাৎ তেড়ে গিয়ে ধরা পড়া এক গুণ্ডাকে গদাম করে ঘুসি মারল চোয়ালে। ছিটকে পড়ে গেল
লোকটা। বুঝলাম চিনতে পেরেছে গতকালের সেই ড্রাইভারকে, যে
ওকে চড় মেরেছিল। অফিসারও ব্যোমকে গেছে। তানিয়াদি বুঝিয়ে বলল ব্যাপারটা।
তারপর তিনি হেসে ঝিন্টুর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন, “ইটস ওকে!”
আমরা
জঙ্গল পেরিয়ে পাহাড়ের গা দিয়ে উঠতে শুরু করলাম উপরে।
শ্যাওলায় মোড়া একটা সরু পাকদণ্ডি পথ উঠে গেছে এঁকে বেঁকে। আমাদের সামনে পিছনে
পুলিশের লোক। বার বার পিছলে যাচ্ছিলাম পাথরের গায়ে। ডালপালা
খামচে ধরে দম নিয়ে উঠছিলাম আবার। আধঘণ্টার চেষ্টায় পৌঁছলাম একটা গুহার মুখে। তারপর
পিছন ফিরে তাকাতেই ঘুরে গেল মাথা। সমুদ্রটা প্রায় দশতলা সমান নিচে একটা সুইমিং
পুলের মতো লাগছে। শ্রী মন্তব্য করল, "গুপ্তধন লুকানোর আদর্শ জায়গাই
বটে!"
স্যাঁতস্যাঁতে
অন্ধকার গুহার ভিতরে আগে ঢুকে গেল পুলিশের একটা দল। অফিসার আবার সবুজ সংকেত দিতে
আমরা ভিতরে গেলাম। ধাপে ধাপে এবড়ো খেবড়ো সিঁড়ি নেমে
গেছে অনেকটা নিচে। সেখানে একটা বড়ো চাতাল। তারপর আবার
ডানদিকে একটা গুহা চলে গেছে সরু হয়ে। একজন একজন করে ঢুকলাম ভিতরে। অন্ধকার একটা দশ
বাই দশ ফুট ত্রিকোণাকৃতি ঘরের মেঝেতে হাঁটু মুড়ে মাথা নিচু করে বসে আছে তিনজন। এদের
গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
তানিয়াদি
এগিয়ে গেল লোকগুলির দিকে। একজনকে পিছন থেকেই দেখে বোঝা যাচ্ছে যে তিনি সুরেশ সারাফ।
আর একজনের পরিচয় দিলেন অফিসার, “ফুকেতের কুখ্যাত মাফিয়া গ্যাং-এর লিডার।” বড়ো
বড়ো দাড়ি গোঁফ, চোখে বড়ো চশমাওলা তিন নম্বর ব্যক্তিটির চেহারাটা খুব চেনা লাগছে।
তানিয়াদি তার দিকে এগিয়ে গিয়ে কড়া গলায় পরিষ্কার বাংলায় বলল, "দা-ভিঞ্চির
পিস্তলটা ঝোলা থেকে বের করুন বিশ্বজিৎবাবু।"
চমকে
উঠলাম আমরা। কোন বিশ্বজিৎবাবু! তানিয়াদি আমাদের দিকে ঘুরে বলল, "চিনতে পারছিস
লোকটাকে? চন্দননগরে দেখা হয়েছিল একবার। প্রফেসার শৈলেন চৌধুরীর ছেলে। প্রথম দিন
থেকে আমাদের টার্গেট করে যাচ্ছে।" তারপরেই এক টানে দাড়ি গোঁফের জঙ্গল খুলে
গেল চোখের সামনে। দেখলাম সত্যি বড়ো অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে লোকটা। "পাদরিকে খুন
করার পর ডায়রিটা ইনিই চুরি করে তুলে দিয়েছিলেন ‘মুন জুয়েলারি’র মালিক বড়ো ভাই মহেশ
সারাফের কাছে। আবার গুপ্তধনের ভাগ যাতে ওনার পাতে কম না পড়ে, সেই জন্য ছুটে এসেছেন
এত দূর। ইনিই রমেশকে এটাক করেছিলেন ফিফি আইল্যান্ডে। কারণ রমেশবাবু বাগড়া দিচ্ছিলেন
এনাদের কাজে। ছোটো ভাইয়ের সঙ্গে বাকি দু’জনের খুব একটা বনিবনা নেই। মেজভাই সুরেশ
সারাফ ছিল বড়দার অনুগত সেপাই। তাই ওনাকেই পাঠানো হয়েছে গুপ্তধনের ডিল করতে।"
অফিসার
মাথা নেড়ে জানালেন, "কিন্তু কোনো গুপ্তধন তো পাওয়া যায়নি এখানে।"
ইতিমধ্যে
গুহাতে আমাদের পিছনে আর একজন ব্যক্তি এসে উপস্থিত হয়েছেন। ইনি সেই ইউরোপিয়ান। আমাদের
অবাক করে তানিয়াদি ভ্রু তুলে বলল, "আসুন মিঃ অ্যান্দিজ জিরিজমান।
আপনি তো পিছনের বোটটাতে ছিলেন। অফিসার এনার সঙ্গে আপনার আগেই পরিচয় হয়েছে। তোদের
জানিয়ে দিই ইনি সম্পর্কে মৃত পাদরি এন্টনি জিরিজমানের ভাই। ফ্রান্সের বিখ্যাত
জিওলজিস্ট। ফুকেতে আসার পরেই উনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ
করেছিলেন।"
অফিসার
বললেন, "মিঃ জিরিজমান গত রাতে ফোন না করলে আমরা জানতেই পারতাম না তোমাদের
কোথায় লুকিয়ে রেখেছে!”
জিরিজমান
জানালেন, “আমি তানিয়ার সঙ্গে দেখা করার জন্য ওর হোটেলেই যাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি দৌড়োতে
দৌড়োতে হোটেল থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে ওরা চারজন বেরিয়ে গেল। আমিও পিছনে
একটা বাইক রাইডার ভাড়া করে ধাওয়া করলাম। কিছুক্ষণ পরেই বুঝলাম ওরা ট্র্যাপে পড়েছে।
তারপর গাড়িগুলিকে ফলো করে আমি পরিত্যক্ত কারখানাটা দেখে এসে পুলিশকে জানালাম।”
“তারপরেই
গিয়ে আপনাদের উদ্ধার করা হয়।"
“বুঝলাম!”
জিরিজমান
এগিয়ে এসে বিশ্বজিৎবাবুর ব্যাগের চেন খুলে বের করলেন একটি কাগজে মোড়া পুরোনো আমলের
দেড় হাত বন্দুক। মোড়কটা খুলতে টর্চের আলোয় দেখা গেল সুন্দর হাতির দাঁতের কাজ করা
একটি ওয়ান সাটার পিস্তল। বললেন, "দা-ভিঞ্চির ডিজাইন করা এই হুইল লক পিস্তলটি জেনারেল
ডাসফারগাস উপহার পেয়েছিলেন ফ্রান্সের সম্রাট চোদ্দতম লুই-এর কাছ থেকে। ইতিহাসের
পাতায় যাঁকে বলা হয় 'লুই দ্য গ্রেট' অথবা 'সান কিং'। ডাসফারগাসের ছায়া সঙ্গী জোসেফ
বালাটিকও সাধারণ মানুষ ছিলেন না। একদিকে তিনি যেমন ছিলেন দক্ষ নাবিক আবার অসাধারণ
ইঞ্জিনিয়রও। থাইল্যান্ডের রাজা নারাইয়ের কাছ থেকে
পাওয়া বিপুল ধনরত্ন তিনি লুকিয়ে রেখেছিলেন এই গুহায়। যার সংকেত আর ম্যাপ এঁকে
রেখেছিলেন এই বন্দুকের বাঁটের ভিতরে। এই তথ্যগুলি অবশ্য আমি তানিয়ার কাছ থেকে
পাওয়া নাবিকের ডায়রির পিডিএফ পড়ার পরেই জানতে পারি।" কথাটা শেষ করে জিরিজমান
তাঁর হাতে ধরা পিস্তলটির বাঁটের জোড় অংশে একটা ছোটো ছুরির ফলা দিয়ে চাপ দিলেন। ফলে
সেটা খুলে আলাদা হয়ে গেল। ভিতর থেকে বের হল তিনটে ছোটো ভারী লোহার গুলি।
পকেট থেকে একটা আতস কাচ বের করে জিরিজমান বেশ কিছুক্ষণ ধরে লক্ষ করলেন ভিতরের
আঁকিবুঁকিগুলি।
আস্তে
আস্তে তাঁর চোখ দুটি চক চক করে উঠছিল। ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল হাসি। বললেন,
"জোসেফ বালাটিকের ডায়রি পড়ার সময়েই লক্ষ করেছিলাম ব্যাপারটা। এই প্রাচীন 'গালো-ইটালিক'
ভাষা তো বহুকাল হল বাতিল হয়ে গেছে। আর এই ভাষার বিশেষজ্ঞ এখন সারা পৃথিবীতেই
দুর্লভ। এখানে একটা ম্যাপ আঁকা আছে দেখ।"
কাছে
গিয়ে দেখলাম বন্দুকের খোলের ভিতর 'ইউ' আকৃতির একটা দ্বীপের গায়ে ক্রস আঁকা রয়েছে।
তিনি বললেন, "এ অঞ্চলের সমুদ্রে 'ইউ' আকৃতির দ্বীপ একটাই রয়েছে। সেটা আন্দাজ
করে মাফিয়ারা এই দ্বীপে এসেছিল ঠিকই। কিন্তু গুপ্তধনের হদিস বের করতে গেলে তো
ভাষাটা বুঝতে হবে। এদের মধ্যে কেউই এই ভাষায় দক্ষ নন।" মিঃ জিরিজমান হাতে
একটা টর্চ নিয়ে দেয়ালগুলিতে কিছু একটা খুঁজতে শুরু করলেন। নোনা ধরা শ্যাওলার ছোপে
হাত বুলাতে বুলাতে দাঁড়িয়ে গেলেন এক জায়গায়।
সবাই
মিলে সেই জায়গাটা পরিষ্কার করতে একটা জ্যামিতিক ছবি বোঝা গেল ধীরে ধীরে। একটা
চক্র। তার মধ্যে একটা ত্রিভুজ। মাঝে ফুল, লতা, পাতা। মিঃ জিরিজমান ত্রিভুজের তিনটে
কোণে তিনটি ফুলকে লক্ষ করতে বললেন। তারপর পিঠের ব্যাগ থেকে একটা বাক্স বের করে সরু
চামচে করে বারুদ নিয়ে ঢাললেন বন্দুকটির মধ্যে। শেষে সেই লোহার গোলা মুখের মধ্যে
ঢুকিয়ে সরু লোহার শিক দিয়ে ঠেসে দিলেন ভালো করে। হ্যামারের
জায়গাটা ঘষে পরিষ্কার করে দেয়াল থেকে পিছিয়ে এলেন দশ পা গুনে। তারপর তাক করলেন
দেয়ালে আঁকা একটা ফুলের দিকে। প্রচণ্ড জোরে শব্দ হল বদ্ধ গুহার ভিতর। কানে
তালা লেগে গেল আমাদের। গুহা ভরে গেল ধোঁয়া আর বারুদের গন্ধে।
দেখলাম লোহার গুলিটা গিয়ে আঘাত করেছে সেই ফুলের ঠিক মাঝখানে। আরও দু’বার একই জিনিস
করলেন জিরিজমান। তিনটে ফুলে তিনবার গুলির আঘাত করতেই
হুড়মুড় করে একটা আওয়াজ হল। হকচকিয়ে গিয়ে আমরা পিছিয়ে এলাম কিছুটা। গুহার দেয়াল
থেকে ত্রিভুজাকৃতির অংশটা ভেঙে পড়ে গেল চোখের সামনে। টর্চের আলোয় দেখলাম সেখানে আর
একটা রাস্তা খুলে গেছে।
এক
গাল হেসে জিরিজমান বললেন, “ভরবেগের পারফেক্ট কম্বিনেশন। কয়েকশো বছর পরেও জোসেফ
বালাটিকের ইঞ্জিনিয়ারিং বুদ্ধির তারিফ করতেই হবে। আমি নিশ্চিত এর ভিতরেই আছে
সম্রাট 'নারাই'এর গুপ্তধন।”
।। আট ।।
সমুদ্রের
গায়ে ফুকেতের আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর “মাই খাও বান” থেকে পশ্চিমের সূর্যাস্তের
দৃশ্য না দেখলে হয়তো আমাদের এই সফল এডভেঞ্চারটার এমন মধুর সমাপ্তি হত না। সেই
দিকেই নিস্পলক চোখে তাকিয়ে ছিলাম আমরা চারজনে। আকাশের গায়ে মেঘ আর সমুদ্রের জলে
ডুবন্ত সূর্যের অসাধারণ রঙের খেলা দেখে মনে হচ্ছিল প্রকৃতি নিজেই তখন এক 'লিওনার্দো-দা-ভিঞ্চি'।
তানিয়াদি
বলল, “বিয়ের অনুষ্ঠানটা মহেশ সারাফ খুব বুদ্ধি করে রাতারাতি ফুকেতে করার প্ল্যান
করেছিলেন। যাতে ফেরার পথে গুপ্তধনের অংশ, মানে সোনাদানা বা টাকা পয়সা সবার মধ্যে
ভাগ করে নিয়ে দেশে ফেরা যায়। তাতে কাস্টমসে আটকাবে না। বুঝলি?”
ঝিন্টু
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “তা নয় বুঝলাম। কিন্তু দা-ভিঞ্চির পিস্তল আর গুপ্তধন,
সবই তো নিয়ে নিল থাইল্যান্ড সরকার। আমাদের জন্য ছিটে ফোঁটাও দিল না কিছু!”
“এত
সুন্দর রোমাঞ্চকর একটা স্মৃতি নিয়ে ফিরছি, সেটাই বা কম কীসের?” মন্তব্য করল শ্রী।
তানিয়াদি
বলল, “তাছাড়া, কাগজে লিখেছে ঐতিহাসিক গুপ্তধন উদ্ধারের জন্য আমাদের পুরস্কার দেবে
থাই সরকার।”
“তাই
নাকি! তা হলে তো কলকাতায় ফিরে একটা গ্র্যান্ড পার্টি চাই।”
“আমি
ভাবছি পুরস্কারের টাকাটা চন্দননগরের সেই অনাথ আশ্রমে দিয়ে দেব। পাদরি এন্টনি
জিরিজম্যানের স্বপ্ন কিছুটা হলেও পূরণ হবে। তোরা কী বলিস?”
তানিয়াদির
এই কথাটা শুনে আমাদের তিনজনেরই মন ফুরফুরে আনন্দে ভরে গেল। আর সেই সময়েই আমাদের
ডাক পড়ল ব্যাঙ্ককের বিমান ধরার জন্য।।
_____
ছবিঃ লেখক