মুন্সী প্রেমচন্দ
অনুবাদঃ রাজীবকুমার সাহা
হায় রে ছেলেবেলা! সে স্মৃতি ভোলার নয়। সেই কাঁচা ভাঙাচোরা ঘরদোর, সেই পুবের বিছানা
আমার, সেই উদোম গায়ে খালি পায়ে খেতখামারে দস্যিপনা, আমগাছে বেয়ে ওঠা ¾ সব দৃশ্যপট কেমন যেন চোখের
সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছে একে একে। সাধারণ চামড়ার দিশি জুতো পরে যে খুশির
রং ধরত মনে, আজ দামি জুতোতেও সে আনন্দ আর পাই না। গুড়ের পাকের গরম রসে যে মজা ছিল, এখন গোলাপগন্ধী শীতল
শরবতেও তা থাকে না। ফুটকড়াই আর কাঁচা কুলে যে রস ছিল, সে আজ আঙুর আর ক্ষীরমোহনে
কোথায়?
আমি জেঠতুতো ভাই হলধরের সঙ্গে ও-গাঁয়ের এক মৌলবি সাহেবের
কাছে পড়তে যেতুম। তখন আমি আট। হলধর (বর্তমানে সে পরলোকগত)
আমার চেয়ে দু’বছরের বড়ো। দু’জনে সকালবেলা বাসি রুটি খেয়ে,
দুপুরের জন্যে ছোলা ভাজা আর যবের ছাতু পুঁটুলি বেঁধে রওনা হয়ে যেতুম। তারপর তো সারাদিনের বিধাতা আমরাই। মৌলবি সাহেবের ওখানে কোনও হাজিরা-খাতা তো ছিল না যে
যথাসময়ে উপস্থিত না হলে কোনও জরিমানা হবে। তবে আর ভয় কীসে? কখনও থানার সামনে
দাঁড়িয়ে সেপাইদের কসরত দেখতুম তো কখনও কোনও ভল্লুক বা বাঁদরনাচ দেখিয়ে বেড়ানো মাদারির
পিছু ধরে ঘুরে ঘুরে কাটিয়ে দিতুম সারাদিন। কোনো কোনোদিন স্টেশনের দিকে চলে গিয়ে
একের পর এক গাড়ির বাহার দেখতুম। একেকটা গাড়ির আসাযাওয়ার সময়-জ্ঞান যতটুকু আমাদের
ছিল তা বোধ করি টাইমটেবিলেরও ছিল না।
পড়তে যাবার পথে শহরের এক মহাজন একটা বাগান তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন। একটা কুয়োও খোঁড়া হচ্ছিল সে জমিতে। সেখানেও এক চিত্তাকর্ষক তামাশা অপেক্ষা
করে থাকত আমাদের জন্যে। বুড়ো মালি বেশ আপ্যায়ন করে নিজের ঝুপড়িতে নিয়ে বসাত আমাদের। তার কাজেও হাত লাগাতুম আমরা। কখনও বালতিভর্তি জল টেনে এনে গাছের
গোড়ায় ছিটিয়ে দিতুম,
কখনও খুরপি হাতে নতুন নতুন গাছের চারা লাগাতুম, কখনও বা কাঁচি চালিয়ে বেলফুলের ঝাড় ছেঁটে দিতুম আচ্ছা করে। তাতে শিশুসুলভ প্রকৃতির মালির মুখে
এমন একটা ভাব ফুটে উঠত যেন সে আমাদের এসব করতে বাধা না দিয়ে ধন্য করেছে। যে কাজ শেষ হতে তার দিন ঢলে যেত, আমরা ঘণ্টাভর সময়েই
তা সমাধা করে দিতুম। আজ আর সে মালি নেই বটে, তবে বাগানটা রয়েছে
বহাল তবিয়তে। বেশ শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে তার। যখনই তার পাশ কেটে যাই, বড্ড ইচ্ছে হয় এই
গাছগাছালিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ভাসাই, আর বলি, বন্ধু, তোমরা আমাকে ভুলে গেছ হয়তো কিন্তু আমি নই। আমার হৃদয় জুড়ে তোমাদের স্মৃতি আজও
উজ্জ্বল, ঠিক ততটাই যতটা তোমাদের কচি সবুজ পাতাগুলো। নিঃস্বার্থ ভালোবাসার জীবন্ত প্রতিমূর্তি
তোমরা।
কখনও সখনও তো আমরা সপ্তাহের পর সপ্তাহ কামাই করতুম আর মৌলবি
সাহেবের কাছে এমন সব অজুহাত তৈরি করতুম যে তাঁর রাগ নিমেষে গলে জল হয়ে যেত। সে কল্পনাশক্তি আজ থাকলে এমন উপন্যাস
লিখে ফেলতুম যে পাঠক বিস্ময় বোধ করতেন। উপস্থিত তো এই দশা যে শতবার মাথা খুঁড়লে
তবে একটা কাহিনি বেরোয়।
যাই হোক, আমাদের মৌলবি সাহেব পেশায় দর্জি ছিলেন। মৌলবিগিরি ছিল তাঁর একটা শখ মাত্র। আমরা দু’ভাই গাঁয়ের কুর্মি-কামারদের কাছে মৌলবি সাহেবের খুব বড়াই করতুম। আমাদের প্রশংসার আতিশয্যে মৌলবি সাহেবের
কোনও কাজ জুটে গেলে গর্বে বুক ফুলে উঠত আমাদের। যেদিন পোক্ত কোনও অজুহাত দাঁড় করাতে
পারতুম না, মৌলবি সাহেবের জন্যে কিছু না কিছু হাতে করে নিয়ে হাজির হতুম। কখনও সের-আধা সের ডাল-শস্য, তো কখনও পাঁচ-দশটা আখ,
কখনও বা যব অথবা গমের কাঁচা শীষের ছড়া ¾ উপহার চাক্ষুষ করতেই মৌলবি সাহেবের রাগ পড়ে যেত। যখন ওগুলোর মরশুম নয়, তখন শাস্তির হাত থেকে
নিজেদের বাঁচাতে অন্য কোনও উপায় বের করে নিতুম।
মৌলবি সাহেবের পাখির শখ ছিল বেজায়। মক্তবে শ্যামা, বুলবুল, দোয়েল ইত্যাদির খাঁচা ঝোলানো থাকত। ছাত্রদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ওরাও পড়া
করত। ওই
পাখিদের জন্যে বেসন পিষতে উৎসাহের অন্ত ছিল না আমাদের। মৌলবি সাহেব ছেলেদের সবাইকে পোকামাকড়
ধরে আনতে আদেশ দিতেন। তাঁর পাখিরা সে পোকামাকড় বেশ তৃপ্তি করে খেত। আমরা দু’ভাই বেশি বেশি করে
সে সব ধরে এনে মৌলবি সাহেবকে খুশি রাখার চেষ্টা করতুম।
এক সকালে আমরা দু’ভাই পুকুরঘাটে নামলুম মুখ ধুতে। হলধর মুঠোতে কী একটা ফর্সামতো জিনিস
দেখাল গোপনে। আমি
ঝাঁপিয়ে পড়ে জোর করে তার মুঠো আলগা করে দেখি টাকা একটা। বিস্মিত কণ্ঠে শুধোলাম, “এই টাকা তুই কোথায়
পেলি রে?”
হলধর জানাল, “মা তাকের ওপর রেখেছিল, খাটিয়ায় চড়ে পেড়ে এনেছি।”
ঘরে কোনও সিন্দুক বা আলমারি তো কিছু ছিল না, টাকাকড়ি উঁচু তাকেই
রেখে দেওয়া হত আমাদের। একদিন আগেই জ্যাঠামশাই শন বেচেছিলেন
কিছু। সেই
টাকাই জমিদারের ঋণ শোধ করবার জন্যে তাকের ওপর রাখা ছিল। হলধর কখন কী উপায়ে তা দেখে ফেলেছিল
কে জানে। ঘরের
সবাই যখন কাজেকর্মে ব্যস্ত,
তখন নিজের খাটিয়া টেনে এনে তাতে চড়ে এক টাকা পেড়ে এনেছে সে। সেই বয়স অবধি আমরা টাকাকড়ি ছুঁয়েও
দেখিনি কক্ষনও। সেই
টাকাটা চোখের সামনে দেখে রোমাঞ্চ আর ভয়ের যে তরঙ্গ আন্দোলিত হল মনের ভেতর, তা এখনও স্পষ্ট মনে
আছে। আমাদের
কাছে টাকাকড়ি তখনও অলভ্য এক বস্তু বৈ কিছু ছিল না।
মৌলবি সাহেব আমাদের পড়ানোর বিনিময়ে বারো আনা বেতন পেতেন। মাসের শেষে জ্যাঠামশাই স্বয়ং তা মিটিয়ে
আসতেন গিয়ে। অতএব
সটান একটাকা হাতে পেয়ে আমাদের মনের উপস্থিত অবস্থাটা সহজেই অনুমেয়। তবে মার খাওয়ার আতঙ্ক সে আনন্দকে ম্লান
করে দিচ্ছিল। টাকাকড়ি
অগুনতি তো ছিল না। চুরিটা
অচিরেই ধরা পড়ে যাবে নির্ঘাত। জ্যাঠামশাইয়ের ক্রোধান্বিত মুখটা আমি
না হলেও হলধর স্পষ্ট কল্পনা করতে পারছিল। এমনিতে তাঁর মতো সিধে মানুষ এ দুনিয়ায়
আর দুটি ছিল না। যে
কেউ এক হাটে বেচে অন্য হাটে কিনে নিতে পারত অনায়াসে। কিন্তু একবার রেগে গেলেই সর্বনাশ। তখন হিতাহিত জ্ঞান থাকত না তাঁর। জ্যাঠাইমাও ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতেন তখন।
আমরা দু’জনে বেশ কিছুক্ষণ এসব আলাপ-আলোচনা
করলাম। শেষে
অনেক বিচার-বিবেচনার পর সিদ্ধান্ত হল যে হাতের লক্ষ্মী এভাবে পায়ে ঠেলা উচিত হবে না। প্রথমত, সন্দেহটা আমাদের ওপর
আসার সম্ভাবনাই নেই। আর যদি আসেও পরিষ্কার অস্বীকার করব। বলব, আমরা টাকাপয়সা নিয়ে
করবটা কী? কিন্তু হায় রে কপাল! যদি আরও
তলিয়ে ব্যাপারটা ভেবে দেখতুম সেদিন, তবে সেই বীভৎস লীলা আর চাক্ষুষ
করতে হত না যা পরবর্তী সময়ে ঘটল। কিন্তু সেই চরম উত্তেজনার মুহূর্তে
শান্ত মনে ভেবে দেখার অবস্থা আমাদের ছিলই না।
হাতমুখ ধুয়ে আমরা ভয়ে ভয়ে বাড়িতে ঢুকলুম। কেউ যদি তখন তল্লাশি নিতে এগিয়ে আসে
তবে এক ভগবানই জানেন কী যে হবে। কিন্তু দেখা গেল সবাই যে যার কাজে
ব্যস্ত, কেউ ফিরেও তাকাল না আমাদের দিকে।
আমরা জলখাবারও খেলুম না, দুপুরের খাবারও নিলুম না, বইপত্র কোনওমতে বগলদাবা করে মাদ্রাসার পথ ধরলুম। বর্ষার সময়। আকাশে কালো মেঘ ছেয়ে আছে। উল্লসিত আমরা মক্তবের দিকে এগিয়ে চললুম। আজ কাউন্সিলের মন্ত্রী বনে গেলেও সেদিনকার
মতো এত আনন্দ হত না। ইচ্ছেসুখেরা ঝাঁকে ঝাঁকে বুড়বুড়ি কাটছিল মনে, আকাশমহল গড়ে উঠছিল
একের পর এক। কপালজোরে
বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েছে আজ। জীবনে আর সে সুযোগ কখনও আসবে কি না
কে জানে। তাই
টাকাটা এমনভাবে টিপে টিপে খরচ করা চাই যাতে দিনের পর দিন চলে। সেকালে পাঁচ আনা সের দরে দারুণ দারুণ
সব মেঠাই মিলত। আর
হয়তো বা আধা সের মেঠাইও আমরা একবারে খেতে পারতুম না। তবুও মেঠাইয়ে টাকাটা খরচ করতে মন চাইল
না। আরও
সস্তা কোনও খাবার চাই যাতে মন ও পেট দুইই ভরে আর খরচাটাও কম হয়। শেষে গোটাকতক পেয়ারাতে নজর গেল আমাদের। দু’জনেই একবাক্যে রাজি হয়ে গেলাম। দুই পয়সার পেয়ারা কেনা হল। বড়ো বড়ো বেশ কয়েকটা পেয়ারা মিলল। দু’ভাইয়ের কুর্তার কোঁচড় ভরে গেল তাতে। হলধর দোকানির হাতে টাকাটা দিতেই সে
সন্দেহের চোখে খানিক পরখ করে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “টাকা কোথায় পেলে, বাবুরা?
চুরিচামারি করোনি তো?”
উত্তর তৈরিই ছিল। বেশি না হলেও দু-তিনটে বইপত্র তো পড়া
হয়ে গেছে ততদিনে। বিদ্যাদেবীর করুণা কিছুটা হলেও ঝরে পড়েছে মাথায়। ঝটপট উত্তর দিলুম, “মৌলবি সাহেবের ফি
দোব। ঘরে
ভাঙানি ছিল না, তো জ্যাঠামশাই টাকাটা পাঠিয়ে দিলেন।”
দোকানির সন্দেহ দূর হল। দু’ভাই মিলে এক সাঁকোর ওপর পা ঝুলিয়ে বসে
পেট পুরে পেয়ারা খেলুম। কিন্তু বাকি সাড়ে পনেরো আনার কী ব্যবস্থা
করি? টাকাটা
আস্ত থাকলে লুকিয়ে রাখা কঠিন কিছু ছিল না। একমুঠো পয়সা এখন রাখি কোথায়? না খুঁটে এতটা জায়গা
আছে, না পকেটে। তাছাড়া নিজেদের কাছে রাখাটা নিরাপদ
নয় মোটেই।
অনেক শলাপরামর্শ করে সিদ্ধান্ত হল যে বারো আনা মৌলবি সাহেবকে
দিয়ে দেওয়া হবে আর বাকি সাড়ে তিন আনার মেঠাইয়ে উদরপূর্তি হবে। সিদ্ধান্ত শেষে মক্তব পৌঁছলুম দু’জনে। আজ বেশ কিছুদিন পর হাজির হয়েছি আমরা। মৌলবি সাহেব চোখ লাল করে জানতে চাইলেন, “এতদিন ছিলি কোথায়
তোরা?”
“মৌলবি সাহেব, বাড়িতে একজন মারা গেছিল,”
বলতে বলতে বারো আনা তাঁর সামনে নামিয়ে রাখলুম। আর কী? মৌলবি সাহেবের চোখমুখ
নরম হয়ে এল। মাসের
আরও দিন কতক বাকি ছিল। সাধারণত মাস ফুরোলে তাগাদার পর তাগাদা দিয়ে টাকাকড়ি মেলে তাঁর। দস্তুরমতো অগ্রিম বেতন হাতে পেয়ে বড্ড
খুশি হলেন তিনি। দু’ভাই চারপাশের ছেলেদের
পানে সগর্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলুম ¾ ব্যাটারা চেয়ে দ্যাখ, তোরা তো দিনের পর
দিন তাগাদা না পেলে পয়সা ঠেকাস না। আর আমাদের দ্যাখ, কেমন অগ্রিম বেতন
হাতে তুলে দিলুম।
পড়া শুরু হতেই কানে এল, আজ দিঘির পাড়ে মেলা বসবে। ছুটি হয়ে যাবে দুপুরেই। মৌলবি সাহেব বুলবুল লড়াতে যাবেন মেলায়। এই আনন্দসংবাদে হুঁশ রইল না কারও। বারো আনা তো যথাস্থানে দেওয়াই হয়ে
গেছে, বাকি সাড়ে তিন আনার মেলায় গতি করা যাবে। জমবে দারুণ! ইচ্ছেমতো রাবড়ি খাব,
ফুচকা খাব, ঘুগনি সাঁটিয়ে সন্ধে পার করে বাড়ি ফিরব। কিন্তু বাদ সাধলেন স্বয়ং মৌলবি সাহেব। শর্ত রাখলেন, মেলা শুরু হওয়ার আগেই
সবাই যেন যার যার পড়া মুখস্থ করে ফেলে। যে পড়া বলতে পারবে না সে ছুটি পাবে
না। শেষমেশ
এই দাঁড়াল যে আমি তো ছুটি পেয়ে গেলুম, বেচারা হলধরটা আটকা পড়ল। আমি ছাড়াও আরও কয়েকটা ছেলে ছুটি পেয়ে
গিয়েছিল; সবাই মেলার দিকে পা বাড়াল। আমিও এদের সঙ্গ ধরলাম। পয়সা আমার কাছেই ছিল, তাই হলধরের জন্যে
আর অপেক্ষা করলুম না। বলে এলুম, ছুটি পেতেই সে যেন
মেলায় উপস্থিত হয় গিয়ে, দু’জনে একসঙ্গে
মেলা দেখব তখন। কথা দিয়ে এলুম, যতক্ষণ না সে মেলায় উপস্থিত হচ্ছে ততক্ষণ এক
নয়া পয়সাও খরচ করব না আমি। তখন কে আর জানত কপালে কী দুঃখ নাচছে
আড়ালে। মেলায়
ঢুকেছি এক ঘণ্টারও বেশি হয়ে গেছে, হলধর ব্যাটার দেখা নেই। তাহলে কি এখনও মৌলবি সাহেব তাকে আটকে
রেখেছেন? নাকি পথ ভুলে গেল? কড়া নজর রেখেছি পথের দিকে। মেলায় একা একা ঘুরতে ইচ্ছে করছিল না। মনে সংশয়ও উঁকি দিচ্ছিল যে চুরি ধরা
পড়ে গেল না তো? জ্যাঠামশাই তাকে পাকড়াও করে নিয়ে যাননি তো?
বিকেল পড়ে আসতে আমি খানিকটা রাবড়ি কিনে খেয়ে হলধরের ভাগের পয়সাটা
পকেটে ফেলে আস্তে আস্তে বাড়ির পথ ধরলুম। পথে খেয়াল হল, একবার মক্তব ঘুরে
যাই না কেন? হয়তো বা হলধর এখনও বসে রয়েছে সেখানে।
কিন্তু না, মক্তব নিঝুম। হ্যাঁ, একটা ছেলেকে খেলে
বেড়াতে দেখা গেল। সে আমাকে দেখতে পেয়েই উঁচু গলায় বলে উঠল, “বাচ্চু, ঘরে ফেরো আজ। দেখো কেমন পিঠে পড়ে। তোমার জ্যাঠা এসেছিলেন। হলধরকে মারতে মারতে টেনে নিয়ে গেছেন। একেক মারে মুখ থুবড়ে পড়ছিল হলধর। টেনে তুলেই ফের মার। তুমি মৌলবি সাহেবকে যে অগ্রিম বেতন
দিয়েছিলে সেও ফেরত নিয়ে গেছেন। এখন কোনও উপায় ভাবো জলদি, নয়তো একটা মারও মাটিতে
পড়বে না।”
শরীরের সমস্ত রক্ত যেন শুকিয়ে এল আমার। যা সন্দেহ হচ্ছিল, তাই হল শেষে। পায়ে এতটুকু জোর পাচ্ছি না। একেকটা যেন একেক মনি পাথর। বাড়ির পথে এক পা চলতেই কষ্ট হচ্ছিল
প্রচণ্ড। দেবদেবীর
যতগুলো নাম মনে ছিল সবার কাছে মানত করলুম ¾ কাউকে মণ্ডা, কাউকে প্যাঁড়া,
তো কাউকে বাতাসা। গাঁয়ে ঢুকেই গাঁও-দেবতার স্মরণ করলুম। বড়ো জাগ্রত তিনি। সবই করলুম যা যা করার, কিন্তু বাড়ি যতই কাছাকাছি
আসতে লাগল বুকের ভেতর হাতুড়ির ঘা ততই তীব্র হতে লাগল। আকাশের কালো মেঘগুলো ততই ঘন হতে লাগল। আকাশ ভেঙে নামার অপেক্ষাটুকু বাকি। দেখতে পাচ্ছি, সবাই যে যার কাজকর্ম
সেরে বা ফেলে রেখে বাড়ির দিকে জোর পা চালিয়েছে। গাইবাছুরও লেজ তুলে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়চ্ছে। পাখপাখালিও কিচিরমিচির শব্দে নিশ্চিন্ত
আশ্রয়ের খোঁজে উড়ে চলেছে। এক আমারই কোনও হেলদোল নেই, পা চলছে না আর। মনেপ্রাণে চাইছিলুম এই মুহূর্তে গা
কাঁপিয়ে যেন ধুম জ্বর আসে। তা ইচ্ছেগুলো আর কবেই বা পূরণ হয়েছে? কিছুই হল না,
বহাল তবিয়তে আমি ধীরে ধীরে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালুম। এখন?
আমাদের দেউড়ির মুখে বিশাল বড়ো ঝাঁকড়া এক তেঁতুলগাছ ছিল। আমি চট করে সে-গাছের আড়ালে গিয়ে লুকোলুম
যাতে আরও খানিক অন্ধকার নামলে চুপিচুপি ঘরে ঢুকে মা’র খাটের তলায় গিয়ে সেঁধোতে পারি। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে তখন মা’র কাছে খুলে
বলব সব। মা
আমার সরলমতি, কখনও মারধোর করেন না। তাঁর কাছে বসে একটু আধটু চোখের জল
ফেললেই হবে, মা আমার গলে যাবেন একেবারে। রাতটুকু কোনওমতে কেটে গেলেই, ব্যস। সকালে আর কে কী মনে রাখবে? রাগ পড়ে যাবে সবার।
আমার এই মনোকামনা যদি পূরণ হত তবে আর কোনও কথাই ছিল না সেদিন, বেঁচে যেতাম আমি। কিন্তু বিধাতার তা মোটেও ইচ্ছে ছিল
না। ভাগ্যের
ফেরে কে একটা ছেলে আমাকে দেখে ফেলল আর আমার নাম ধরে চিৎকার করতে করতে ঘরের দিকে ছুটে
গেল। আমার
আর কোনও আশাভরসা অবশিষ্ট রইল না। অনন্যোপায় আমি উঠোনে পা ফেলেই গগনভেদী
এক চিৎকার করে উঠলুম সহসা,
মার খাওয়া কুকুর যেমন কাউকে এগিয়ে আসতে দেখলে আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে। দাওয়ায় বাবা বসেছিলেন। বাবার শরীরটা ইদানিং ভালো যাচ্ছিল
না। তিনি
ছুটি নিয়ে বাড়িতেই বিশ্রাম নিচ্ছিলেন ক’দিন ধরে। তাঁর ঠিক কী অসুখ করেছে তা জানতুম
না, তবে
দেখতে পেতুম সন্ধের পর কাচের গ্লাসে তিনি বোতল থেকে কী একটা ওষুধ ঢেলে নিয়ে চুমুক দিয়ে
খেতেন, সঙ্গে মুগডাল ভাজা। নিশ্চয়ই প্রসিদ্ধ কোনও হেকিমের দেওয়া
ওষুধ হবে তা। ওষুধ
জিনিসটা বড্ড দুর্গন্ধ আর তেতোই হয়। এটাও নিশ্চয়ই ব্যতিক্রম কিছু নয়। তবুও কেন কে জানে বাবাকে দেখতাম এই
ওষুধটা খুব মজা করে খেতেন তিনি। কী জানি বাবা, আমি তো ওষুধ খেতে
হলে নাক টিপে ধরে এক ঢোঁকে গিলে ফেলি তা। তবে বাবার ওষুধটা বোধ করি ধীরে ধীরে
খাওয়ারই নিয়ম। বাবার
আশেপাশে তখন গাঁয়ের আরও দুয়েকজন বা কখনও সখনও চার-পাঁচজন রোগী ঘিরে বসে থাকত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটু একটু করে সেই
ওষুধ খেত সবাই মিলে। শেষে রাতের খাবারের ডাক পড়লে আরও যেন অসুস্থ হয়ে পড়ত তারা, ঠিকমতো উঠে দাঁড়াতে
পারত না।
এই মুহূর্তেও কয়েকজনা মিলে সেই ওষুধই খাচ্ছে তারা। বাবাকে ঘিরে ক’জন রোগী বসে আছেন। আমাকে নজরে পড়তেই চোখ লাল করে বাবা
বলে উঠলেন, “ছিলি কোথায় এতক্ষণ?”
আমি মিনমিন করে উত্তর দিলাম, “কই, কোথাও নয়
তো।”
“আজকাল চুরিচামারিতে হাত পাকাচ্ছিস, অ্যাঁ? বল, টাকাটা চুরি করেছিলি
কি না।”
আমার বুকে তখন দামামা বাজছে। সামনে খাঁড়া ঝুলছে। শ্বাস ফেলতেও ভয় হচ্ছিল পাছে শব্দ
হয়।
বাবা আরও গরম হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কথা বেরোচ্ছে না
কেন? বল, টাকাটা তুই চুরি করেছিস?”
আমি সর্বশক্তি এক করে উত্তর দিলাম, “আমি বললাম…”
মুখ থেকে সবটা কথা বেরোয়নি তখনও, বাবা দেখলাম রুদ্রমূর্তি
ধারণ করে দাঁতে দাঁত পিষে প্রহারোদ্যত হয়ে আমার দিকে তেড়ে আসছেন।
আমি তীব্র আতঙ্কে চিৎকার দিয়ে উঠলাম। চিৎকারের মাত্রা এতটাই সীমা ছাড়িয়ে
গিয়েছিল যে বাবাও থতোমতো খেয়ে গেলেন। হয়তো ভাবলেন, না মারতেই যদি এর
এই দশা হয় তো দু-চারটে ঘা পড়লে প্রাণটাই না বেরিয়ে যায়। যেই না আমি বুঝে গেলুম যে ওষুধে কাজ
হয়েছে কান্নার মাত্রা দ্বিগুণ করে দিলুম তৎক্ষণাৎ। ততক্ষণে অন্য রোগীদের মধ্যে ক’জন দৌড়ে এসে বাবার
হাত ধরে ফেলল আর ইশারায় আমাকে সরে যেতে বলল। ছোটোরা সাধারণত এমতাবস্থায় অকুস্থলেই
দাঁড়িয়ে থাকে এবং পড়ে পড়ে মার খায়। আমি সেই ধাতুর গড়া নই। মুহূর্তে পিঠটান দিলুম সেখান থেকে।
তবে ভেতরবাড়ির দৃশ্য এর চেয়েও বেশি ভয়ংকর ছিল। আমার তো বুক শুকিয়ে গেল সে দৃশ্য দেখে। দেখি কী, পিছমোড়া করে হলধরকে
বেঁধে রাখা হয়েছে এক খুঁটিতে। গা-ভর্তি ধুলোমাটি। আর সে অবিরাম ফুঁসে চলেছে রাগে। পায়ের কাছের মাটিতে জলের শুকনো দাগ। জ্যাঠাইমা অনবরত ছেলেকে গালাগাল দিয়ে
যাচ্ছেন, আর মা পাশে বসে মশলা বাটছেন।
সবার প্রথমে জ্যাঠাইমাই খেয়াল করলেন আমাকে। বললেন, “নাও, আরেকজনও হাজির। কী রে, টাকাটা তুই চুরি করেছিলি,
না ও?”
আমি জোর গলায় জবাব দিলুম, “আমি নই, হলধর।”
মা বলে উঠলেন, “মানলুম সে-ই চুরি করেছে,
তা তুই তক্ষুনি বাড়িতে এসে জানালি না কেন?”
ভেবে দেখলুম এই মুহূর্তে মিথ্যে বলা ছাড়া গত্যন্তর নেই। হলধরের মার খাওয়ার অভ্যেস আছে, আরও গুটিকতক ঘায়ে
ওর ক্ষতিবৃদ্ধি কিছু হবে না। আমি কখনও মার খাইনি। দু-চার ঘায়েই প্রাণ বেরিয়ে যাবে আমার। আর হলধরও নিজেকে বাঁচাতে আমাকে ফাঁসিয়েছে
নির্ঘাত। নইলে
প্রথমেই জ্যাঠাইমা ওকথা কেন জিজ্ঞেস করবেন যে টাকা আমি চুরি করেছি, না হলধর? আমি তাড়াতাড়ি বললুম, “কী করব? হলধর
হুমকি দিয়ে রেখেছিল যে কাউকে বলে দিলে প্রাণে মেরে ফেলবে।”
মা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, “দেখলে তো দিদি, আমার কথা ফলল কি না! ছেলে আমার তেমন নয়। টাকাকড়ি সে ছুঁয়েও দ্যাখেনি আজ অবধি। কিন্তু কে শোনে কার কথা। সবাই মিলে আমাকেই… হুঁহ।”
হলধর ঘাড় বাঁকিয়ে বলে উঠল, “আমি কখন তোকে বলেছি যে বলে দিলে মারব?”
সটান উত্তর দিলুম, “হ্যাঁ, বললি না!
পুকুরঘাটে?”
হলধর প্রতিবাদ করে উঠল, “মিথ্যে কথা মা, মিথ্যে
বলছে ও।”
জ্যাঠাইমা মুখ ঝামটে উত্তর দিলেন, “মিথ্যেবাদী তো তুই। এক তুই ছাড়া দুনিয়ার সব সত্যবাদী যুধিষ্ঠির। হ্যাঁ, তোর বাপ চাকরি করত,
ঘরে টাকা আনত তবে চারজনা তাঁকে মানুষ ভালো বলত। তখন তোকেও মিথ্যেবাদী বলত না কেউ। মেঠাই যার ভাগ্যে ছিল সে খেয়েছে, তোর ভাগ্যে লাথি-ঝাঁটা থাকলে খণ্ডাবি কীসে?”
এই বলতে বলতে জ্যাঠাইমা হলধরের হাত খুলে দিয়ে তাকে ঘরে নিয়ে
গেলেন।
আমার মা সে-যাত্রা বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন আমাকে। নয়তো মারের সীমা থাকত না সেদিন। নির্জনে মা’র কাছে বসে নিজের নির্দোষিতার
ঝাঁপি খুলে বসলাম। আমার
স্নেহশীলা মা নিজের ছেলেকে সত্যবাদী যুধিষ্ঠির ভাবতেন। তাঁর সম্পূর্ণ বিশ্বাস ছিল যে সব অপরাধ
হলধরেরই ছিল।
কিছুক্ষণ পর গুড় আর চালভাজা হাতে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে। হলধরও বেরিয়ে এল চিতল পিঠে চিবোতে
চিবোতে। দু’ভাইয়ে মিলে বাড়ি থেকে
বেরিয়ে অন্ধকার মাঠে বসে যে যার কাহিনি শোনাতে লাগলুম। আমার কাহিনি সুখের, আর ঠিক উলটোটা হলধরের। তবে কাহিনি যতই বিপরীত হোক, শেষ কিন্তু
একটাই — গুড়, পিঠে, আর চালভাজা
ভাগাভাগি।
_____
ছবিঃ আন্তর্জাল
ছবিঃ আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment