অপমানব
মূল কাহিনিঃ দ্য লার্কিং ফিয়ার (১৯২২)
এইচ পি লাভক্র্যাফট
ভাষান্তরঃ দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
।।
এক ।।
চিমনির ওপরের ছায়া
ঝড়পাহাড়ের মাথার সেই
পরিত্যক্ত প্রাসাদটায় উঁকিঝুকি মারা আতঙ্কের খোঁজে প্রথম যেবার পা দিই, সে এক
ঝড়ঝঞ্ঝার রাত। বাতাসে বিদ্যুতের ছোঁয়া ছিল। বাজ ডাকছিল মেঘে ঢাকা আকাশে। উঁহু, আমি
একলা যাইনি অবশ্য। আসলে যে কোনও অজানা ভয় আমায় টানে। বড়ো
সাংঘাতিক সেই টান। একলা একলা তার সন্ধানে গোটা জীবনটাই প্রায় কেটে গেল আমার। তবে,
যে সময়টার কথা বলছি, তখনও আমি কাঁচা। তখনও সে টান এত গভীর ফাঁস হয়ে আমার গলায় এঁটে
বসেনি।
দুই গাঁট্টাগোট্টা বন্ধু ছিল সঙ্গে।
তেমন কোনও ভয়ের খোঁজে বের হলে সে-সময় তারাও আমার সঙ্গে এসে জুটত।
মাস খানেক আগে থেকেই জায়গাটা
নিয়ে গোটা এলাকায় একটা বেশ ভয়ের আবহ তৈরি হয়ে উঠেছিল। দুঃস্বপ্নের মতো কয়েকটা
নারকীয় মৃত্যু। অকল্পনীয় নিষ্ঠুরতার চিহ্ন বাদে অপরাধী নিজের কোনও ছাপই রেখে যায়নি
অকুস্থলে।
বিষয়টা নিয়ে খবর করবার জন্য তখনও
সে-চত্বরের কাছাকাছি গ্রামের একমাত্র হোটেলটাতে বেশ কিছু রিপোর্টার খুঁটি গেড়ে
রয়েছে। যে অভিযানের প্ল্যান আমরা করেছিলাম, তার আভাস পেলে নিঃসন্দেহে এরা দল বেঁধে
সঙ্গে এসে জুটত। তাতে অনেক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট হবার ভয় হয়েছিল আমার। কাজেই
গ্রাম থেকে রওনা হয়েছিলাম তাদের চোখ এড়িয়ে, একদম চুপচাপ। কেউ টের পায়নি। এখন ভাবি,
ভগবান যদি তখন আমায় খানিক সুবুদ্ধি দিতেন, যদি ওদের সঙ্গে করে নিয়ে যেতাম সেই
রাত্রে, তাহলে হয়তো কঠিন, অবিশ্বাস্য সত্যের এই গোপন বোঝা আমায় এতদিন একা একা বয়ে
বেড়াতে হত না। হ্যাঁ, একা একাই বয়ে বেড়াই আমি সে রাত্রের ঘটনাগুলোর স্মৃতিকে।
দুনিয়াকে জানাতে গেলে, হয় তারা আমাকে অবিশ্বাস করে পাগল বলবে, কিংবা, বিশ্বাস করলে
নিজেরাই উন্মাদ হয়ে যাবে ওর দানবিক ইঙ্গিতকে সইতে না পেরে।
তবে আর আমি পারছি না। এবার
বলতেই হবে আমায়। কতদিন একা একা নিজের মনে বিড়বিড় করে বেড়াব, আপনারাই বলুন! মাঝে
মাঝে মনে হয় ওর বোঝা বইতে বইতে সত্যিই বুঝি চৈতন্য লোপ পাবার সময় এসে গেছে আমার।
মনে হয়, হয়তো গোড়াতেই আমার সব কিছু বলে দেয়া উচিত ছিল। ও-পাহাড়ের নির্জন বুকে যে আতঙ্কের
বাস, কেবল আমিই তা জানি...
একটা ছোটো মোটরে করে রওনা
দিয়েছিলাম আমরা। গ্রাম ছাড়িয়ে বন। তারপর আস্তে আস্তে জমি উঁচু হতে হতে শেষে ঘন
জঙ্গলে ছাওয়া পাহাড়ের দেয়ালের নিচে এসে গাড়ির রাস্তা শেষ হয়ে গেল। দিনের বেলা ক’দিন
ধরেই জায়গাটায় কৌতূহলী লোকজনের ভিড় থাকে। কিন্তু সেই অন্ধকার রাত্রে একটাও
জনপ্রাণী ছিল না সেখানে। নির্জন, অন্ধকার পাহাড়টা বড়ো ভূতুড়ে লাগছিল তখন। একটা
অশুভ ছায়া যেন ঘিরে আছে গোটা এলাকাটাকে।
জায়গাটার ব্যাপারে আগেভাগে
যদি নাও জানা থাকে কারও, তবুও সেখানে পা দিলে সেই ছায়াটা সে টের পাবেই। পাহাড়ের
গায়ের ঘন জঙ্গলে বুনো জীব দূরস্থান, একটা পোকামাকড়েরও আওয়াজ মিলছিল না। ওরা জানে।
যেখানে মৃত্যুর গন্ধ ভাসে সেখানে ওরা থাকে না। প্রাচীন, বাজ-পোড়া গাছগুলো অতিকায়
চেহারার। প্রাচীন সর্পরাজদের মতোই বিচিত্রভাবে এঁকেবেঁকে আকাশের দিকে উঠে গেছে
তাদের শরীর। ঝোপঝাড়ে ঢাকা, ইতিউতি কোয়ার্টজের
খোঁদলে ভরা বন্ধুর মাটির বুকে এখানে ওখানে মাথা জাগিয়ে রয়েছে বিচিত্রদর্শন সব বড়ো
বড়ো ঢিবি। যেন দানবিক কিছু খুলি ছড়িয়ে রয়েছে চারপাশে।
এই ঝড়পাহাড়ের মাথার আতঙ্ক
নিয়ে গুজবের বয়েস এক শতাব্দীরও বেশি। ওর কথা আমি প্রথম জানতে পেরেছিলাম খবরের
কাগজের একটা আর্টিকল থেকে। সেখানে যে দুর্ঘটনাটার খবর দেয়া হয়েছিল সেই থেকেই গোটা
দুনিয়া ওর কথা প্রথম শোনে। ক্যাটস্কিল পর্বতশ্রেণীর যে নির্জন এলাকাটায় ডাচরা
এককালে তাদের আস্তানা বানিয়েছিল তার একেবারে শেষপ্রান্তে পৌঁছোলে তবে তার দেখা
পাওয়া যায়। সে আস্তানা ছেড়ে ডাচরা বহু আগেই সরে গেছে। পেছনে রেখে গেছে কিছু
ভাঙাচোরা প্রাসাদের ধ্বংসস্তূপ আর পাহাড়গুলোর জনহীন ঢালে দূরে দূরে গুটিকয় ছোটো ছোটো
গ্রাম। দেশে পুলিশ বাহিনী গড়বার আগে বাইরের লোকজন সেখানে বিশেষ পা দিত না। এখনও
কদাচিত দুয়েকবার পুলিশ সে-এলাকায় টহল দিতে যায়।
তবে বাইরের লোকের এতকাল জানা
না থাকলেও ঝড়পাহাড়ের আতঙ্কের প্রবাদটা ওর কাছাকাছি এলাকায় বেশ ভালোভাবেই চালু
রয়েছে। ও-পাহাড়ের লোকজন না জানে চাষ-আবাদ, না জানে কোনও জিনিসপত্র বানাবার কায়দা।
মাঝেমধ্যে তারা পাহাড় ছেড়ে নেমে আসে। সঙ্গে করে আনে হাতে বোনা ঝুড়ি। তার বদলে
রোজকার জীবনে কাজে লাগে এমন হরেক জিনিসের সওদা করে নিয়ে ফের ফিরে যায় তাদের পাহাড়ি
আস্তানায়।
ঝড়পাহাড়ের এহেন নামটা হবারও
কারণ আছে একটা। ওর মাথায় প্রায়শই ঝড় ওঠে, আর ঘন ঘন বাজ পড়ে। তার একেবারে চুড়োর
কাছটিতে দাঁড়িয়ে আছে পরিত্যক্ত মার্টেনস প্রাসাদ। শতবর্ষেরও বেশি প্রাচীন এই
পাথরের বাড়িটা নিয়ে ভয়ংকর সব গল্পগাছা শোনায় এলাকার মানুষ। সেখানে নাকি মৃত্যু
সাক্ষাৎ অতিকায় চেহারা নিয়ে বুকে হেঁটে ঘুরে বেড়ায় সারা গ্রীষ্ম জুড়ে। কাছাকাছি
গ্রামের লোকজন পাহাড়টার দিকে দেখিয়ে বলত, “শয়তান। সাক্ষাৎ
শয়তানের বাসা ওখানে। এ-চত্বরে অন্ধকার নামবার পর কেউ একা পথে বের হলে ও এসে তাকে
ও-ই পাহাড়ের ভেতরে নিয়ে যাবে। আর নিয়ে যেতে ইচ্ছে না হলে শরীরটাকে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলে
রেখে যাবে।” কখনও কখনও নাকি গ্রাম থেকে পাহাড় অবধি পথের বুকে ফোঁটা ফোঁটা রক্তের
চিহ্নও দেখেছে অনেকে। কেউ কেউ বলত, আকাশে বাজ ডাকলে সেখানকার শয়তান ঘুম ভেঙে জেগে
ওঠে। অনেকে আবার বলত, তা নয় হে। আসলে ও যখন গর্জন করে, দূর থেকে সেইটেই বাজের
শব্দের মতো শোনায়।
তবে হ্যাঁ। পাহাড়ের ঢালের
গ্রামগুলোর আধা বুনো লোকজন যতই রাতের অন্ধকারে আলোছায়ার মধ্যে রাক্ষুসে কিছু একটার
দেখা পাওয়ার গালগল্প শোনাক না কেন, পাহাড়ের বাইরের দুনিয়ার লোকজন সেসব কথায় খুব
একটা আমল দিত না। তবে একটা জিনিস সবাই অনুমান করত, ওই মার্টেনস প্রাসাদে কিছু একটা
আছে। ওই আধবুনোরা সওদা করতে এসে বেশিরকম বিশ্রী জাতের কোনও গল্প শোনানোয় দুয়েকবার
লোকজন অবশ্য ও-প্রাসাদে গিয়ে ঘুরে এসেছে, কিন্তু তেমন কিছুর দেখাসাক্ষাৎ পায়নি।
ফলে হাতেনাতে প্রমাণ কিছু না পেলেও গ্রামের বুড়োবুড়িরা কিন্তু মার্টেনস-এর অশরীরীর
বিষয়ে কিছু গালগল্প বলত। মার্টেনস পরিবারের ব্যাপারেও অনেক প্রবাদ চালু ছিল
এলাকায়। তাদের লোকজনের নাকি পুরুষানুক্রমে দুটো চোখ দু’রকম হত। নাকি ওই পরিবারের
ইতিহাসেও অনেক রহস্য আছে। নাকি একবার এক ভয়ানক খুন হবার পর ওদের ওপর অভিশাপ
লেগেছিল...
যে ভয়াল ঘটনাটার জন্য
মার্টেনস প্রাসাদের দিকে আমার মন টেনেছিল সে ছিল পাহাড়ের ঢালের আধবুনোদের সেই ভয়ের
গল্পগুলোর একটা সন্দেহজনক প্রমাণ। এক গ্রীষ্মের রাত্রে খানিক সাংঘাতিক ঝড়বৃষ্টির
পর হঠাৎ পাহাড়তলির গ্রাম এলাকায় পাহাড় থেকে আধবুনোদের দলটা হুড়োহুড়ি করে নেমে চলে
আসে। তাদের এলোমেলো চ্যাঁচামেচি থেকে এইটুকুই উদ্ধার করা যায় যে বুকে হাঁটা সেই
সাক্ষাৎ মৃত্যুর দূত নাকি বের হয়ে এসেছে মার্টেনস প্রাসাদ থেকে। সে রাত্রে লোকজন
তাদের কথায় পুরোপুরি অবিশ্বাস করেনি। তার একটা কারণ এই যে, কিছু একটা সত্যি সত্যি
না ঘটে থাকলে একসঙ্গে এতগুলো লোক এভাবে ভয় পেয়ে পাহাড় ছেড়ে একসঙ্গে নেমে আসত না।
আর তাছাড়া সে রাত্রে গ্রামের লোকজন কিছু না দেখলেও পাহাড় থেকে কিছু রক্ত জল করা
অস্বাভাবিক শব্দ শুনেছিল।
পরদিন সকাল হতে গ্রামের লোকজন
কিছু পুলিশ সঙ্গে নিয়ে আধবুনো পাহাড়িদের সঙ্গে ব্যাপারটার তদন্ত করতে গিয়েছিল।
গিয়ে তারা আবিষ্কার করে মৃত্যুর দূত কথাটা নেহাত মিছে নয়। যে জায়গাটায় তাদের পথ
দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় সেখানটা ওই আধবুনোদের একটা ছোটোখাটো বস্তি ছিল। গোটা বস্তিটা
একটা ধ্বস নেমে তলিয়ে গেছে। আধবুনোদের দাবি, নাকি আকাশ থেকে নেমে আসা একটা বাজের
ঘা খেয়ে অমনটা ঘটেছে।
দৃশ্যটা ভয়ংকর হলেও খুব একটা
অস্বাভাবিক নয়। অমন ধ্বস পাহাড়ে নেমেই থাকে। যেটা অস্বাভাবিক সেটা হল, বস্তিটার
জনা-পঁচাত্তর বাসিন্দার মধ্যে একজনও জ্যান্ত নেই। গোটা ধ্বসের এলাকাটা জুড়ে
তাদের আধখাওয়া, দাঁত আর নখে ছেঁড়াখোঁড়া
শরীরের টুকরোটাকরা ছড়িয়ে আছে।
অথচ গোটা জায়গাটা তন্নতন্ন
করে খুঁজেও সেখানে যে কোনও রাক্ষুসে জীব এসে ঢুকেছে বা খুনজখম শেষ করে সেখান থেকে
বেরিয়ে গিয়েছে তেমন কোনও চিহ্ন ধরা পড়ল না কারও চোখে। আগেও পাহাড়িরা মাঝেমধ্যে
গ্রামে নেমে এসে দুয়েকটা এহেন খুনজখমের গল্প বলেছে। তবে সেসব সময়ে তাদের বুকে
হাঁটা মৃত্যুদূতের গল্পকে গাঁজাখুরি বলে উড়িয়েই দিয়েছে সবাই। ধরে নেয়া হয়েছে, তেমন
কিছু হয়ে থাকলেও, আসলে আধবুনোদের মধ্যেই কোনও কাল্টের সদস্যদের হাতে বলি হয়েছে
লোকগুলো। কিন্তু এ-যাত্রা আর তেমন সন্দেহ করা যাচ্ছিল না।
অবশ্য খানিক বাদে সে সন্দেহটা
ফের উঠে এসেছিল অন্য একটা কারণে। শরীরগুলোর টুকরোটাকরা খুঁজেপেতে এনে হিসেব মেলাতে
গিয়ে দেখা গিয়েছিল, পঁচাত্তরজনের মধ্যে পঁচিশটা শরীরের কোনও হিসেব নেই। তবে
সন্দেহটা মুখে বললেও পঁচিশটা লোক মিলে পঞ্চাশটা মানুষকে এমন ভয়ানকভাবে খুন করে
ফেলতে পারে সেটা মেনে নেয়া কঠিন হচ্ছিল লোকজনের পক্ষে।
অতএব রহস্যটার কোনও সমাধান হল
না। শুধু চোখের সামনে রয়ে গেল একটা ভয়ানক ছবি। আকাশ থেকে বাজ নেমে এসে পাহাড়ে আছড়ে
পড়ল, আর তারপর সেখানে পড়ে রইল একটা মরা গ্রাম আর পঞ্চাশজন মানুষের ছেঁড়াখোঁড়া
মৃতদেহ।
ঘটনাস্থলটা মার্টেনস প্রাসাদের
থেকে বেশ ক’মাইল দূরে হলেও এলাকার লোকজন কিন্তু ঘটনাটার দায় চাপাচ্ছিল ওই
প্রাসাদের অদেখা বাসিন্দার ওপরেই। তবে তাদের সঙ্গে আসা পুলিশের লোকজন সে দাবিতে
খুব একটা গুরুত্ব দিতে নারাজ। লোকজনের চাপে পড়ে প্রাসাদে একটা দায়সারা তদন্ত করতে
গিয়েছিল বটে তারা, কিন্তু জায়গাটাকে একেবারে খা খা খালি দেখে সে তদন্তে ইতি ঘটতে
দেরি হয়নি।
তবে পুলিশে গুরুত্ব না দিলে
কী হয়, এলাকার লোকজন অত সহজে হার মানতে নারাজ। গোটা প্রাসাদ চত্বরটা তারা যাকে বলে
চিরুনি তল্লাশি করে ছেড়েছিল সেবার। কিন্তু সেই তল্লাশি সেরে, তার পর কাছাকাছি যত
পুকুর, জলা, নালা আছে তাতে ডুব মেরে, আশপাশের বনজঙ্গল আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও লাভ হল
না কোনও। ধ্বংসের ভয়ংকর দৃশ্যটা ছাড়া
হত্যাকারী আর কোনও প্রমাণ ছেড়ে যায়নি গোটা এলাকায়।
খোঁজাখুঁজি যখন দ্বিতীয় দিনে
পা দিয়েছে ততক্ষণে ঘটনাটার খবর কাগজওয়ালাদের কানে গিয়ে পৌঁছেছে। ঝড়পাহাড়ে রিপোর্টারের
ঢল নামল। তারপর তো রোমহর্ষক নিউজ রিপোর্টের বান ডাকল
কাগজে কাগজে। হত্যাদৃশ্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ
থেকে শুরু করে স্থানীয় লোকজনের সাক্ষাৎকারে মার্টেনস প্রাসাদের ভয়াল ইতিহাস-ভূগোল
ছাপা হতে লাগল প্রতিদিন।
এ-জাতীয় ঘটনায় আমার বেশ
ভালোরকম সব অভিজ্ঞতা গড়ে উঠেছিল ততদিনে। অতএব খবরের
কাগজের লোক ভোলানো রঙচঙে কথাবার্তায় শুরুতে বিশেষ গুরুত্ব দিইনি। ভেবেছিলাম, ওসব
আসলে ফক্কিকারি করে কাগজ বিক্রি বাড়াবার কায়দা। দু’দিনে ঠাণ্ডা হয়ে আসবে। কিন্তু
প্রায় সপ্তাহ খানেক বাদেও যখন দেখলাম বিষয়টা নিয়ে কাগজওয়ালাদের উৎসাহ কমবার বদলে
আরও বেড়ে চলেছে, তখন মনে হল ব্যাপারটাকে একটু তদন্ত করে দেখা দরকার। অতএব ১৯২১
সালের পাঁচই আগস্ট আমি লেফার্ট কর্নার নামের একটা গ্রামে পৌঁছে সেখানকার যে
হোটেলটায় সাংবাদিকরা থানা দিয়েছে, সেই হোটেলেই চেক ইন করলাম। গ্রামটা ঝড়পাহাড়ের
পাদদেশের সবচেয়ে কাছে। ফলে খোঁজারুর দল সেইখানেই সবাই এসে থানা দিয়েছে।
এরপর হপ্তা তিনেক সেই হোটেলে
খুঁটি গেড়ে বসে বিষয়টা নিয়ে কেবল খোঁজখবর চালিয়েছিলাম আমি। ততদিনে কোথাও কিছু
প্রমাণ-টমান না পেয়ে অনেক খোঁজারুই উৎসাহ হারিয়ে যার যার জায়গায় ফিরে গেছে। কিছু
নাছোড় সাংবাদিক ছাড়া আর কেউ নেই হোটেলে।
যা হোক, এবারে সেই রাতটার
কথায় ফিরে যাই।
মোটরের ইঞ্জিন বন্ধ করে দুই
সঙ্গীকে নিয়ে ঝড়পাহাড়ের সেই ঢিবিগুলোর ফাঁক দিয়ে দিয়ে ওপর দিকে উঠে যাচ্ছিলাম
আমরা। একসময় টর্চের আলোয় প্রাচীন ওকগাছগুলোর ফাঁকে ফাঁকে প্রাসাদের পাঁশুটে রঙের
দেয়ালগুলো দেখা দিল। টর্চের দুর্বল আলোর আবছায়ায় সুবিশাল একটা পাথুরে কফিনের মতো
দাঁড়িয়ে থাকা প্রাসাদটার চেহারায় একটা অশুভ ছাপ ছিল। দিনের ঝকমকে রোদের আলোয় তা
টের পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু আমি তাতে পিছিয়ে যাবার লোক নই। তিন সপ্তাহ ধরে সব
দেখেশুনে তখন আমার মাথায় গোটা ব্যাপারটা নিয়ে একটা তত্ত্ব খাড়া হয়েছে। সেইটেকে
পরীক্ষা না করে আমি সেখান থেকে তখন এক পা নড়তে রাজী নই। তত্ত্বটা হল, সম্ভবত আকাশ
থেকে নেমে আসা বাজ ও-প্রাসাদের কোনও গোপন আস্তানায় ঘুমন্ত ওই মৃত্যু-দানবকে জাগিয়ে
তোলে। সে দানব রক্তমাংসের হোক কি খানিক ধোঁয়াই হোক, তার সন্ধান না নিয়ে আমি ফিরব
না বলে ঠিক করেছিলাম।
আগেই দিনের বেলা এসে
ধ্বংসস্তূপটাকে তন্নতন্ন করে ঘুরে দেখে গেছি। ফলে ওর কোথায় কী আছে সে আমি নিজের
হাতের তেলোটার মতোই চিনি তখন। স্থানীয় গালগল্পে এ-বাড়ির জাঁ মার্টেনস-এর
হত্যাকাণ্ডের কথা বেশ কুখ্যাত। অতএব প্রাসাদে পৌঁছে তার ঘরটাতেই থানা দিলাম আমরা।
কেমন যেন মনে হচ্ছিল রাতে কিছু ঘটবার হলে ওখানটাতেই সেটা ঘটবে।
প্রাসাদের দোতলার দক্ষিণ-পুব
কোনায় দাঁড়িয়ে থাকা এই ঘরটা আয়তনে মোটামুটি দুশো স্কোয়ার ফুট। প্রাসাদের আর দশটা
ঘরের মতোই ওর মধ্যেও পুরোনো কিছু আসবাবের ভাঙাচোরা টুকরো ছড়িয়ে আছে। ঘরের পুবদিকে
একটা বিরাট জানালা। দক্ষিণের দেয়ালেও জানালা একটা আছে বটে, তবে সেটা তুলনায় ছোটো।
কোনও জানালাতেই কোনও গরাদ বা কপাটের বালাই নেই। পুবের জানালার ঠিক উলটোদিকে দেয়ালের
গায়ে একটা ফায়ার প্লেস। ওর ভেতর দিয়ে বেসমেন্ট থেকে ঘর গরম করবার চুল্লির পাইপ উঠে
গেছে। তার টাইলগুলোতে প্যারাবল-এর সেই ‘প্রডিগ্যাল সন’ গল্পটার ইঙ্গিত। দক্ষিণের
জানালার উলটোদিকের দেয়ালে একটা চওড়া খাট।
রাত গভীর হচ্ছিল। বাইরে ঝড়
উঠেছে। গাছাগাছালির ফাঁক দিয়ে দূরে দূরে বাজ পড়বার শব্দগুলো ক্রমশ জোর হয়ে উঠছিল। বুঝতে
পারছিলাম, সময় এগিয়ে আসছে। এইবার তাড়াতাড়ি প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম। দরকারি জিনিসপত্র
আগে থেকেই গুছিয়ে রাখা ছিল। পুবের জানালা দিয়ে তিনটে দড়ির মই পাশাপাশি ঝুলিয়ে
দিলাম প্রথমে। তলার ঘাসজমিতে যে জায়গাটায় তারা গিয়ে মাটি ছুঁয়েছে সেটা আগে থেকেই
দেখে রেখেছি। তারপর তিনজন মিলে আরেকটা ঘর থেকে একটা ভারী খাট টেনে এনে জানালাটার
সামনে আড়াআড়ি ঠেকনা দিয়ে রাখা হল। সেটার ওপরে ফারগাছের বড়ো বড়ো পাতাওয়ালা কয়েকটা ডাল
ছড়িয়ে দিয়ে তার ফাঁকে ফাঁকে তিনজন বসে অপেক্ষা শুরু হল। তিনজনের হাতেই অটোমেটিক
বন্দুক। ঠিক হল, এক একজন পালা করে একঘন্টা মতন পাহারা দেবে, আর অন্য দু’জন সেই
ফাঁকে খানিক বিশ্রাম নিয়ে নেবে। সত্যিই যদি ভয়ংকর কিছু একটা উদয় হয় তাহলে দু’দিকেই
পালাবার রাস্তা আমাদের তৈরি। সে যদি জানালা দিয়ে আসে তাহলে দরজা বেয়ে সিঁড়ি দিয়ে
ছুট দেয়া যাবে। আর দরজা দিয়ে এলে জানালার দড়ির মই তো রইলই। আগেকার যত ঘটনা শোনা
গেছে তাতে একটা ভরসা ছিল, পালালে পরে পেছন থেকে তাড়া হয়তো সে আমাদের করবে না। সেটা
তার স্বভাব নয়।
রাত বারোটা থেকে একটা অবধি
আমার জাগবার পালা। আশ্চর্য ব্যাপার হল, অমন ভয়ানক একটা বাড়িতে, ওই নিশুত রাত্রে,
একটা পাল্লাহীন বিরাট জানালার ধারে বসে ঝোড়ো মেঘের ধেয়ে আসা দেখতে দেখতেও আমার খুব
ঝিমুনি আসছিল সেই সময়টা। আমি বসেছিলাম বন্ধু দু’জনের মাঝখানে। একপাশে
জানালার দিকে রয়েছে জর্জ বেনেট। রাত একটায় আমার পালা যখন শেষ হল তখন সে ঘুমিয়ে
একেবারে কাদা। আমার অন্যপাশে, ঘরের ভেতরের দিকটায়, ফায়ার প্লেসের দিকে মুখ করে বসেছিল
টোবি। সেও ঢুলছিল বসে বসে। তবুও বেনেটের মতো নিঃসাড়ে ঘুমোচ্ছিল না বলে ঠিক করলাম
আমার পর পাহারার কাজটা সে-ই নেবে।
ক্রমাগত বেড়ে ওঠা বাজের শব্দ
ঘুমের ভেতর আমার মনের ওপর সম্ভবত কিছু ছাপ ফেলছিল। কারণ, গোটা সময়টা আমার স্বপ্নে
ভেসে উঠছিল অদেখা কোনও মহাপ্রলয়ের ছবি আর কানফাটানো সব শব্দ। মাঝে একবার সামান্য ক্ষণের
জন্য ঘুমটা ভেঙেছিল আমার। ভেঙেছিল বুকের ওপর ঘুমন্ত বেনেটের একটা হাতের অস্থির
আঘাতে। যেটুকু সময় চোখ খুলেছিলাম, তার ভেতর টোবি ঠিকঠাক পাহারা দিচ্ছে কি না সেটা
দেখবার সুযোগ হয়নি আমার। শুধু ফায়ার প্লেসটার দিকে একনজর চোখ ফেলে একটা তীব্র ভয়
জেগে উঠেছিল এইটুকুই জানি। আর জানি, কাছাকাছি অশুভ কোনও অস্তিত্বের উপস্থিতির আভাস
সেই মুহূর্তগুলোর মতো তীব্রভাবে আমার মনের ভেতর পাকিয়ে ওঠেনি আগে কখনও।
কয়েক মুহূর্ত ওভাবে জেগে
থাকবার পর সম্ভবত ফের ঘুমিয়েই পড়েছিলাম আমি। কারণ, রক্ত জমানো চিৎকারগুলো শুরু হতে
যখন লাফিয়ে উঠেছিলাম, তাঁর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত দুঃস্বপ্নগুলোর টুকরো টুকরো ছবিই
ঘিরে ছিল আমায়।
চিৎকারের শব্দগুলো আস্তে
আস্তে বাড়ির নিচের বেসমেন্টের দিকে হারিয়ে যাচ্ছিল। নিবিড় অন্ধকারের মধ্যে সামনে
হাত চালিয়ে টের পেলাম টোবি আর সেখানে বসে নেই। অন্ধকারে কোথায় হারিয়ে গেছে সে কে
জানে। আমার বুকের ওপর তখন ছড়িয়ে ছিল একটা ভারী হাত। সম্ভবত তা ঘুমন্ত বেনেটেরই হাত
হবে।
আর তারপর এল সেই বজ্রপাতের
মুহূর্ত। তার আকস্মিক, ভয়ানক আঘাতে গোটা পাহাড়টাই কেঁপে উঠল যেন থরথর করে। জানালার
বাইরে একটা প্রাচীন ওক তার আঘাতে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে ফেটে পড়ল যেন চারপাশে।
বাজটা পড়বার সঙ্গে সঙ্গে যেন বেনেটই
খাড়া হয়ে উঠে দাঁড়াল আমার পেছনে। জানালার বাইরে জ্বলন্ত গাছের লালচে আলোয় তার অতিকায়
ছায়াটা এসে পড়ছিল উলটোদিকের ফায়ার প্লেসের চিমনির গায়ে।
হঠাৎ সেই ছায়াটার দিকে ভালো
করে তাকিয়ে কেঁপে উঠেছিলাম আমি। না! ওটা বেনেটের ছায়া নয়। হতে পারে না। কোনও
মানুষের ছায়া ওরকম হয় না! ঠিক কেমন তার অপমানবিক চেহারা, তা কোনও মানুষের কলম
অক্ষরে লিখে বোঝাতে পারবে না। আর তার পরের মুহূর্তেই খেয়াল হল, আমি সেই জানালার
ধারে একেবারে একা। ছায়াটা উধাও। আর জর্জ বেনেটও কখন যেন নিঃশব্দে উধাও হয়েছে সেখান
থেকে।
বেনেট আর টোবিকে আর কখনও
খুঁজে পাওয়া যায়নি।
।।
দুই ।।
ঝড়ের রাতের অতিথি
সেই বিভীষিকার রাত্রির পর বেশ
ক’টা দিন লেফার্টস কর্নার নামের হোটেলটার একটা ঘরে কাটিয়ে দিয়েছিলাম আমি। কেমন করে
সে রাতে আমি ওই প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে আমার মোটরগাড়িটায়
পৌঁছেছিলাম, কেমন করেই বা তাতে স্টার্ট দিয়ে গ্রামে ফিরে সবার নজর এড়িয়ে হোটেলে
গিয়ে উঠেছিলাম সে আমি নিজেও জানি না। ওখান থেকে বের হবার পর থেকে হোটেলে ফিরে আসা
অবধি সময়টায় যা মনে আছে তা হল ঝড়ে মাথা দোলানো দৈত্যাকার ঝুপসি গাছের দল, বাজের
শব্দ আর ছোটো ছোটো টিলাগুলোকে ঘিরে থাকা অন্ধকার রাত।
সেই ঘরে নিজেকে আটকে রেখে
ক্রমাগত ভয়ের আক্রমণে পঙ্গু হয়ে যেতে যেতেই আমার মনে হয়েছিল, পৃথিবীর বুকে যত
অজানা আতঙ্কের অস্তিত্ব আছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর কোনও একজনকে আমি দেখেছি সে
রাত্রে। সে এই পৃথিবীর কেউ নয়। হতে পারে না। জীবজগতের ঊর্ধ্বতনের কোনও ধাপই অমন
ভয়াল কোনও অস্তিত্বের জন্ম দেয়নি এই গ্রহের বুকে। যে ছায়াটা আমি দেখেছিলাম, তাকে
বিশ্লেষণ করবার সাহসটুকুও আমার অবশিষ্ট ছিল না। আমার আর পেছনের জানালাটার মধ্যে
কিছু একটা এসেছিল। সে বেনেট নয়। যদি সে কোনও শব্দ করত, অন্তত যদি গরগর করে উঠত বা
হুঙ্কার দিত, নিদেন একটু হাসতও তা হলেও হয়তো আর ততটা ভয়ংকর ঠেকত না তাকে। কিন্তু
সে একেবারে নিঃশব্দে এসেছিল। একটা ভারী হাত
রেখেছিল আমার বুকে।
তবে হ্যাঁ। জিনিসটা বায়বীয়
নয়। নিতান্তই জৈব। ওই ছোঁয়াটাই তার প্রমাণ। যাঁর ঘরে আমরা গিয়ে বসেছিলাম, সেই জাঁ
মার্টেনসকে বাড়ির কাছেরই একটা কবরে সমাধিস্থ করা হয়। অদৃশ্য তিনি হয়ে যাননি। অথচ
টোবি আর বেনেট...
না। আমাকে খুঁজে দেখতে হবে।
কোথায় হারিয়ে গেল তারা... ভাবতে ভাবতে কখনও চোখদুটো জুড়ে এলেই আমার নিঃশ্বাস বন্ধ
হয়ে আসছিল। বড়ো ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের দল যেন আমার ঘুমিয়ে পড়বার অপেক্ষায় রয়েছে!
দুয়েকদিন এইভাবে কাটাবার পরে
আমি ঠিক করলাম, এ-রহস্যের শেষ না দেখে এখান থেকে কিছুতেই পালাব না আমি। মূর্খের
মতো ভেবেছিলাম, এক রাত্রের মধ্যে দু-দুটো জোয়ানকে উধাও করে দিতে পারে যে বস্তু,
তাকে খুঁজে বের করে, তার আসল পরিচয় জানা প্রয়োজন। যত ভয়ংকরই সে হোক না কেন, অজানা
আতঙ্কের চাইতে তা কম ভয়াল হবে।
তবে একা তা করা যাবে না।
সঙ্গী চাই একজন। ব্যাপারটা অন্তত আর একজন কাউকে জানাতে হবে। তাছাড়া তখন আমার এমন
অবস্থা যে কাউকে বলে একটু হালকা না হলে উন্মাদ হয়ে যাব বলে ভয় হচ্ছিল।
ভেবেচিন্তে অবশেষে লেফার্ট-এ
তখনও টিকে যাওয়া সাংবাদিকদের একজনকে বেছে নিলাম বিষয়টা জানাবার জন্য। ভদ্রলোকের
নাম আর্থার মুনরো। বছর পঁয়ত্রিশ বয়েস। রোদপোড়া চামড়া, রোগাটে গড়ন। ভদ্রলোকের
শিক্ষাদীক্ষা বা রুচির যেটুকু পরিচয় পেয়েছি তাতে এধরনের অদ্ভুত বিষয়ে তাঁর আগ্রহ
অন্যদের চাইতে কিছু বেশি বলেই আমার ধারণা হয়েছিল।
সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকের
একটা বিকেলে মুনরোকে ডেকে আমার গল্পটা শোনালাম। শুরু
থেকেই তার হাবভাব দেখে বুঝতে পাচ্ছিলাম, বিষয়টায় তার আগ্রহ রয়েছে। গল্প শেষ হলে সে
গোটা ঘটনাটাকে বেশ তীক্ষ্ণ আর বুদ্ধিদীপ্তভাবে বিশ্লেষণ করল। তারপর যে পরামর্শটা
সে দিল সেইটিও একেবারে বাস্তববোধ যুক্ত। তার মতে জায়গাটার ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক
বিষয়ে আরও গভীরভাবে না জানা অবধি মার্টেনস প্রাসাদে পরের অভিযানটা স্থগিত রাখাই
উচিত।
তারপর তারই উদ্যোগে আমরা গোটা
অঞ্চলটা ঘুরেফিরে মার্টেনস পরিবারের বিষয়ে যেখানে যা তথ্য পাওয়া যায় তা একত্র
করবার কাজ শুরু করে দিলাম। আর এই অনুসন্ধান করতে গিয়েই গ্রামের একজন বাসিন্দার
থেকে আমাদের হাতে এসেছিল সে পরিবারের একটা প্রাচীন ডায়েরি।
ঝড়পাহাড়ের সেই ভয়ংকর ঘটনার পর
সেখানকার আধবুনোদের অনেকেই এলাকা ছেড়ে পালিয়েছিল। যে সামান্য কিছু বাসিন্দা তখনও
তার ঢালগুলোতে টিকে ছিল, তাদের সঙ্গেও কথাবার্তা বলে জায়গাটার বিষয়ে একটা ভালো মতন
আন্দাজ গড়ে তুললাম আমরা। এরপর শুরু হল অভিযানের আগের শেষ প্রস্তুতির পালা।
ডায়েরিতে পাওয়া তার ইতিহাসের ভিত্তিতে মার্টেনস প্রাসাদের খুঁটিনাটি তদন্ত। এরই
পাশাপাশি আধবুনোদের গল্পকথায় তাদের গ্রামগুলোর যেখানে যেখানে এই দানব-সম্পর্কিত
দুর্ঘটনার খবর আছে সেগুলোর বিষয়েও বিশদ অনুসন্ধান শেষ করা হল।
শুরুতে এই খোঁজখবর থেকে নতুন
কিছু বিশেষ জানা যায়নি। কিন্তু তারপর আস্তে আস্তে সমস্ত তথ্যকে খাতায় সাজাতে তার
থেকে একটা সুনির্দিষ্ট নকশা দেখা দিতে শুরু করল। দেখা গেল, প্রাসাদের কাছাকাছি
এলাকাগুলোতে আক্রমণের হার বেশি। আর প্রত্যেকটা ঘটনাস্থল আর প্রাসাদের মধ্যে ঘন
অরণ্যের কোনও না কোনও একটা এলাকা এমনভাবে থাকছে যাতে প্রাসাদ থেকে সেখানে পৌঁছোতে
অরণ্যের ঘেরাটোপ ছেড়ে বাইরে আসতে হয় না। ব্যতিক্রম অবশ্যই ছিল। শেষ যে আক্রমণটায়
অতগুলো প্রাণ চলে গেল, সেটাই তো ঘটেছিল একটা ন্যাড়া এলাকায়।
তবে বস্তুটার চেহারা নিয়ে কোনও
বিশ্বাসযোগ্য বিবরণ আমরা কোথাও পাইনি। কেউ তাকে বলেছে একটা অতিকায় সাপের মতো, আবার
পরক্ষণেই বলেছে, ও একটা দানব। কারও মতে সে স্বয়ং বজ্রধারী শয়তান, আবার কেউ দাবি
করে বিশাল কোনও বাদুড়ের মতো দেখতে সেই শয়তানকে। এমনকি, দেখা গিয়েছিল, শকুন বা
চলন্ত গাছের মতো চেহারার বিবরণও দিয়েছেন কেউ কেউ।
তবে চেহারার সুনির্দিষ্ট কোনও
বিবরণ না পেলেও একটা অনুমান আমরা করছিলাম, জিনিসটা এমন কোনও প্রাণী যার ওপর
বৈদ্যুতিক ঝড়ঝঞ্ঝার গভীর প্রভাব আছে। যদিও কেউ কেউ তাকে উড়ুক্কু জীব বলে দাবি
করেছিল, কিন্তু সে তত্ত্বকে আমরা কল্পনা বলেই বাদ দিয়েছিলাম। তা না হলে তার
যাতায়াতগুলোর বেশিরভাগ শুধুমাত্র জঙ্গুলে রাস্তায় ঘটবার আর কোনও কারণ ছিল না। তবে
বিভিন্ন আক্রমণস্থলগুলোর থেকে প্রাসাদের দূরত্ব আর জীবটার আবির্ভাব ও অন্তর্ধানের
মধ্যেকার সময়ের তফাতগুলো মিলিয়ে এই জমি দিয়ে চলাচলের তত্ত্বটা খানিক দুর্বল হয়ে
পড়ছিল তাও বটে। কারণ, হিসেবগুলো ঠিক থাকলে তার ছোটবার গতি অকল্পনীয়রকম দ্রুত হতে
হয়।
এই অনুসন্ধানের কাজটা করতে
করতেই আধবুনোদের সঙ্গে পরিচয় খানিক ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছিল আমাদের। দেখতে পাচ্ছিলাম, এরা
আসলে লোক বড়ো ভালো। শুধুমাত্র পরিবেশের কারণে আস্তে আস্তে সভ্যতার ভিত দুর্বল হয়ে
পড়ছে তাদের সমাজের।
বাইরের দুনিয়ার মানুষজনকে বড়ো
ভয় তাদের। তবে বারবার তাদের মধ্যে যাওয়া-আসা করবার ফলে আস্তে আস্তে আমাদের বিষয়ে
সেই ভয় তারা কাটিয়ে উঠছিল। আর তারপর, যখন প্রাসাদের চারপাশের সব ঝোপঝাড় ঘেঁটে, তার
ভেতরের ইট-কাঠ উপড়ে আমরা তন্নতন্ন করে খোঁজ শুরু করলাম তখন দেখি তারা নিজে থেকেই
এগিয়ে এসেছে সে-কাজে হাত লাগাতে। বেনেট আর
টোবির কথা তাদের বলেছিলাম আমরা। বলেছিলাম, ওদের খুঁজে বের করবার জন্য তাদের সাহায্য
আমাদের দরকার। শুনে তারা ভারি দুঃখ পেয়েছিল। কারণ তারা আমাদের সাহায্য করতে চায়,
কিন্তু তারা এও জানে, শত চেষ্টাতেও বেনেট আর টোবিকে কখনও খুঁজে পাওয়া যাবে না আর।
তাদের বিশ্বাস, ওই ভয়ংকরের হাতে প্রাণ দেয়া তাদের অজস্র আত্মীয়পরিজনদের মতোই ওই দু’জনও
একেবারে এই দুনিয়ার বার হয়ে গেছে।
অক্টোবরের মাঝামাঝি দেখা গেল
আমাদের আসল কাজ বিশেষ এগোয়নি। এ সময়টা ঝড়বৃষ্টি হয় না বিশেষ। আকাশ
সাধারণত পরিষ্কার থাকে। ফলে দানবের আক্রমণও খুব একটা ঘটে না। তার ওপর বেশ কিছুদিন
ধরে ওই প্রাসাদে তন্নতন্ন করে খুঁজে সামান্যতম সূত্রও না পেয়ে তখন আমরা আস্তে
আস্তে হাল ছেড়ে দিতে বসেছি। ভয় হচ্ছিল, শীতের মরসুম এসে এইবার আমাদের অনুসন্ধানে
একটা লম্বা বিরতি টেনে দেবে বুঝি।
ফলে শেষের সেই দিনটায় যখন
আমরা আধবুনোদের সেই নামহীন গ্রামে এসে পৌঁছেছিলাম আরও কিছু অনুসন্ধানের জন্য, সেই
দিনটা আমাদের মনে একটু হতাশাই কাজ করছিল। এই গ্রামটাতেই দানবের শেষ ভয়ানক আক্রমণটা
ঘটেছিল। তার পর সেখান থেকে তার বাসিন্দারা সবাই চলে গেছে। শঙ্কুপাহাড় আর ম্যাপল
টিলা নামে দুটো টিলার মাঝখানে একটুকরো ফাঁকা জমিতে তার অবস্থান।
ম্যাপল টিলার কাছ ঘেঁষে। কিছু কিছু বাড়ি তো ম্যাপল টিলার গায়ে খোঁড়া গর্ত একেকটা।
জায়গাটা ঝড়পাহাড়ের পাদদেশ
থেকে দু’মাইল উত্তর-পশ্চিমে আর মার্টেনস প্রাসাদ থেকে তার দূরত্ব মোটামুটি মাইল তিনেক।
তার ভেতর প্রায় সোয়া দু’মাইল জায়গা একেবারে ন্যাড়া। ছোটোখাটো কয়েকটা সাপের মতো
প্যাঁচালো ঢিবি বাদে সে জায়গাটা মোটামুটি সমতল বলা যায়। ঘাসজমি আর ছোটোখাটো ঝোপঝাড়
ছাড়া সেখানে আর কোনও গাছপালা নেই। জায়গাটার তদন্ত করে আমাদের বিশ্বাস হয়েছিল,
এখানে দানব হানা দিয়েছিল ওই শঙ্কুপর্বতের দিক থেকে। কারণ, ওর দক্ষিণদিক থেকে ফের
একটা জঙ্গুলে এলাকা পাক খেয়ে ঘুরে গিয়েছে ঝড়পাহাড়ের পশ্চিমপ্রান্তের কাছাকাছি
এলাকা পর্যন্ত। গ্রামটার যে ঘরবাড়িগুলো ধ্বস নেমে হারিয়ে গিয়েছিল বলে আগেই বলেছি,
দেখা যাচ্ছিল, সে ধ্বসটা নেমেছে ম্যাপল টিলা থেকে। ধ্বসের জায়গাটার একেবারে পাশে
একটা বাজ-পোড়া গাছ সাক্ষী দিচ্ছিল, হত্যার সেই রাত্রে তার মাথায় নেমে আসা আকাশের
আগুনই ডেকে এনেছিল দানবকে।
জায়গাটা অন্তত বিশ বার তন্নতন্ন
করে দেখবার পর একটা হালকা ভয়ের ছোঁয়া লাগছিল আমাদের দু’জনের মনে। এত বড়ো একটা ঘটনা
যেখানে ঘটে গেল, সেখানে তার একটা সামান্য সূত্রও থাকবে না? তবুও ধীরে ধীরে অন্ধকার
হয়ে আসা মেঘলা আকাশের নিচে আমরা উদ্দেশ্যহীনভাবে সেই ধ্বংসস্তূপের বুকে ঘুরে
বেড়াচ্ছিলাম, যদি কোনও সূত্র মেলে। প্রত্যেকটা কুঁড়ের ধ্বংসস্তূপে ফের ঢুকে
দেখছিলাম আমরা। ম্যাপল টিলার গায়ে খুঁড়ে বানানো গর্ত বাসাগুলোর একটাতেও ঢুকতে বাদ
দিচ্ছিলাম না। কিন্তু তাতে ফল হচ্ছিল না কোনও। হারিয়ে
যাওয়া শরীরগুলোর সামান্যতম চিহ্নও নেই কোথাও। আর সেই সঙ্গে হতাশার পাশাপাশি একটা
নামহীন ভয় সেই পাহাড়দের চূড়া থেকে যেন শকুনের মতো ডানা ছড়িয়ে দিচ্ছিল আমাদের মনে।
বিকেল ধীরে ধীরে সন্ধের দিকে
এগোচ্ছিল। ঘনিয়ে আসা অন্ধকারে বেশি দূর চোখ চলে না। ঝড়পাহাড়ের মাথায় জমে ওঠা মেঘের
দল গুরু গুরু শব্দ তুলছিল। রাতের অন্ধকারে সে শব্দ বুকে যতটা ধাক্কা দেবে ততটা না
হলেও সে শব্দ শুনে খানিক বুক দুরুদুরু করছিল বৈকি! তবে যতই বুক দুরুদুরু করুক, মনে
মনে আমরা চাইছিলাম ঝড়টা দিন থাকতেই শুরু যদি হয়েও যায় তাহলেও খানিক রাত অবধি যেন
চলে। সেই আশায় বুক বেঁধে আমরা এলোমেলো ঘুরে বেড়ানো বন্ধ করে কাছাকাছি আধবুনোদের
একটা গ্রামে গিয়ে উঠলাম রাতের জন্য কিছু লোক জড়ো করবার মতলবে। লোকগুলো
ভীতু। তবুও তাদের মধ্যে থেকে গুটিকয়েক কমবয়েসি ছোকরা আমাদের অভয় পেয়ে এসে সঙ্গে
জুটল।
তাদের সঙ্গে নিয়ে রওনা হয়ে
ধ্বংস হওয়া গ্রামটায় ফের পৌঁছোতে না পৌঁছোতেই নামল আকাশভাঙা বৃষ্টি। সে বৃষ্টিতে
কোথাও একটা মাথা না গুঁজে থাকবার উপায় নেই। আকাশে তখন অকালে
ঘন অন্ধকার নেমে এসেছে। তবুও গোটা এলাকাটা তদ্দিনে হাতের তেলোর মতো চেনা হয়ে
যাওয়ায়, ঘন ঘন বিদ্যুৎঝলকের আলোয় গ্রামের অলিগলি বেয়ে তুলনায় শক্তপোক্ত একটা কুঁড়ে
খুঁজে নিতে খুব একটা অসুবিধে হল না। এবড়োখেবড়ো কাঠের গুঁড়ি আর পাটাতন দিয়ে তৈরি
ঘরটার দরজাটা তখনও টিকে আছে। আর আছে দরজার পাশে খুপরিমতো একখানা জানালা। দুটোই
ম্যাপল টিলার দিকে মুখ করা।
বাইরে তখন বৃষ্টির সঙ্গে
সঙ্গে হাওয়ার তেজ ভয়ানক বেড়ে উঠেছে। ভেতরে ঢুকে এসে দরজাটা আঁটোসাঁটো করে বন্ধ করে
দেয়া হল প্রথমে। জানালা আগলাবার পাল্লা এরা ঘরের কোথায় রাখে তার একটা ধারণা আগেই
থাকতেই ছিল। ফলে এখানেও সেইটে খুঁজেপেতে এনে জানালাটাকে ঢাকতে অসুবিধে হল না কোনও।
এরপর ঘুটঘুটে অন্ধকারের ভেতর
সেই ঘরের মধ্যে বসে আমাদের অপেক্ষা শুরু হল। মাঝেমাঝে পাইপের আগুনের হলকা, দেয়ালের
কাঠের গুঁড়িদের ফাঁক দিয়ে বাইরের বিদ্যুতের ঝলক আর সঙ্গে করে নিয়ে আসা ফ্ল্যাশ লাইটগুলোর
ইতিউতি আলো তখন সেই অন্ধকারে আমাদের সম্বল।
বসে থাকতে থাকতেই বারংবার
ঝড়পাহাড়ের মাথায় সেই রাতটার কথা মনে পড়ে আমার বুক কেঁপে উঠছিল। একটা প্রশ্ন বারবার
পাক খেয়ে উঠছিল আমার মনে, সে রাতে রাক্ষসটা কেন প্রথমে বাঁয়ে আর ডানে বসা দুটো
মানুষকে আক্রমণ করল? মাঝের জনকে কেন শেষমুহূর্তের জন্য ছেড়ে রেখেছিল সে? কেন সে
তাদের পরপর আক্রমণ করেনি? যেদিক থেকেই সে হানা দিক না কেন, আমার তো তার দ্বিতীয়
শিকার হবার কথা। ঠিক কোন পদ্ধতিতে আক্রমণটাকে সাজিয়েছিল সে? নাকি
আমি যে খোঁজারু দলটার নেতা সেটা অনুমান করেই আমাকে সে বাঁচিয়ে রেখেছিল একেবারে
শেষে আরও ভয়ংকর কিছু পরিণতি উপহার দেবার জন্য? যদি ঠিক সময়ে সেই প্রলয়ঙ্কর বাজটা
তাকে ভয় দেখিয়ে না তাড়াত তাহলে হয়তো আমাকেও...
এইসব এলোমেলো দুশ্চিন্তার
মধ্যেই হঠাৎ কাছাকাছি একটা বাজ পড়বার শব্দ উঠল। আর সেই শব্দের সঙ্গে সঙ্গেই উঠল
প্রবল বেগে খসে পড়া মাটির স্তূপের আওয়াজ। ছুটন্ত,
উদ্দাম বাতাস যেন নেকড়ের পালের মতো সুর তুলেছে তখন আমাদের কুঁড়েটাকে ঘিরে।
আওয়াজটার গতিপ্রকৃতি অনুসরণ
করে আমরা ততক্ষণে নিশ্চিত যে ফের একবার ম্যাপল টিলার মাথার একলা গাছটাকেই ঘা
মেরেছে আকাশছেঁড়া বিদ্যুতের স্রোত। মুনরো তাড়াতাড়ি উঠে এসে জানালার ঢাকনা সরিয়ে
বাইরের দিকে চোখ রাখল যদি ব্যাপারটা যাচাই করে নেয়া যায় সেই আশায়।
ঢাকনাটা সরাতেই বাতাস আর
বৃষ্টির একটা দমকা সশব্দে ভেতরে ঢুকে এসে কানে তালা লাগিয়ে দিল আমাদের। শব্দের সেই
তাণ্ডবের ভেতর মুনরো কী বলছে তার কিছুই আর কানে যাচ্ছিল না আমার। শুধু দেখতে
পাচ্ছিলাম, জানালাটা খুলে সে শরীরটা বাইরের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে প্রকৃতির সেই
তাণ্ডবের মধ্যেও যদি কিছু নজরে আসে সেই আশায়।
ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসছিল
বাতাস। ঘন অন্ধকারটাও কেটে যাচ্ছিল একটু একটু করে। বুঝতে পারছিলাম, ঝড় থেমে আসছে। খানিক
বাদে রাত অবধি ঝড় চলবার আশায় ছাই দিয়ে দেয়ালের ফাঁক দিয়ে একটুকরো রোদ এসে লুকোচুরি
খেলা শুরু করল আমাদের সঙ্গে। আমি উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে দিতে ভেতরে খানিক আলো এল।
বাইরে তখন সবকিছু একেবারে
লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। খানিক আগে হয়ে যাওয়া ছোটোখাটো ধ্বসটার কল্যাণে গোটা এলাকাটায়
থক থক করছে স্তূপ স্তূপ কাদা আর তার ভেতর ইতিউতি কয়েকটা জলের কুণ্ডি। অথচ মুনরো
তখনও খানিক দূরে জানালা দিয়ে শরীরের অর্ধেকটা বাইরের দিকে ঝুঁকিয়ে স্থির হয়ে
রয়েছে। অথচ জলকাদার ওই থই থই নরকে বিশেষ কোনও কিছু দেখবার আছে বলে আমার মনে হচ্ছিল
না। তাহলে এত আগ্রহ নিয়ে ও দেখছেটা কী? আস্তে আস্তে কাছে এগিয়ে গিয়ে আমি মুনরোর
কাঁধটা ধরে নাড়া দিলাম। সে নড়ল না। এইবার কাঁধ দুটো ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে তাকে
আমার দিকে ঘুরিয়ে ধরেই পেটের ভেতরটা গুলিয়ে উঠল আমার। দৃশ্যটা সাক্ষাৎ নরক থেকে
উঠে আসা একটা ছবি যেন। মুনরো মারা গেছে। তার চিবোনো
আর খুবলে খাওয়া মাথাটায় মুখ বলে কিছু অবশিষ্ট ছিল না।
।। তিন ।।
লালচে আভার অর্থ
নভেম্বর ৮, ১৯২১। তীব্র ঝড়ের
সেই রাত্রে একটা মিটমিটে লণ্ঠন সম্বল করে আমি, একলা একলা, মূর্খের মতো জাঁ
মার্টেনস-এর কবরটা খুঁড়ে চলেছিলাম। বিকেলবেলা, ঝড় আসবার উপক্রম হতেই আমি খোঁড়া
শুরু করেছিলাম। এখন অন্ধকার নেমে এসেছে। মাথার ওপর গাছপালার ঘন আবরণের ওপারে তীব্র
ঝড় উঠেছে। আমি একটা অসুস্থ উন্মাদনায় ভর করে কবরটা প্রাণপণে খুঁড়ে চলেছি তখন।
অক্টোবরের সেই বিকেলের পর
মুনরোর শরীরটাকে আমি কবর দিয়ে দিয়েছিলাম ওই পাহাড়েরই বুকে। আধবুনোদের সতর্ক করে
দিয়েছিলাম, বাইরের কাউকে যেন তারা কিছু না বলে। তার মৃত্যুটার অর্থ আমি বুঝিনি।
আমি জানতাম, বাইরের দুনিয়ার অন্য মানুষজনও ওর মানে বুঝবে না। তাদের আমি বলেছিলাম সেই
ঝড়ের রাতে মুনরো পাহাড়ের বুকে কোথাও হারিয়ে গিয়েছে।
অনেক খোঁজাখুঁজি করেছে তারা। বলাবাহুল্য তাতে কোনও ফল হয়নি। হয়তো আমার সঙ্গে সেদিন
সেই কুঁড়েতে হাজির থাকা বুনোগুলো কিছু কিছু বুঝেছিল। কিন্তু তাতে আর কী যায় আসে।
তারা তো আর বাইরের দুনিয়ায় সেসব কাউকে বোঝাতে আসছে না!
আমার মনে কিন্তু ঐ মৃত্যুটা
কোনও স্থায়ী দাগ কাটতে পারেনি। প্রাসাদের ওই রাতটার পর থেকেই অনুভূতিগুলো কেমন যেন
ভোঁতা হয়ে গিয়েছিল আমার। একটাই আবেগ শুধু অবশিষ্ট ছিল সেখানে। যে ভয়ংকরের আভাস আমি
দু-দুবার পেয়েছি, তার রহস্যটাকে খুঁজে বের করবার তীব্র একটা আত্মধ্বংসী নেশা। প্রথমে
বেনেট আর টোবির ওভাবে হারিয়ে যাওয়া, আর তারপর আর্থার মুনরোর অমন করুণ মৃত্যুর পর
সে-নেশার কথা আর কারও সঙ্গে ভাগ করে নেব না বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আমি। ফলে তখন
সে একেবারে আমার একার প্যাশন।
যে জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আমি
কবরটা খুঁড়ছিলাম, সেখানকার দৃশ্যটাই যে কোনও সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের স্নায়ুবিকার
ঘটিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট। আমার চারপাশে প্রাচীন বৃক্ষরাজদের এবড়োখেবড়ো অন্ধকার শরীর;
প্রাগৈতিহাসিক কোনও শয়তানের মন্দিরের স্তম্ভদের মতো আকাশের দিকে উঠে গেছে তারা। বাইরের
তীব্র ঝড়, বাজের শব্দ কিংবা অঝোর বৃষ্টির সামান্যই তাদের পত্রমুকুটদের ফাঁক দিয়ে নিচে
এসে পৌঁছোয়। চুঁইয়ে আসা বিদ্যুতের আবছা আলোয় গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে প্রাসাদের আইভি
ছাওয়া দেয়াল নজরে আসে। আমার পায়ের নিচে, স্যাঁতসেঁতে, ফুলে
ওঠা পচাটে ছত্রাকের ভিড়। গাছের শেকড়ের ধাক্কায় উপড়ে আসা সমাধিপাথরগুলোর ফাঁক দিয়ে
তার নিচের মাটির বিষাক্ত রস তারা শুষে চলেছে ক্রমাগত। তারই মধ্যে মধ্যে বিদ্যুতের
আবছা আলোয় তখনও দাঁড়িয়ে থাকা দুয়েকটা সমাধিফলকের চেহারা দেখা যায়।
ইতিহাসের পাঠ আমাকে তখন সেই
কবরখানায় এনে ফেলেছে। হ্যাঁ, ইতিহাস। পর্যবেক্ষণ, কৌশল, অভিযান... এই সবকিছুকেই তো
অদেখা ওই রাক্ষসের শয়তানি রসিকতা ব্যর্থ করে দিয়েছে। সে-পথ ছেড়ে তাই এরপর আমি মন
দিয়েছিলাম ইতিহাসের অনুসন্ধানে। আর্থার মুনরোর সঙ্গে কাজ করবার সময় স্থানীয় ইতিহাস
জোগাড় হয়েছিল অনেক। জোগাড় করা গিয়েছিল বেশ কিছু নথিপত্রও। সেগুলো খুঁটিয়ে দেখে,
বিশ্লেষণ করে তখন একটা বিশ্বাস আমার মাথায় বাসা বেঁধেছে। ও-রাক্ষস কোনও দেহধারী
জন্তু নয়। মাঝরাতের বজ্রপাতে সওয়ার হয়ে আসা কোনও শয়তান অশরীরী ও। আর সে অশরীরী আর
কেউ নয়, ১৭৬২ সালে মারা যাওয়া স্বয়ং এই জাঁ মার্টেনস।
আর তাই আমি মূর্খের মতো তাঁর
কবরটাই খুঁড়ে চলেছিলাম তখন। খুঁড়তে খুঁড়তেই মনে মনে ফের একবার ঝালিয়ে নিচ্ছিলাম
এ-বাড়ির ইতিহাস। ১৬৭০ সালে জেরিট মার্টেনসের হাতে এই প্রাসাদের পত্তন। নয়া
আমস্টারডামের এই ধনী ব্যবসায়ী ইংরেজদের শাসনে মোটেই খুশি ছিলেন না। আর তাই, তাদের
রাজত্বের মূল স্রোত থেকে অনেক দূরের এই জঙ্গুলে পাহাড়ের মাথায় তাঁর এই প্রাসাদ
বানানো। এ জায়গাটার বুনো পরিবেশ তাঁর ভালো লেগেছিল। শুধু একটাই অস্বস্তির কারণ ছিল
তাঁর। সে হল এই ঝড়বৃষ্টি আর বজ্রপাতের উৎপাত। থাকতে শুরু করবার কিছুদিন বাদে সে
উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি একটা সেলার তৈরি করিয়ে নেন নিজের জন্য, যাতে ঝড় উঠলে সেখানে
গিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারেন।
জেরিটের উত্তরাধিকারীদের
বিষয়ে খুব বেশি কিছু জানা যায় না, কারণ ইংরেজ শাসকদের লোকালয়গুলোর সঙ্গে তাঁরা
কেউই বিশেষ কোনও যোগাযোগ রাখেননি। লোকজনের থেকে দূরে, একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে
বসবাস করতেন তাঁরা। লোকে বলে, ওর ফলে নাকি তাঁদের কথাবার্তাও ক্রমশ জড়ানো হয়ে
উঠেছিল। স্বাভাবিক বাক্যালাপ বিশেষ বুঝতেও পারতেন না নাকি। একটা
বংশানুক্রমিক বৈশিষ্ট্য এঁরা পুরুষানুক্রমে পেয়ে এসেছেন। এঁদের প্রত্যেকের একটা
চোখের মণি নীল, আর অন্যটার রঙ বাদামি।
আস্তে আস্তে বাইরের দুনিয়ার
সঙ্গে যোগাযোগ একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার পর মার্টেনসরা নিজেদের পরিবারের মধ্যে,
আর প্রাসাদের দাসদাসীদের সঙ্গে বিয়েশাদি করতে শুরু করে। পরিবারের কিছু সদস্য সেই
সূত্রেই আস্তে আস্তে পাহাড়ের নানান জায়গায় ছড়িয়ে থাকা বুনোদের সঙ্গে গিয়ে মিশে
যায়। তবে অধিকাংশ সদস্যই প্রাসাদে টিকে থেকেছিল এর পর। ক্রমেই নিজেদের আরও বেশি
বন্দি করে ফেলছিল তারা সেই প্রাসাদের জেলখানায়। ঝড়বৃষ্টি আর বাজ-বিদ্যুতের
ব্যাপারে পূর্বপুরুষ জেরিট-এর অস্বস্তিটা তারা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিল। সে অস্বস্তি
পুরুষানুক্রমে বদলে গিয়েছিল দুর্যোগের সময়গুলোয় তাদের মধ্যে দেখা দেয়া একটা
অস্বাভাবিক, অসুস্থ উত্তেজনায়।
জাঁ মার্টেনস অবশ্য এদের ভেতর
খানিক ব্যতিক্রমী মানুষ ছিলেন বলা যায়। আলবানি কনভেনশনের খবর ঝড়পাহাড়ে পৌঁছোবার পর
তিনি ঔপনিবেশিক সৈন্যদলে যোগ দেন। জেরিট
মার্টেনসের পর তিনিই প্রথম বাইরের দুনিয়াটাকে দেখেছিলেন খানিক। বছর ছয়েক সেনাদলে
কাজ করবার পর তিনি যখন ঝড়পাহাড়ে ফিরে এলেন তখন তাঁর উদ্ভট বাপ-কাকারা আর তাঁকে
নিজেদের একজন বলে মেনে নিতে রাজি নন। তিনি নিজেও তখন আর মার্টেনসদের উদ্ভট আচার-বিচার
মেনে নিতে পারেন না। ঝড়বৃষ্টির সময় তাঁদের মতো সেই অস্বাভাবিক স্নায়বিক উত্তেজনাও
আর দেখা দেয় না তাঁর মধ্যে।
এর ফলে যা হবার তাই হল। নিজের
পরিবারেই ব্রাত্য হয়ে গেলেন জাঁ মার্টেনস। মাঝেমাঝেই তখন তিনি আলবানিতে তাঁর এক
বন্ধুকে চিঠিতে লিখতেন, এ-বাড়ি ছেড়ে এবার তিনি পাকাপাকি অন্য কোথাও চলে যাবেন।
১৭৬৩ সালের বসন্তে লেখা একটা
চিঠি থেকে দেখা যাচ্ছে, জাঁ-এর আলবানির বন্ধু জোনাথন গিফোর্ড বেশ কিছুকাল বন্ধুর
চিঠিপত্র না পেয়ে খানিক উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন। প্রাসাদে জাঁকে নিয়ে অশান্তির খবর
তিনি জানেন বলেই আরও বেশি উদ্বিগ্ন হয়েছেন বলে জানাচ্ছেন তিনি। এরপর জাঁ-র সঙ্গে
দেখা করবার জন্য ভদ্রলোক ঘোড়ায় চড়ে সোজা প্রাসাদে চলে আসেন।
তাঁর ডায়েরি থেকে দেখা
যাচ্ছে, সেপ্টেম্বরের কুড়ি তারিখে তিনি ঝড়পাহাড়ে এসে পৌঁছোন। এসে দেখেন প্রাসাদের
একেবারেই ভগ্নদশা। দু’রকম চোখওয়ালা গোমড়ামুখো মার্টেনসের দল আর তাদের জন্তুর মতো
জীবনযাপন দেখে বেশ ধাক্কা খেয়েছিলেন তিনি। তারাই তাদের জড়ানো, প্রায় অবোধ্য ভাষায়
গিফোর্ডকে জানায়, জাঁ মার্টেনস মারা গেছেন। তাদের দাবি, আগের হেমন্তে বাজ পড়ে
মৃত্যু হয়েছে তার। বাড়ির পাশের বাগানের পেছনে কবরখানায় শায়িত আছে তার শরীর। তার
নিরাভরণ কবরটাও তারা গিফোর্ডকে নিয়ে গিয়ে দেখায়।
তবে মার্টেনসদের আচরণে এমন কিছু
একটা ছিল যে গিফোর্ডের সন্দেহ হয় তাতে। পরের সপ্তাহে তিনি আবার লোকজন নিয়ে ফিরে আসেন
মার্টেনসদের প্রাসাদে। কবরটা খুঁড়ে গিফোর্ড দেখেন ভুল সন্দেহ তিনি করেননি। সেখানে
শোয়ানো কঙ্কালটার খুলিটা গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছিল ভারী কোনও অস্ত্রের আঘাতে। এরপর
আলবানিতে ফিরে গিয়ে তিনি মার্টেনসদের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ জানান।
যদিও আইনসঙ্গত প্রমাণ বিশেষ
কিছু ছিল না, তবুও খবরটা চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছিল। মার্টেনসরা অতএব এবারে বাকি
দুনিয়ার কাছে একঘরে হয়ে পড়ল। কেউ তাদের সঙ্গে কোনও কাজকারবারে রাজি নয়। তাদের
প্রাসাদটাও অভিশপ্ত বলে গুজব চাউর হয়ে গেল চারদিকে।
তবে মার্টেনসরা তাতেও টিকে
রইল। রইল, হয়তো প্রাসাদ-সংলগ্ন জমিতে চাষ-আবাদের ফসলের ওপর নির্ভর করেই। দূর থেকে
পাহাড়ের মাথায় মাঝেমধ্যে আলোর ইশারা থেকে বাকি দুনিয়া টের পেত, তারা এখনও টিকে আছে
সেখানে। তবে কেউ কখনও সেখানে গিয়ে তাদের কোনও খোঁজখবর নিত না। শেষের দিকে বড়ো
অনিয়মিত হয়ে উঠেছিল ওই আলো। ১৮১০ সালে শেষবার দেখা দেবার পর মার্টেনস প্রাসাদের
বাতি চিরতরে নিভে যায়।
ততদিনে ওই পাহাড় আর প্রাসাদ
ঘিরে বিভিন্ন অশুভ উপকথা গড়ে উঠেছে। ফলে আলো নিভে গেলেও ১৮১৬ অবধি ভয়ে কেউ ওই
প্রাসাদের দিকে পা দেয়নি। ১৮১৬ সালে প্রথম পাহাড়ের ঢালে গড়ে ওঠা আধবুনোদের
গ্রামগুলো থেকে একটা দল সরেজমিনে তদন্ত করে দেখে আসে, ভাঙাচোরা, জনহীন প্রাসাদটা
পড়ে আছে শুধু পাহাড়ের মাথায়। তাতে শেষের দিকে গড়ে তোলা বড়ো বড়ো হলঘরগুলো থেকে
অনুমান করা যাচ্ছিল, মার্টেনসদের বংশবৃদ্ধি ভালোই চলছিল একসময়। অথচ সেখানে কোনও
কঙ্কাল-টঙ্কাল না খুঁজে পাওয়ায় সবার ধারণা হয়, তার বাসিন্দারা নিশ্চয় দল বেঁধে
অন্য কোথাও চলে গেছে।
তবে তাতেও পরিত্যক্ত সেই
প্রাসাদ নিয়ে স্থানীয় বুনোদের ভয় গেল না। বরং দিনে দিনে তা আরও বেড়েই চলল। সেই সঙ্গে
নতুন নতুন উদ্ভট সব গল্পও শোনা যেতে লাগল মার্টেনসদের প্রাসাদকে ঘিরে। আর সেইসব
কাহিনিকে বুকে ধরে নিয়ে পাহাড়ের মাথায় নির্জনে একলা দাঁড়িয়ে রইল মার্টেনস
প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ। জাঁ মার্টেনসের কবর খুঁড়তে খুঁড়তে বিদ্যুতের আবছা আলোয় আমি সেই
ধ্বংসাবশেষের আইভি ছাওয়া পাথরের দেয়ালগুলোই দেখতে পাচ্ছিলাম গাছগাছড়ার ফাঁকে ফাঁকে।
আগেই বলেছি আমার খোঁড়াখুঁড়িটার
মধ্যে নির্বুদ্ধিতার ছাপ ছিল। কথাটা বলবার নির্দিষ্ট কারণ আছে। আসলে খোঁড়াখুঁড়ির
শুরুতেই মাটির সামান্য নিচে থেকে জাঁ মার্টেনসের কফিনটা বের হয়ে এসেছিল। তার মধ্যে
খানিক ধুলো আর নাইট্রেটের ছিটেফোঁটা ছাড়া তখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। কিন্তু আমার
কবর খোঁড়ার উন্মাদনা তাতে শান্ত না হয়ে বরং বেড়ে গিয়েছিল আরও। উন্মাদের
একাগ্রতায় আমি কফিনের নিচের জমিতে গভীর থেকে গভীরতর একটা গর্ত খুঁড়ে চলেছিলাম তখন।
ঈশ্বর জানেন কীসের আশায় কোদাল চালাচ্ছিলাম আমি। আমার সে মুহূর্তে শুধু মনে হচ্ছিল,
পাতালবাসী এক নিশাচর খুনি প্রেতাত্মার কবর আমি খুঁড়েই চলেছি... খুঁড়েই চলেছি...
জানি না কতটা গভীর অবধি খুঁড়ে
গিয়েছিলাম আমি সেই রাত্রে। কিন্তু তারপর একসময় হঠাৎ চলন্ত কোদালের আঘাতে আমার
পায়ের তলার মাটি সরে গেল। একটা গর্তের মুখ খুলে গেছে সেখানে। ভারসাম্য হারিয়ে
অগভীর সেই গর্তটার মধ্যে আছড়ে পড়তে লন্ঠনটা নিভে গিয়েছিল। তাতে ঘাবড়ে না গিয়ে আমি
পকেট থেকে ফ্ল্যাশ লাইটটা বের করে তার বোতাম টিপলাম। গর্তটার দেয়াল থেকে দু’দিকেই
একটা সরু সুড়ঙ্গ চলে গেছে। ফ্ল্যাশ লাইটের আলোয় কোনওদিকেই তার শেষ দেখা যায় না।
সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তার ভেতর ঢোকা সম্ভব নয়। তবে বুকে হেঁটে একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ
তার মধ্যে দিয়ে যাতায়াত করতে পারবে।
ওই পরিস্থিতিতে পূতিগন্ধময়
থকথকে কাদায় ভরা সে সুড়ঙ্গে ঢোকবার কথা কোনও সুস্থ বুদ্ধির মানুষ কল্পনাতেও আনত না
সে ঠিক। তবে সে মুহূর্তে আমি খুব একটা সুস্থ বুদ্ধিতে ছিলাম না। ভয়, যুক্তি,
ঘেন্না এই সবকিছুকে তখন ছাপিয়ে উঠেছে, সেই অদেখা আতঙ্কের রহস্য খুঁজে বের করবার
একটা উন্মাদ তাগিদ। অতএব, সুড়ঙ্গের যেদিকটা প্রাসাদের দিকে গিয়েছে সেই দিকটার
ভেতরে আমি বুকে হেঁটে ঢুকে পড়লাম। তারপর অন্ধকারের মধ্যে সেই কাদার বুকে হাত-পায়ের
ধাক্কায় দ্রুত এগিয়ে চললাম। মাঝে মাঝে দুয়েকবার শুধু দাঁতে কামড়ে ধরে রাখা ফ্ল্যাশ
লাইটটার বোতাম টিপে দেখে নিচ্ছিলাম আর কতটা পথ বাকি। অবশ্য তাতে লাভ হচ্ছিল না কোনও। মাটির
অনেক নিচে ক্রমাগত এদিক ওদিক বাঁক খেতে থাকা একটা অন্ধকার সুড়ঙ্গের ভেতর পাক খেতে
খেতে বুকে হেঁটে চলা একটা মানুষের সময়, দিক, নিরাপত্তা এই সমস্ত বোধ হারিয়ে যেতে
বাধ্য। আমারও তাই গিয়েছিল সেই মুহূর্তে। সাময়িকভাবে হারিয়ে গিয়েছিল সমস্ত স্মৃতিও।
হারিয়ে গিয়েছিল মাঝে মাঝে ফ্ল্যাশলাইটটা জ্বালিয়ে চারপাশটা দেখে নেবার তাগিদটাও।
অবশিষ্ট ছিল কেবল অন্ধকার দুর্গন্ধ পাঁকের মধ্যে দিয়ে বুকে হেঁটে অতিকায় কোনও ভূগর্ভ-কীটের
মতো অনির্দেশ্য গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলা।
হঠাৎ অন্ধকারে সুড়ঙ্গের
দেয়ালের সঙ্গে একটা ধাক্কা লেগে ফ্ল্যাশ লাইটটা জ্বলে উঠতে আমার চেতনা ফিরে এল
খানিক। আলোটা তখন কমজোরি হয়ে এসেছে। সামনে কাদায় ভরা নিচু সুড়ঙ্গটা দেখলাম বেঁকে
গিয়েছে বাঁয়ের দিকে।
বাতিটা আর নেভালাম না আমি।
ক্রমেই হালকা হয়ে আসতে থাকা আলোটা তখন আমার সভ্যতার সঙ্গে সংযোগের শেষ চিহ্ন। তাকে
দাঁতে কামড়ে ধরে প্রাণপণে এগিয়ে যাওয়া শুরু করলাম ফের। আর ঠিক তখনই সুড়ঙ্গটা হঠাৎ
খাড়া ওপর-মুখী একটা বাঁক নিল, আর সেই বাঁকে পৌঁছে ওপর দিকে মাথাটা তুলতেই আমার
ফ্ল্যাশ লাইটের লালচে ক্ষয়াটে আলোটা খানিক দূরে দুটো ভিন্ন ভিন্ন রঙের ঝিলিক তুলল।
দুটো চোখ যেন ঝলসে উঠেছে সেই আলোর ছোঁয়া পেয়ে।
সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেলাম আমি।
পিছিয়ে পালাবার মতো মনের জোর তখন হারিয়ে গেছে আমার। চোখগুলো নিয়ে একটা অন্ধকার
শরীর যেন আস্তে আস্তে গুঁড়ি মেরে আমার দিকে এগিয়ে আসছিল...
ঈশ্বরের অসীম কৃপা যে সেই সময়
আমি সে রাক্ষসের আসল পরিচয় জানতাম না। জানলে হয়তো আমার দুর্বল হৃৎপিণ্ড সেখানেই
চিরকালের জন্য থেমে যেত। কিন্তু যে বাজ-বিদ্যুৎ তাকে ডেকে এনেছিল আমার সামনে, সেই
বাজ-বিদ্যুতেরই কৃপায় আমি সেদিন বেঁচে যাই। আসলে
সুড়ঙ্গ দিয়ে এলোমেলো চলতে চলতে আমি ভূ-ত্বকের একেবারে কাছাকাছিই চলে এসেছিলাম
ততক্ষণে। মাথার ওপর মাটির আবরণ পাতলা হয়ে এসেছিল বেশ।
চোখদুটো যখন আমার প্রায়
কাছাকাছি এগিয়ে এসেছে, ঠিক তখন একটা প্রলয়ঙ্কর বাজ নেমে এল আমার একেবারে কাছে। এ পাহাড়ের
বুকে আগে অনেক জায়গাতেই তেমন বজ্রপাতের নিদর্শন আমি আগেও দেখেছি। বাজের আঘাতে গর্ত
হয়ে যাওয়া ভূ-ত্বকের ভেতর গলে জমাট বেঁধে ওঠা কোয়ার্টজের স্তূপ তার সাক্ষ্য দেয়।
আমার রক্ষাকর্তা হয়ে সেই মুহূর্তে আকাশ থেকে ঠিক তেমনই একটা বাজ নেমে এসেছিল মাটির
পাতলা আবরণ কাটিয়ে সেই জীবটার শরীরে।
একই সঙ্গে সেই তীব্র আঘাতে
ভারসাম্য হারিয়ে ধ্বসে পড়া মাটি ও কাদার স্রোত আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে চলল জায়গাটা থেকে
দূরে। তারপর একসময় মাথায় বৃষ্টিধারার স্পর্শ পেয়ে চেয়ে দেখি, পাহাড়ের
দক্ষিণ-পশ্চিম ঢালের একটা ন্যাড়া এলাকায় মাটির ওপর উঠে এসেছি আমি। মাথার ওপরে খাড়া
উঠে যাওয়া অরণ্য-ছাওয়া ঢালের তলা থেকে নিচের দিকে এগিয়ে যাওয়া এই জায়গাটা তখন
লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে প্রকৃতির রোষে। ঘন ঘন বিদ্যুৎঝলকে দেখা যাচ্ছিল, তার ওপর জমে
উঠেছে স্তূপ স্তূপ কাদার পাহাড় আর জলের কুণ্ডি। তার ভেতর ঠিক কোনখানটা দিয়ে আমি
মাটির তলার সুড়ঙ্গ বেয়ে এসে আকাশের মুখ দেখেছি সেটা অনুমান করবার কোনও উপায় আমার
ছিল না। আর ঠিক তখনই দক্ষিণে অনেক দূর থেকে একটা লালচে আলোর ঝলক দপদপ করে উঠে আমায়
চমকে দিয়ে হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে দিয়ে গেল।
দিন দুয়েক বাদে দক্ষিণে
আধবুনোদের একটা গ্রামে গিয়ে সেই লাল ঝলকানিটার অর্থ জানতে পারলাম। আর সেটা জেনে ভয়টা
আরও বেশি করে চেপে বসল আমার মনে। সেদিন রাত্রে যে বাজটা আমাকে সেই শরীরী আতঙ্কের
হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়ে গিয়েছিল, সেটা পড়বার সামান্য পরেই প্রাসাদ থেকে মাইল বিশেক
দক্ষিণের একটা গ্রামে একটা বাড়ির দুর্বল ছাদ ভেঙে তার ওপরে ছেয়ে থাকা গাছ থেকে কিছু
একটা নেমে এসেছিল সেই ঘরের ভেতর। গ্রামের বাকি লোকজন ঘরের ভেতর তাণ্ডবের শব্দ শুনে
ভয় পেয়ে আগুন লাগিয়ে দেয় তাতে। সেই আগুনেরই ঝলকানি আমি দেখেছিলাম সেদিন রাত্রে।
।। চার ।।
তার মানে শয়তানটা একটা দেহ
নিয়ে চলে না! এই সত্যিটা জানবার পর, আর সেই ভয়ানক রাত্রে তার একটা রূপের মুখোমুখি
হবার পর কোনও সুস্থ মনের মানুষ এ ব্যাপারে আর একলা অনুসন্ধান চালাতে সাহস পাবে না।
তার দুটো দেহ ধ্বংস হয়েছে সেই ঝড়ে রাত্রে। একটা বাজের ধাক্কায় আর অন্যটা
গ্রামবাসীদের আগুনে। প্রায় কাছাকাছি সময়ে। বিশ মাইল তফাতে দুটো জায়গায়। কিন্তু
তাতেও আমি পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারিনি। যে দানবের দুটো দেহ সম্ভব, তার আরও অনেক
শরীরই থাকতে পারে, এই সম্ভাবনার চিন্তাটাই আমায় তখন উত্তেজিত করে তুলছিল। ফলে ভয়
পাবার বদলে বিষয়টার শেষ দেখবার জন্য অসুস্থ কৌতূহলটা আরও উগ্র হয়ে উঠেছিল আমার।
কয়েকদিন বিশ্রাম নিয়ে
ধাক্কাটা খানিক সামলে নেবার পর ফের আমি জাঁ মার্টেনসের কবরটা খুঁড়ে দেখবার জন্য
রওনা দিলাম। গিয়ে দেখি ইতিমধ্যে বৃষ্টি আর ধ্বস মিলে সেখান থেকে সুড়ঙ্গের সব চিহ্ন
মুছে দিয়েছে। সেখানে জমে উঠেছে মাটি আর পাথরের নতুন স্তূপ। কতটা গভীরে খুঁড়ে আমি সে
সুড়ঙ্গের নাগাল পেয়েছিলাম সেটাও বোঝবার আর কোনও উপায় নেই তখন। বিশ মাইল দক্ষিণের
যে গ্রামে শয়তানটার একটা শরীরকে পুড়িয়ে শেষ করা হয়েছিল সেখানে গিয়েও নতুন বিশেষ
কিছু জানা গেল না। আধবুনোরা জানাল, ঘরের ভেতর কেবল একজন মানুষই ছিল আক্রমণের সময়।
অথচ তার ছাইয়ের ভেতর থেকে একজন মানুষের পোড়া খুলির পাশাপাশি আরও একটা হাড়ের টুকরোও
পাওয়া গিয়েছিল। সেটাও সম্ভবত কোনও মানুষের খুলির টুকরো। ওদিকে গাছ থেকে লাফিয়ে
নামা রাক্ষসের চেহারার সঠিক বর্ণনাও তারা কেউ দিতে পারেনি। সেই অন্ধকার আর
ঝড়বৃষ্টির মধ্যে তাকে ভালো করে দেখা সম্ভবও ছিল না। যে গাছ থেকে সে নেমে এসেছিল
তাকে পরীক্ষা করেও কোনও চিহ্ন-টিহ্ন খুঁজে পাওয়া গেল না। আশপাশের জঙ্গলের ভয়াবহ চেহারার
গাছপালাগুলোর মধ্যেও কোনও জীবের চলাফেরার কোনও নিদর্শন ছিল না।
জাঁ মার্টেনসের কবরে আর কিছু
খুঁজে না পেয়ে এরপর আমি ফিরে গেলাম আধবুনোদের ধ্বংস হওয়া গ্রামের যে ঘরটায় আর্থার
মুনরোর মৃত্যু এসেছিল সেইখানে। সেটা ছিল চোদ্দই নভেম্বর। আগেই অবশ্য জায়গাটাকে তন্নতন্ন
করে খুঁজে দেখেছি আমরা। কিন্তু এইবার সেখানে নতুন করে খোঁজ
চালাবার মতো কিছু নতুন তথ্য আমার হাতে এসেছে। এইবারে আমি জানি, বাজ-বিদ্যুতে সওয়ার
হয়ে আসা বহুরূপী হত্যাকারীর আবির্ভাবের সঙ্গে মাটির তলা বেয়ে চলাচলের একটা সম্পর্ক
আছে। ফলে মুনরোর মৃত্যু হয়েছিল যে কুঁড়েতে তার দু’পাশের পাহাড়দুটোর গায়ে ধ্বসের
জায়গাগুলোর দিকে এইবার আমি মনোযোগ দিলাম।
বলা বাহুল্য, এ-যাত্রা শঙ্কু
আর ম্যাপল পাহাড়ের মধ্যে দু’নম্বরটার দিকেই আমার নজর পড়ল বেশি করে। কারণ সেটা
কুঁড়ের যেদিকে, সেইদিকেই কিছু দূরে ঝড়পাহাড়ের মাথায় রয়েছে মার্টেনসের প্রাসাদ।
সেদিন সারা বিকেল ধরে
খুঁজেপেতেও কোনও ফল হয়নি। সন্ধের মুখমুখ আমি ম্যাপল টিলার মাথায় গিয়ে দাঁড়ালাম।
আমার সামনে নেমে যাওয়া ঢালের গায়ে ছোট্ট, পরিত্যক্ত গ্রামটা শুয়ে আছে। গ্রাম
ছাড়িয়ে উপত্যকা, আর তার ও-পাড়ে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঝড়পাহাড়।
খানিক বাদে বর্ণিল
সূর্যাস্তের পর আকাশে পুর্ণিমার চাঁদ উঠে এল। গোটা উপত্যকা জুড়ে ছড়িয়ে গেল তার রুপোলি
আলোর মায়া। সেই আলো মেখে গোটা উপত্যকাটা জুড়ে মাথা উঁচিয়ে ছিল অসংখ্য নিচু নিচু
ঢিবির দল। কোন আতঙ্ক বাসা বেঁধে আছে সেখানে তা না জানলে চাঁদ-ছাওয়া সেই উপত্যকাকে
বড়ো শান্তির জায়গা বলেই মনে হবে। তবে আমি তো জানি! তাই সেদিকে চোখ রেখে আমার মনে
শান্তির বদলে একটা ব্যাখ্যাহীন ভয়ই জড়িয়ে উঠছিল কেবল।
তাকিয়ে থাকতে থাকতেই হঠাৎ
গোটা উপত্যকাটার ভৌগোলিক চেহারাটা আমার সামনে অন্য একটা রূপ নিয়ে জেগে উঠল। ভূ-তত্ত্বের
কোনও ধারণা আমার নেই। কিন্তু তবুও প্রথম যখন এ-পাহাড়ে পা দিই তখন এর বিস্তীর্ণ
উপত্যকা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ওই বিচিত্রদর্শন ঢিবিগুলো দেখে আমার কৌতূহল জেগেছিল।
ঝড়পাহাড়কে ঘিরে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে আছে তারা। পাহাড় থেকে যত দূর গেছে তত
তার সংখ্যা কমেছে ধীরে ধীরে। এখন চাঁদের আলোছায়ার খেলা আমার চোখে সেই ঢিবিগুলোর
সজ্জার ভেতরে একটা নির্দিষ্ট নকশার আভাস ফুটিয়ে তুলছিল। ঝড়পাহাড়কে কেন্দ্রে রেখে
ঢিবিগুলো যেন অতিকায় কিছু আকর্ষীর মতো দূরদূরান্তরে ছড়িয়ে গেছে উপত্যকা ধরে। যেন
পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়ানো মার্টেনসদের প্রাসাদ তার আতঙ্কের জাল ছড়িয়ে রেখেছে তাকে
ঘিরে থাকা বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে!
ধারণাটা মাথায় আসতেই একটা
অসহনীয় উত্তেজনা ছড়িয়ে গেল আমার শিরায় শিরায়। উন্মাদের মতো চিৎকার করে উঠলাম আমি,
“হা ঈশ্বর! সুড়ঙ্গের মুখ ওগুলো... মাটির তলা দিয়ে সুড়ঙ্গের জাল... তাই সেদিন
রাত্রে আমার দু’পাশ থেকে বেনেট আর টোবিকে নিয়ে গিয়েছিল... হয়তো গোপন সুড়ঙ্গ আর
ফায়ার প্লেসের গর্ত দিয়ে বের হয়ে এসে...”
আর তারপর, সবচেয়ে কাছাকাছি
থাকা ঢিবিটার কাছে ছুটে গিয়ে আমি পাগলের মতো তার গায়ে খুঁড়তে শুরু করলাম... আর
সামান্য খোঁড়বার পর, যখন তার মাটি সরে গিয়ে একটা সুড়ঙ্গের মুখ সেখানে দেখা দিল,
সেই মুহূর্তটায় আতঙ্ক আর উল্লাসের মিশ্র অনুভূতি মেশা একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার আমার
গলা দিয়ে উঠে এসে মিশে গেল রাত্রের বাতাসে। আমার অনুমান ভুল নয় তবে!
এইবার উন্মাদের মতো কোদাল
হাতে আমি ছুট দিলাম সেই চাঁদের আলো ছাওয়া উপত্যকার মধ্যে দিয়ে। আমার লক্ষ ছিল মার্টেনস
প্রাসাদের সেই অভিশপ্ত বেসমেন্ট, যেদিকে টোবিকে ধরে নিয়ে উধাও হয়েছিল তার
আক্রমণকারী!
বেসমেন্টের ভাঙাচোরা মেঝের
এখানে ওখানে পাগলের মতো কোদাল চালাতে চালাতে অবশেষে সাফল্য এল ঘরের একপাশে দাঁড়ানো
পুরনো কালের বিরাট চিমনিটার কাছে এসে। এখান থেকে একসময় আগুনের তাপ চিমনি বেয়ে
বিভিন্ন ঘরে ছড়িয়ে পড়ত। সেখানে চিমনির গোড়ায় জমে ওঠা ঝোপঝাড়গুলোকে সরাতেই মুখ বের
করল বিরাট একটা গর্ত। তার ভেতর দিয়ে অন্ধকার পাতালের দিকে এগিয়ে গেছে একটা গভীর
সুড়ঙ্গ। সুড়ঙ্গের ঠিক মাথার ওপর থেকে ওপরের দিকে উঠে গেছে গরম হাওয়া পাঠাবার
চিমনি।
পকেটে রাখা একটুকরো মোমবাতি
জ্বালিয়ে নিয়ে তার কাঁপা কাঁপা আলোয় সুড়ঙ্গটার দিকে দেখছিলাম আমি। একাই খানিক
এগিয়ে দেখব, নাকি ফিরে গিয়ে লোকজন জুটিয়ে এনে অভিযানটা চালাব সেই নিয়ে একটু
দ্বিধায় পড়েছি তখন। দুটো রাক্ষস ইতিমধ্যে মারা পড়েছে। হয়তো ওতেই এ-প্রাসাদের
অভিশাপের সমাপ্তি ঘটে গেছে। কিন্তু তবুও, বলা যায় না। হয়তো আরও কিছু বাকি রয়ে গেছে
ওই সুড়ঙ্গের ওধারে, প্রাসাদের তলার কোনও অন্ধকার এলাকায়!
ঠিক তখন জানালা দিয়ে হু হু
করে ছুটে আসা এক ঝলক ভিজে হাওয়া আমার মোমবাতিটাকে নিভিয়ে দিয়ে গেল। চমকে উঠে খেয়াল
করলাম, দেয়ালের ফুটিফাটাগুলো দিয়ে বাইরের চাঁদের আলো আর দেখা যাচ্ছে না। ঘন
অন্ধকার নেমে এসেছে সেখানে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অন্ধ কোনও জৈবিক তাড়নাতেই
অন্ধকারের মধ্যে হাতড়ে হাতড়ে গর্তটার থেকে যতটা সম্ভব দূরে সরে গেলাম আমি। বেসমেন্টটার
একেবারে উলটোদিকের কোণে গিয়ে আশ্রয় নিলেও আমার চোখদুটোকে তখন চুম্বকের মতো টেনে
রেখেছে চিমনির গোড়ার ওই কালো গর্তটা। বাইরে আকাশে অকালের মেঘে বিদ্যুৎ-ক্ষরণের আলো
ফাটাফুটি দিয়ে ঢুকে এসে বারে বারে হালকা আলোয় ধুইয়ে দিচ্ছিল তার ভাঙা ইটের দেয়াল
আর মুখ জুড়ে ছেয়ে থাকা ঝোপঝাড়গুলোকে।
একটা দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে প্রায়
মিশে থেকে মরার মতো স্থির হয়ে অপেক্ষা করছিলাম আমি। আসন্ন
বজ্রপাত কোন আতঙ্ককে টেনে বের করে আনবে ওই গর্তের মুখ দিয়ে তা দেখবার একটা উদগ্র
কৌতূহল, আর সেই সঙ্গে তীব্র ভয়ের অনুভূতি মিশে আমার সমস্ত মনোযোগকে তখন বন্দি করে
ফেলেছে ওই কালো গর্তটার মুখের দিকে।
এবং সে এল। একেবারেই হঠাৎ
করে। বাইরে একটা ভয়ানক বজ্রপাতের শব্দ উঠল হঠাৎ, আর তার সঙ্গে সঙ্গেই কালো গর্তটার
ভেতর থেকে প্রথমে ভেসে এল ঘন ঘন শ্বাসের শব্দ আর চাপা গলার দুর্বোধ্য আওয়াজ।
তারপর হঠাৎ সেখান থেকে বের হয়ে এল বিকৃত-দেহ একটা দোপেয়ে দানব! আর তার পেছন পেছন
সেখান থেকে ধেয়ে এল অসংখ্য কুঁজো ফ্যাকাশে দোপেয়ের একটা স্রোত। মানুষের অবয়বের
সঙ্গে ক্ষীণ সাদৃশ্য, পাতালপুরীর সেই জীবদের ভয়াবহতাকে বাড়িয়েই তুলছিল কেবল।
এঁকেবেঁকে অতিকায় কোনও সাপের মতোই শরীরে ঢেউ তুলতে তুলতে অপমানবের সেই স্রোতটা
গর্ত বেয়ে বের হয়ে এসে বেসমেন্টের চারধারের ফাটাফুটি দিয়ে অজস্র ধারায় ছড়িয়ে
যাচ্ছিল চারধারে ছেয়ে থাকা জঙ্গলের ভেতরে।
শয়ে শয়ে, অপমানুষের সেই
দলগুলোর প্রত্যেক সদস্যের শরীর বাঁকা, কুঁজো। লোমহীন বাঁদরের একেকটা নারকীয়
ক্যারিকেচার যেন। ছুটে চলতে চলতেই তাদের একেকটা দল মুহূর্তের জন্য থেমে কোনও দুর্বল
সঙ্গীর ওপর অভ্যস্ত ভঙ্গিতে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল। তারপর মুহূর্তের মধ্যে হতভাগা জীবটার
শরীরটাকে ছিঁড়েখুঁড়ে মুখে চালান করে দিয়ে ঠোঁট চাটতে চাটতে ফের তারা ছুটে যাচ্ছিল
বাইরের দিকে।
জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে দিয়ে তাদের
তলায় গজিয়ে ওঠা দুর্গন্ধ ছত্রাকদের স্তূপ মাড়িয়ে স্রোতগুলো ছুটে যাচ্ছিল পাহাড়ের
ঢালে ঢালে ছড়িয়ে থাকা অরণ্য আর গ্রামগুলোর দিকে। অনুমান করতে পারছিলাম, আজ তাদের
দুর্বার খিদের সামনে যে ধরা পড়বে, সে মানুষ হোক কি অরণ্যচারী জীবজন্তু, তাদের আর
রেহাই নেই।
অন্ধকার কোণটায় নিস্তব্ধ হয়ে
বসে থাকতে থাকতেই আমার হাতে উঠে এসেছিল সঙ্গে করে আনা পিস্তলটা। এদের অন্তত একটাকে
কাছ থেকে দেখতে চাই আমি। আর তাই গোটা স্রোতটার বাইরে বের হয়ে যাওয়া যখন শেষ হয়ে
এল, ঠিক তখন, সুড়ঙ্গ থেকে বের হয়ে আসা শেষ রাক্ষসটার দিকে নিশানা স্থির করে একটা
বাজ পড়ার শব্দের আড়াল নিয়ে আমি পিস্তলের ট্রিগারে চাপ দিলাম...
অন্ধকারের আড়াল নিয়ে, নরকের
বাসিন্দাদের সেই ছুটন্ত স্রোতগুলোর থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে সে রাত্রে আমি কেমন করে
মানুষের দুনিয়ায় ফিরে এসেছিলাম তা আমি নিজেও জানি না।
এর সপ্তাহখানেক বাদে আমি
আলবানি পৌঁছে সেখান থেকে একদল মানুষ নিয়ে ফের ফিরে এসেছিলাম মার্টেনসের প্রাসাদে।
প্রাসাদ সহ ঝড়পাহাড়ের গোটা চুড়োটা ডাইনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। বন্ধ করে
দেয়া হয়েছিল উপত্যকা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা যতগুলো সুড়ঙ্গের মুখ খুঁজে পাওয়া যায় তার সবগুলোকেই।
এমনকি প্রাসাদ ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা অরণ্যের প্রাচীন, বিকৃতদর্শন গাছগুলোও রেহাই
পায়নি আমাদের হাত থেকে।
কিন্তু তবুও আজও শান্তিতে ঘুম
আসে না আমার। তাদের বাইরে বের হয়ে আসবার পথ যথাসম্ভব বন্ধ করেছি তা ঠিক, ঝড়পাহাড়ের
গোটা চুড়োটাকেই প্রাসাদের সঙ্গে অনেকটা জায়গা নিয়ে অনেকটা গভীর করে নিশ্চিহ্ন করে
দেয়া হয়েছে। কিন্তু তাও প্রাসাদের মাটির তলার সেই সুড়ঙ্গের রাজত্বে আমাদের ধ্বংসের
আগুন কতটা পৌঁছেছিল তা কে জানে! হয়তো তারও নিচে, আরও গভীরে পাহাড়ের পেটের ভেতর কোনও
অজানা শিরায়, অজানা গুহায়...
আজও আকাশে বাজের শব্দ উঠলে
আমার ঘুম আসে না। চোখের সামনে ভেসে ওঠে ভূগর্ভের কিছু কাদায় ভরা সুড়ঙ্গ...
সেখানে... ঝাঁকে ঝাঁকে...
শেষ রাক্ষসটাকে গুলি করে
মারবার পর, বাকিরা চলে যেতে আমি এগিয়ে গিয়ে তাকে ভালো করে দেখেছিলাম। মানুষের মতোই
অবয়ব তার। কিন্তু মানুষের বড়ো সামান্যই অবশিষ্ট আছে সাদাটে, ছোটোখাটো একটা গোরিলার
মতো সেই শরীরে। তীক্ষ্ণ হলদেটে দাঁত আর ফ্যাকাশে
জান্তব শরীর। যেন বিবর্তনের বিপরীত পথে হেঁটে মানুষের
থেকে গড়ে ওঠা কোনও অপমানব। মরবার আগে সে একবার চোখ খুলে তাকিয়ে দেখেছিল আমার দিকে।
তখন নজর করেছিলাম, তার দুই চোখের মণি দুটো আলাদা রঙের, একটা নীল, অন্যটা বাদামি।
ঠিক যেমনটা দেখেছিলাম কয়েক রাত আগে পাতাল-সুড়ঙ্গে আমার দিকে এগিয়ে আসা অন্ধকার
শরীরটার মুখে। মার্টেনসদের চোখ! আর সেই মুহূর্তেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম, কোথায়
হারিয়ে গিয়েছিল তাদের বিশাল পরিবার। সমাজ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে, নির্জন পাহাড়চুড়োয়
স্বেচ্ছা-বন্দিত্বের ঘেরাটোপে নিজেদের সংখ্যা বাড়াতে বাড়াতেই হয়তো তারা হেঁটে
গিয়েছিল বিবর্তনের বিপরীতমুখী পথে। তারপর একসময় আলোর দুনিয়া ছেড়ে মাটির গভীরে
হারিয়ে গিয়ে, মনুষ্যত্বকে চিরতরে হারিয়ে সৃষ্টি করেছিল নতুন অপমানুষের সমাজ।
হয়তো এখনও তারা আছে। হয়তো
পৃথিবীর অন্যান্য জায়গাতেও একইভাবে মাটির গভীরে বেড়ে উঠছে বিপরীত বিবর্তনের একইরকম
নারকীয় ফসলের নতুন নতুন দল। হয়তো তারা সংখ্যায় বেড়ে উঠছে আমাদের চোখের আড়ালে! হয়তো
একদিন...
_____
অনুবাদকের বক্তব্যঃ কাল্পনিক হলেও এহেন ঘটনার
উদাহরণ ইতিহাসে আছে। ইংল্যান্ডের ইতিহাসে ‘সনে বিন’ ও তার নরখাদক পরিবার এইরকমই এক
বিপরীত বিবর্তনের বাস্তব উদাহরণ।
ছবিঃ সংগৃহীত
একেবারে অন্য ধরনের গল্প
ReplyDelete