লালকমল আর নীলকমল
সঙ্গীতা দাশগুপ্ত রায়
কেউ যখন বাদামের খোসা ছাড়িয়ে খোসাটা মুখে ফেলে বাদামটা নিচে
ফেলে দেয় তখন তাকে নিয়ে চিন্তা হওয়ারই কথা। বিশেষ করে ঘটনাটা যদি টানা গোটা ছয়েক
বাদামের ক্ষেত্রে হয়। লালকমল রোয়াকে লাফিয়ে উঠে নীলকমলের গা ঘেঁষে বসল।
“কী রে! খোসায় বাদামের থেকে বেশি ভিটামিন
নাকি?”
নীলকমল উত্তর দিল না। বন্ধুর দিকে তাকিয়ে
পর্যন্ত দেখল না। মন দিয়ে খোসা ছাড়াচ্ছে। ভাব দেখে মনে হচ্ছে এই বাদামটাও সোজা
নর্দমায় যাবে। তক্কে তক্কে ছিল লাল। বাদামটা ফেলার ঠিক আগেই হাত পাতল এবং মাঝ
হাওয়ায় টপ করে ধরেও ফেলল। বাদামটা দিব্যি
পুরুষ্টু এবং হাসিখুশি। লাল দু’বার মুঠোয় ওটাকে নাচিয়ে নিয়ে মুখে পুরে চিবোয়।
“যাব্বাবা! এ তো এমনি চিনেবাদামের মতোই খেতে
রে!”
লালের কথায় নীল এবার বিরক্ত হয়ে তাকাল, “চিনেবাদাম
চিনেবাদামের মতো খেতে হবে না তো কি জাপানীবাদামের মতো হবে? গাধা কোথাকার!”
“আরে না। আমি ভাবলাম বাদামটা বুঝি খোসার
চেয়ে খারাপ খেতে তাই তুই ওটা ফেলে খোসা খাচ্ছিস।”
নীলকমলের মেজাজ একদম ভালো নেই। বিরক্ত হয়ে
তাকাল, “তুই কোথায় একটা যাচ্ছিলি না? এখানে গ্যারাজ করলি কেন নিজেকে!”
“যাব। আগে এই বাদাম রহস্যটা বুঝে নিই।
যাচ্ছি মাদার ডেয়ারির দুধ আনতে। রাতে পায়েস হবে কিনা!”
এটা আসলে টোপ। মোটেই পায়েস-টায়েস হবে না।
মাদার ডেয়ারির দুধ ওদের নিত্যি আসে। সাত চামচ নারায়ণ সেবায়, একুশ চামচ মহাদেবের ছবির সামনে, এক কাপ দিদির
পরীক্ষার আগের ভিটামিন আর ক্যালসিয়ামায় চঃ আর বাকিটুকু চামচ হিসেব করে সারাদিনের
চায়ে লাগে। কিন্তু পায়েস শুনলে নীলের চোখ নাক জিভ সব জলে ভরে ওঠে। বাদামের রহস্য
জানতে এই টোপটা দিল লাল। যদি মুখ খোলে।
“ওঃ, তো যা। বেলা হলে দুধ ফেটে যায়।”
বোঝাই যাচ্ছে নীলের এক্কেবারেই কথা বলার
ইচ্ছা নেই। লালকমল আর কথা না বাড়িয়ে রক থেকে নেমে পরে। ওদিকে দুধের দোকানে লাইন
পড়ে যাবে লম্বা। মাসকাবারির খদ্দের বলে রমুকাকা রেয়াত করে
না। যে আগে আসবে দুধ তার। সাফ কথা।
ফেরার সময় রোয়াক ফাঁকা। নীল বাড়ির ভিতরে
ঢুকে গেছে নিশ্চয়ই। তারুদের ছাগলটা মুখে ক’টা ঘাসপাতা নিয়ে নীলের জায়গাটাতে শোয়ার
উদ্যোগ করছে। পাড়ায় গোটা তিনেক ছাগল আছে। তারুদের,
নলিনীকাকার আর বিধুয়ার। সব ক’টাকেই
একরকম দেখতে লাগে। কালচে বাদামি রং। কোনটা কার ছাগল
আলাদা করে চিনতে পারত না লালকমল। নীলই ওকে শিখিয়েছে। তারুদের
ছাগলের ডান কানটা ছোটো, নলিনীকাকাদের ছাগলের একটা পায়ের লোম অল্প ধূসর আর বিধুয়ার
ছাগলটা সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যবান। নীলের সন্দেহ আগামী কিছুদিনের মধ্যেই বিধুয়ার
ছাগলটা উধাও হবে পাড়া থেকে। নধর ছাগলকে খাসি বলে বেচে দেবে বিধুয়া কসাইদের হাতে। এ
নিয়ে লালকমলের সঙ্গে বিস্তর আলোচনাও হয়েছে। বিধুয়া
ছাগলটাকে বেঁধে রাখে না তেমন। ওরাও পাড়ার বাইরে যায় না। কোনো অ্যানিমেল শেলটারে
যদি এক ফাঁকে ছাগলটাকে পৌঁছে দেওয়া যায় তাহলে বেচারা প্রাণে বেঁচে যাবে। কিন্তু
অ্যানিমেল শেলটার কোথায় তা ওদের জানা নেই। তাছাড়া
লালের সন্দেহ যে দূরে কোথাও নিয়ে যেতে হলে তো বাসে করেই যেতে হবে। বাসে কি ছাগলদের
উঠতে দেয়? মোটের ওপর ওরা ধরেই নিয়েছে বিধুয়ার ছাগলটার
আয়ু অল্প এবং অন্তিম গন্তব্য বিরিয়ানির হাঁড়ি। ওর ওপর মানিকজোড়ের মায়াও তাই একটু
বেশি। তবে ঠাহর করে দেখলেই বোঝা যায় এটা বিধুয়ার ছাগল না। তারুদের
ওই কান ছোটো ছাগলটাই। বেদম আয়েসি এটা। সুযোগ পেলেই ফাঁকা রকে শুয়ে পড়ে এসে।
“দুধ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ছাগলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করবি নাকি?” ওপরের জানলা থেকে
নীলের গলা ভেসে আসে।
লালকমলেরও সম্মানবোধ টনটনে। ঘাড় তুলে বলল,
“তাই করব ভাবছি। অন্ততঃ কথার উত্তর না পেলেও বুঝব যে কথা বলতে পারে না তাই বলে না।”
“দাঁড়া, আসছি নিচে,” নীলকমল এবার হেসে ফেলে।
“চল বাড়িতে দুধটা দিয়ে আসি আগে, নইলে
সত্যিই কেটে যাবে...” পা চালায় দু’জনে।
বাড়ির সদরের কাছেই চুন্নিদি দাঁড়িয়ে। “এই
যে মানিকজোড়! পড়াশুনো নেই নাকি রে? সকাল সকাল পাড়া বেড়াচ্ছিস?”
চুন্নিদি কলেজে পড়ে। তাই ভাই আর ভাইয়ের
বন্ধুদের দেখলেই পড়তে বসা নিয়ে খিচখিচ করে।
“দুধ আনতে গেছিলাম তো, দেখছ না?”
লাল চট করে দরজায় সেঁধিয়ে যায়।
“সারাদিন ফাঁকি দে। বাবাকে বলছি, তোদের পড়াশুনোর দিকে কোনো নজর নেই আজকাল!” শুনেও না শোনার ভান করে নীলও
এবার বাড়ির মধ্যে ঢুকে যায়। আর ঢুকেই সুখবর। মানে ঠিক সুখবর নয়, সুঘ্রান এবং খাবার। কাকিমা লুচি ভাজছে রান্নাঘরে। বাতাসে
গরম ঘিয়ের সুবাস যেন টানতে থাকে নীলকে।
“ভেতরে আয়। মা জলখাবার করছে। চল পড়ার ঘরে
গিয়ে বসি।”
দোনামনা করে ভেতরে যায় নীল। কাকিমা
আগেই টের পেয়েছে। লুচির থালা নিয়ে ঘরে এল। লুচি, আলুর দম আর দরবেশ।
“নীল, ইতু কেমন আছে রে? রোজ ভাবি দুপুরের দিকে একবার ও বাড়ি যাব, সে আর হয়ে ওঠে না,” কাকিমা লুচি ধরিয়ে দিয়ে ওদের সঙ্গে গল্প করতে বসে।
আসলে নীলের মা ইতু আর লালের মা গৌরী দুই
ইস্কুলবেলার বন্ধু। একই পাড়ার মেয়ে। বিয়েও একই পাড়ায়। আরও মজার ব্যাপার হল নীল আর
লাল দুজনেরই একই মাসে ক’দিন আগে পরে জন্মদিন। মায়েরা
বুদ্ধি করেই ছেলেদের নাম নীলকমল আর লালকমল রেখেছিল। বড়ো হলে দুটিতে যাতে বন্ধুত্ব
থাকে সেই ভেবেই হয়তো এমন ফন্দি।
তা লাল আর নীল মায়েদের সে ইচ্ছার মর্যাদা
দিয়েছে বই কি। শুধু দু’বাড়িতেই নয়, পাড়ায়, ক্লাবে, স্কুলে,
খেলার মাঠে সব জায়গাতেই ওরা মানিকজোড়।
একটু বড়ো হতে নীল মাঝে মাঝেই এ বাড়িতে
এসে আবদার করত ঠাকুরমার ঝুলি থেকে লালকমল আর নীলকমলের গল্প পড়ে শোনাও। ওদের
বাড়িতে এসব আবদার মেটার জো নেই। নীলের বাবা কাকা
মিলে চার ভাইয়ের একান্নবর্তী পরিবার। এছাড়াও দাদু ঠাকুমা, দাদুর ভাই কাকুদাদু ইত্যাদি নিয়ে বাড়িতে একগাদা গুরুজন। কেউ বাত, কেউ
হাঁপানি, কেউ অম্বল নিয়ে জেরবার। এদিকে নীলের মা-কাকিমারা সারাদিন কেবল খাবার আর
চায়ের তদারকি করে। পালা পার্বণে একসঙ্গে
পুজো দিতে যায়, ব্রত করে, উপোস
ভাঙ্গে, পুজোর বাজার করতে বেরোয়, সিনেমা
দেখতে যায় দুপুর বেলায়। মোটের ওপর নীলের
মাকে একা পাওয়া এক অসম্ভব ব্যাপার। এমনকি নীলের যদি
পেট খারাপ বা জ্বরও হয় তো জেম্মা কি ঠাম্মাই শিঙ্গিমাছের ঝোল আর থানকুনি পাতা বাটা
দিয়ে ভাত খাইয়ে দেয়। অবশ্য এখন আর
খাওয়াতে হয় না। নীল তো আর ছোটোটি নেই। বাবার
কাঁধ বরাবর লম্বায় এখন। ওদিকে লাল বরং ওর মায়ের মতো ছোটোখাটো। সেই কারণেই বোধহয়
ইদানিং নীল লালের ওপর গার্জেনগিরি ফলায়।
“বাড়িতে সব্বাই ভালো আছে কাকিমা। যাও না
কেন? মা-ও তোমার কথা জিজ্ঞেস করে,” নীল লুচি
মুখে পুরে আয়েস করে উত্তর দেয়।
“যাব রে। ওদিকে তোর বড়দির বিয়ের কদ্দূর
হল?”
এতক্ষন অবধি বেশ সুন্দর সময় কাটছিল।
লুচিগুলো নরম, সাদা, মুচমুচে,
আলুর দমের গা মাখা ঝোল... আহা! নীলের মুখ থেকে সকালের সে বৈরাগ্য
অনেক আগেই অন্তর্হিত হয়েছে। এখন এক আয়েসি তৃপ্তির আভা ঠোঁটের পাশ থেকে গাল বেয়ে
কানের দিকে গড়াচ্ছিল, হঠাৎ বড়দিদির বিয়ের কথায় ঘরে যেন সে আভার ওপর আষাঢ়ের মেঘ
ঘনিয়ে এল। নীলের দিদিরা যখন কাঠের ফ্রেমে নরম কাপড় আটকিয়ে ছুঁচে সুতো পরিয়ে ফুল
পাতা পাখি ফুটিয়ে তোলে তখন অনেক সময় হাতে ছুঁচ ফুটে রক্ত বেরিয়ে আসে আর দিদিরা উফ্
টুকু না করে এক দৃষ্টে রক্তটার দিকে তাকিয়ে থেকে থেকে শেষে জামায় কি শাড়িতে রক্তের
ফোঁটাটুকু মুছে নেয়, নীল ঠিক ওইভাবেই পাতের লুচির দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ।
বড়দিদি, লীলাবতী, নীলের মেজজেঠুর বড়ো মেয়ে, ভারি বিদুষী সে।
গাছপালা অন্ত প্রাণ। বটানি নিয়েই পড়াশুনো। তবে বটানি তো সবাই পড়ে, কিন্তু আত্মস্থ
করে ক’জন? লীলাবতী করেছে এবং ভীষণভাবে করেছে। ফলে তার গোটা
ঘর জুড়ে বড়ো মেজ সেজ পাতাবাহার। জানলার ধার ঘেঁষে আয়তাকার টবে পালং, পুঁই, নটের বাগান। কিন্তু বাজারের ঝুড়িতে শাক পাতা
দেখলেই বড়দির চোখে জল আসে। ক’দিন আগে হালুয়াদা বাজারের ব্যাগ বোঝাই করে গোড়া সমেত
নটেশাক এনে নামিয়েছে। মা কাকিমারা সবাই বলল এত্ত তাজা নটে! দিব্যি থোড় ঝিঙ্গে বড়ি
কুমড়ো দিয়ে রান্না হবে। বড়দি সে সময়েই বেরোচ্ছিল ইউনিভার্সিটির উদ্দেশে। রান্নাঘরের
সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমাকে কিন্তু ওই সবজি-টবজি দেবে না। তাজা তাজা গাছগুলোকে উপড়ে
মেরে কেটে খেয়ে পাপ করতে চাই না আমি। স্রেফ ভাত ডাল মাছ ব্যস।’
তো এই বড়দিরই বিয়ে সামনের নভেম্বরের
শেষে। বাড়িতে হই হই চলছে সারাদিন। দ্যাখ না দ্যাখ খালি বিয়ের বাজার বিয়ের ফর্দ
বিয়ের দশকর্মা রব। বাবা কাকা জেঠু সবাই কেবল লিস্টি বানায় আর কাটে। ছোটো
বড়ো দুই পিসিই কাছাকাছি। দুপুর হলেই তারাও এসে হাজির। হালুয়াদা বলে এবার চায়ের
জলের জন্য হাঁড়ি চাপাতে হবে। কেটলিতে আর হচ্ছে না।
মা তেমন না বুঝতে পারলেও লাল ঝটিতি বুঝে
নেয় নীলের বাদামের খোসা খাওয়ার কারণ। নিশ্চয়ই দিদির বিয়ে নিয়েই কিছু হয়েছে। তাই তো
মা বিয়ের কথা জানতে চাইতেই লুচি হাতে নিয়ে চুপ করে আছে নীল। তাড়াতাড়ি কথা ঘোরায়
লাল, “আরে বড়দির বিয়ের গল্প তুমি ও বাড়িতে গিয়েই তো করতে পারো মা! নীল, ওপরে চল। এ বছরের ঘুড়ি কেনার আগে দেখে নিই আগের কী কী আছে। শিগগির খা তো
তুই!”
নীল খাবারে মন দেওয়ার আগে শুধু অল্প করে
বলে, “জোগাড় ভালোই হচ্ছে মনে হয়। খালি বড়ো বড়ো ব্যাগ আসছে। তুমি দুপুরে যেও
কাকিমা। মা দেখাবে সব।”
ছাদের ঘরে গিয়ে দেখা যায় পুরোনো তক্তাপোশের
নিচে যে ক’টা ঘুড়ি রাখা ছিল, ঘুন্টি তার ওপর নিজের চারটে ছানা নিয়ে
আরামে শুয়ে আছে। ঘুন্টি এ বাড়ির
আদরের মেনি। চুন্নিদিদির খাটে সে ঘুমোয় রাতে। দিদির মেখে দেওয়া দুধ পাউরুটি দিয়ে
সকালে ব্রেকফাস্ট করে। এ বাড়িতে বিষ্যুদবারে নিরামিষ রান্না। শুধু ঘুন্টির জন্য
আগের দিনে ফ্রিজে মাছ তুলে রাখা হয়। মাছ ভাত ছাড়া ঘুন্টি খায় না। একবার কে যেন
কোথা থেকে পড়ে এসেছিল বেড়ালরা দুধ খায় বটে কিন্তু ভালোবাসে না। ইন ফ্যাক্ট
বেড়ালদের মধ্যে একটা বড়ো অংশ ল্যাকটোজ ইনটলারেন্সে ভোগে। সে
সময় দিদি যাকে পারে জিজ্ঞেস করত, আচ্ছা আমার ঘুন্টিরও কি ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স আছে?
শেষে নীলের বাবাই একদিন হাঁক পাড়লেন, “হ্যাঁ
রে চুন্নি! ঘুন্টির ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স আছে
কিনা সে তো দুধ খেয়ে ওর বমি বা পেট খারাপ হচ্ছে কিনা তা দেখলেই বোঝা যাবে। এর জন্য
সবাইকে পাগল করে মারছিস কেন?”
কথাটা দিদির মনে ধরেছিল। ক’দিন কেবলই দুধ
পাউরুটি খাওয়ানোর পর ঘুন্টির পিছন পিছন ঘুরত আর বলত, “হ্যাঁ রে,
বমি হবে? কী রে! গা গোলাচ্ছে?”
এর কিছুদিন পরেই দিদি আবার কার কাছে শুনে
এল বেড়ালকে ছাতু খাওয়ালে গায়ে শক্তি হয়। সে শুনে ছাতু খাওয়ানোর চেষ্টাও হল কিছুদিন। কিন্তু
ঘুন্টির জিভ অতি অ্যারিস্টোক্র্যাট। ছাতু-টাতু তার রোচে না। বরং ছাতু দেখলেই পিছন
ফিরে দাঁড়ায়। শেষে চুন্নিদি ওষুধের দোকান থেকে এক কৌটো
প্রোটিন পাউডার কিনে আনল। নীলের বাবা এবারও
হাঁক দিল, “হ্যাঁ রে! শুধু প্রোটিন পাউডারে হবে? নাকি জিমের মেম্বারশিপের ব্যবস্থা করব?”
নীলের মা ফিক করে হেসে বলল, “শক্তি
বাড়িয়ে ঘুন্টি করবে কী? রেস্টলিং করবে নাকি?”
চুন্নিদি মা বাবার কথার উত্তর দিল না বটে,
তবে দেখা গেল প্রোটিন পাউডার ঘুন্টির পেটে সইল না। ইনটলারেন্সের চূড়ান্ত যাকে বলে।
সারা বাড়ি নোংরা করে ঘুন্টি বসে বসে মাটি আঁচড়ে চাটছে দেখে চুন্নিদি ক্ষান্ত দেয়।
কিন্তু এতেই কি গোল মেটে? অত দামি প্রোটিন! ফেলে দেবে নাকি? মা দু’দিন সামনে দাঁড়িয়ে লালের হাতে গ্লাস ধরিয়ে দিল।
লাল নেহাতই শান্তিপ্রিয়। দুটো দিন কষ্ট করে
খেয়ে নিয়েছিল। তিনদিনের দিন থেকে বুদ্ধি করে গ্লাস নিয়ে
ছাদের ঘরে চলে আসে। ফলে ছাদের কোণের জবাগাছটা আজকাল যেন একটু বেশিই পুরুষ্টু লাগে।
আর কটা দিন গেলেই ওই কৌটোও শেষ হবে আর জবাগাছও শুধু জল খেয়ে থাকবে যা লাল ছাড়া আর
কেউ জানবে না। হ্যাঁ, নীল অবশ্য জানবে, কারণ লাল যা জানে নীলের কাছে তা অজানা হতেই
পারে না।
যাক, যে কথা হচ্ছিল, চুন্নিদির ওই আদরের ঘুন্টিরানি
মাঝেসাঝেই এই ঘরে এসে ডেরা বাঁধেন। গোটা তিন চার ছানাপোনার মুখ দেখেন, খাইয়ে দাইয়ে তাদের হাঁটু শক্ত করেন তারপর থাবা নেড়ে তাদের টা টা করে দেন
একদিন। এবারও ওই কারণেই আসা ওপরের ঘরে, আর এসে
চার-ছ’টা গোটা ও ফাটা ঘুড়ির ওপরেই তিনি গুছিয়ে বসেছেন।
“আগেই তুলে রাখা উচিত ছিল। আমি বলেছিলাম
দেওয়ালের হুকে লাগা। তুই শুনলি না তখন,” নীল মুখ ব্যাজার করল।
“ইসস্ এতগুলো ঘুড়ি!” লাল হাত কামড়ায়...
“ছাড়, কিনে নেব ক’খানা,” নীল কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়ায়। তারপর কেমন উদাস গলায় বলে,
“এ শখ তো কিনেও পূরণ করা যায়।”
“সব শখই তো কিনে পূরণ করা যায়। এই তো ক’দিন
আগে বাবা এক সেট কিরীটী অমনিবাস কিনে আনল। মায়ের শখ অনেকদিনের। আমিও ভেবে রেখেছি, সামনের টুর্নামেন্টের আগে এক সেট স্পাইক দেওয়া জুতো কিনব। বাবুয়াদার মতো। তুইও
কিনিস। একসঙ্গে পরে ক্ষুদিরাম টুর্নামেন্টে নামব, এ আমার অনেকদিনের শখ। দিদিও
দেখিস না শখ করে কেমন দু’দিন অন্তর চুড়ি হার কানের দুল কেনে!”
“নাহ, সব শখ মেটে না রে...” নীল মাথা নাড়ে। তারপর
কার্নিশের অশ্বত্থ গাছটার গোড়া ধরে টেনে তুলতে তুলতে বলে, “বড়দির বিয়েতে আমার শখ
আর মিটছে কই।”
“সে কী! তোর কোন শখ মিটছে না?”
“বলুকাকা আসছে বিয়েতে...”
“হ্যাঁ, সে তো আসবেই। আসারই
তো কথা। তাতে কী?” লাল অবাক হয়।
বলুকাকা নীলের বাবার খুড়তুতো ভাই। ভেটেরিনারি
ডাক্তার। থাকে আসানসোলে। একা থাকে। কোনো বলুকাকিমা নেই সংসারে। মানুষ হয়েছে এই
বাড়িতেই নীলের বাবা জেঠাদের সঙ্গে। ছোটোবেলায় মা বাবা হারিয়েছে, তায় বিয়ে থাওয়া করেনি। তাই নীলদের বাড়িতে বলুকাকার আলাদা আদর। বলু কিছু
বলল তো সবাই তা অক্ষরে অক্ষরে মানবে। তবে
ভেটেরিনারি ডাক্তার ছাড়াও বলুকাকার আর একটা বিরাট গুণ আছে। যে কোনো তিথি নক্ষত্রের
অবস্থান বলুকাকা চোখ বন্ধ করে বুঝে বলে দিতে পারে। ঘুম থেকে উঠে সারাদিনের ঘন্টা
মেপে সুলক্ষণ অলক্ষণ বিচার না করে জলটুকুও খায় না বলুকাকা। কোন ক্ষণ, কোন লগ্ন ভালো, কোন লগ্ন ধরলে যাত্রা নাস্তি আর ছেড়ে
গেলে যাত্রা স্বস্তি থেকে শুরু করে দিনের কোন সময়ে জল কলসিতে ধরে রাখলে সে জলে
পোকা হওয়ার সম্ভাবনা কম অবধি বলুকাকা শুধু অঙ্কের হিসেব গুণেই বলে দেয়। তাই
তো শুধু বাড়িরই না, পাড়ার অনেকেরই বিয়ের লগ্ন, পৈতের নিয়ম থেকে শুরু করে কেউ মারা গেলে সময়ের দোষ বিচার অবধি জানার জন্য
বলুকাকাকে ফোন করে নিয়মিত। অনেক সময় শুভকাজের
আগে লোকে নীলকমলদের বাড়িতে গিয়ে বলুকাকার ফোন নাম্বার চায়। একটু সময় বিচার করে
দেওয়ার অনুরোধ আর কি। তা সেই কাকা
বাড়ির মেয়ের বিয়েতে আসবে এ তো স্বাভাবিক!
নীলকমল আবার সেই বাদামখোসার একাগ্রতায়
ফিরে যায়। একটা ডেঁয়ো পিঁপড়ে কুটকুট করে মুখে খাবার
নিয়ে সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। অন্য সময় হলে নীল এখুনি তর্জনী আর মধ্যমার টোকায়
ব্যাটাকে তিন ফুট দূরে পাঠিয়ে দিত। কিন্তু আজ ওসব কিচ্ছু না। বরং নরম চোখে
পিঁপড়েটার দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে, “বড়দির গাছপালা প্রীতি তো তুই জানিস। তাই বড়দি
বলেছে আমার বিয়েতে যেন কোনো একগাদা সবজিপাতি মেনুতে না থাকে। এমনকি পটলের দোলমা কি
আলুদ্দমও না। মানে যতটা সম্ভব কম পরিমাণ গাছপালা হতাহত হবে আর কী! বেগুন ভাজা, কপির রসা, চালকুমড়োর পুর ভরা এসবের নামও যেন না থাকে
এও বলেছে। মেনুতে শুধু মাছ আর মাংস। মাংসের
পোলাও হচ্ছে জানিস? আর ইলিশের বিরিয়ানি। তার সঙ্গে মাছের মাথা
দিয়ে ডাল, ভেটকি ফ্রাই, প্রণ পকোড়া,
চিংড়ি মালাইকারি, ইলিশ আচারি, চিতল কালিয়া, মুর্গি
সদাবাহার, মুর্গ মখমলি, মাটন
বড়া কাবাব, পশতুনি কিমা কিশ... আরও কী কী সব আছে! এমনকি
চাটনিও হচ্ছে পুটি মৌরলা আর মাছের ডিমের বড়া দিয়ে। কেটারার নাকি বলেছে মাংসের
হালুয়ার রেসিপি আছে তাদের কাছে। চাই কি মাংসের হালুয়াও...”
মেনুর শুরুর দিকে লাল গুনতে শুরু করেছিল।
শেষে কেমন ভেবলে গেল।
“এত মাছ এত মাংস মানুষ খাবে কী করে রে?”
“খাবে। সব্বাই খাবে। শুধু আমি খাব না
বুঝলি? খাস তোরা সবাই চেটে পুটে। আমি ঘর থেকেই
বেরোব না। আমার সেদিন জ্বর হবে দেখিস। খুব জ্বর হবে। এত জ্বর হবে যে কেউ জানতেই
পারবে না নীলকমল চক্রবর্তী দিদির বিয়ের দিন ঘরে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে খালি
পেটে...” নিজের সেই ভবিষ্যতের বেচারাথেরিয়াম ছবি ভেবে নীলের নিজেরই চোখে জল এসে
যায়। গলা ভারি হয়ে ওঠে।
“কী ভুলভাল বকছিস বল তো? খাবি না কেন? জ্বরই বা কেন হবে তোর?”
“বললাম না বলুকাকা আসছে? তোর মনে আছে, বলুকাকা আগেই বলেছিল এ বছর আমার পৈতে দেওয়া হবে? কী নাকি এক শুভদিন আছে। কিন্তু পৈতে নিয়ে লোকে যে ছেলেখেলা করে সে সব
বলুকাকা হতে দেবে না। তাই পৈতে হওয়ার ছ’মাস আগে থেকেই আমাকে ব্রাহ্মচর্য পালন
করানো হবে। দ্বিজ হতে গেলে সাত্ত্বিক ভোজন আর সৎ সত্তার উন্মোচন না কি হাতির মাথা
হওয়া জরুরি। আর এই সম্পূর্ণ
সাত্ত্বিক হতে গেলে আমাকে নাকি শুধু শাকসবজি নিরামিষ খাবার খেতে হবে। এছাড়া
ক্রিকেট ফুটবলের মাঠেও নামা যাবে না।”
“অ্যাঁ! পৈতে নিতে গেলে খেলা ছাড়তে হবে? কেন!” লালের মুখখানাও খাবি খাওয়া কই মাছের মতো হাঁ হয়ে যায়।
“কারণ খেলাধুলো করতে শরীরে স্ট্রেন্থ
লাগে আর সে স্ট্রেন্থ পেতে গেলে প্রোটিন খাওয়া জরুরি। কিন্তু
আমার তো আর আমিষ চলবে না। এমনকি ডিমও না। নো ননভেজ, স্ট্রিকটলি। বলুকাকা আমাকে কাল
ফোনেই বলে দিয়েছে। বাবাকেও। অবশ্য এও বলেছে যে ছানা, দুধ, ঘি ইত্যাদিতে যথেষ্ট স্ট্রেন্থ হয়, তবে ওসব
খেয়ে মাঠে নামার থেকে গরু হয়ে ঘাস খাওয়ার জন্য মাঠে চরলেই তো হয়! তাছাড়া মানুষ যে
ভালোবেসে খায়, শুধু শরীরে জোর আনতেই খায় না, সে কথা
বলুকাকাকে কে বোঝাবে!” একটা ভাঙা আধলার কুচি ছাদ থেকে তুলে উলটোদিকের পেয়ারা
গাছটায় ছুঁড়ে দেয় নীল। সন্ধের ঝোঁকে ঘরে ফিরে আসা ঝিমুন্তি পাখিগুলো ক্যাঁ চ্যাঁ
টি ট্যাঁ করে উড়ে যায় একটু দূরে।
ছাদের কোণ থেকে একটা টিকটিকি টিকটিক করে
ডেকে ওঠে।
“শুনলি তো? টিকটিকি ডাকল। বুঝতেই পারছিস একটা কথাও মিথ্যে বলছি না। যাকগে ভাই। তোরা
খাস-টাস। আমি আর ক’টা দিন পরেই দ্বিজ হব। তারপর হয়তো বলুকাকার ওই ভ্রমণানন্দবাবার
কাছে দীক্ষাও হবে। দেখবি বাবা আর জেঠু মিলে আমাকে দেওঘরে গুরুদেবের আশ্রমেই পাঠিয়ে
দেবে। মাথায় টিকি হাতে প্যাঁড়া আর দুধের লোটা নিয়ে তোদের কথা ভাবব বসে বসে...”
“ধ্যাত! ওসব তো অনেক দূরের কথা! দীক্ষা-টিক্ষা
কে নিচ্ছে? টিকি দেওঘর প্যাঁড়া দুধ এসব কী বকছিস? আর এই সব ব্রাহ্মচর্য্য, নিরামিষ ভক্ষণ এসব শুনে
কাকিমা কিছু বলছে না?” লালুর কেমন মায়া লাগে।
“কী জানি ভাই! মা’র তো নাগালই পাই না।
বিয়ের দামামাতেই মেতে আছে। যেন আগে কখনও কারুর বিয়ে হয়নি। অবশ্য বলুকাকার কথা শুনে
বড়োজেঠু বলেছে, বলু তো থাকে আসানসোলে। যখন যখন ও আসবে তখন না হয় নীল নিরিমিষ খাক।
বাকি দিনগুলো এমনিই চলুক। বলুকে না জানালেই হল। কিন্তু
বড়দির বিয়েতে বলুকাকা তো আসবেই। তাই বুঝতেই পারছিস। আমার পেটে ওই ছানার ডালনা কী ধোঁকাই
নাচছে,” চোখটা যেন বিকেলের ম্লান আলোয় আরও বেশি ম্লান দেখায় নীলের।
আকাশে লাল সূর্য অস্তের আলো ফেলে ডুবছে।
ও পাড়ার থেকে একটা ঘুড়ি আকাশের এক্কেবারে ঈশান কোণে একবার তরতরিয়ে ওপরে উঠছে তো
আবার গোত্তা খেতে খেতে নিচে নামছে। নিশ্চয়ই দামি ঘুড়ি হবে। নিচের দিকে লম্বা একটা
ল্যাজ যেটা আকাশের গায়ে সাপের মতো হাওয়া কেটে সরে সরে যাচ্ছে। ঘুড়িটার
দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে লাল হঠাৎ একবার নীলের মাথার দিকেও তাকাল। টিকি? হাতে প্যাঁড়া মাথায় টিকি প্রাণের বন্ধুটিকে ভেবে বড্ড মনখারাপ লাগছিল
লালের। কোথাকার কে বলু চক্কোত্তি আসানসোল থেকে এসে ওর প্রাণের চেয়ে প্রিয় আর
ভাইয়ের চেয়ে আপন বন্ধুটাকে সত্যিই কেড়ে নিয়ে চলে যাবে ভাবতেই পারছিল না লালকমল।
রাতে দিদিই তুলল কথাটা। লাল আর নীল ছাদ থেকে নেমে ঘুড়ির ওপর ঘুন্টির সংসার
দেখেও চুপচাপ। সেই জন্যেই বোধহয় দিদির একটু অবাকই
লেগেছে। ভাইকে সামনে পেয়েই কথাটা তুলল, “হ্যাঁ রে, ঘুন্টি তোদের ঘুড়ির ওপর বাচ্চা নিয়ে গ্যাঁট হয়ে বসেছে দেখেছিস?”
“আবার ঘুন্টি বাড়ির মধ্যেই?? উফ্, বাড়ি নয় তো! যেন বেড়াল উৎপাদন কারখানা হয়ে
উঠেছে এটা...” বাবা গজগজ করে।
“সে কী! ঘুড়ি কেনার পয়সা কিন্তু আমি আর
দিতে পারব না বলে দিলাম,” মা রুটি সেঁকতে সেঁকতে গলা চড়ায়।
“আর ঘুড়ি! ঘুড়ি ওড়ানোর লোকই চলল দেওঘর...”
বোমটা আস্তে করে ফাটাল লাল, “বলুকাকা আসছে আসানসোল থেকে। নীলের পৈতে দিইয়ে আর তার সঙ্গে
সঙ্গেই দীক্ষাও দিইয়ে দেওঘর নিয়ে যাবে।”
“কী উলটোপালটা বকছিস? বলু? মানে ওই ও বাড়ির ছোটো ছেলে বলু? ও কেন নীলকে দেওঘর নিয়ে যাবে?” মা রুটি পাতে দিতে
দিতে ভুরু কোঁচকায়, “নীলের ক্লাস টেন। এর মধ্যে বাড়িতে বিয়ে থা। তারপর আবার বেড়াতে
যাবে নাকি? ইতুর কি এক্কেবারে ছেলেটাকে নিয়ে মাথাব্যথা নেই?
কালই যাচ্ছি আমি।”
“ইতুকাকিমা বোধহয় পাত্তাই দিচ্ছে না মা
ব্যাপারটাকে। কিন্তু বড়ো জেঠু বলেছেন বলুকাকার ওপর কেউ কথা বলবে না। উনি নীলকে
সাত্ত্বিক দ্বিজ বানাতে ছ’মাস নিরামিষ খাওয়াবেন ঠিক করেছেন। অতএব
সেটাই হবে। অবশ্য যখন বলুকাকা কলকাতায় আসবে তখনই। বাকি সময় নীল যা খুশি তাই খাক।”
“ভাগ্যিস বলুদা ঘুন্টির কাকা নয়!” দিদি
ফোড়ন কাটে।
বাবা রুটিতে তরকারি কাচিয়ে তুলে একবার
শুধু বলে, “হুম্। যত পাগলের কীর্তি।”
দেখতে দেখতে বড়দির বিয়ে এসে গেল প্রায়।
মাঝে লালকমল একদিন বড়দিকেই গিয়ে সব বলতে চেয়েছিল। তাতে নীল খেঁকিয়ে উঠল, “বড়দি কী
করবে? আমার জন্য কি মেনুতে সয়াবিনের শিককাবাব আর
পাটপাতার কাটলেট অর্ডার করবে? বড়দির বাবা, মেজজেঠুই বলুকাকার মুখের ওপর কিছু বলছে না তো বড়দি। ফুঃ।”
কথাটা মিথ্যে নয়। ব্যাপারটা নিয়ে কারুরই
তেমন মাথাব্যথা নেই। বরং এর পর নীলের উপনয়নে নতুন মেয়ে জামাইয়ের আসা নিয়ে খানিক হা
হা হি হি হচ্ছে শোনা যাচ্ছে।
এদিকে এ বাড়িতেও লালকমলের মা আর দিদি ও
বাড়ির বিয়ে নিয়ে বেশ মেতে উঠেছে। আনন্দনাড়ু বানানো, জল সইতে যাওয়া, সবেতেই তারাও হাজিরা
দেয়। মাঝে একবার দিদি কাকে যেন জিজ্ঞেস করল বলুকাকা আসবে না? কখন আসবে?
নীল কান খাড়া করে
শোনে বলুকাকা আসছে দুপুরের ট্রেনে। একটা নাগাদ পৌঁছে যাবে নিশ্চয়ই। ওদিকে গায়ে
হলুদের তত্ত্ব আসে। শাঁখ উলুর মধ্যে দিয়ে আসা মাছ, মিষ্টি, দই হাতে হাতে গুছিয়ে
রাখে সবাই। জলখাবারের মেনুতে লুচি, ডিমের কষা, ফিস ফ্রাই
আর রসকদম্ব।
“শুনেছিস? বলুকাকা আসছে দুপুর করে। তুই এখন জলখাবারটা
তো খা! জেঠু তো বলেইছে কাকু না আসা অবধি সব চলবে। আমার ফিশফ্রাইটাও তুই খা,” লাল
জলখাবারের প্লেট নিয়ে নীলকে সাধে।
“যা যা, বিকেলের অত ভালো ভালো খাবারই যখন খাব না তখন সকালেও দুটো চিঁড়ে কি মুড়ি
চিবিয়ে নেব আমি। তুই খা ওসব ভালো মন্দ,” অভিমানে নীলের গলা বুজে আসে।
“কী হচ্ছে শুনি এখানে! খাওয়া নিয়ে
সাধাসাধি? জানিস নীল, দুনিয়ার কত মানুষ জীবনে এসব
খাবার চেখে তো দূর, চোখেও দেখেনি! শিগগির খেতে বোস, আয়,” হুকুমের টোনে শুরু করলেও শেষের দিকে চুন্নিদিদির গলার সুরটা এমন নরম
যেন ঘুন্টিকে খেতে ডাকছে।
নীল দোনামনা করে। রাতের খাবারে তো কিছুই
নেই নিরামিষ তেমন। তাও কপালে জোটে কী না জোটে। ডিমের কষা আর ফিশ ফ্রাইটুকু খেয়ে
নিলে বরং পেটটা ভর্তি থাকে।
“কী হল রে? খা তাড়াতাড়ি! ঠান্ডা ফ্রাই ভালো লাগে নাকি খেতে? লুচিও
তো চুপসে গেল!” দিদি তাড়া লাগায়। এদিকে ফ্রাইয়ের গন্ধটা যেন দু’হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে
ধরছে। অনেকক্ষণ সময় নিয়ে জলখাবারটুকু শেষ করল নীল। বাকি ভাইবোনেরা সবাই এদিক ওদিক
ছড়িয়ে ছিটিয়ে। দিদিরা কে কেমন সাজবে সেই নিয়ে হইচই। চুন্নিদিও নীল খেতে শুরু করেছে
দেখে ওই দলে ভিড়ে গেছে। দূরের আত্মীয়রাও এক এক করে আসতে শুরু করে দিয়েছে। সামনের
দরজা হাট করে খোলা। তারুদের ছাগলটা অন্যদিন সদর খোলা পেলেই ঢুকে পড়ে ভিতরে, কিন্তু
আজ এত লোকজনের আনাগোনার মাঝে কেমন থতোমতো খেয়ে বাইরে থেকে উঁকি দিচ্ছে।
প্যান্ডেলওয়ালা হলুদ আর লাল কাপড়ের ডিজাইন করে তোরণ বাঁধছিল। তাদের মধ্যে একজন
হাতের রশির গোছাটা মাটিতে রাখতেই ছাগলছানাটা মুখটা এগিয়ে বোধহয় শুঁকে দেখে বুঝতে
চাইল বস্তুটা কী। একবার দাঁতও বসাতে যাচ্ছিল। প্যান্ডেলওলার তাড়া খেয়ে পিছিয়ে গেল।
নীল তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে নিজের ভাগের একটা লুচি দিল ওকে। পরম আহ্লাদে খানিক শুঁকে
চেটে শেষে লুচিটা আয়েস করে চিবোতে শুরু করে ছাগলটা। আহা রে, খা, ভালো করে খা... নীল উদার চোখে তাকায়।
লাল আর নীল ঘরেই ছিল। বলুকাকা এল বেলা
আড়াইটেয়। তার আগেই জেম্মা ছোটোদের খেতে বসিয়ে দিয়েছিল। নীলও সবার সঙ্গে ভাত, ডাল, মুড়িঘন্ট, তেলকই, ডাকবাংলো
মুরগি, চাটনি, পায়েস খেয়েছে পেট ভরে।
বলুকাকা এসে বড়োদের প্রণাম-টনাম করেই
নীলুর খোঁজ করল। নীলু সামনে যায়নি। আড়াল থেকে শুনল মেজজেঠু ঘটা করে বলছে, “বলু,
তুই কিন্তু খাবারদাবারের ওখানে থাকবি। অতিথিদের খাওয়াদাওয়া যেন ঠিকঠাক হয়, তোর দায়িত্ব রইল।”
কান থেকে আগুন বেরোয় নীলের। এই মেজজেঠুর
প্রেশারের জন্য নুন খাওয়া বারণ। আলুনি রান্না হয় জেঠুর। কিন্তু মাঝে মাঝে মুখে তার
আনতে জেঠু নীলুকে দিয়েই লুকিয়ে ঝাল কাঁচকলার চিপস, আঙ্গুল ঢোকানো সাবুর পাঁপড়ের প্যাকেট আনায়। নীল ক্কাউকে বলে দেয় না সে
কথা। আর এখন জেঠু সে সব বেমালুম ভুলে গেল? ভুলে গেল বিলুকাকা
খাওয়ার জায়গায় থাকলে নীলের আর খাওয়াই হবে না? রাগে ঘরে এসে
শুয়ে পড়ে নীল। ভাইবোনেদের মধ্যে কে যেন এসে ডাকল একবার।
“ওর ভীষণ মাথা ধরেছে, ডাকিস না,” বলে লাল ভাগিয়ে দিল তাকে।
মাঝে একবার মা-ও এসেছিল ঘরে। নীল মায়ের সঙ্গেও
কথা বলেনি। লাল অবশ্য থাকতে পারেনি। জিজ্ঞেস করল, “ইতুমাসি, নীলকে সত্যিই বলুকাকা নিরামিষ খাওয়াবে নাকি ধরে?”
“কী জানি বাপু! বলুকে কিছু বললেও কি সে
শোনার ছেলে? শেষে কাজের বাড়িতে চিল্লিয়ে রেগে এক
হাঙ্গামা করবে। তার চেয়ে আমরা নিচের রান্নাঘরে নীলুর খাবারটা গুছিয়ে এনে রাখব। তুই
চাইলে তোরটাও। দু’জনে না হয় ওর চোখের আড়ালে নিচে বসে খেয়ে নিস। খাবার ঘরে দেব না।
বলুর চোখে না পড়লেই হল তো। ব্যস। তারপর বলুকে বুঝিয়ে বলব ‘খন আমরা। এই ব্যস্ততার
মধ্যে আর ঝামেলা করে কাজ নেই, বুঝলি না?”
শুনতে শুনতে নীল বালিশে মুখ গুঁজে দাঁত
কিড়মিড় করে। সারা দুনিয়ার লোক ছাদের ম্যারাপের নিচে ঝকঝকে আলোয় পাত পেড়ে গুছিয়ে
খাওয়াদাওয়া হই চই করবে আর ও খাবে নিচে ওই ঝুল পড়া মিটমিটে লাল আলোর রান্নাঘরে লুকিয়ে
লুকিয়ে? কেন? চোর নাকি ও?
খাওয়াটাই কী সব? একসঙ্গে হইচই করে বসার
আনন্দটা যে মাটি হচ্ছে সে বেলা? এদিকে মা ঠাম্মা দু’জনেই বলে,
‘সত্যির জয় সবসময় নীল। ন্যায়ের জয় সর্বত্র।’ তা এই কি ন্যায়? দিদির বিয়েতে ভাইকে ভালোমন্দ না খেতে দেওয়া? খেলেও
তা লুকিয়ে চোরের মতো অন্ধকারে? তার চেয়ে তারুদের ছাগলটার মতো
বাইরে গিয়ে দাঁড়াক না কেন নীল? ভাঙ্গা থালায় চারটে খাবার এনে
নামিয়ে দিক সামনে!
রাগে অভিমানে নীল ঠিক করে ফেলে করুক সবাই
হইচই। গিলুক যত খুশি। আজ রাতে যখন বিয়ে নিয়ে সবাই মত্ত থাকবে তখন নীল চুপচাপ চলে
যাবে এ বাড়ি ছেড়ে। এ সংসারে কেউ নেই ওর। লালের জন্য খারাপ লাগবে ঠিকই, তা সে ধীরে
ধীরে সয়ে যাবে নিশ্চয়ই। ভাবতে ভাবতে মন খারাপ বলেই বুঝি নীল একসময় ঘুমিয়েই পড়ে
নিজের বিছানায়।
ঘুম যখন ভাঙল তখন গোটা বাড়ি ঝলমল করছে।
দরজার সামনে নহবত। তার ওপরে বসে দুটো লোক কী করুণ একটা সুর বাজাচ্ছে সানাইয়ে। জুঁই, বেলির মালা আর পারফিউমের গন্ধ এ ওকে টেক্কা দিয়েছে। এ ঘরেও নিশ্চয়ই সাজগোজ
করে গেছে কেউ কেউ। এদিক ওদিক ছেঁড়া ফুল, মালা থেকে খুলে পড়েছে
নিশ্চয়ই। ড্রেসিং টেবিলের ওপর পাফ থেকে ঝরে পড়া পাউডারের গুড়ো... লাল
নেই ধারে কাছে কোথাও। নীলের পরনে সকালের শার্ট, কোঁচকানো, ঘুম চোখে খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল নীল। মা বিছানায় পাজামা পাঞ্জাবি
গুছিয়ে রেখে গেছে। দিদির বিয়ে বলে কথা। নতুন মেটে রঙের পাঞ্জাবি, সাদা পাজামা। বউভাতে
তো নীল ধুতি পরবে ঠিক করেছিল। কিন্তু এখন কী কর্তব্য? উঠে ফ্রেশ হয়ে
রেডি হবে নাকি মুখ বুজে ঘরে দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকবে, সে নিয়ে মনে বেশ দ্বিধা। বাইরে
হইচই হচ্ছে। বড়দিকে নিশ্চয়ই লাল টুকটুকে বেনারসিটা পরিয়ে দেওয়া হয়েছে। গায়ে হলুদের
সময় ওরা সবাই হলুদ জামা পরে বড়দিকে ঘিরে ছবি তুলল। এখন
তো আরও কত কত ছবি উঠবে।
“আর সে ছবিতে তুমি থাকবে না। অনেক কাল পরে
যখন লোকে জিজ্ঞেস করবে বড়দিদির বিয়েতে নীলকমল নেই কেন, তখন সবাই জানবে নীলকমল
তুচ্ছ খাবারের কথা ভেবে দিদির বিয়েতে একটুও আনন্দ করেনি...”
নীল চমকে ঘুরে দাঁড়ায়। কে বলল কথাটা? ঘরে তো কেউ নেই। কেবল দেওয়ালে বুড়ো ঠাকুদ্দাদাদু, যিনি
আসলে নীলের বাবার ঠাকুর্দা, তাঁর ছবিটি ঝকঝক করছে। কাজের
বাড়িতে ছবিগুলো মুছে তকতকে করা হয়েছে। গলায় আজ একটা মালাও জুটেছে। তাই বুঝি বুড়োর
মুখেও কথা এত! নীল আপনমনে হাসে। আসলে ঠাকুদ্দাদাদু নন, নীলের
নিজের মনের মধ্যেই এই কথাটা বার বার জাগছে। শেষে বুঝি বিবেকের কাছে হেরে গিয়েই নীল পাজামা
পাঞ্জাবি গলায়। সঙ্গে একটা উত্তরীয়ও রেখেছে মা। বড়ো
আয়নায় নিজেকে দেখে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে নীল নিজেই নিজেকে বলে, ‘বাহ, বেশ দেখাচ্ছে কিন্তু!’
দরজার ওদিক থেকে কেউ ধাক্কা দেয়। খিল
খুলে দেখে লালকমল। সত্যিই লালকমল যেন। লালচে মেরুন পাঞ্জাবি আর কালো চুড়ি দেওয়া
পাজামায় ছোটোখাটো চেহারার লালকে দেখাচ্ছে যেন কার্তিক ঠাকুরটি।
“বাহ, তৈরি হয়ে গেছিস? চল চল। গুড যে তোর রাগ ভেঙ্গেছে। নিচে যাবি?
সবার গায়ে আতর মেশানো জল ছিটিয়ে দিচ্ছে নিচে গেলেই। বরযাত্রীদের
জন্য ব্যবস্থা, কিন্তু সে আর কে মানছে!” লাল অফুরান উৎসাহে বলতে থাকে।
সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামার মধ্যে কত রকমের রং, কত রকম সুবাস আর কত ধরনের হাসি! নীল আর লাল পায়ে পায়ে ওপরে ওঠে। ছাদনার
নিচে বড়দি বসে আছে। দেখাচ্ছে যেন দুর্গা প্রাতিমাটি। সবাই সবাইকে দেখে অবাক হচ্ছে,
খুশিও! দ্বারভাঙ্গার রাঙ্গামেসো আর পাইকপাড়ার ছোটো পিসেমশাই একটু
দূরে দাঁড়িয়ে কোনো সিরিয়াস বিষয় নিয়েই আলোচনা করছে বুঝি। মুখ দেখে তো তাই মনে
হচ্ছে। নীলের মা বিয়ের আসরেই কীসব গোছগাছ করে দিচ্ছে পুরুতমশাইয়ের হাতে হাতে
আর তার খোঁপাতে দায়িত্ব নিয়ে জুঁইয়ের মালাটি কাঁটা দিয়ে গুছিয়ে সাজিয়ে দিচ্ছে
লালের মা। নীল আর লাল পায়ে পায়ে কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই বড়দি মুখ ভার করে তাকাল, “আমার
বিয়ে বসে যাচ্ছে আর তুই ঘুমোচ্ছিলি নীল? মনে থাকবে আমার।”
নীলের মনটা ভার হয়ে আসে। ভাগ্যিস রাগ-টাগ
ভুলে ওপরে এল। বড়দি যে নিজের বিয়ে বলে আমাকে একেবারে ভুলে বসে নেই সেটা তো জানা
গেল অন্ততঃ।
“ওমা নীল! উঠেছিস বাবা? মাথা ব্যথা কমল?” জেম্মা কেমন আটপৌরে করে একটা দামী
জরিওয়ালা শাড়ি পরেছে!
“কমেছে জেম্মা। তোমাকে খুব সুন্দর
দেখাচ্ছে,” নীল হাসে। এই সব মানুষগুলোকে ছেড়ে চলে যাবে?
বলুকাকুর জন্য? জেম্মার কষ্ট হবে না? মা
দুশ্চিন্তা করবে না? কত বুদ্ধি করে আমাকে রান্নাঘরে বসিয়ে
ভালোমন্দ খাওয়াতে চাইল মা! আমি চলে গেলে কি মা খুব কাঁদবে? নাকি
মেজদি, মঘাই, রাপুনদের নিয়ে ভুলে থাকবে
নিজের ছেলেকেই?
ওপাশে খাবার জায়গা। মাঝে বড়ো করে পর্দার
পার্টিশন। পায়ে পায়ে লাল আর নীল ওদিকে যায়। বেঞ্চ-টেঞ্চ মুছে তার ওপর দিয়ে কাগজের
রোল গড়িয়ে দিচ্ছে একটা লোক। বিয়েবাড়ির এত জাঁকজমকের মধ্যে লোকটার পরনে একটা ময়লা
জামা আর পাজামা। যদিও কোমরে বাঁধা গামছাখানা এক্কেবারে নতুন।
বলুকাকা লোকজনকে ডেকে ডেকে বোঝাচ্ছে খাবার
যেন বার বার জিজ্ঞেস করে দেওয়া হয়। নীলের দিকে চোখ পড়তেই এগিয়ে এল, “এই যে নীলবাবু, রেডি তো? দিদির বিয়ে বলে কথা! তবে হ্যাঁ, যেটা সকালে তোকে জিজ্ঞেস করা হয়নি... খাবার নিরামিষ খাচ্ছ তো? ক’টা মাস একটু কৃচ্ছসাধন... তারপর...”
“তারপর পৈতে ছিঁড়ে ব্রহ্মশাপ, তাই তো?” লাল পাশ থেকে মজার গলায় বলে।
“অ্যাঁ! শাপ কী রে! দেখবি, আমি প্রমাণ করে দেব শাস্ত্রবিধি মেনে উপবীত ধারণ করলে মানুষ কতভাবে দৈব শক্তির
আধার হয়ে উঠতে পারে।”
তুমি পারো? নীল হঠাৎ যেন আক্রমণ করে বসে... বলুকা? তুমি পারো
দৈবশক্তি দেখাতে?
ধুস, আমি বাপ মা মরা। আমার আবার পৈতে কবে হল? তবে হ্যাঁ, আমি
বহু পুঁথি ঘেঁটেছি বুঝলি? সবেরই সার কথা হল ফলো দ্য রুল। এই
যে এখন দেখছিস বিয়ের নিয়মকানুন। এসব কী? সবই তো ফলোইং রুলস্...
ছাদের ওদিক থেকে দমকা হাওয়া দেয়।
প্যান্ডেলের কাপড় অল্প উড়ে পোলাওয়ের সুঘ্রাণটুকু এদিকে ঠেলে দেয়।
চল নিচে যাই... লাল নীলের হাত ধরে টানে।
বিয়ের কাজ প্রায় শেষ। বড়দিকে ভারি মিষ্টি
মতো বউ বউ দেখাচ্ছে। নীল একটু আগেই চুপচাপ উঠে এসে দেখছিল। কাল
বড়দি চলে যাবে। তারপর যখন আবার আসবে, শুধু মা জেঠিমাদের সঙ্গে গিয়ে গল্প করবে
হয়তো। এই তো বিয়ের ক’দিন আগে থেকেই বড়দি ভাইবোনদের একেবারে পাত্তাই দিত না। তবে
পরশু বড়দি বলছিল ভাইবোনেদের মধ্যে যে সব থেকে বেশি যত্ন নিতে পারবে ঘরের গাছগুলোর
তাকে বড়দি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসবে। নীল জানে ও পারবে না। এসব যত্নটত্ন ওর
এক্কেবারেই আসে না। তাছাড়া ও তো আর এদের মধ্যে থাকবেও না। আর কিছুক্ষণ মাত্র। লাল
একটু আগেই বলছিল খেয়েদেয়ে বাড়ি যাবে একবার। নীল লালকে বলেছে ওপরেই খেতে। নীলের
এমনিতেই খিদে নেই। লাল সে সব পাত্তা দিচ্ছে না এখন। মন দিয়ে মেয়েদের হইচই দেখছে।
“অ্যাই, তোরা এখানে! চল চল খেতে বসবি,” হঠাৎ মা এসে নীলের হাত ধরে।
“আমি? খেতে বসব? বলুকা?” নীল একটু থতোমতো
খেয়ে যায়।
“ছাড় তোর বলুকাকা। চল খেতে বসবি,” মা ধমক
দেয়।
“না, আমি খাব না। আমার খিদে নেই একদম,” নীল গোঁয়ারের মতো পা চেপে দাঁড়িয়ে থাকে।
“খাবি না? এত করে বুদ্ধি করে আমি আর চুন্নি মিলে প্ল্যান করলাম...”
চুন্নিদির সঙ্গে কী প্ল্যান? নীল সজাগ হয়। লালের মুখ দেখে কেমন সন্দেহ হয়। মিটিমিটি হাসছে নাকি?
“আগে খেতে বোস, বলব পরে...” লাল এবার হাত ধরে টান দেয়।
ওদিকে চুন্নি বলুকাকাকে সঙ্গে নিয়ে
বাড়ির কড়া নাড়ে। লালের বাবা দরজা খুলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন, “এসেছিস? উফ্, সেই থেকে কেঁদেই চলেছে, বাপ রে বাপ। বলু! দ্যাখো
তো শিগগির গিয়ে কী ব্যাপার।”
বলুকাকা হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে ঢোকেন। টানা
বারান্দার এক কোণে ফুলতোলা আসনে একটা গাবলু মতো মেনি বেড়াল শুয়ে। মাঝে মাঝেই একটা
কান্নার সুর বেরোচ্ছে গলা দিয়ে।
“এই দেখ বলুকাকা, ঘুন্টি কেমন কেঁদেই
চলেছে। আর কেবল বমি সেই বিকেল থেকে...”
ঝটপট করে বলুকাকা হাঁটু গেড়ে বসে। অন্ধকার
বারান্দায় তেমন কিছু দেখাই যায় না। এদিকে
বিয়েবাড়ির ধুতি পাঞ্জাবি পরেই এসেছে। পকেটে টর্চও নেই। বলুকাকা হতাশ হয়ে চুন্নিকেই
বলে, “একটা টর্চ কি মোমবাতি নিয়ে আয় দেখি। এভাবে তো কিছু দেখাই যাচ্ছে না রে...”
প্রায় মিনিট চল্লিশ পরীক্ষা নিরীক্ষার পর
বলুকাকার মুখে হাসি ফোটে, “ঘুন্টি ঠিকই আছে বুঝলি? এই দ্যাখ, ল্যাজের নিচে কি একটা ক্লিপ আটকে গেছে বলে
ব্যথায় কাঁদছিল। আর বমি হচ্ছে মনে হয় কিছু উলটোপালটা খেয়ে। আজ তো নয়ই, কাল দুপুর অবধি কিচ্ছু খেতে দিবি না। শুধু জল, স্রেফ
জল ডায়েট বুঝলি? নে নে ধর... এটা কী অ্যাঁ? কাপড় শুকোনোর ক্লিপ নাকি? গৌরীদির কান্ড আর কী!
বেড়ালের ল্যাজে ক্লিপ লাগিয়ে টাঙ্গাতে গেছিল বোধ হয়... চল দেখি।
ওদিকে বোধহয় বরযাত্রীদের খাওয়া হয়ে গেল এর মধ্যে। যাক গে। সবার আগে আমি ভেটেরিনারি
ডাক্তার। এসব হল ডিউটি কলস্। একে তো অবহেলাও করা যায় না! চল চল পা চালিয়ে এবার...”
বকবক করতে করতে বলুকাকা লম্বা পা ফেলে হাঁটা দেয়। পিছনে পিছনে শাড়ির কুঁচি আঁচল
সামলেসুমলে চুন্নিও।
রাতে বাসরে ছোটোকাকা গলা খুলে গান গায়।
ভয়ংকর বেসুরো সে গান শুনে নতুন জামাইবাবু বায়না করে এই যদি গান হয় তো আমিও বেতালা
তবলা বাজাব।
নীল এক ফাঁকে মা-কে চেপে ধরে, “বলো এবার, কী প্ল্যান? কী করেছ চুন্নিদির সঙ্গে মিলে?”
মা ফিক করে হাসে। তারপর নীলের যত্নে
আঁচড়ানো চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলে, “তুই বুঝি ভাবছিলিস সত্যিই মা তোকে নিচের
রান্নাঘরে পিঁড়ি পেতে খেতে দিয়ে নিজে মজা করে ওপরে পোলাও কালিয়া খাবে?”
“তুমিই তো বললে তখন তাই,” নীল অবাক হয়ে
তাকায়। লাল পাশে এখনও দাঁড়িয়ে হাসি মুখে।
“তুই তো রেগে মেগে ঘুমিয়ে পড়লি। লাল তখন
চুন্নিকে ডেকে নিয়ে এল। আমি লাল আর চুন্নি মিলে ঠিক করলাম বলুকে খাবার
সময় ছাদ থেকে সরাতে হবে। ভেবেচিন্তে চুন্নিই বলল বলুকাকা তো ভেটেরিনারি ডাক্তার।
ঘুন্টির জন্য বলুকাকাকে আমাদের বাড়িতে কিছুক্ষণের জন্যে নিয়ে যাওয়া যায় না? তা
নিয়ে তো যাবে, কিন্তু কেন? আমার মনে
পড়ল, গৌরী বলেছিল ঘুন্টির জন্য নাকি কী সব প্রোটিন-মোটিন এনেছিল। সে জিনিস ঘুন্টির
পেটে সয়নি মোটেই। চুন্নিকে জিজ্ঞেস করলাম, ওটা খেলে ঘুন্টির প্রাণসংশয় হতে পারে কি? চুন্নি বলল, না না, একটু বমি পেট খারাপ হতে পারে
শুধু। ব্যস, প্ল্যান তৈরি। চুন্নি সন্ধেবেলায় বাড়ি থেকে সেজেগুজে বেরোনোর সময় ঘুন্টিকে
আধ কাপ ওই প্রোটিন খাইয়ে এসেছিল। জোলাপের মতো আর কি। আর টুক করে একটা কাপড় শুকোনোর
ক্লিপ ওর ল্যাজে আটকে দিয়েছিল যাতে ল্যাজ ছাড়ানোর জন্য ঘুন্টি একটু বেশি ডাকাডাকি
করে। বুঝতে পারছিস তো? তোকে বঞ্চিত না করার জন্য ঘুন্টিকে আজ একটু কষ্ট দিতে হয়েছে আমাদের...
বেড়ালের শরীর খারাপ শুনেই বলু হুড়মুড় করে ও বাড়ির দিকে হাঁটা দিল তো!”
ইসসস্... ক’দিন আগেই ঘুন্টির ওপর কী
রেগেই না গেছিল নীল। আর চুন্নিদিদি! সে তো সারাদিন খালি পড়া নিয়ে টিকটিক করে। তায়
ঘুন্টি অন্ত প্রাণ। সেই চুন্নিদিদি নীলের জন্য এত কিছু করেছে! ভেবেই কেমন
আশ্চর্য লাগে।
“তবে হ্যাঁ, লাল আমাদের না বললে আমরা কিন্তু জানতেই পারতাম না যে তুই বলুর কথাগুলো
ভেবে ভেবে কষ্ট পাচ্ছিলি এত।”
নীল মিটিমিটি হাসে। লাল ওর সিক্রেট ফাঁস
করে দিয়েছে বটে, তবে আরও একটা সিক্রেটের খবর জানিয়ে দিয়েছেও বটে। মা তো মা-ই, কিন্তু চুন্নিদিদিও যে নীলকে এত ভালোবাসে তা কি ও আগে কখনও জানত?
পরের দিন কাঁদতে কাঁদতে গাড়িতে ওঠার সময়
বড়দি ভিড়ের মধ্যে থেকে নীলকে ডেকে নেয় হাত নেড়ে। কাছে যেতে কানে
কানে বলে, “মন খারাপ করিস না। বলুকাকাকে আমি বলে দিয়েছি শুধু পৈতের ক’টা দিনই ওসব
নিয়মকানুন। এ ছাড়া আমার ভাইকে কেউ যদি নিরামিষ খাইয়ে রাখে তো আমি জীবনে বাপের বাড়ি
আসব না, ব্যস।”
ফুল দিয়ে সাজানো গাড়িটা যখন বড়দি আর নতুন
জামাইবাবুকে নিয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে, নীল তখন লালের দিকে
তাকিয়ে ফিকে হাসে, তারপর আস্তে আস্তে বলে, “দিদিগুলো একদম মায়ের মতো হয়, না রে?”
_____
ছবিঃ সুমিত রায়
আমার ছোটবেলায় আমার ছোটপিসিমণি র বিয়ে মনে পড়িয়ে দিলেন। বিয়ে মানেই ত উৎসব আর ছোটদের হই হুল্লোড়, মান অভিমান। খুব মনকেমনিয়া গল্প আপনার।
ReplyDelete