ইন্দিরা
মুখোপাধ্যায়
অনেক দিন
আগে তিব্বতের স্নালং নামে এক শহরে বাস করতেন সে দেশের রাজা জেন্ডং। রাজার মৃত্যুর
পরে তাঁর ছেলে গেনচগ সেই রাজ্য শাসন করতে থাকলেন। দরবারে তাঁর দু’জন প্রধান
হস্তশিল্পী মানুষ ছিল। একজন চিত্রশিল্পী আরেকজন কাঠমিস্ত্রি বা ছুতোর। রাজা এদের
দু’জনের সূক্ষ্ম হাতের কাজের খুব পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। অথচ এই শিল্পী এবং ছুতোর মোটেও
পরস্পরের বন্ধু ছিল না। চিত্রশিল্পী ছুতোরকে খুব ঈর্ষা করত।
একদিন সেই
চিত্রশিল্পী রাজা গেনচগকে গিয়ে বলল, “গতকাল রাতে আমি এক স্বপ্ন দেখেছি রাজামশাই।
আপনার বাবা রাজা জেন্ডং স্বর্গ থেকে এক পরিকে পাঠিয়ে আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। আমিও
গেছি আপনার বাবার কাছে সেই পরির সঙ্গে। গিয়ে দেখি আপনার বাবা আরও ধনী হয়ে গেছেন
স্বর্গে গিয়ে। উনি আমাকে একটি চিঠি দিয়ে বলেছেন আপনাকে দিতে। এই নিন রাজামাশাই, এই
সেই চিঠি।”
রাজা গেনচগ
বললেন, “বেশ।
এবার পড় দেখি চিঠিতে কী লিখেছেন আমার স্বর্গত বাবা।”
চিত্রশিল্পী
পড়ে বলল, “চিঠিখানি ঐ ছুতোর মিস্ত্রিকে নিয়ে।”
সেই শুনে
রাজা বললেন,
“দেখি দাও আমার হাতে।”
চিঠি খুলে
রাজা পড়তে লাগলেন। সেখানে লেখা ছিল -
‘গেনচগ, শুনতে
পাচ্ছ? আমি, তোমার
বাবা বলছি। স্বর্গে এসে আমি খুব বড়োলোক হয়ে নতুন জীবন যাপন করতে শুরু করেছি। আগের
জীবনে যা কিছু পাইনি সব পেয়েছি এখানে এসে। শুধু আমার একটি ইচ্ছে এখনও পূর্ণ হয়নি।
আমি ভেবেছিলাম স্বর্গে একটি সুন্দর মন্দির তৈরি করব। সব দেবদেবীরা বাস করবেন সেই
মন্দিরে। কিন্তু এখানে তেমন সুদক্ষ ছুতোর নেই যে বানাবে অমন এক মন্দির। সুতরাং
শহরের সবচেয়ে নিখুঁত সেই কাঠমিস্ত্রিকে এই চিত্রশিল্পীর সঙ্গে যদি তুমি পাঠিয়ে দাও
এখানে। তাই এর হাত দিয়ে তোমাকে আমি চিঠি পাঠালাম।’
গেনচগ ভাবলেন, এ আমার বাবার লেখা চিঠি হতে বাধ্য! বাবা চিরকাল একটা সুন্দর
মন্দির বানানোর চেষ্টায় থাকতেন। অতএব আমার এ ব্যাপারে শীঘ্রই কিছু করা উচিত।
এই ভেবে তিনি তাঁর প্রিয় ছুতোর মিস্ত্রিকে ডেকে তাঁর বাবার
ইচ্ছার কথা জানালেন। বললেন, “আমার বাবার ইচ্ছা পূর্ণ করতে তুমি শীঘ্র স্বর্গের পথে পা
বাড়াও।”
ছুতোর ভাবল, এ কী আজব কথা বলছেন রাজামশাই! বাস্তবে
সে কখনও সম্ভব? এ
নিশ্চয়ই ঐ আর্টিস্টের কোনও কুমতলব। আমার সঙ্গে ওর মোটেও পটে না। তাই আমাকে ও এই রাজ্য
থেকে সরিয়ে দিতে চাইবার ফন্দি আঁটছে।
ছুতোর রাজার সামনে কিছু প্রকাশ করল না, তবে বলল, “বেশ, তাই হবে রাজামশাই।
কিন্তু সেখানে আমি পৌঁছব কেমন করে? সে তো শুনেছি অনেক দূর। সাধারণ মানুষ যেতে পারে না সেখানে।”
তখন রাজা গেনচগ তলব করলেন সেই চিত্রশিল্পীর। বললেন, “কেমন করে ছুতোরকে আমার
বাবার কাছে পাঠানো যায়? তোমরা তার সব ব্যবস্থা করে ফেল।”
দুষ্টু চিত্রশিল্পী বলল, “ছুতোর
সব যন্ত্রপাতি নিয়ে আসুক তবে। একটা কাঠের পাটাতনে সব রেখে তার ওপরে তাকে বসতে হবে।
এবার সেই কাঠে অগ্নিসংযোগ করলেই সেই ধোঁয়ায় ছুতোরও ক্রমশঃ ধোঁয়ার সঙ্গে আকাশের
দিকে উঠতে থাকবে। আর আকশের দিকেই তো স্বর্গের পথে যেতে হয় শুনেছি।”
ছুতোর সব
শুনে বলল,
“বাহ!
এ দেখি দারুণ প্রস্তাব! কিন্তু একটা কথা আছে ভায়া। আমি আমার
নিজের জায়গা থেকে যাত্রা শুরু করব। আমাকে সাত দিন সময় দেওয়া হোক।”
রাজা বললেন, “বেশ
তাই হবে।”
ছুতোর
বাড়িতে ফিরে তার বউকে সব কথা খুলে বলল।
তার বউ বলল, “আমি
জানতাম ঐ লোকটা একদিন ঠিক তোমাকে খুন করার ফন্দি বের করবে।”
ছুতোর বলল, “আজ
থেকেই কাজ শুরু করে দিতে হবে, বুঝেছ?” এই বলে
নিজের ঘরের নিচ থেকে একটা সুড়ঙ্গ কেটে ফেলে তাকে যে স্থানে পোড়ানো হবে সেইখান অবধি
তার নির্গমন পথ রাখল।
সাতদিন কেটে
গেল। রাজা গেনচগ ছুতোরকে খবর দিলেন, আর তার লোকজনদের বললেন কাঠের গুঁড়ি, জ্বালানোর
তেল সব জোগাড় করে রাখতে। একটি চারকোনা গঠন বানানো হল সেই কাঠ দিয়ে। মধ্যিখানে হবে
ছুতোরের বসার জায়গা। আর তার চারকোনায় স্তূপীকৃত কাঠকুটো রাখা থাকল। যথাসময়ে ছুতোর
সেখানে বসে পড়ল তার সব যন্ত্রপাতি নিয়ে। এবার তেল ঢেলে দিল রাজার লোকজনেরা। সেই
আর্টিষ্টের তখন মনে আনন্দ আর ধরে না। এবার যেইমাত্র অগ্নিসংযোগ করা অমনি পা পিছলে
ছুতোর ঝাঁ করে সেই সুড়ঙ্গের মধ্যে পড়ে গেল, আর সোজা তার ঘরের মধ্যে গিয়ে পড়ল।
চিত্রশিল্পী তখন জোরে হাততালি দিয়ে বলল, “এবার দেখ সকলে, এই
ধোঁয়া কেমন আমাদের ছুতোর বন্ধুকে স্বর্গের দিকে নিয়ে চলে।” অথচ ততক্ষণে সেই ছুতোর
নিজের ঘরের মধ্যে বানানো আরেকটি অন্ধকার ঘরের মধ্যে গিয়ে ঢুকে পড়েছে। ঘরে যেতেই
তার বউ বলল,
“কী গো! এত নোংরা মেখে এসেছ, এবার স্নান করে কাচা জামাকাপড় পরে
নাও।” ছুতোর বলল, “দাঁড়াও, দাঁড়াও। আগে রঙ্গ তামাশা দেখি।”
এভাবে সেই
অন্ধকার ঘরে তিন মাস ধরে থাকতে থাকতে ছুতোর ধবধবে ফরসা হয়ে গেল। তিন মাস পরে সে
একদিন নিজের সবচেয়ে দামী, রেশমের ওপর জরির কাজ করা চকমকে
পোষাকটি পরে রাজার দরবারে এল। তার হাতে ছিল রাজার জন্য লেখা একটি চিঠি।
রাজা বললেন, “বাহ!
বেশ,
বেশ। পড় দেখি বাবা কি লিখে পাঠিয়েছেন
এবার?”
রাজামশাইয়ের সামনে ছুতোর জোরে জোরে চিঠিখানি পড়তে শুরু করে
দিল -
‘স্নেহের গেনচগ,
তোমাকে সকলে সুশাসক বলে জানে। তুমি ভালোই দেশ পালন করছ।
তুমি আমার কথামতো যে ছুতোরকে মন্দির বানানোর জন্য পাঠিয়েছিলে সে তাঁর কাজ সুষ্ঠুভাবে
শেষ করেছে। খুব সুন্দর মন্দির নির্মাণ করেছে সে। এবার তুমি দেখ, সে
পৃথিবীতে ফিরে গিয়ে তার পুরস্কার পাবে। এবার মন্দিরের গায়ে চিত্রকল্প ফুটিয়ে তোলার
জন্যে তোমার রাজ্যের দক্ষ চিত্রশিল্পীকে আমার কাছে পাঠাতে হবে বাবা। নয়তো এ
মন্দিরের কাজ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ঠিক যেমনিভাবে তুমি ছুতোরকে এখানে পাঠিয়েছিলে,
ঠিক তেমন করেই চিত্রশিল্পীকে পাঠিয়ে দিও কিন্তু।
ইতি তোমার বাবা।’
ছুতোর আরও বলল, “রাজামশাই,
কী অপূর্ব জায়গায় থাকেন আপনার বাবা, আর
কী বিশাল বড়োলোক উনি। ওনার কাছে আপনি আর কী! ওনার ধন দৌলত,
প্রভাব প্রতিপত্তি দেখবার মতো। ওনার
উচ্চাকাঙ্ক্ষা আমি পূর্ণ করেছি বলে আমাকে উনি কত কিছু দিয়েছেন।”
ছুতোরের গায়ের চামড়া দেখে চিত্রশিল্পীর সন্দেহ হল। আগুনে
পুড়ে গিয়ে কারও এমন হয় নাকি? সে নিশ্চয়ই স্বর্গ অবধি পৌঁছাতে পারেনি।
অর্ধেক রাস্তা গিয়ে সে ফিরে এসেছে। তবে ছুতোরের গলায় প্রবালের মালা আর তার রাজকীয়
পোশাক দেখে মনে হল, একবার চেষ্টা করলেই হয়। ও ব্যাটা কী সুন্দর ঝকমকে সব পোশাক
পরে আছে আর আমি সাদামাটা পোশাক পরেই কাটিয়ে দিলাম জীবন।
তাকেও সাতটা দিন সময় দেওয়া হল। আগের বারের মতো কাঠ, তেল
সব একত্রে জড়ো করল রাজার লোকজনেরা। যখন সেই সময় এগিয়ে এল,
অগ্নিসংযোগের ঠিক পূর্বমুহূর্তে ছুতোর
বলল, “এবার আমাদের একটু গান শোনা যাক। এবার আমাদের আর্টিষ্ট স্বর্গে
চড়বেন।”
সকলে মিলে ড্রাম, হর্ণ,
ট্রাম্পেট নিয়ে গান শুরু করে দিল।
অগ্নিসংযোগ করতেই সেই দুষ্ট চিত্রশিল্পী পুড়ে ছাই হয়ে গেল। কিন্তু এত নাচাগানার
মধ্যে কেউ শুনতেও পেল না চিত্রশিল্পীর চিত্কার। আগুনের কালো ধোঁয়ায় চারিদিক
অন্ধকার তখন। কেউ কিচ্ছুটি দেখতেও পেল না। প্রকৃতপক্ষে সেদিন সত্যি সত্যি সেই
দুষ্ট চিত্রশিল্পীর ভয়ানক স্বর্গবাস হল বটে!
(তিব্বতের কিংবদন্তী অনুসরণে)
_____
ছবিঃ আন্তর্জাল
ছবিঃ আন্তর্জাল
No comments:
Post a Comment