লিরিকদার হোপ নাইট
অভিষেক সেনগুপ্ত
এক
একসময়
কালো চামড়ায় মোড়া ছিল রিভলভিং চেয়ারটা। এখন ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। হেডবোর্ডটা ভাঙা।
জায়গায় জায়গায় চামড়া ফেঁসে গিয়ে ফোম বেরিয়ে পড়েছে। বাঁদিকেরটা অটুট থাকলেও ডান
হাতলটা ঝুলছে মন্দিরের ঘণ্টার মতো। দড়ি-টড়ি
দিয়ে ম্যানেজ করার চেষ্টা হয়েছিল। লাভ হয়নি। চেয়ারটাতে বসলেই
বিশ্রী ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ হয়। হাউজিং
কমপ্লেক্সের কোনও ফ্ল্যাট থেকে এটা বাতিল হওয়ার
পর আমাদের ক্লাব ‘দিনরাত’-এ তুলে
এনেছে লিরিকদা। তারপর থেকে এটাই ওর সিংহাসন। লিরিকদা
ছাড়া কারও এতে বসার অনুমতি নেই। ও ক্লাবে না থাকলেও আমরা বসার ঝুঁকি
নিই না। কে বলতে পারে, হয়তো তখনই দেহত্যাগ করে বসল চেয়ারটা!
ওই কালো
চেয়ারের দিকে এখন আকুল তাকিয়ে রয়েছি আমরা। সামু, কচা, অরি, বাপ্তু, বাপন, সুবায়ু, মৌদি, সুমিরা একটু দূরে অর্ধচন্দ্রাকারে
মেঝেতে বসে। যে লিরিকদা এই চেয়ার ছাড়া
বসে না, সেও পর্যন্ত মাটিতে ঠাঁই নিয়েছে। লজঝড়ে চেয়ারটার বেঁচেবর্তে থাকা বাঁ হাতলটা ধরে পরম যত্নে দোল দিচ্ছে লিরিকদা। ডানদিকে
আমি। একটা হাতপাখা নিয়ে হাওয়া করছি। লিরিকদার
চেয়ারটা জুড়ে এখন একরাশ কাশফুল ফুটে রয়েছে। গুটিসুটি মেরে পরম
নিশ্চিন্তে শুয়ে রয়েছে তুলোর মতো সাদা লোমওয়ালা একটা কুকুর। সামনের দুটো পায়ের ওপর
মুখ রেখে সুখনিদ্রা দিচ্ছে সে। আর আমরা তার দিকে তাকিয়ে রয়েছি নির্নিমেষে।
ঘণ্টা খানেক আগেও জানতাম না আমাদের এতখানি কুকুর প্রেম রয়েছে।
স্কুলে নতুন সেশন শুরু হয়েছে। এবার আমি, বাপ্তু, অরি মাধ্যমিক দেব। বাপন, সামু,
সুবায়ুরা ইলেভেনে উঠেছে। মৌদির কলেজে ফাইনাল ইয়ার। কচা আর সুমি ছাড়া আমরা সবাই
কোচিং ক্লাস আর পড়ার বইয়ে ডুবে। সময় পাচ্ছি
না আমাদের ক্লাব দিনরাতে এসে আড্ডা মারার। আজ রবিবার বলে সবাই জুটেছি। দাবা আর ক্যারমের
সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলাম আমরা। তখনই একটা
ক্ষীণ কুঁইকুঁই আওয়াজ পেয়ে থমকে গিয়েছিলাম সকলে। দরজাটা খোলা পেয়ে একটা কুকুর ঢুকে
এসেছে ক্লাবে। অরি ‘অ্যাই যাহ্, যাহ্’ করে তেড়ে গিয়েছিল।
কিন্তু কুকুরটার মধ্যে কোনও হেলদোল দেখিনি। সে ভয় পায়নি। কুঁইকুঁই করতে করতে বরং এগিয়ে
এসেছিল আরও কয়েক পা। ছোট্ট চেহারার কুকুরটার গায়ের সাদা
লোমগুলো ময়লায় কালচে হয়ে গিয়েছে। মুখটা করুণ, শুকনো। কালো
পুঁতির মতো দুটো উজ্জ্বল চোখে অসহায়তা। দু’পাশে ঝুলে পড়া দুটো লম্বাটে
কান তিরতির করে নড়ছে। একরত্তি না হলেও কুকুরটা বাচ্চাই। সাত-আট মাস বয়স হবে। ঠিকঠাক খেতে পায় না বোধহয়।
ভীষণ রুগ্ন। একঝলক দেখলেই মায়া পড়ে যাবে। কুকুরটাকে
তাড়ানোর জন্য ছুটে গিয়েও থমকে গেল অরি।
“লুঁকুক্লাঁ
লাঁক?”
আমি
দেখলাম, লিরিকদা অবাক চোখে তাকিয়ে রয়েছে কুকুরটার দিকে। লিরিকদা এই দিনরাত ক্লাবের
প্রেসিডেন্ট। আমাদের হিরো। মানুষের প্রতি যেমন প্রগাঢ় ভালোবাসা, পশুপাখিদের জন্যও
তেমন। আমাদের এই হাউজিংয়ের সমস্ত কুকুরকে ও প্রায়ই এটা ওটা খাওয়ায়। যে কারণে ওরা প্রচণ্ড ভালোও বাসে লিরিকদাকে।
লিরিকদা
এইমাত্র যা বলল, সেটা বোঝার সাধ্য আমাদের ছাড়া আর কারও নেই। লিরিকদা ছেলেবেলা থেকে
চরম তোতলা। কথা বলতে গেলেই জিভ জড়িয়ে যায়। আর সেটাকে ম্যানেজ করতে গিয়ে ‘ল’ আর ‘ক’-র সঙ্গে চন্দ্রবিন্দু মিশিয়ে কথা বলে। লিরিকদার কথাকে আমরা নাম দিয়েছি ‘লি-কোড’।
লোকে অবশ্য লি-কোড শুনলে ভাববে ‘জি-টক’! মানে, ঘোস্ট বা ভূত কথা বলছে। এই মুহূর্তে
ও যেটা জানতে চাইল, সেটা হল, ‘কুকুরটা কার?’
সত্যিই
তো, কুকুরটা কার? এই হাউজিংয়ে
অনেকের বাড়িতেই কুকুর আছে। দু’বেলা তারা পোষ্যদের নিয়ে পার্কে কিংবা রাস্তায়
হাঁটতে বের হয়। এই কুকুরটাকে দেখে মনে হচ্ছে, রাস্তার নয়, কারও না কারও বাড়ির কুকুর। বাড়ি থেকে পালিয়েছে নাকি?
আমি
বললাম, “লিরিকদা, নিশ্চয়ই
কোনও বাড়ির কুকুর এটা। কিন্তু
কার বলো তো?”
ল, ক-এর
সঙ্গে চন্দ্রবিন্দু মিশিয়ে লিরিকদা গম্ভীর গলায় বলল, “লাঁক লকেঁ লোঁক্ক।” যার
অর্থ হল, ‘তাই মনে হচ্ছে।’ সেই সঙ্গে লিরিকদা আমাকে যা বলল তার মানে দাঁড়ায়, “রিন, এইরকম একটা ভালো জাতের কুকুর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে কেন? ও কি
বাড়ির রাস্তা ভুলে গিয়েছে?”
লিরিকদার
গলা থেকে দুর্ভাবনা ছাপিয়ে যন্ত্রণা উঠে এল। আমিও ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছিলাম। সত্যিই
বেচারা হারিয়ে গিয়েছে। না হলে এত ময়লা আর রুগ্ন হত না। আমাদের অনেকগুলো অবাক চোখের
সামনে কুকুরটা দিব্যি থাবা পেতে বসে পড়েছে ক্লাব-ঘরের মেঝেতে। এবার শীত অনেক লম্বা ব্যাটিং করেছে। যে কারণে মার্চের
দোড়গোড়াতে দাঁড়িয়েও গ্রীষ্ম চোখরাঙানির
সুযোগ পায়নি। কিন্তু কুকুরটার সারা গায়ে লম্বা লম্বা লোম। ওর গরম লাগাটাই স্বাভাবিক।
এই ক্লাবঘরের ভেতরটা ঠাণ্ডা। বেচারা তাই আয়েস করে বসেছে মেঝেতে।
মৌদি ক্লাব
থেকে সোজা কোচিংয়ে যাবে। ফিরতে ফিরতে সেই দুপুর। ওর ব্যাগে সবসময় জল আর বিস্কুট থাকে। আমরাও সুযোগমতো ভাগ বসাই। মৌদি
তাড়াতাড়ি উঠে ব্যাগ খুলে ক্রিমক্র্যাকার
বিস্কুটের
প্যাকেট থেকে একটা বিস্কুট বের করে কুকুরটার সামনে
দিল। বাচ্চাটা এখনও কুঁইকুঁই করছে। কিন্তু বিস্কুট সামনে পেয়েও ওর মধ্যে কোনও হেলদোল দেখলাম না। বিস্কুটটা একবার দেখে উদাস চোখে মুখ ঘুরিয়ে নিল।
লিরিকদা এবার
চেয়ার ছেড়ে উঠে এল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ভালো করে দেখে বলল, “দেখে মনে হচ্ছে জার্মান স্পিৎজ। স্পেনিয়ালের থেকে এরা চেহারায় খানিকটা বড়ো হয়। ভীষণ আদুরে আর অভিমানী। একই সঙ্গে
নির্ভরশীল। ও মনে হয় বিস্কুট খেতে ভালোবাসে না। একটু
দুধ দিলে কেমন হয়?”
লিরিকদা
শুধু দুধে থেমে থাকেনি। সত্যি বলতে কী, আমরাও চাইনি। একটা অসহায় বাচ্চার পাশে থাকব না? মৌদির কোচিংয়ে যাওয়া
মাথায় উঠল। আমরা সবাই ঝাঁপিয়ে পড়লাম বাচ্চা কুকুরটাকে নিয়ে। লিরিকদা গেল দুধ আনতে।
বাপন ছুটল বাড়ি। ওদের বাড়িতে আগে
একটা গোল্ডেন রেট্রিভার ছিল। মারা গিয়েছে বছর খানেক হল। তার ব্যবহার করা একটা শ্যাম্পু রয়ে যেতে পারে বলে বাপনের ধারণা।
আমি গেলাম পাউডার আনতে। আর মৌদি গেল বাড়ি থেকে একটা প্লেট আর চিরুনি জোগাড় করার জন্য। কিছুক্ষণের মধ্যে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় চেহারা
পালটে দিলাম বাচ্চা কুকুরটার।
অরি,
সুবায়ু আর সামু মিলে ক্লাবের লাগোয়া পুকুর থেকে স্নান করিয়ে নিয়ে এল ওকে। যাকে
দেখে একটু আগেও মনে হয়েছে, কালচে রংয়ের, সে-ই এখন দুধসাদা চেহারা নিয়ে হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে। কী অপূর্ব মিষ্টি দেখতে বাচ্চাটাকে! লোম আঁচড়ে পাউডার মাখিয়ে দেওয়ার পর ও-ও যেন পুলকিত হয়েছে। মহানন্দে লেজ
নাড়াতে নাড়াতে আমাদের কোলে কোলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাচ্চা কুকুরটার দেখলাম বেশি পছন্দ
লিরিকদাকে। মিহি গলায় দু’বার ভুক ভুক করে ডেকে হাত চেটে দিল
লিরিকদার। একটা প্লেটে তখন লিরিকদা দুধ খাওয়াতে শুরু করেছে ওকে। এই ক’দিন বোধহয় ওর
খাওয়া হয়নি। এক প্লেট দুধ নিমেষে চেটে উড়িয়ে দিয়ে জিভ বের করে তাকিয়ে রইল লিরিকদার
দিকে। লিরিকদা হাসিমুখে আরও খানিকটা ঢেলে দিল প্লেটে। প্রায় একগ্লাস দুধ খেয়ে পেট
ভরতেই বোধহয় ঘুম পেয়ে গিয়েছিল। দুটো হাই তুলে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ল মেঝেতে।
লিরিকদার কী মনে হতে ঘুমন্ত বাচ্চাটাকে সন্তর্পণে তুলে শুইয়ে দিল নিজের চেয়ারটাতে।
তারপর বাঁদিকের হাতলটা ধরে ধীরে ধীরে দোলাতে লাগল চেয়ারটা। যেন বেবিকট দুলিয়ে ঘুম
পাড়াচ্ছে কোনও মানব শিশুকে। আর আমি গরম লাগতে পেরে ভেবে একটা হাতপাখা জোগাড় করে হাওয়া করতে লাগলাম। হাতপাখার হাওয়ায় ওর সাদা লোমগুলো ফরফর করে উড়ছে।
আর বাকিরা ‘আহা, বেচারা ঘুমোক’ মুখ করে তাকিয়ে রয়েছে।
“আমি ঠিকই
ধরেছি, ও বাড়ির রাস্তা ভুলে হারিয়ে গিয়েছে,” হাতল
ধরে চেয়ার দোলাতে দোলাতে নিচু গলায় বলল
লিরিকদা।
“কী করে খুঁজে
বের করব ওর বাড়ি?” চিন্তিত গলায় বলল মৌদি।
“কাগজে বিজ্ঞাপন
দিলে হয় না?” ফিসফিস করে বলল সুবায়ু।
শুনেছি
ডগ রেজিস্ট্রেশন ওয়েবসাইট হয়। যারা পোষ্য কেনে তারা তাদের পোষ্যদের ছবি আপলোড করে
ঠিকানা, ফোন নম্বর দিয়ে রাখে। আমি সেটা জানালাম লিরিকদাকে। লিরিকদা চিন্তিত গলায় বলল,
“এসব তো বিদেশে হয়। কলকাতাতেও হয়তো থাকতে পারে। বর্ধমানে কি
হবে? তবুও হাল ছাড়লে চলবে না। ওকে ওর
বাবা-মার কাছে পৌঁছে দিতেই হবে।”
“আর যদি ওর
বাড়ি খুঁজে না পাই আমরা?” সুমি প্রশ্ন করল।
এটা আমরা
ভেবে দেখিনি। সত্যিই যদি ওর অভিভাবককে খুঁজে না পাওয়া যায়, কী হবে? ওকে রাখব
কোথায়? রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া যায় না। সব কুকুরেরই পাড়া সেন্টিমেন্ট থাকে। অনুপ্রবেশকারীদের
ওরা পছন্দ করে না। আমাদের হাউজিংয়ে প্রচুর রোডেশিয়ান। ওরা
এই বাচ্চাটাকে দেখতে পেলে আস্ত রাখবে না। ক্লাবেই আপাতত
রাখতে হবে ওকে।
আমরা
সবাই লিরিকদার দিকে তাকিয়ে। ও একমনে দেখছে ঘুমন্ত কুকুরটাকে। হঠাৎই মনে হল, তিরতির
করে লিরিকদার ঠোঁট কাঁপছে। চোখে জল। নিজেকে সামলে আস্তে আস্তে লিরিকদা বলে উঠল, “কিছুদিন আগে কলকাতার একটা সরকারি হাসপাতালে এক দঙ্গল বাচ্চা কুকুরকে কিছু লোকজন পিটিয়ে মেরেছিল। ওই ঘটনার জেরে সারা দেশে
হইচই পড়ে গিয়েছিল। আমাদের দেশে এইসব নিরীহ
প্রাণীদের কোনও মূল্য নেই রে!”
লিরিকদার
গলা কাঁপছে। ওর কষ্টটা ছুঁয়ে গেল আমাদেরও। আহা রে, বেচারাদের দেখার কেউ নেই। আমি
বললাম, “লিরিকদা, এদের জন্য কিছু
করা যায় না?”
ছলছলে
চোখে লিরিকদা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “জীবে
প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর। এদের জন্য কিছু করতেই হবে।”
দুই
আমরা
বাচ্চা কুকুরটার নাম দিয়েছি ‘ঘুমু’। সুযোগ পেলেই ব্যাটা হাত-পা ছড়িয়ে একটু ঘুমিয়ে নেয়। ওর আর কাজই বা কী আছে! আমাদের মতো পড়াশোনা তো
করতে হয় না! তাছাড়া ঘুমুকে পাহারা দেওয়ার কাজটাও আমরা করছি।
নতুন নামটা বোধহয় ঘুমুর পছন্দ রয়েছে। নাম ধরে ডাকলেই
মহানন্দে দু’ইঞ্চি লেজটা নাড়াচ্ছে। তিনদিন হল ঘুমু ক্লাবেই রয়েছে। আমরা যে যার বাড়ি
থেকে খাবার-টাবার যোগান দিচ্ছি। ঘুমুর কোনও বাছবিচার
নেই। আলুপোস্ত-কলাই ডাল টু মাছ-মাংসের ঝোল দিব্যি
উড়িয়ে দিচ্ছে। কচার বাড়ি থেকে আনা পলতাপাতার বড়াও টেস্ট
করে দেখেছে। আগের মতো রুগ্ন ব্যাপারটা
ওর নেই। বেশ চনমনে হয়ে উঠেছে। দস্যিও হয়েছে। সারাক্ষণ শুধু খেলা আর খেলা। তবে একটা
অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল করেছি, ঘুমুর সহবত শিক্ষা
আছে। কিছু বললে বুঝতে পারে। অন্যান্য কুকুররা জিনিসপত্র এলোমেলো করে, ছেঁড়াছেঁড়ি
করে, ঘরের মধ্যে বাথরুম করে ফেলে।
ঘুমু ম্যানার্স জানে। ওর জন্য একটা বাটিতে প্লাস্টিকের প্লেট ঢাকা দিয়ে জল রাখা
থাকে। ওর যখন জল তেষ্টা পায়, পায়ে করে প্লেটটা একটু সরিয়ে জল খেয়ে আবার প্লেটটা
ঢাকা দিয়ে দেয়। ব্যাপারটা অবাক করার মতো। ঘুমু হ্যান্ডশেকও করতে জানে। ‘চুপ করে
বসো’, বললে বুঝতে পারে। এমনকি, বলার আগেই বুঝতে পারে অনেক কিছু। নিশ্চয়ই কোনও ট্রেনার ওকে শিক্ষা দিয়েছিল। আরও একটা ব্যাপার, পাতলা ফিনফিনে একটা
চেন আছে ওর গলায়। বড়ো বড়ো লোমে
ঢাকা থাকায় আমরা শুরুতে বুঝতে পারিনি। চেনটাতে একটা চ্যাপ্টা লকেটমতো আছে। তাতে
লেখা, এস.বি.এল।
লকেটটা
দেখার পর থেকে আমরা কনফার্মড, ঘুমুর
অভিভাবক যে-ই হোন না কেন, তিনি বেশ বড়োলোক। কারণ,
চেনটা রুপোর হলেও লকেটটা প্লাটিনামের। কে এই এস.বি.এল? ঘুমু বর্ধমানের যে নয়, খোঁজখবর
নিয়ে নিশ্চিত হয়েছি আমরা। তাহলে ও এখানে এল কী করে? এটাই বুঝতে পারছি না। লিরিকদা
নিজের নেটওয়ার্ক কাজে লাগিয়েও হতাশ হয়েছে। ঘুমুর কোনও পাস্ট হিস্ট্রি খুঁজে পাওয়া
যায়নি। অবশ্য আমরা এতে খুব একটা অখুশি হইনি। আমরা চাই, ঘুমু আমাদের কাছেই থাকুক। ও
যেমন আমাদের, আমরাও তেমন ওর ন্যাওটা হয়ে গিয়েছি।
ঘুমু এসে
হাজির হওয়ার দিন থেকে একটা দুর্ভাবনা কাজ করছিল। হাউজিংয়ে প্রচুর কুকুর আছে। ওরা কীভাবে
নেবে ঘুমুকে? দেখা গেল ঘুমু ম্যাজিক জানে। ও যেমন আমাদের পটিয়ে ফেলেছে, তেমনই হাউজিংয়ের
কুকুরদেরও। এখন ক্লাব-ঘরের সামনে নেড়িদের একটা দঙ্গল
ভিড় করে থাকে। তারা ওর শত্রু নয়, ভক্ত! ঘুমুকে পাহারা দেওয়ার কাজটা ইদানীং ওরাই
করে। ঘুমুও দেখেছি নিশ্চিন্তে ওদের সঙ্গে আড্ডা-টাড্ডা মারে।
ঘুমুকে
পাওয়ার দিন থেকে রাস্তার কুকুরদের নিরাপদ ও ভালো জীবন দেওয়ার জন্য কিছু করব, মাথায়
ঘুরছিল আমাদের। তা নিয়ে আমরা এখন মিটিংয়ে বসেছি।
লিরিকদা নিজের
প্ল্যানটা গুছিয়ে বলল। কুকুরদের জন্য একটা ডগ ভিলেজ তৈরি করব আমরা। ব্রাজিলের রিওতে এমন ভিলেজ আছে শুনেছি। সেখানে অসংখ্য কুকুর থাকে। ওদের জন্য
আলাদা ছোটো ছোটো বাড়ি আছে। পর্যাপ্ত খাবার পায়।
সুখের না হলেও মোটামুটি স্বচ্ছল জীবনযাপন বলা যেতে পারে। লিরিকদা ওইরকম একটা গ্রাম
বানাতে চাইছে। কিন্তু তার জন্য একটা ফান্ড দরকার। সেটা কীভাবে বানানো যায়? অভিনব
প্ল্যান ভেঁজে ফেলেছে লিরিকদা। ঘুমুকে
কোলে নিয়ে ওর গলায় হাত বোলাতে বোলাতে লিরিকদা বলল, “কলকাতা তো বটেই, আমাদের বর্ধমানেও আগে ডগ শো হত। বাড়ির কুকুররা তাতে অংশ
নিত। ওইরকম ডগ শো অ্যারেঞ্জ করতে পারি। কিন্তু
তাতে ডগ ভিলেজের জন্য অর্থ তোলা যাবে না। আমাদের দরকার এমন একটা অভিনব ব্যাপার, যা
মানুষকে চমকে দেবে। মিডিয়া তুমুল আগ্রহ দেখাবে। বিজ্ঞাপনদাতারা হামলে পড়বে। ডগ
ভিলেজের জন্য ফান্ড তুলতে তখন অসুবিধা হবে না।”
লিরিকদা
মানেই অদ্ভুত সব কাণ্ডকারখানা। দুর্গাপুজো, মেড ডে — এমন অনেক কিছু যা বলে শেষ করা
যাবে না। আবার নতুন কী ভাবছে, কে জানে? আমার একটু ভয়-ভয়ও করছে। লিরিকদা সম্পর্কে
যাদের সামান্য ধারণাও আছে, তারা জানে, লিরিকদার সব অভিনব ব্যাপার নিয়ে শুরুতে
দারুণ হইচই হয়। শেষ পর্যন্ত মর্মান্তিকভাবে কেঁচে
যায়। আর তাতে যে ঝড় ওঠে, সেটা সামলাতে গিয়ে বিস্তর ঝামেলার মুখে পড়তে হয়। বেশ
কয়েকবার তো আমরা বাড়ি থেকে ভয়ে মাস খানেক
বেরোতে পারিনি।
পুরোনো
কথা মনে পড়তেই গা শিরশির করে উঠল। কিন্তু লিরিকদা বিকারহীন। ও ঘুমুকে আদর করতে
করতে কী যেন ভাবছে। আমরা দিনরাতের মেঝেতে হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছি। কৌতূহল হচ্ছে তুমুল। লিরিকদা মুখ তুলে বলল, “ধর, যদি একটা ফ্যাশন শো করি?”
“ফ্যাশন
শো?” লিরিকদার কথা শেষ হতে না হতেই
বলে বসল সামু, “কিন্তু
ফ্যাশন শোর সঙ্গে ডগ ভিলেজের কী সম্পর্ক?”
কথার
মাঝে আলটপকা মন্তব্য লিরিকদা একদম নিতে পারে না। সামুর দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাতেই ও
চুপ করে গেল। আমাদের মনেও নানা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছিল। লিরিকদার বকুনির ভয়ে সেগুলো
গিলে ফেললাম।
“বিভিন্ন
শহরে প্রতিবছর শীতকালে একটা সপ্তাহ ধরে বড়ো বড়ো ফ্যাশন শো হয়। যেমন ধর, প্যারিস ফ্যাশন উইক, লাস ভেগাস ফ্যাশন উইক, লন্ডন,
নিউ ইয়র্ক কিংবা মস্কো ফ্যাশন উইক। এগুলোতে বিশ্বের
নামী ব্র্যান্ডগুলো তাদের নতুন প্রোডাক্ট লঞ্চ করে। জামাকাপড়, জুতো, পারফিউম, কসমেটিকস—এসব।”
লিরিকদা
সবার দিকে একঝলক দেখে নিল। বোধহয় বোঝার চেষ্টা করল, কে কী ভাবছে। তারপর আবার বলল, “আমরা এইরকম ফ্যাশন শো করব। তবে সপ্তাহ জুড়ে নয়, একদিনের। কিন্তু সেটা হবে
ডগ ফ্যাশন শো। ধর, একেকজন মডেলের সঙ্গে একটা ডগ মডেল র্যাম্পে
হাঁটবে। মেল বা ফিমেল মডেল নিয়ে ফ্যাশন শো অ্যারেঞ্জ করলে নামী ব্র্যান্ডগুলোকে
অ্যাপ্রোচ করা যাবে। এটার সঙ্গে ঘুমুদের অ্যাড করলে আকর্ষণ বেড়ে যাবে। মানে ধর,
মডেল যে পোশাক পরে হাঁটবে, ঘুমুদের গায়েও সেই রংয়েরই পোশাক থাকবে। তবে পোশাকের প্যাটার্ন
ওদের মতো করে নিতে হবে। প্লাস যেটা হবে, পোষ্যদের নিত্য ব্যবহার্য প্রোডাক্টের
কোম্পানিগুলোও জোড়া যাবে। অনেক বেশি লোক এতে ইনভলভড হবে। ফান্ড জেনারেট করতে অসুবিধা হবে না। আমাদের পার্পাস সার্ভ হয়ে যাবে।”
লিরিকদার
পরিকল্পনাটা এককথায় চাবুক! আমি মোহিত হয়ে গেলাম। সত্যিই তো, ফ্যাশন শো তো সারা
পৃথিবীতে হয়। কিন্তু ডগ ফ্যাশন শো কোথায় হয়েছে? আমি একগাল হেসে লিরিকদাকে সম্মতি
জানালাম।
নিজের
পরিকল্পনার গভীরতা বুঝে নিজেই উত্তেজিত হয়ে পড়েছে লিরিকদা। ওর
কথা এখন আমরাই বুঝতে পারছি না। ল, ক-এর সঙ্গে চন্দ্রবিন্দু মিশিয়ে
ও যা বলল, তার মানে, “আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি, পৃথিবীতে
এমন ঘটনা এর আগে কখনও হয়নি। ফ্যাশন শোগুলোর নতুন লঞ্চ করা ড্রেস বা বিউটি
প্রোডাক্ট একটা ফ্যাশন ট্রেন্ড তৈরি করে। পোষ্যদের মধ্যেও এমন একটা ট্রেন্ড চালু হবে। ভাব তো, কী দাঁড়াতে পারে ব্যাপারটা।
রাস্তাঘাটে আমরা চমৎকার পোশাকে দেখতে পাব ঘুমুদের।”
কচা মহা
উৎসাহ নিয়ে বলল, “ধরো, পঞ্চুর মতো একটা পোশাক, যা
সাধারণত মেয়েরা পরে, শীতকালে সেইরকমই ঘুমুরা পরতে শুরু করল!”
অরি চোখ
কপালে তুলে বলল, “কিংবা গলায় বাহারি বো পরানো শুরু
হল। তাতে ওদের নাম, ঠিকানা লেখা থাকবে। হারিয়ে
গেলে লোকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যাবে।”
বাপন
এতক্ষণ চুপ করে ছিল। ও-ও ঢেলে দিল ওর ভাবনা। “অথবা ভরা শীতে ওদের জন্য বিশেষ লেদার জ্যাকেট তৈরি করা শুরু করল বিভিন্ন
কোম্পানি!”
সবাই যখন
কিছু না কিছু বলছে, আমিই বা চুপ করে থাকি কেন? বলে উঠলাম, “কে বলতে পারে, এই ডগ ফ্যাশন শো দেখে ইন্সপায়ার্ড হয়ে পাড়ায় পাড়ায় ডগ বুটিক
চালু হবে না!”
লিরিকদা
ঘন ঘন মাথা দোলাচ্ছে। ওর ঠোঁটের
দু’কোণে ঝিলিক দিয়ে ওঠা হাসিতে তৃপ্তির ছোপ ধরেছে।
আমাদের আলোচনা
এতক্ষণ বোধহয় মন দিয়ে শুনছিল ঘুমু। সরু
গলায় সম্মতি দেওয়ার মতো করে সংক্ষেপে বলল,
‘ভুক!’ যেন ‘ঠিক’ শব্দটাই উচ্চারণ করল ও।
তিন
বছর
পনেরো-কুড়ি আগে মাধ্যমিক পরীক্ষাটা নাকি মার্চ মাসে
হত। ওটাই ঠিক সময় ছিল। কারণ, হাতে আট-ন’মাস সময় থাকলেও মনে হয় না অরি, বাপ্তু আর আমি
জীবনের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাটা ঠিকঠাক দিতে পারব। বা দিলেও ফেল করব নির্ঘাত।
গত দুটো মাস যেভাবে ডগ ফ্যাশন শো নিয়ে মেতে আছি, পড়াশোনা ডকে উঠেছে প্রায়। বাড়িতে
এর জন্য বিস্তর শাসানি, ধমকানি সহ্য করতে হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু আমরা নিরুপায়।
অষ্টপ্রহর
ইষ্টনাম জপের মতো মায়ের ‘রিন, পড়তে বস’ শুনতে শুনতে ফিশফ্রাই হয়ে যাচ্ছিল কান।
সামাজিক কাজে হাত দিয়েছি। এখন তো আর পিছিয়ে আসা যায় না।
সেদিন
রান্নাঘরে মা লুচি বেলছিল। আমাকে বাড়ি থেকে বেরোতে দেখে চিলচিৎকার জুড়ে দিল, “সকাল থেকে না পড়ে কোথায় যাচ্ছিস?”
রান্নাঘরের
সামনে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা
বোঝানোর চেষ্টাও করেছিলাম মাকে। বলেছিলাম, “মা,
বইয়ের বাইরেও একটা দুনিয়া আছে। আমরা যদি সেই দুনিয়া দেখভালের দায়িত্ব না নিই, কে
নেবে? এখন থেকে ফোকাসড হতে হবে আমাদের। না হলে সমাজ সর্বাঙ্গসুন্দর হবে কী করে?”
কথা শুনে
লুচি বেলা ভুলে মা মিনিট দেড়েক অবাক
হয়ে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ উপভোগ্য ছিল। যে কোনও মা-ই চাইবে, তার ছেলে যেন সমাজের নামী মানুষ হয়। মা
বোধহয় কল্পনার জগতে ভবিষ্যতের স্বনামধন্য ছেলের ছবিই খুঁজছিল মন দিয়ে। আমি লজ্জায়
মাথা নামিয়ে নিয়েছিলাম।
আচমকা
একটা হ্যাঁচকা টান পড়তে বুঝেছিলাম, আমি যা ভাবছি তা নয়, মা আসলে রাগের চোটে
ব্যোমকে গিয়েছিল। হ্যাঁচকা টানটা তারই বহিঃপ্রকাশ। রান্নাঘরে চাকতি-বেলনার পাশে একটা গামলায় ময়দা মাখা ছিল। সেখান থেকে লেচি
ছিঁড়ে ছিঁড়ে লুচি বেলছিল মা। রাগে
অগ্নিশর্মা হয়ে সেটা ভুলে গিয়ে আমার বাঁ কানটাকে লেচি ভেবে অ্যাইসান টান মেরেছিল
যে, টানা দেড়দিন আগুনের মতো গরম ছিল। যতবার কানে হাত দিয়েছি, ছ্যাঁকা লেগেছে! ভেবেছিলাম
মাকে বলব, ক’টা দিন আমি রান্নাঘরে কান পেতে শুচ্ছি। আমার বাঁ কানেই দিব্যি
ডাল-ভাত রান্না হয়ে যাবে। গ্যাসটাও বাঁচানো যাবে। গামছা
নিংড়ানো কানমলা খাওয়ার পর অবশ্য এসব বলার সাহস হয়নি।
আমার থেকেও
খারাপ হাল বাপ্তু, অরিদেরও। তবে আমরা পারিবারিক দুর্যোগকে আমল দিইনি। বৃহত্তর
স্বার্থের কথা ভেবে ছোটোখাটো
ব্যাপারগুলো সরিয়ে রাখতে হয়, লিরিকদা বলেছে। এরপর আর কোনও কথা হয় না। তাছাড়া অন্তিম
লগ্নে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। ছুটকো-ছাটকা
বিপদ নিয়ে ভাবার সময় এখন একেবারেই নেই।
ফ্যাশন
শোর আয়োজনের পর্ব শেষ। হাতে আর মাত্র দুটো দিন। পয়লা বৈশাখের রাতে আমরা শোটা করছি।
এর নাম দেওয়া হয়েছে, হোপ নাইট। কেন এই নাম, তার
ব্যাখ্যা লিরিকদা দিয়েছে। ওর কথামতো, এটা একটা ড্রিম প্রজেক্ট। একটা স্বপ্নের
পিছনে ছুটছি। সেটা সফল করতে পারলে সমাজে একটা বিপ্লব আনতে পারব। একটা উদাহরণ তৈরি
করা যাবে। কুকুরদের জন্য সরকারি হোম আছে। পৌরসভার গাড়ি এসে পাড়া থেকে অবাঞ্ছিত
কুকুরদের তুলে নিয়ে যায়। তারপর তাদের কী হয়, কেউ খোঁজ রাখে? জানে, ওরা বেঁচে রইল
কি না? খেতে পায় কি না? অকাট্য যুক্তি। এই
কারণে লিরিকদার ফ্যান আমরা। ভগবান যদি লি-কোডের
বদলে ওকে আমাদের মতো স্বাভাবিক শব্দ দিতেন!
যে কোনও অনুষ্ঠানকে অভিনব করতে গেলে শুধু চমক দিলে হয় না,
সর্বাঙ্গসুন্দর করতে হয়। একটা ব্লু-প্রিন্ট
তৈরি করে সেইমতো গত দু’মাস ধরে আমরা কাজ করেছি। প্রথমেই দরকার ছিল একজন ফ্যাশন
ডিজাইনার। লিরিকদার ছেলেবেলার বন্ধু শান্তনু দাশগুপ্ত দেশের নামকরা ফ্যাশন
ডিজাইনার। বলিউডে একচেটিয়া বাজার। শান্তনুদাকে ফোনে পুরো ব্যাপারটা বলার পর লাফিয়ে
উঠেছিল। তবুও আমাদের মনে সন্দেহ ছিল। এত বড়ো ফ্যাশন ডিজাইনার ব্যাপারটাকে কতটা গুরুত্ব দেবে? তিনদিন পর মুম্বই থেকে
যখন নিজের ম্যানেজারকে নিয়ে বর্ধমানে এসে হাজির হল শান্তনুদা, আর সন্দেহ রইল না।
শান্তনুদা
সব শুনে বলেছিল, “এইরকম অভিনব ব্যাপার আমি কখনও
শুনিনি। দ্যাখ লিরিক, আমি ক্রিয়েটিভ লোক। যেখানে ক্রিয়েটিভিটির সুযোগ থাকে, আমি এগিয়ে
যাই। তোদের শোটা অবিশ্বাস্য সাকসেস পাবে, দেখে নিস।”
ফ্যাশন
শোর মেল-ফিমেল-ডগ মডেলদের পোশাক বানানোর জন্য শান্তনুদার টেকনিক্যাল টিমের দশজন
মেম্বার এখানকার একটা হোটেলে গত দেড় মাস
রয়েছে। ড্রেস ডিজাইন করেছে খোদ শান্তনুদা। বাছাই করা কিছু মডেল এসেছে কলকাতা ও
মুম্বই থেকে। শুধু শো স্টপার হিসেবে থাকবে লিরিকদা আর মৌদি। ফ্যাশন শোতে শো
স্টপারের ভূমিকাটা সিনেমার নায়ক-নায়িকার মতো। সেরা পোশাক পরে তারা সবশেষে র্যাম্পে হাঁটে। ব্যাপারটা গ্ল্যামারাস যেমন, তেমনই দৃষ্টিনন্দন। লিরিকদা
কিছুতেই শো স্টপার হতে রাজি হচ্ছিল না। শান্তনুদা ওকে রাজি করিয়েছে।
শান্তনুদা
জুড়ে যাওয়ার পর স্পনসর নিয়ে আর আমাদের ভাবতে হয়নি। ওর সংস্থাই পি.আর-এর কাজটা করেছে। দেশের সমস্ত নামী
ব্র্যান্ডগুলো মোটা টাকার বিনিময়ে এই শোতে অংশ নিচ্ছে। তারা ইতিমধ্যে তাদের
স্পেশাল পোশাক পাঠিয়ে দিয়েছে। আমরা হিসেব
করে দেখেছি, সব খরচাপাতি বাদ দিয়ে প্রায় ষাট-সত্তর লক্ষ টাকা থেকে
যাবে আমাদের হাতে। হোপ নাইটের উদ্দেশ্য জানার পর অনেকে অনুদান দেওয়ার জন্যও এগিয়ে
এসেছেন। ডগ ভিলেজ বানানোর জন্য জায়গা কেনা, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা — সব কিছুর সুরাহা হয়ে যাবে।
ঘুমুরা
জুড়ে যাওয়ায় ডগ ফ্যাশন নিয়েও একটা হিড়িক পড়েছে। পোষ্যদের ব্যবহার্য জিনিস এতদিন
যারা বানাত, তারাই এখন ফ্যাশন কনসেপ্টে জোর দিচ্ছে। একটা
বিপ্লব যে আমরা আনতে চলেছি, তা নিশ্চিত।
‘হোপ
নাইট’-এর জন্য হাউজিংয়ের মাঠে একটা পেল্লাই
অস্থায়ী এসি অডিটোরিয়াম তৈরি করা হয়েছে। বিদেশি ধাঁচে বানানো হয়েছে র্যাম্পটা। শো
দেখার জন্য তিনরকম দামের টিকিট রাখা হয়েছে। লিরিকদা টিকিটের দাম ঠিক করার পর আমরা মৃদু
প্রতিবাদ করেছিলাম। এত চড়া দাম হলে লোকে কিনবে না। লিরিকদা নিজের সিদ্ধান্ত থেকে
নড়েনি। পরে বুঝেছিলাম, ওর অনুমান ঠিক ছিল। একে তো অভিনব ফ্যাশন শো, তার ওপর অনুষ্ঠানের
আগে ও পরে দুটো নামী বাংলা ব্যান্ডকে জুড়ে দেওয়ায় ‘হোপ নাইট’-এর একটাও টিকিট পড়ে নেই। নানা মহল থেকে টিকিটের জন্য আমাদের কাছে অনুরোধ
আসছে অহরহ। শুনেছি, টিকিট নাকি
ব্ল্যাকও হচ্ছে। এইরকম একটা কর্মকাণ্ডকে বাস্তবে রূপ দেওয়া যে কতটা ঝক্কির, হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি এই ক’দিনে। তা হোক, অবহেলায় পড়ে থাকা
প্রাণীগুলোর জন্য কিছু করতে পারছি।
মেল ও ফিমেল মডেল বাইরে থেকে এলেও ঘুমু সহ আমাদের হাউজিংয়ের
স্ট্রিট ডগরাই ফ্যাশন শোর র্যাম্পে হাঁটবে। ওদের ট্রেনিং দেওয়াটাই ছিল চ্যালেঞ্জ।
তিনজন ট্রেনার এর জন্য নিযুক্ত করা হয়েছে। তারা রোডেশিয়ানদের মধ্যে থেকে দশজনকে
বেছে নিয়েছে যারা একটু শান্তপ্রকৃতির। আর শো স্টপার ঘুমু। ডগ ট্রেনাররা ট্রেনিং
দেওয়ার সময় অবাক হয়ে গিয়েছে। ঘুমুই নাকি দশজন নেড়িকে অনেকটা শিক্ষিত করে তুলেছে। ট্রেনাররা ঘুমুর আদবকায়দা
দেখে রীতিমতো মোহিত। কীভাবে হাঁটতে হয় র্যাম্পে, ঘুমু আগে থেকে জানত কি না,
তা নিয়ে ট্রেনাররা রীতিমতো সন্দিহান। রিহার্সলের সময় ঘুমু ধীর পায়ে হাঁটার
পাশাপাশি র্যাম্পের শেষ মাথায় এসে দু’পায়ে দাঁড়িয়ে পড়ছে। এই
স্টাইলটা লালু, কালু, সাদারাও অ্যাডপ্ট করে নিয়েছে। দেখলেই বোঝা যায়, ঘুমু টিমটার
লিডার। আমরা পর্যন্ত ক’দিনের রিহার্সল দেখে অবাক হয়েছি। গত পনেরো দিন ধরে হোপ
নাইটের সিলেকটেড কুকুরদের জন্য তো বটেই, পুরো হাউজিংয়ের রোডেশিয়ানদের জন্য চার বেলা
মিলের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বেচারাগুলো পেট পুরে খাক।
চার
আজ পয়লা
বৈশাখ। সকাল থেকে দম ফেলার সুযোগ পাইনি আমরা। এত বড়ো কর্মকাণ্ড হলে যা হয়! গত তিনদিন ধরে মিডিয়া ‘হোপ নাইট’ নিয়ে ব্যাপক প্রচার
শুরু করেছে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় ইন্টারভিউ দিতে হচ্ছে লিরিকদাকে। দোভাষীর কাজটা আমাকে করতে হয় বলে কথা বলতে বলতে আমার জিভ প্রায় ক্ষয়ে যাওয়ার মুখে।
আজ সকাল থেকে আবার ন্যাশনাল মিডিয়া ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সমস্ত বড়ো বড়ো নিউজ চ্যানেলগুলোতে লাইভ দেখানো হচ্ছে। আমরা অবশ্য টিভি-স্বত্ব আগেই একটা চ্যানেলকে বিক্রি করে দিয়েছি। তারা পুরো শোটা লাইভ দেখাবে। ফলে
হাউজিংয়ের নানা প্রান্তে ওবি ভ্যান লাগিয়ে বাকি চ্যানেলগুলোর সাংবাদিকরা বিস্তর
‘ফোনো’ দিচ্ছে। ডগ স্পেশালিস্টদের নিয়ে কেউ কেউ আবার লাইভ শোও করছে। সব মিলিয়ে
সারা দেশে একটা আলোড়ন পড়ে গিয়েছে।
টিভির দৌলতে কাশ্মীর টু কন্যাকুমারীকা পর্যন্ত লোকজন চিনে ফেলেছে লিরিকদা ও
আমাদের। চ্যানেলওয়ালারা শুধু হোপ নাইটে আটকে থাকেনি। তারা এই অভিনব ফ্যাশন শোর
পিছনে থাকা আমাদের দশজনের বাড়িতে গিয়েও স্টোরি করেছে। ফলে বাড়িতে এতদিন বিক্ষোভের
যে আগ্নেয়গিরিটা জেগে ওঠার মুখে ছিল, সেটা নিভে গিয়ে একেবারে গদগদ হয়ে উঠেছে। সকাল
থেকে খাওয়া হয়নি বলে আমার মা বাড়ি থেকে পরোটা বানিয়ে খাইয়ে দিয়ে গিয়েছে আমাদের।
সন্ধেয়
অডিটোরিয়ামে পা দেওয়ার পর মনটা ভীষণ ভালো হয়ে গেল। ডিজিটাল লাইটে ছয়লাপ পুরো
অডিটোরিয়াম। রঙিন আলোর ঝলমলে বলয়গুলো খেলা করে বেড়াচ্ছে অডিটোরিয়ামের আনাচেকানাচে। চেয়ারগুলো ইতিমধ্যেই ভরে গিয়েছে। অনুষ্ঠান শুরুর অনেক আগে থেকেই লোকজন এসে
হাজির। শান্তনুদাকে সঙ্গে নিয়ে লিরিকদা র্যাম্পে
গিয়ে দাঁড়াতেই পুরো অডিটোরিয়াম হই হই করে
উঠল। হাততালি আর সিটির আওয়াজে কান পাতা দায়। হোপ নাইটের ফ্যাশন শোর আগে ও পরে দুটো
জনপ্রিয় বাংলা ব্যান্ড পারফর্ম করবে। যাদের প্রথম পারফরম্যান্স, তারা মঞ্চ সাজিয়ে
নিচ্ছে। সংক্ষিপ্ত ভাষণে লিরিকদা পুরো ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করে দিল। দোভাষীর কাজ করলাম আমি। সঙ্গে সঙ্গে বাংলা
ব্যান্ডটা তাদের গানের দরজা খুলে দিল।
সব ফ্যাশন
শোতে একটা স্টুডিও থাকে। অডিটোরিয়ামটার পিছন দিকে সেইরকম একটা গ্রিনরুম বানানো
হয়েছে। ফ্যাশন শোটা সব মিলিয়ে
পঁয়তাল্লিশ মিনিটের। দেশের সেরা দশটা নামী ব্র্যান্ড তাদের পোশাক লঞ্চ করবে। সবশেষে
শান্তনুদার ডিজাইন করা ড্রেস পরে মঞ্চে হাঁটবে শো স্টপার লিরিকদা ও মৌদি।
গ্রিনরুমে এখন যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কাজ চলছে। একঝাঁক মেকআপ আর্টিস্ট পর পর সাজাচ্ছে
মডেলদের। হেয়ার স্টাইলিস্টরা চুল বেঁধে দিচ্ছে মেয়ে মডেলদের। ডিজাইনাররা তাদের
পোশাক পরাচ্ছে।
আমার নজর
গেল ঘুমুর দিকে। ও কোণের দিকে একটা টেবিলে বসে গম্ভীর
মুখে সব পর্যবেক্ষণ করছে। ওর গায়ের লোম কেতা করে ছাঁটা। সেই কারণে কি গম্ভীর? ওর
কাছে গিয়ে মাথায় হাত বোলাতে নাকটা আমার হাতে ঘষে দিল ঘুমু। জিজ্ঞেস করলাম, “কী রে, ভয় লাগছে?”
ও ঘরঘরে
আওয়াজ করে সোহাগ প্রকাশ করে যেন বলার চেষ্টা করল, ‘একটু ভয় ভয় লাগছে ঠিকই, তবে ম্যানেজ করে নেব।’
ওর মনের
কথা বুঝে আদর করে বললাম, “চিন্তা
নেই, সব ঠিক হবে। তোর বন্ধুদের একটু
সামলাস। দেখিস কোনোরকম ঝামেলা না পাকিয়ে বসে।”
ঘুমু
সম্মতিসূচক গলায় ‘ভুক…ভুউউউউউক’ করে আওয়াজ করল। যার অর্থ
হতে পারে, ‘ঠিক আছে। তুমি চিন্তা কোরো না।’
ঘুমুর
পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের হাউজিংয়ের খাঁটি দেশিরা। লালু-ভুলুদের দিকে তাকিয়ে আমি অবাক হয়ে গেলাম। আরে, ওদের তো চেনাই যাচ্ছে না! ভালো
করে চান করিয়ে নখ-টখ কেটে দেওয়া হয়েছে। গায়ের লোম রীতিমতো চকচক করছে। গা থেকে
ভুরভুর করে পারফিউমের গন্ধ ভেসে আসছে। ওরা যে নেড়ি, মনেই হচ্ছে না। বেশ অভিজাত মুখ
করে তাকিয়ে রয়েছে ওরা। ঘুমু ওদের দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় কিছু বলল। বোধহয় আমি যা
বলেছি সেটাই ট্রান্সলেট করে দিল। দেখলাম, লালু-ভুলুরা
আমার দিকে হাসি মুখে তাকিয়েছে। যেন ওরা নিশ্চিত করছে, এই শো ঠিক উতরে দেবে।
ঘুমুদের
কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই দেখলাম, শান্তনুদা ওর টিম নিয়ে ঘুমুদের কাছে হাজির
হয়েছে। পোশাক-আশাক তো রয়েইছে, সেই সঙ্গে
নানারকম গয়নাগাঁটিও। আমি পায়ে পায়ে সরে এলাম। বাংলা ব্যান্ডের গান শেষ হয়েছে। এবার
ফ্যাশন শো শুরু হবে। অডিটোরিয়ামের দিকে এগিয়ে গেলাম।
চোখের
সামনে আমি যা দেখছি, চিরকাল মনে থাকবে। ফ্যাশন শো শুরু হওয়ার সময় শান্তনুদা একবার
মঞ্চে এসেছিল। ছোট্ট কথায় ও বলল, “ভারত
কেন, পৃথিবীর বুকে এমন ইউনিক শো কখনও হয়নি। র্যাম্পে যাদের সঙ্গে হাঁটবে মডেলরা,
তাদের এই হাউজিংয়ের রাস্তায় দেখেন রোজ। আজ ঘুমু-লালু-ভুলুরাই নায়ক। আসলে ওরাই
পালটে দিতে চলেছে নিজেদের জীবন। আসুন, আমরা ঘুমুদের মহা তারকা
হওয়ার সাক্ষী হই।”
গ্রিনরুমের
করিডরটা দুটো রাস্তায় ভেঙে গিয়ে র্যাম্পে এসে
পড়েছে। দুটো দিক থেকে দু’জন করে এসে দাঁড়াচ্ছে র্যাম্পে। একদিক থেকে মেল বা ফিমেল
মডেল। অন্যদিক থেকে ঘুমুদের একজন। মডেলদের
ক্যাট-ওয়াকের সঙ্গে হাঁটার জন্য একটা নির্দিষ্ট ছন্দ দরকার পড়ে। সেটা রাখতে না পারলে বা পায়ে পায়ে চলতে না পারলে ছন্দপতন হতে বাধ্য। তখন ফ্যাশন শোয়ের তালটা
কেটে যাবে। ঘুমুদের এই ব্যাপারে অনেক ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে। তবুও একটা আশঙ্কা থেকেই যায়। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, গ্রিনরুমের করিডর ধরে হেঁটে
সাবলীলভাবে র্যাম্পে এসে দাঁড়াল ঘুমু। একটি মেয়ে মডেল অন্য রাস্তা থেকে এসে র্যাম্পে
দাঁড়িয়েছে। ঘুমু আর মেয়েটি পরস্পরকে দেখে নিল একবার। যেন হাসি বিনিময় করল। তারপর
হাঁটতে শুরু করল ওরা। মেয়েটি তার ছন্দে হাঁটছে। কী আশ্চর্য, ঘুমুর হাঁটার মধ্যেও সেই ছন্দ দেখতে পাচ্ছি। এত নিখুঁত ক্যাট-ওয়াক ও কপি করল কী করে? মেয়ে মডেলটির গায়ে কমলা রংয়ের হাঁটু-ঝুল ফ্রক। হাই-হিল ব্ল্যাক লেদারের শু। মাথায় সবুজ টুপি। ঘুমুর গলায় কমলা স্কার্ফ। মাথায় তেরছা করে পরা সবুজ টুপি।
গলা থেকে ঝুলছে ওর লকেটটা। র্যাম্পে যে মেয়েটি হাঁটছে, তার দিকে কারও চোখ নেই,
সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখছে ঘুমুকে। সে র্যাম্পে কিছুটা এগিয়ে হঠাৎ দু’পায়ে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল। মনে হল যেন একটা বাচ্চা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। সারা অডিটোরিয়াম হাততালি দিচ্ছে। ঘুমু র্যাম্পের
এন্ডে এসে ক্ষণিকের জন্য দাঁড়াল। তারপর আবার পিছন ফিরে হাঁটতে শুরু করল গ্রিনরুমের
দিকে।
অবিশ্বাস্য!
ওয়েল ট্রেনড কুকুররাও বোধহয় র্যাম্পে এত ভালোভাবে, এমন ভয়ডরহীন হাঁটতে পারবে না। একা
ঘুমু নয়, লালু-ভুলুদের রোডেশিয়ান টিমটাও দুরন্ত পারফর্ম করছে। গ্রিনরুমের মুখে
দাঁড়িয়ে দেখলাম, ঘুমু গ্রিনরুমে না গিয়ে র্যাম্পে ওঠার মুখে দাঁড়িয়ে র্যাম্পে
যাওয়ার আগে লালু-ভুলুদের
পিঠে মুখ ঘষে দিচ্ছে। যেন সাহস দেওয়ার মতো করে পিঠ চাপড়ে দিচ্ছে। নেড়িদের টিমটার বডি ল্যাঙ্গুয়েজই পালটে যাচ্ছে তার পর। দেখতে
দেখতে আমি আর লিরিকদা ইমোশনাল হয়ে পড়ছিলাম। অডিটোরিয়াম
থেকে ছিটকে আসা আলোয় বুঝতে পারলাম, আমরা কাঁদছি!
পাঁচ
লিরিকদাকে
আমরা প্রচণ্ড ভালোবাসি। যে কারণে ওর কোনও
ব্যাপারে কখনও না করি না। সত্যি কথা বলতে কী, ‘না’ না বললেও মনে মনে একটা ভয় কাজ
করে। কী যে ঘটিয়ে বসবে! অন্তত গত কয়েক বছরের
ইতিহাস খুব একটা সুখকর নয়। তাই একটা আশঙ্কা ঘাপটি মেরে থাকে। এই প্রথম লিরিকদার অভিনব পরিকল্পনা দশে দশ পেল। কোনও ঝুট-ঝামেলা
ছাড়াই সাকসেসফুল হোপ নাইট। এমনকি, শো স্টপার হিসেবেও লিরিকদা আর মৌদি হিট। সব
মিলিয়ে লোকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিচ্ছে আমাদের। সারা দেশ জুড়ে আলোড়ন পড়ে গিয়েছে।
অনেকেই আমাদের দেশের বড়ো বড়ো
শহরগুলোতে এইরকম ফ্যাশন শো করার জন্য অনুরোধ করছে।
হোপ নাইট
শেষ হওয়ার পর গভীর রাত পর্যন্ত আমরা দশজন একের পর এক ইন্টারভিউ দিয়েছি। ব্যাপারটা
যে কী বিরক্তিকর, বলে বোঝানো যাবে না। একই কথা বারবার বলতে হচ্ছে। তবুও আমাদের মুখে হাসিই ঝলমল করছিল।
শো শেষ
হওয়ার পর ঘুমুদের হাউজিং এস্টেটের দোতলার বিশাল মিটিং ঘরটাতে রেখে আসা হয়েছিল।
বেচারা এমনিতে ক্লান্ত। তারপর মিডিয়ার এত অত্যাচার সহ্য করা ওদের পক্ষে সম্ভব নয়।
আমরাও ক্লান্ত শরীরে যখন বাড়ির পথ ধরলাম, ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। এক অসম্ভব
তৃপ্তি নিয়ে কখন যে তলিয়ে গিয়েছি ঘুমে, বুঝতেই পারিনি।
স্বপ্ন
সত্যি হলে তার তৃপ্তিই আলাদা। সেই তৃপ্তিই বারবার স্বপ্ন হয়ে ফিরে আসে। আমার বাড়ির
সামনে একটা বিরাট ভিড় দেখতে পাচ্ছি। ‘রিন-রিন’ চিৎকার করছে অনেক লোক। গোটা
বর্ধমান কি এসে হাজির হয়েছে নাকি? আমি ব্যালকনিতে গিয়ে
দাঁড়ালাম। সকালের দিকে এখনও শীত শীত করে।
গায়ে একটা সাদা চাদর জড়িয়েছি। নিজেকে অনেকটা অমিতাভ বচ্চন কিংবা শাহরুখ খানের মতো
মনে হচ্ছে। ওঁদের জন্মদিনে জলসা অথবা মন্নতের সামনে এমন ভিড় হয়। ব্যালকনিতে
দাঁড়িয়ে ওঁরা হাত নাড়ান। আমিও গায়ের চাদরটা ঠিক করে দু’হাত তুলে জনতার উদ্দেশে হাত নাড়লাম। ‘রিন-রিন’ চিৎকারটা বেড়ে গেল। কিন্তু এই চিৎকারে যেন স্বতঃস্ফুর্ততা
নেই। কেমন যেন আর্তি। বড়ো তাগিদ নিয়ে যেন ডাকাডাকি
করছে আমার নাম ধরে। ঘুমটা ভেঙে গেল। ধড়মড়িয়ে উঠে বসে
দেখলাম, আমার ঘরে বিছানার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে লিরিকদা, মৌদি, সুমি, বাপ্তু, কচা,
সামু, সুবায়ু, অরিরা।
কী
ব্যাপার, পুরো টিম এখানে কেন? চোখ কচলে
বিছানায় বসতেই মনে হল, ওদের মুখে কালো ছায়া।
একরাশ টেনশন গ্রাস করেছে। আমি অবাক হয়ে তাকাতে লিরিকদা বলল, “ঝটপট রেডি হয়ে ক্লাবে আয়। একটা সমস্যা হয়েছে।”
“কিক্-কী হয়েছে?” আশঙ্কার চোরাস্রোত নেমে
গেল আমার মেরুদণ্ড বেয়ে।
লিরিকদার
চোখমুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভেঙে পড়েছে প্রচণ্ড। ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে অস্ফুটে বলল, “দেরি করিস না।”
পনেরো
মিনিটের মধ্যে ক্লাবে এসে দেখলাম এই সকালে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা ঘিরে রয়েছে ‘দিনরাত’-কে। ক্লাবে ঢুকে দেখলাম, লিরিকদারা মাথা নিচু করে বসে আছে। কোণের দিকে একজন অচেনা ভদ্রলোক বসে। ইনি
আবার কে?
আমি
ক্লাবে পা রাখতেই লিরিকদা বলল, “ইনি
সমরকান্তি ভট্টাচার্য। কলকাতায় বাড়ি। পেশায় আইনজীবী। উনি আমাদের শোটা গতকাল টিভিতে
লাইভ দেখে সকালে এখানে এসে হাজির হয়েছেন। রলিকে খুঁজছেন উনি।”
রলি! সে
আবার কে? মনে করার চেষ্টা করলাম। নাহ্, এমন নাম তো আগে শুনিনি।
আমি জিজ্ঞাসু চোখে লিরিকদার দিকে আবার তাকালাম। সমরকান্তিবাবু এতক্ষণ চুপ করে বসেছিলেন। তিনি হেসে
বললেন, “ঘটনাটা তোমাদের খুলেই বলি। সূর্যবিকাশ
লাহিড়ী কনস্ট্রাকশনের ব্যাবসা করতেন। উনি আমার
অনেকদিনের ক্লায়েন্ট। বিয়েশাদি করেননি। কিছুদিন আগে ওঁর পরিচিত একজন রলিকে উপহার
হিসেবে দিয়েছিল। সন্তানের মতোই ভালোবাসতেন রলিকে। উত্তরপাড়ার বাড়িতে একজন ট্রেনার
রেখে ওঁকে সবরকমের শিক্ষা দিয়েছিলেন। রলি ঠাণ্ডা স্বভাবের। মাস তিনেক আগে সূর্যবিকাশবাবু আমাকে ফোন করে বলেন, ওঁকে আননোন
নাম্বার থেকে ফোন করে খুনের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। আমি ওঁকে পুলিশে যোগাযোগ করতে বলি।
উনি বোধহয় ভয় পেয়েছিলেন। ক্লায়েন্টদের পাস্ট হিস্ট্রি মোটামুটি জানা থাকে আমাদের।
সূর্যবিকাশবাবু দীর্ঘদিন ব্যাবসা
করছেন। সেই সংক্রান্ত পুরোনো কোনও
সমস্যা হঠাৎ করে তাঁকে চেপে ধরছে কি না তখন
বুঝতে পারিনি। উনি আমাকে বলেছিলেন, একটা উইল করে যেতে চান। ওঁর কিছু আত্মীয়স্বজন
আছেন যাঁদের সঙ্গে সূর্যবিকাশবাবুর সম্পর্ক খুব একটা ভালো নয়। ওঁর অর্থের লোভেই
তাঁরা মাঝেমাঝে উৎপাত করেন। উইল করলে কার কপাল খুলবে, কে জানে! সূর্যবিকাশবাবু
অবাক করে দিয়ে বলেছিলেন, আমার সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি রলির নামে লিখে দিয়ে
যাব। কোর্ট পুরোটা কন্ট্রোল করবে। রলি আমার কাস্টডিতে থাকবে। রলির
অবর্তমানে এই বিপুল অর্ধেক সম্পত্তি চলে যাবে একটা অনাথ আশ্রমে।
বাকিটা ভাগ করে দেওয়া হবে ওঁর আত্মীয়দের মধ্যে।”
সমরকান্তিবাবু
একটু থামলেন। গুছিয়ে নিলেন নিজেকে। তারপর বললেন, “সূর্যবিকাশবাবুর কথামতো উইল তৈরির কয়েকদিন পরই পথ দুর্ঘটনায় উনি মারা যান। উনি
নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে উত্তরপাড়ায় ফিরছিলেন। শক্তিগড়ের কাছে হাইওয়েতে
অ্যাক্সিডেন্টটা হয়। উইলের ব্যাপারটা আমি আর সূর্যবিকাশবাবু ছাড়া তৃতীয় কোনও
ব্যক্তি জানত না। সূর্যবিকাশবাবুর অ্যাক্সিডেন্টের দিন থেকেই নিখোঁজ হয়ে যায় রলি।
তবুও আমি হাইকোর্টে উইল পেশ করি। রলিকে
খোঁজা শুরু হয়। কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। কিন্তু
কোনও সাড়া পাইনি। আমি ভেবেছিলাম, রলিকে বোধহয় গুম করা হয়েছে। ও না থাকলে যাদের
সুবিধা হতে পারে, তারাই ওকে হয়তো গুম করেছে। সব বুঝতে পারলেও কিছু করার নেই। প্রায়
মাস তিনেক হল রলি নিখোঁজ। হাইকোর্টের নির্দেশ মতো আগামী সপ্তাহে আত্মীয়দের মধ্যে
বিপুল সম্পত্তির অর্ধেক ভাগ করে দিতে হবে। মোটা টাকা পাবেন তাঁরা একেকজন।”
“এটা তো
বুঝলাম। কিন্তু রলির সঙ্গে আমাদের যোগটা ধরতে পারছি না,” অস্থির হয়ে বলে বসলাম আমি।
সমরকান্তিবাবু
মিষ্টি করে হাসলেন। “তোমাদের ফ্যাশন শোতেই তো রলিকে
দেখলাম। সাদা লোমওলা মিষ্টি দেখতে জার্মান স্পিৎজ। শো
স্টপার হিসেবে কাল লিরিকবাবুর সঙ্গে হাঁটছিল। ওর গলায় একটা প্লাটিনামের লকেট আছে।
তাতে এস.বি.এল লেখা।
মানে সূর্যবিকাশ লাহিড়ী।”
আমি
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। “রলি
মানে, আমাদের ঘুমু!”
সমরকান্তিবাবু
ভুল বলেননি। সত্যিই ঘুমুর গলায় একটা লকেট আছে। ওকে পাওয়ার পর থেকে আমাদের মনে এটা
নিয়ে অনেক প্রশ্ন ছিল।
সমরকান্তিবাবু
বললেন, “ঠিক সময়ে ওকে খুঁজে পেয়েছি।
কোর্টকে এখনই সবটা জানাতে হবে। আর ওর সিকিউরিটির ব্যবস্থা করতে হবে। সম্পত্তির
জন্য ওঁত পেতে রয়েছে যারা, তারা কিন্তু ওকে
ছেড়ে দেবে না। মানুষ যে কতটা নিচে নামতে
পারে, মানুষই তার উদাহরণ।”
আমার
মনটা খারাপ হয়ে গেল। ঘুমুর মুখটা মনে পড়ছে। ওর জ্বলজ্বলে দুটো চোখ। ছটফট করে বেড়ানো, আদর খেতে চাওয়া, ভালোবাসা উপুড় করে দেওয়া। ও আর আমাদের কাছে থাকবে না? আমি তাকিয়ে দেখলাম,
লিরিকদা মাথা নিচু করে বসে রয়েছে। মৌদি ঠোঁট চেপে সামলাচ্ছে নিজেকে। সুমি কাঁদছে। এর
আগেও দেখেছি, মনখারাপ আর চোখের জল ভীষণ সংক্রামক হয়। সুমির চোখের জল আমাদের চোখেও
আস্তে আস্তে ঢুকে পড়ছে।
সমরকান্তিবাবু
নরম গলায় বললেন, “তোমরা রলিকে ভালোবেসে ফেলেছ,
বুঝতে পারছি। ও এইরকমই। যার কাছে যায়, তাকেই দখল করে নেয়। ওর কপাল ভালো তোমাদের
কাছে এসে পড়েছিল। অন্য কারও হাতে পড়লে যে কী হত, কে জানে!”
কবজি
উলটে একবার হাতঘড়িটা দেখলেন সমরকান্তিবাবু। চিন্তিত মুখে
বললেন, “দশটা বেজে গিয়েছে। এবার আমাকে
রওনা দিতে হবে। তোমরা প্লিজ মনখারাপ কোরো না।
কথা দিচ্ছি, রলি আবার বেড়াতে আসবে তোমাদের কাছে। এবার ওকে এনে দাও। দুপুরের আগে
হাইকোর্টকে জানাতে হবে যে, ও বেঁচে আছে।”
লিরিকদা
আমার দিকে তাকিয়ে ইশারা করল। লিরিকদার কথা কখনও অমান্য করি না। কিন্তু আজ ইচ্ছে
করছে না ওর কথা শুনতে। মন ভার হয়ে আসছে। তবুও উঠতে হল। হাউজিং এস্টেটের অফিসের দোতলার মিটিং ঘরে ঘুমু সহ আরও দশজনকে
রাখা হয়েছে। ওদের যাতে কষ্ট না হয়, তার সমস্ত ব্যবস্থা করা আছে। কাল রাতে আমি নিজে
ঘুমুকে ঘুম পাড়িয়ে এসেছিলাম। তখন কি আর জানতাম, সকালটা অন্যরকম হবে?
আমি অফিস-ঘরের দোতলায় উঠে হলঘরের সামনে এসে দাঁড়ালাম। দরজা খোলাই ছিল। আমাকে দেখলে ঘুমুরা ছুটে আসে। আজ কেউ এল না। হলঘরে উঁকি
দিয়ে দেখলাম, ভেতরটা ফাঁকা। লালু-ভুলুদের পুরো বাহিনীটা নেই! এমনকি, ঘুমুকেও দেখতে
পাচ্ছি না! টেনশনের একগুচ্ছ কালো পিঁপড়ে আমার শরীর জুড়ে দাপাদাপি করছে। ঘুমু
কোথায়? পুরো দোতলাটা তন্নতন্ন করে খুঁজলাম। নাহ্, কোথাও নেই!
আমি উদ্ভ্রান্তের
মতো ছুটতে শুরু করলাম ক্লাবের দিকে। মাথায় একরাশ দুশ্চিন্তা চেপে বসেছে।
সমরকান্তিবাবু যেমন হোপ নাইট দেখে ঘুমুকে চিনতে পেরেছেন, সূর্যবিকাশ লাহিড়ীর
আত্মীয়স্বজনের পক্ষেও ওকে চিনে নেওয়াটা কঠিন নয়। রাতের
অন্ধকারে ওদেরই কেউ কি ঘুমুকে গুম করল?
ক্লাবের
সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল লিরিকদারা। আমাকে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটতে দেখে সামু, বাপ্তু,
অরি, সুবায়ুরা এগিয়ে এল। হাঁপাতে হাঁপাতে আমি বললাম, “ঘুমু অফিস-ঘরে নেই। এমনকি লালু-ভুলুদেরও
দেখতে পেলাম না। ঘুমুকে কি কেউ কিডন্যাপ করল?”
লিরিকদার
চোখগুলো উত্তেজনার বশে ঠিকরে বেরিয়ে এসেছে। ওর শুধু ঠোঁট নড়া দেখতে পাচ্ছি। কী
বলছে তার কিছুই বুঝতে পারলাম না।
সমরকান্তিবাবুও
ঘটনার আকস্মিকতায় যেন থমকে গিয়েছেন। ভাঙা ভাঙা স্বরে বললেন, “কী বলছ? কে ওকে নিয়ে গেল? চারদিক খুঁজে দেখো। ওকে না পেলে কোর্ট যে আত্মীয়দেরই
অর্ধেক সম্পত্তি দিয়ে দেবে!”
আমাদের
মধ্যে মৌদির মাথা সবচেয়ে ঠাণ্ডা। ও বলল, “চল, সবাই মিলে পুরো হাউজিংটা
খুঁজি। কোথায় আর যাবে? নিশ্চয়ই আশেপাশে আছে।”
ঘণ্টা খানেক ধরে পুরো হাউজিংয়ে চিরুনি তল্লাসি চালিয়েও কোথাও ঘুমুকে খুঁজে পেলাম না। ঘুমু আমাদের সবার বাড়ি চেনে।
আমরা যে যার নিজেদের বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নিয়েও দেখলাম। নাহ্, কোত্থাও নেই। আশ্চর্য
ব্যাপার হল, শুধু যে ঘুমু কর্পূরের মতো উবে গিয়েছে তাই নয়, লালু-ভুলুদেরও দেখতে
পাচ্ছি না। এমনকি, হাউজিংয়ের একটাও কুকুর নজরে পড়ছে না। সবাই যেন হাওয়ায় মিলিয়ে
গিয়েছে। ঘুমুকে খুঁজতে গিয়ে আমরা আবিষ্কার করেছি, কারও কারও বাড়ির পোষ্যরাও
নিখোঁজ। সব মিলিয়ে রীতিমতো হইচই পড়ে গিয়েছে হাউজিংয়ে। এমন রহস্যজনক ঘটনা এর আগে
কখনও ঘটেনি। লিরিকদা দেখলাম একেবারে ভেঙে পড়েছে। কেমন যেন পাংশু মুখ নিয়ে ঘুরে
বেড়াচ্ছে। আমাদের যাকেই দেখতে পাচ্ছে, উদ্বেগ নিয়ে জানতে চাইছে, ঘুমুকে পাওয়া গেল
কি না।
ঘণ্টা খানেক পর ক্লাবে এসে বসলাম আমরা। মানসিকভাবে সবাই ভেঙে
পড়েছি। সমরকান্তিবাবুকে দেখার পর থেকে মনটা খারাপ হয়েছিল। ঘুমুর ওপর আমাদের মায়া
পড়ে গিয়েছে। ওকে নিয়ে চলে যাবেন উনি! কিন্তু এই ঘটনার জন্য কেউই তৈরি ছিলাম না।
সমরকান্তিবাবু
এতক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “এবার তো
পুলিশে খবর দিতে হয়। ব্যাপারটা কিন্তু আর শুধু রলিকে নিয়ে নয়। তোমাদের হাউজিংয়ের
অন্তত ষাট-সত্তরটা কুকুরও আচমকা হারিয়ে গিয়েছে।”
লিরিকদা
মাথা নেড়ে মৌদির মাধ্যমে বলল, “কী হচ্ছে,
কিছুই বুঝতে পারছি না। ঘুমু উধাও হয়ে যাবে কেন? আর হাউজিংয়ের বাকি কুকুরগুলো? ওরাও
এলাকা ছেড়ে বেরিয়ে যাবে? হয় নাকি? তাছাড়া কেউ যদি একসঙ্গে এতগুলো কুকুর গুম করত,
তাহলে ওরা ছেড়ে দিত? চিৎকার চেঁচামেচি করে হাউজিং মাথায় করে ফেলত না? এত চুপিসাড়ে ব্যাপারটা ঘটত কি?”
একটু
থেমে লিরিকদা আবার বলল, “নাহ্, এবার পুলিশের সঙ্গে
যোগাযোগ করতেই হবে।”
লিরিকদা
পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে বর্ধমান থানার নম্বর ডায়াল করতে যাবে, এমন সময়
ইন্দ্রদা এসে হাজির। পার্কের পিছন দিকে ওর একটা সাইকেল স্ট্যান্ড আছে। ইন্দ্রদা
যেমন লিরিকদার খুব কাছের বন্ধু, তেমনই আমাদেরও ভালোবাসে। ক্লাবে ঢুকে হাসতে হাসতে
ইন্দ্রদা বলল, “লিরিক, তুই কিন্তু পারিস! গতকাল
রাতে হোপ নাইট শেষ হওয়ার সময় বললি, ডগ ভিলেজের জন্য জায়গা খুঁজতে হবে। এরই মধ্যে
সেটা খুঁজেও নিলি? ভালো, ভালো। রাস্তার কুকুরগুলোর জন্য কেউ কিছু ভাবছে দেখে ভালো
লাগছে রে। তোরা এগিয়ে যা।”
লিরিকদা
ফ্যাকাশে মুখ তুলে একবার দেখল ইন্দ্রদাকে। তার পর নিচু গলায় বিড়বিড় করে বলল, “ওসব
খুঁজে আর কী হবে? ঘুমুকে পাওয়া যাচ্ছে না। হাউজিংয়ের বাকি কুকুরগুলোও উধাও।
বেচারাগুলো কোথায় গেল কে জানে।”
লিরিকদার
কথা শুনে ইন্দ্রদার হাসিটা হঠাৎই মিলিয়ে গেল। ও উত্তেজিত গলায় বলে উঠল, “ঘুমুকে পাওয়া যাচ্ছে না? কী বলছিস? আমি আলমগঞ্জের সাহেববাগানের পাশ দিয়ে আসার সময় ওকে দেখে এলাম যে!”
ইন্দ্রদারা
একসময় হাউজিংয়ে থাকত। এখন নূতনগঞ্জের দিকে বাড়ি করে উঠে গিয়েছে। তবে সাইকেল
স্ট্যান্ডটা যেহেতু ওর, তাই দু’বেলা নিয়ম করে আসে। হাউজিংয়ে আসার সময় ওকে আলমগঞ্জ
পেরিয়ে আসতে হয়।
লিরিকদা
সটান উঠে দাঁড়াল। ইন্দ্রদার কাঁধ খামচে আকুলতা ঢেলে জিজ্ঞেস করল, “তুই সত্যি বলছিস?”
আমরাও
পর্যন্ত অবাক হয়ে গিয়েছি। ইন্দ্রদা মজা করছে না তো?
ইন্দ্রদা
বলল, “সে কী রে! তোরা জানিস না? আমি ভাবলাম
সাহেববাগানটা তোরা কিনে নিয়েছিস! ওখানেই বানাবি ঘুমুদের থাকার গ্রাম!”
লিরিকদা
বলল, “ইন্দ্র, তোর বাইক আছে না? আমাকে নিয়ে চল ওখানে। আর আপনি,”
সমরকান্তিবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, “গাড়ি নিয়ে এসেছেন না? আমাকে ফলো করুন।”
ব্যাপারটা
এখনও আশ্চর্য লাগছে। ঘুমু ওর দলবল নিয়ে সাহেববাগানে গেল কী করে?
হাউজিং
থেকে বেরিয়ে মিনিট পনেরো গেলেই আলমগঞ্জ। জায়গাটা
আসলে বর্ধমানের ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেল্ট। রাইস মিল, চিঁড়ে কল, লেদ কারখানায় ভর্তি। দুর্গাপুর এক্সপ্রেস-ওয়ের
ধারে আলমগঞ্জের সাহেববাগান। ইংরেজ আমলে কোনও এক সাহেব জায়গাটাতে বাগানবাড়ি বানিয়েছিলেন।
সেই থেকেই ওটা সাহেববাগান নামে পরিচিত। এখন অবশ্য জায়গাটা জঙ্গল হয়ে পড়ে রয়েছে।
তবে পোড়ো বাড়িটা এখনও টিকে আছে।
আমরা
পৌঁছনোর আগেই লিরিকদা আর ইন্দ্রদা পৌঁছে গিয়েছে। অবাক হয়ে আমরা দেখলাম, সাহেববাগানের
পুরোনো লোহার গেটটার বদলে একটা ঝকঝকে
গেট। তার গায়ে একটা বড়ো সাইনবোর্ড ঝুলছে — সূর্যবিকাশ
লাহিড়ী।
সমরকান্তিবাবুও
একটু ঘাবড়ে গিয়েছেন। মাথা নেড়ে বললেন, “হ্যাঁ,
সূর্যবিকাশবাবু খুন হওয়ার কিছুদিন আগে এই প্রপার্টিটা কিনেছিলেন। তাহলে কি খুন
হওয়ার আশঙ্কায় উনিই রলিকে লুকিয়ে রেখে গিয়েছিলেন এখানে? যেদিন রোড অ্যাক্সিডেন্টে
মারা যান উনি, সেদিন বর্ধমান থেকে উত্তরপাড়ায় ফিরছিলেন। সেদিন তাহলে এখানেই
এসেছিলেন?”
গেটে
তালা দেওয়া ছিল না। আমরা গেট ঠেলে সাহেববাগানে ঢুকে পড়লাম। জায়গাটা মনোরম। সবুজে
মাখামাখি। নানান পাখপাখালির ডাক ভেসে আসছে। প্রাণ জুড়িয়ে গেল সাহেববাগানে ঢুকে।
সূর্যবিকাশবাবু বাগানবাড়িটা কেনার পর কিছুটা সংস্কার করিয়েছিলেন, দেখলেই বোঝা যায়।
মোরাম-ঢালা
রাস্তা সোজা চলে গিয়েছে। আমরা কিছু দূর এগোতেই দেখতে পেলাম একটা ব্রিটিশ আমলের
বাংলো। বাড়িটার সামনে একটা আগাছায় ভরা লন। তার সামনে পদ্মফুলে ভরা একটা পুকুর।
আমরা একটু এগোতেই ‘ভুক-ভুক’ আওয়াজ শুনতে পেলাম। ঝোপঝাড় ভেঙে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে
লালু-ভুলুরা। আমাদের চিনতে পেরে নাক ঘষে দিয়ে যাচ্ছে প্যান্টে, পায়ে। আনন্দে
গড়াগড়ি খাচ্ছে কেউ। নানান রংয়ের প্রায় শ’দেড়েক কুকুর! ঘুমু? ঘুমু কোথায়?
সমরকান্তিবাবু
চেঁচালেন, “রলি… রলি!”
লিরিকদা
ভেজা গলায় চেঁচাল, “লুঁকুঁ… লুঁকুঁ!”
আমরা
সবাই একসঙ্গে ডাকলাম, “ঘুমুউউউউউ!”
দেখলাম,
ভাঙাচোরা বাংলা থেকে বেরিয়ে এসে লনের সামনে দাঁড়িয়েছে ঘুমু। ও যেন অপেক্ষা করছিল
আমাদের জন্য। দৌড়তে দৌড়তে আসছে। দূর থেকে
মনে হল, একটা সাদা তুলোর বল হাওয়ায় উড়ছে।
সমরকান্তিবাবুর
দিকে তাকিয়ে লিরিকদা বলল, “হোপ নাইট
থেকে আমরা একটা বড়ো ফান্ড জেনারেট করেছি। ডগ ভিলেজ
বানানোর জন্য। এখানেই ভিলেজটা বানালে আপত্তি নেই তো আপনার?”
সমরকান্তিবাবু
হেসে বললেন, “আমি আপত্তি করার কে? রলি, মানে
আপনাদের ঘুমুর যখন আপত্তি নেই!”
আমরা
তাকিয়ে দেখলাম, ঘুমু ছুটতে ছুটতে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। ওর দুটো সাদা কান দুলছে।
জিভটা কাত হয়ে বেরিয়ে রয়েছে একদিকে। একছুটে
লিরিকদার কোলে উঠে সোহাগী আওয়াজ করল ঘুমু। বোধহয় বলল, ‘তোমরা রাগ করোনি তো? না বলে চলে এসেছি বলে?’
আমরা
সবাই হেসে উঠলাম। লজ্জায় লিরিকদার বুকে মাথা গুঁজল ঘুমু।
_____
ছবিঃ পার্থ মুখার্জী
No comments:
Post a Comment