সহেলী রায়
এক
পাহাড়ি উতরাই ধরে গাড়িটা যেন গড়িয়ে চলেছে। সামান্য
এদিক-ওদিকেই ঘটে যেতে পারে অঘটন। ডান পাশে সুগভীর খাদ। ঋষিদের পাড়ায় অনেকখানি খালি
জমি পড়েছিল কর্পোরেশনের। শপিং মল হবে কথা ছিল। তবে পাড়ার সমস্ত বড়োদের বারবার আবেদনে
সেখানে গড়ে উঠেছে একটা সুন্দর পার্ক। প্রচুর গাছগাছালি নিয়ে সবুজের সমারোহ। সেখানে
একটা সুউচ্চ স্লিপও আছে। ঋষির খুব পছন্দের রাইড এই স্লিপ। স্লিপের মাথায় উঠে বসলে
ওদের গোটা পাড়াসহ উত্তর কলকাতার অনেকখানি অংশ দেখতে পাওয়া যায়। এমনকি পাঁচ মাথার
মোড়ের ঘোড়ায় সওয়ার নেতাজীও। ঋষি স্যালুট ঠুকে ‘জয় হিন্দ’ বলে শরীরটা
হালকা করে ছেড়ে দেয় স্লিপের ওপর। কয়েক মুহূর্তে শহরটা মেলাতে মেলাতে শুধু পার্কের
সবুজ গালিচা হয়ে যায়। এখন গাড়িতে বসেও সমান অনুভূতি হচ্ছিল ঋষির। যেন স্লিপে বসে
গড়িয়ে যাচ্ছে। সবার মুখেই কেমন ভয় মাখানো হাসি। একে অপরকে ধরে বসে আছে। ঋষির অবশ্য
বেশ মজাই লাগছে। গাড়ি এসে অবশেষে সমতলে দাঁড়াল। সবার মুখ থেকে ‘উফ্’ বেরিয়ে এল।
হাঁফ ছেড়ে বাঁচার উন্মাদনা। কিন্তু এ কী! সামনে কী?
“পয়দল পার হোনা পড়েগা?” কোমর ছাড়াতে সকলেই প্রায়
গাড়ি থেকে নেমে পড়েছে। ঋষির বাবা সিদ্ধার্থ প্রশ্নটা ছুড়লেন ড্রাইভার শেরিংকে।
বাকিরাও হাঁ করে তাকিয়ে শেরিংয়ের মুখের দিকে।
“নহি সাব, গাড়িসে যায়েগা,” শেরিংয়ের চোখে
মুখে সরল হাসি।
ঋষির খুব ভালো লেগে গেছে শেরিং ভাইয়াকে। এন.জে.পি
থেকে ঋষিদের সঙ্গী শেরিং। গতকাল ট্রেন থেকে নেমে প্রথমে ওরা আসে কালিম্পংয়ে। আজ গন্তব্য বিদ্ধ্যাং।
কালিম্পং থেকে পনেরো কিলোমিটার দূরে হিমালয়ের অন্দরমহলে লুকিয়ে থাকা ছোট্ট গ্রাম।
এই দু’দিন ধরে শেরিং ভাইয়ার বোলেরোতে করে ঘুরে বেড়াচ্ছে ওরা। খানিক যেতে না যেতেই
বারবার গাড়ি দাঁড় করিয়ে ছবি নেওয়া বা কখনও প্রকৃতি উপভোগ করা — এত
কঠিন রাস্তা, তাও শেরিংয়ের মুখে কোনও বিরক্তি নেই। সারাক্ষণ হাসিমাখা একটা মুখ।
শেরিংয়ের কথা শুনে সবাই এ
ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। সামনে হুড়মুড় করে নদী বয়ে চলেছে। নদীর ওপর ছোটো বড়ো
অজস্র বোল্ডার পাথর। এর ওপর দিয়ে গাড়ি পেরোবে? শেরিং সবাইকে গাড়িতে উঠে পড়তে বলল।
“রেলি খোলা,” শেরিং
হেসে এই নদীর নাম বলল।
ঋষি জানে এইসব পাহাড়ি ঝোরা
বা ছোটো নদীগুলোকে স্থানীয় মানুষেরা খোলা বলে। গাড়ি বড়ো বড়ো বোল্ডারের ওপর দিয়ে
নৌকোর মতো দুলতে দুলতে রেলি খোলা পেরোচ্ছে। সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ছে এর ওর ঘাড়ে। ঋষি
ও ওর বন্ধু আদি, ওদের বাবা-মা আর আদির বোন টুকি এসেছে বেড়াতে।
“ওয়াও! কী সুন্দর জায়গা রে
ঋষি!” অবাক
হয়ে তাকিয়ে আছে আদি।
সকলেই খুশিতে ছটফট করছে।
চারদিকে পাহাড়ে ঘেরা একটুকরো সমতল। ছড়ানো ছেটানো কটেজ। রেলি খোলার জলের স্রোতের
আওয়াজ। খোলার ওপর একটা ঝুলন্ত লম্বা ব্রিজ। পাহাড়,
পাহাড়ি ঝোরা, ঝুলন্ত ব্রিজ সব মিলিয়ে যেন ক্যালেন্ডারের ছবির শহর। কটেজে সবাই জিনিসপত্র
রেখে এসে এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়েছে। ঋষি, আদি আর টুকি নদীতে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে
পড়েছে।
দুই
ঋষি আর আদি একই স্কুলে
ক্লাস সেভেনে পড়ে। টুকি অবশ্য ক্লাস ফোর। তবে দুষ্টুমিতে দাদাদের টক্কর দিতে পারে
টুকি। ওই আগে দৌড়ে চলে গেল নদীর দিকে। বড়োরা বারবার করে বলে দিলেন, কেউ যেন বেশি দূর
না যায়। পাথরগুলোর ওপর অনবরত জল বয়ে চলেছে বলে সামান্য পিচ্ছিল হয়ে আছে। ওরা
তিনজনেই জুতো পাড়ে খুলে একে অপরের হাত ধরে মাঝনদী বরাবর একটা উঁচু পাথরের উপর বসে
জল নিয়ে খেলা করতে লাগল। ঋষি হাঁ করে
ঝুলন্ত ব্রিজখানা দেখছিল। হালকা হাওয়ায় অল্প অল্প দুলছে ব্রিজটা।
“ব্রিজের ওপারে কী আছে রে?” আদির খুব
অবাক প্রশ্ন।
“গ্রাম। ঐ গ্রামটার নামই আসলে বিদ্ধ্যাং।”
ঋষির বরাবরের অভ্যেস কোথাও
আসার আগে সেই জায়গা নিয়ে ইন্টারনেটে অল্পবিস্তর ঘাঁটাঘাঁটি করা। এই অভ্যেস অবশ্য বাবার কাছ থেকে
পাওয়া।
“চ, যাবি?”
“না, এখন গেলে বকা খাবি।
সবার সঙ্গেই যাব। লাঞ্চ করেই তো যাব।”
গোল করে ছাউনি দেওয়া কিছুটা
অংশে ডাইনিংয়ের ব্যবস্থা। গরম
ভাত, স্কোয়াশের তরকারি আর ডিমের ঝোল দিয়ে সবাই খুব তৃপ্তি করে খাচ্ছে। চারদিকে পাহাড়ের মালা দেখতে দেখতে
খিদের পেটে সবাই অমৃতের স্বাদ পাচ্ছে।
খাওয়ার পরে হালকা একটু বিশ্রাম নিয়েই সবাই বেরিয়ে পড়ল ব্রিজের দিকে। ব্রিজে ওঠার মুখে একটা বিরাট গাছের নিচে কিছু
সিঁদুর মাখানো পাথর পড়ে আছে।
সামনে কিছু ফুলও আছে।
হয়তো পুজো হয় পাথরগুলো। ঋষি খানিকটা ঝুঁকে পাথরগুলো দেখল কিছু
সময় ধরে। তারপর
সবার সঙ্গে পা মেলাল। কয়েক
ধাপ সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই ব্রিজে উঠে পড়ল ওরা।
ধীরে ধীরে দুলুনি খেতে খেতে ওরা চলে গেল ওপারে। ওপারে কিছুটা জনবসতি আছে। পাহাড়ি লোকজন যে যার কাজে ব্যস্ত। ঋষিরা সামান্য এগিয়ে গিয়ে সব ঘুরেফিরে
দেখতে লাগল।
“টুকি কই? টুকি?” আদির মা
মোহিনী আন্টি হঠাৎ খুব ছটফট করতে লাগলেন।
সত্যি টুকিকে দেখা যাচ্ছে
না। ও একটু আগে আগেই হাঁটছিল। ঋষি আর আদি পেছনেই ছিল, তবে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে
বলতে যাওয়াতে খেয়াল করেনি টুকি অনেকটা এগিয়ে গেছে।
“বোন তো সামনেই ছিল, গেল
কই?” আদিও খুব উদ্বিগ্ন।
ঋষির একটু রাগই হল নিজের
ওপর। প্রথম থেকেই বড়োরা বলে আসছিলেন টুকির খেয়াল রাখতে। এত গল্পে মগ্ন হয়ে গেল যে ছোটো
মেয়েটা কোথায় চলে গেল খেয়ালই হয়নি। বাকিরাও সবাই ‘টুকি টুকি’ বলে চিৎকার করতে
লাগল।
এক মহিলা নিজের ঘরের আধফালি
বারান্দায় বসে দুটো কুকুর ছানার মাথায় হাত বোলাচ্ছিল। ঋষি তাকে হিন্দিতে জিজ্ঞেস করল। বাচ্চা মেয়ে শুনে মহিলার চোখদুটো
উদাস হয়ে গেল। মহিলা শুধু দু’পাশে মাথা নাড়ল। তার মানে সে টুকিকে দেখেনি। মোহিনী
আন্টি এবার কাঁদতে শুরু করে দিলেন। ঋষির মাও অস্থির হয়ে উঠলেন। ঋষির বাবা
সিদ্ধার্থ সবাইকে কটেজে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। হোমস্টের মালিক করণ রাইয়ের সঙ্গে
আলোচনা করে ঠিক করতে হবে। সে নিশ্চয়ই এই গ্রামের লোকজনদের চেনে।
সন্ধে তখন নামবে নামবে। ব্রিজের
ওপর থেকে যতদূর দেখা যায় দু’দিকের ঘন জঙ্গলে ঘেরা পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে হাজার হাজার পাথর পেরিয়ে বয়ে চলেছে নদী।
গোল থালার মতো অস্তাচলের সূর্য এখনই যেন ঝাঁপ দেবে নদীর কোলে। তার আগে সোনা ছড়িয়ে
দিয়েছে প্রতিটি পাথরের মাথায়। চারদিক কেমন রহস্যময় হয়ে উঠেছে। এত অপরূপ দৃশ্য মনের
মধ্যে এত টানাপোড়েন সত্ত্বেও ঋষির চোখ এড়াল না। ব্রিজের অন্যদিকটাতেও একবার মুখ
ঘোরাল ঋষি। যতদূর চোখ যায় মনে হল থরে থরে বেশ কিছু চোখ-নাক-মুখ বসে রয়েছে। কী
ওগুলো? গাটা কেমন ছমছম করে উঠল। এতটা উঁচুতে উঠেছে বলেই ওগুলো দেখা গেল। নয়তো
কটেজের কাছে থেকে কিছুই দেখা যায়নি। ঋষি এখন কোনও মুখ খুলল না। এখন সঠিক সময় নয়। আগে টুকিকে খুঁজে পাওয়া দরকার।
তিন
টুকির বাবা প্রাণেশবাবু হন্তদন্ত
হয়ে রিসর্টের মালিক করণ রাইকে ডাকাডাকি শুরু করলেন। করণ এবং বাকি কর্মচারীরাও চ্যাঁচামেচি
শুনে বাইরে বেরিয়ে এল। ঋষি
দেখল উত্তেজনায় প্রাণেশ আঙ্কেল ভালোভাবে কথা বলতে পারছেন না। আন্টি কেঁদেই চলেছেন অনবরত। করণ রাই সবাইকে শান্ত হতে বলে মোবাইল
বের করে কারও সঙ্গে নেপালি ভাষায় কিছু বলতে শুরু করলেন।
“বাবা-আ-আ...”
টুকির গলা না? সবাই চমকে উঠল। হ্যাঁ, ব্রিজের ওপর থেকে টুকিকে দেখা যাচ্ছে। কারও একটা
হাত ধরে এদিকেই আসছে। ব্রিজ থেকে নেমে দৌড়ে এল টুকি। আন্টি ওকে জড়িয়ে ধরলেন। টুকির
কপালে কমলা রঙের সিঁদুর লেপে আছে, তার ওপর চাল বসানো।
“এসব কী? কোথায় গেছিলি?” প্রাণেশ
আঙ্কেল একটু রেগেই জিজ্ঞেস করলেন।
“আরে সাব, গুসসা মত হইয়ে।
বচ্চি দেবী কা রূপ হোতি হ্যায়। মন্দিরমে থোড়া আরতি কিয়ে ইনকা।”
এতক্ষণে সবাই মন দিল টুকির
সঙ্গে আসা লোকটার দিকে। একে কিন্তু একদমই নেপালিদের মতো দেখতে নয়। পরনে কমলা রঙের
লুঙ্গি-চাদর। করণ আঙ্কেল আলাপ করিয়ে দিলেন।
ওপরে শেরওয়ালির মন্দির আছে। লোকটি ওখানকার পূজারি। ঋষি লোকটার চোখের মধ্যে যেন
কীসের একটা ছায়া দেখতে পেল। একটু আগে ব্রিজ থেকে আবছা যেসব চোখ-নাক-মুখ দেখতে পেয়ে
একটা অনুভূতি হয়েছিল, এই পূজারির চোখের দিকে তাকালেও তেমন একটা গা ছমছমে ভাব আসছে।
আর কেউ লক্ষ করল কি না কে জানে, তবে ঋষির কিছু ভালো ঠেকছে না।
বেশি কথা না বাড়িয়ে সবাই
কটেজে ঢুকে পড়ল। খানিক উত্তেজনার পর সকলেরই গরম লাগছিল। তবে সেই রেশ কাটিয়ে হুড়মুড়
করে আক্রমণ করছে পাহাড়ি শীতের কামড়। সবাই গরম জামা চাপিয়ে করণ আঙ্কেলের পাঠানো গরম
কফি আর চিকেন পকোড়ায় মন দিয়েছে। তার সঙ্গে চলছে টুকি টকিং রেডিও। ঋষির বাবা টুকিকে
এই নামেই ডাকেন। টুকি বলে যাচ্ছে মন্দিরে তাকে বসিয়ে কীভাবে পুজো করা হল। সবাই
অবাক হয়ে শুনছে। ঋষির মনটা বারবার ব্রিজের ওপারে চলে যাচ্ছে।
“নাস্তে মে ক্যায়া লেনা
হ্যায়?” করণ আঙ্কেল নিজে এসেছেন পরদিন ব্রেকফাস্টের অর্ডার নিতে। “আপলোগো কো এক
বাত বতানা হ্যায়। বাচ্চো কো কটেজ কি সাইড হি রহনে দিজিয়ে। ব্রিজকে নিচে সে উস সাইড
মত জানে দিজিয়ে। ওঁহাপে কুছ ঠিক নেহি হ্যায়। বহত দিনো সে প্রবলেম চল রহা হ্যায়।”
সবাই খুব উদ্বিগ্ন হয়ে তাকাল
করণজির দিকে। ঋষি নড়েচড়ে বসল।
“আপ থোড়া ডিটেল মে বতাইয়ে,
করণজি।” ঋষির মা মুখ খুললেন টেনশনে।
করণ আঙ্কেল সংক্ষেপে
বললেন, ওখানে কিছু পাথর আছে যেখানে আজব সব মুখ খোদাই করা আছে। সে মুখ কে, কবে,
কীভাবে, কখন খোদাই করেছে কেউ জানে না। বেশ কয়েক বছর ধরে হয়েই চলেছে। প্রতিটা
খোদাইওয়ালা পাথর সৃষ্টির দু’দিন আগে গ্রামের এবং আশেপাশের বহু গ্রামের একটা করে
বাচ্চা মেয়ে হারিয়ে যায়। স্থানীয় মানুষদের
বিশ্বাস, কোনও অজানা অভিশাপে এই গ্রামের বা আশেপাশের গ্রামের মেয়েরা ওখানে পাথর হয়ে যায়। তবে ট্যুরিস্টদের সঙ্গে
আজ পর্যন্ত কোনও বিপদ ঘটেনি। ট্যুরিস্টরাই রুটি–রুজি-রোজগার। করণ আঙ্কেল নিজের
মেয়েদেরও ভয়ে এখানে আনেন না। করণ আঙ্কেলের পরিবার কালিম্পংয়ে থাকে। এই করে এখন এখানকার
গ্রামগুলিতে কমবয়সি মেয়ে আর নেই। এতে স্থানীয় বাসিন্দাদের আশঙ্কা, এবার নাকি মহাপ্রলয় নেমে
আসবে এখানে। টুকিকে ওইজন্যই ওরা আরতি করেছে। ওরা মেয়েদের দেবীরূপে মানে।
এতটুকু শুনেই শিউরে উঠল
সকলেই। তবুও ভালো, ট্যুরিস্টদের সঙ্গে কিছু হয় না। ঋষি কিন্তু নিশ্চিন্ত হতে পারছে
না। আদি ভয়ে মাথা পর্যন্ত লেপ টেনে নিল। এমনিতেও পরদিন ওদের দুপুরে এখান থেকে ধোতরে
চলে যাবার কথা। মানে মানে রাতটুকু কাটলে শান্তি। সবাই ডিনার করে তাড়াতাড়ি শুয়ে
পড়ার কথা ভেবে নিল। ঋষি, আদি, বিশেষত টুকিকে সাবধান করা হল সকালে উঠে বড়োদের সঙ্গে
ছাড়া কেউ যেন বাইরে না বেরোয়।
প্রথম রাতটুকু ঘুমিয়ে পড়লেও
কিছু একটা অদ্ভুত শব্দে ঋষির ঘুম ভেঙে গেল। একটা বড়ো রুমে পরপর চারটে খাট। ঋষি আর
আদি একটা খাটে। জানালার পর্দাগুলো খুব পাতলা। ঋষি দেখল কেমন যেন একটা ছায়া সরে সরে
যাচ্ছে। না নড়াচড়া করে চুপচাপ পর্যবেক্ষণ করতে লাগল সে।
“নওসো নিননানব্বৈ হো গয়া। অওর
এক। বাস।”
“ট্যুরিস্ট হ্যায়। কুছ
গড়বড় হোগা তো বদনাম হো যায়েগা। ট্যুরিস্ট আনা বনধ হো যায়েগা।”
“বখওয়াস মত করো, সব ধ্বংস
হো যায়েগা।”
খুব ফিসফিস করে কথোপকথন
চলছে। চারদিক সাংঘাতিক নিস্তব্ধ, আর ঋষি সম্পূর্ণরূপে জেগে। কান খাড়া করে শোনা যায়
যতটা। তার মানে যা ভেবেছে তাই। টুকির একটা বিপদ আছে। খানিকক্ষণ পর আবার চারপাশ
নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
ঋষি বালিশের পাশ থেকে ঘড়ি
বের করে দেখল তিনটে বাজে। আদিকে আস্তে আস্তে ডেকে তুলল। পা টিপে টিপে বাইরের দরজা
সাবধানে খুলে বেরিয়ে এল। বাকিরা অঘোরে ঘুমোচ্ছে।
চার
“বেরোলি কেন এত রাতে?” আদির
ভয়ার্ত গলায় প্রশ্ন।
“আমার সঙ্গে চল। যা বলব
করবি। গড়বড় করিস না। টুকির খুব বিপদ।”
ঋষি আশেপাশে দেখে নিল। না,
কাউকে দেখা যাচ্ছে না। লো পাওয়ারের একটা টর্চ নিয়ে দু’জনে এগোল। রেলি খোলার ছপাত ছপাত শব্দ, পাশ
দিয়ে ওরা এগিয়ে চলেছে। ব্রিজের নিচ দিয়ে এগোতে গিয়েই আদি ঋষির হাত চেপে ধরল। “করছিস
কী? ওদিকে যেতে বারণ করল তো!”
“উফ্! তুই মেয়ে? ওদিকে
শুধু মেয়েদের ভয়।”
ঋষির জবাবে আদি কিছুটা
বুকে বল পেল।
বেশ খানিকটা যাওয়ার পর
টর্চের আলো একটা পাথরে পড়তেই দু’জনে চমকে উঠল। অদ্ভুত চোখ-নাক-মুখ খোদাই করা।
পাশাপাশি পর পর এরকম অজস্র। যেন সেই রূপকথার পাথরের দেশ। সবার যেন প্রাণ আছে।
জিয়নকাঠি ছুঁয়ে দিলেই কথা বলবে। দু’জনের চোখেই অপার বিস্ময়। ঋষি হঠাৎ আদির হাত ধরে
হ্যাঁচকা টান দিল। দু’জনেই একটা বড়ো পাথরের পেছনে গিয়ে বসল। আদি কিছু বুঝে ওঠার
আগেই দেখল, কালকের সেই পূজারি আর সঙ্গে রিসর্টেরই এক কর্মচারী অন্য একটা পাথরের
পেছন থেকে বেরিয়ে আসছে। আদি খেয়াল না করলেও ঋষি ঠিক খেয়াল করে আদিকে টেনে নিয়েছে।
“অওর এক, বাস অওর এক। ইসকে
বাদ সব খতম। জ্যায়াদা টাইম নহি হ্যায়, লড়কি উঠা লো। কাল শেরওয়ালি কি সামনে উসকি
বলি কি পূজা ভি হো গয়ি। চওবিস ঘন্টেকে অন্দর বলি নহি হোনে সে অনর্থ হো যায়েগা। তুমে
ভি মারনা পড়েগা।”
“না-আ-আ!” আদি হঠাৎ চিৎকার
করে উঠল। ঋষি ওর মুখটা চেপে ধরল। তবে শেষরক্ষা হল না। পূজারিরা এসে ওদের দু’জনকে
পাথরের পেছন থেকে বের করে জাপটে ধরল।
“পহলে ইয়ে দোনো কো খতম
করো।” পূজারির চোখ হালকা ভোরের আলোতেও বোঝা যায়, রক্তজবার মতো লাল।
“শাস্ত্রীজি, সব ট্যুরিস্ট
হ্যায়। প্রবলেম হো যায়েগা। মুঝে পয়সা নহি চাহিয়ে।” রিসর্টের কর্মচারী ছেলেটি কাকুতিমিনতি করতে
লাগল।
“উয়ো সব বাদ মে দিখা
যায়েগা। জ্যায়দা সময় নহি হ্যায়। শেরাওয়ালি কি ইচ্ছা হ্যায়। জয় মাতা দি!”
কোমর থেকে কিছু একটা বের
করে ঋষির মাথায় ধরল পূজারি। ঋষির হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে ফেলেছে
ভয়ে। পরক্ষণেই পূজারির হাত আলগা হয়ে গেল। ঋষি চোখ খুলে দেখল বাবা পেছন থেকে এসে পূজারিকে জাপটে ধরেছে। প্রাণেশ আঙ্কেল
রিসর্টের ছেলেটাকে। করণ আঙ্কেল ছেলেটাকে ধরে মারতে শুরু করল বেধড়ক। ওদেরকে রিসর্টে নিয়ে আসা হল।
চারদিকে বেশ পরিষ্কার হয়ে
উঠেছে আকাশ। খানিক বাদে রেলি খোলা পেরিয়ে দুটো পুলিশ ভ্যান এগিয়ে এল। আশপাশের
গ্রাম ভেঙে লোক জড়ো হয়েছে রিসর্টে।
“আমি তো জানি আমার গুণধর
ছেলেকে। সবেতেই তার কৌতূহল। কাল রাতে করণজি যখন বিপদের কথা বলছিল তখনই ঋষির চোখমুখ উত্তেজিত। তখন থেকেই
জানি ও কিছু একটা করবেই। তাই রাতে জেগেই ছিলাম। তাতে উপকারই হল। কিছু কথোপকথন কানে
এল। করণজিকে রাতে বলা ছিল, আমরা ডাকলেই যেন তিনি বেরোন। ঋষি আর আদি বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে
আমিও প্রাণেশকে ডেকে তুলে বেরিয়ে ওদের পিছু নিলাম। করণজিকেও ডেকে নিলাম। আমরা ব্রিজের ওপরের রাস্তা দিয়ে
পাথরগুলোর ওপর দিয়ে পূজারিদের পেছন দিকে গিয়ে লুকিয়ে রইলাম যাতে বিপদ এলে পেছন থেকে
আক্রমণ করতে পারি।”
ঋষির বাবার কথা শেষ হতে না
হতেই কালিম্পং থানার ওসি বিনায়ক সেন মুখ খুললেন। “মেয়ে গায়েব হয়ে যাচ্ছে, পাথর হয়ে
যাচ্ছে, অভিশাপ — কিছুতেই কূলকিনারা করতে পারছিলাম না।
ব্রাভো, ঋষিবাবু আর আদিবাবু। তোমরা তো হিরো। বিদ্ধ্যাং কোনওদিন তোমাদের ভুলবে না।”
পূজারিকে ঘা দুয়েক দিতেই
বেরিয়ে এল বংশপরম্পরার রহস্য। উন্মেষ শাস্ত্রী। হিমাচলপ্রদেশের বাসিন্দা। পরপর
দুটো মেয়ে হয়ে মারা যাওয়ার পর প্রায় উন্মাদ হয়ে পাহাড়-পর্বতে ঘুরে বেড়াত। সেখানেই
এক সাধুর সঙ্গে দেখা হয় তার। সাধু তাকে বলে, মা শেরওয়ালির অভিশাপ আছে তার জীবনে।
তাই হাজারটা নাবালিকাকে বলি চড়ালে তার এই
দোষ কাটবে। উন্মেষ ঘুরতে ঘুরতে চলে আসে বিদ্ধ্যাং। এখানে সরল মানুষদের বাগে আনতে
বেশি সময় লাগেনি উন্মেষের। গ্রামের মধ্যে শেরওয়ালির মন্দির বানিয়ে মন্দিরের পূজারি
হয়ে যায়। তারপরেই শুরু করে তার খেলা। নাবালিকা পাথর হয়ে যাওয়ার গল্প। আশেপাশের বহু
গ্রামের ন’শো নিরানব্বইটি মেয়ের প্রাণ নিয়েছে এই উন্মেষ। প্রতিটা পাথরের নিচে আছে
একটি করে কিশোরীর দেহ। মাঝরাতে
সেই পাথরে খোদাই করা হত চোখ, নাক, মুখ যাতে গ্রামের লোকজন বিশ্বাস করে বাচ্চা
মেয়েগুলো পাথর হয়ে গেছে। তাকে এই কাজে টাকার বিনিময়ে বরাবর সাহায্য করে এসেছে
রিসর্টের ছেলেটি। শেষ বলিটুকু রক্ষা পেল ঋষির সাহসিকতার জন্য।
টুকুকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে
আদি। আতঙ্ক এখনও কাটেনি তার। শেরিং ভাইয়া হাসিমুখে হাজির তার রথ নিয়ে। রেলি খোলা
আজ উত্তাল। চারপাশের পাহাড় যেন মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন জানাচ্ছে ঋষিদের। আর ঐ ন’শো
নিরানব্বই পাথর যেন জিয়নকাঠির ছোঁয়া পেয়েছে আজ। তারা যেন খিলখিল করে হাসছে।
বোলেরো আবার দুলতে দুলতে
রেলি খোলা পেরোচ্ছে। এইবার
স্লিপ বেয়ে ওপরে উঠবে গাড়ি। পাঁচ মাথার মোড়ে ঘোড়ায় সওয়ার নেতাজী দেখা দেবেন। ঋষি
চোখ বুজে আওড়াল, ‘জয় হিন্দ!’
_____
ছবিঃ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
No comments:
Post a Comment