গল্পের ম্যাজিক:: এক ঝোলা আর তিন ভূত - জয়তী রায়


এক ঝোলা আর তিন ভূত
জয়তী রায়

শিবুদাদার ঝোলায় তিনটে ভূত থাকে। ছোট্ট থেকে একথা শুনে শুনে বড়ো হয়ে বুড়ো হতে চললাম। না কথার নড়চড় হল, না শিবুদাদার ভূতের দেখা পেলাম। সে যদি বলো, দেখা শোনা একপ্রকার হয়েই যেত কখনও কখনও। এখনও বেশ মনে পড়ে। সত্তর সালে কথায় কথায় লোডশেডিং হত। আমাদের তাতে ভারি বয়ে যেত! পড়াশুনোর চাপ আমাদের ছিল না বাপু। আকাশে জোছনা ফুটফুট। বাতাস ফুরফুর। উঠোন ভরা চাঁদের আলোয় খেলা আর গরম গরম মাছভাজা খাও বারান্দায় বসে। ওই সময় চেঁচিয়ে উঠত শিবুদাদা - নিল নিল। মাছ নিল। বজ্জাত। নোলা ভারি ভূতের পো।
বাবা আস্তে করে ধমক দিতেন, “শিবু। হচ্ছে কী! বাচ্চারা ভয় পাবে।”
বাচ্চাদের ভয় পেতে বয়ে গেছে। তখন মোবাইল ছিল না। ছিল না ফেসবুক। সোশ্যাল মিডিয়ার হরেকরকম। আমাদের সময় কেটে যেত গল্পে গল্পে। সে গল্পে ভূত প্রেত রাক্ষস রাজকুমারী পেতনি সব জীবন্ত। সব সত্যি। তাদের নিয়েই ঘরকন্না। শিবুদাদার ঝোলায় থাকে তিনটি ভূত। নাচুনে কাঁদুনে আর হাসুনে। আমাদের মতোই ছটফটে। দুষ্টু আর খেলুড়ে।
দিদি ভারি ভুলো। এই রাখছে। এই হারিয়ে ফেলছে। পরীক্ষার আগে দরকারি নোটস হারাবেই হারাবে। সারা বাড়ি মাথায় করে চেঁচাবে দিদি, “শিবুদাদা, শিবুদাদা, খোঁজো খোঁজো।”
সে ধমকে ওঠে দিদিকে, “রোজ রোজ হারাবে। রোজ রোজ চিল্লাবে। দেখি ঝোলা নাড়িয়ে।”
সে নোটস শিবু খোঁজে না ভূত, অত খবরে কার কী দরকার। এমন বহুরকম ব্যাপার-ট্যাপার বাড়িতে ঘটতে থাকত। সে নিয়ে পরে আর কারও মাথাব্যথা ছিল না। মা বাবা দাদা দিদি আর আমি এই ক’জনের সংসারে অবাক হবার মতো কিছু ছিল না। দিন যেত দিনের মতো। বিকেল থেকে রাত গড়াত নিজের মতো। তবে জায়গা যেহেতু তিরিশ বছর আগের নৈহাটির এক ছোট্ট গ্রাম, গ্রামের ধারে নদী, তার তীরে ছমছম শ্মশান, কাঠে পোড়া মৃতদেহ, বর্ষাকাল হলে, গভীর রাত হলে শরীর অর্ধেক পুড়ে পড়ে থাকে, শিয়াল কুকুর ছিঁড়ে খায়, তাদের আত্মা ঘুরে বেড়ায়। অপদেবতা হয়।  মাঝে মাঝেশ্মশানে আসে পিশাচসিদ্ধ তান্ত্রিক। ইয়া বিশাল চেহারা। চোখে ভয়ংকর কুটিলতা। সঙ্গে থাকে রোগা পটকা দুটো স্যাঙ্গাত রাতের বেলা কত কিছু অং বং হৃং ট্রিং করে। ডোম পাড়ার কচি বাচ্চা উধাও হয়। ফিস ফিস কথা ভাসে। শিশুবলি হল নাকি?
বাবা পাড়ার মাথা। আপদে বিপদে গরিব লোক বাবার কাছেই ছুটে আসে। ধনী নন তিনি, কিন্তু গ্রামের লোকের কাছের মানুষ। বাচ্চা গায়েব হবার পিছনে তান্ত্রিক আছে নিশ্চিত, সেইসঙ্গে আছে আরও কারও লোভ। কিছু কিছু মানুষের অন্ধবিশ্বাস আছে এই সব বলি তুকতাক ইত্যাদিতে। তারা মনে করে এইসব করলে কার্য সিদ্ধি হয়।
আমাদের বাড়ির উঠোনে ছোটোখাটো জমায়েত হল সেদিন। তান্ত্রিকের অত্যাচারে টেঁকা যাচ্ছে না। সেইসঙ্গে জুটেছে চালের ব্যবসায়ী রাঘব সমাদ্দার। রাঘব ভয়ংকর লোক। চালের ব্যাবসা উপরে উপরে। ভিতরে আছে আরও নানানরকম খারাপ কাজ। চড়া সুদে টাকা ধার, ছোটো ছোটো মেয়েদের ধরে ধরে বিয়ে দেওয়া, লোকের জমি দখল - সব মিলিয়ে এলাকার ত্রাস লোকটা। তান্ত্রিকের সঙ্গে হেব্বি খাতির। কেউ যদি কথা না শোনে তবে বান মেরে মুখে রক্ত তুলে দেবে। ছোটোখাটো রোগা চেহারা। মাথা জোড়া টাক। প্রজাপতি গোঁফ। বয়স? সে হবে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে। চোখ ছোটো আর ধূর্ত। সবচেয়ে মারাত্মক হল ওর দুটো কুকুর। কালো কুচকুচে। দেশি কিন্তু তেজ দেখলে অবাক হতে হয়। সদর হাসপাতালের পাশে, বিশাল বাগানসহ বাড়ি রাঘব সমাদ্দারের। সেখানে ঘুরে বেড়ায় কুকুরগুলো। অমাবস্যার গভীর রাত্তিরে কী সব উৎকট হোম যজ্ঞ হয়। তখন শোনা যায় কাঁদছে কুকুরগুলো। এলাকার লোক ভয় পায়। রটনা থাকে, হিংস্র পিশাচের আরাধনা চলছে মাটির নিচের গোপন কুঠুরিতে।
এই রাঘব সমাদ্দারের সঙ্গে বাবার লেগে গেল সাংঘাতিক বিরোধ। সরকার থেকে ঠিক করল নদীর উপর ব্রিজ তৈরি করবে। সে ব্রিজ তৈরির কনট্র্যাক্ট নেবার জন্য খেপে উঠল রাঘব। বাবা প্রতিবাদ করলেন, “নাহ্! লোক ভালো না হলে, ব্রিজের মালমশলা খারাপ হবে। মানুষের জীবন নিয়ে ছিনমিনি খেলা যাবে না। ব্রিজ বানাবে সুধাংশু। ভালো ছেলে। ইঞ্জিনিয়ার।”
রাঘব চোখ নাচিয়ে প্রশ্ন করল, “আমাকে আটকাবে কে? আপনি? শ্রী চিত্তরঞ্জন বসু? হাহাহা। তিন পয়সার মাস্টার! এত বড়ো সাহস?
বাবা বললেন, “সরকারের লোককে টাকা দিয়ে বশ করতে পারো, কিন্তু এলাকার মানুষ বিরোধিতা করলে তুমি কিছুই করতে পারবে না। এটা মনে রেখো।”
“মাষ্টার!” চেঁচিয়ে উঠল রাঘব, “সাবধান সাবধান। ছেলেপুলে নিয়ে ঘর করো। সাবধান বলে দিলাম।”
অন্ধকার নেমে এসেছে উঠোনে। শিবুদাদা এসে দাঁড়াল। সঙ্গে মা আর আমরা তিন ভাইবোন। ভুল বললাম। আরও কেউ। দেখা যায় না যাদের। শিবুদাদার ঝোলায় থাকে। দিদি চুপি চুপি বলল, “বুঝলি মুনিয়া। শিবুদার ভূতগুলো বোকা আর ভীতু। এদের সঙ্গে পারবে না।”

*                           *                           *

ব্রিজ তৈরির কাজ শুরুর আগে একের পর এক সরকারি অফিসার আসতে শুরু করল। অবাক ব্যাপার, তারা কেউ বাবার সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করল না। সব রাঘব সমাদ্দারের বাড়ি যায়। সেখান থেকেই চলে যায় কলকাতা। বাবা দমে যাবার পাত্র নন। লোকজনের সঙ্গে মিটিং করতে লাগলেন। সরকারি অফিসারদের সামনে বিক্ষোভ হল একদিন। সব মিলে পাকিয়ে উঠল জোরদার গন্ডগোল।
একদিন কারা যেন চড়াও হল আমাদের বাড়ি।
দুমদাম ঢুং ধাং বুম ব্যুম দম দম - ঢিল পড়ছে। আমাদের বাড়ির চতুর্দিক ঘিরে বাবা লাফিয়ে উঠলেন বিছানা থেকে। এলাকায় টিমটিমে ইলেকট্রিক ল্যাম্পপোস্ট। কেউ নেই কোথাও। চতুর্দিকে ছড়িয়ে আছে ঢিল। মড়ার মাথার খুলি। হাড়। মা কাঁপতে কাঁপতে কেমন জড়ানো গলায় বলল, “তুমি ছেড়ে দাও। এই ব্রিজ যে বানাবে বানাক। তুমি ছেড়ে দাও।”
পুজোর আগে আগে বেশ ঠাণ্ডা পড়ে গেছে। হিম মেখে দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকার। দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে জ্বলছে বাবার চোখ।
পরের দিন এলাকার সবার স্বাক্ষর সংগ্রহ করে এক আবেদন লিপি জমা পড়ল জেলার ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে। দাঁত কিড়মিড় করতে করতে দৌড়ে এল রাঘব সমাদ্দার, “মাষ্টার। এই  শেষ। আর নিস্তার নেই তোর। আগামীকাল অমাবস্যা। তোর গোটা বাড়ি জীবন্ত পুড়ে মরবে। থানা পুলিশ কেউ বাঁচাতে পারবে না।”
রাঘব চলে গেল। মা ঝাঁপিয়ে পড়ল বাবার উপর, “তুমি থামবে? থামবে?
এই কথা যুগে যুগে শুনে এসেছে কিছু বেহিসেবি লোক, যারা মানুষের ভালো করতে চায়। নিজের প্রাণের বিনিময়ে, সুখের সংসারে বিনিময়ে কেন করো এইসব? এই সব মানুষের কাছে একটাই উত্তর, মানুষের ভালো না করলে সে তো অমানুষ। কোনো হিসেবি কথা তারা শুনবে না। বাবাও শুনলেন না এলাকার দুঃখী গরিব মানুষ, মধ্যবিত্ত মানুষ যেন সারাজীবন নিরাপদে নদী পার হতে পারে, বাবা তার জন্য জীবন বাজি রাখলেন।
পরদিন অমাবস্যা। সকাল থেকে সাজ সাজ রব। রাঘব আসবে রাত্তিরে। সঙ্গে সেই তান্ত্রিক। হিংস্র কুকুর। আরও কে কে জানে? বাবাকে নিয়ে বলি দেবে না কি ওরা? উফফ। বুক শুকিয়ে যাচ্ছে। খাটের এক কোণে বসে আছি গুটি পাকিয়ে। পাড়ার বহু লোক জড়ো হয়েছে উঠোনে। হাতে হাতে হ্যারিকেন। ছেলে বুড়ো সকলের মুখ থমথম। কিছুতেই হার মানবে না কেউ।
বাবা গম্ভীর গলায় বললেন, “বাড়ি যাও সকলে। প্রাণহানির আশঙ্কা আছে।”
ভিড় থেকে এক কাকু বলল, “পুলিসে খবর দিলে হয় না?
“থানা বিশ্বাস করবে এসব আজগুবি অলৌকিক ঘটনায়? যা দেখা যায় না? ওরা আসবে কেন আমাদের কথায়?
“তবে আমরাও যাব না।”
“যাও। যাও বলছি,” ধমক দিলেন বাবা, “যদি সত্যি সত্যি আমার কিছু হয়, তোমরা আছো। লড়াই চালিয়ে যাবে।”
বলতে বলতে এসে গেল ধুলোর ঝড়। সে কী আওয়াজ! উঠোন ঢেকে গেল ধুলোয়। হ্যারিকেন নিভে গেল। দু-একটা লাইট কট কট করে বন্ধ হল। সবাই চোখে নাকে হাত চাপা দিচ্ছে। কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। চিৎকার করছে সবাই। দিদি আর মা প্রাণপণ চেঁচাচ্ছে।
বাবা বাবা। বাবা কোথায় গেল?
উঠোন জুড়ে জান্তব ঘড় ঘড় শব্দ। কার যেন খুব কষ্ট হচ্ছে। গলা টিপে ধরলে যেমন হয়! অথচ সেই গলার স্বর হাড় হিম করা ভয়ংকর।
হঠাৎ দিদি তীক্ষ্ম গলায় চেঁচিয়ে উঠল, “শিবুদা। শিবুদা। তুমি কই? তুমি কই?
কে যেন হি হি করে হেসে উঠল ব্যঙ্গ করে, “সে আর তার ফিঙে ভূত পালিয়েছে রে। কেউ কিছু করতে পারবে না।”
ধুলোর বাতাস ক্রমশঃ জমাট বাঁধতে লাগল। শ্বাস কষ্ট শুরু হচ্ছে। দম বন্ধ করা কাশি। আমি কষ্টে মাকে ডাকতে লাগলাম। কিছু দেখাই যাচ্ছে না চোখে ধুলো ঢুকে কর কর করছে। আর পারছি না। সব শেষ। হে ভগবান! মাত্র ক্লাস ফাইভ আমার। বাবাকে মনে হয়...

হঠাৎ একটা বিন্দু জেগে উঠল ঘরের মধ্যে। ফিকে গোলাপি রঙ। মিহি। সুতোর মতো। চোখ কচলে তাকালাম। মিহি আলো হাত বুলিয়ে দিল আমার মাথায়। ঠান্ডা বাতাস ছড়িয়ে পড়ছে ঘরে।
শিবুদার ভূত।
বোঝা গেল, চলছে এক অসম লড়াই। বিরোধীপক্ষ বেশি শক্তিশালী। হিংস্র গলায় কেউ বলল, “বশীকরণ করো শিবুকে।”
“পারবি না। চেষ্টা করিস না।”
এতক্ষণে শোনা গেল শিবুদার গলা। ধুলোর ঝড় থেমেছে। ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে ডাকাতের মতো কিছু প্রাণী। মানুষের মতো দেখতে, কিন্তু সারা শরীরে কাপড় নেই। ছাই মাখা। লম্বা লম্বা কালো কালো শরীর। ভয়ানক চোখ। এদের সামনে শিবুর পুঁচকে ভূত করবে কী? তারা তো আমাদেরই মতো। নিরীহ। আমার কানে কানে কে যেন বলল, “পুঁচকে যদি লক্ষ হয়, তবে সে জিতে যায়।”
কে রে? কে রে?
খিলখিল হাসি ছড়িয়ে পড়ল ভোরের শিউলি ফুলের মতো। ঝরঝর। ঘর জুড়ে উঠোন জুড়ে হাসি। যেন শরতের মেঘ। যেন গাছ ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে ফুল ফেলছে কেউ। হাসি বড়ো সংক্রামক। আমাদের বুকের ভিতর দিয়ে কুলকুল করে হাসি আসতে লাগল। ভয়ানক চেহারার লোকগুলো কেমন ঘাবড়ে গেল মনে হল। হাতের ধারাল অস্ত্র ঘুরিয়ে আমাদের দিকে তেড়ে আসতে গেল। কিন্তু চারিদিকে গোলাপি আলোর ফুলকি পাঁচিল তুলেছে। লক্ষ লক্ষ ফুলকি। এতক্ষণে চোখ পরিষ্কার হয়েছে। বাবা কই? বাবা? মেঝেতে ওটা কে শুয়ে? বাবা? বেঁকেচুরে মাটিতে পড়ে? বাবা গো। বাবা... মনে পড়ল, বাবা বলতেন, ‘অশুভ শক্তির প্রতাপ সবসময় বেশি কিন্তু হারিয়ে দেওয়া যায় যদি নিজের মনের জোর থাকে।’
শুনলাম দিদি বলছে, “বাবাকে মেরেছে? ছাড়ব না ওদের। ঝাঁপিয়ে পড়। শিবুদা আছ?
“আছি। চিন্তা নেই।”

তারপর? নিজেরাই অনুমান করো, তারপর কী ঘটল! সব কথা বলতে নেই। তবে এইটুকু শুনে রাখো, ভোরের আলো ফুটি ফুটি হতে হতে পরিষ্কার হল আকাশ। উঠোন জুড়ে নামল মানুষের ঢল। রাঘব সমাদ্দার ছিল তার মধ্যেই বসে। চোখে মুখে তার বৈষ্ণব প্রশান্তি। সবার সঙ্গে সঙ্গে সেও ব্রিজ বানাবার কাজে উৎসাহ দিচ্ছিল। বাবাকে পেন্নাম করল দু’বার। শিবুদাদা আর তার তিন ভূত? তারাও আমাদের সঙ্গেই ছিল। এখনও আছে। যাবে আর কোথায়?
_____
ছবিঃ সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী

No comments:

Post a Comment