গল্প চুরির গল্প
সত্যজিৎ দাশগুপ্ত
।।
১ ।।
আজকাল ওয়েব ম্যাগাজিন খুব জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। মনে হচ্ছে আর দশ থেকে পনেরো বছরের মধ্যে লোকের মুখে মুখে ফিরবে এইসব ম্যাগাজিনের কথা। এর কয়েকটাতে আমার লেখা বেরিয়েছিল। ম্যাগাজিনগুলো সারা বিশ্বের বাংলাভাষীরা পড়ে। তাই আমার লেখাও নিশ্চয়ই পড়েছে।
আর তার সঙ্গে অনিদার কথাও সারা পৃথিবীর লোক
জানতে পেরেছে! কথাটা ভাবলেই আমার গা শিউরে ওঠে!
আমরা এখন শিয়ালদার বি আর সিং হাসপাতালের কোয়ারটারসে। অনিদার এক বন্ধু অরিন্দমদা
রেলের ডাক্তার। সে থাকে এখানে। সাহিত্যে তার বিশেষ ঝোঁক থাকাতে প্রায়ই ওদের ফ্ল্যাটে
আমাদের সাহিত্যের আড্ডা হয়। সঙ্গে থাকেন
নামকরা সব সাহিত্যিকরা। আসলে অরিন্দমদার সূত্রেই এনাদের সঙ্গে আমাদের পরিচয়। আর তা আজ হয়ে গেল অনেকদিন। আজ অনিদা ছাড়া যাঁরা ঘর আলো করে
আছেন, তাঁরা হলেন, সাহিত্যিক সাত্যকি রায়, নীলাদ্রী দাশগুপ্ত, উৎসব মুখোপাধ্যায়, ডঃ
অলকা রায় আর কাবেরী চট্টোপাধ্যায়। এনারা প্রত্যেকেই সাহিত্যিক আর ইতিমধ্যেই
নিজেদেরকে সাহিত্যের আকাশে ‘তারা’ বলে প্রমাণ করেছেন। অরিন্দমদা নিজেও এক-আধটু লেখে টেখে। তবে তা শখে। অনিদা অবশ্য বলে ওর লেখার হাত খারাপ না।
কয়েকদিন আগে সত্যজিৎ রায়ের ‘সোনার
কেল্লা’ নিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলাম। যেটা
বেরিয়েছিল একটা ওয়েব ম্যাগাজিনে। সেটা নিয়েই আলোচনা চলছিল। না, আমার লেখা নিয়ে নয়। ছবিটা নিয়ে। এত বড়ো বড়ো সব সাহিত্যিকদের মধ্যে আমার লেখা
নিয়ে আলোচনা হবে, আমি তা স্বপ্নেও ভাবি না! তবে বলতে ভালো লাগছে, আমি এই সব মানুষদের কাছ থেকে
এই লেখাটা নিয়ে বেশ প্রশংসা পেয়েছি। সাত্যকিদা তো আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, “চালিয়ে যা জয়। ভালো হচ্ছে।”
তাতে অনিদা একটা একপেশে হাসি হেসে বলল, “আর বেশি বোলো না সাত্যকিদা। এর পর ও বলবে, আমার কেসগুলো ও গল্পের আকারে লেখে বলে আমার পরিচিতি বাড়ছে!”
অনিদা সাত্যকিদার কথায় ফোড়ন কেটে
আমার পেছনে লাগতে অলকাদি আমাকে আড়াল করে বলে উঠল, “তা নয়ত কী অনি? তোমার কাজের জন্য তো তুমি চোর ডাকাতদের মধ্যে জন-অপ্রিয়।
কিন্তু আমাদের জয়ই তো সাধারণ মানুষের কাছে তোমাকে জনপ্রিয় করে তুলেছে!”
“নাও হল এবার,” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে
অনিদা বলল, “আমাকে তো তোমরা সবাই কোণঠাসা করে দিলে দেখছি।”
আসলে মুখে না বললেও অনিদা আমাকে খুব ভালোবাসে। নিজের দাদা না হলেও দাদার থেকে কোনও অংশে কম নয়। অবশ্য বাইরের লোক
আমাদের দু’জনকে মাসতুতো ভাই বলেই জানে।
ভেতরের খবর হল আমাদের মায়েরা সেই ছেলেবেলাকার স্কুলের বান্ধবী। তারপর সেই বন্ধুত্ব
প্রায় পরিবারে পালটে যায়। কালীঘাটের হরিশ চ্যাটার্জী স্ট্রিটের মেঘমালা এপার্টমেন্টের
দোতলার পাশাপাশি দুটো ফ্ল্যাটে থাকি আমরা আর অনিদারা। ফ্ল্যাট
আলাদা হলেও বলতে গেলে আমি প্রায় সারাক্ষণই পড়ে থাকি অনিদাদের ফ্ল্যাটে। অনিদা ছাড়া আমি কোনও কিছু ভাবতেই পারি না। পেশায় ও গোয়েন্দা, আর আমি ওর সাগরেদ। অনেকটা তোপসের ভূমিকা পালন করি বটে, তবে তোপসের মতো আমি অত চৌকস নই। আর
ফেলুদা? সে হল অনিদার গুরু। ও বলে, ও যা শিখেছে, তা ফেলুদার কাছ থেকেই। ফেলুদা যেমন বলেছিল, তার শিক্ষাগুরু শার্লক হোমস।
আর আমার লেখার কথা বললে? অনিদাই হল তার প্রথম পাঠক। আর সত্যি
কথা কী, একেবারে গুণমুগ্ধ পাঠক। আজ পর্যন্ত আমার সব লেখার প্রথম ড্রাফট ওই দেখে
দিয়েছে। অনিদা ‘ওকে’
না বললে আমি কোনও মতেই লেখা বাইরে বের করি না।
আমাদের আড্ডা জমে উঠেছিল। এর মধ্যে অরিন্দমদার মা আমাদের জন্য জলখাবার দিয়ে
গেছেন। আড্ডার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ডান হাতের কাজটাও চলছিল বেশ। ঠিক এই সময় কলিং বেল বেজে উঠল।
অরিন্দমদাই গেল দরজা খুলতে। খুট করে দরজা খোলার পর পরই ওর গলা সপ্তমে উঠতে আমাদের
আড্ডাটা এক পলকের জন্য থামল। সবাই উৎসুক হয়ে প্রায় একসঙ্গে ঘরের
দরজার দিকে তাকালাম।
“আরে আপনি! আসুন আসুন। সবাই কখন এসে গেছে!”
কে এসেছেন আমরা সবাই মোটামুটি আন্দাজ করেই ফেলেছিলাম। এবার সে ব্যাপারে
নিশ্চিত হলাম সেই মানুষটা চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরে
ঢোকার পর।
তমাল দাশগুপ্ত বলতে যাঁর কথা প্রথমেই আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে তা হল, চেহারায়
খুবই সাদামাটা। মেরেকেটে পাঁচ চারের মতো উচ্চতা।
মাঝারি শরীরের গড়ন। গায়ের রং শ্যামলা। পরনে বেশির ভাগ সময়েই সাদা পাঞ্জাবি আর
পায়জামা। আর নজর করার মতো বিষয়, ওনার চোখে হরলিক্সের
বোতলের কাচের মতো মোটা কাচওয়ালা চশমাটা। চোখের নজরে
মানুষটার যে ছবিটা তুলে ধরার চেষ্টা করলাম, সেটা
ছাড়াও ওনার একটা বড়ো পরিচয় রয়েছে। আজকের দিনে বাংলা
সাহিত্যে ছোটো গল্পের লেখক হিসেবে তমাল
দাশগুপ্ত বেশ জনপ্রিয় নাম। আর আমি নিজেও ওনার লেখার ভক্ত। উনি অবশ্য আমার কাছে তমাল
জেঠু। পেশাগত দিক থেকে উনি ছিলেন কলকাতার একটা কলেজের ফিজিক্সের প্রফেসর। রিটায়ার
করার পর পুরোপুরি লেখালিখিতে ডুবে গেছেন।
বয়স প্রায় পঁয়ষট্টি পেরোনো মানুষটা ঘরে উপস্থিত সবার
গুরুজন। তাই
উনি ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে আমরা সবাই উঠে দাঁড়ালাম।
“আরে বোসো বোসো সবাই,” একটা
দীর্ঘশ্বাস ফেলে শরীরের ক্লান্তিটাকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করে ধপ করে সামনের সোফাটায়
বসে পড়লেন তমাল জেঠু। অরিন্দমদা এর
মধ্যে ওর মা’কে আরেক জনের খাবার দিয়ে যাবার
জন্য বলে দিল।
“থাক থাক, আর অত কিছু করতে হবে না,” হাঁপাতে
হাঁপাতে বললেন তমাল জেঠু।
“আরে খান খান তমালদা। মাসিমা যা বানিয়েছেন না ছোলার ডালটা!” বলল সাত্যকিদা।
দেখতে দেখতে ওনার জন্য খাবার চলে এল। তার সঙ্গে আমাদের আড্ডাও আবার শুরু হয়ে গেল।
গল্প জমিয়ে চলছে। কিন্তু এই সময় লক্ষ করলাম তমাল জেঠু আজ বেশ
চুপচাপ। জিনিসটা ঘরের সবার নজরেই পড়েছিল।
কাবেরীদি এবার ওনাকে নিজে থেকে জিজ্ঞাসা করল, “কী হয়েছে তমালদা? আজ এত মিইয়ে রয়েছেন?”
ব্যাপারটা চোখে পড়ার মতোই বটে। কারণ তমাল জেঠুর মতো আমুদে মানুষ এভাবে চুপচাপ বসে থাকবে, তাও আবার এমন চাঁদের হাটে, সেটা মেনে
নেওয়া যায় না।
“না রে কাবেরী, কিছু না।”
“আপনার দীর্ঘশ্বাসটা যে একটা সমস্যার, সেটা বুঝতে খুব একটা কষ্ট করতে হচ্ছে
না, কিন্তু সেই সমস্যাটা কীসের,
সেটা আন্দাজ করতে পারছি না,” বলল
অনিদা।
“গোয়েন্দার সামনে কোনোরকম ফিকির
চলবে না কিন্তু,” বলল অলকাদি।
“কী হবে বলে বলো তো?” মুখ চুন অবস্থায় বললেন তমাল
জেঠু।
“কী হয়েছে সেটা তো বলুন?” বলল সাত্যকিদা।
“আর বলিস না রে ভাই! মানুষ যে আজকাল এত নিচে নেমে গেছে, ভাবা যায় না!”
।।
২ ।।
চায়ের কাপে একটা চুমুক মেরে তমাল জেঠু যে ঘটনাটা এবার বললেন, সেটা হল এই -
গত শুক্রবারের ঘটনা। আগেই বলেছি, ছোটো গল্প লিখিয়ে হিসেবে তমাল জেঠু খুব জনপ্রিয়। এখানে সেখানে নানান অভিজ্ঞতা
থেকে সঞ্চয় করা ঘটনা উনি গল্পের মধ্য দিয়ে আসাধারণভাবে তুলে ধরেন পাঠকদের সামনে। তো তেমনই
একটা অভিজ্ঞতা ওনার হয়েছিল আগের রবিবার দীঘা গিয়ে। তো সেই অভিজ্ঞতার কথা পাঠককে
উপহার দিয়ে একটা চমক আনার কথা ওনার মাথায় ঘুরছিল। ভেবেছিলেন,
একটা নামকরা ম্যাগাজিনের বর্ষা সংখ্যায় দেবেন।
দীঘা থেকে ফিরেই তাই সেই লেখাটা নিয়ে পড়েন তমাল জেঠু। গত শুক্রবার রাত ন'টা
থেকে উনি গল্পটা লিখতে বসেন। ছোটো গল্প। কিন্তু যেহেতু উনি একটু চিন্তা করে সময় নিয়ে লেখেন, তাই ঠিক করেছিলেন গল্পটা লিখতে
উনি দু'দিন সময় নেবেন। কিন্তু হঠাৎ করে ছন্দ চলে আসাতে উনি সেদিন আর থামলেন না। যখন
উনি সেই গল্পের শেষ শব্দটা লিখলেন, রাত তখন দুটো।
শিল্পীই হয়তো তাঁর শিল্প সব থেকে ভালো বুঝতে পারেন। গল্পটা লিখেই উনি বুঝতে পারলেন এ লেখা ওনাকে অন্য মাত্রা দেবে। উত্তেজনায় বাকি রাত ভালো করে সেদিন ঘুমোতে পারলেন না তমাল জেঠু। পরদিন সকাল বেলা উঠে একবার লেখাটা
দেখে নিয়ে সেই দুপুরেই ছুটলেন পাবলিশারের কাছে। কিন্তু গল্পটা বিশ্বাস পাবলিকেশনের
বিশ্বাসবাবুকে দেখাতে উনি যা বললেন, তাতে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল তমাল জেঠুর।
"এ লেখা তো অলরেডি জমা পড়ে গেছে।"
"মানে!" কথাটা শুনে ভিরমি খেলেন তমাল জেঠু।
"হ্যাঁ, আজ সকালে মিঃ ঘোষ এই লেখাটাই জমা করে গেছেন," বললেন বিশ্বাসবাবু।
"কিন্তু এ কী করে সম্ভব! আমি তো গল্পটা মাত্র কালকেই..."
তমাল জেঠুর কথা শেষ করতে না দিয়ে এবার বিশ্বাসবাবু খান আষ্টেক সাদা ফুল
স্কেপ কাগজ ওনার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, "এই দেখুন
না। এই গল্পটাই তো?"
এক লেখা - এক নাম! পাতাগুলো ওলটাতে ওলটাতে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে
পারছিলেন না তমাল জেঠু। এ কী করে সম্ভব! নিজের মনকেই নিজে প্রশ্ন করে ঠকে
যাচ্ছিলেন উনি। অথচ এই লেখাটা নিয়েই উনি এসেছেন। একই লেখা, একই কনসেপ্ট, মিঃ ঘোষের
মাথায় এল কী করে! ওনার লেখাও আট পাতা, মিঃ ঘোষের জমা দেওয়া লেখাটাও আট পাতা! ওনার
লেখার মতো এই লেখাটারও পর্ব সংখ্যা চার!
প্রত্যেকটা প্যারাগ্রাফ, লাইন, এমনকি শব্দও এক! যেন মনে হচ্ছে আসল কপিটাকে কেউ
জেরক্স করে জমা করে দিয়েছে! অথচ উনি লেখার পর আজ সকালেই মাত্র সব পাতাগুলো
কম্পুটার থেকে প্রিন্ট নিয়েছেন। তাও আবার বাইরে থেকে নয়, নিজের
কম্পুটার থেকেই। এই লেখা নিয়ে কারও সঙ্গে আলোচনাও
করেননি উনি। তাহলে লেখাটা বাইরে বেরোল কী করে! এটা কি ম্যাজিক? না কি ভোজবাজি? মিঃ
ঘোষের ওপর রাগ করার থেকেও তমাল জেঠু তখন ঘোরের মধ্যে, জিনিসটা সম্ভব হল কী করে, তা
বুঝতে। ঘটনাটা হজম করতে উনি ততক্ষণে ধপ করে সামনে রাখা চেয়ারটাতে বসে পড়েছেন।
সেটা দেখে মিঃ বিশ্বাস ওনাকে জিজ্ঞাসা করলেন, "কী তমালদা, সব ঠিক আছে তো?"
উনি তখন কী উত্তর করবেন বুঝতে পারছিলেন না। কোনও রকমে মাথাটা ডানদিকে কাত
করে বললেন, "মিঃ ঘোষ নিজে হাতে করে এই লেখাটা
দিয়ে গেছেন?"
"তা না হলে আর বলছি কী দাদা?" মুখ দিয়ে চুক করে একটা শব্দ করে
মিঃ বিশ্বাস বললেন, "জানেন তো, কেমন খিচখিচে মানুষ!
আপনি দাদা কত ভদ্র! আর উনি? লেখা জমা করলেন। আর শুধু জমা না। আমাকে দিয়ে সই
পর্যন্ত করিয়ে নিলেন! আরে ভাই, আমরা এতদিনের পাবলিশার! আমরা কি লেখা চুরি করব?
এতটুকু ভরসা নেই আমাদের ওপর?"
মিঃ বিশ্বাস আরও কত কিছু
বললেন। কিন্তু তমাল জেঠুর কানে তার একটা শব্দও ঢুকল না। সামনে রাখা জলের গ্লাসটা
এক চুমুকে শেষ করলেন। তারপর হনহনিয়ে বেরিয়ে এলেন মিঃ বিশ্বাসের ওখান থেকে।
"আপনার গল্প, আর উনি জমা করে এলেন? তাও নিজের নামে!" অবাক হয়ে বলল সাত্যকিদা।
"কিন্তু আপনার কথা শুনে যা বুঝলাম, তাতে তো মনে হয় পাবলিশার বিশ্বাসদার
পর আমরাই প্রথম বাইরের লোক, যারা কিনা জানতে পারল যে আপনি একটা নতুন লেখা লিখেছেন?" বলল অলকাদি।
তখন নীলাদ্রীদা বলল, "আর এই গল্পের ব্যাপারে
আপনি তো কারও সঙ্গে কিছু আলোচনাও করেননি, তাই
না?"
"আর তাছাড়া, সব থেকে
আশ্চর্যের ব্যাপার, উনি যে লেখাটা জমা করেছেন, সেটা হুবহু এক!" বলল কাবেরীদি।
"আপনি প্রিন্টও তো নিজের ঘর থেকেই করে নিয়ে গেছিলেন," বলল উৎসবদা।
একেকটা প্রশ্ন এল একেকজনের কাছ থেকে। তাতে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তমাল
জেঠু বললেন, "তোমাদের সবার প্রশ্নের একটাই উত্তর
এবং সেটাও এক কথাতেই – হ্যাঁ।"
অনিদা এতক্ষণ চুপ করে বসে তমাল জেঠুর কথা শুনছিল। অবশ্য তাকিয়ে দেখলাম ওর
কপালে গোটা তিনেক ভাঁজ। ওর এ বিষয়ে কোনও বক্তব্য নেই, একথা আমি মেনে নিতে পারছিলাম
না। তাই বেশ বুঝতে পারছিলাম যে, ও মনে মনে নিশ্চয়ই কিছু একটা হিসেব করছে। জিনিসটা বোঝার চেষ্টা করছে। আর আমার
আন্দাজ যে ঠিক, তা বুঝলাম অরিন্দমদার করা প্রশ্নের উত্তরটা শুনে।
"কিরে অনি, তুই কিছু বলছিস না যে? কোনও ইন্টারেস্ট পাচ্ছিস না নাকি?"
"না তা নয়," ডান গালে হাত ঘষে অনিদা বলল, "বোঝার চেষ্টা
করছি ঘটনাটা ঘটল কী করে?" তারপর তমাল জেঠুকে জিজ্ঞাসা করল, "মিঃ ঘোষ
মানে উনিই তো যিনি আপনার মতোই ছোটো গল্প লেখেন আর খুব ভালো ছবি তোলেন?"
"হ্যাঁ," মাথাটা একবার সামনের দিকে
হেঁট করলেন তমাল জেঠু। বললেন, "মিঃ ঘোষ, মানে বিকাশ ঘোষ।"
কাবেরীদি তখন নাক-মুখ কুঁচকে বলল, "উনি ছোটো গল্প লেখেন বটে। কিন্তু তার জন্য ‘তমালদা’র মতো’ বললে তমালদাকে ছোটো করা হবে অনি।"
তাতে অনিদা মুচকি হেসে বলল, "তা আমি মানি কাবেরী!"
"বরঞ্চ তুমি বলতে পারো ভদ্রলোক দারুণ ফটোগ্রাফার," পাশ থেকে বলল অলকাদি।
"ঠিক," অলকাদির কথায় সায় দিল সাত্যকিদা।
"হুম," তাতে মাথাটা বার দুই সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে অনিদা বলল, "ওনার
বেশ কিছু ছবির প্রদর্শনী আমি দেখেছি। সত্যিই ভালো ফটোগ্রাফার বলতে হবে। কথাটা বলে আবার কোনও একটা চিন্তায় ডুবে গেল অনিদা।"
"কিছু বুঝতে পারছিস ব্যাপারটা?" জিজ্ঞাসা করল অরিন্দমদা।
"না, সত্যিই কিছু মাথায় ঢুকছে না," গম্ভীর গলায় বলল অনিদা। তারপর তমাল জেঠুকে জিজ্ঞাসা করল, "আপনি
যখন লিখছিলেন, তখন কেউ ঘরে ঢুকেছিল?"
"না না," গলা তুলে তমাল জেঠু বললেন, "বললাম না, সেদিন
লিখতেই তো বসলাম রাত ন’টা নাগাদ। আর লেখা শেষ করলাম রাত
দুটোয়। আর সেদিন রাতে কেউ আমার ফ্ল্যাটে আসেইনি!"
"বাড়ির কাজের লোক বা আর কেউ?"
"দেখো অনি, আমার মতো একা
মানুষ এই কলকাতা শহরে আর কেউ আছে কিনা আমি জানি না। সেদিন রাত ন’টায় খেয়েদেয়ে আমি দরজা বন্ধ করে লিখতে বসি। তারপর বার দুয়েক বাথরুমে যাই
নেচারস কলে সাড়া দিতে। সেই সময় আমার একমাত্র কাজের
লোক বলাই ঘুমিয়ে কাদা। রাত দশটা বাজলেই রোজ ঢুলতে
শুরু করে। তাই কারও পক্ষে অতটুকু সময়ের মধ্যে আমার লেখা চুরি করা সম্ভব নয়। আর তাছাড়া
বলাই অমন মানুষ নয় বলেই আমি মনে করি। এমন ছোটো কাজ ও করবে না। মানে যদি সুযোগ পেত তাও।"
"কিন্তু সকাল বেলা?" অনিদার প্রশ্ন শুনে বুঝলাম ও সহজে কাউকে
সন্দেহ মুক্ত করবে না।
ওর প্রশ্ন শুনে তমাল জেঠু মুখে হাসি এনে বললেন, "আমার বেডরুমে একটা
পার্সোনাল এটাচড বাথরুম আছে। সেদিন আমি সকাল সাতটা নাগাদ ঘুম
থেকে উঠে সেই বাথরুমেই স্নান করে ল্যাপটপ খুলি। তার অনেকক্ষণ পরে ঘরের দরজা খুলি। এর বেশ
কিছুক্ষণ পর বলাই আমার জন্য চা জল খাবার নিয়ে আসে। আর তারপর ও আর আমার ঘরে সেদিন আসেনি। এর পর আমি লেখাটার প্রিন্ট আউট নিই আর তারপর ঘর
থেকে বেরোই। বলতে গেলে বলাই জানেই না বা দেখেইনি আমি কী লিখছিলাম বা আগের দিন রাত
থেকে ওর চোখ আমার ল্যাপটপের স্ক্রিনে পড়েইনি। সুতরাং,
বলাইকে সাসপেক্ট করা যায় না।"
তমাল জেঠুর কথাগুলো যে অনিদার কাজকে কঠিন করল তা বেশ বুঝতে পারলাম।
"আর তাছাড়া, আমার ল্যাপটপ পাসওয়ার্ড প্রোটেকটেড। বলাই ইংরিজি জানে না।
ওর পক্ষে চাইলেও ল্যাপটপ খোলা সম্ভব না অনি,"
আবার বললেন তমাল জেঠু। "আর সত্যি কথা বলতে কী, আমি পাসওয়ার্ড সেদিন গল্পটা
লেখার পর পরই চেঞ্জ করেছি। তাই -"
তমাল জেঠুর কথার মানেটা আর অনিদাকে বলে দিতে হল না। মোদ্দা কথা, ওনার বাড়ির
কাজের লোক বলাইদা কোনোভাবেই এই চুরির সঙ্গে জড়িয়ে
থাকতে পারে না।
"কিন্তু তবে প্রশ্ন হল, চুরিটা তাহলে হল কী করে? আর জিনিসটা যে ঘটেছে,
সেটা অস্বীকার করার জো নেই!"
"কোনও টিম ভিউয়ার জাতীয় -"
অরিন্দমদার কথা শেষ করতে না দিয়ে তমাল জেঠু বললেন, "ওটা নেই আমার
মেশিনে।"
টিম ভিউয়ার সফটওয়্যারটা আমি ব্যবহার করেছি। অনিদার ল্যাপটপে আছে। এটা দিয়ে
অনেক সময় অন্য কম্পুটারে বসেও আরেকটা কম্পুটারে কাজ করা যায়। অবশ্য এর জন্য দুটো কম্পুটারেই এটা থাকতে হবে। অনিদা বেশ কয়েকবার আমার সঙ্গে টিম ভিউয়ার অন করে কাজ করেছে। যেমন সেই একবার, কলেজ স্ট্রিটের একটা কেসে, ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে অনেকটা দূর গিয়ে হঠাৎ দেখে একটা ফাইলের
কিছু জিনিস নিয়ে যায়নি। তখন ও ওর এক বন্ধুর বাড়ি থেকে টিম ভিউয়ার চালিয়ে আমাদের
ল্যাপটপ থেকে ওর দরকারি সব তথ্য দেখে নিয়েছিল।
"হুম," কথাটা শুনে অনিদা একটা
দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বুঝলাম ও আন্দাজ করার চেষ্টা করছে আসল রহস্যটা কী সেটা জানার।
ঘরে এখনকার নিস্তব্ধতাটাকে ‘পিন ড্রপ
সাইলেনস’ বলা যেতে পারে। আসলে এমন একটা
ভূতুড়ে ব্যাপারের কোনও রকম ব্যাখ্যা
কারও কাছে ছিল না। আমি উৎসুক হয়ে চেয়েছিলাম অনিদার দিকে। আমার মতোই সবারই ভরসা এখন ও। আর ওকেই এই ভাবে চুপ করে থাকতে দেখে
এবার তমাল জেঠু বললেন, "আমার মনে হয় ছেড়ে দাও অনি। এ নিয়ে আর
মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। জীবনে কত লিখেছি। একটা নষ্ট হয়েছে তাতে আর কী? আমার প্রতিভা
থাকলে কী আর ও সেটা নিয়ে নিতে পারবে? তোমরা জানো তো, সত্যজিৎ বাবুর গল্প না বলে
নিয়ে হলিউড মেরে দিয়েছিল। আর আমি তো কোন ছাড়!"
কথাটা শুনে অনিদা কেন জানি না তেড়ে উঠল। বলল, "আমি থাকতে এটা হতে দেব
না। ওই
লোককে উচিত শাস্তি পেতেই হবে এই নোংরা কাজের জন্য।"
তাতে সাত্যকিদা বলল, "হ্যাঁ অনি, দেখো তো কিছু করতে পারো কিনা। ক্রিয়েশন চুরি করে নেওয়া একটা জঘন্যতম ক্রাইমের
মধ্যে পড়ে বলে আমি মনে করি।" তখন ঘরে
উপস্থিত সবাই ওর কথায় সায় দিল।
"তাহলে তুমি এখন কী করবে?" অনিদাকে জিজ্ঞাসা করল কাবেরীদি।
তাতে অনিদা ওর অতি পরিচিত ঢংয়ে বলল, "প্রথমে আমি দু'চারটে প্রশ্ন করতে
চাই।"
তা শুনে তমাল জেঠু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, "বলো কী জানতে চাও।"
অনিদা কেসটাতে ঢুকবে আমি জানতাম। এবার জেরা পর্ব শুরু হবে বুঝে নড়েচড়ে বসলাম।
"মিঃ ঘোষ থাকেন কোথায়?" তমাল জেঠুকে জিজ্ঞাসা করল অনিদা।
"আমার পাশের ফ্ল্যাটে। তিন তলায়। আর আমি থাকি দোতলায়।"
"ও! উনি আর আপনি পাশাপাশি থাকেন?" জিনিসটা জেনে অবাক হল অনিদা।
আসলে আমরা জানতাম যে তমাল জেঠু আর মিঃ ঘোষ, দুজনেই শ্যাম বাজারে থাকেন।
কিন্তু ওনারা যে প্রতিবেশী, তা জানতাম না।
জিনিসটা শুনে অলকাদি হেসে বলল, "বাঃ! একেবারে চোরের সঙ্গে ঘর করছেন তো দেখছি!"
"আর বোলো না ভাই,"
হেসে উত্তর দিলেন তমাল জেঠু।
"আপনি লেখা জমা দেবার ঠিক কতক্ষণ আগে মিঃ ঘোষ লেখাটা জমা দিয়ে আসেন?" আবার প্রশ্ন করল অনিদা।
"আমি তো গেছিলাম দুপুরে। আর উনি নাকি সকাল বেলাতেই লেখাটা জমা
দিয়েছিলেন।"
"সময়টা জানেন?"
"সময়?" বলে কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন তমাল জেঠু। তারপর বললেন, "এই
সাড়ে এগারোটা হবে বোধ হয়।"
"আপনি এ ব্যাপারে আর ওনাকে কিছু বলেননি?"
"বলেছিলাম তো! লোকটা আমাকে বলতে গেলে অপমান করে তাড়িয়ে দিল, জানো! বলে কিনা, ও আগে জমা করে এসেছে। আর এটাই নাকি প্রমাণ যে লেখাটা ওর। আমিই নাকি লেখাটা চুরি করার চেষ্টা করছি!"
"আপনি প্রমাণ চাননি?"
"সে চাইনি আবার? সে তো তার ল্যাপটপে সেই লেখার ওয়ার্ড ফাইলটা পর্যন্ত
দেখিয়ে দিল।"
"হুম," কথাটা শুনে অনিদা বেশ
কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল। তখন সাত্যকিদা ওকে জিজ্ঞাসা করল, "তাহলে তুই এখন কী
করবি অনি?"
অনিদা তখন মাটির দিকে চোখ সরু করে একদৃষ্টে চেয়ে। কপালে ওর চারটে ভাঁজ।
এবার গলাটা খুব গম্ভীর করে বলল, "একবার তমালদার বাড়ি যেতে হবে। আর তারপর মিঃ
ঘোষের সঙ্গে দেখা করার আছে।"
।।
৩ ।।
এমন ভূতুড়ে কেস এর আগে অনিদা পায়নি। আমি
অনেক চিন্তা করেও বিন্দুমাত্র আন্দাজ করতে পারিনি চুরিটা হল কী করে। বন্ধ ঘরের মধ্যে এক রাতে গল্প লিখে সেটা নিজেরই কম্পুটার থেকে প্রিন্ট করে
নিয়ে গিয়ে দেখা গেল সেই লেখা আগেই জমা পড়ে গেছে! এ
ভূতুড়ে কান্ড ছাড়া আর কী? কাল রাতে
অনিদাও অনেকক্ষণ ধরে বিষয়টা নিয়ে মাথা
ঘামিয়েছে। রাতে খাবার পর থেকে ওকে দেখেছি মেঝের দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে কী যেন চিন্তা
করেছে। ও
এতটাই বিষয়টাতে ঢুকে পড়েছিল যে স্টার স্পোর্টসে শচিনের করা অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে একটা সেঞ্চুরি দেখানোর সময়ও ওর চোখ অন্য দিকে ছিল। এই সব সময় ওর মন অন্য
জগতে চলাফেরা করে। কেউ কথা বলুক ও চায় না। তাই আমি আর ওর সঙ্গে কথা বলে নিজের বিপদ ডেকে আনিনি। শেষ পর্যন্ত অবশ্য অনিদা বলতে গেলে এক রকম বিরক্ত হয়েই ‘স্ট্রেইঞ্জ’ বলে উঠে গেছিল।
আমরা প্রায় শ্যামবাজারের বুড়ি ছুঁয়ে ফেলেছি। ঘড়িতে এখন সকাল দশটা। ঘুম থেকে
উঠেছিলাম সেই সাড়ে পাঁচটাতে। তারপর যোগব্যয়াম সেরে স্নান করে সকালের খাবার খেয়ে
যখন গাড়ি নিয়ে বেরোচ্ছি তখন বাজে প্রায় পৌনে ন’টা। বাড়ি থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত আমাদের মধ্যে যা যা কথা হয়েছে সেগুলো
তেমন দরকারি নয়, তাই লিখলাম না। শ্যামবাজার আর ফড়িয়া পুকুরের মাঝে এক জোড়া যমজ বিল্ডিং-এর
কমপ্লেক্সে থাকেন তমাল জেঠু। পাঁচ তলা উঁচু দুটো বিল্ডিং-এর মাঝখানে প্রায় দশ
ফুটের মতো চওড়া একটা প্যাসেজ রয়েছে। সেখানে
দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে মাথা তাক করে অনিদা একসঙ্গে ফ্ল্যাট দুটোকে দেখল। তমাল জেঠু আমাদের নিতে এসেছিলেন। উনি তখন ডান দিকের
বিল্ডিং-এর তিন তলার ফ্ল্যাটটার দিকে ইশারা করে
বললেন, "ওটায় থাকেন মিঃ ঘোষ।"
ঠিক সেটার উলটোদিকে দোতলার ফ্ল্যাটটার
দিকে ইশারা করে অনিদা বলল, "ওটায় নিশ্চয়ই আপনি?" তাতে তমাল জেঠুর হাসিটা গাল পর্যন্ত ছড়াল।
ইংরিজিতে দোতলাকে বলে ফার্স্ট ফ্লোর আর তিন তলাকে সেকেন্ড। এর কারণটা আমার জানা নেই। একটা বিল্ডিং-এর এক তলার মেঝেই ফার্স্ট হওয়া উচিত। কিন্তু সেটাকে আবার বলা হয় গ্রাউণ্ড ফ্লোর! লিফটের জন্য অপেক্ষা না করে
আমরা নিজেদের পায়ের ওপরেই ভরসা করলাম।
মেরে কেটে পাঁচ ফুট লম্বা, ভীষণ রোগা,
লম্বাটে মুখ, তোবড়ানো গাল, টিকালো নাক, মাথার চুলগুলো ফিকে হয়ে আসা ঘাসের মতো আর গায়ের রং বেশ ফরসা। যে
লোকটা দরজা খুলল তাকে দেখতে অনেকটা এই রকম। এবার আমাদের দেখে ফিক করে হাসতে আবিষ্কার করলাম ওপরের ডান দিকের সেটের তিন নম্বর পাটির দাঁতটা নেই। মানে চলতি কথায়
যাকে ফোকলা বলা যেতে পারে! বুঝলাম এই হল তমাল জেঠুর সারাক্ষণের সঙ্গী বলাইদা।
একটা মাঝারি আকারের ডাইনিং রুম পেরিয়ে আমরা
প্রায় বারো বাই এগারোর একটা ঘরে ঢুকলাম। লেখকের ঘর কেমন হতে পারে সে কথা বলে আর লেখা খরচ করার কোনও মানে হয় না। যেদিকে তাকাই
শুধু বই আর বই। ঘরের এক পাশে একটা সিঙ্গল খাট আর জানালার ধারে পাতা রয়েছে টেবিল
চেয়ার। টেবিলের ওপর একটা ল্যাপটপ রাখা ছিল। অনিদা এবার সেটার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
"এতেই আপনি লেখেন?"
"হ্যাঁ," একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তমাল জেঠু বললেন, "এই আমার
দুনিয়া। আমার এক মুঠো পৃথিবী।"
কথাটা শুনে অনিদা একবার মুচকি হেসে ওনার দিকে তাকাল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, "এই
চেয়ারেই বসে সেদিন লেখাটা লিখেছিলেন?"
অনিদার প্রশ্নের উত্তরে তমাল জেঠু বার দুয়েক মাথাটা সামনের দিকে ঝোঁকালেন।
এই ফ্ল্যাটের জানালাগুলো বাড়ির মতো। জোড়া
পাল্লার। আমাদেরগুলো যেমন স্লাইডিং, তেমনটা নয়। আজকালকার দিনে অবশ্য প্রায়
জানালাগুলোই স্লাইডিং হয়। আমার মা তো আমাদের ফ্ল্যাটটার জন্য প্রোমোটারকে তাই নিয়ে চার কথা শুনিয়েই দিয়েছিল। কারণ মায়ের পছন্দ ছিল পাল্লা
দেওয়া জানালা। আর প্রোমোটার আমাদের দিয়েছে স্লাইডিং জানালা। আমরা অবশ্য পরে
সেগুলোকে ভেঙে পাল্লা দিয়ে নিয়েছি। অনিদারাও তাই করে নিয়েছে।
অনিদা ঘরের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে টেবিলে রাখা ল্যাপটপটার দিকে চেয়ে বেশ কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল। তারপর পেছন ঘুরে জানালার দিকে মুখ
ঘোরাল। এবার জানালা দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল। শেষে ঘাড় তুলে
ওপর দিকে নজর দিয়ে বলল, "ওই তিন তলার ফ্ল্যাটেই লেখক বিকাশ ঘোষ থাকেন, তাই
না?"
"হ্যাঁ," বললেন তমাল জেঠু।
এর মধ্যে অনিদার পাশে আমিও গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম জানালার সামনে। অনিদা যখন
মাথা তুলে মিঃ ঘোষের ফ্ল্যাটের দিকে তাকাল, তখন লক্ষ করলাম কেউ একজন যেন সট করে সরে
গিয়ে জানালার আড়ালে চলে গেল!
জিনিসটা দেখে অনিদা একবার আড়চোখে আমার দিকে তাকাল। তারপর তমাল জেঠুকে
জিজ্ঞাসা করল, "উনি কি ফ্ল্যাটে
একাই থাকেন?"
"না," মাথা নেড়ে তমাল জেঠু বললেন, "ওনার স্ত্রী আর উনি
থাকেন। ভদ্রলোকের এক ছেলে। থাকে আমেরিকাতে।"
"হুম," কিছুক্ষণ ভেবে অনিদা আবার
প্রশ্ন করল, "সেদিন রাতে কি ওনারা জেগে ছিলেন?"
তাতে একটু ভেবে তমাল জেঠু বললেন, "কই, না তো। যতদূর মনে পড়ছে, সেদিন রাতে তো মিঃ ঘোষের ঘরে অত রাত পর্যন্ত আলো জ্বলতে
দেখিনি। এমনিতেই তো উনি দেখি রাত দশটার মধ্যে শুয়ে পড়েন। রাত দুটো পর্যন্ত, উঁহু, উনি অত রাত পর্যন্ত জেগে থাকার মানুষ নন।"
তমাল জেঠুর কথা শুনে আবার কোনও একটা চিন্তায় ডুবে গেল অনিদা। প্রায় মিনিট
খানেক পরে ও বলল, "আপনার লেখাটা একবার দেখা যায়?"
"হ্যাঁ, কেন নয়?" বলে তমাল জেঠু ল্যাপটপ চালালেন।
আট পাতার লেখাটা দেখতে দেখতে অনিদা একবার পাশে রাখা প্রিন্টারটার দিকে এক
ঝলক চেয়ে নিয়ে বলল, "এই প্রিন্টারেই পরের দিন সকালে
প্রিন্ট নিয়েছিলেন?"
উত্তরে আবার মাথাটা সামনের দিকে বার দুয়েক ঝোঁকালেন তমাল জেঠু।
অনিদা মনে মনে কী হিসেব করছিল বলতে পারব না, কিন্তু ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছিল সে কথা। প্রায় মিনিট দশেক পর অনিদা উঠে দাঁড়াল।
"কিছু বুঝতে পারলে?" জিজ্ঞাসা করলেন তমাল
জেঠু। আমিও উৎসুক হয়ে চেয়ে ছিলাম ওর দিকে।
তাতে গম্ভীর গলায় অনিদা বলল, "একটু সময়
লাগবে।"
আমি তখন বললাম, "তাহলে এখন কী করবে?"
ও তখন বলল, "একবার মিঃ ঘোষের সঙ্গে দেখা করতে চাই।"
।।
৪ ।।
লেখকের থেকেও বিকাশ ঘোষ মানুষের কাছে বেশি পরিচিত ফটোগ্রাফার হিসেবে। সারা ফ্ল্যাট জুড়ে শুধু ছবি আর ছবি। মানুষ, ছোটো বাচ্চা, পাখি, জীবজন্তু, প্রকৃতি, আরও কত কী! এর মধ্যে সবথেকে নজর কাড়ল ঘরের দেওয়ালে টাঙানো বিশাল আকারের কাঞ্চনজঙ্ঘার ছবিটা। ছবির নিচে নাম
দেখে বুঝলাম এটা মিঃ ঘোষেরই তোলা।
এই কমপ্লেক্সের দুটো বিল্ডিং-এর ফ্ল্যাটেরই আকারগুলো প্রায় এক রকম। দরজা
খুলেই একটা বড়ো হল ঘর। আর সেটা পেরিয়ে দুটো ঘর। ডান দিকের ঘরটাকে মিঃ ঘোষ বেড রুম হিসেবেই ব্যবহার করেন। আর
পাশের ঘরটা ওনার স্টুডিও কাম লাইব্রেরি।
আমরা মিঃ ঘোষের ফ্ল্যাটের কলিং বেল বাজাতে উনি নিজেই এসে দরজা খুললেন।
তারপর আমাদের দেখে বললেন, "দাশগুপ্ত পাঠাল?"
প্রশ্নটা ঘাবড়ে দেবার জন্য যথেষ্ট হলেও অনিদা কিন্তু সহজেই সামলে নিল। মুচকি
হেসে বলল, "ভেতরে আসতে পারি?"
তাতে মিঃ ঘোষ আমাদের পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখে নিয়ে বললেন, "না বলবো না, কিন্তু কারণটা জানতে চাইব।"
তারপর আমাদের ভেতরে ঢুকতে ইশারা করে
বললেন, "এসো, ভেতরে এসো।"
"ধন্যবাদ!" বলে ফ্ল্যাটের ভেতরে ঢুকল
অনিদা। ওর পেছন পেছন দুরু দুরু বুকে আমিও। কেন জানি
না, মানুষটাকে দেখেই মনে হয়েছিল সে মেজাজে বেশ তেরিয়া! তারপর কথাবার্তা শুনে তাতে আর কোনো সন্দেহ রইল না।
"তুমিই অনিরুদ্ধ সেন তো?" অনিদাকে
জিজ্ঞাসা করলেন মিঃ ঘোষ।
অনিদা হেসে "হ্যাঁ" বলতে উনি এবার আমার দিকে চেয়ে বললেন, "রণজয়?"
আমি হেসে সৌজন্যতা দেখিয়ে বললাম, "রণজয় বোস।"
তাতে উনি একটা তাচ্ছিল্যের একপেশে হাসি হেসে বললেন, "লেখার হাতটা তো মন্দ না। তাহলে এই সব গুন্ডাগিরিতে এই বয়স থেকে নিজেকে
জড়িয়ে ফেলছ কেন?"
আমি কী উত্তর করব বুঝতে পারছিলাম না। বাউন্সারটা অবশ্য অনিদাই সামলাল। বলল, "প্র্যাকটিকাল অভিজ্ঞতা আছে বলেই না এত ভালো লেখে, মিঃ ঘোষ।"
"হুম। জায়গা মতো পড়লে ট্যাঁ ফো সব বেরিয়ে যাবে হে ছোকরা!"
আমাকে কেউ ছোকরা বলে ডাকুক, সেটা আমি মেনে
নিতে পারি না। কিন্তু অনিদা বলে, সব জায়গায় সব সময় মাথা গরম করতে নেই। তাই নিজেকে
সামলে নিলাম। তবে বেশ বুঝতে পারলাম যে এইবার আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী বেশ শক্ত।
আমরা এখন মিঃ ঘোষের স্টুডিও কাম লাইব্রেরিতে। সারা ঘর জুড়ে ছবি আর বই। জানালার সামনে দাঁড় করানো একটা ট্রাইপড। পাশে
একটা টেবিলে রাখা রয়েছে দুটো ডি এস এল আর ক্যামেরা। সেগুলোর মধ্যে একটা সেভেন ডি
আর অন্যটা ফাইভ ডি। দুটোই ক্যাননের এবং যথেষ্ট দামি। দুটো ক্যামেরার সঙ্গেই লেন্স লাগানো ছিল। অনিদার চোখ তখন সারা ঘরে লাট্টুর মতো পাক খাচ্ছে। বুঝতে পারছিলাম গল্প চুরির রহস্যের একটা সূত্র বের করার জন্য
ও মরিয়া হয়ে উঠেছে।
আমাদের দু’জনকে সামনের জোড়া চেয়ারে বসার
জন্য বলে মিঃ ঘোষ বললেন, "দেখো ভাই, তোমরা কেন এসেছ, আমি
জানি। কিন্তু গল্পটা আমারই লেখা। দাশগুপ্তর হাত থেকে এ লেখা বেরোনো সম্ভব না।
কিন্তু একটা গল্পের জন্য এই ভাবে টিকটিকি লাগিয়ে কী প্রমাণ করতে চাইছে দাশগুপ্ত, কে জানে?"
লোকটা আবার আমাদের বেমক্কা অপমান করল। অনিদা কিন্তু একই রকম নির্বিকার।
রাগে আমার মাথা বোঁ বোঁ করছে। কিন্তু কিছু বলতে পারছি না। অনিদা সেকথা হয়তো বুঝতে পারল। আমার মুখের দিকে চেয়ে আলতো করে চোখের পাতাদুটো একবার ফেলে
আমাকে শান্ত হতে বলল। তারপর খুব ঠান্ডা গলাতেই বলল, "লেখাটা একবার দেখতে
পারি?"
একেবারে সরাসরি আক্রমণ! অনিদার কথা শুনে মিঃ ঘোষের চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে
বেরোতে শুরু করল। "তুমি কি আমায় চ্যালেঞ্জ করছ নাকি হে ছোকরা?"
অনিদা কিন্তু আগের মতোই শান্ত। খুব নরম গলাতেই বলল, "দেখুন আমি একটা কাজ হাতে নিয়েছি। তাই আপনার সাহায্য
আশা করছি। আপনি
লেখাটা দেখাতে না চাইলে দেখাবেন না। কিন্তু যদি
আপনি দোষী না হন, তাহলে আমি রিকোয়েস্ট করব, আপনি আমাকে
সাহায্য করুন।"
কথাটায় মনে হয় কাজ হল। কিছুটা হলেও রাগ নামল মিঃ ঘোষের। বললেন, "তোমার
রেপুটেশনের কথা মাথায় রেখেই আমি অনুমতি দিচ্ছি আমার লেখাটা দেখার।"
"থ্যাঙ্কস!" হেসে বলল অনিদা।
মিঃ ঘোষ যখন এবার ব্যাগ থেকে তাঁর ল্যাপটপ বের করছেন, অনিদা তখন উঠে একবার
জানালার কাছে গেল। এর মধ্যে মিঃ ঘোষ আমাদের জন্য প্লেটে করে মিষ্টি আর কাচের
গ্লাসে কোল্ড ড্রিঙ্কস এনে দিয়েছেন। আর জানিয়ে দিয়েছেন যে তাঁর স্ত্রী পুজো দিতে দক্ষিণেশ্বরে গেছেন, তাই আমাদের সব ত্রুটি নিজ গুণে ক্ষমা
করে দিতে হবে।
"ওই ফ্ল্যাটেই তো তমাল দাশগুপ্ত থাকেন তাই না?"
"হ্যাঁ," ল্যাপটপ অন করতে করতে বললেন মিঃ ঘোষ।
অনিদা এবার টেবিলের সামনে এসে ক্যামেরাগুলো দেখতে লাগল। আমি জানি ক্যামেরার
ওপর ওর দুর্বলতা বরাবরের। হতে পারে জানালার কাছে উঠে যাওয়াটা ওর ক্যামেরাগুলোর
কাছে পৌঁছোতে পারার একটা আছিলা। এবার সেভেন ডি ক্যামেরাটা নিয়ে সেটায় লাগানো
লেন্সটা দেখে বলল, "বাঃ, এইট্টি ফাইভ! বলতে গেলে বেস্ট ফর পোরট্রেট।"
কথাটা শুনে একবার অনিদার দিকে চেয়ে মিঃ ঘোষ মুচকি হাসলেন। তারপর বললেন, "শখ
আছে নাকি এদিকে?"
"ওই আর কী!" মুচকি হেসে উত্তর দিল অনিদা। অবশ্য ওর উত্তরটা যতই
দায়সারা হোক, আমি কিন্তু জানি, মন দিয়ে কাজ করলে ফটোগ্রাফার হিসেবে অনিদা বেশ নাম
করে যেত! আর লেন্সের ব্যাপারে ওর জ্ঞান যথেষ্ট।
"আমার কাছে সত্তর দুশোও আছে,"
বললেন মিঃ ঘোষ।
"বাঃ।"
পোরট্রেট ছবি মানে যে মানুষের মুখের ছবি
তা আমি জানি। আর খুব বেশি না হলেও জানি যে ওই পঁচাশি মাপের
লেন্সটা দিয়ে সেটা সবচেয়ে ভালো হয়।
মিঃ ঘোষ ততক্ষণে ল্যাপটপ চালিয়ে দিয়েছেন। এবার সেভেন ডি ক্যামেরাটার পাশে
রাখা ফাইভ ডি ক্যামেরাটার দিকে ইশারা করে
বললেন, "ওতে যে লেন্সটা রয়েছে, দেখেছ?"
অনিদা তখন সেই ক্যামেরাটা হাতে তুলে নিয়ে চোখ কপালে তুলে বলল, "বাবা, এ তো আটশো!"
মিঃ ঘোষ তাতে একটা একপেশে তাচ্ছিল্যের হাসি
হেসে বললেন, "হুঁ, দশ লাখের কাছাকাছি দাম ভাই!"
"দশ লাখ!" আমি কথাটা ঢোঁক গিলেই হজম করলাম। একটা লেন্সের দাম এত!
আর কত লম্বা লেন্সটা!
"আপনি কিন্তু ল্যান্ডস্কেপ বেশি ভালো তোলেন," ক্যামেরাটা রাখতে রাখতে
বলল অনিদা।
কোনও প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবিকে যে ল্যান্ডস্কেপ বলে তা আমি জানি। আসলে কাঁচা
ভাষায় যাকে আমরা সিনারি বলি, তাকেই পাকা ভাষায় বলে ল্যান্ডস্কেপ। এসবই অবশ্য
অনিদার দৌলতেই শেখা। ওর প্রশংসা শুনে মনে হল কিছুটা হলেও গললেন মিঃ ঘোষ। হেসে
বললেন, "বাইরের কাঞ্চনজঙ্ঘার ছবিটা দেখেছ? এতে তোলা।" বলে ওই আটশো মাপের
লেন্সটা দেখালেন মিঃ ঘোষ।
"হ্যাঁ, দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম, এমন কিছু একটা ব্যবহার করা হয়েছে," বলল অনিদা।
"হুম। তা কই, দেখো আমার লেখাটা। তোমার জন্য তো ল্যাপটপ খুলে
দিয়েছি।"
তাতে অনিদা "হ্যাঁ, ওই আর
কী" বলে এমনভাবে ল্যাপটপের দিকে এগিয়ে গেল যেন মনে হল লেখা পরীক্ষা করার
ব্যাপারে ওর আর কোনও আগ্রহ নেই। ভাবলাম, ক্যামেরা দেখে কি অনিদার মাথা ঘুরে গেল
নাকি?
অনেকটা দায়সারাভাবে ল্যাপটপটা দেখে নিয়ে অনিদা বলল, "আমি সরি মিঃ ঘোষ।
আপনাকে এতটা বিরক্ত করলাম।"
তাতে হো হো করে হেসে মিঃ ঘোষ বললেন, "না না। তুমি তো তোমার কাজ করেছ
ভাই। আসলে দাশগুপ্তটা বরাবরই ওই রকম। শুধু শুধু নিজে বদনাম হল তো!"
তমাল জেঠু তার মানে মিথ্যে কথা বলেছেন! ব্যাপারটা
আমার কোনো মতেই হজম হচ্ছিল না। কিন্তু অনিদার মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে যে ওই লেখাটা যে মিঃ ঘোষের সেটা ও
মেনে নিয়েছে! কিন্তু এটা কী করে সম্ভব!
অনিদা এবার মিঃ ঘোষকে জিজ্ঞাসা করল, "তাহলে তমাল দাশগুপ্ত হঠাৎ কেন
আপনার লেখাকে নিজের লেখা বলে চালাতে গেলেন?"
"এগুলো হিংসা ছাড়া আর কিছু না। ফটোগ্রাফার হিসেবে আমার এত নাম। তার
ওপর আবার লেখার জগতে পা রেখেছি। প্রতিবেশী হয়ে অল্প দিনের মধ্যেই বাজি মেরে চলে
যাবে, কে মানবে বলো ভাই? মানছি ও অনেক দিন ধরেই লেখালেখি করছে। কিন্তু তেমন নাম
কোথায় ওর? আর আমি তো নাম কিনতে শুরু করে দিয়েছি। তাই, যদি টেক্কা দিয়ে দিই! সেই
কারণে এই অপবাদ দেবার চেষ্টা। তবে আমার সঙ্গে পেরে ওঠেনি। বাড়িতে এসেছিল ঝগড়া করতে। হুট আউট করে ভাগিয়ে দিয়েছি!"
"কিন্তু শুনেছি ওনার কাছেও ওই লেখার এক কপি রয়েছে। সেটা উনি পেলেন কী
করে?" এই প্রশ্নটা শুনে বুঝতে পারলাম মিঃ ঘোষকে অনিদা এখনও নির্দোষ বলে মেনে
নেয়নি। ও আসলে কায়দা করে কথা বের করার চেষ্টা করছে।
জিনিসটা অবশ্য মিঃ ঘোষ বুঝতে পারলেন না। মুখ দিয়ে চুক করে একটা শব্দ করে
বললেন, "হবে হয়তো কোনোভাবে জোগাড় করেছে। আমি ও নিয়ে আর চিন্তা করছি না।"
আগামী বর্ষা সংখ্যায় লেখাটা নাকি বিশ্বাস পাবলিশার্স বের করবে। তাই নিয়েই
মিঃ ঘোষ মেতে রয়েছেন। বোঝা গেল এ ব্যাপারে উনি আর বেশি মাথা ঘামাতে চান না। অনিদা এবার কোন পথে এগোবে তা বুঝতে পারছিলাম না। কারণ
হঠাৎ করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, "আচ্ছা, আমরা তাহলে আজ আসি।"
* * *
আমরা মিঃ ঘোষের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এলাম। ফেরার সময় তমাল জেঠুর সঙ্গে একবার দেখা করতে গেলে উনি উৎসুক হয়ে প্রশ্ন করলেন, "কিছু পেলে অনি?"
তাতে ‘না’ বলে মাথা নাড়ল অনিদা। তখন তমাল জেঠু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, "যাক
গে, আর ও নিয়ে মাথা ঘামিও না। তুমি চেষ্টা করেছ, এই ঢের।"
ফেরার পথে অনিদাকে জিজ্ঞাসা করলাম, "তমাল জেঠু লেখাটা লেখেননি?"
অনিদা আমার কথার কোনও উত্তর করল না। আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম, "তুমি
তাহলে মিঃ ঘোষকে সন্দেহর তালিকা থেকে মুক্তি দিচ্ছ?"
"আমি প্রমাণ চাই জয়," উত্তরটা বেশ গম্ভীরভাবে দিল অনিদা।
"তুমি তার মানে মিঃ ঘোষের পক্ষে?"
অনিদা তখন হেসে ‘আমি সত্যের পক্ষে’ বলে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল।
।।
৫ ।।
শ্যামবাজার থেকে ফিরতে ফিরতে আমাদের দুপুর হয়ে গেছিল। ফেরার পর থেকেই
অনিদাকে দেখলাম ও কেসটার ব্যাপারে মৌনী নিয়েছে।
ফেসবুক করছে, ইনস্টাগ্রাম করছে, হিস্ট্রি চ্যানেল
দেখছে, এপিক চ্যানেলে ডকুমেন্টারি দেখছে, আমার সঙ্গে ক্রিকেট নিয়ে আলোচনাও করছে। কিন্তু তমাল জেঠুর গল্পটা নিয়ে কোনও কথা বলছে
না। দুপুরে খেতে খেতে আমি একবার ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, "গল্প চুরির ব্যাপারটা
নিয়ে তোমার কী মতামত অনিদা?"
তাতে ও মাংসের হাড় চিবোতে চিবোতে বলল, "গল্পটা পড়ে দেখতে হবে। নিশ্চয়ই
ভালো হবে, কী বল?"
বুঝলাম ওর মেজাজ এখন অন্য স্কেলে। তাই আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। এমনটা মাঝে
মাঝে হয়। হঠাৎ হঠাৎ করে ওর ব্যবহার দেখে মনে হয় ও যেন কেস থেকে বেরিয়ে গেছে।
কিন্তু পরে অন্য কিছু সামনে আসে। খাবার পর দুপুর বেলা আমি স্যার চার্লি চ্যাপলিনের
ওপর লেখা একটা বই পড়ছিলাম। সত্যিই, পড়তে পড়তে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছিল। ওনার
সম্পর্কে বলতে গিয়ে অনিদা একবার বলেছিল, GOD wanted to act, so Sir
Charlie Chaplin came in this World !!! মানে ভগবান অভিনয় করতে
চেয়েছিলেন, তাই স্যার চার্লি চ্যাপলিন এই পৃথিবীতে এসেছিলেন।
আমার চোখ বইতে থাকলেও অনিদা কিন্তু সেই তখন থেকে পরে আছে ল্যাপটপ নিয়ে।
প্রায় একটানা অনেকক্ষণ বলতে গেলে চোখের পাতা না ফেলে ল্যাপটপের স্ক্রিনে চোখ রেখে
এবার সোজা হয়ে বসে একটা লম্বা শ্বাস ফেলে অনিদা বলল, "অসাধারণ!"
"কী অনিদা?" আমি বইয়ে বাঁ হাতের মধ্যমা দিয়ে একটা বুকমার্ক করে
বইটা বন্ধ করে ওর দিকে চাইলাম।
"গল্পটা," বলল অনিদা।
"গল্প?" আমি অবাক হয়ে বললাম, "কোন গল্প অনিদা?"
"এই, যেটা নিয়ে আমাদের নতুন কেস।"
"মানে!" আমার অবাক হওয়াটা তিনগুণ হল, "তুমি ও গল্প পেলে
কোথায়? তমাল জেঠু তোমায় গল্পটা দিয়েছেন?"
"না," হেসে বলল অনিদা।
"তাহলে?" আমি অনিদার কথা শুনে এমন গোলকধাঁধায় পড়ে গেছিলাম যে আমার অজান্তেই বইয়ের মধ্য থেকে বুক মার্কার তৈরি করা আঙুলটা
বেরিয়ে গিয়ে কতটা পড়া হয়েছিল সেটা হারিয়ে ফেললাম। তবে পাতার নম্বরটা মনে ছিল। তাই
ঘাবড়ালাম না।
"ম্যাজিক," বলল অনিদা।
"ম্যাজিক মানে?"
"গল্পের নাম।"
"কিন্তু -" অনিদার কথা শুনে আমি তখন খেই হারিয়ে ফেলেছি। কারণ আমি
যতদূর জানি তমাল জেঠু বা মিঃ ঘোষ, কেউই ওকে লেখাটা দেয়নি। তাহলে সেটা ওর হাতে এল
কী করে? কথাটা ওকে জিজ্ঞাসা করতে যাবো, ঠিক তখন ও অরিন্দমদাকে ফোন করল।
"...হ্যাঁ রে, অরিন্দম, কাল বিকেলে
একবার মিট করা যায়? ...হ্যাঁ, মোটামুটি একটা হিসেব
পেয়ে গেছি। ...হ্যাঁ, সবাইকেই ডাক।
...তমাল দাশগুপ্ত তো বটেই। তার সঙ্গে বিকাশ ঘোষ...
ও চিন্তা করিস না, ওনাকে আমি ম্যানেজ করে নেবো। বাকিদের
তুই ফোন কর। ...ওকে, কাল তাহলে বিকেল পাঁচটায়।
তোদের বি আর সিং এর ফ্ল্যাটে।"
অনিদার কথা থেকেই বুঝে গেলাম কাল কী হতে চলেছে। ও ফোন রাখতে আমি প্রায় লাফিয়ে
উঠলাম। "তার মানে তুমি গল্প চুরির রহস্যটার সমাধান
করে ফেলেছ!"
উত্তরে অনিদা কিছু বলল না। তাতে আমার কৌতূহল আরও বেড়ে গেল। হাতের বইটা
বিছানায় রেখে আধশোয়া অবস্থা থেকে সোজা হয়ে বসতে গিয়ে খাটের কোনায় মাথায় একটা টাক
খেলাম। এবার মাথার সেই জায়গাটায় হাত বোলাতে বোলাতে বললাম,
"মিঃ ঘোষ কি আদৌ চুরি করেছিলেন ওটা?"
উত্তরে অনিদা বলল, "খুব মজার ব্যাপার জানিস জয়?"
অনিদার কথা শুনেই বুঝলাম ও সব জট ছাড়িয়ে ফেলেছে। আমার বুক ধুকপুক করতে শুরু
করল। সঙ্গে সঙ্গে গলা তুলে আমি চোখ বড়ো বড়ো করে অনিদার দিকে ঝুঁকে পড়ে বললাম,
"তাই? কেমন?" কিন্তু ও আমার উত্তেজনায় জল ঢেলে দিয়ে বলল, "চল, আজ
একটা নাটক দেখে আসি। অনেক দিন দেখিনি। প্রায় দু’সপ্তাহ হয়ে গেল।"
বুঝলাম ও এখন কিছু খোলসা করবে না। তাই বাধ্য হয়ে চেপে গেলাম। তারপর বিছানা
ছেড়ে উঠে বসলাম বেরোবার জন্য তৈরি হতে।
* * *
আজ বিকেলে অরিন্দমদার বাড়িতে আবার চাঁদের হাট বসেছে। সাত্যকিদা, অলকাদি,
কাবেরীদি, নীলাদ্রীদা, উৎসবদা, সবাই রয়েছে। তমাল জেঠু অনেকক্ষণ আগেই চলে এসেছিলেন। এবার সব শেষে ঘরে এসে ঢুকলেন মিঃ বিকাশ ঘোষ। আমরা যে কেস
নিয়ে আলোচনা করতে এসেছি সেটা অরিন্দমদা ছাড়া আর কেউ জানে না। সবাই জানে আজকের
আড্ডাটা শুধু লেখা নিয়েই। আসলে অনিদার এমনটাই নির্দেশ ছিল। কিন্তু আচমকা মিঃ ঘোষকে
দেখে সবাই একটু চমকে উঠলই বলা যায়। জিনিসটা মেক আপ দিতে অনিদা বলল, "আমিই
ওনাকে ডেকেছি।"
তাতে তমাল জেঠু যে ভাবে ভুরু কুঁচকে তাকালেন, তার মানে হল "কেন?"
এর উত্তরটা এল অরিন্দমদার থেকে। "উনিও লেখক। তাই আমরা ভাবলাম ওনার
যোগদান আমাদের দলকে আরও ভারী করে
তুলবে।"
কথাটা শুনে সবাই একে অপরের দিকে চাইতে বোঝা গেল কেউ ওনাকে ভালোভাবে নিচ্ছে না। জিনিসটা হয়তো মিঃ
ঘোষও বুঝতে পেরেছিলেন। তাই উনি সামান্য ইতস্তত করে বললেন, "দেখুন, আপনারা না
চাইলে আমি এখুনি এখান থেকে চলে যেতে পারি।"
জিনিসটা অন্য দিকে যাচ্ছে বুঝতে পেরে অলকাদি বলল, "না না, তা কেন?
আপনি ভুল বুঝবেন না। আপনি এসেছেন, সবার ভালোই লাগছে।"
আস্তে আস্তে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে উঠল। আমাদের আড্ডাও জমে উঠল। প্রাক
রবীন্দ্রনাথ, চর্যাপদ, রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ হয়ে
আমাদের আলোচনা ঢুকে পরল সুনীল গাঙ্গুলিতে। শেষে
শুরু হল আজকের লেখকদের লেখা নিয়ে আলোচনা। ঘরে উপস্থিত সকলেই দেখলাম সুচিত্রা ভট্টাচার্যের বিরাট ফ্যান। কথায় কথায় উঠল বনফুলের ছোটো গল্প নিয়ে আলোচনা। তারপর হেমেন্দ্র কুমার, সত্যজিৎ রায় হয়ে আলোচনা শুরু হল তমাল জেঠুর লেখা নিয়ে।
ওনার লেখা নিয়ে কথা শুরু হতে মিঃ ঘোষকে দেখলাম ব্যাকফুটে যেতে। আচমকাই যেন
চুপ করে গেলেন ভদ্রলোক।
বিষয়টা যে অনিদাও লক্ষ করেছিল, সেটা ও আমাকে পরে বলেছিল।
"মিঃ ঘোষও কিন্তু ভাল লেখেন,"
বলল অনিদা।
"হ্যাঁ, ওনার কয়েকটা লেখা পড়েছি, খারাপ লাগেনি," বলল কাবেরীদি।
তাতে হেসে মিঃ ঘোষ বললেন, "ভাল লেগেছে আর খারাপ লাগেনি, এর মধ্যে
কিন্তু ঢের ফারাক আছে কাবেরী!"
"না, আমি আসলে সেটা..."
"বলতে চাওনি, জানি,"
কাবেরীদির কথা কেটে মিঃ ঘোষ তাঁর অতি পরিচিত তেরিয়া ঢংয়ে বললেন, "আসলে জানো তো,
মিডিয়া না বললে আমরা মানি না বা মানতে চাই না কোনও নতুন লোকের কাজও যে ভালো হতে পারে।"
"না না, আপনি ভুল ভাববেন না। ও মনে হয় না সেই সব ভেবে বলেছে।"
পরিস্থিতি সামাল দেবার চেষ্টা করল অরিন্দমদা।
ঠিক এই সময় বাউন্সারটা মারল অনিদা। বলল, "আপনার ‘ম্যাজিক’ গল্পটা কিন্তু সাংঘাতিক হয়েছে
মিঃ ঘোষ।"
অনিদার মুখে নিজের লেখা গল্পের কথা শুনে থমকালেন মিঃ ঘোষ। লক্ষ করলাম
আচমকাই শিরদাঁড়াটা সোজা হল
তমাল জেঠুর।
"তুমি জানলে কী করে?" আচমকাই মুখ হাঁ হয়ে গেল মিঃ ঘোষের।
"গল্পটা পড়ে," হেসে বলল অনিদা।
"তুমি ওই গল্প পড়েছ?" চোখ কপালে তুলে বললেন তমাল জেঠু।
"কিন্তু পড়লে কী করে? আমি তো তোমাকে দিইনি!" যেন আকাশ থেকে পড়লেন মিঃ ঘোষ।
"তুই পড়লি কখন গল্পটা!" অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল অরিন্দমদা।
ঘরে উপস্থিত প্রায় সবাই তখন অপলকে চেয়েছিল অনিদার দিকে। আমার বুকের
ধুকপুকানিটা তখন অনেকটাই বেড়ে গেছে। গল্পের ছলে যে অনিদা কেসের মধ্যে ঢুকে পড়েছে, তা বুঝতে পারলাম।
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে মুখে মুচকি হাসি নিয়ে একদৃষ্টে মিঃ ঘোষের দিকে চেয়ে রইল অনিদা। তারপর
পকেট থেকে একটা চৌকো জিনিস বের করে আমাদের সবার সামনে তুলে ধরল।
"এটা?" ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করলেন মিঃ ঘোষ।
"মেমোরি কার্ড। ২৫৬ জিবি। স্যান ডিস্ক।"
"মানে?" ভুরুর সঙ্গে সঙ্গে এবার নাকটাও কুঁচকে গেল মিঃ ঘোষের।
অনিদার হেঁয়ালি আমার মতো ঘরের
অন্যদেরও ফাঁপরে ফেলল। অলকাদি বলল, "এটা তো একটা ডি এস এল আর ক্যামেরার মেমোরি
কার্ড বলে মনে হচ্ছে।"
"ঠিক তাই," বলে হেসে এবার হাত নামিয়ে
নিল অনিদা।
"কিন্তু ওটা কার?" জিজ্ঞাসা করল সাত্যকিদা।
তখন কার্ডটা উলটে সেটা চোখের কাছে নিয়ে অনিদা বলল, "এতে তো খুব ছোট্ট
করে লেখা আছে দেখছি ‘বি জি’।”
"বি জি!" অনিদার কথা শুনে সামান্য সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লেন মিঃ ঘোষ। বললেন, "কই দেখি?"
এবার অনিদার হাত থেকে মেমোরি কার্ডটা নিয়ে মিঃ ঘোষ সেটা চোখের সামনে নিলেন।
তারপর চশমাটা ভালো করে চোখে বসিয়ে নিয়ে কার্ডটা
দেখতে দেখতে বললেন, "একী! এ তো আমার কার্ড! এ তুমি পেলে কোথায়!"
"কার্ডটা আপনার?" মিঃ ঘোষের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উলটে ওনাকে
প্রশ্ন করল অনিদা।
"আমার মানে? আলবাত আমার," হাঁটুতে একটা চাপড় মেরে
গলা সপ্তমে তুলে মিঃ ঘোষ বললেন, "দেখছ না, আমার নামের ইনিশিয়াল করা রয়েছে? বি
জি, মানে বিকাশ ঘোষ। আর এটা আমারই হাতের লেখা। কিন্তু তুমি এটা পেলে কোথায়?"
"পেলাম না, নিলাম," আবার হেঁয়ালি করল অনিদা।
"নিলাম? মানে?" মিঃ ঘোষের অবাকের পরিমাণটা বাড়ল।
অনিদা তখন বলল, "সেদিন আপনার বাড়িতে যখন গেছিলাম, তখন কায়দা করে এটা
আমি সরিয়ে নিয়েছিলাম।"
"এর মানে কী?" এবার রাগে ফেটে পড়লেন মিঃ ঘোষ, "তুমি
আমাকে জিজ্ঞাসা না করে আমার ঘর থেকে আমার ক্যামেরার মেমোরি কার্ড চুরি করে নিয়ে
এসেছ! কত বড়ো স্পর্ধা তোমার? তুমি নাকি সত্যর
পেছনে দৌড়োও!"
কখন, কীভাবে, কোথা থেকে এবং কেন - অনিদা মেমোরি কার্ডটা মিঃ ঘোষের ঘর থেকে
নিয়ে এল, সেটা ভাবছি, অনিদা তখন নিজেই আমার মনে তৈরি হওয়া প্রশ্নের উত্তরগুলো দিয়ে দিল।
"আসলে এটা ছিল ওই ফাইভ ডি ক্যামেরাটার মধ্যে। মানে যেটার মধ্যে টেলি
লেন্সটা লাগানো ছিল। আমি যখন ক্যামেরাটা দেখছিলাম, তখনই এটা ওর থেকে বের করে নিই।"
"কিন্তু কেন?" কপাল কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল অরিন্দমদা।
অনিদা তাতে একবার ওর দিকে তাকাল। তারপর বলল, "আর এই কার্ডটা থেকেই
আমার হাতে এসেছিল ‘ম্যাজিক’ গল্পটা।"
"কার্ডে গল্প! তাও সেই কার্ড আবার ক্যামেরাতে লাগানো!" অবাক হয়ে
বলল কাবেরীদি।
"হ্যাঁ," মাথাটা সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে অনিদা বলল, "সেই গল্প,
যেটা লেখা হয়েছিল সেদিন, মানে সেই শুক্রবার রাতে।"
"কিন্তু সে গল্প তো লেখা হয়েছিল ল্যাপটপে, কার্ডে নয়," অনিদার দিকে কটমটিয়ে চেয়ে
বললেন মিঃ ঘোষ।
"ঠিক তাই," শূন্যে তর্জনী ছুঁড়ে অনিদা
বলল, "লেখা হয়েছিল ল্যাপটপেই। কিন্তু তারপর সেটা উড়ে চলে যায় ক্যামেরার
মেমোরি কার্ডে।"
"ওঃ অনি, কী সব হেঁয়ালি করছ, ব্যাপারটা খুলে
বলো," এবার অধৈর্য হয়ে বলল অলকাদি।
"তাহলে তো পুরো ঘটনাটা খুলে বলতে হয়!" ঘরে উপস্থিত সবার দিকে
একবার করে চেয়ে মুচকি হেসে বলল অনিদা।
"তা তুমি অপেক্ষা করছ কীসের
জন্য?" ভুরু কপালে তুলে বলল সাত্যকিদা।
তমাল জেঠুকে দেখলাম একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছেন অনিদার দিকে। অবশ্য ওনার মতো সবার চোখই এখন অনিদার ওপর আটকে।
এবার অনিদা যে ঘটনাটা বলল, সেটা অনেকটা এই রকম -
"সেদিন রাত ন’টা। নতুন
গল্প শুরু করলেন তমাল দাশগুপ্ত। রাত দুটো পর্যন্ত লিখে গল্পটা শেষ করলেন উনি। তার
পরের দিন দুপুর বেলা যখন সেই লেখাটা বিশ্বাস পাবলিশার্সে নিয়ে গেলেন, তখন সেখানকার
কর্ণধার মিঃ বিশ্বাস জানালেন যে এ লেখা আগেই জমা পড়ে গেছে। ব্যস, মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল ওনার। এ কী করে সম্ভব? এ লেখা তো উনি আগে বাইরে বের করেননি! তাহলে?
“আমরা সবাই এই ঘটনা জানি। যদিও, মিঃ ঘোষ দাবি করেছেন এ লেখা ওনারই। আর তার
প্রমাণ ওনার হাতের কাছেই রয়েছে। ওনার
ল্যাপটপে আমি এই লেখার কপি দেখেছি। সেটার ওয়ার্ড ফাইলও আমি দেখেছি। কিন্তু তাহলে?
আসল ঘটনাটা কী? রহস্যটা কী এই ঘটনার পেছনে? কে সত্যি বলছেন? তমাল দাশগুপ্ত নাকি
মিঃ ঘোষ?"
এতটা বলে থামল অনিদা। ঘরে উপস্থিত সবার মধ্যে একটা গুজগুজ শুরু হতে অনিদা
সবাইকে হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে বলল, "আসলে এই গল্পটা লেখার পেছনে চলছিল আরেকটা
গল্প লেখা। চলছিল একটা সিনেমা। মানে ছবিতে গল্প বলা। একজন লিখছিলেন আর আরেকজন সেটা
সঙ্গে সঙ্গে কপি করে
নিচ্ছিলেন।"
"মানে?" অবাক হয়ে প্রশ্ন করল অরিন্দমদা।
"হ্যাঁ," তাতে মুচকি হেসে মাথাটা একবার সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে
অনিদা বলল, "আর তার পদ্ধতিটা সত্যিই অভিনব।"
"সেটা কেমন?" জিজ্ঞাসা করল অলকাদি।
"আসলে গল্পটা সেদিন লিখছিলেন তমাল জেঠুই। কিন্তু সেটা কপি করছিলেন মিঃ
ঘোষ। হ্যাঁ, অনেকটা খেলার মতো। মানে
লাইভ রেকর্ডিং।"
"কী যা তা বলছ অনিরুদ্ধ!" এবার তেতে উঠলেন মিঃ ঘোষ। বললেন, "আমাকে
ডেকে এনে এই ভাবে অপমান করার কোনও রাইট তোমার নেই!"
অনিদা কিন্তু ওনার কথার তেমন কোনও পাত্তা দিল না। ও বলতে থাকল।
"তমাল দাশগুপ্ত সেদিন ওই লেখাটা লিখছিলেন তাঁর চেয়ারে বসে। তাঁর চেয়ার
টেবিলটা ঘরের এমন পজিশনে রাখা, যাতে করে কিনা সেই চেয়ারে বসলে মানুষকে জানালার
দিকে পিঠ করেই বসতে হয়। আর কেউ যদি
জানালার সামনে মুখ রাখে, তাহলে সে পরিষ্কার দেখতে পায় ল্যাপটপটা। আর সেই ভাবেই
চুরি হয়েছিল গল্পটা।"
"বাঃ," বলে এবার হাততালি দিয়ে উঠলেন মিঃ ঘোষ, "দারুণ গল্প বানাচ্ছ তো! তার মানে তুমি বলতে চাইছ, আমি ব্যাটম্যান বা স্পাইডার
ম্যানের মতো উড়ে গিয়ে দাশগুপ্তর জানালায় ঝুলে
থেকে ওর লেখা টুকে নিয়েছি!" কথাটা বলে হা হা করে হেসে উঠলেন মিঃ ঘোষ।
অনিদা কিন্তু এতে এতটুকু দমল না। বলল, "গল্প বানাইনি মিঃ ঘোষ। গল্প
সেদিন তৈরি হয়েছিল। যেন অনেকটা সিনেমা।
হ্যাঁ, তমাল দাশগুপ্ত সেদিন একেকটা পাতা লিখছিলেন, আর সেগুলোকে আপনি সঙ্গে
সঙ্গে কপি করে নিচ্ছিলেন আপনার প্রচন্ড শক্তিশালী ওই লেন্সটা দিয়ে। আপনি সেই সময় দাঁড়িয়ে ছিলেন জানালার
ধারে। দেখতে পাচ্ছিলেন যে তমাল জেঠু কোনও একটা নতুন লেখা শুরু করেছেন। আপনি জানতেন
ওনার লেখা কতটা শক্তিশালী। এই লেখা যদি আপনার নামে বেরোয়, তাহলে আপনারও সুযোগ থাকে
নাম কেনার। আর লেখাটা যদি ভাল হয়? ব্যস, কেল্লা ফতে! কিন্তু ওনার লেখা আপনি পাবেন
কী করে? সঙ্গে সঙ্গে মাথায় একটা ফন্দি আসে আপনার। আপনার কাছে আছে ভীষণ শক্তিশালী একটা লেন্স, যা দিয়ে কিনা চাঁদের ছবিও ঝকঝকে তোলা যায়। দূরের ছবির প্রতিটা ডিটেলস চলে
আসে আপনার হাতের মুঠোয়। আর শুধু লেন্স না, আপনার কাছে রয়েছে দারুণ একটা ক্যামেরা। ক্যাননের ফাইভ ডি। তাহলে আর অপেক্ষা কেন? বের করে ফেললেন ক্যামেরা। ৮০০ এম
এম লেন্সটা জুড়লেন সেটার সঙ্গে। তারপর
বের করলেন ট্রাইপডটা, ক্যামেরাটা বসিয়ে নিলেন সেটার
ওপর। ব্যস, চলতে লাগল অন লাইন ডাকাতি! তমাল
জেঠু একেকটা পাতা শেষ করে সেটা একবার করে দেখছেন, আর আপনিও ঝট করে সেটার ছবি তুলে
নিচ্ছেন। হ্যাঁ, এই ভাবেই রাত দুটো পর্যন্ত জানালার ধারে দাঁড়িয়ে তমাল জেঠুর
লেখাটার ছবি তুলে নিলেন আপনার ক্যামেরাতে। আর তারপর তমাল জেঠু ঘুমিয়ে পড়লে আপনি শুরু করলেন আপনার কাজ। সারা রাত জেগে কপি বানালেন লেখাটার। সকাল ছ’টা নাগাদ শেষ হল আপনার ডাকাতি। তারপর সকাল সাড়ে এগারোটা নাগাদ
গেলেন বিশ্বাস পাবলিশার্সে। জমা দিলেন লেখাটা। আর তারপর তমাল জেঠু যখন নিজের লেখা
নিয়ে গেলেন বিশ্বাস পাবলিশার্সের অফিসে, ততক্ষণে সব শেষ! নিজের সদ্য লেখাটা দেখে
তখন ভিরমি খাবার অবস্থা ওনার।"
এতটা বলে থামল অনিদা। ঘরে কারও মুখে তখন একটাও কথা নেই। বাবু হয়ে বসেছিল অলকাদি। ডান হাতের
কনুইটা হাঁটুতে রেখে হাতের তালুর ওপর কপাল চেপে চোখ বন্ধ করে এতক্ষণ অনিদার কথা শুনছিল। এবার ধীরে ধীরে
মাথা তুলে বলল, "সত্যিই ভাবা যায় না। আগাথা ক্রিষ্টিও ফেল অনি!"
সাত্যকিদাকে দেখলাম ঘন ঘন মাথা নাড়তে। কপালে ওর চারটে ভাঁজ। তমাল জেঠুর
মুখের হাঁ-টা একটা ওভাল শেপ নিয়েছিল।
মিঃ ঘোষ যেহেতু প্রফেশনাল ক্রিমিনাল না, তাই অনিদার কথায় কোণঠাসা হয়ে পড়লেন। এবার একেবারে ধরাশায়ী হলেন ওর প্রমাণ পেশ করায়।
"ওই মেমোরি কার্ডটা যে আপনার সেটা আপনি স্বীকার করেছেন। তাতে তোলা ছবিগুলো সেই গল্পেরই। আর সেগুলো যে সময় তোলা হয়েছিল, তার ডেট আর টাইমও রয়েছে প্রত্যেকটা ফাইলের সঙ্গে। সুতরাং, এটা একটা বিরাট প্রমাণ। আর
তাছাড়া, তমাল জেঠুর ল্যাপটপের ওয়ার্ড ফাইলটা আর আপনার ল্যাপটপের ফাইলটার পাশে
দেখাতে থাকা সময়টাও বলে দিচ্ছিল যে তমাল জেঠুই
আগে লেখাটা লিখেছেন। কারণ, সেটার টাইম দেখাচ্ছে সেই শুক্রবার রাত দুটো পাঁচ। আর
আপনারটা সকাল ছ'টা এগারো। মানে পরের দিন ভোর বেলা।"
মাথা নিচু করে বসেছিলেন তমাল জেঠু। একই অবস্থা মিঃ ঘোষেরও। থমথমে মুখটা
এবার সামান্য উঠতে কাবেরীদি বলল, "এই নোংরামোটা কেন করলেন মিঃ ঘোষ?"
তাতে আবার মাথা নামিয়ে নিলেন উনি। যার মানে হল, উনি দোষ স্বীকার করে নিলেন।
পাশ থেকে তখন সাত্যকিদা বলল, "এটা লেখার জগত। এখানে প্রতিষ্ঠা পেতে
সময় লাগে। আর একজনের লেখা নিজের নামে চালিয়ে সাময়িক সাফল্য পেলেও প্রতিভা না থাকলে
সেই সাফল্য নিমেষেই জানালা দিয়ে উড়ে পালায়। আপনি
তো লেখার জগতে মাত্র ছয়-সাত বছর এসেছেন। আর সেখানে তমালদা
একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক। আজকে ছোটো গল্পের
দুনিয়াতে একটা ‘নাম’। তাই একটা লেখা নিলেও আপনি ওনাকে কি আটকে রাখতে পারতেন?"
তাতে মাথাটা বার চারেক সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে সাত্যকিদার কথায় সায় দিয়ে বিকাশ
ঘোষ তাঁর মোবাইল ফোনের দিকে হাত বাড়াতে অনিদা জিজ্ঞাসা করল, "কাকে ফোন করছেন
মিঃ ঘোষ?"
"বিশ্বাস পাবলিশার্স..." ফ্যাকাসে
মুখে বললেন মিঃ ঘোষ।
অনিদা তখন মুচকি হেসে বলল, "আমি বলে রেখেছি। উনি ওই গল্প আপনার নামে
ছাপবেন না। কারণ উনি জানেন ওটা আপনার লেখা নয়।"
আবার মাথা নিচু করে নিলেন মিঃ ঘোষ। ওনার সেই তেরিয়া মেজাজটা তখন একেবারে উধাও! এবার ধীরে ধীরে মাথা তুলে ডান হাতটা বাড়িয়ে
তমাল জেঠুর হাতটা চেপে ধরে বললেন, "আমায় ক্ষমা করে দাও দাশগুপ্ত। মানুষ লোভে
পড়লে অনেক খারাপ কাজই করে ফেলে। আমি অনুতপ্ত।"
"আরে না না," লজ্জা লজ্জা মুখ করে হেসে
উঠলেন তমাল জেঠু।
অলকাদি তখন বলল, "দোষ স্বীকার করে অনুতপ্ত হলে সব দোষ মাফ হয়ে যায় মিঃ
ঘোষ।"
"আর আপনি তো এখন আমাদের গ্রুপেরই একজন সদস্য!" বলে হো হো করে
হেসে উঠলেন তমাল জেঠু। আর ওনার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের অন্যরাও।
* * *
ফেরার সময় বেশ তূরীয় মেজাজে ছিল অনিদা। এমন মজাদার কেস ও আগে কখনও পায়নি। ওর সঙ্গে
সঙ্গে আমার মেজাজও বেশ তোফা। যদিও কিছু কিছু জায়গায় ধোঁয়াশা
আছে। তাই এবার অনিদার দিকে তাকাতে ও হেসে বলল, "কোথায় বুঝতে পারছিস না, বল।"
আমাদের গাড়ি এখন শিয়ালদা ছেড়ে মৌলালীর কাছে। এখান থেকে একবার ধর্মতলায় মেট্রো
গলিতে যাব। অনিদা ক্যামেরার লেন্স পরিষ্কার করার জন্য একটা স্প্রে কিনবে। ওখানকার
বিখ্যাত তিনটে ক্যামেরার দোকানের মধ্যে র্যাশনাল আর তনভীর'স ওর খুব চেনা। আরেকটা
দোকান এম এম ও খুব ভালো। ওখানেও চেনা রয়েছে। তবে আগের দুটোর মতো নয়।
"তোমার কী দেখে প্রথমে সন্দেহ হল যে এমন একটা কিছু হয়েছে?"
"কিছু একটা অস্বাভাবিক যে হয়েছে, সেটা তমাল দাশগুপ্তর কথা শুনেই
বুঝেছিলাম। বন্ধ ঘর থেকে লেখা চুরি হয়ে গেল। এ কী করে সম্ভব? প্রথমটায় আমিও বেশ
ঘাবড়েছিলাম। কিন্তু তমাল দাশগুপ্তর ঘরে ঢুকে একটা অদ্ভুত চিন্তা মাথায় এল। জানালা। হ্যাঁ, জানালা। সব দিক যদি বন্ধ থাকে, তবে ওই জানালা দিয়েই
চুরিটা হয়েছিল। কথাটা আমার মনে উঁকি দিচ্ছিল। অথচ বুঝতে পারছিলাম না, সেটা কী করে।
কিন্তু তারপর মিঃ ঘোষের ফ্ল্যাটে ঢুকে প্রথমে কাঞ্চনজঙ্ঘার অমন সুন্দর ছবিটা দেখে
মাথার মধ্যে একটা চিন্তা এল। তারপর যখন দেখলাম ক্যামেরার
ট্রাইপডটা জানালার সামনে রাখা আর ফাইভ ডি ক্যামেরাটায় লাগানো রয়েছে
অমন দুর্ধর্ষ একটা টেলি লেন্স, তখন মনে মনে সন্দেহ তৈরি হল। আর তাছাড়া
ট্রাইপডের ওপর যে প্লেটটা থাকে, সেটা তখনও লাগানো ছিল
ক্যামেরাটাতে। মানে সেটা কয়েকদিনের মধ্যেই ব্যবহার হয়েছিল। এমনকি ক্যামেরা থেকে
ব্যাটারিও খুলতে ভুলে গেছিলেন মিঃ ঘোষ। আর সন্দেহ সত্যি বলে প্রমাণ হল মেমোরি কার্ডটা হাতে আসতে। সেটাও আবার ঢোকানো ছিল ক্যামেরার মধ্যেই। উনি সেদিন গল্পের ছবিগুলো
ল্যাপটপে কপি করে নিয়ে আবার কার্ডটা
ক্যামেরাতেই ঢুকিয়ে রেখেছিলেন। খুব কায়দা করে চোরের ওপর বাটপাড়ি করতে হয়েছিল সেদিন। মিঃ ঘোষ যখন আমাদের জন্য কোল্ড ড্রিঙ্কস আর মিষ্টি
আনতে সেই ঘর থেকে বেরিয়েছিলেন, ঠিক সেই সময় খুব সাবধানে কার্ডটা ক্যামেরা থেকে বের
করে নিয়েছিলাম। এমনকি তুইও বুঝতে পারিসনি। আর বাড়ি ফিরে কার্ডটা ল্যাপটপে লাগাতে
চোখের সামনে সব কিছু পরিষ্কার হয়ে গেল। দুয়ে দুয়ে চার মিলে গেল।"
অনিদা থামতে আমি হেসে বললাম, "বাঃ, দারুণ তো!"
"কী?" জিজ্ঞাসা করল অনিদা।
"এই যে, গল্প চুরির গল্প!"
"বার বার বলছিস কথাটা। এটাই নাম দিবি নিশ্চই এই মামলাটার?" হেসে
গাড়ির গতি বাড়াল অনিদা।
_____
ছবিঃ সুজাতা ব্যানার্জী
বাহ! সুন্দর প্লট।। The Idea.
ReplyDeleteদারুন লাগলো গল্প টা । বেশ ইনফরমেটিভ ও
ReplyDelete