কমিকস
সমগ্র – ১ ।। ময়ূখ চৌধুরী
লালমাটি
প্রকাশন ।। মুদ্রিত মূল্যঃ ৪০০ টাকা
পাঠ
প্রতিক্রিয়া ।। রাখী আঢ্য
ভদ্রলোক ঠিক
সময় সামনে এসে না দাঁড়ালে এ যাত্রা পৈতৃক প্রাণটা খুইয়েছিলাম আর কি! সেই কোন
ছোটোবেলায় পড়েছিলাম ‘অ-এ অজগর’। কিন্তু সত্যি সত্যি যে জীবটা এতটা বীভৎস হতে
পারে তা কল্পনারও বাইরে ছিল। সবে তার এক ভয়ানক পাকসাটে বিশাল দাঁতাল বাঘটার শেষ
আর্তনাদ পৃথিবীর বাতাসে মিলিয়ে গেছে কি যায়নি, উৎসাহভরে ঝোপের আড়াল থেকে মুখটা বাড়িয়েই
নিজের ভুলটা অনুভব করলাম। মুহূর্তের ব্যবধানে ঘুরে দাঁড়িয়ে এক ভয়াবহ মুখব্যাদান
করে ধীরে ধীরে পাকসাট খুলে আমার দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করল সর্পিল দানবটা। বেশ
বুঝতে পারছি এখনই পালাতে হবে। কিন্তু পা দুটো যে কে যেন মাটির সঙ্গে পেরেক দিয়ে
গেঁথে দিয়েছে। আর হয়তো কিছুক্ষণ... আর ঠিক তখনই ভদ্রলোক যেন আকাশ থেকে উদয় হলেন
আমাদের দু’জনের মাঝখানে। দুটো হাত শূন্যে একবার ঘোরালেন। আর কী এক অজানা ইঙ্গিতে
মনে হল যেন আমাদের আর অজগরের সামনের ব্যবধানটা ক্রমশ বাড়ছে... বাড়ছে...
“এখন একটু
ভালো লাগছে?” স্নেহ ভরা
গলায় প্রশ্ন করলেন ভদ্রলোক। ভদ্রলোকের মাঝারি উচ্চতা, শ্যামবর্ণ, রোগা কিন্তু
ব্যায়াম করা পাকানো চেহারা। হাতে একটা বিশাল বড়ো তুলি। মুখটা কোথায় যেন দেখেছি
দেখেছি, কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছি না।
“হ্যাঁ, বেশ
ঠিক লাগছে,” বোধহয়
কিছুটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। এতক্ষণে ক্লান্তিটা উবে গিয়ে শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগছে। একটা
অজানা উত্তেজনায় যেন পেয়ে বসেছে আমাকে।
“কিন্তু
আপনি কি জাদুকর?”
“না না, আমাকে বরং
জাগলার বলতে পারো। রং-তুলি,
আঁকা-রেখার জাগলার। আমার নাম শক্তিপ্রসাদ রায়চৌধুরী। আরে কথায় কথায় তো
তোমার নামটাও জানা হল না।”
“আমি অর্ক।”
“তা
অর্কবাবু, তুমি
হঠাৎ এখানে?”
“আসলে এবারে
পূজার ছুটিতে বাবার কাছে খুব আবদার করেছিলাম একটু নতুন কিছু দেখাতে হবে। একেবারে
অন্য জগৎ, অন্য
অভিজ্ঞতা। আর বাবা তো সেই মতো সব ব্যবস্থা করেও দিয়েছিলেন। কিন্তু এইভাবে যে
বিপদে পড়ব ভাবতে পারিনি। আপনি না এলে কিন্তু্...”
কথাটা শেষ
হবার আগেই ভদ্রলোক উঠে পড়লেন। একটু হেসে বললেন, “বেশ তো, বিপদ যখন
কেটেই গেছে তখন না হয় তোমায় আজ আমার জাগলিং-এর দুনিয়া থেকেই ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।
বলেই ভদ্রলোক আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই চোখের সামনে তার হাতের তুলিটা দিয়ে
বাতাসে একটা আঁচড় কাটলেন আর সঙ্গে সঙ্গেই যেন বদলাতে শুরু করল সামনের দৃশ্যপট। ধীরে
ধীরে সব মিলিয়ে গিয়ে কোথা থেকে যেন উদয় হল এক বিশাল খরস্রোতা নদী... ঠান্ডা
বাতাস... আর জলজঙ্গলময় এক উন্মুক্ত প্রকৃতি। ভদ্রলোক সামনের দিকে পা বাড়ালেন, আর
আমিও যেন মোহাচ্ছন্নের মতো এগিয়ে চললাম তার সঙ্গে।
“বুঝলে
অর্কবাবু,” ভদ্রলোক
বলতে শুরু করলেন, “এই
যে সামনে দেখছ সবুজ বনানী,
পাহাড়, এক সময়
বিশালাকার রোমশ গন্ডার,
দানবীয় ম্যামথ আর বাইসনের পদক্ষেপে ধূলিধূসরিত হয়েছে এই অঞ্চল। ভেবো না যেন
রূপকথার গল্প বলছি। কিছুকাল আগেও যা ছিল কল্পনা সেই কোমোডো ড্রাগন কিন্তু এখনও
পাওয়া যায়। ভদ্রলোকের বাচনভঙ্গিটা বড়ো অদ্ভুত। বড়ো জীবন্ত। উনি একটা একটা করে
বর্ণনা দিচ্ছেন, আর
দৃশ্যগুলো যেন ছায়াছবির মতো আমার সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
বলতে বলতেই
ভদ্রলোক হাতের তুলিটা সামনের দিকে তুলে ধরলেন। “ওই দেখ, ওই যে দূরে
দেখছ একদল বিশাল বাইসন আর তার পিছনে জেব্রার পাল। সবচেয়ে সামনে যে বাইসনটা দেখছ
ওর নাম হল মবোগো। আর জেব্রার দলটিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে পেককা। যূথবদ্ধ একটা
দলের দলপতির কতটা দায়িত্ববোধ থাকে, মমতাবোধ থাকে দলের প্রতি, তা ওদের
থেকে শিখতে হয়। জঙ্গল আর তার বাসিন্দাদের ভালোবাসলে জানতে পারবে এখানকার প্রাচীন
নিয়ম হল - জোর যার মুলুক তার। এখানে বীরত্ব আর মৃত্যু পাশাপাশি গা ঘেঁষে চলে।”
বড়ো বড়ো
ঘাসের বন আর জড়াজড়ি করে করে বেড়ে ওঠা বিশাল বিশাল প্রাচীন গাছের জঙ্গলকে পাশ
কাটিয়ে আমরা দু’জনে এগিয়ে চলেছি। একটা উঁচু টিলা। তার ওপর উঠতেই সামনে খোলা
উন্মুক্ত প্রান্তর চোখে পড়ল। আসলে অভ্যাস নেই তো, পা-টা কনকন করছিল। তাই টিলার উপর
একটু বসলাম দু’জনে। জঙ্গলের ঘনত্বটা এদিকে একটু কম। দূরে ধ্বংসস্তূপের মতো কিছু
একটা চোখে পড়ল।
“আচ্ছা ওটা
কী?” জিজ্ঞেস
করলাম আমি।
“ও হল
প্রাচীন ভারতের এক মহান প্রজাবৎসল রাজা মহারাজ রুদ্রদমনের রাজধানীর ধ্বংসাবশেষ।
মহারাজ মাঝেমাঝেই ছদ্মবেশে রাজ্য ত্যাগ করে নানা রোমাঞ্চকর অভিযানে বেরিয়ে পড়তেন।”
ওনার
কথাগুলো শুনতে শুনতে আমি মানসচক্ষে অনুভব করছি প্রাচীন ভারতের এক বিস্মৃতপ্রায়
অধ্যায়কে। দীর্ঘকায়,
প্রশস্ত বক্ষ মহারাজ সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। সূর্যের আলোতে ঝকঝক করছে তার খোলা
তলোয়ার। আর্য সভ্যতার একটা ছোট্ট নিদর্শন যেন আমার চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে
দাঁড়িয়ে রয়েছে, আর আমিও ক্রমশ ডুবে যাচ্ছি ইতিহাসের পাতায়।
“তুমি
রবিনহুডের নাম শুনেছ?
শেরউড বনের রবিনহুড?”
চমকে উঠলাম
ভদ্রলোকের প্রশ্নটা শুনে। এতক্ষণ কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম। “হ্যাঁ শুনেছি,” একটা
ইতিবাচক ঘাড় নাড়লাম আমি, আর তিনিও শোনালেন রবিনহুডের আরও কিছু অজানা কাহিনি।
“চলো, এবার এগোনো
যাক।”
ভদ্রলোকের
হাত ধরে আমি উঠে পড়লাম। উঁচু টিলাটাকে পিছনে ফেলে ধীরে ধীরে সামনের ধ্বংসস্তূপটা
পার করে আমরা এগিয়ে চললাম সামনে। ভদ্রলোকের অননুকরণীয় বাচনভঙ্গিতে বলে চলা
গল্পের স্রোত কিন্তু থেমে নেই। ইতিহাস হয়ে কল্পবিজ্ঞান, প্রাগৈতিহাসিক
থেকে ভবিষ্যৎ, অনায়াস
তার গল্পের বিচরণ। একদিকে বলে চলেছেন অসাধারণ কিছু কাহিনি আর মাঝে মাঝেই হাতে
তুলিটা নিয়ে সামনের অদৃশ্য ক্যানভাসে কী যেন আঁকিবুঁকি কাটছেন, আর আমার দৃশ্যপটে
থেকে থেকেই ফুটে উঠছে নানা স্বাদের রোমাঞ্চকর কিছু চিত্র কাহিনি। এ কাহিনিতে কখনও
রক্তাক্ত বাংলা তো কখনও ভয়ংকর আফ্রিকা। কখনও পরাজিত প্রাণীর অন্তিম জান্তব আর্তনাদ
তো কখনও জ্যোৎস্নার বুক চিরে রক্তাক্ত অসির ঝলকানি।
চলতে চলতেই
তার কাছ থেকে শুনে নিলাম বীর বাঙালি ভিখু সরদারের একটা মাত্র টাঙ্গি সম্বল করে
ভয়ঙ্কর বন্য কুকুরদের সঙ্গে লড়াই-এর গল্প। শুনলাম সাহসী ডাকাত চাঁদ সিং-এর কাহিনি, মারাঠা বীর
কাহ্নোজি আংগ্রের মোঘল বাহিনীর হাত থেকে দেশ মুক্তির অমর বীরগাথা, সুদূর
ব্রাজিলের বুকে ইতিহাস সৃষ্টি করা বীর বাঙালি কর্নেল সুরেশ বিশ্বাস আর তার পোষা
রয়েল বেঙ্গল টাইগার রঙ্গলাল-এর গল্প, আরও কত কী। আমাকে বললেন, “বুঝলে
অর্কবাবু, এই
যে তুমি গল্পগুলো শুনছ, এগুলো কিন্তু শুধু শোনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখো না। মনের
খাতায় এঁকে নিও এই সমস্ত বন্যপ্রাণী তথা তাদের ঘিরে থাকা মানুষজন এবং নানা
চরিত্রগুলির শারীরিক বৈশিষ্ট্য ও চলাফেরার ছন্দগুলোকে। ছায়াটাও যেন শরীরের সঙ্গে
মিলে যায় নিখুঁতভাবে।” সত্যিই দেশ বিদেশের এত বহু বিচিত্র কাহিনি, তার কতটুকুই
বা আমরা জানি? উনি
না বললে হয়তো জানতেই পারতাম না ইতিহাসের নানা ভয়ঙ্কর অস্ত্রের জন্মকথা বা ভয়াবহ
দ্বৈরথ যুদ্ধের কথা।
গল্প শুনতে
শুনতে খেয়ালই করিনি কোথা দিয়ে অনেকখানি সময় পার করে গেছে। ধীরে ধীরে লক্ষ করলাম
জঙ্গল ফিকে হয়ে আসছে। দু-একটা ইতি-উতি কুঁড়েঘর, কয়েকটা ছেলে খেলে বেড়াচ্ছে।
এতক্ষণে বোধহয় ক্লান্তিটা চেপে ধরল।
“আরে, ওই তো, এসে গেছি। সামনে
দেখতে পাচ্ছ ওই যে মস্ত বাড়িটা, ওটা প্রফেসর ত্রিলোকনাথ ত্রিবেদীর বাড়ি। ওখানেই আমরা
বিশ্রাম নেব চলো।”
বিশাল লোহার
গেটটা পার করে বাড়ির চৌহদ্দিতে ঢুকতেই আরও এক আশ্চর্য দুনিয়া। বাড়িটা একটু পুরোনো
হলেও বেশ ব্যবহারযোগ্য। একটা সরু রাস্তা গেট থেকে বাড়ির মূল দরজা পর্যন্ত চলে
গেছে। দু’পাশে জানা-অজানা নানা গাছপালা, কত অচেনা ফুল ফুটে রয়েছে। প্রফেসর আসলে
একজন উদ্ভিদবিজ্ঞানী, আর মানুষটাও বেশ অমায়িক আর মজাদার। খুব যত্ন করে আমাদের বৈঠকখানা
ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালেন। বাড়িটায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে শুনছিলাম প্রফেসরের নানা
অদ্ভুত কীর্তিকলাপ। উনি কী একটা আশ্চর্য গাছ আবিষ্কার করেছেন যার পাতা খেলেই উনি
নিজেকে প্রচন্ড শক্তিশালী অনুভব করেন।
“এই নিন
বাবু, এটা
খেয়ে নিন,”
একজন ভৃত্য গোছের মানুষ একটা রেকাবিতে শরবত এনে দিলেন। সত্যিই খুব তেষ্টা
পেয়েছিল। এক চুমুকে শরবতটা খেয়ে নিলাম। নাঃ, একটু বিশ্রামের খুব প্রয়োজন আছে। সোফায়
পিঠটা এলিয়ে দিতেই চোখ দুটো ক্লান্তিতে বুজে এল...
“অর্ক, এই অর্ক...
কী রে...”
বহু দূর
থেকে ক্ষীণকণ্ঠে কে যেন আমার নাম ধরে ডাকছে... আওয়াজটা আস্তে আস্তে বাড়ছে...
“এই অর্ক, কী রে? এই অবেলায়
পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিস... সেই কখন থেকে ডেকে যাচ্ছি। বিকেলেও খেলতে গেলি না।”
মায়ের ডাকে
সংবিৎ ফিরল। চোখটা খুলে ধড়মড় করে উঠে বসলাম। পাশেই চোখে পড়ল আধখোলা গল্পের বইটার
পাতাগুলো পতপত করে উড়ছে। ময়ূখ চৌধুরীর লেখা কমিকস সমগ্র - প্রথম খন্ড। আর খোলা
পাতার ওপর যে ভদ্রলোকের ছবি দেখতে পাচ্ছি তার মুখটা দেখে চমকে উঠলাম। আরে এনার সঙ্গেই
তো এতক্ষণ ঘুরছিলাম - শক্তি প্রসাদ মানে ময়ূখ চৌধুরী! তাই মুখটা খুব চেনা চেনা
লাগছিল। তাহলে কি এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলাম? আর স্বপ্নে এনার সঙ্গেই কি মানস
ভ্রমণ? স্বপ্নও
কি এতটা জীবন্ত হয়?
মাথাটা এবার আস্তে আস্তে পরিষ্কার হচ্ছে। সত্যি তো, কিছুদিন আগে
বাবার কাছে আবদার করেছিলাম যে এবারের ছুটিটা যেন আমার অন্যভাবে কাটে। তাই বাবা গতকাল
কলেজ স্ট্রিট থেকে এই বইটা এনে দিয়েছিল। আর আজ দুপুর বেলায় এটা পড়তে পড়তেই...।
মায়ের মুখের দিকে কিছুক্ষণ বোকার মতো তাকিয়ে বইটা আবার হাতে তুলে নিলাম। প্রথমে
সূচিপত্র, তারপর
পাতাগুলো আস্তে আস্তে ওলটাতে লাগলাম। অজগর, জেব্রা, বনবাসী
বন্ধু, তলোয়ার, নন্টে ফন্টে, রতনলাল
প্রফেসর... এই তো এদের সঙ্গেই তো এতক্ষণ সময় কাটল। যেমন সুন্দর ছাপার হরফ তেমনি
বলিষ্ঠ তুলির টান। শুধু রঙিন অলংকরণগুলোই নয়, সাদা-কালো কমিকসগুলোও বড়ো বেশি
মনকাড়া। মনের গভীর থেকে উঠে আসা সময়কথন - ছবিতে ছবিতে। সঙ্গে উপরি পাওনা
ভূমিকাচ্ছলে লেখক সম্পর্কিত নানা অজানা তথ্য তথা চরিত্র-চিত্রণের ইতিহাস। বইটার
প্রতিটা বিভাগই অত্যন্ত যত্ন সহকারে গ্রন্থিত করা হয়েছে।
“হ্যাঁ মা, বইটা আর
একটু পড়ে উঠছি। খুব খিদে পেয়ে গেছে। তুমি বরং কিছু খেতে দাও।” আবার ডুবে
গেলাম বইটার ভেতর। বাবা বলেছিল, পড়া হয়ে গেলে বইটা একবার দিতে। বাবাও নাকি বইটা পড়ে
দেখবে। পড়াচ্ছি তোমাকে দাঁড়াও। আগে তো এর বাকি দুটো খন্ড ম্যানেজ করি। মাথার মধ্যে
বদবুদ্ধিটা চাগাড় দিয়ে উঠল। এবারের পূজার ছুটিটা সত্যিই দারুণ কাটবে।
_____
দুর্দান্ত রিভিউ দিদি... ফাটাফাটি হয়েছে... প্রথমে তো আমি বুঝতেই পারিনি যে এটা রিভিউ না কোন লেখা,অসাধারণ লাগলো। Awesome হয়েছে...
ReplyDelete