ভুট্টা
দীপাঞ্জনা দাস
ভুট্টা
দীপাঞ্জনা দাস
মনখারাপ করে বিলের ধারে
বসে ছিল পিকু। অঙ্কের ক্লাস টেস্টে চার পেয়েছে সে পঞ্চাশে। অঙ্কের স্যার ব্রজনন্দবাবু
খাতার উপর বড়ো বড়ো করে লিখে দিয়েছেন, ‘বাঁদর’।
এ পর্যন্তও ঠিক ছিল। কিন্তু যখন তিনি পিকুর
কানটাকে রেডিওর নবের মতো ঘুরিয়ে দিয়ে বললেন খাতা
বাবাকে দিয়ে সই করিয়ে আনতে, তখন আর তার দুঃখের সীমা রইল না। তাই স্কুল ছুটির পর সে
চলে এসেছে এই কলমি বিলের ধারে। এখানে সে
আগে কখনও আসেনি। মানে আসতে দেওয়া
হয়নি। কাউকেই দেওয়া হয় না। লোকে বলে এই বিলের ধারে
নাকি পেতনি থাকে। তা থাকুক। পিকুর
এখন একটা নিরিবিলি জায়গা প্রয়োজন।
পিকুদের গ্রামটা ছোটো।
লোকজন বড়ো একটা কম নেই। তাই
শান্তিমতো ফাঁকায় দু’দণ্ড বসা মুশকিল। বসার সম্ভাব্য সকল জায়গাই এলাকার
বয়স্কদের হুকোঁ-কলকের আসর হয়, আর না হয় অমুক কাকিমা তমুক জেঠিমার
সংসারচর্চার স্থান হয়ে ওঠে। তাই নিরুপায় পিকু পেতনির আস্তানায় এসে উপস্থিত হয়েছে।
জায়গাটা মোটেই ভূতুড়ে
নয়। বরং বেশ সুন্দর। বিলটায় অল্প কিছু কলমি লতা ভেসে রয়েছে। বাকি অংশে স্থির কালো জলের উপর দু-তিনটে জলফড়িং
নেচে বেড়াচ্ছে। সবুজ ঘাস হাঁটু ছুঁতে
চায়। বিলের ধারে বড়ো পাকুড়গাছটা নুয়ে পড়েছে
একদিকে। বিকেলের শান্ত শীতল বাতাসে তার পাতাগুলো দুলে দুলে উঠছে। ওর পাতার আড়াল থেকেই কী একটা পাখি ডাকছে চিরিক
চিরিক করে, দেখা যাচ্ছে না।
এসব দেখতে দেখতেই হঠাৎ পিকুর
মনে পড়ল বাবার রাগী মুখখানা। মনে হতেই তার
কানটা আবার টনটন করে উঠল। কানে হাত দিল পিকু। উহ্! কষে মলে দিয়েছে। এখনও গরম
ঠেকছে। তার মন আবার উদাস হয়ে যায়। বাড়ি ফিরলে রাম ঠ্যাঙানি আছে কপালে! দীর্ঘশ্বাস
ফেলে পিকু।
“ধুর! চলেই যাব।”
“কোথায় যাবে?” হঠাৎ কে যেন বলে ওঠে পাশ
থেকে।
কে? কে কথা বলল? বিলের পেতনি? পেতনিরা কথা বলে? সে চমকে উঠে এদিক
ওদিক তাকিয়ে প্রশ্ন করল, “অ্যাই কে রে?”
হঠাৎ পাকুড়গাছের পিছন
থেকে একটা নেড়া মাথা ছেলে হাসি হাসি মুখ নিয়ে টুক করে বেরিয়ে এল। বলল, “এই যে,
আমি।”
ছেলেটাকে কেমন যেন
অদ্ভুত লাগল পিকুর। গোল মুখ, মাথায় একটাও চুল নেই, বয়স্কদের মতো চকচকে টাক। গোল গোল চোখ,
চ্যাপটা নাক আর পাতলা ঠোঁটে
হাসির ঝিলিক দিচ্ছে। গায়ের রঙ ধবধবে ফরসা।
সাহেব নাকি? না, দিব্যি পরিষ্কার বাংলায় কথা বলছে যে।
সাহেব হবে কী করে? ছেলেটাকে আগে কখনও এ তল্লাটে দেখেনি সে। পিকু প্রশ্ন করল, “তুমি
কে?”
ছেলেটা একটু ভেবে নিয়ে বলল,
“আমার নাম? উম্... ভুট্টা।”
“ভুট্টা? এ আবার কেমন নাম?
ভুট্টা কারও নাম হয় নাকি?”
“কেন হবে না? নাড়ু যদি
নাম হয়, পটল যদি নাম হয়, তবে ভুট্টা কী দোষ করল?”
পিকু ভেবে দেখল, কথাটা সত্যি। নাড়ুও খাবার
জিনিস, পটলও খাওয়া হয়, আবার ভুট্টাও খাবার জিনিস এবং বেশ ভালো খেতে। সুতরাং ভুট্টা
নাম হতেই পারে। ক্ষতি নেই। ছেলেটা আরও
কাছে এগিয়ে এল। পিকু বলল, “তুমি কোথায় থাকো? আগে তো কোনওদিন দেখিনি তোমায়।”
“দেখবে কী করে? আজই তো
প্রথম এলুম এখানে। ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। এমন সময় দেখি তুমি বসে আছ। তাই কথা কইতে
এলুম।”
পিকু একটা ঢিপির মতো জায়গায় একটা পাথরের উপর বসে
ছিল। ছেলেটা ঢিপির নিচে দাড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। পিকু তাকে হাতের ইশারায় তার
পাশে বসতে বলল। সে খুশি হয়ে এগিয়ে এসে স্প্রিংয়ের মতো লাফিয়ে বসে পড়ল তার পাশে।
“বাপ রে! এক লাফে এতটা উঠে পড়লে?”
“এখানকার গ্র্যাভিটি
আমার উপর খুব একটা কাজ করে না।”
“মানে? কী কাজ করে না?”
“ও তুমি বুঝবে না। যাক সে কথা, কোথায় একটা
যাবার কথা বলছিলে তখন?”
“কোথাও যাবার কথা বলিনি তো। তবে চলে যেতে ইচ্ছে
করছে।”
“কোথায় যাবে সেটাই তো
জানতে চাইছি।”
“দূরে কোথাও। অনেক দূরে।
এস্কিমোদের কাছে চলে যাব। বরফের
বাড়ি বানিয়ে থাকব আর মাছ ভাজা খাব।”
“আইডিয়াটা মন্দ নয়। তবে
ওখানে শীতে বড়ো কষ্ট।”
“হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। আমার কাছে অত
সোয়েটার নেই। আর সোয়েটার আনতে গেলেও তো বাড়ি যেতে হবে।”
“তো যাচ্ছ না কেন?”
পিকু জোর গলায় বলে উঠল, “না! আমি বাড়ি
যাব না।”
“আমিও যাব না।”
পিকু অবাক হয়ে তাকায় ভুট্টার দিকে। “কেন? তুমিও বাড়ি থেকে চলে
এসেছ?”
“হ্যাঁ। রাগ হয়েছে।”
এ যে তারই মতো! যাক, একটা বন্ধু পেলে মন্দ
হয় না। তার মনের কৌতূহলটা সে আর চেপে রাখতে পারল না। জিজ্ঞেস করল, “তোমার মাথায়
চুল নেই কেন?”
ভুট্টা মাথায় হাত
বোলাতে বোলাতে বলল, “সে অনেক দুঃখের কথা। শুনবে?”
“হ্যাঁ শুনব। আমারও আজ
অনেক দুঃখ হচ্ছে।”
“বেশ, তবে বলি শোনো।
সেবারও আমি বাড়ি থেকে রাগ করে চলে এসেছিলুম। এদেশে নয়, অন্য দেশে। এসে উপস্থিত
হলাম এক বৈজ্ঞানিকের বাড়িতে। তিনি বাড়ি ছিলেন না। আমি গিয়ে ঢুকলাম তাঁর ল্যাবরেটরিতে। চারদিকে ঘুরে
ঘুরে বিভিন্নরকম যন্ত্রপাতি আর রংবেরঙের তরল ভরা কাচের শিশি দেখছি, এমন সময় চোখে পড়ল একটা বড়ো জারে খয়েরি মতো কী যেন আছে। দেখে খুব লোভ হল। ঢাকনা খুলে
চোঁ চোঁ করে অর্ধেক মেরে দিলুম। তারপরই আমার সব চুল ঝরঝর করে পড়ে গেল।”
ভুট্টা ঠোঁট উলটে তার টাকে হাত বোলাতে লাগল আবার।
পিকু জিজ্ঞেস করল, “কেন? কী ছিল ওতে?”
“ওতে কী একটা অ্যাসিড
ছিল। আমি ভেবেছিলুম ভেলি গুড়।” বলে ভুট্টা দাঁত বের করে হাসতে লাগল।
আচ্ছা বোকা তো ছেলেটা!
ভেলি গুড় ভেবে অ্যাসিড খেয়ে নিল? পিকু আবার বলল, “অ্যাসিড খেলে তুমি বেঁচে আছ কেমন
করে?”
“আমরা অত সহজে মরি না।
অ্যাসিড খেলে আমাদের এমন কিছু ক্ষতি হয় না।”
“বাব্বা! তুমি কোথাকার
লোক হে?”
“সে তুমি চিনবে না।
আচ্ছা, তোমার কীসের দুঃখ বলছিলে?”
পিকু একটুক্ষণ চুপ করে
অঙ্ক খাতাটা বের করে ভুট্টার হাতে দিল। ভুট্টা দেখে বলল, “তোমায় বাঁদর বলেছে? না,
এ ভারি অন্যায় কথা। এক প্রাণীকে অন্য প্রাণীর নামে ডাকা যায় না। তুমি মনখারাপ কোরো না। তোমায়
বাঁদর বললেই তো তুমি সত্যি বাঁদর হয়ে যাচ্ছ না। ওই যে দেখছ দূরে মাঠে গরুটা
ঘাস খাচ্ছে, ওটাকে যদি আমি ডায়নোসর বলি, গরুটা কি ডায়নোসর হয়ে যাবে? যাবে না।
তেমনি তুমিও বাঁদর হলে না।”
পিকু মনে একটু জোর পায়।
কিন্তু আবার মনে একটা কথা আসে। বলে, “কিন্তু
নম্বরটা? আমি তো সত্যিই চার পেয়েছি। এটা বাবা দেখলে আর রক্ষে নেই। কানদুটো বোধহয় আর থাকবেই না।”
“তা বটে। তবে এ যদি
আমাদের দেশ হত, তাহলে কিন্তু তোমার ভয় ছিল না। বরঞ্চ তুমি তারিফ পেতে।”
“সে কেমন? অঙ্কে চার
পেলে কেউ তারিফ করে?”
“হুম, আমাদের দেশে করে।
ওখানে হিসেব সবই উলটো এখানের থেকে। কম নম্বর
পেলেই সেটা লোকে ভালো বলে। বেশি নম্বর পেলেই লোকে
নিন্দে করে। আমিই তো কতবার বেশি নম্বর পাওয়ার জন্য পিটুনি খেয়েছি।”
পিকু অবাক হয়ে তাকিয়ে
থাকে। এ কোন দেশ রে বাবা?
“তোমার দেশটা কোথায় বলো তো।”
“সেটা ঠিক বোঝানো যাবে
না। অনেক দূরে, আবার খুব কাছে। মানে
দুটো একসঙ্গেই চলছে, কিন্তু উলটো দিকে। সমান্তরালভাবে।
মাঝখানের দূরত্বটা টপকে আসাই ঝকমারি।”
পিকু মাথা চুলকে বলল,
“নাহ্, কিচ্ছু বুঝতে পারছি
না।”
“যাক গে, বুঝে কাজ নেই। ওসব অনেক
জটিল ব্যাপার।”
“আচ্ছা তোমায় কী বলে
ডাকব?”
ভুট্টা খানিক ভেবে বলল,
“সেটাও একটা সমস্যা। আমাদের হিসেবে দেখলে তোমার থেকে আমি মাত্র তিন বছরের বড়ো। কিন্তু তোমাদের হিসেবে দেখতে
গেলে আমি
তোমার চেয়ে আটচল্লিশ বছরের বড়ো।”
বলে কী ছেলেটা? খ্যাপা নাকি? এই ছোটো ছেলেটা তার থেকে আটচল্লিশ
বছরের বড়ো? হতে পারে ওর মাথায়
দাদুদের মতো টাক, কথাও বলে বড়োদের
মতো, তবুও এত বয়স হওয়া অসম্ভব। পিকু
বলে, “ধুর! কী যে বলো
কিছুই বুঝি না।”
“বোঝানোটা একটু কঠিন
বটে, তবে এখন না বললেও হবে না।”
“কেন?”
“কারণ, যদি আমি তোমার একটু বড়ো হবার জন্য অপেক্ষা করি, তবে
ততদিনে আমি সব ভুলে যাব। ছোটো হয়ে
যাব কিনা।”
পিকু হাঁ করে তাকিয়ে
থাকে। ছেলেটার মাথায় নির্ঘাত ছিট আছে। ছোটো হয়ে যাবে? এ কেমন কথা? কেউ কখনও ছোটো হয়ে যায়?
ছেলেটা নিজেই বলল আবার,
“কী, বুঝলে না তো? দাঁড়াও, বুঝিয়ে বলি তোমায়।” এই বলে
ভুট্টা গুছিয়ে বসল আর দুলে দুলে বলতে শুরু করল। “আগেই বলেছি আমাদের ওখানে
সবকিছুই এখানকার থেকে উলটো। ওখানে সবার জন্ম হয় একেবারে বড়ো অবস্থায়। মানে কেউ
জন্মায় ষাট বছর বয়সে, কারও
আশি, আবার কেউ বেশ ছোটো হয়ে
জন্মায়, মানে পাঁচ,
দশ, পনেরো, সতেরো এইরকম।
“জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গেই বোঝা যায় সে কতদিন বাঁচবে।
সেভাবে বয়স ছোটে উলটোদিকে। অর্থাৎ যেমন ধরো আমি। আমার জন্ম হয়েছিল
ষাট বছর
বয়সে। কিন্তু তারপর আর একষট্টি বাষট্টি হয়নি। ঊনষাট আটান্ন করে পিছিয়ে গেছে। মানে বয়স কমেছে। বয়স কমার সঙ্গে সঙ্গে দেহের আকার আয়তনটাও ক্রমশ ছোটো হয়ে গেছে। পাকা চুল কালো হয়ে
গেছে, ফোকলা মাড়িতে দাঁত গজিয়েছে, এইসব আর কী।
“আবার, এখানে যেমন মানুষ
পরিচয়হীন হয়ে জন্মায়, ওখানে কিন্তু তা নয়। মানুষ জন্মায় নাম নিয়ে, পরিচয় এবং পেশা
নিয়ে। আস্তে আস্তে বয়স কমার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো লোপ পেতে থাকে।
একেবারে ছোটো বয়সে তার আর নাম থাকে
না। ঠিক সেইরকমভাবেই যখন সে জন্মায়, আগে থেকেই তার মাথায় অনেক জ্ঞান-ট্যান থাকে, তারপর কমতি বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো সে ভুলতে থাকে। এখানে
যেমন মানুষ বড়ো হবার সঙ্গে সঙ্গে শিখতে থাকে।
“এখানে প্রতিযোগিতা কে কত
শিখতে পারে, জানতে পারে। ওখানে তেমনি কে কত ভুলতে পারে। তাই তখন বলছিলুম, আমাদের দেশে তোমার মতো অঙ্কে
কেউ চার পেলে তাকে মেধাবী বলে গণ্য করা হত।”
পিকুর বিস্ময়ের শেষ
নেই। ছেলেটা কি সত্যি কথা বলছে? না বানিয়ে?
“আচ্ছা, ওখানে বুড়ো হয়ে
গেলে, সরি, বাচ্চা হয়ে গেলে শেষে কী হয়?
মরে যায়?”
“নাহ্, ওখানে মৃত্যু হয় না কারও। ওখানে জন্ম হয় মৃত
মানুষের। আর পরের জন্মের জন্য প্রস্তুত হয়।”
পিকু একটু ইতস্তত করে বলল,
“ইয়ে, একটু সহজ করে বলো
না।”
ভুট্টা মিটমিট করে হেসে
তাকায় পিকুর দিকে। বলে, “সিক্রেটটা তোমায় বলেই দিই। তোমায় বলতে ক্ষতি দেখছি না।”
“কী সিক্রেট?”
“এখানে মানুষ মারা গেলে
তার সেই অবস্থাতে, সেই বয়সে, সেই বুদ্ধি নিয়ে, সেই পরিচয় নিয়েই জন্ম হয় আমাদের পৃথিবীতে।
তারপর সেখানে চলে তার ছোটো
হবার পালা। তাকে সবকিছু ভুলে যেতে
হয়। এক্কেবারে ছোটো হয়ে গেলে, মানে তার যত
আয়ু ছিল সেটা ফুরিয়ে গেলে তার আবার জন্ম হয় তোমাদের পৃথিবীতে। শিশু হিসেবে। আবার
সে বড়ো হয়, নতুন পরিচয় পায়,
নতুন অনেক কিছু শেখে, নতুনভাবে বাঁচে। তারপর মারা গেলে আবার চলে আসে আমাদের
পৃথিবীতে। এভাবেই চলতে থাকে।”
পিকু ভাবল, তাহলে তো সে
খারাপ নম্বর পায়নি। এই পৃথিবীতে না হোক, ভুট্টাদের পৃথিবীতে সেটা ভালো নিঃসন্দেহে। আর ভুট্টার কথা
যদি সত্যি হয়, তবে সেও তো একদিন ওখানেই ছিল। সেও সেখান থেকেই এসেছে। তবে সেদিক
থেকে দেখতে গেলে সে বেশ মেধাবী ছাত্র। মনখারাপের ভাবটা একেবারে কেটে যায় তার। নাহ্, কোথাও গিয়ে কাজ নেই। এখানেই
থাকবে সে।
“এবার বাড়ি যাও। সন্ধে হয়ে এল। মা চিন্তা করছেন
তোমার জন্য।” ভুট্টা তার কাঁধে হাত রাখে।
“আর তুমি?”
“আমিও ফিরে যাব আমার
পৃথিবীতে।”
ওরা দু’জনেই ঢিপি থেকে নেমে দাঁড়ায়।
হঠাৎ একটা প্রশ্ন আসে পিকুর মনে। বলে, “আচ্ছা, তোমার যখন জন্ম হয়েছিল, তখন কি
তোমার নাম ভুট্টা ছিল?”
“না, অন্য নাম ছিল,” হেসে উত্তর দেয় ভুট্টা।
“তবে কী নাম?”
“দর্পনারায়ণ চৌধুরী।”
“বাপ রে, কী কঠিন নাম! এর চেয়ে ভুট্টাই
ভালো।”
“হা, হা, হা। তার জন্যই ওটা বললুম। যাও এবার
বাড়ি যাও।”
“আচ্ছা, আসি।”
পিকু বাড়ির দিকে পা বাড়াল।
কয়েক পা হাঁটতে তার মনে হল, দর্পনারায়ণ চৌধুরী নামটা সে কোথায় যেন শুনেছে। বড্ড চেনা। সেকথা
বলতেই সে পিছন ঘুরল। কিন্তু কেউ নেই, একদম ফাঁকা। ভুট্টা চলে গেছে।
বাড়ি ফিরতেই মা তাকে
বলল, “এত দেরি করলি কেন? কোথায় গিয়েছিলি? নিশ্চয়ই মাঠে খেলতে গিয়েছিলি? তোকে নিয়ে আর পারি না। যা, হাতমুখ ধুয়ে আয়।”
সে ভিতরে গিয়ে দেখল
খাটের উপর একটা চিঠি। স্কুলের চিঠি। তার উপরে বাবার নাম লেখা। এই রে! তার অঙ্কে
চার পাওয়ার ঘটনাটা কি চিঠি লিখে জানাল বাবাকে? কী সর্বনাশ! তার কানটা আবার টনটন
করে ওঠে। আর নিস্তার নেই। তাও সে মাকে সাহস করে জিজ্ঞেস করে চিঠিটার কথা। মা বলল, “তোদের স্কুলের প্রাক্তন হেড
মাস্টারমশায়ের সোমবার মৃত্যুবার্ষিকী। তাই স্কুলে অনুষ্ঠান আছে। তোর বাবাকে যেতে
বলেছে।”
পিকুর বাবা এই গ্রামের
একমাত্র ডাক্তার। সৎ, ভালো মানুষ। সবাই খুব মান্যি করে।
স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁকে অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানান হয়। যাক! নিশ্চিন্ত।
পিকু চিঠিটা খুলল। উপরে বড়ো বড়ো করে
লেখা - ‘দর্পনারায়ণ চৌধুরী স্মৃতি
পুরষ্কার বিতরণী’।
পিকুর ধাঁ করে মনে পড়ে
গেল। আরে! এজন্যই নামটা এত চেনা লাগছিল তার। দর্পনারায়ণ চৌধুরী তাদের স্কুলের
প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক। তাঁকে পিকু কখনও চোখে দেখেনি। কারণ, তার জন্মের অনেক আগেই তিনি
মারা গিয়েছেন। তবে প্রতিবছর তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে স্কুলে অনুষ্ঠান হয়। প্রত্যেক
ক্লাসের ফার্স্ট বয়দের পুরষ্কার দেওয়া হয়। এবছর তাঁর তেরোতম মৃত্যুবার্ষিকী। চিঠি থেকে
মুখ তুলল পিকু। ভুট্টার বলা একটা কথা মনে পড়ে গেল তাঁর — “আমাদের
হিসেবে দেখলে তোমার থেকে আমি মাত্র তিন বছরের বড়ো।”
তার থেকে তিন বছরের বড়ো মানে তেরো বছর। মানে তাদের স্কুলের
প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক দর্পনারায়ণ চৌধুরী ভুট্টা নাম নিয়ে এসে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে খোশগল্প করে গেলেন? তার মানে ভুট্টা, ইয়ে,
স্যার যা বলেছেন সব সত্যি? হেডমাস্টারমশায় কোনওদিন মিথ্যে বলতেই পারেন না।
স্কুলের লাইব্রেরিতে টাঙানো তাঁর ছবিটা মনে পড়ে পিকুর। গোল
মুখ, ফরসা রঙ, মাথায় টাক, চ্যাপটা
নাকের উপর বসানো মোটা কালো ফ্রেমের
চশমা, পাতলা ঠোঁটে হাসির ঝিলিক দিচ্ছে। পিকু শুনতে পায় তিনি যেন ছবির ভিতর থেকেই
বলছেন, “আমার নাম? উম্... ভুট্টা।”
_____
ছবিঃ সুজাতা ব্যানার্জী
No comments:
Post a Comment