ম্যাজিক ল্যাম্প:: অক্টোবর ২০২১

সপ্তম বর্ষ।। প্রথম সংখ্যা।। অক্টোবর ২০২১
শারদ সংখ্যা ১৪২৮
------------------

প্রচ্ছদঃ মৃণাল শীল
--------

সম্পাদকীয়:: শারদীয়া ২০২১


ম্যাজিক ল্যাম্পের প্রিয় বন্ধুরা,

ম্যাজিক ল্যাম্পের সম্পাদকীয় লিখতে বসা আমার খুব প্রিয় কাজ আর পুজোসংখ্যার সম্পাদকীয় তো খুব স্পেশাল তা তোমরা জানোই
দেখতে দেখতে পুজো চলেই এল এই দুটো বছর তোমার আমার খুব যে মনের মতো কেটেছে তা নয় অনেক কিছুই মনের মতো হয়নি অনেক বিপদ-আপদ ঝড় ঝাপটা গেছে আমাদের পরিবারের ওপর দিয়ে অনেক কিছুই অগোছালো হয়ে গেছে সময় এসেছে আবার নতুন ভাবে গোছানোর, নতুন ভাবে ভাবার অনেকগুলো দরজা বন্ধ হলে ঠিক একটা না একটা দরজা খুলে যায় তাই মনে আশার আলো জ্বালিয়ে রেখো বন্ধুরা একদিন আমরা সব বাধা-বিপত্তি, দুঃসময় কাটিয়ে উঠব ম্যাজিক ল্যাম্প সেই ভরসার আলোটুকু হয়ে থাকতে চায় তোমাদের সবার জীবনে এই পুজোয়, উৎসবের মরশুমে চারপাশের সবাইকে নিয়ে আনন্দ কোরো বন্ধুরা আর যারা কোনো কিছুর অভাবে উৎসবে যোগ দিতে পারছে না, নতুন জামা, জুতো কিনতে পারছে না তাদের সাহায্য কোরো মনকে সবসময় উদার কোরো অনুদার, সংকীর্ণ মনেই অসুরের বাস তাই জানবে
ম্যাজিক ল্যাম্প প্রতিবারের মতোই অনেক সুন্দর সুন্দর লেখার ডালি সাজিয়ে নিয়ে এসেছে তোমাদের জন্য কে নেই সেখানে তোমাদের প্রিয় বর্তমানের সব সাহিত্যিকরাই আছেন যাদের কলমের ম্যাজিক দেখবে তোমাদের বড়ো হয়েও মনে থাকবে সুজন দাশগুপ্ত, শিশির বিশ্বাস, অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য- মতো দিকপাল সাহিত্যিকরা তো রয়েছেনই, আরও আছেন অনন্যা দাস, ঋতা বসু, রাজা ভট্টাচার্য, ঈশানী রায়চৌধুরী, সঙ্গীতা দাশগুপ্ত রায় - তালিকা শুরু করলে আর শেষ হবার জো নেই মৌ দিদি তোমাদের জন্য আবার একটা সুন্দর রূপকথার গল্প বলে শুনিয়েছেন আমাদের গল্প রেল বিভাগে নতুন যারা লিখেছে তাঁরা তাক লাগিয়ে দিয়েছে জিনিকে তাঁদের কলমের ম্যাজিকে
ছড়ায়, ছবিতে, প্রবন্ধে, ভ্রমণ কাহিনিতে একেবারে জমজমাট ম্যাজিক ল্যাম্প
এই সংখ্যার অভিনব প্রচ্ছদখানি এঁকেছেন শিল্পী মৃণাল শীল এই সংখ্যাটি ঝকঝকে তকতকে করে সাজিয়ে গুছিয়ে তোমাদের সামনে এনেছেন শ্রী তাপস মৌলিক
ভালো থেকো বন্ধুরা
শারদ শুভেচ্ছা ভালোবাসা
ইতি,
জিনি
----------
ছবি - প্রত্যয়ভাস্বর জানা

গল্প:: মিস্টার পাই ও শিক্ষামন্ত্রী ঘনশ্যামবাবু - অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী


মিস্টার পাই ও শিক্ষামন্ত্রী ঘনশ্যামবাবু
অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী
 
১৫ সেপ্টেম্বর
কিছুদিন আগে থেকে ঠিক করেছি নিয়মিত ডায়েরি লিখব। বিশেষ করে দরকারি কথাগুলো লিখে রাখব। গত তিরিশ বছর ধরে যে অজস্র আবিষ্কার করে চলেছি, তা লিখে না রাখলে আমি নিজেই ভুলে যাব। একই সঙ্গে আমার ফাউন্টেন পেনগুলোরও সামান্য সদব্যবহার হবে।
কিছুদিন আগে অনিলিখাই আমার ফাউন্টেন পেনের সংগ্রহ দেখে প্রথম আমাকে এ আইডিয়াটা দিল। আমি তো আর সাহিত্যিক নই, যে ইচ্ছেমতো সাদা কাগজে একটা গল্প বা উপন্যাস লিখে ফেলব। মাঝে মধ্যে অবশ্য বেশ কিছু প্রবন্ধ লিখি, কখনও বাংলা কিশোর সাহিত্য নিয়ে, কখনও বা বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি নিয়েসারা ভারত ঘুরে দেখা দেবদেবীর মূর্তি নিয়ে এখন লিখছি। একই সঙ্গে গত কিছুদিন ধরে ডায়েরি লিখে দেখেছি, বেশ ভালো লাগছে। কালি, কলমের সঙ্গে মনের যোগাযোগ হয়তো অনেক গভীরে। লেখা অনেক বেশি অকপট হয়, নিজেকেও ভাবায়
এ ছাড়া অবশ্য আরেকটা কারণও আছে। তা হল লিও। লিও হল আমার তৈরি কৃত্রিম বুদ্ধিসম্পন্ন রোবট। ও যে রোবট তা দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই। এমন কী ওর গায়ে হাত দিলেও বোঝা যাবে না যে ও মানুষ নয়তোমরা নিশ্চয়ই ‘লিও-এর অদ্ভুত জগতে’ লিওর কথা আগেই শুনেছ। তা লিওকে আমি অনেক কিছু শেখালেও শুধু আমার হাতে লেখা বাংলা নোটস পড়তে শেখাইনি। এর পিছনে আমার হাতের লেখার মাহাত্ম্য অবশ্যই আছে। সেটা আমি ছাড়া কেউ পড়তে পারে না। আমার প্রতিবেশী অবিনাশবাবু তো ক্লাস সিক্স ফেল ছাত্রের হাতের লেখা বলে মন্তব্য করতেও ছাড়েননি।
যতই হোক, দিনের শেষে লিও একটা রোবটই। কিছু জিনিস থাকা ভালো যা রোবটের আয়ত্তের বাইরে চিরকাল থাকবে, যেমন আমার বিদঘুটে অপাঠ্য হাতের লেখাআমি অবশ্য ওকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি। তবুও
তবে এই ডায়েরি লেখার ব্যাপারে আমাকে আরও নিয়মিত হতে হবে। এখনও সে অভ্যেসটা গড়ে ওঠেনি।
পাঁচ সপ্তাহ আগে আমার বন্ধু প্রফেসার ফিলিপো পাচিনি একটা গুরুতর সমস্যার ব্যাপারে আমাকে ফ্রান্স থেকে ফোন করেছিল।
গ্লোবাল ওয়ারমিং-এর জন্য জলের উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ায় সমুদ্রে কোরাল রীফ বা প্রবাল প্রাচীর সাঙ্ঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রবাল প্রাচীর সমুদ্রের জলের তলায় কখনও অগভীর জলে, কখনও বা গভীর জলে গড়ে ওঠে। খুব বড়ো ঢেউ, বন্যা বা বড়ো ঝড়ের হাত থেকে উপকূলকে রক্ষা করতে ঢালের মতো কাজ করে। একই সঙ্গে বিভিন্ন ধরণের সামুদ্রিক প্রাণীর জন্য এই প্রবাল প্রাচীর শুধু খাদ্যের সন্ধানই নয়, বাসস্থানও।
এখন সামুদ্রিক ঝড়, প্লাবনের সম্ভাবনা যেমন একদিকে বাড়ছে আর অন্যদিকে কোরাল রীফ উধাও হয়ে যাচ্ছে। এর জন্য আগামী দিনে উপকূলবর্তী এলাকায় মানুষের পক্ষে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে। সমস্যাটা বিশ্বজুড়েই সাঙ্ঘাতিক আকার ধারণ করছে। এই ব্যাপারে আমার কাছে পরামর্শ চেয়েছিল প্রফেসার ফিলিপো পাচিনি আমি একটু সময় চেয়ে নিয়েছিলাম, তবে এ ব্যাপারে অবশ্যই সাহায্য করব এ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম।
আমি এ ধরনের সমস্যা এলে ‘Gedankenexperimente,’ বা ‘থট এক্সপেরিমেন্ট’-এ বিশ্বাস করি। ঠিক যেমন আইনস্টাইনও করতেন। বেশিরভাগ বড়ো আবিষ্কারের পিছনে থাকে গভীর পরীক্ষামূলক চিন্তাভাবনা বা থট এক্সপেরিমেন্ট’আমার ক্ষেত্রেও বেশিরভাগ আবিষ্কারে সেটাই সাহায্য করেএর দুটো উদাহরণ দিই
কী হবে যদি পৃথিবীর আকাশে একটার জায়গায় তিনটে চাঁদ থাকে বা যদি একটা সাইকেলের বেগ আলোর বেগের থেকেও বেশি হয়ে যায়, সে ক্ষেত্রে আমরা সেই সাইকেলকে কীভাবে দেখব।
এটা তো আর ল্যাবে বসে এক্সপেরিমেন্ট করে দেখা যায় না। কিন্তু কল্পনার সাহায্যে সেই বিষয়ের অনেক গভীরে গেলে একটা ধারণা করা যায়। সেটাই হলো ‘থট এক্সপেরিমেন্ট’।
এসব ক্ষেত্রে আগে ভাবতে হয়। ল্যাবের কাজ অনেক পরে। সেভাবেই এই আইডিয়াটা প্রথমে মাথায় এলযদি এরকম কিছু করতে হয়, তাহলে সেটা যেন সহজে তৈরি করা যায়, সেটা ভাবতে হবে। সমুদ্রের জলের নিচে তো আর কংক্রিটের প্রাচীর গড়া সম্ভব নয়। কিন্তু সমুদ্রের জলে যদি দুটো ইলেকট্রোডের মধ্যে বিদ্যুৎ পাঠানো হয়, সেক্ষেত্রে সমুদ্রের জল থেকে ক্যালসিয়াম কারবোনেট এবং ম্যাগনেশিয়াম হাইড্রক্সাইড আলাদা হয়ে চুনাপাথর তৈরি করবে, যা অনেকটাই সাধারণ কোরাল রীফের মতো হবে। এভাবে আমরা নিজেরাই কৃত্রিম প্রবাল প্রাচীর তৈরি করে নিতে পারব যা আমাদের ঝড়-জল, বন্যা - এসব থেকে রক্ষা করবে।
কথাটা মাথায় আসার সঙ্গে সঙ্গে এ ব্যাপারে ল্যাবের অ্যাকোয়ারিয়ামে সমুদ্রের জল এনে তার মধ্যে দিয়ে বিদ্যুৎপ্রবাহ চালিয়ে পরীক্ষা করে দেখলাম। আমার ধারণা একদম ঠিক। দু’দিন বাদে সামান্য চুনাপাথর-এর কণা পেলাম। কিন্তু এত আস্তে হলে চলবে না। এ ভাবে প্রবাল প্রাচীর তৈরি করতে হলে কয়েকশো বছর লেগে যাবে। অনেক তাড়াতাড়ি করতে হবে।
এখানেই আমার আসল পরীক্ষা শুরু হল। আমি সব সময় মনে করি একটা সফল ইকোসিস্টেমে যারা থাকে, তারা প্রত্যেকেই সে ইকোসিস্টেম তৈরি করতে সাহায্য করেযদিও বিজ্ঞান এখনও জানে না যে এই কোরাল রীফের পিছনে বিভিন্ন প্রাণীজগৎ বা মাইক্রোব–এর অবদান কী, কিন্তু আমার ধারণা নিশ্চয়ই কিছু আছে বিশেষ কিছু মাইক্রোব-এর সাহায্য নিয়ে যদি এই প্রসেসটাকে ত্বরান্বিত করা যায়, সেক্ষেত্রে কৃত্রিমভাবে প্রবাল প্রাচীর তৈরি করা যাবে।
সেটা নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট শুরু করলাম। আজ সকালে সে পরীক্ষায় প্রথম বিশেষ সাফল্য পেলাম সেই বিশেষ মাইক্রোবসগুলোর মধ্যে কিছু অজানা মাইক্রোব আছে সেগুলোর সহজ নাম দিলাম রাম, শ্যাম, যদু, মধু - এরকম জটিল বৈজ্ঞানিক নাম দিয়ে ওদের দুর্বোধ্য করে রাখার কোনো মানে নেই। আমার আবিষ্কার করা সব কিছুরই আমি তাই সহজ নাম দিই।
গণেশ আর লিও দু’জনে এসব এক্সপেরিমেন্টের সময় আমার সঙ্গেই থাকে। আজও ছিল। তবে কিছু সময় ইচ্ছে করে লিওকে সঙ্গে রাখিনি।
এখন একটা ফোন করব ফিলিপো পাচিনি–কে। ওকে জানাতে হবে এই পদ্ধতির ব্যাপারে। আমার ধারণা এটা নিয়ে বড়োভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা দরকার। সেক্ষেত্রে খুব সহজেই আমরা হাইব্রিড প্রবাল প্রাচীর তৈরি করতে পারব। এভাবে লক্ষ লক্ষ লোকের জীবন ও জীবিকা রক্ষা করা সম্ভব হবে। আমি মনে করি আমরা এখন এমন একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি যে গ্লোবাল ওয়ারমিং এড়াতে গেলে আমাদের সবার একজন আরেকজনকে সাহায্য করতে হবে। নিজের স্বার্থের কথা শুধু ভাবলে চলবে না।
এমনিতেও আমার নোবেল পুরস্কারের মতো পুরস্কারে কোনো লোভ নেই। প্রত্যেকটা আবিষ্কার করার পরে যে আনন্দ পাই, সেটাই সেরা পুরস্কার। লক্ষ লক্ষ লোকের প্রাণের থেকে বড়ো পুরস্কার কীই বা আছে!
 
১৭ সেপ্টেম্বর
ইতিমধ্যে আমার পরীক্ষা আরও সাফল্য পেয়েছে। অবাক হয়েছি দেখে যে আমার আবিষ্কৃত দুই মাইক্রোব ‘যদু’ আর ‘মধু’-কে জলে তড়িৎপ্রবাহের সাহায্যে আমার তৈরি ওই প্রবাল প্রাচীরে নিয়ে আসতে পারলে কী তাড়াতাড়ি সেই কৃত্রিম প্রবাল প্রাচীর তৈরি হয়ে যাচ্ছেযে জিনিস এমনিতে করতে এক বছর লাগত, সেটাই ওরা করে ফেলছে চুনাপাথরের উপরে কয়েক মিনিটের মধ্যে। আর সেই হাইব্রিড প্রবাল প্রাচীর বেশ শক্ত পোক্ত। ঢেউতে তেমন ক্ষতি করতে পারবে না।
তবে সেটা কতটা শক্ত ঠিকভাবে বোঝার জন্য আমার আরও অনেক বড়ো জায়গা লাগবে, যেখানে সমুদ্রের মতো কৃত্রিম ঢেউ তৈরি করা সম্ভব।
ফিলিপো পাচিনি কতটা খুশি হয়েছে, তা বলাই বাহুল্য। আমি বার বার বারণ করা সত্ত্বেও বিজ্ঞানী মহলে এই আবিষ্কারের পিছনে আমার অবদানের কথা জানিয়েছে। আমাকে ফ্রান্সে যেতে অনুরোধ করেছে। যাতায়াত, থাকা-খাওয়ার সব খরচ ওই দেবে। ও চায় এই আবিষ্কারের সঙ্গে আমার নামটাও যেন জুড়ে থাকেপাচিনি লোকটা ভালো। সবাই এরকম চায় না। এমন নাছোড়বান্দা যে শেষে আমি আমার নাম রাখার প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য হয়েছি।
ওর কাজ অবশ্য এখনও অনেক বাকিবড়ো স্কেলে এই পরীক্ষা করা দরকারতার জন্য বেশ কিছু জায়গা জুড়ে সমুদ্রে এই এক্সপেরিমেন্ট করতে হবে। দেখতে হবে এর অন্য কোনো সাইড এফেক্ট হচ্ছে কিনা। হয়তো দেখা গেল যে কোনো ধরনের মাছ এ জন্য উপকূলবর্তী এলাকা থেকে উধাও হয়ে গেলএরকম আরও অনেক কিছুই হতে পারে।
এ ব্যাপারে আরেকটা কথা মনে পড়ে গেল।
 
আগামীকাল আমাকে এখানে কল্যাণগড়ে কী একটা সরকারি পুরস্কার দেওয়া হবেশিক্ষামন্ত্রী আসবেন এখানে। তিনি নাকি নিজের হাতে আমাকে এই পুরস্কার তুলে দেবেন। কিছুদিন আগে আমার প্রতিবেশী অবিনাশবাবু এ ব্যাপারে বলতে এসেছিলেন। ওর আজকাল পার্টির লোকজনদের সঙ্গে ওঠাবসা। এতে নাকি ওর আজকাল কাজের ব্যাপারে অনেক সুবিধে হয়। এখানকার পার্টির লোককে সুপারিশ করেছেন আমার পুরস্কারের ব্যাপারে। আমার দেওয়া পাকা চুল তোলার মেশিনটা ওর খুব নাকি পছন্দ হয়েছে। সে সুপারিশ কাজ করেছে। আমি নাকি সে পুরস্কার পেতে চলেছি। বেশ দর্পের সঙ্গেই এসে বললেন কথাটা।
“বুঝলেন পাই, এসব আবোলতাবোল ছেলেভোলানো আবিষ্কারের মধ্যে একটাই কাজের কাজ করেছেন। আমার পাকা চুল তোলার মেশিনটা। কী দারুণ। মাথায় বসালে টুকটুক করে ঘুরে বেড়ায়, আর ঠিক দেখে শুনে আমার পাকা চুল তুলে দেয়। ভারী আরাম। এই একটা আবিষ্কার আপনার ভাগ্য বদলে দিতে চলেছে। শিক্ষামন্ত্রী ঘনশ্যাম বাবুর নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন। উনি নিজে হাতে আপনাকে এ পুরস্কার দেবেনপুরোটাই আমার সুপারিশে।”
আমি শুনে বেজায় খেপে গিয়েছিলাম। এসব মন্ত্রী, দলীয় নেতাদের হাত থেকে এভাবে পুরস্কার নিতে আমার একদমই ভালো লাগে নাতার উপরে সুপারিশ! এসব শুনলে মনে হয় বিজ্ঞানকে যেন অপমান করছি। সরাসরি ‘না’ বলে দিলাম। আমি কোনোভাবে এ পুরস্কার নেব না।
ভাবলাম উনি সেটা মেনে নিয়েছেন। তখনকার মতো চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু দু’দিন বাদে আবার কানা রনেনকে নিয়ে এলেন। বোমা তৈরির সময় ফেটে রনেন–এর এক চোখ কানা হয়ে গিয়েছিল।
সে লোকটাকে দেখে আমার এমন গা রিরি করছিল যে কী আর বলবলোকটার নানান ধরনের কুখ্যাতি আছে। আবার ‘না’ বলে দিলাম। কিন্তু তারপরে লোকটা আবার আরেকদিন এলবেশ বুঝতে পারছিলাম আমার নাম ওরা উপরমহলে বলে দিয়েছে ও পুরস্কার সেজন্য মঞ্জুর হয়ে গেছেএখন না গেলে মন্ত্রীর অপমান হবে ওরা বেশ অসুবিধেতে পড়বে
শেষে গণেশই আমাকে বোঝালগণেশ মানে আমার সহকারী গণেশ। বাড়ির বাইরের সব কাজ ওই দেখে। ওকে নাকি মাছওয়ালাও এ ব্যাপারে ভয় দেখিয়েছে। ভালো পারশে, চিংড়ি আর ইলিশ এলে, কোনোটাই আর দেবে না বলেছে। যাই হোক, ওর আর চিংড়ির কথা ভেবেই রাজি হয়ে গেলাম এ পুরস্কার নেওয়ায় ধরেই নিয়েছি এর জন্য কয়েক ঘণ্টা নষ্ট হবে।
আগামীকাল সে পুরস্কার নিতে যেতে হবে খানিকক্ষণ। ভেবেছি লিও-কে সঙ্গে নিয়ে যাব। আমার একবার দেখার ইচ্ছে ছিল লিও সবার সঙ্গে কীভাবে মেশে। কয়েকমাস হল ওকে তৈরি করেছি। কৃত্রিম বুদ্ধিসম্পন্ন লিওকে দেখে কেউ বলবে না যে ও রোবট।
তবে দেখার ব্যাপারটা ওর একমাত্র বৈশিষ্ট্য নয়। ও বুদ্ধিমত্তায় অনেক মানুষের থেকে অনেক এগিয়ে আছে। এখন ওর উপরে আমি নতুন কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছি। সেটা হল একবার দেখে, সামান্য কথা বলে মানুষকে চেনার ক্ষমতা। এটা শুনতে খুব সহজ মনে হলেও একজন কৃত্রিম বুদ্ধিসম্পন্ন রোবট-এর পক্ষে এটা সহজ কাজ নয়।
হাবেভাবে, চলাফেরায়, চেহারায়, কথাবার্তার মাধ্যমে একজন মানুষ কেমন, তা সহজে বোঝা যায়। সেই জাজমেন্ট বা বিচারবোধ একটা রোবটকে দেওয়া যায় কিনা সেটাই দেখছিলাম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। এর জন্য ওকে অবশ্য অনেক দাগী অপরাধী থেকে শিক্ষিত মানুষ - তাদের সবার ছবি, তাদের সম্পর্কে নানান তথ্য, নানান সিনেমা, ভিডিও ইত্যাদি দেখিয়েছি। বাকিটা অবশ্যই ওর মেশিন লার্নিং, অর্থাৎ সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে ক্রমাগত শেখার ক্ষমতাতবে এর জন্য আরও বেশি করে ওর বিভিন্ন ধরনের মানুষের সঙ্গে মেশা দরকার। সে সুযোগ পাইনি। ঠিক করেছি ওকেও তাই নিয়ে যাব কালকের অনুষ্ঠানে। একটা প্র্যাক্টিকাল টেস্ট হবে।
 
১৯ সেপ্টেম্বর
গতকাল নানান কাণ্ড যা হল, তারপর রাতে আর লেখার ইচ্ছে হয়নি।
গতকাল সেই মন্ত্রীর সভায় আমি ঠিক সময়মতোই গিয়েছিলাম। সঙ্গে লিও ছিল। যথারীতি ওকে কেউ রোবট বলে বুঝতে পারেনি। আমার আপ্তসহায়ক বলার পরে কোনো প্রশ্নের মুখেও পড়তে হয়নি।
আমি এসব মন্ত্রী–টন্ত্রীর খবর বিশেষ রাখি না। তার মানে এই নয় যে রাজনীতি বুঝি না। কিন্তু এদের মধ্যে সুযোগ সন্ধানী, অপরাধীদের সংখ্যা ইদানিং এত বেড়ে গেছে যে এদের সঙ্গে কথা বললেও নিজের অপরাধবোধ বেড়ে যায়। তাই বক্তৃতার সময় প্রথম সারিতে বসে একটা বাংলা গল্পের বই পড়ছিলাম।
যাই হোক, এই মন্ত্রী যে বেশ জাঁদরেল ও জনপ্রিয় সেটা মাঝে মধ্যে দীর্ঘ হাততালির বহর দেখে বেশ বুঝতে পারছিলাম। এখানে আগে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় যুদ্ধ বিমান-এর জন্য একটা হ্যাঙ্গার ছিল। সেই জায়গায় আর পাশের বুনো আমতলার পুরো মাঠ ভরে গিয়েছিল। বক্তৃতার শেষে আমার ডাক পড়ল পুরস্কার নেওয়ার জন্য।
আমার কী কী আবিষ্কার, সে সব ওরা আগেই জানতে চেয়েছিল। গণেশ আমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের লিস্ট একটা কাগজে লিখে দিয়েছিল। মন্ত্রী মশাই দেখি সেই লিস্টটা একবার দেখে, ছিঁড়ে পকেটে ফেলে দিয়ে বলে উঠলেন, “ধুর, ওসব আমার লাগে না। আমি সব জানি।”
বলে দৃপ্ত ভঙ্গিতে মাইকের সামনে গিয়ে বলতে শুরু করলেন, “কল্যানগড়ের গর্ব, আমাদের বাংলার গর্ব, কল্যানগড়ের সুসন্তান প্রখ্যাত বিজ্ঞানী মিস্টার পাই, আজ এখানে আছেন। ওঁর অজস্র আবিষ্কারের কথা তো আপনারা জানেনইএসব আবিষ্কার কোনোটাই আমাদের সরকারের সাহায্য ছাড়া হত না। আমাদের কাছ থেকে আবিষ্কারের জন্য অনুপ্রেরণা না পেলে উনি রাস্তায় রাস্তায় ভিখারির মতো ঘুরে বেড়াতেন। আজ সে সব আবিষ্কার ভারত পেরিয়ে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ বদলে দিতে চলেছে। পেনিসিলিন, মাইক্রোস্কোপ, স্টেথোস্কোপ, আয়নোস্কোপ...”
বলে মন্ত্রীমশাই যে কী কী বলতে শুরু করলেন - আমি এক পাশে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিলাম। বুঝতে পারছিলাম এই সমাজে শিক্ষাটাই অপরাধযাদের শিক্ষা থাকে না, তাদের লজ্জাই থাকে না।
কিন্তু অবাক হচ্ছিলাম ওঁর উচ্চারিত প্রত্যেকটা শব্দের সঙ্গে সঙ্গে সমবেত জনতা হাততালি দিয়ে উঠছিল। উনি উৎসাহিত হয়ে আরেকটা জিনিস-এর নাম বলে উঠছিলেন। শেষে টর্চ, ব্যাটারি হয়ে উনি ম্যালেরিয়া, পোলিও – এসবের আবিষ্কারকর্তা হিসেবে আমার নাম উল্লেখ করতে শুরু করলেন। তাতেও দেখি হাততালি আর থামে না।
যাই হোক, সে কথার ঝড় এক সময় থামল। উনি আমাকে পুরস্কৃত করার পরে ফিসফিস করে আমাকে বলে উঠলেন, “দেখলেন, কীরকম আপনাকে আমি ফেমাস করে দিলাম। আজ থেকে আপনি হলেন একজন হিরো।”
স্টেজের থেকে নেমে আমার পাশে ‘লিও’-কে দেখে ওঁর কী মনে হল কে জানে! বলে উঠলেন, “বাহ, এর তো বেশ ভালো পেটানো চেহারা। আমার দলে যোগ দিতে বলুন। কী নাম তোমার!”
বলে পাশে দাঁড়ানো স্থানীয় নেতা হাতকাটা বাবলুকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন, “কী ব্যাপার বাবলু, এসব ভালো ভালো ছেলেদের খবর রাখছ না।”
ইতিমধ্যে লিও নিজের নাম বলেছে। কিন্তু মন্ত্রীর বাড়িয়ে দেওয়া হাত করমর্দন না করে, তারপরে যা বলে উঠল তার জন্য আমি একেবারে প্রস্তুত ছিলাম না। সেটা অবশ্য ও আমাকেই জানাতে চেয়েছিলকিন্তু সে কথা মন্ত্রীমশাই-এর কান এড়ায়নি।
“লোকটা নির্লজ্জ, মিথ্যুক, চরিত্রহীন, অপদার্থ, কিছুই জানে না, কিন্তু সবজান্তা ভাব অতীতে অনেক অপরাধ করেছে। খুন করে থাকলেও অবাক হব না। একানব্বই শতাংশ সম্ভাবনা।”
মন্ত্রী ঘনশ্যামবাবুর চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেলমুহূর্তে দেখলাম ওঁর চোখ রাগে লাল হয়ে উঠেছে। লিও-র দিকে এক পা এগিয়ে বলে উঠলেন, “কী, কী বললে!”
বলেই লিওর গালে সপাটে চড়। শুধু একটা নয়, একের পর একদেখলাম লিও বেশ হাসিমুখে মন্ত্রীর চড় থাপ্পড় সহ্য করল। কিন্তু কোনো রকম ক্ষমা চাইল না। মন্ত্রীর সঙ্গে দুটো গুন্ডা মতো লোক ছিল, তারাও লিওকে চড়–থাপ্পড়-লাথি মারতে মারতে মাটিতে ফেলে দিল। আমি কোনোরকমে লিওকে আগলাতে গিয়ে নিজেও একটু মার খেলাম। ভাগ্য ভালো লিও উলটে ওদের মারেনি। সেক্ষেত্রে যে কী হত!
ফেরার পথে অবিনাশবাবু বললেন, “আপনার জন্য আজ আমার মান সম্মান সব জলাঞ্জলি দিতে হল। এখন সামনের জলা জায়গা পুকুর বুজিয়ে বাড়ির যে এক্সটেনশন করব ভাবছিলাম, তা আর হল না।” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ভদ্রলোক। ফের বলে উঠলেন, “বলেছি না, এসব রোবট চাকর রাখবেন না। তাকে আবার আদিখ্যেতা করে এখানে নিয়ে এসেছেন। এখন বুঝুন। আর ক’দিন এখানে থাকতে পারবেন দেখুন।”
আমি আর উত্তর দিইনি। একটাই সান্ত্বনা, লিও তাহলে মানুষ চিনতে শিখেছে। আমার পরীক্ষা ঠিক দিকেই এগোচ্ছে। একই সঙ্গে যে সংযম লিও দেখিয়েছে, তা অসাধারণ।
এটা হল প্রথম খারাপ খবর। দ্বিতীয় খারাপ খবরটা পেলাম বাড়ি ফিরে গণেশের কাছ থেকে। ল্যাবে তৈরি হওয়া কৃত্রিম প্রবাল প্রাচীর কৃত্রিমভাবে তৈরি করা জলস্রোতে ভেঙে গেছে। যতটা শক্ত ভেবেছিলাম, ততটা নয় তাহলে? দেখতে হবে কীভাবে এই প্রাচীর আরও মজবুত করা যায়।
গণেশের সঙ্গে এই ব্যাপারে যখন আলোচনা করছিলাম, দেখলাম লিও আমাদের পাশ দিয়ে চলে গেল আজকের এই ঘটনা ও কীভাবে নিয়েছে কে জানে!
 
২৬ সেপ্টেম্বর
এ ক’দিনে যা হল, তা কীভাবে লিখব জানি না। কতটা লেখা ঠিক, তাও জানি না। তবে একটাই ভরসা, একজন ছাড়া অন্য কেউ আমার হাতের লেখা পড়তে পারে না।
একটু গুছিয়ে লেখার চেষ্টা করি।
আমার পুরস্কার পাওয়ার ঘটনার তিন দিন পরে মন্ত্রীর বারাসাতের বাড়িতে ডাকাত পড়ে। সে ডাকাত সিকিউরিটি গার্ডদের মারধর করে অজ্ঞান করে ফেলে রেখে মন্ত্রীকে কিডন্যাপ করে। তার পর থেকে মন্ত্রী ঘনশ্যামবাবু উধাও। কোথাও কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। রাজ্য পুলিশ সব রকম চেষ্টা চালাচ্ছে ইতিমধ্যে সি আই ডি-ও কোমর বেঁধে তদন্তে নেমে পড়েছে। তবে কোনো কিছুর কূল কিনারা করতে পারেনি। কেউ বলছে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, কেউ বলছে বিরোধী দল এর জন্য দায়ী।
ডাকাতির ঘটনার দু’দিন পরে মন্ত্রী ঘনশ্যামবাবুর জিম থেকে একটা পাথরের মূর্তি পাওয়া যায়, যে মূর্তি বাড়ির লোক আগে কখনও দেখেনি। ঠিক মাদাম তুসোর মোমের মূর্তির মতোই ‘মন্ত্রী’-র অবিকল পাথরের মূর্তি। এত ভালো পাথরের মূর্তি কে কবে তৈরি করল তা বাড়ির লোকেরা বলতে পারছে না। কাগজে খবরটা ছোটো করে বেরিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে ওই মূর্তির শিল্পী ঘনশ্যামবাবুর হদিস জানে কিনাকিন্তু সেরকম কোনো তথ্য এখনও সামনে আসেনি।
খবরটা শুনে আমি বুঝেছি কী হয়েছে। একটু খোঁজ করলে দেখা যাবে ওই পাথর খুব সাধারণ পাথর নয়। ওই পাথর ঠিক দেখা যায় কোরাল রীফে। বা আমার তৈরি করা নকল কোরাল রীফে।
আমার ডায়েরির পাতায় যেখানে ওই কৃত্রিম প্রবাল প্রাচীর সম্বন্ধে সব ডিটেলস লিখে রেখেছিলাম, সেখানে দেখেছি ঠিক আমার হাতের লেখায় আরও দু’লাইন কে যেন লিখে রেখেছে। আমার প্রসেস ও উল্লেখিত মাইক্রোবদের সঙ্গে আরেক পরিচিত মাইক্রোবের নাম, যা কিনা ওই প্রবাল প্রাচীরকে মজবুত করে।
লিও তার মানে শুধু আমার হাতে লেখা পড়তে নয়, নকল করতেও শিখে গেছে। বাকিটা আর ডায়েরিতে লেখা ঠিক হবে না।
আমার কাছে ব্যাপারটা পরিষ্কার। মন্ত্রী ঘনশ্যামবাবুকে আর কোনো দিনই খুঁজে পাওয়া যাবে না।
তবে এর বাইরেও একটা ঘটনা ঘটেছে। লিও দেখেছি আমার পাওয়া ‘বাংলার আইনস্টাইন’ নামক পুরস্কারটা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছে। সেটা অবশ্য ও না করলে আমিই করতাম।
----------
ছবি - অতনু দেব

গল্প:: একটা ঘোড়ার গল্প - সুজন দাশগুপ্ত


একটা ঘোড়ার গল্প
সুজন দাশগুপ্ত

নিউ জার্সিতে বাঙালি বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে একমাত্র দেবজ্যোতিরই ঘোড়া ছিল। যখন ছিল, মানে নব্বই দশকের গোড়ায় - দেবজ্যোতিকে তখন আমি চিনতাম না। ওর কথা অবশ্য শুনেছিলাম অনেক। নামিদামি ব্রিটিশ কোম্পানির বড়ো এক্সিকিউটিভ - নিউইয়র্ক-লন্ডন করে বেড়ায়, বাঙালিদের সঙ্গে মেশে-টেশে না, নাক-উঁচু সায়েব-টাইপ, ইত্যাদি, ইত্যাদি।
বছর পনেরো আগে দেবজ্যোতির সঙ্গে যখন আমার পরিচয় হল, তখন ও অবসর নিয়েছে। নিউ জার্সিতে একটি নন-প্রফিট সংস্থার জন্য নানান কাজ করছে, মানে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াচ্ছে। দু-একদিন কথা বলেই বুঝলাম, ওর সম্পর্কে যা-যা শুনেছি সব ভুল। উন্নাসিক তো নয়ই, বাস্তবিকই একজন ভদ্রলোক। খুবই ফ্রেন্ডলি। কোনো বাদ-বিচার না করে লোকের বিপদে-আপদে এগিয়ে আসে, কাউকে ছোটো করে না, মন দিয়ে সবার কথা শোনে, আর দারুণ অর্গানাইজার। শেষেরটা তো হবেই - অত বড়ো এক্সিকিউটিভ তো এমনি এমনি ছিল না! চট করে দেবজ্যোতির স্ত্রী শিখার কথাও একটু বলে দিই। এমনিতে শিখা কথা-বার্তা কম বলে, কিন্তু যখন বলে বুঝতে অসুবিধা হয় না - সব কিছু ওর নখ-দর্পণে!

এইবার ঘোড়ার কথায় আসি। দেবজ্যোতির কন্যা ছোটোবেলা থেকেই ঘোড়ায় চড়তে ভালোবাসত। পিছনে কার অনুপ্রেরণা ছিল কে জানে, নিশ্চয় স্কুলের কোনো বন্ধুর। দেবজ্যোতি ব্যাপারটা জানতও না, অফিসের মিটিং নিয়েই এত ব্যস্ত থাকত! বাড়িটা পুরো সামলাত শিখা। শিখা ভালো করেই জানত মেয়ের এই শখের কথা। শুধু তাই নয়, মেয়েকে নিয়ে নিয়মিত হর্স ফার্মে গিয়ে গিয়ে শিখারও মনে হয় কিঞ্চিত ঘোড়া-প্রীতি গড়ে উঠছিল। নিউ জার্সিতে তখন বেশ কয়েকটা হর্স-ফার্মে ঘোড়ায় চড়া যেত। এখনও তাদের কয়েকটা আছে। আমাদের ছোট্ট শহর মন্টভিলেও এক সময়ে দু-দুটো হর্স-ফার্ম ছিল। সেখানে টাকা দিয়ে ঘোড়ায় চড়া যেত কিনা কোনোদিন খোঁজ নিইনি। ভাগ্যিস আমার মেয়ের সেই শখ ছিল না!

আসল গল্পের শুরু দেবজ্যোতির মেয়ে যেদিন ঘোষণা করল, এবার জন্মদিনে তার একটা ঘোড়া চাই! মেয়ের দশ বছরের জন্মদিন মাত্র কয়েকদিন বাদে। দেবজ্যোতি তো আকাশ থেকে পড়ল! ঘোড়া কেন? এর আগে মেয়ের ইচ্ছেয় একটা পাখি নিয়ে বিস্তর ভুগেছে। কোথাও বেড়াতে গেলে সেই হতচ্ছাড়া পাখিকে খাঁচায় নিয়ে ঘুরতে হত। কেন হত? বাড়িতে তাকে খাওয়াবে কে? সেই বজ্জাত পাখি আবার হোটেল-ঘরে নতুন জায়গায় ঘুমোতে চাইত না, কিচিরমিচির করে সবার ঘুম নষ্ট করত! এখন কি ঘোড়াকে নিয়েও ঘুরতে হবে?
অনেক বোঝানোর চেষ্টা করল মেয়েকে, মেয়ে অনড়। দেবজ্যোতি খেয়াল করল বউ শিখাও ওকে সাপোর্ট করছে না। মনে হচ্ছে সেও কেমন জানি মেয়ের দলে! আচ্ছা বিপদ!
শেষে হাল ছেড়ে মেয়েকে জিজ্ঞেস করল, “কী রকম ঘোড়া চাস? টাট্টু ঘোড়া?”
ওই একটা ঘোড়ার কথাই দেবজ্যোতি দেশে জানত, চেহারায় ছোটোখাটো, এদেশে বোধহয় পোনি বলে। কিনতে হলে ছোটোখাটো সাইজের কিছু কিনতে হবে, সামলানো যাবে।
মেয়ে জন্মেছে এদেশে, তার কোনো ধারনাই নেই বাবা কী বলছে!
না, না, আমি চাই কোয়ার্টার হর্স।”
কোয়ার্টার হর্স! সেটা আবার কী? ঘোড়া কি হাফ, কোয়ার্টার এভাবে বিক্রি হয়, মানে টাইম শেয়ার?”
আইডিয়াটা মন্দ নয় – উৎফুল্ল হল দেবজ্যোতি। নিশ্চয় ওটার অর্থ শেয়ারে ঘোড়া কেনা। চারজন মিলে একটা ঘোড়া কিনবে। গত বছরই একটা রিসর্ট এরিয়াতে দেবজ্যোতি আর শিখা একটা টাইম-শেয়ার অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছে। বছরে কয়েক সপ্তাহের জন্যে অ্যাপার্টমেন্টটা ওদের দখলে থাকবে। অন্য সময়ে অন্য মালিকদের। এটাও নিশ্চয় ওরকম একটা ডিল!
আঃ, বাবা! কোয়ার্টার হর্স কি জানো না? যে-ঘোড়া দারুণ কোয়ার্টার মাইল দৌড়োয়।”
কোয়ার্টার মাইল দৌড়োয় মানে? কোয়ার্টার মাইল দৌড়ে যদি হাঁপিয়ে যায়, তাহলে সেখান থেকে ফিরবে কী করে?”
শিখা এবার বুঝিয়ে দিল। অ্যামেরিকান কোয়ার্টার হর্স হল ঘোড়ার এক ধরনের জাত, যেগুলো এসেছে ব্রিটিশ থরোব্রেড আর নেটিভ অ্যামেরিকান চিক্‌-আ-স ঘোড়া থেকে। শিখা শেষ করল একটা প্রশ্ন দিয়ে, “তুমি এটা জানতে না?”
না, জানতাম না। আর এখনও বুঝতে পারছি না, ‘কোয়ার্টার’ কথাটা আসছে কেন?”
ওই যে মেয়ে বলল, এই জাতের ঘোড়াগুলো কোয়ার্টার মাইল রেসে জেতে।”
এটা দেবজ্যোতির কাছে একটা নতুন তথ্য।
এখন বুঝলাম। আসলে ঘোড়াদের জাত-ঠিকুজি জানার জন্য তো আমি আমি পড়াশুনো করিনি।”
বাবার অজ্ঞতা দেখে মেয়ে কিন্তু অবাক! “কী বলছ বাবা, তুমি সত্যিই ঘোড়াদের কথা জানো না? থরোব্রেড, মাস্টাং, পিন্টো - এগুলো শোনোনি?”
নিশ্চয় শুনেছি,” প্রতিবাদ করল দেবজ্যোতি। “শোন, ফোর্ড মোটর কোম্পানি যখন মাস্টাং, আর পিন্টো গাড়ি বাজারে ছাড়ল, তখন গাড়ির সামনে একটা ঘোড়ার সিম্বল থাকত। ডিকশনারি খুলে দেখেছিলাম, মাস্টাং হচ্ছে বুনো ঘোড়া, কাউবয়রা ওদের পোষ মানাত। আর পিন্টোর গায়ে সাদা রঙের ছোপ থাকে। কোয়ার্টার হর্স কি পিন্টো?”
তা কেন হবে? কোয়ার্টার হর্স, কোয়ার্টার হর্স
পিন্টোর ওই বহুরূপী রঙ দেবজ্যোতির পছন্দ নয়, সুতরাং কোয়ার্টার হর্স নিশ্চয় তার থেকে ভালো।
ঠিক আছে, ঠিক আছে, কেনা না হয় যাবে। কিন্তু কোত্থেকে?”
মা আর মেয়ে সেটা খোঁজ করে রেখেছিল। দেবজ্যোতির কাজ হল সেটাকে গিয়ে চাক্ষুষ দেখা এবং দরদাম করা। দরদাম বিশেষ করা গেল না, তবে ঘোড়ার সাইজ দেখে দেবজ্যোতির চিন্তা হল, বাড়িতে রাখবে কোথায়? গ্যারাজে তো রাখা যাবে না। অনেক রকম নিয়ম-কানুন আছে এদেশে। যার কাছ থেকে কিনছে, সে অনেকগুলো আস্তাবলের হদিশ দিল। তাদের একটা দেবজ্যোতিদের বাড়ি থেকে মাইল তিনেক দূরে - ইন্টারস্টেট হাইওয়ে টু-এইটি সেভেন-এর গা ঘেঁষে।
আস্তাবলটা একবার দেখা দরকার। দেখল বেশ বড়ো জায়গা। ঘোড়াদের রাখার জন্য পাশাপাশি অনেকগুলো ঘর বা খুপরি। পাশে ওদের এক্সারসাইজ করার একটু বন্দোবস্ত। খুবই ইমপ্রেসিভ। ভাড়া মাসে সাড়ে পাঁচশো! ওই সময়ে এই টাকার অঙ্ক মোটেই কম নয়। কিন্তু কী আর করা! টাকাটা খুব একটা সমস্যা নয়। মাইনে আর বোনাস-ফোনাস নিয়ে দেবজ্যোতির ভালোই রোজগার, আর মেয়ের ঘোড়া বলে কথা! তার থাকার জন্য জায়গা তো একটা নিতেই হবে। কিন্তু ঘোড়ার খাওয়াদাওয়া? জিজ্ঞেস করল আস্তাবলের ম্যানেজারকে।
সেটা ভাড়ার মধ্যে পড়ে না,” ম্যানেজার জানাল, “স্টল পরিষ্কার করা, খাওয়ানো, ঘোরানো, ইত্যাদি হচ্ছে এক্সট্রা।”
কবে থেকে ভাড়া পাওয়া যাবে?”
এখন থেকেই। ফিটনেস সার্টিফিকেট থাকলে ঘোড়াকে আজই নিয়ে আসতে পারেন।”
ফিটনেস সার্টিফিকেট!” আরেকটা নতুন জিনিস শুনল দেবজ্যোতি।
ব্যাপারটা কিছুই নয় একজন ভেট, মানে ঘোড়ার ডাক্তারকে দিয়ে ব্লাড টেস্ট, এক্স-রে ইত্যাদি করিয়ে ঘোড়া যে সুস্থ, তার একটা সার্টিফিকেট দিতে হবে। এটা আমাদের আস্তাবলের সুরক্ষার জন্য। নতুন ঘোড়া থেকে অন্যান্য ঘোড়াদের যেন কোনো রোগ না হয়।”
ঘোড়াটি যে আস্তাবলে ছিল সেখানকারই এক ভেট ঘোড়াটার নানান পরীক্ষা করলেন। একদিন বাদে ফিটনেস সার্টিফিকেট মিলল। এক্স-রে, ব্লাড টেস্ট, চিকিৎসকের ফি সব মিলে বিল হল সাড়ে পাঁচশো ডলার। আবার সেই সাড়ে পাঁচশো! কিন্তু ঘোড়া তার নতুন বাড়িতে যাবে কী করে? হাইওয়ে দিয়ে তো নিয়ে যাওয়া যায় না। বেশ কিছু টাকা খরচা করে একটা স্পেশাল গাড়ি ভাড়া করতে হল। এইসব নানান ঝামেলা চুকিয়ে ঘোড়াকে তার বাড়িতে ঢুকিয়ে দেবজ্যোতিকে আবার ছুটতে হল লন্ডনে – কোম্পানি বোর্ডের এমার্জেন্সি মিটিং।

মিটিং-এ কতগুলো খুব জরুরি ব্যাপারে অনেক ডিসিশন নিতে হবে। অনেক টাকাকড়ি জড়িত, পরিষ্কার মাথায় সিদ্ধান্তগুলো বোর্ড মেম্বারদের নিতে হবে। বোর্ড-রুমের মিটিং সব সময়ে ক্লোজড ডোর – হুট-হাট করে কেউ ঢুকতে পারে না। উত্তপ্ত আলোচনা চলছে, হঠাৎ বোর্ড-রুমের দরজা বাইরে থেকে কেউ খুলল - দেবজ্যোতির সেক্রেটারি! দারুণ উত্তেজিত, দেবজ্যোতির কাছে এসে কানে কানে বলল, “প্লিজ একটু বাইরে এসো।”
হতচকিত দেবজ্যোতি বাইরে এসে জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার?”
তোমার স্ত্রীকে এখুনি ফোন করো, এমার্জেন্সি!”
কী সর্বনাশ! শিখার কি কিছু হল? মেয়ের? আশি দশকের কথা, তখনও মোবাইল ফোন সে-ভাবে আসেনি, দেবজ্যোতি সেক্রেটারির অফিস থেকেই বাড়িতে ফোন করল।
কী হয়েছে শিখা?”
ঘোড়া পালিয়েছে!”
পালিয়েছে মানে? কী করে পালাল?”
শিখাও খুব বিপর্যস্ত। “আস্তাবল থেকে ফোন এসেছে, ওকে পাওয়া যাচ্ছে না। ওরা জানে না, কোথায় গেছে। এটুকুই আমাকে বলেছে।”
ননসেন্স! তার মানে কী? ওটা তো ওদের রেসপন্সিবিলিটি?”
ওরা বলছে, ওরা টাউনের সব রেগুলেশন মেনে বেড়া দিয়েছে। সেটা টপকালে তো ওদের কিছু করার নেই। আর এরকম আগে কখনও ঘটেনি।”
পুলিশে খবর দিয়েছে?”
বলছে কাল সকালে চব্বিশ ঘণ্টা পার হলে দেবে।”

এরপর মিটিং চলল, কিন্তু দেবজ্যোতি তাতে মনঃসংযোগ করতে পারল না। পরের দিন খুব সকালে লন্ডন থেকে প্লেন ধরে ফিরে আসবে নিউ জার্সিতে। রাতেই মাথায় এল আইডিয়াটা। হোটেল থেকে রাত ন-টায় ফোন করল শিখাকে। নিউ জার্সিতে তখন বিকেল চারটে।
একটা কাজ করো তো, ও হয়তো হাইওয়েতেই কোথাও আছে, তুমি আমাদের হুড-খোলা গাড়িটা নিয়ে আস্তাবলের আশেপাশে মাইল চারেক রেডিয়াসে চক্কর দিতে থাকো, কাছাকাছি পেয়ে যেতে পারো মনে হয়।”
কী বলছ যা-তা, মাথা ঠিক আছে তোমার? আমি কি এই বিকেল চারটেতে হাতে ল্যাসো নিয়ে মার্সিডিজ চড়ে ঘুরব? তুমি আগে এসো, তারপর দেখ কী করা যায়!”

রাতে আর ঘুম হল না দেবজ্যোতির। দুঃস্বপ্ন আর দুঃস্বপ্ন! সকালে নিউ জার্সি পৌঁছে, এয়ারপোর্ট থেকে ফোন করল আস্তাবলে। না, কোনো খবর পাওয়া যায়নি ঘোড়ার। তবে ম্যানেজারের বক্তব্য, ঘোড়ারা খুব বুদ্ধিমান, রাস্তা চিনে ফিরে আসতে পারে। আর পালিয়েছে যখন, তখন ও যথেষ্ট করিৎকর্মা। পুরোনো আস্তাবলে যখন যায়নি, তখন এখানেই ফিরে আসবে – অবশ্য রাস্তায় গাড়িটাড়ির ধাক্কা না খেলে। পুলিশে ডায়রি করা হয়েছে। কোথাও কেউ ঘোড়া দেখতে পেলেই ওরা জানতে পারবে।
দেবজ্যোতি বুঝল, এগুলো সব কথার কথা। দামি ঘোড়া - ওকে কি আর ফেরত পাওয়া যাবে!

*                   *                  *

একদিন, দু-দিন তিনদিন চলে গেল কোনো খবর নেই, চতুর্থ দিন আস্তাবলের ম্যানেজার ফোন করে বলল, সাত মাইল দূরে একটা আপেল বাগানে ওকে পাওয়া গেছে। সেখানে একটা মেয়ার বা ঘোটকী থাকে, তার সঙ্গে দিব্যি মেজাজে সময় কাটাচ্ছে! নিশ্চয় আগে ওই ঘোটকীকে ও চিনত, ম্যানেজার যোগ করল। “এই খবরটা আগে জানা থাকলে এতটা চিন্তিত হতাম না।”
এটা সুখবর, কিন্তু ঘোটকীর কাছে যেতে দীর্ঘপথ কাঁটা তারের বেড়া ইত্যাদি পার হতে গিয়ে ওর চার পায়ের নানান জায়গা কেটে-ছড়ে ক্ষতবিক্ষত! ডাক্তারকে দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে নতুন ফিটনেস সার্টিফিকেট নিতে হবে। সেটা পাবার পর আস্তাবলে আবার ঢোকানো যাবে।
কত টাকা লাগবে তার জন্য? সাড়ে পাঁচশো ডলার। তার পরেও ভোগান্তি, কারণ পায়ের ক্ষতগুলো দিনে কয়েকবার পরিষ্কার করে লোশন লাগাতে হবে। ঘোড়া শুধু শিখাকেই পছন্দ করে, কাজটা তাকেই করতে হবে। অচেনা কেউ করতে গেলে লাথি খাবার সম্ভাবনা! ডাক্তারের আরও একটা বিধান। ঘোড়াকে বিশ্রাম নিতে হবে তিন মাস – মা বা মেয়ে কেউই ঘোড়ায় চাপতে পারবে না।

গল্প শেষ হবার পর দেবজ্যোতিকে জিজ্ঞেস করলাম, কতদিন এই সাদা হাতি, মানে ঘোড়া পুষলে?”
দু-বছর। ওই দু-বছর কিন্তু মা ও মেয়ে মনের আনন্দে ঘোড়ায় চেপে ঘুরেছিল।”
শুধু দু-বছর কেন?”
তারপর আমি লন্ডনে বদলি হয়ে যাই। ঘোড়াটাকে বিক্রি করে দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।”
তা তো বটেই!”
----------
বিশেষ দ্রষ্টব্য - গল্পটা আমার পুরোপুরি মনে নেই, তাই এদিক ওদিক বেশ কিছু গোঁজামিল দিয়েছি, তবে কাহিনি পালটাইনি, গ্যারান্টি।
----------
ছবি - স্যমন্তক চট্টোপাধ্যায়